#বিনিদ্র_রজনী
#পর্ব_১১
#মুমতাহিনা_তারিন
পাখিদের কলতানে ঘুম ভাঙলো তুলির । ফজরের নামাজ পড়ে বিছানায় শুইয়ে তসবিহ পড়ছিলো পড়তে পড়তে কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছে বুঝতে পারেনি । ধরণীতে ছড়িয়ে পড়েছে সূর্যের সোনালী আলো ,,,,যা গাছের ডাল পালা ভেদ করে জলার থায় গ্লাস ভেদ করে তীর্যক ভাবে ঘরে প্রবেশ করছে । হাতের তালুতে ভর দিয়ে বিছানা থেকে উঠে বসলো তুলি । ফুলে উঠা পেটের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘনশ্বাস ছাড়লো । ছোট ছোট কদম ফেলে এগিয়ে গেলো জানালার কাছে । জানালার নিচে লাগানো গাছগুলোতে একটা দুটো করে ভালোই ফুল ফুটেছে । জানালা খুলে দিল তুলি বাইরে থেকে আসা ঠান্ডা বাতাস সারা শরীরে kapiye দিলো । কি নির্মল বাতাস!
প্রায় পনেরো মিনিট যাবত জানালার কাছে দাড়িয়ে থাকলো তুলি । আলসেমি করলে হবে না বেলা তো কম হলো না ফ্রেশ হয়ে খেয়ে দেয়ে আবার স্কুলে যেতে হবে। ভারী শরীর নিয়ে ক্লাস নিতে কষ্ট হয় যদিও বসে থাকে তবু ছোটো ছেলে পেলের চিল্লাচিল্লিতে মাথা ব্যাথা শুরু হয় ।তাই আজকে গিয়ে হেড স্যারের সাথে কথা বলবে ভাবলো । আর তো বেশিদিন নেই ডেলিভারির আর স্কুল তো বেসরকারি সমস্যা হবে বলে মনে হয় না । এই দুটো মাস একান্ত ভেবে বিশ্রামের প্রয়োজন তুলির । নিজের সন্তানকে সারাটা সময় দেবে । মানুষের মৃত্যুর ঠিক নেই কত মানুষ বাচ্চা ডেলিভারি হওয়ার সময় মারা যায় । তাই এই দুইমাস সারা দিন ছোটো ছোট এবাদত করে কাটাবে ।সকাল সাতটা বেজে গিয়েছে নয়টা থেকে ক্লাস শুরু যেতে হয়তো দশমিনিট লাগবে কিন্তু গোছাতে হবে তো। তাই আর দেরি না করে ওয়াশরুমে ঢুকলো তুলি ,,,, ওয়াশরুমে লাগানো ছোটো আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে হাসলো তুলি । কেমন মোটা মোটা লাগছে তাকে ,,, মুখটাও উজ্জ্বল হয়ে গিয়েছে তার!
রান্নাঘরে শুকনো ঝাল আর জিরে নেড়ে নেড়ে ভেঁজে নিচ্ছে শাপলা বেগম । আজকে ঘন ডাল আর আলু ভর্তা রান্না হয়েছে তরকারী নেই ,,,,কিন্তু তুলিকে কিছু জানাননি শাপলা বেগম । যদি তরকারী শেষ হওয়ার কথা বলত তাহলে কালকে হয়তো ওই শরীর নিয়ে বাজার করতে ছুটতো । শাপলা বেগমের কোমরে ব্যাথা , আরো হাটাহাটি করে দেখে শুনে সবজি কেনা কাজটা কোনো কালেই শাপলা বেগম পারবে না । সবদিন তুলির আব্বু বাজার করে এনে দিয়েছে রান্না করছে এখন আর দেখে শুনে কিনতে পারে না । তুলিকে হাজার বারণ দিলেও সে শুনবে না সেটা শাপলা বেগম খুব ভালো করেই জানে ,,,যদি কিছু বলা হয় তাহলে ঐযে ডাক্তার বলেছে একটু হাটাহাটি করতে।
রান্না ঘরে প্রবেশ করতেই নাকে আসলো শুকনো ঝালের পোড়া গন্ধ । খুক খুক করে কেশে উঠলো তুলি । কাশীর শব্দ শুনে সম্বিত ফিরলো শাপলা বেগমের । জলদি করে গ্যাস টা অফ করে দিয়ে পিছে ঘুরল ।
” আম্মা তরকারী নেই একবারও তো বললে না । কালকে বললে এনে দিতাম ”
তুলির কথা শুনতে শুনতে আবার সামনে ঘুরল শাপলা বেগম । খুন্তি দিয়ে কড়াই থেকে শুকনো ঝাল আর জিরে গুলো ঢাকুনে রাখতে রাখতে বললো –
” আমি জানতাম,, তুই কোনো কথা শুনতে চাইতিস না ঠিক চলে যেতি তাই আর বলি নি । এই শরীর নিয়ে এত কাজ করা কি ঠিক?”
তুলি ধির পায়ে শাপলা বেগমের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো । ভাত হয়ে গেছে একটা প্লেট নিয়ে ভাত বাড়তে বাড়তে বললো –
” আম্মা একটা কথা বলি?”
” বল জিজ্ঞেস করার কি আছে? ”
শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট গুলো হালকা ভিজিয়ে নিল তুলি । কিছুটা ইতস্তত করে বললো –
” নিলয়কে ভাই কে তুমি আসতে বলেছিলে তাই না? কেনো আম্মা? সব কিছু জেনেও!”
শুকনো ঝাল জিরে আর ভাজা পেঁয়াজ গুলো পিষছিল শাপলা । তুলির কথা শুনে হাতটা থেমে গেলো ,,,মুখ থেকে হাসি হাসি ভাবটা উবে গেল মুহুর্তেই । কিছুক্ষণ চুপ থেকে সেদ্ধ আলু ঢাকুনে রাখতে রাখতে বললো –
” আমি যা করছি আর করবো সব তোর ভালোর জন্যই ,,,,”
” তাতো জানি আম্মা কিন্তু নিলয়ের সাথে কথা বললে দেখা সাক্ষাৎ করলে মানুষ কি বলবে !!! এমনি ও স্বামীর ঘরে জায়গা হয়নি বলে কম কথা শুনতে হচ্ছে না”
তুলির উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর। শাপলা বেগম হালকা হাসলেন মেয়ের কথা শুনে ,,আলু ভর্তা বানানো শেষ হাত টা ধুয়ে তুলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন ।
” বয়স তো কম হলো না ,,,এই সমাজকে আমার খুব চেনা আছে । মানুষের কথায় কান দিয়ে দরকার নেই এই দুটো মাস অন্তত হাসি খুশি থাক । নিলয়ের সাথে কথা বললে দেখবি ভাল লাগবে ,,,কতদিন এমন ঘরকুনো হয়ে পড়ে থাকবি আর? জীবনে তো সামনে এগিয়ে যেতে হবে ”
তুলি কিছু বললো না মাথা নাড়িয়ে শাই দিলো শাপলা বেগমের কথায় ।
_______________________
মালতী বেগমের সামনে আদনান দাড়িয়ে আছে । চোখেমুখে এক রাশ আশা নিয়ে মালতী বেগমের দিকে তাকিয়ে আছে সে ।
মালতী বেগমের সামনে ফোনে থাকা তুলির ছবি দেখাচ্ছে আদনান । খুব ভালো ভাবে ছবিটা পরখ করে দেখলেন মালতী বেগম । মুখে হতাশার একটা চাপ তুলে বললেন –
” না বাবা এই মেয়েকে তো কোথাও দেখি নি আর এইখানে থাকে ও না ”
কথাটা শুনে আদনানের সকল আশা মুহূর্তেই গুড়িয়ে গেলো মোটামুটি সব জায়গায় তুলিকে খোঁজা শেষ আদনানের । কোথায় গিয়েছে তুলি কে জানে ? আদেও কি তুলির সাথে আর কোনোদিন দেখা হবে কি না জানে না আদনান ,,,শুধু যাবে তুলিকে খুঁজতে হবে ।আদনান নিরাশ হয়ে দরজার কাছ থেকে বাইরে চলে আসলো ।
চোখের নিচে হালকা ভাবে ডার্ক সার্কেল পড়ে গেছে আদনানের । রাতে ঠিক মত ঘুম হয় না তুলির মুখটা অক্ষিপটে ভেসে উঠে কানে বাজে তার সুরেলা কণ্ঠস্বর । মাঝে মাঝে স্বপ্নে দেখা দেয় ছোটো একটা বাচ্চা যার আধো অধ বুলিতে বাবা ডাকটা খুব অস্পষ্ট ভাবে শুনতে পায় আদনান । চুলগুলো ও রুক্ষ হয়ে গিয়েছে ,শরীরটা শুকিয়ে গিয়েছে অনেকটা । প্রতিদিন অফিস শেষ করেই এলাকায় এসে খোঁজ নেয় আদনান । কিন্তু এখন কি করবে এইখানেও তো কোনো ধরেনের খোঁজ পেলো না তুলির ।
এইসব কথা ভাবতে ভাবতে আনমনে হাটছিল আদনান তখন কারোর সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল । আকস্মিক ধাক্কা খাওয়াই টাল সামলাতে পারছিল না আরো সকাল থেকে না খাওয়া ,,,,সামনের ব্যাক্তি তাকে ধরে ফেললো । আদনান সেই ব্যাক্তির দিকে চোখ ছোটো ছোট করে চাইলো ।
” আরে ভাই দেখে শুনে চলবেন না সামনেই তো রাস্তা ছিল এমন অন্যমনস্ক ভাবে হাঁটলে দুর্ঘটনা ঘটতে কতক্ষন”
আদনান সোজা হয়ে দাড়ালো । মলিন হাসি দিয়ে সামনে থাকা লোকটার কালো মার্বেলের মত চোখ গুলোর দিকে তাকিয়ে একটু মলিন হাসলো ।
” আসলে খেয়াল করি নি । আই অ্যাম রিয়েলি সরি”
“ইটস ওকে ,,বাসায় যেতে পারবেন তো? আমি গাড়িতে উঠিয়ে দেবো? ”
” তার দরকার নেই আমি গাড়ি এনেছি ধন্যবাদ ”
আদনান আর দাড়ালো না অনেক ক্ষন এসেছে এইখানে । বাসায় যেতে হবে ,,, আদনান নিজের বাড়িতে থাকে না এই প্রায় এক মাস । লিতুন বেগমের তুলির নামে বাজে কথা শুনতে একদম ভালো লাগে না তার তাই আপাতত রোহান দের বাসায় থাকছে।
____________________________
অরোরা নিজের ঘরের জানালার সামনে বসে আছে । বাইরের ব্যাস্ত শহর তাকে যেনো কোনোমতেই ছুঁয়ে যাচ্ছে না । এতদিন পর নিজের ভালোবাসাকে তুচ্ছ, মরীচিকা ছাড়া কিছুই মনে করতে পারে না সে । যদিও আদনানের সাথে সম্পর্ক আগের মতই আছে কিন্ত এই সম্পর্কের মাঝে একটা কিন্তু রয়ে গিয়েছে । সেই কিন্তু টার উত্তর জানা নেই অরোরার । যাকে ভালো রাখতে সে বিশ্বাসঘাতক হলো তার জন্য সেই মানুষটা কষ্টে আছে । সে শুধু মাত্র থার্ড পারসন হয়ে থেকে গেলো,, আর নিজের কাছে সব চেয়ে নিকৃষ্ট মানুষ । ভালোবাসায় একেবারে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল অরোরা তাই তো ওই নিষ্পাপ বাচ্চাটার কথা একবার ভাবতে পারেনি । ক্ষণে ক্ষণে নিজে পুড়ে হচ্ছে অরোরা কত বড় পাপ করে ফেললো সে !!! নিজেও খোঁজ চালাচ্ছে তুলির ,,একবার তুলির কাছে মাফ চাইবে অরোরা এই আত্মগ্লানি নিয়ে বেঁচে থাকা আর সম্ভব হচ্ছে না তার পক্ষে ।
অন্যদিকে শিউলী আজকে ডক্টর এর কাছে তৃতীয় বারের মত হাজির হয়েছে । অনেক চেষ্টা করেও বাচ্চা কনসিভ করতে পারছে না সে । ডাক্তার গত দুইবার এক কথাই বলছে কোনো সমস্যা নেই কারোর ,,না শিউলির আর না রোহান এর কিন্তু তাও হচ্ছে না যখন আরেকটু ট্রাই করতে । বাচ্চা হাওয়া না হাওয়া আল্লাহর কাছে আল্লাহ যখন চাইবে তখন দেবে কিন্তু কোনোভাবেই শিউলী নিজেকে শান্ত রাখতে পারছে না । মনের মধ্যে থাকা শঙ্কা বার বার তাকে তার অপরাধটা স্মরণ করাচ্ছে । মাঝে মাঝে তার মনে হয় তুলি তাকে দেখসি আর উচ্চস্বরে হেসে চলেছে বিভিন্ন ভাবে উপহাস করছে তাকে নিয়ে । রাত বেরাত কেঁদে উঠে শিউলী ,,,রোহান বোঝাতে বোঝাতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে । শিউলির অবস্থা দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে । কি হবে সামনে কে জানে?
_____________________
ইংরেজি ক্লাসটা নিয়ে অফিস রুমে বসে ছিল তুলি । হঠাৎ করেই তার শরীর খারাপ লাগছে । সব শিক্ষকরা তখন চা নিয়ে আড্ডা দিচ্ছিল তুলির অস্বস্তি বুঝতে পেরে সবাই তাকে বাড়ি চলে যেতে বলেছে । তুলি আর কথা বাড়ায়নি তার প্রচণ্ড খারাপ লাগছে আজকে । রমলা ম্যাডাম গাড়িতে উঠিয়ে দেওয়ার জন্য রাস্তায় আসতেই নিলয়ের সাথে দেখা হলো । তুলির অবস্থা বুঝতে পেরে এগিয়ে এলো নিলয় …
” তুলি কি হয়েছে খারাপ লাগছে ?? ডক্টর এর কাছে যাবি?”
” আপনি তুলির পরিচিত?”
” হ্যাঁ কি হয়েছে ওর ? ”
” শরীর খারাপ লাগছে তাই বাসায় পাঠানোর জন্য গাড়ি খুঁজতে এশেছিলাম আপনি যখন ওর পরিচিত ওকে বাসায় পৌঁছে দিবেন”
” হ্যাঁ অবশ্যয় ”
নিলয় আর সেখানে না দাড়িয়ে সামনে গিয়ে একটা রিকশা ডেকে নিয়ে আসলো । তুলির হাতটা শক্ত করে ধরে রিক্সায় তুলে নিলো ।
চলবে,,,