বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব-২৮+২৯+৩০

0
453

#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_২৮
জাওয়াদ জামী

কায়েসের অপারেশন চলছে। বাইরে কুহু, আফরোজা আর তাহমিনা অস্থিরভাবে পায়চারি করছে। তাহমিদ ওটির ভেতরে আছে।
আফরোজা নাজনীন একমনে আল্লাহকে ডাকছেন।
কুহু স্থির হতে পারছেনা। চিন্তায় ওর হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। অনবরত দোয়া ইউনুস পাঠ করছে। তাহমিনা আক্তার কুহুর কাছাকাছি থাকছেন।
” কুহু মা, এত টেনশন করিসনা। দেখবি তোর বাবা ঠিক সুস্থ হয়ে উঠবে। তুই একটি বস তো। এভাবে অস্থির হলে, তোর একটা কিছু হয়ে যাবে। তুই এই চেয়ারটায় বস। ”
” আন্টি আমার কিছুই ভালো লাগছেনা। কেমন যেন পা’গ’ল পা’গ’ল লাগছে। ”
” এভাবে বলিসনা, মা। তু… ” তাহমিনা আক্তার কথা শেষ করতে পারলেননা। এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে সেখানে আসেন শাহনাজ সুলতানা। আনান পরিক্ষা শেষ করে বাসায় যাওয়া মাত্রই তিনি মেডিকেলের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন।
ফুপুকে দেখেই কুহুর ঠোঁট ভেঙে কান্না শুরু করে। তিনিও পরম মমতায় কুহুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন। কারো মুখে কোন কথা নেই। সবারই চোখ অপারেশন থিয়েটারের দরজার দিকে।

দীর্ঘ তিন ঘন্টা পর অপারেশন শেষ হয়। ডক্টর কায়েকসে নিবিড় পর্যবেক্ষনে রেখেছেন। চব্বিশ ঘণ্টা পর তাকে কেবিনে শিফট করা হবে। কায়েসের জন্য নির্ধারিত কেবিনে সবাই উৎকন্ঠা নিয়ে বসে আছে। নাজমা পারভিনও একটু আগেই এসেছেন। তিনি একজন মহিলাকে নিযুক্ত করেছেন, তার শ্বশুরকে দেখার জন্য। তিন দিনের জন্য শ্বশুরের দ্বায়িত্ব তার কাছে দিয়েই তবে তিনি ঢাকায় এসেছেন। তিন বোন মিলে এই কাঁদছেন, তো এই হা হুতাশ করছেন। আবার মাঝে মাঝে কুহুকে শান্তনা দিচ্ছেন, আদর করছেন। দুপুর গড়িয়ে শেষ বিকেলের প্রহর এসেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ কিচ্ছুটি মুখে তোলেননি। তাহমিনা আক্তার বাসা থেকে খাবার এনেছেন, কিন্তু কেউই সেই খাবারে হাত দেয়নি। তিনি অনেকে সেঁধেও কাউকে খাওয়াতে পারেননি। অগত্যা নিরুপায় হয়ে বসে বসে তিন বোনের কান্না দেখছেন।
রাতে তারা তিন বোন মেডিকেলে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগেই তাহমিনা বাসায় ফিরে গেছেন। অসুস্থ শ্বাশুড়িকে রেখে তিনি আর মেডিকেলে থাকার সাহস করেননি। আবার বাসায় গিয়েই রাতের খাবার করতে হবে। এখানে পাঠাতে হবে। তিনি বাসায় গিয়ে রান্না করেই ড্রাইভারকে দিয়ে পাঠিয়েছেন। তাহমিদ সেই গাড়িতেই বাসায় ফিরবে। তাই আফরোজা নাজনীন কুহুকে বললেন, তাহমিদের সাথে বাসায় যেতে। তারা তিনবোন এদিকটা সামলে নিবেন। কুহুও আর দ্বিরুক্তি না করে তাহমিদের সাথে বেরিয়ে আসে।
মেডিকেল থেকে বাসার দূরত্ব এক ঘন্টা। কুহু গাড়িতে উঠে বসতেই, তাহমিদ ওকে সিট বেল্ট বাঁধতে বলে। কিন্তু কুহুর আজ তাহমিদের কাছে শোনার মুড নেই। তাই শুনেও না শোনার ভান করে বসে থাকে। এদিকে গাড়ি চলতে শুরু করেছে। তাহমিদ দেখল কুহু সিট বেল্ট বাঁধেনি, তাই বাধ্য হয়েই ও সিট বেল্ট বাঁধতে গেলেই কুহু অসম্মতি জানায়।
” ধন্যবাদ, আমি এভাবেই যেতে পারব। ”
” সাধে তো আর তোমাকে ত্যা’ড়া বলিনা। এই মেয়ে যার কপালে জুটবে, তার জীবনটা তেজপাতা করে ছাড়বে। সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি।
হয় নিজে বেল্ট বাঁধবে, নয়ত আমি বেঁধে দিব। কথা ক্লিয়ার? আমি এক থেকে তিন পর্যন্ত গুণব, এর মধ্যে বেল্ট না বাঁধলে আমার জন্যই সুবিধা। ” তাহমিদ গুণতে শুরু করার আগেই কুহু ঝটপট বেল্ট বেঁধে নেয়। ও মোটেও চায়না তাহমিদ সিট বেল্ট বেঁধে দিক।

কিছুদূর আসতেই তাহমিদ ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলে। ড্রাইভার গাড়ি থামালে তাহমিদ নেমে কোথাও যায়। অনেকক্ষণ পর
পর দু হাতে কয়েকটা পলিব্যাগ আর শপিংব্যাগ ঝুলিয়ে আসে। দেখে বোঝাই যাচ্ছিল, ব্যাগগুলোতে কিছু আছে। একটা ব্যাগ ড্রাইভারকে দিয়ে, পেছনে কুহুর পাশে এসে বসে।
গাড়ি চলতে শুরু করলে, তাহমিদ একটা ব্যাগ থেকে কয়েকটা চকলেট আর চিপস বের করে কুহুকে দেয়। আরেকটা শপিংব্যাগ ধরিয়ে দেয় কুহুর কাছে।
” কি আছে এতে? আর আমাকে দিচ্ছেন কেন? ”
” বাসায় যেয়ে দেখ, কি আছে। কিন্তু দয়া করে সিক্তাকে দেখিওনা। ওর জন্যও একটা ব্যাগ আছে । ”
” কিন্তু আমি এটা নিতে পারবনা। আপনি বরং এগুলো সিক্তাকেই দিন। ”
” এমনিতেই তো আর ত্যা’ড়া বলিনা! তুমি কি বাচ্চা? কিছুই বোঝনা? অবশ্য যে বুঝেও না বোঝার ভান করে, তাকে কিছুতেই বোঝানো যায়না। বাই দ্য ওয়ে, তোমার নিতে ইচ্ছে না করলে ফেলে দিও। কিন্তু এখনতো চিপস, চকলেট খাও। এগুলো অনন্ত ফেলোনা। ”
কুহু ঠোঁট টিপে হাসে। ও ইদানীং লক্ষ্য করেছে এই মানুষটাকে রাগাতে বেশ লাগে। সে রেগে গেলে কপালের মাঝখানের নীলচে দুইটা শিরা ফুলে উঠে। যা দেখতে কুহুর কাছে আকর্ষনীয় লাগে।
কুহু আনমনে চিপসের প্যাকেট খুলে চিপস মুখে পুরতে থাকে।
” এই মেয়ে দেখছি, মিনিমাম ফর্মালিটিও জানেনা! পাশে কেউ বসে থাকলে তাকেও যে অফার করতে হয়, এটাও কি শিখিয়ে দিতে হয়! ” কুহুর ফর্মালিটির আশায় না থেকে তাহমিদ প্যাকেট থেকে কয়েকটা চিপস নিয়ে খেতে শুরু করে।
” আমার সাথে আপনার কি শ’ত্রু’তা, আমি ভেবে পাইনা! আমার জন্য এসব আনতে পারলে, নিজের জন্য নিতে দোষ কোথায়! এভাবে অন্যের থেকে কিছু নেয়া মোটেও ঠিক নয়। ” কুহু পানসে মুখে জবাব দেয়।
” প্রথমত, তোমার সাথে আমার কোন শ’ত্রু’তা নেই। শ’ত্রু’তা তোমার চালচলন, আচার আচরণের সাথে। দ্বিতীয়ত, আমি মোটেও অন্যের কাছ থেকে কিছুই নিচ্ছিনা। নিচ্ছি নিজের মানুষের কাছে থেকে। যে আমার একান্ত আপনজন। তার ওপর আমার ষোলআনা অধিকার আছে। অবশ্য এসব তোমাকে বলে লাভ নেই। তোমার গো’ব’র ভর্তি মাথায় এসব ঢুকবেনা। ”
” আমার ঠ্যাকা পরেনি, আপনার এসব ফালতু কথা বোঝার। আপনার কথা আপনিই বুঝে, গিলে খান। ”
” শোন মেয়ে, বেশি কথা বলোনা। আজকাল একটু বেশিই কথার তুবড়ি ছুটছে তোমার মুখে৷ আমি কিছু বলছিনা মানে এই নয়, যে ভবিষ্যতেও কিছু বলবনা। এটা বেশ বুঝতে পারছি, ভবিষ্যতে কঠিন শা’স্তি তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। ”
” আপনি আমাকে শা’স্তি দিবেন! আপনি শা’স্তি দেয়ার কে! আমার মুখ আর আমিই কিছু বলতে পারবনা! কত খা’রা’প মানুষ চিন্তা করা যায়! ”
” না, তুমি কিছুই বলতে পারবেনা। আর আমি কে, এটা কিছুদিন পরই বুঝতে পারবে। তবে আই সয়্যার, তোমাকে শা’স্তি দিতে আমার মোটেও খা’রা’প লাগবেনা। আমি আবার খা’রা’প মানুষ কিনা। তাই প্রতিদিনই চাইব তুমি অ’প’রা’ধ কর, আর আমি শা’স্তি দিব। ” তাহমিদের কথা শুনে কুহুর একটা শিরশিরে অনুভূতি বুকের মাঝে উথালপাতাল করছে। এই ছেলে এমনভাবে কথা বলে কেন! একটুও লজ্জাশরমের বালাই নেই।
দুজনের খুনসুটির মাঝেই গাড়ি এসে দাঁড়ায় ‘কুঞ্জছায়া’র গেইটে। তাহমিদ গাড়ি থেকে নেমে, দরজা খুলে দেয়। কুহু বের হয়ে আসলে ওর হাতে শপিংব্যাগ ধরিয়ে দেয়।
কুহু হাঁটতে শুরু করলে, তাহমিদ জোড় কদমে ওর পাশে আসে।
” রাত দশটার পর একবার ছাদে এসো। আমি অপেক্ষা করব। তবে তার আগে দেখবা ব্যাগে কি আছে। ”
” পারবনা। ” কুহুর সোজা উত্তর।
” অলরাইট, আমি কাউকে জানাতে চাচ্ছিলামনা। কিন্তু তুমিই সবাইকে জানানোর জন্য উৎসাহিত করলে। এরপর আমি তোমাকে ধরে বেঁধে ছাদে নিয়ে গেলে, পরে আমাকে দোষ দিতে পারবেনা। ”
কয়েকধাপে তাহমিদ পৌঁছে গেছে মেইন গেইটে। কলিংবেলে চাপ অপেক্ষা করছে গেইট খোলার।

তাহমিনা আক্তার ওদের জন্য টেবিলে খাবার সাজিয়ে অপেক্ষা করছেন। আয়েশা সালেহা আগেই খেয়ে শুয়ে পরেছেন। তার শরীরটা কয়েকদিন থেকে ভালো যাচ্ছেনা। কুহু মেডিকেল থেকে এসে গোসল সেরে একটু বসেছে। শরীরটা বেশ ক্লান্ত।
তাহমিদ গোসল সেরে নিচে এসে দেখল কেউ আসেনি খেতে। তাই ও নিচ থেকেই সিক্তার নাম ধরে ডাকতে শুরু করে। ভাইয়ের ডাক শুনে সিক্তা আর কুহু নিচে আসে।
ওদের তিনজনের খাওয়া হলে তাহমিনা আক্তার খেয়ে নেন। এরপর যে যার রুমে আসে। তবে কুহু দিদুনের কাছে যায়। ও দিদুনের কাছেই ঘুমাবে। সিক্তা চাচ্ছিল কুহু তার সাথে ঘুমাক। কিন্তু কুহু বলেছে দিদুন অসুস্থ তাই তার কাছেই থাকবে। বাধ্য হয়ে সিক্তা রাজি হয়।

রাত দশটা বেজে ত্রিশ। তাহমিদ ছাদে কুহুর জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু কুহুর আসার কোন নামই নেই। অথচ একবারের জন্যও তাহমিদ ধৈর্য্য হারায়না। সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়।

কুহু শপিংব্যাগ নিজের কাছেই রেখেছে। খেয়ে এসে শুয়েছে ঠিকই, কিন্তু ওর ঘুম আসছেনা। আবছা আলোয় ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখল সাড়ে দশটা বাজে।
” তাহমিদ ভাইয়া, কি আমার জন্য ছাদে অপেক্ষা করছে! এতরাতে ছাদে যাওয়া কি ঠিক হবে? ” নিজেই নিজেকে সুধায়। কিন্তু উত্তর না পেয়ে উঠে বসে। খানিক পর শপিং ব্যাগ হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। কোনায় থাকা চেয়ারের দিকে এগিয়ে যায়। চেয়ারটা আলোর দিকে টেনে নিয়ে বসে পরে। শপিংব্যাগের মুখ ফাঁকা করে দেখার চেষ্টা করে৷ এরপর হাত গলিয়ে দেয় ব্যাগের ভেতর। হাতে উঠে আসে আরেকটা ছোট ব্যাগ। সেটা খুলে দেখল কালো কাঁচের চুরি, আবার ভেতরে হাতে দিলে পায় একটা কালো হিজাব, দুইটা থ্রিপিস, এরপর একে একে আলতা, কালো টিপ, আর বেলি ফুলের মালা পায়। আর সবশেষে পায় একটা চিরকুট। সেখানে লিখা আছে,
” আমার শ্যামাঙ্গীনিকে যেকোন সাজেই মায়াবতী লাগে। আমার বহুদিনের সাধ শ্যামাঙ্গীনিকে একবার খোঁপায় বেলিফুলের মালা, কপালে কালো টিপ, হাতে কাঁচের চুরি আর আলতা রাঙ্গা পায়ে দেখি। তার পরনে থাকবে কালো জামদানী শাড়ি। কিন্তু আজ তাড়াহুড়োয় শাড়ি কিনতে পারিনি। এজন্য আমি অতিব দুঃখ প্রকাশ করছি।
আমার শ্যামাঙ্গীনি কি আজকে আমার সাধ পূরন করবে? তবে কথা দিচ্ছি, একদিন আমার আলমারি ভর্তি কালো জামদানী থাকবে। যেগুলোর মালকিন থাকবে একমাত্র আমার শ্যামাঙ্গীনি। ”
চিরকুটটা পড়ে কুহুর হাত-পা কাঁপছে। এসব কি লিখেছে মানুষটা! এতই যদি ভালোবাসা তবে সেদিন কেন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল? তবে নানান ঘাত-প্রতিঘাতের পর এবার ও একটু প্রশান্তি চায়। চায় একজন যত্নবান পুরুষ। যে পুরুষের ছায়ায় সে নিরাপদে থাকবে। যে পুরুষের মাঝে নিজেকে হারাবে। যার ভালোবাসায় পূর্ণ হবে। সেই ছায়া সে তাহমিদের মাঝে দেখেছে। দেখেছে একজন পুুরুষ কতটা দ্বায়িত্ববান হতে পারে। অন্যের বিপদে কিভাবে ঝাঁপিয়ে পরতে পারে। সকলকে আপন করে নেয়ার ক্ষমতা যার মধ্যে বিরাজমান। কিন্তু আজ রাতে কি করবে কুহু? নানান চিন্তায় দোদুল্যমান কুহুর মন। মন এবং মস্তিষ্কের স্নায়ুযুদ্ধ চলে অনেকসময়। শেষে জয়ী হয় মন। কিন্তু কুহু এখনই ধরা দিতে নারাজ।

তাহমিদ ধৈর্য্য নিয়ে ছাদের রেলিং ধরে অপেক্ষা করছে। রাত এগারোটা ছুঁইছুঁই। কুহু এখনো আসেনি। এই অপেক্ষা মন্দ লাগছেনা। বরং এই অপেক্ষা ওর কাছে মধুর মনে হচ্ছে।
হঠাৎ করেই তাহমিদ ওর চারপাশে একটা মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছে। পেছনে না তাকিয়েই বুঝতে পারে গন্ধের উৎপত্তি। ওর ঠোঁটের কোন প্রসারিত হয়।
মন বলে উঠে, ” সে এসেছে। তোর শ্যামাঙ্গীনি এসেছে। এবার ওকে বলে দে মনের ভেতর যা কিছু আছে। ”
” অনেকসময় ধরে অপেক্ষা করছি। বড্ড য’ন্ত্র’ণা দাও তুমি। অপেক্ষার প্রহর যে কত কঠিন, তা যদি তুমি জানতে। ” পেছনে না ফিরেই বলে তাহমিদ।
কুহু তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে রয়। পেছনে না তাকিয়েই কিভাবে বুঝল আমি এসেছি!

চলবে..

#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_২৯
জাওয়াদ জামী

” দেখুন আমি চাইনা আপনি কোন সিনক্রিয়েট করুন। তাই এতরাতে ছাদে এসেছি। কি বলবেন জলদি বলে ফেলুন। এমনিতেই আমার মন মানসিকতা ভালো নেই। ”
” আমি জানি তোমার মন ভালো নেই। কোন মেয়ে তার বাবার এমন পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক থাকতে পারেনা। এমনকি আমি এটাও জানি, আমার আবদারটাও অন্যায়। একটা মেয়ের এমন অবস্থায় তার সাথে নির্জনে কথা বলা খুব ভালো দেখায়না। কিন্তু আমি নিরুপায়। আজ তোমার সাথে আলাদাভাবে কথা না বললেই হতনা। ”
” কি এমন কথা আছে, যার জন্য আপনি এত অধৈর্য্য হয়ে গেছেন? আর এমনিতেও আমি জানি, আপনি যতসব ফা’ল’তু কথা বলতেই আমাকে এখানে ডেকেছেন। ”
” আমি ফা’ল’তু কথা বলতে তোমাকে এখানে ডেকেছি! আরে, তোমার বিয়ের আলোচনা করছিল শাহনাজ আন্টি। সেই কথা শুনেই মনে মনে হচ্ছিল আমি পা’গ’ল হয়ে যাব। আর তুমি বলছ আমি ফালতু কথা বলতে ডেকেছি? ”
” আমার বিয়ের বিষয়ে আলোচনা হচ্ছিল! এসব কি বলছেন আপনি? ”
” হুম, শাহনাজ আন্টির কোন এক প্রতিবেশি তার ছেলের জন্য তোমাকে পছন্দ করেছে। সেই কথাই তিনি বড়মার সাথে আলোচনা করছিলেন।সব শুনে মনে হল, বড়মারও এতে সায় আছে। তবে তিনি আগে তোমার সাথে দেখা বলতে চান। যখন আমি সেকথা শুনলাম, তখন মনে হলো আজ তোমার সাথে কথা না বললেই নয়। এবার বলো আমার কি খুব বেশি অন্যায় হয়েছে? ”
নিজের বিয়ের কথা শুনে কুহুর বুকের ভিতর ধুকপুক করছে।
” আচ্ছা, আমি এখন আসছি। আর কখনোই এভাবে রাত-বিরেতে আমাকে ডাকবেননা। কেউ জানলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। ” কথাগুলো বলেই কুহু তড়িঘড়ি করে ছাদ থেকে নিচে আসে।
আর তাহমিদ বিমর্ষচিত্তে তাকিয়ে থাকে কুহুর যাওয়ার দিকে। ওর একটা কথাই মনে হচ্ছে, কুহু এভাবে না গেলেও পারত। পাঁচটা মিনিটও কি ওকে দেয়ার মত সময় ছিলনা কুহুর কাছে? সেই দিনের সেই অন্যায়ের জন্য আর কতদিন এভাবে তড়পাতে হবে? ওর অন্যায়ের কোন ক্ষমা কুহুর ঝুলিতে কি নেই?
” আচ্ছা, আমি কি কুহুর কাছে নিজেকে খুব সস্তাভাবে উপস্থাপন করছি? যে কারনে কুহু আজও সেই ভুলের জন্য আমাকে ক্ষমা করতে চাইছেনা। তাকে ভালোবাসি জন্যই কারনে-অকারনে তার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে। তার আশেপাশে ছায়া হয়ে থাকতে সাধ হয়। কিন্তু আমার ভালোবাসাকে ও কি তুচ্ছ ভাবছে? যদি তাই হয়, তবে নিজেকে আর সস্তা হতে দিবনা। ওকে সারাজীবন ভালোবেসে যাব, কিন্তু ওর কাছে আর নিজেকে ছোট করবনা। ওকে আগে বুঝতে হবে আমার ভালোবাসার গভীরতা। ” হাসনাহেনা গাছের নিচে সটান হয়ে শুয়ে, অন্তরীক্ষের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলেছে তাহমিদ।
আজ নিজেকে বড্ড অযোগ্য মনে হচ্ছে। সেদিন সেই ভুলটা না করলে, কুহু তার একান্তই নিজের হয়ে যেত। ওকে হারানোর কোন ভয় থেকে থেকে মনে উঁকি দিতনা। এখন বুঝতে পারছে, সময় থাকতে যার মূল্য দেয়নি, আজ সেই মূল্যহীন মেয়েই অমূল্য সম্পদ রুপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে তাহমিদের হৃদ মাজারে।

কুহু দিদুনের রুমে এসে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। ফুপু যদি ওর জন্য কাউকে পছন্দ করে, তবে সে কিছুতেই না করতে পারবেনা। কুহু চায়না ফুপুরা ওর জন্য কোন কষ্ট পাক। যে ফুপুদের কারনে আজ ও এ পর্যন্ত আসতে পেরেছে, সেই ফুপুদের কথা কখনোই অমান্য করতে পারবেনা। সেই সাহসও কুহুর নেই। যে ফুপুদের কথার অবাধ্য ও কখনোই হয়নি আর আজও হবেনা। আনমনে কখন যে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে তা সে বুঝতেই পারেনি। বারান্দার গ্রীল ভেদ করে চাঁদের আলো বারান্দায় এসে পরছে। ভরা পূর্নিমায় চাঁদের আলো তার জৌলুস ছড়াচ্ছে। ধরনীর বুকে তার হৃদয় নিং’ড়া’নো সৌন্দর্য ছড়িয়ে দিয়ে গর্বে বিচরণ করেছে বিশ্বব্রহ্মান্ডে। কিন্তু গৌরবে গরবিনী চাঁদের আলোর কারসাজি উপভোগ করার মত মন এখন কুহুর নেই। ওর মনে এখন বিরাজ করছে বি’ষা’দে’র কালো ছায়া। যে ছায়াতলে ঢাকা পরে যায় তাহমিদ নামক একজন পুরুষের ভালোবাসা। যে ভালোবাসার উর্ধ্বে ঠাঁই পায় ফুপু নামক মমতাময়ীদের স্নেহ, ভালোবাসা।

একই বাড়িতে দুজন মানব-মানবী সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে দেয়। একজন নিজেকে বদলানোর প্রত্যয় নিয়েছে, তো আরেকজন বিসর্জন দিয়েছে তার প্রেমিক পুরুষের ভালোবাসা।

পরদিন সকালে কুহু আসে তাহমিদের রুমে। তাহমিদ কিছুক্ষণ আগে রুমে এসেছে। ওর হাতে গতকালের তাহমিদের দেয়া শপিংব্যাগ। কুহু এর আগে কখনো তাহমিদের রুমে আসেনি, তাই ও বেশ অপ্রস্তুত বোধ করছে। কুহুকে দেখে তাহমিদ ভুরু কুঁচকে তাকায়।
” এই নিন আপনার জিনিস। আশা করব ভবিষ্যতে এমন কাজ আর করবেননা। আমার জন্য ফুপুদের সম্মান ক্ষুণ্ণ হোক তা আমি চাইনা। আশা করি কথাটা মনে রাখবেন। ”
তাহমিদ কিছু না বলে হাত বাড়িয়ে শপিংব্যাগ নেয়। কুহুর কথার কোন প্রত্যুত্তর করেনা।
কুহু শপিংব্যাগ তাহমিদকে দিয়ে সোজা বেরিয়ে আসে রুম থেকে।
তাহমিদ বিষন্ন হেসে শপিংব্যাগ রেখে দেয় আলমারিতে।
” আমার ভাগ্যের লিখন যদি তুমি হও, তবে তোমাকে আমার হতে কেউই রুখতে পারবেনা। নিয়তি যেদিন চাইবে, সেদিনই তোমার-আমার সম্পর্ক পরিণতি পাবে। আর সেদিন তুমি আজকের এই আচরণের জন্য লজ্জা পাবে। তবে আজকের মত সেদিনও তোমার ওপর কোন অভিযোগ আমি রাখবনা। কে’লে’ঙ্কা’রি’র ভয়ে তুমি সত্যিকারের ভালোবাসা পায়ে ঠেলে দিলে। কিন্তু একবারও জানলেনা, প্রয়োজনে তোমার সব ক’ল’ঙ্ক আমি বুকে তুলে নিতাম। কোন ক’ল’ঙ্ক তোমাকে ছুঁতেও পারতনা। তোমার একবিন্দু সুখের জন্য আমি ক’ল’ঙ্কে’র সাগরে ডুব দিতাম। কিন্তু আফসোস তুমি আমার ভালোবাসা বুঝলেনা। ”

ডাইনিং টেবিলে সবাই একসাথে বসে খাচ্ছে। কুহু কোনদিকে না তাকিয়েই একমনে খাচ্ছে। তাহমিদ একবার আড়চোখে কুহুর দিকে তাকিয়ে খাওয়ায় মন দেয়। কারো মুখে কোন কথা নেই। ডাইনিং রুমে সুনশান নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। ওদের এই নিস্তব্ধতা দেখে তাহমিনা আক্তারের মনে কু ডাকছে। কি চলছে দুজনের মধ্যে তা তিনি বুঝতে পারছেননা।
” তাহমিদ, তোর কি সকালে ক্লাস আছে? যদি ক্লাস থাকে মেডিকেলে যাবার সময় কুহুকেও নিয়ে যাস। ”
” ওকে মা। তুমি ওকে তৈরি হতে বলো। আমি আধাঘন্টা পরই বের হব। ”
তাহমিদের কথা শুনে তাহমিনা আক্তার নিশ্চিত হয়ে যান, দুজনের মধ্যে কিছু একটা ঘটেছে।

খাবার পর কুহু তৈরি হয়ে ড্রয়িংরুমে আসে। তাহমিনা আক্তার সেখানে কিছু একটা করছিলেন।
” কুহু মা, কি হয়েছে তোদের? আমার ছেলেটা এমন চুপচাপ হয়ে আছে কেন? শোন মা, মনে কোন প্রশ্নের উদয় হলে কিংবা কোন সমস্যা সৃষ্টি হলে, মিলেমিশে সমাধানের চেষ্টা করবি। তোর যথেষ্ট বয়স হয়েছে, আশা করি এর থেকে বেশি কিছু বলার দরকার হবেনা। ”
তাহমিনা আক্তারের কথায় কুহু কোন জবাব না দিয়ে শুধু মাথা নাড়ায়।
এমন সময় তাহমিদ তৈরি হয়ে ড্রয়িংরুমে আসে।
” মা, আমি বেরোলাম। ও যদি আসে, তবে আসতে বলো। ” তাহমিদ কথাটা বলেই বেরিয়ে আসে।
কুহুও তাহমিদের পিছু পিছু আসে।
ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে ওদের অপেক্ষা করছে।
তাহমিদ সোজা যেয়ে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে। এতে কুহুর কোন হেলদোল নেই। সে গিয়ে পেছনে বসে।

কুহুকে ওর বাবার কাছে পৌঁছে দিয়ে তাহমিদ ক্লাস করতে যায়। এরমধ্যে একটিবারও না কুহুর দিকে তাকিয়েছে, আর না কুহুর সাথে কথা বলেছে।
কুহু কেবিনে এসে দেখল কেবিনে শুধু ওর মেজো ফুপু বসে আছে। ফুপুকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে, বড় ফুপু ডক্টরের সাথে কথা বলছে, আর ছোট ফুপু বাবার কাছে গেছে। কুহু ফুপুকে বলে বাবাকে দেখতে যায়।

কাঁচের দরজা মধ্যে দিয়ে কুহু বাবার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। ওর চোখের কোনে পানি জমেছে। ও কি কখনো ভেবেছিল বাবার এমন কিছু হবে! আবার সবকিছু ভুলে যখন একজনের ওপর মায়া জন্মাল, ঠিক তখনই জানতে পারল, ফুপুরা ওর বিয়ের কথা ভাবছে। জীবন ওকে যে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, তা বোধগম্য নয় কুহুর৷ ও শুধু জীবনটাকে নিজস্ব গতিতে চলতে দিয়েছে। দেখা যাক কোন ঘাটে এসে এই চলার সমাপ্তি ঘটে।

আফরোজা নাজনীন কেবিনে এসে জানায় সন্ধ্যায় কায়েসকে কেবিনে শিফট করবে। গতকালকের থেকে তার শারীরিক অবস্থা আজকে খানিকটা উন্নতি হয়েছে। একথা শোনার পর ওরা সবাই স্বস্তি পায়।
কুহু বাবার কথা শোনার পরপরই কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। ক্লাস শেষে মেডিকেলে ডখন পৌঁছায় তখন দুপুর দুইটা বেজে গেছে।
এরমধ্যে আফরোজা নাজনীন বাসায় গিয়েছিলেন। তিনি দুই ঘন্টা বাসায় কাটিয়ে, বোনদের এবং কুহুর জন্য খাবার নিয়ে মেডিকেল আসেন।

খাবার পর যখন সবাই একসাথে টুকটাক কথা বলছিলেন, তখনই হন্তদন্ত হয়ে কেবিনে প্রবেশ করে শিউলি আক্তার। তার সাথে শিহাব আর সিক্তা এসেছে। সে মেডিকেলে কখনো আসেনি তাই প্রথমে বড় ননদের বাসায় যেয়ে সিক্তাকে নিয়ে এসেছে। ছোটমাকে দেখেই কুহুর চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। আর নাজমা পারভিন সোফা ছেড়ে উঠে সোজা দাঁড়ায় শিউলির সামনে। কোন কথা না বলেই আচমকা কয়েকটা থা’প্প’ড় বসিয়ে দেয় শিউলির গালে। ঘটনার আকস্মিকতায় শিউলি হতভম্ব হয়ে গেছে। কেবিনে ভ’য়া’ন’ক নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে।
নাজমা পারভিন শুধু থা’প্প’ড় দিয়েই ক্ষান্ত হননি। তিনি এবার শিউলির চুলের মু’ঠি ধরে টেনে হিঁ’চ’ড়ে নিয়ে এসে কেবিনের মেঝেতে আ’ছা’ড় মারেন।
” ফ’কি’ন্নি’র মেয়ে, তোর সাহস কি করে হয় আমার ভাইকে ধা’ক্কা দেয়ার? এই কাজ করতে তোর কলিজা একবারও কাঁ’পে’নি? তোর মনে হয়নি একথা আমরা শুনলে, তোকে কি করতে পারি? তোকে আমার ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে এনে আমরা কি ভুল করেছিলাম? তোকে আমরা তোর প্রাপ্য মর্যাদা দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুই এর যোগ্য নয়। আসলে কাককে যতই ময়ূরের পালক পড়াই না কেন, কাক সবসময় কাকই থাকে, ময়ূর হয়না। তুই সেই কাক, যাকে হাজার চেষ্টা করেও ময়ূর বানানো যাবেনা। ” নাজমা পারভিন আজ নিজের মধ্যে নেই। চোখের সামনে শিউলিকে দেখেই হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছে।
” নাজমা, তুই এসব কি শুরু করেছিস? এতটা বে’য়া’দ’ব হয়েছিস তুই, যে ভাইয়ের বউয়ের গায়ে হা’ত তুলছিস! ” আফরোজা নাজনীন রেগে উঠেছেন।
” কিসের ভাইয়ের বউ! এই শ’য়’তা’নি কখনো আমাদের ননদের সম্মান দিয়েছে! নিজে সম্মান পেতে হলে অন্যকেও সম্মান দিতে হয়। এই বে’য়া’দ’ব মহিলা কখনো আমাদের সেই সম্মান দিয়েছে, যে ওকে আমরা মাথায় তুলে রাখব? যেদিন ও আমার ভাইকে মে’রে’ছে, সেদিন থেকে ওর সাথে সম্মুখ ল’ড়া’ই শুরু হয়েছে। আমি যা করছি, তাই করতে দাও। তুমি বাঁধা দিতে আসলেও মানবোনা। ” দ্বিগুণ তেজে বলে উঠে
নাজমা পারভিন।
” বড় আপা, তুমি একটা কথাও বলবেনা। মেজো আপা যা করছে, তাকে করতে দাও। ওর এই শাস্তিটুকুর প্রয়োজন আছে। এখন যদি ও না শোধরায়, তবে ভবিষ্যতে কিন্তু আমাদের পস্তাতে হবে। ”
শিউলি আক্তার মেঝেতে উপুড় হয়ে পরে কাঁদছে।

চলবে…

#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_৩০
জাওয়াদ জামী

” শাহনাজ, তুইও নাজমার মত প্র’তি’শো’ধপ’রা’য়’ন আচরণ করছিস! আব্বা-আম্মা এই শিক্ষাই তোদের দিয়েছিল! তাদের শিক্ষাকে ভুল প্রমানিত করলি তোরা? ” আফরোজা নাজনীন আফসোস নিয়ে বলতে থাকেন।
” বড় আপা, সবক্ষেত্রে বাবা-মা’ র শিক্ষার বড়াই দেখান ঠিক নয়। কিছু কিছু সময় নিজের বিবেক দিয়েও কাজ করতে হয়। আজ যদি আব্বা-আম্মার দেয়া শিক্ষার দোহাই দিয়ে একে ছেড়ে দিই, তবে আমাদের আব্বা-আম্মার শিক্ষার অ’প’মা’ন করা হবে। আর এর মত মানুষকেতো ছাড় দিতেই নেই। এরা অন্ধকার সমাজ গড়ার হাতিয়ার। সময় থাকতে এদের উপড়ে ফেলতে হয়। তা নাহলে এরা সমাজে সং’ক্রা’ম’ক ব্য’ধি ছড়িয়ে দেয়। ” আজ শাহনাজ সুলতানা তার বড় বোনের কোন কথাই শুনতে রাজি নয়। কথাগুলো শেষ করেই শাহনাজ সুলতানা শিউলি আক্তারকে মেঝে থেকে তুলে, তিনিও পরপর কয়েকটা থা’প্প’ড় মারেন।
” শোন শিউলি, তুই যা করেছিস সেটা ক্ষমার অযোগ্য। শুধু আমরা বলে, তোকে এখন পর্যন্ত পুলিশে দিইনি। তাই বলে ভাবিসনা, তোকে ছেড়ে কথা বলব। ”
ছোট বোনের এমন রূপ কখনোই দেখননি আফরোজা নাজনীন।
কুহু স্তব্ধ হয়ে ফুপুদের কর্মকান্ড দেখছে। প্রয়োজনে ওর ফুপরাও যে প্রতিবাদী হতে পারে, তা দেখে কুহু চরম বিস্মিত।
শিহাব মায়ের এরূপ হেনস্তা দেখেও চুপচাপ থাকে। ও সেদিন চোখের সামনে বাবাকে মা’র খেতে দেখেছিল। তাই সেদিন থেকেই নিজের মায়ের প্রতি বিতৃষ্ণা চলে এসেছে।
” তা তুই শুধু শিহাবকে এনেছিস কেন? তোর গুনধর মেয়ে কোথায়? যে এই সকল কিছুর মুলে, তার মুখ দর্শন করতে পারবনা! এই সুযোগে তাকেও শিক্ষা দিতাম। ” নাজমা পারভিন ব্যঙ্গ করে বললেন।
এই ভয়টাই শিউলি পাচ্ছিল। সে কোন উত্তর না দিয়ে চুপচাপ থাকে। এদিকে ওর তিন ননদ একই কথা বারবার জিজ্ঞেস করছে। তবুও শিউলি কিছু বলেনা।
” ফুপু দৃষ্টি আপু, চেয়ারম্যানের ছেলে সবুজের সাথে আজ রাতে পালিয়েছে। ” শিহাব মায়ের বদলে উত্তর দেয়।
শিহাবের কথা শুনে কেবিনের সকলে স্তব্ধ হয়ে গেছে। তারা কথা বলার মত অবস্থায় নেই। সকলে শুধু একে-অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। অবশেষে নিরবতা ভেঙে কথা বললেন, নাজমা পারভিন।
” বাহ, বংশের মুখে চু’ন’কা’লি মাখাতে আর কিছু লাগবেনা। তুই আর তোর মেয়েই এর জন্য যথেষ্ট। বড় কপাল করে তোকে ঐ সংসারে এনেছিলাম , আর অবশেষে বাপের নামও ডু’বা’লা’ম। ”
শিউলির মাথা নিচু করে কথা শোনা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। তবে মেয়ে যে পালিয়েছে এর জন্য তার আফসোস নেই। মেয়ে তার চেয়ারম্যান বাড়ির বউ। এটা চাট্টিখানি কথা!
আফরোজা নাজনীন ডুকরে কেঁদে উঠেন। ঐ ছোট্ট মেয়েটা এইভাবে বাপ-দাদার নাম ডু’বা’লো!
তিনি বেশ বুঝতে পারছেন শিউলির আস্কারা পেয়েই দৃষ্টি ভুল পথে গেছে।
কুহু হতবিহবল হয়ে ফুপুর দিকে তাকিয়ে থাকে। এই ফুপু যেকোন পরিস্থিতি শক্ত হাতে সামাল দিতে পারেন। সবাইকে সব সময়ই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ধৈর্য্য রাখতে রাখতে বলেন। কিন্তু আজ তিনি কাঁদছেন। আজ কে তাকে সামাল দিবে! সবারই যে মনের অবস্থা বিরূপ।

সারাটাদিন কেবিনে থমথমে অবস্থা বিরাজ করেছে। নাজমা পারভিন থেকে থেকেই শিউলিকে মারতে তেড়ে গেছেন। কখনোবা গালাগালি করেছেন। আর শিউলি এসব কিছুই নিরবে সহ্য করে গেছেন।

সন্ধ্যায় কায়েসকে কেবিনে স্থানান্তরিত করা হয়।
তার জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু শরীর দূর্বল থাকায় কথা বলতে পারছেননা। তাকে কেবিনে দেয়া হলে শিউলিকে দেখা মাত্রই ঘৃণায় মুখ কুঁচকে ফেলে। এই নারীকে দেখার কোন ইচ্ছে তার নেই।
বাবাকে দেখেই শিহাব সেই যে তার পাশে বসেছে, উঠার নাম নেই। কুহুও বাবার আশেপাশেই থাকছে।
পরদিন সকালে শিউলি তার ছেলেকে নিয়ে গ্রামে ফিরে যায়। গ্রামে যাবার আগ পর্যন্ত কায়েস শিউলির সাথে একবারের জন্যও কথা বলেলনি।

বোনদের সেবাশুশ্রূষা, মেয়ের যত্নআত্তি পেয়ে একমাসের মধ্যেই কায়েস প্রায় সুস্থ হয়ে যায়। এই একমাস সে বড় বোনের বাসায় থেকেছে।
ব্যবসার যাবতীয় কিছু ফোনেই সামলেছে। তবে কুহু বাবার হয়ে দুইবার গ্রামে গিয়ে টাকার হিসেব নিয়েছে। পুরো মার্কেটের ভাড়া তুলে এনেছে। বাবার কথামত সেই টাকাগুলো নিজের এ্যাকাউন্টে জমা রেখেছে।
শিউলি যখন শুনেছে, কুহু সব টাকা নিয়ে ঢাকায় ফিরে গেছে, তখন থেকেই রা’গে ফুঁ’স’ছে।

এদিকে দৃষ্টি দিন দশেক পরেই স্বামীর সাথে ফুলতলা এসেছে ৷ মেয়ে-জামাইকে পেয়ে শিউলি আনন্দে আটখানা হয়ে যায়। জামাইয়ের যত্নআত্তির ত্রুটি রাখেনা। তিনদিন পর মেয়ে যখন শ্বশুর বাড়ি ফিরে যায়, সে অনেক কিছু বেঁধে দেয় । নিজের জমানো টাকা থেকে বিশ হাজার টাকা জামাইয়ের হাতে দেয়৷ নিজেদের দোকানে যেয়ে ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, টিভি, ল্যাপটপ, খাট, আলমারি, সোফা, ড্রেসিংটেবিল সবকিছুই জামাইয়ের পছন্দমত নিয়ে, তাদের সাথে পাঠিয়ে দেয়। জামাই এতকিছু পেয়ে ভিষণ খুশি হয়।
চেয়ারম্যান বাড়িতে এসব নিয়ে যখন ওরা প্রবেশ করে, তখন চারদিকে দ্রুত খবর ছড়িয়ে পরে সবুজ শ্বশুর বাড়ি থেকে কতকিছু নিয়ে আসছে৷
আহলাদে দৃষ্টি যেন আকাশে উড়ছে। ও ভেবেছে বাবার বাড়ি থেকে এতকিছু এনে, সবাইকে নিজের অধীনে করে নিবে। কিন্তু সে ভুল।

দীর্ঘ একমাস পর আফরোজা নাজনীন তার ভাইকে নিয়ে গ্রামে আসে। সাথে কুহুও রয়েছে।
কায়েকসে দেখে শিউলি দৌড়ে তার কাছে আসে। কিন্তু কায়েস ওকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
কায়েস ভালোমত হাঁটতে পারছেনা। এদিকে ডক্টরও তাকে বেশি নড়াচড়া করতে নিষেধ করেছে। তাই ঢাকায় ফেরার আগে আফরোজা নাজনীন ভাইয়ের ব্যবসার ম্যানেজারকে ডেকে যাবতীয় সকল নির্দেশ দেন। সেই সাথে একটা এ্যাকাউন্ট নম্বর দেন, যেখানে মাস শেষে টাকা পাঠাতে বলেন। শিউলি দেখল তার থেকে সব ফসকে যাচ্ছে। কিন্তু আপাতত সে এসব নিয়ে কিছুই বলবেনা। আগে সবকিছু আবার পূর্বের ন্যায় হয়ে যাক। তারপর আবার সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ সে-ই করবে।
এমন সময় ম্যানেজার জানায়, কিছুদিন আগে শিউলি আক্তার তার মেয়ে-জামাইকে মার্কেটে নিয়ে যেয়ে বেশ কিছু জিনিসপত্র নিয়েছেন। একথা শুনেই কায়েস রেগে উঠে। কিন্তু বোনের চোখের ইশারায় থেমে যায়। আফরোজা নাজনীন চাননা পরিবারের এসব বিষয় বাহিরে যাক।
ম্যানেজার বিদায় নিলে, দুই ভাই-বোন মিলে শিউলিকে চেপে ধরে। দুজনের চাপে পরে শিউলি সব স্বীকার করতে বাধ্য হয়। আফরোজা নাজনীন অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে থাকেন শিউলির দিকে। কতটা সাহস থাকলে, এতকিছুর পরও কোন মানুষ এমন করতে পারে!
” বড় আপা, আমি নিরুপায় হয়ে এই মহিলাকে সংসারে রেখেছি। তার সাহস কত দেখ! যে মেয়ের বিষয়ে আমি কিছুই জানিনা, তার বিয়ে হয়েছে আমি আজই জানলাম। আর সে কিনা, মেয়ে-জামাইকে হাত ভর্তি করে গিফ্ট পাঠিয়েছে! ওর বুক একটুও কাঁপেনি! আমাকে জানানোর প্রয়োজনও মনে করেনি! আমি আর ভাবতে পারছিনা, আপা। ”
” ভাই, তুই এসব চিন্তা করে শরীরের ক্ষতি করিসনা। আমরা আছিতো। তুই বাড়িতে থেকেই ব্যবসা দেখাশোনা করবি। প্রতিমাসেই আমরা তিনবোন গ্রামে আসব। ব্যবসার সব হিসাব-নিকাশ আমরাই দেখব। এছাড়া কুহু আছে। ও ফোনে ম্যানেজারের সাথে যোগাযোগ রাখবে। আগে তুই সুস্থ হ। তারপর কার কি ব্যবস্থা নিতে হবে, সেটা আমরা দেখব। ”
কায়েস বোনের কথায় সায় দেয়।

তাহমিদ কিছুদিন থেকে ঠিকঠাক খাওয়া-দাওয়া করছেনা। সবসময়ই মনমরা হয়ে থাকছে। তাহমিনা ছেলের এমন অবস্থা দেখে চিন্তায় পরে গেছেন। আফরোজা নাজনীনও লক্ষ্য করেছেন তাহমিদ কেমন শুকিয়ে গেছে। তিনি তাহমিদকে
জিজ্ঞেসও করেছেন , কি হয়েছে। কিন্তু তাহমিদ কিছুই জানায়নি, বরং এড়িয়ে গেছে।

চলবে…