#বিনিদ্র_রজনী
#পর্ব_১০
#মুমতাহিনা_তারিন
” আপনি এইখানে!”
গাঢ় কালো বর্ণের চোঁখের দিকে চেয়ে বললো তুলি । নিলয় হালকা হাসলো ,,, নিলয়কে হাসতে দেখে ব্রু কুচকে গেলো তুলির । নাকের ডগায় জমে থাকা ঘামগুলো উড়না দিয়ে মুছে বললো –
” আশ্চর্য হাসছেন কেনো আপনি? আমি কি মজা করেছি নাকি?”
নিলয় তুলির দিকে ঝুঁকে গিয়ে তুলির ব্রুর উপরে থাকা কাটা দাগটা পর্যবেক্ষণ করলো । আবার ঠোঁটে ফুটে উঠলো মুগ্ধ করা হাসি । সেদিক নজর দিলো না তুলি এই লোকের মতই গতি বুঝতে পারছে না সে । কালকে একটা অস্বস্তিকর মুহুর্ত আর আজকে হুট করে হাজির হয়ে যাওয়ার মানে কি?
” সর তো একটু ঘরে ঢুকি ”
তুলিকে এক সাইডে বোবা বানিয়ে রেখে ঘরে ঢুকে গেলো নিলয় । তুলি অবাকের উপর অবাক এই ছেলেকে না চেনে না কোনো কথা বললো । কমন সেন্স বলতে কিছু নেই নাকি ।
” আপনি তো অনেক অভদ্র কিছু না বলে,, ঘরে ঢুকে গেছেন বের হন ঘর থেকে”
তুলির এহেন কথা শুনে মজা পেলো নিলয় । ঘরের এক পাশে কম দামী সোফাটার উপর ধপ করে বসে পড়লো । তুলির মেজাজ এবার অনেক খারাপ হচ্ছে আঙুল নেড়ে কিছু বলতে যাবে তখন ভিতরের ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো শাপলা বেগম । বাইরের কথা অস্পষ্ট ভাবে কানে লেগেছিল তার তাই আর ঘরে থাকেনি।
” আরে ছোটন যে,, কালকে কত বললাম থেকে যা শুনলি না ”
” না কাকিমা সমস্যা নেই । তোমার মেয়ে আমাকে ঘর থেকে বের করেই দিচ্ছিল ভাগ্যিস তুমি এসেছো। ”
” কিরে তুলি তাই নাকি ! আরে ও তো তোর নিলয় ভাই । মনে নেই রেশমি কাকীর ছেলে যার সাথে সারাদিন ঘুর ঘুর করতিস ”
নিলয় নামটা শুনেই কেমন বিষাদ ছুঁয়ে গেলো মনে। তবুও অবাক লাগছে আজ কতবছর পর দেখা! অবশ্য চেহারা অনেক পাল্টে গেছে নিলয়ের। পরিচয় না দিলে তুলি ইহজনমে চিনতে পারত না তাকে । আবার খুব লজ্জা ও লাগছে সে কেমন ভাবে বের করে দিচ্ছিল ভেবেই মেকি হাসলো ।
” ভালো আছেন ভাইয়া?”
“আর ঢং করতে হবে না। বুঝতে পারছি আমাকে চিনি দিয়ে গুলাই খেয়ে ফেলেছিস সেই কবেই ”
” আরে না তুমি তো অনেক বদলে গেছো মুখে দাড়ি রেখেছো,কত লম্বা হয়েছো তোমাকে কিভাবে চিনবো বলো ”
” একবার আপনি একবার তুমি তুই কি কোনোদিন বদলাবি না!”
তাদের এই মিষ্টি কথোপকথন উপভোগ করছে শাপলা বেগম । মেয়েটা কতদিন পর একটু কারোর সাথে ঠিকভাবে কথা বলছে ভেবেই মনে প্রশান্তির বাতাস বয়ে গেলো শাপলার । এভাবেই তো দেখতে চেয়েছিলো তুলিকে হাসিখুশি থাকবে কিন্তু কি হলো!!
” তোরা বস আমি এখনি পিয়াজু বানিয়ে আনি ভালো লাগবে খেতে খেতে গল্পঃ করতে। ”
” জি কাকিমা অনেকদিন আপনার হাতের পীয়াজু খাওয়া হয় না”
নিলয় দের বাড়ি ছিল তুলিদের বাড়ি ঘেঁষেই । অবস্থাপন্ন ছিলো নিলয়রা । যখন তুলি হয়েছিল তখন নিলয়ের বয়স মাত্র তিন বছর….শাপলা বেগমের ঘর থেকে ভেসে আসা অদ্ভুত কান্নার আওয়াজ শুনে কেপে উঠেছিল নিলয় । মাটির ঘরের চারিপাশে মহিলারা ভিড় জমিয়েছিল । নিলয় রেশমীর শাড়ির কোনা ধরে ঘরে ঢুকে তোয়ালেতে মোড়ানো ছোট্ট শরীর ছুঁয়েছিল প্রথম । কি এক আলাদা অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিলো । চোখের পাতলা পাপড়ি মেলে এদিক সেদিক চোখ গোল গোল করে দেখছিল তুলি ।
তারপর কেটে গেলো কয়েক বছর ,,,,,,তুলি তখন ছয় বছরের নিলয় দুইমাত্র সঙ্গী তার । দুইমাত্র কেনো? নিলয়ের চাচার মেয়ে লামিয়ার সাথে তার অনেক খাতির । রাত নেই দিন নেই খেলা আর খেলা কিন্তু নিলয়ের বয়স তেরো বছর পড়াশোনা করতে হচ্ছে তাকে । সকালে স্কুল গিয়ে বিকেলে তুলির সাথে খেলা করে সময় কাটায় নিলয় । তুলির দুই চল মজা করে টেনে দেয় ..কান্নাকাটি করলে কত কিছু বলে যে তাকে থামাতে হয় ইয়াত্তা নেই ।
সব ঠিক চলছিল কিন্তু নিলয়ের বাবা হাসিবুর রহমানের বদলি হলো । থেকে যাওয়ার কোনো উপায় ছিল না তাই খুব দ্রুত চলে গেল তারা ।যাওয়ার আগে ছোট্ট তুলিকে লুকিয়ে রেখে যেতে হয়েছিল নইলে ওর চোখে পানি দেখে যেতে খুব কষ্ট হতো সবার। তারপর থেকে আর যোগাযোগ ছিল না তুলি দের সাথে নিলয়ের । সময় প্রবহমান কারোর জন্য সে থেমে থাকে না বছরের পর বছর ঘুরতে থাকলো আর সব স্মৃতি সময়ের অন্তরালে লুকিয়ে গেলো । কিন্তু এতবছর পর যখন তুলিকে দেখলো প্রথমে বিশ্বাস না হলেও খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হলো এইটাই তুলি সেই ভীতু তুলি ।
অবাক লাগছে নিলয়ের প্রাণোচ্ছল মেয়েটা কেমন ঝিমিয়ে গেছে । কত দুর্বিসহ ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে কে জানে ! কালকে সন্ধায় মালতী বেগম কল দিয়ে দেখা করতে বলেছিল সেই উদ্দেশ্য এসেছিল এইখানে পথিমধ্যে শাপলা বেগমের সাথে দেখা । এক প্রকার জোর করেই ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়েছিল শাপলা বেগম তখন গভীর ঘুমে নিমজ্জিত তুলি। সবকিছু খুলে বলেছিল শাপলা বেগম নিলয় শুধু বিস্মিত হচ্ছিলো শুনে । অতীত তো বদলানো সম্ভব না তাই নিলয়কে এসে তুলির সাথে গল্পঃ করার কথা বলেছে শাপলা বেগম বেশি সময় তো আর নেই ,,,,ডাক্তার স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছে তুলি হতাশায় ভুগছে তাকে হাসি খুশি রাখতে হবে ।আর বর্তমানের প্রেক্ষাপট অনুযায়ী নিলয় সবথেকে ভালো হবে তুলির জন্য ।
________________________
আদনান হন্যে হয়ে তুলিকে খুজে চলেছে । রিনাদের বাড়ি এসে অনেক অনুরোধ করেও কিছু জানতে পারেনি আদনান। ফারহান এর সাথে যেই বাজারে দেখা হয়েছিল সেটা কেন্দ্রীয় বাজার অনেক দুর থেকেও মানুষ আসে এইখানে । যেহুতু তুলি প্রেগনেন্ট তাই বেশিদূর থেকে হয়তো আসেনি আশেপাশে কোথাও হয়তো থাকছে তুলি। কিন্তু এক্সাক্ট লোকেশন খুজে বের করা সহজ না এই বাজারের চারপাশে আবাসিক ভরপুর । আর একা সব স্থানে। খোঁজা সম্ভব নয় তাই রোহান কে ধরে বেধে সাথে এনেছে আদনান । তিনটে বিল্ডিং খোঁজা শেষ ,,,,, কোথাও খুঁজে পেলো না তুলিকে আদনান আর রোহান । বিকেল হয়ে গিয়েছে সারা শরীর ঘেমে গেছে আদনানের । উজ্জ্বল বর্ণের মুখটা কেমন লাল হয়ে গেছে। রোহান বসে পানি খাচ্ছে সেও খুব ক্লান্ত । আদনান এর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে গলা টা পরিষ্কার করে নিল ।
” তুই কি জানিস সব অরোরা আর শিউলী মিলে করেছে?”
” শিউলি!! আমি জানতাম অরোরা করেছে সব ”
” তুই জেনেও কেনো তুলিকে বাচাস নি? তুই তো বিশ্বাস করতিস তুলি খারাপ কিছু করেনি তাহলে?”
রোহান এর কথাশুনে আদনানের মুখটা কালো হয়ে গেলো । পকেট থেকে টিস্যু বের করে কপালের ঘাম মুছে রাস্তার দিকে উদাস দৃষ্টিতে চাইলো সে ,,,
” আমি ভেবেছিলাম তুলি চলে গেলে আমি হয়তো ভালো থাকবো তুই তো জানিসই ওকে আমি মানতে পারছিলাম না এজ এ ওয়াইফ ”
” হুম ।আমার মনে হয় না তুলি তোর কাছে ফিরবে ”
” কেনো ফিরবে না আফটার অল আমি ওর হাজব্যান্ড আর ওর গর্ভে থাকা বাচ্চাটা ওর একার না আমারও ওর উপর সম্পূর্ণ অধিকার আছে আমার”
” তুই অন্তত অধিকারের কথা বলিস না । আচ্ছা এই যে দুটো বছর ও তোর পিছনে ঘুর ঘুর করলো তোর এত সেবা যত্ন করলো তুই তাকে কি অধিকার দিয়েছিলি? নিজের যা যা অধিকার ছিল সব তো সুদে আসলে উসুল করে নিয়েছিস ওকে কি দিয়েছিলি?”
আদনান কোনো উত্তর দিতে পারলনা । কী উত্তর দেবে সে?? সত্যি তো বলেছে রোহান ।
” কিরে কথা বলিস না কেনো? উত্তর নেই তাই তো । থাক সেসব কথা আজকে আর খোঁজা সম্ভব না পড়ে আবার আসলে হবে ”
” হুম ”
আসার সময় কোনো কথা বলেনি আদনান । নিজের কাছে নিজেকে ছোটো হয়ে গেছে আজকে তুলিকে ও কোনো অধিকার দেয় নি বিয়ের তিনদিন শুধু একটু হাত ধরার অনুমতি দিয়েছিল আদনান তারপর বদলি,,,,কত কি হয়ে গেল।
চলবে,,,,