#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_৪৩
জাওয়াদ জামী
এভাবে সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নায় অতিবাহিত হয় আরও কিছুদিন। যে যার মত করে চলছে। নিয়মের কোনও পরিবর্তন হয়নি। ভাটা পরেনি ভালোবাসায়।
এইচএসসি’ র রেজাল্ট দিয়েছে। কুহু, সিক্তা দুজনেই জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। কুহু ও সিক্তা বোর্ডের মেধাতালিকায় যৌথভাবে চতুর্থ হয়েছে।
দুই মেয়ের এরূপ অজর্নে সবাই খুশি। নাজমা পারভিন ছুটে এসেছিলেন চিটাগং থেকে। দু’জনকে অনেক কিছু গিফ্ট করেছেন। কায়েসও এসেছিল। মেয়ে আর ভাগ্নীর জন্য দুহাত ভরে জিনিসপত্র এনেছে। বাদ যায়নি শাহনাজ সুলতানা ও তাহমিনা আক্তারও। তারা সবাই ওদের দু’জনকে নিজেদের পছন্দমত শপিং করিয়েছেন।
সবাই ওদেরকে নানানরকম গিফ্ট করলেও, তাহমিদ শুধু সিক্তাকে গিফ্ট করেছে। কুহুকে কিছুই দেয়নি। সিক্তা এই নিয়ে তাহমিদকে খুব খোঁ’চা’চ্ছে, কুহুকে কেন কিছু দিলনা? কিন্তু তাহমিদ মুখে কুলু পেতে রেখেছে।
এতে অবশ্য কুহুর কোন আফসোস নেই। ও ভালো করেই জানে তাহমিদ নিশ্চয়ই কিছু প্ল্যান করে রেখেছে।
রেজাল্টের পর কুহু এবং সিক্তা পড়াশোনায় আরও মনযোগী হয়। তাহমিদ মাঝেমধ্যে দুজনকেই পড়াচ্ছে। এটা সেটা দেখিয়ে দিচ্ছে। কুহুদের সাথে তাহমিদও যেন কোমড় বেঁধে লেগেছে, যেভাবেই হোক ওদের ভালো কোথাও চান্স পেতেই হবে।
ওরা কয়েক জায়গায় অ্যাডমিশন দেয়৷ তাহমিদ নিজে ওদের নিয়ে গিয়েছে অ্যাডমিশন দিতে।
সবখানেই ওরা বেশ ভালো পরীক্ষা দিয়েছে।
রেজাল্টের পর দেখা গেল কুহু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে।
সিক্তাও তিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। তবে ওর ইচ্ছে ছিল মেডিকেলে পড়ার। কিন্তু মেডিকেলে চান্স পায়না বেচারি। এতে ওর মন ভিষণ খারাপ হয়ে যায়।
সবার সাথে আলোচনা করে ওরা সিদ্ধান্ত নেয় দুজনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে।
কুহু পদার্থ বিজ্ঞানে এবং সিক্তা রসায়ন বিভাগে ভর্তি হয়।
কুহু ফুপুদের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয় ও এখন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কোন ফ্ল্যাট নিয়ে সেখানে থাকবে। বিয়ের আগে এভাবে শ্বশুর বাড়িতে থাকা খুব ভালো দেখায়না।
আফরোজা নাজনীন তার পরিবারে এই কথা জানালে, সবাই তার বিরুদ্ধে যায়। তারা কেউই কুহুকে অন্য কোথাও থাকতে দিতে রাজি নয়।
তাহমিদ একদম বেঁকে বসেছে। ও কিছুতেই চায়না কুহু এই বাসা ছেড়ে অন্য কোথাও থাকুক।
কিন্তু কুহুর জেদের কাছে সবাইকে হার মানতে হয়।
শাহনাজ সুলতানা ও আনান মিলে কুহুর জন্য একটা ফ্ল্যাট পছন্দ করেন। যেটা তার ছোট ননদের। এটা কুহুর জন্য বেশ নিরাপদ হবে। পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় তলা ছাড়া সবগুলো ফ্ল্যাট ভাড়া দেয়া। দ্বিতীয় তলায় শাহনাজ সুলতানার ননদের পরিবার থাকে।
দ্বিতীয় তলার একপাশে দুইটা বেডরুম, একটা কমন বাথরুম, এবং বেডরুমের সাথে লাগোয়া বারান্দা।
শাহনাজ সুলতানার ননদ এই অংশটা রেখেছিলেন তার শ্বশুর বাড়ি থেকে চিকিৎসার জন্য আসা আত্মীয়দের জন্য। গ্রাম থেকে অনেকেই চিকিৎসার জন্য ঢাকা আসলে এখানেই থাকত। পরে ধীরে ধীরে তারা দোতলা বিল্ডিং পাঁচতলা করেন। এবং নিচে দুইটা রুম, বাথরুম আত্মীয়দের জন্য বরাদ্দ করেন। তাই দোতলার এই অংশটা ফাঁকা হয়ে যায়। তার ছেলে-মেয়েরা দেশের বাইরে থাকায় এতবড় ফ্ল্যাট তাদের দরকার হয়না।
শাহনাজ সুলতানা ননদকে রাজি করান কুহুর থাকার জন্য রুম দুইটা দিতে।
পরে শাহনাজ সুলতানার ননদ দুইটা রুমের মধ্যে ছোট রুমকে রান্নাঘর ও ডাইনিংয়ের জন্য ব্যবস্থা করে দেন।
ক্লাস শুরু হওয়ার দশদিন পর কুহু ফ্ল্যাটে চলে আসে। ওর চলে আসাতে সবার মন খারাপ হয়ে গেছে। কুহু আসার সময় তাহমিদকে দেখতে পায়নি। কুহু যেদিন থেকে জানিয়েছে ও আর ‘কুঞ্জছায়া’ য় থাকবেনা। তারপর থেকে তাহমিদ কুহুর সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। কুহু বুঝতে পারে তাহমিদ ওর ওপর রাগ করেছে। কিন্তু ও নিরুপায়। এভাবে বিয়ের আগে এই বাড়িতে থাকতে ওর খারাপ লাগে।
তাহমিদ কুহুর সাথে কথা বলছেনা, এটাতে কুহু বেশ কষ্ট পাচ্ছে। কয়েকবার তাহমিদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু কোন লাভ হয়নি। উপায় না দেখে কুহু তাহমিদকে অনেকবার ফোন করেছে কিন্তু তাহমিদ একবারও রিসিভ করেনি। উল্টো ওর নম্বর ব্লক করেছে।
বিষন্ন মনে কুহু ‘ কুঞ্জছায়া ‘ র সীমানা ত্যাগ করে।
যাওয়ার আগে একটিবার তাহমিদের সাথে কথা বলার প্রয়োজন ছিল। তার ভুল ভাঙ্গানোর প্রয়োজন ছিল।
আজ সকালে মেজো ফুপু ফোন করে জানিয়েছেন আগামী সোমবার সকালেই তিনি ঢাকা আসছেন। দুই বোনের সাথে দেখা করে সেদিন দুপুরেই তিনি ফুলতলার পথে রওনা দিবেন। তিনি সাথে করে কুহুকে নিতে চান। আফরোজা নাজনীন ছোট বোনের গ্রামে যাওয়ার কথা শুনে, নিজেও সেখানে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। তিনি সানাউল রাশেদিনকে জানালেন। সেই সাথে তাহমিদকে বললেন, কুহুকে নিয়ে তারা ফুলতলা যাবেন। কুহু এ বাসা থেকে চলে যাওয়ার পর তাহমিদ ওর বিষয়ে কোন কথা বলেনা। তাই বড়মার কথায় কোন প্রতিক্রিয়া জানায়না।
সোমবার সকালে নাজমা পারভিন কুহুকে নিয়ে প্রথমে বড় বোনের বাসায় আসলেন।
কুহু এখানে এসেই তাহমিদের খোঁজ করে, কিন্তু তার দেখা পায়না। সে নাকি খুব সকালেই কোথাও বেরিয়েছে। কষ্টে কুহু কেঁদে ফেলে। সবার সাথে দেখা করে ঘন্টা দুয়েক পর তারা বেরিয়ে পরেন শাহনাজ সুলতানার বাড়ির উদ্দেশ্যে। সেখানে তিন বোন মিলে কিছুক্ষণ কাটান। শাহনাজ সুলতানার বাবার বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও আরোশির জন্য যেতে পারছেননা। ওর সামনে পরীক্ষা আছে। তাই মেয়েকে রেখে তিনি যেতে চাইছেননা।
শাহনাজ সুলতানার বাসায় দুপুরের খাবার খেয়ে তারা রওনা দেন ফুলতলার দিকে। রাস্তায় জ্যাম থাকায় তাদের অনেক দেরি হয়ে যায়। ফুলতলা পৌঁছাতে রাত আটটার বেশি বেজে যায়।
দুই বোনকে হঠাৎ বাড়িতে দেখে কায়েস অবাক হয়ে গেছে। ওরা সবার সাথে কুশল বিনিময় করে। এরপর কায়েস বাজারে যেতে চায় বোনদের জন্য খাবার আনতে। তারা রাতের খাবার খাওয়ার পরপরই কুহুরা এসেছে। তবে শিউলি রান্না করার জন্য রান্নাঘরে যেতে লাগলে আফরোজা নাজনীন তাকে নিষেধ করেন। কারন তারা হোটেল থেকে খাবার কিনে এনেছেন। তাদের আসতে রাত হবে বুঝতে পেরেই, খাবার নিয়েছেন।
রাতে ফুপুদের কাছে শুয়েছে কুহু। ফুপুরা সেই কখন ঘুমিয়েছে কিন্তু ওর চোখে ঘুম নেই। অনেকদিন যাবৎ তাহমিদের সাথে ওর দেখা নেই। আজ আসার সময়ও তার দেখা পায়নি।
যে মানুষটা ওকে একদিন না দেখলে অস্থির হয়ে যায়, একদিন কথা না বললে ছটফট করে, সেই মানুষটাই আজ দেড়মাস যাবৎ আড়ালে থাকছে। এটা কিছুতেই মানতে পারছেনা কুহু। এত রাগ করেছে সে! কুহু তাহমিদের কথা মনে করে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। এখন যে তাকে ফোন করবে সেই উপায়ও নেই।
তাহমিদ ওর রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। গতরাতে যখন শুনেছিল আজ কুহু আসবে, তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সকাল সকাল বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার। ও কুহুর সামনে কিছুতেই পরতে চায়না। মেয়েটাকে অনেক বুঝিয়েছে এই বাসায় থেকে ক্লাস করতে। একা একা কুহু অন্য জায়গায় থাকবে, এটা চায়নি তাহমিদ। বাইরের জগৎ খুব খারাপ। তারউপর কুহু খুব একটা চালাকও নয়। ওর বাইরে একা টিকে থাকতে খুব কষ্ট হবে। এই বাসায় ও থাকলে তাহমিদ নিশ্চিন্তে থাকত। কিন্তু জেদি মেয়েটা সেই কথা মানলে তো।
এতদিন কুহুকে না দেখে তাহমিদের ভিষণ কষ্ট হচ্ছে। একবার মন চাচ্ছে কুহু ঢাকায় আসলেই, ওর কাছে ছুটে যেতে। কিন্তু পরক্ষণেই যখন কুহুর ত্যাড়ামোর কথা মনে হয় তখন সব ভালোবাসা উবে যায়। একরাশ রা’গ এসে জমা হয় বুকের মাজারে। এখানে রা’গ জিতে যায়, হারিয়ে দেয় ভালোবাসাকে।
ফুপুদের আসার কথা শুনে পরদিন দুপুরে দৃষ্টি স্বামীসহ বাপের বাড়ি আসে।
দৃষ্টিকে দেখে তারা দুই বোন একে অপরের দিকে তাকায়। ফর্সা টুকটুকে মেয়েটার এ কি হাল হয়েছে। শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। চেহারার সেই লাবন্য কোথায় হারিয়েছে! এতদিন দৃষ্টির ওপর যে রাগ ছিল ওকে দেখামাত্রই তা মিলিয়ে যায়। দৃষ্টি দৌড়ে এসে বড় ফুপুকে জড়িয়ে ধরে। আফরোজা নাজনীন অবাক হয়ে যান দৃষ্টির এমন কাজে। যে মেয়ে তারা আসলে তেমন একটা ভিড়তনা আজ সেই মেয়ে তাকে এভাবে জাপ্টে ধরেছে! ভাতিজীর মুখের দিকে ভালোভাবে তাকিয়েই তিনি বুঝে নেন, তার ভাতিজী ভালো নেই।
শিউলি ননদদের সাথে সবুজকে পরিচয় করিয়ে দেয়। তারাও সবুজের সাথে যতটুকু কথা বলা প্রয়োজন ততটুকুই বলেন। সবুজকে দেখেই তাদের অপছন্দ হয়।
দুপুরে খাবার সময় নাজমা পারভিন দৃষ্টির সাথে এটাসেটা নিয়ে কথা বলছেন।
” দৃষ্টি বিয়ের পর তোর শ্বশুর তোকে গহনাগাঁটি কিছু দিয়েছে? তোর ভরনপোষণ কে করছে? ” নাজমা পারভিন চেয়ারম্যান সম্পর্কে ভালো করেই জানেন। তাই তিনি ইচ্ছে করেই সবুজের সামনে এই প্রসঙ্গ তুলেছেন।
ফুপুর কথা শুনে দৃষ্টি মাথা নিচু করে থাকে। সে কি করে বলবে বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত ও শ্বশুর বাড়ি থেকে একটা সুতাও পায়নি।
দৃষ্টির মৌনতা দেখে তারা সব বুঝে যান।
” এই যে ছেলে, লেখাপড়া কিছু জানো? চাকরি করতে চাইলে আমাকে বল। আমার ভাসুরের কোম্পানি আছে। তুমি চাইলে সেখানে চাকরির ব্যবস্থা করে দেব। বিয়ে করেছ অনেকদিন হয়েছে, এবার কিছু কর। আর কতদিন আমার ভাই মেয়ে-জামাইকে টানবে? এদিকে তোমার বাপও বোধহয় কিছুই দেয়নি। এবার নিজের রাস্তা নিজে দেখ। এতদিন শুনেছি চেয়ারম্যান মানুষের জিনিস খেয়েই বিল্ডিং উঠায়, এবার নিজের সামনে সব দেখছি। সে কি পারেনা তার একটা ছেলেকে টাকা দিয়ে ব্যবসায় নামাতে! সে তা করলনা৷, টাকা দিল আমার ভাই। আবার তার ভরনপোষণও করছে! ” দৃষ্টিকে চুপ থাকতে দেখে নাজমা পারভিন সবুজের সাথে কথা বলতে চান।
এদিকে সবুজ নাজমা পারভিনের কথা শুনে খাওয়া ভুলে গেছে। এভাবে কেউ ওকে অপমান করতে পারে, তা ও ভাবতেই পারেনি। তবে সবুজ এটা বুঝে নেয় এই মহিলার সাথে উচ্চবাচ্য করা যাবেনা। ভদ্রমহিলা ঠোঁ’ট’কা’টা স্বভাবের। তাই ও ভেতরে ভেতরে রা’গ’লেও বাহিরে থেকে হাসিমুখে নাজমার কথা হজম করে৷
চলবে…
#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#বোনাস_পার্ট
জাওয়াদ জামী
দৃষ্টি আগের মত নেই। এখন অনেকটাই বদলে গেছে। যে দৃষ্টি আগে কুহুকে পছন্দ করতনা, এখন সে-ই যেচে কুহুর সাথে কথা বলছে। কুহুর রেজাল্ট শুনে খুশি হয়েছে। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে শুনে খুশিতে কেঁদে দেয়। কুহু ছোট বোনের এমন আনন্দ দেখে হাসিমুখে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। তবে কুহু দৃষ্টির সাথে ঠিকমত কথা বললেও, একবারও সবুজের সাথে কথা বলেনি। সবুজকে কেন যেন ওর ভালো লাগেনি।
তিনদিন গ্রামে কাটিয়ে আফরোজা নাজনীন এবং নাজমা পারভিন ঢাকা ফিরে যেতে চাইলে, কুহু আর দুইটা দিন থাকতে চায়। এবার ঢাকা গেলে হয়তো আগামী ছয়মাসে গ্রামে আসতে পারবেনা। ও ফুপুদের আর দুইটা দিন থাকতে বলে। কিন্তু তারা নিরুপায়। তাদের ফিরে যেতেই হবে। আবার কায়েসও এখন কুহুকে কিছুতেই যেতে দিতে চাচ্ছেনা। সে চাইছে মেয়েটা আর কিছুদিন থাকুক। তাই আফরোজা নাজনীন কুহুকে কয়েকটা দিন গ্রামে থাকতে বললেন। তিনদিন পর দুপুরে তারা ফুলতলা থেকে রওনা দেন। সবুজ সেদিন দুপুরে খাবার পরই বাড়িতে চলে যায়। তাই আজ সবুজের সাথে তাদের দেখা হয়না। দুই ফুপু দৃষ্টিকে দশ হাজার করে বিশ হাজার টাকা দেন। দৃষ্টি নিতে না চাইলেও জোড় করে দেন।
আফরোজা নাজনীন এবং নাজমা পারভিন সকলের কাছ থেকে বিদায় নেন।
পরদিন দুপুরে সবুজ কুহুদের বাড়ি আসে। আসার পর থেকেই কুহুর সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু কুহু সবুজকে পাত্তা দেয়না।
শিউলি আক্তার এবার আর কুহুর সাথে দূর্ব্যবহার করেনি। সে নিজের মত আছে। কুহুও তাই।
শিহাব সারাদিন কুহুর আশেপাশে ঘুরঘুর করে। দৃষ্টি প্রানখুলে কুহুর সাথে কথা বলছে। কুহুর বেশ ভালো লাগছে দৃষ্টির এই পরিবর্তন।
রাতে খাবার পর যে যার ঘরে চলে আসে। কুহু নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়। বিছানায় বসে ফোন হাতে নিতেই দেখল তাহমিদের নম্বর থেকে পাঁজটা মিডস কল। তাহমিদের নম্বর দেখে কুহুর বুকের ভিতর বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস দোলা দেয়। কবে কি মানুষটা ব্লক খুলে দিয়েছে! ও তাহমিদের নম্বরে ফোন দেয়। কিন্তু ফোন সুইচড অফ পায়। আবার মন খারাপ হয়ে যায় কুহুর। ও ভাবল তাহমিদ বোধহয় রা’গ করে ফোন অফ রেখেছে। কিন্তু বোকা মেয়ে একবারও ভাবলনা তাহমিদ স্যারের সাথে মেডিকেলের ওটিতে আছে।
তাহমিদের বাসায় ফিরতে রাত এগারোটা বেজে যায়। ও বাসায় ঢুকেই সোজা ওয়াশরুমে চলে যায়। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে গোসল সেরে নিচে আসে। সেখানে বড়মা ওর জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছেন।
তাহমিদ খেতে খেতে বড়মাকে কুহুর কথা জিজ্ঞেস করে। বড়মা ওকে জানায় কুহু কয়েকদিন পর আসবে।
তাহমিদের মন খারাপ হয়ে যায়। কতদিন মেয়েটাকে দেখেনি। ওকে না দেখে আর থাকতে পারছেনা। মেয়েটাকে দুপুর থেকে কয়েকবার ফোন করেছে, অথচ সে রিসিভ করেনি। তাহমিদ ভাবল রাতে আর ওকে ফোন করবেনা। একবারে সকালেই কথা বলবে ওর শ্যামাঙ্গীনির সাথে। এতদিনের কথা না বলার আক্ষেপ ঘুচাবে সকালেই।
সারাদিন মেডিকেলে ছুটাছুটি করে, ওটিতে কাজ করে ক্লান্ত তাহমিদ এগারোটা পঁয়তাল্লিশে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়। শোবার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে যায়। ঘুমানোর আগে একবার ফোন হাতে নিয়ে দেখল এখনও ফোন অন করেনি। সাথে সাথেই ফোন অন করে। একবার ভাবল কুহুকে ফোন করবে কিনা। কিন্তু পরক্ষণেই আবার সিদ্ধান্ত বদলায়। অনেক রাত হয়েছে হয়তো কুহু ঘুমিয়ে পরেছে ভেবে আর ফোন দেয়না তাহমিদ। কিন্তু ও জানলনা কুহু তার ফোনের অপেক্ষায় রয়েছে।
রাত এগারোটা থেকে কুহু কয়েকবার তাহমিদকে ফোন দিয়েছে। কিন্তু বারবার বন্ধ পাচ্ছে।
এগারোটা চল্লিশে কুহু ঘুমানোর প্রস্তুস্তি নেয়।
কেবলমাত্র চোখে ঘুম ভর করেছে, ঠিক সেই সময় ওর ঘরের দরজায় কারও টোকা দেয়ার আওয়াজে কুহুর ঘুম ছুটে যায়। এতরাতে দরজায় কে টোকা দেয়! কুহু দো-মনা করতে করতে বিছানা থেকে নামে। নিয়মিত বিরতিতে কেউ দরজায় টোকা দিচ্ছে! কুহু দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে কান পেতে শোনার চেষ্টা করছে, দরজার বাইরে কে আছে। আবারও টোকা দেয়ার শব্দ! কুহু বুঝতে পারছে এটা তার বাবা কিংবা শিহাব নয়। এতরাতে বাবা ওর ঘরে আসবেনা। আর আসলেও এভাবে টোকা দিবেনা। সরাসরি ডাক দিবে।
হঠাৎ কুহুর কানে ফোনের রিংটোনের আওয়াজ আসে। যে রিংটোন সে সবুজের ফোনের ছিল। বিকেলে যখন কুহু বারান্দায় বসে শিহাবের সাথে কথা বলছিল, তখন সবুজ বাইরে যাচ্ছিল, সে সময় সবুজের ফোন বেজে ওঠে। আর এই রিংটোনই ছিল।
এবার কুহু ভয় পায়। তবে কি সবুজ ওর দরজায় টোকা দিচ্ছে! কুহুর হাত-পা ভয়ে কাঁপছে। একবার সিদ্ধান্ত নেয় বাবাকে ফোন দিবে। কিন্তু আবার ভাবে এ নিয়ে যদি ছোটমা অশান্তি করে কিংবা সব দোষ কুহুর গায়ে চাপিয়ে দেয়। সমাজে সকলের সামনে কুহুকে দোষী প্রমানিত করে তখন কি হবে! ও খুব ভালো করে জানে ছোটমা কেমন।
বারবার দরজায় টোকা পরছে। কুহু অস্থিরভাবে ঘরে পায়চারি করছে। ও কি করবে ভেবে পায়না।
একসময় চেয়ার, টেবিল আলনা টেনে দরজার দিকে ঠেসে রাখে। যাতে ধাক্কা দিলেও দরজা না খোলে। ঘরের বড় লাইটের সুইচ অন করে। এবার জানালায় টোকার শব্দ। কুহু ভালো করে জানালার ছিটকিনি লাগিয়ে দেয়। একমনে আল্লাহকে ডাকতে থাকে।
রাত একটা। থেমে থেমে একবার দরজা একবার জানালায় টোকা দিচ্ছে সবুজ।
” কতক্ষণ এভাবে ঘরে সিঁধিয়ে থাকবে টুকটুকি।
তোমাকে আমার মনে ধরছে। আজ রাতে তোমাকে আমার চাই। ” জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে বলল সবুজ। যা কুহুর কানে ঠিক পৌঁছে গেছে। এবার আরও ভয় পায় সে। শিওর হয়ে যায় সবুজই এটা করছে।
কুহু দোয়াদরুদ পাঠ করছে। সেই সাথে আল্লাহকে তো ডাকছেই, এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেতেে। একপর্যায়ে ফোনের দিকে চোখ যায়। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন নিয়ে তাহমিদের নম্বরে ফোন দেয়। ওকে এবার আর নিরাশ হতে হয়না।
মনে আশার সঞ্চার করে বেজে ওঠে ফোন।
তিনবার রিং হতেই তাহমিদের ঘুম ভেঙে যায়। বিছানা হাতড়ে ফোন নিয়ে দেখল, কুহুর নম্বর।
” সোনাপাখি, তুমি এখনও ঘুমাওনি! এত রাতে ফোন দিলে যে? আমি সকালেই তোমাকে ফোন দিতাম। ” ঘুম জড়ানো আদুরে গলায় তাহমিদ বলে।
কিন্তু এই মুহুর্তে তাহমিদের কোন কথা কুহুর কানে পৌঁছায়না।
” আপনি কাল এখানে এসে আমাকে নিয়ে যাবেন। আসবেন তো? ” কুহু কাঁদছে।
কুহুর কান্নার আওয়াজ শুনে তাহমিদের ঘুম ছুটে যায়। ঝট করে উঠে বসে।
” কি হয়েছে পাখি? তুমি কাঁদছ কেন? তুমি ঠিক আছো তো? ”
” আপনি কাল আসবেন প্লিজ। আমার ভিষন ভয় করছে। ” কুহুর কন্ঠে অনুনয়।
” আসব। আমি কাল যত তারাতারি পারি আসব। তুমি ভয় পেওনা। বাবাকে ডাক। রাতে তার কাছেই থাক। ”
” নাহ্ বাবাকে ডাকা যাবেনা। কাউকেই ডাকা যাবেনা। আর আমি কিছুতেই ঘর থেকে বেরোতে পারবনা।”
” ঠিক আছে কাউকেই ডাকতে হবেনা। তুমি দরজা জানালা লক করে ঘরেই থাক, আমি আসছি। ভয় পেওনা সোনা। ফোন কাছে রাখ। আমি ফোন দিলেই সাথে সাথে রিসিভ করবে। আমি রাখছি। আবারও বলছি ভয় পেওনা। আমি আছি। ”
” আপনি আসবেন তো? ”
” কথা দিচ্ছি কাল তোমার দিন শুরু হবে আমার মুখ দেখে। এখন একটু শান্ত হও। আমাকে একটু সময় দাও। আল্লাহ হাফেজ। ”
তাহমিদ ফোন কেটে দিলে কুহু আবারও ভয়ে কুঁকড়ে যায়। না জানি এরপর কি হয়!
ভোর চারটা পর্যন্ত থেকে থেকে কুহুর দরজা-জানালায় টোকা দেয় সবুজ। তবে প্রথমদিকের মত ওতটা ভয় কুহু পায়নি। কারন তাহমিদ সারারাত কুহুর সাথে কথা বলেছে। তখন ফোন কাটার দশ মিনিট পরই তাহমিদ কুহুকে পুনরায় ফোন করেছে। এবং সারারাত কুহুর সাথে কথা বলেছে, ওকে শান্তনা দিয়েছে। ফজরের আজান দিলে তাহমিদ ফোন রেখে কুহুকে ঘুমাতে বলে।
কিন্তু কুহুর চোখে ঘুম আসেনা। রাতের বিভীষিকা বারবার ওকে তাড়া করছে।
সকাল ছয়টায় বাড়ির সামনে গাড়ির হর্নের আওয়াজ শুনে কায়েস একটু চমকায়। এত সকালে কে আসল! দুইদিন আগেই আপারা গেছেন। এখনতো কারও আসার কথা নয়! বাড়ির গেইট খোলাই ছিল। তাহমিদ হুরমুড়িয়ে ঢোকে বাড়িতে। এই সাত-সকালে তাহমিদকে দেখে কায়েস তব্দা খেয়ে যায়। তাহমিদ এখন, এখানে! কিছু হয়েছে কি!
” মামা, কুহু কোথায়? ” কায়েসকে জিজ্ঞেস করেই, তার উত্তরের অপেক্ষা না করে তাহমিদ জোড়ে জোড়ে কুহুকে ডাকতে থাকে।
তাহমিদের ডাক শুনে শিউলি, দৃষ্টি, শিহাব তিনজনই উঠানে আসে। তারা সবাই অবাক হয়ে তাহমিদকে দেখছে। তার পড়নে ট্রাউজার আর টি-শার্ট। বাসার পোশাক পড়েই সে এত সকালে, এতদূর পথ পাড়ি দিয়ে কেন এসেছে!
তাদের সকলের বিস্মিত দৃষ্টি উপেক্ষা করে তাহমিদ কুহুকে ডাকতেই থাকে।
সারারাত না ঘুমানোয় কুহুর মাথা ব্যথা করছিল।
ও নিস্তেজ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। হঠাৎই তার কানে তাহমিদের ডাক পৌঁছে। ধরফরিয়ে বিছানা থেকে নেমে দরজায় ঠেস দেয়া চেয়ার, টেবিল, আলনা সরিয়ে দরজা খুলে দেয়।
দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে তাহমিদ দৌড়ে সেদিকে যায়।
কুহু দরজা হাট করে খুলে দিতেই ওর সামনে তাহমিদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। আশেপাশের লোকজন কিংবা তাদের বিস্মিত দৃষ্টির তোয়াক্কা না করে কুহু ঝাঁপিয়ে পড়ে তাহমিদের বুকে।
ঝাঁকুনিতে একটু পিছিয়ে যায় তাহমিদ, তবুও শক্ত করে কুহুকে ধরে রাখে। এই প্রথম মেয়েটা স্বেচ্ছায় ওর এত কাছে এসেছে।
” আপনি আমাকে ব্লক করেছিলেন কেন? জানেন আপনাকে কতবার ফোন করেছি। সেদিনও ঐ বাসায় আপনাকে খুঁজেছি, কিন্তু আপনি ছিলেননা। আপনি খুব খারাপ, খুব খারাপ। ” কুহু হেঁচকি তুলে কাঁদছে।
” রিল্যাক্স পাখি। তুমি এত অস্থির হয়োনা। আমি এসেছি তো। ধীরে ধীরে তোমার সব অভিযোগ শুনব। এবার বল, তোমার কি হয়েছে? ”
কায়েস ওদের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলনা। মাথা নিচু করে নিজের ঘরে চলে যায়। আর ভাবতে থাকে, কি হয়েছে তার মেয়ের। আমার লাজুক মেয়েটা সবার সামনেই তাহমিদকে জড়িয়ে ধরেছে! আশেপাশে কেউ আছে তা লক্ষ্য করছেনা!
দৃষ্টি ওদেরকে দেখে মিটিমিটি হাসছে। ও আগেই বুঝোিল তাহমিদ ভাইয়া আপুকে পছন্দ করে। আজ তার প্রমান পেল।
শিউলি আক্তারের মুখে কোন কথা জোগায়না। মাথা নিচু করে রান্নাঘরে যায়।
শিহাব ভাবছে, আপু এভাবে কাঁদছে কেন!
রাতের ভয় আবারও কুহুকে জেঁকে ধরে।
” আমাকে নিয়ে চলুন এখান থেকে। আমি এক্ষুনি যেতে চাই। ”
তাহমিদ দেখল দৃষ্টি উঠানে দাঁড়িয়ে আছে।
” দৃষ্টি রুমের ভেতরে যা। কুহুর কাপড়চোপড় সব প্যাক করে দে। কুইক। শিহাব তুই মামাকে ডাক। ” কথা বলতে বলতে ঘাড় ঘুড়িয়ে তাহমিদ একজনকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল।
লম্বাচওড়া, সুঠাম দেহের ফর্সা একটা ছেলে। কুঁতকুঁতে চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
তার তাকানোর ধরন, দাঁড়ানোর ভঙ্গি কোনটাই তাহমিদের ভালো লাগলোনা।
কায়েস ঘর থেকে বেরিয়ে আসলে তাকে জানায়, তারা এখনি চলে যাবে। কায়েস বুঝতে পারে কিছু একটা ঘটেছে। সে কুহুকে জিজ্ঞেস করে কিন্তু কুহু বাবার কথার উত্তর না দিয়ে কেঁদেই চলেছে। ততক্ষণে দৃষ্টি কুহুর ব্যাগ গুছিয়ে তাহমিদের হাতে দিয়েছে।
ওরা সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে।
সবুজ ঘরে এসে দেয়ালে মাথা ঠুকছে। কি থেকে কি হয়ে গেল।
” ধ্যাৎ, পাখি হাত ফসকে বেরিয়ে গেল! ওকে দেখে কত সাধ জাগছিল কাছে পাওয়ার, তা আর হলোনা। সকালেই ঐ শা’লা হিরো সেজে আসছে। শা’লা’কে এই বাড়ির বাইরে একবার যদি পাইতাম। সেখানেই পুঁ’তে দিতাম। দেখি কতদিন আমার ময়নাপাখি বাপের বাড়ি ছেড়ে এদিকসেদিক উড়ে বেড়ায়। একদিন না একদিন ওকে এই বাড়িতে আসতেই হবে। আর সেইদিনই ও আমার হবে। ”
সকালে দারোয়ানের কাছ থেকে শুনেই তাহমিনা ছেলের রুমে আসে। ফাঁকা রুম দেখে তার ভয় হয়। ছেলেটা নাকি রাতেই কোথাও গেছে।
প্রায় ছুটেই তিনি আফরোজা নাজনীনের কাছে আসেন। তাকে সব জানান, দারোয়ান কি বলেছে। আফরোজা নাজনীন সব শুনে চিন্তা করতে থাকেন। এরইমধ্যে তাহমিনা ছেলের নম্বরে ফোন দিয়েছেন। কয়েকবার রিং হওয়ার পর তাহমিদ ফোন রিসিভ করে মা’কে জানায় ও দুপুরের মধ্যেই ফিরবে।
ছেলের সাথে যোগাযোগ বলে তাহমিনা চিন্তামুক্ত হন।
‘ কুঞ্জছায়া ‘ র সকলে এই অসময়ে তাহমিদের সাথে কুহুকে দেখে যতটা না অবাক হন, তারচেয়ে বেশী অবাক হন তাহমিদের কথা শুনে।
” তাহমিদ, তুমি কি বলছ দাদু? যা বলছ ভেবেচিন্তে বলছ? ” আয়েশা সালেহা বিস্মিত।
” আমি যা বলছি একদম সজ্ঞানে বলছি। আজ, এক্ষুনি যদি তোমরা আমার সাথে কুহুর বিয়ে না দাও, আর কুহু যদি রাজি না হয়, তবে আমি এ বাড়ি ছেড়ে চিরতরে চলে যাব। ”
” কি এমন হয়েছে বাপ, যার জন্য তুই এই কথা বলছিস? আজকেই বিয়ে কিভাবে সম্ভব! তোর বাবা এখানে নেই, কায়েস নেই। বাবাকে ছাড়া তুই বিয়ে করবি? ”
” বড়মা, আমি আর কোন টেনশন নিতে পারবনা।
তুমি জানো, রাত দেড়টার আগেই আমি বাসা থেকে বেরিয়েছি? সারারাত আমার রাস্তায় কেটেছে। কতটা টেনশনে ছিলাম আমি। এক মুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছিল আমি বোধহয় পাগল হয়ে যাব। রাত একটায় ফোনে ওর কান্না শুনলে আমার কি হতে পারে, সে সম্পর্কে কোন ধারনা তোমার আছে? আমি ওকে নিয়ে কোন রিস্ক নিতে চাইনা। যা বলার বলে দিয়েছি। বাকিটা তোমাদের হাতে। ”
আফরোজা নাজনীন এবার কুহুর কাছে আসেন।
” সোনা মা, কি হয়েছে তোর? আমাদের একটিবার বল। দেখছিসনা ছেলেটা কেমন টেনশন করছে। ” কুহু কান্নার দমকে ফুপুর কথার উত্তর দিতে পারেনা।
” কুহু, তাহমিদের প্রস্তাবে তুই কি রাজি? আজকে অন্তত কোন ভুলভাল সিদ্ধান্ত নিসনা মা। যা বলার খোলাখুলি বল। ” ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে তাহমিনা আক্তার কুহুকে প্রশ্ন করেন।
কুহু মাথা তুলে একনজর তাহমিদের দিকে তাকায়। ছেলেটার চোখমুখ শুকিয়ে গেছে। চুলগুলো উসকোখুসকো। বাসায় পরার ট্রাউজার, টি-শার্ট পরেই সে ফুলতলা ছুটে গেছে!
মাথা নামিয়ে কিছুক্ষণ অনেক কিছু ভাবে কুহু। জীবনের কিছু হিসেব-নিকেশ কষে মনে মনে। সব সময়ই কেন খারাপটাই ওর সাথে ঘটে?
” ফুপু, উনার প্রস্তাবে আমি রাজি। তোমরা যখন বলবে, তখনই এ বিয়ে হবে। ”
কুহুর এতটুকু কথাতেই সবাই হৈহৈ করে উঠে। আফরোজা নাজনীন তার স্বামীকে ফোন করে অফিস থেকে আসতে বললেন। এরপর দেবরকে কর্মস্থল থেকে ছুটি নিয়ে আসতে বলেন। শাহনাজ সুলতানার বাড়িতে ফোন করেন, নাজমা পারভিনকে জানান। তবে নাজমা পারভিন জানান তিনি আসতে পারবেননা।
এরপর তিনি ফোন করেন কায়েসের কাছে। আজকেই তার ভাইকে শিহাবকে সাথে নিয়ে আসতে বলেন। কায়েস অনেক প্রশ্ন করেছে, কিন্তু তিনি কোন উত্তর দেননি।
সানাউল রাশেদিন এক ঘন্টার মধ্যে বাসায় আসেন। শাহনাজ সুলতানাও ছেলেমেয়ে নিয়ে হাজির হন। তাহমিনা আক্তার সিক্তাকে নিয়ে গেছেন শপিংয়ে। ছেলের বউয়ের জন্য ইচ্ছেমত কেনাকাটা করবেন।
কুহু দিদুনের রুমে শুয়ে আছে। দিদুন ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। এতে বেশ আরামবোধ করছিল কুহু। এরপর কখন যে ঘুমিয়ে গেছে বলতেই পারেনা।
কুহুর ঘুম ভাঙ্গলো ছোট ফুপুর ডাকে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। ফুপুকে দেখে লজ্জা পায় কুহু। নিশ্চয়ই বড় ফুপু তাকে আসতে বলেছেন। শাহনাজ সুলতানা কুহুকে উঠিয়ে ওয়াশরুমে পাঠান। একবারে গোসল করে আসতে বললেন। ফুপু সালোয়ার- কামিজ নিয়ে ওয়াশরুমে ঢোকে।
গোসল সেরে বেরিয়ে এসে দেখল তাহমিনা আক্তার অনেকগুলো শপিং ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। হঠাৎই হুড়মুড় করে দুইটা মেয়ে রুমে ঢোকে। তাহমিনা আক্তারের নির্দেশে কুহুকে ধরে ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসায়।
শফিউল রাশেদিন বড় ভাবির ফোন পেয়েই প্লেনের টিকেট কেটে রাজশাহী থেকে ঢাকায় রওনা দেন। তার টিকেট পেতে দেরি হওয়ায় বাসায় আসতে বিকেল হয়ে যায়।
মাগরিবের আজানের কিছুক্ষণ আগে কুহুকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে আসেন আফরোজা নাজনীন। ওকে সম্পূর্ণ ব্রাইডাল সাজে সাজানো হয়েছে। তাহমিনা আক্তার শপিং করে ফেরার পথে উনার পরিচিত পার্লার থেকে দুইজন বিউটিশিয়ান এনেছিলেন।
আনান তাহমিদের রুমে এসে দেখল সে এখনো ঘুমাচ্ছে। আনান নির্দয়ের মত তাহমিদকে টেনেহিঁচড়ে তুলে ওয়াশরুম পাঠায়। তাহমিনা ছেলের জন্য শেরওয়ানী এনেছেন। সেটা তিনি আনানকে দিয়ে পাঠিয়েছেন।
তাহমিদ গোসল সেরে বেরিয়ে আসলে, আনান ওকে জোড় করে শেরওয়ানী পড়ায়। এরপর ওকে নিয়ে নিচে আসে।
দুজনের বিয়ে সম্পন্ন হওয়া মাত্রই মাগরিবের আজান দেয়।
এতক্ষণ নাজমা পারভিন ভিডিও কলে সব দেখছিলেন। বিয়ে সম্পন্ন হতেই তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন।
তাহমিদ কবুল বলার পরই কুহুর দিকে তাকিয়ে হা হয়ে যায়। ওর বউকে একদম মায়াবতী লাগছে। চেনাই যাচ্ছেনা সে কুহু।
চলবে..
#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_৪৪
জাওয়াদ জামী
শাড়ী আর গহনার ওজনে কুহুর প্রান ওষ্ঠাগত। এদিকে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়েছে সেই কখন। সারাদিন খাওয়া হয়নি। ক্ষুধায় শরীরের অবশিষ্ট শক্তিটুকুও গায়েব। অন্যদিন ফুপু আর তাহমিনা আন্টি কুহুকে খাওয়ানোর জন্য উঠেপড়ে লাগে। কিন্তু আজ তাদের সেইদিকে খেয়ালই নেই। ছেলের বিয়ের জন্য তাহমিনা আক্তার কয়েকজন প্রতিবেশি এবং ঢাকায় তার যে দুই বোন থাকেন, তাদের পরিবারকে আসতে বলেছিলেন। সবাই তাদের নিয়েই ব্যস্ত হয়ে গেছে।
কুহু সেই বিকেল থেকে ড্রয়িংরুমে বসে আছে। না পারছে উঠে যেতে না পারছে বসে থাকতে।
আর এদিকে একটু পরপর আনান এসে ওকে এটাসেটা বলে খুঁ’চি’য়ে যাচ্ছে। তার সাথে সিক্তাও বাদ যাচ্ছেনা। কুহু দাঁতে দাঁত চেপে ওদের অ’ত্যা’চা’র সহ্য করছে। এত কিছুর মাঝেও কুহু তাহমিদকে খুঁজছে। কিন্তু সেই মহাশয়ের কোন খবরই নেই।
প্রতিবেশিরা সবাই চলে গেলে তাহমিনা আক্তার এসে কুহুকে খাইয়ে দেন।
” মা, কতক্ষণ এসব পরে থাকব? ভিষন গরম লাগছে। প্রতিবেশিরা সবাই চলে গেছে, এবার এসব খুলে সালোয়ার – কামিজ পরি? ” কুহু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে তাহমিনা আক্তারকে।
” সবাই তোকে দেখেছে ভালোকথা। আমার ছেলে কি তোকে ভালো করে দেখেছে? আজ তোকে এভাবে সাজিয়েছি আমার ছেলের জন্য। সে-ই যদি না দেখবে, তবে সাজানোর কোন মানেই হয়না। আমার ছেলেটা কবুল বলার পরেই রুমে যেয়ে ঘুমাচ্ছে। তোর দিকে তাকিয়েও দেখেনি। আর তুই কিনা চাচ্ছিস, আমার ছেলের হক নষ্ট করতে! ” তাহমিনা আক্তারের অকপট জবাবে লজ্জায় মাথা নিচু করে কুহু।
ও মনে মনে ভাবছে, এ কেমন শ্বাশুড়ি তার!
রাত নয়টার দিকে কায়েস ছেলেকে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বড় বোনের বাড়িতে প্রবেশ করে।
ড্রয়িংরুমে সবাই মিলে কুহুকে ঘিরে আড্ডা দিচ্ছিল। কায়েস ভেতরে ঢুকে কুহুকে বধূরূপে দেখে অবাক হয়ে গেছে। আজ সকালেই যে মেয়ে ফুলতলা থেকে আসল, রাতেই তাকে বধূ বেশে দেখছে!
কায়েসকে দেখে তাহমিনা আক্তার হাসিমুখে এগিয়ে আসেন।
” আসেন বেয়াই মশাই। মেয়ের বাড়িতে আপনাকে স্বাগতম। এতদিন বোনের বাড়িতে এসেছেন, আজ থেকে মেয়ের বাড়িতে আসবেন। ”
তাহমিনা আক্তারের কথা শুনে কায়েস এবার অবাক হতেও ভুলে গেছে। কি উত্তর দিবে সে তাহমিনা আক্তারের কথার!
আফরোজা নাজনীন এগিয়ে এসে ভাইকে এনে কুহুর পাশে বসায়। বাবাকে দেখে কুহুর বুক ফেটে কান্না আসে। ছোটবেলা থেকেই মা’কে দেখেনি। নিজের বিয়েতে মা’কে তো পাবেইনা জানত, কিন্তু বাবাও যে থাকবেনা এটা ওর কল্পনায়ও ছিলনা।
বাবাকে দেখা মাত্রই কুহু হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। আবারও মনে হয় রাতের সেই বিভীষিকা।
ও কিছুতেই সবুজকে ক্ষমা করতে পারবেনা। বিয়ের মত পবিত্র দিনেও সবুজের জন্য ও বাবাকে কাছে পেলনা।
রাতে সবার খাওয়া শেষ হলে ছেলেমেয়েদের উপরে পাঠিয়ে দেন আফরোজা নাজনীন। এরপর কুহু,তাহমিদসহ বড়রা আয়েশা সালেহার রুমে আসেন।
আফরোজা নাজনীন কোন ভনিতা ছাড়াই কুহুর থেকে জানতে চান, রাতে তাহমিদকে ফোন করার কারন। তিনি পুরো ঘটনা না জানা পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছেননা। কুহুও ভাবল এবার সবাইকে বিষয়টি জানাতে হবে। ওর হঠাৎ তাহমিদকে ডাকা আবার হঠাৎই এই বাসায় চলে আসায় সবারই খটকা লেগেছে।
কুহু একে একে সবটাই জানায় সবাইকে। সবুজের নাম উল্ল্যেখ করতে ভুলেনা। কুহুর মুখে সবকিছু শুনে সবাই কথা বলতে ভুলে গেছে।
” তুই আমাকে রাতেই জানালিনা কেন, মা? তোর বাবা এতটাও খারাপ নয় যে মেয়ের বিপদে এগিয়ে আসবেনা। তোর যদি কিছু হয়ে যেত! ” কায়েস ডুকরে কেঁদে উঠে।
তাহমিদ স্তম্ভিত হয়ে কুহুর দিকে তাকিয়ে আছে। গতরাত মেয়েটার কিভাবে কেটেছে, ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। কুহুর কিছু হয়ে গেলে ও বাঁচত কিভাবে!
” বাবা, আমি কোন ঝামেলা চাইনি। যাই ঘটে যাক না কেন, ছোটমা কিছুতেই আমাকে বিশ্বাস করতনা। আমি জানি, রাতে তোমাকে ডাকলে তুমি নিশ্চয়ই সবুজকে ছাড়তেনা। কিন্তু দৃষ্টি কিংবা ছোটমা বিষয়টা সহজভাবে নিতনা। উল্টে গ্রামের সবার কাছে, সব আত্মীয় স্বজনদের কাছে আমাকে দো’ষী করত। আমার নামে মিথ্যা অ’প’বা’দ দিত। দো’ষ না করেও আমিই আ’সা’মী হতাম। তাই আমি তোমাকে জানাইনি, বাবা। আমি আমার ভুল স্বীকার করছি। ” কেঁদে জবাব দেয় কুহু।
” আমি ওকে ছাড়বনা। কালই গ্রামে গিয়ে ওকে পুলিশে দিব। দৃষ্টিকে ওর কাছে আর যেতে দিবনা। ”
” তুই এত উত্তেজিত হোসনা, ভাই। কুহুর কথায় যুক্তি আছে। শিউলি, দৃষ্টি কেউই মানবেনা তোদের কথা। গ্রামে কুহুর নামে দুর্নাম রটাবে শিউলি। মেয়েটার গ্রামে মুখ দেখানো দায় হয়ে যাবে। ” আফরোজা নাজনীন বলেন।
” তুমি এসব বলছ, আপা! তাই বলে ঐ শয়তানটা শাস্তি পাবেনা! আমার মেয়েদের জীবন নিয়ে খেলতে চাইছে ও। ”
” আমি কি বলছি আগে ভালোভাবে শোন। তুই এখনই গতরাতের ঘটনা নিয়ে ওকে কিছু বলিসনা। এতে কুহুর ওপর আঙ্গুল উঠাবে সবাই। এ সুযোগ ওদের দিসনা। এখন উত্তেজিত না হয়ে বুদ্ধি দিয়ে কাজ কর। ওর সম্পর্কে এযাবৎ যা কিছু শুনেছিস তার প্রমান সংগ্রহ কর। এরপর দৃষ্টিকে বুঝা সবুজ খারাপ ছেলে। ওকে সব প্রমান দেখা। দৃষ্টির চোখে পট্টি বেঁধে দিয়েছে ঐ জা’নো’য়া’র’টা। আগে দৃষ্টির চোখে ওকে অপরাধী প্রমান কর। তারপর কুহুর সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের কথা দৃষ্টিকে জানা। তখন দেখবি দৃষ্টিই ওকে ঘৃণা করবে। এরপর তুই ওকে যা খুশি করিস। আমরা কেউ তোকে বাঁধা দিবনা। বরং তোর পাশে সব সময়ই আছি এবং থাকব। ”
আফরোজা নাজনীনের সাথে সবাই একমত হন।
তাহমিদকে চুপচাপ থাকতে দেখে শফিউল রাশেদিনের খটকা লাগে।
” তাহমিদ, তুমি এমন থম মেরে আছ কেন? কি হয়েছে তোমার? ”
” আমি তোমাদের মতামতের সাথে একমত হতে পারছিনা। ঐ জানোয়ারকে আমি নিজ হাতে শাস্তি দিব। সকালেই যদি এই মেয়ে সব জানাত, আমি সেখানেই ওকে পুঁ’তে রেখে আসতাম।
আর তুমি কি বললে, বড়মা! কুহুর উপর আঙুল তুলবে সবাই! কেন কুহু কি কোন অন্যায় করেছে? অন্যায় করেছে ঐ সবুজ। ওর অন্যায়ের জন্য কুহু কেন মুখ লুকিয়ে থাকবে! আমি কালকেই তোমাদের ঐখানের থানায় যেয়ে, ওর নামে মামলা করব৷ আমাকে কেউ আটকাতে পারবেনা। ”
” তুমি কোথাও যাবেনা। আমরা জানি কুহু কোন অন্যায় করেনি। তবুও কুহুর সম্মান নিয়ে আমরা টানাটানি করতে চাইনা। তুমি মামলা করলেও কিছুই হবেনা। ক্ষমতার মারপ্যাঁচে ও ঠিকই মুক্ত হয়ে যাবে। তখন ও কুহু কিংবা তার পরিবাকে ছেড়ে কথা বলবে? আশেপাশের দশ গ্রামের সবাই চেয়ারম্যান আর তার ছেলের কথা বিশ্বাস করবে। কুহুকে খারাপ প্রতিপন্ন করতে উঠেপড়ে লাগবে। তাই আমাদের আগে প্রয়োজন ঐ ছেলের সব খারাপ কাজের প্রমান। এজন্য আগে আমাদেরকে কাজ করতে দাও। ঐখানের এসপি আমার অতি পরিচিত। আমি তার সাথে কথা বলে রাখব। আমাদের হাতে প্রমান থাকলে ওকে শেষ করা কোন ব্যাপারই হবেনা। কায়েস সব প্রমান জোগাড় করুক, আমিও লোক লাগিয়ে দিব প্রমান সংগ্রহের জন্য । সব প্রমান হাতে এলে তোমার যা ইচ্ছে কর। আমি বোঝাতে পেরেছি? ” সানাউল রাশেদিনের কথায় চুপ হয়ে যায় তাহমিদ। কিন্তু ওর ভেতরের র’ক্ত টগবগ করে ফুটছে।
সকলে মিলে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়, আগে সব প্রমান জোগাড় করেই তবে তারা সবুজের পেছনে লাগবে৷
কুহুকে তাহমিদের রুমে নিয়ে আসেন তাহমিনা আক্তার। আজ বাড়ির বড় মেয়েরা সবাই শ্বশুর বাড়িতে থাকায় এই কাজ তাকেই করতে হচ্ছে। সিক্তা কিংবা আরোশি মেয়েটাকে আর কিইবা শিখয়ে দিবে।
দুরুদুরু বুকে কুহু পা দেয় তাহমিদের রুমের চৌকাঠে। এই বাড়িতে এত বছর যাবৎ আসলেও আগে কখনোই এই রুমে আসেনি কুহু। তাই এই রুম সম্পর্কে কোন ধারনাও নেই।
ভেতরে ঢুকতেই কুহুর নাকে রজনীগন্ধার তীব্র সুবাস লাগে। তাহমিনা আক্তার ততক্ষণে রুমের আলো জ্বালিয়েছেন। রুমটা আলোয় উদ্ভাসিত হতেই কুহুর চক্ষু ছানাবড়া হয়ে যায়। পুরো খাট রজনীগন্ধা, গোলাপ, কাঠবেলির মালা দিয়ে সাজানো! রুমের দেয়াল জুড়ে শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন ফুলের থোকা।
কে সাজালো এভাবে!
” আনান, সিক্তা আর আরোশির কান্ড দেখেছিস! কত সুন্দর করে সাজিয়েছে! আজ থেকে তোর রুম তুই বুঝে নে, মা। এই রুমের সাথে সাথে আমার ছেলের দ্বায়িত্বও আজ থেকে তোকে দিলাম। সারাজীবন আমার ছেলেকে ভালোবাসায় বেঁধে রাখিস। আর শোন, গতরাতের ঘটনা মাথা থেকে একদম ঝেড়ে ফেল। ঐ ছেলে এরা কেউ ছাড়বেনা। ওর শাস্তি ও পেয়ে যাবে। সেসব কথা মনে করে আজকের রাতটা নষ্ট করিসনা। যদি সেসব নিয়ে তাহমিদ তোর সাথে রাগ করে তুই চুপ করে থাকিস। দেখবি রাগ কমে গেলে ও একদম মাটির মানুষ হয়ে যাবে। ” তাহমিনা আক্তার আরও কিছু উপদেশ দেন কুহুকে। কুহুও বাধ্য মেয়ের মত সব মাথায় ঢুকিয়ে নেয়।
তাহমিনা আক্তার রুম থেকে বেরিয়ে গেলে, কুহু বিছানা থেকে নেমে রুমের ভেতরে ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে। বড় সাইজের ছিমছাম একটা রুম। বেড কভার থেকে শুরু করে ফার্নিচার সবকিছুতেই রুচির ছাপ স্পষ্ট। বড়বড় জানালাগুলো পর্দার আড়ালে নিজেদের মুখ লুকিয়েছে। পুরো রুমের চার দেয়ালে অতিরিক্ত কোন কিছু দিয়ে সাজানো নেই। শুধু দক্ষিণের জানালার পাশে দেয়ালে তাহমিদের একটা ছবি ঝুলছে। সাদা দেয়ালগুলো যেন আলো ছড়াচ্ছে।
কুহু দক্ষিণের জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। পর্দা সরিয়ে কিছুক্ষণ সূদুরে চেয়ে থাকে। এরপর এসে দাঁড়ায় তাহমিদের ছবির সামনে।
এ্যাপ্রন হাতে দাঁড়িয়ে আছে সে। ঘাড় একটু বাঁকা করে তাকিয়ে আছে বামপাশের কোন কিছুর দিকে। বাতাসে এলোমেলো চুল। ঠোঁটে মিষ্টি হাসি। পেছনে লাল, হলুদ কলাবতী ফুলেরা বাতাসে দুলছে।
কুহু এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে ছবিটার দিকে৷ তাহমিদ কখন রুমে এসেছে তা জানেইনা। এমনকি ওর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে সেটাও বুঝতে পারেনি।
” আমার মিষ্টি বউটা এ মনযোগ দিয়ে কি দেখছে শুনি? তার একটামাত্র জামাই রুমে এসেছে অথচ তার সেদিকে কোন খেয়ালই নেই! এমন বেখেয়ালি হলে চলবে। ” আচম্বিতে কুহুর কোমড় জড়িয়ে প্রশ্ন করে তাহমিদ। থুতনি রেখেছে কুহুর ঘাড়ের ওপর। ওর নিশ্বাস আছড়ে পড়ছে কুহুর গালে।
আচমকা এভাবে জড়িয়ে ধরায় চমকে উঠে কুহু। এভাবে তাহমিদের তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরায় কেমন লজ্জা করছে। লজ্জা আরও গাঢ়ো হয় যখন তাহমিদ কুহুর গালে লম্বা চুমু দেয়।
” একি বউ, তুমি কাঁপছ কেন! আমি তো এখনও কিছুই করিনি! এখনই যদি এত কাঁপাকাঁপি শুরু কর তাহলে সারারাত কি করবা! রাতের জন্য হলেও অন্তত কিছু কাঁপা-কাঁপি বাঁচিয়ে রাখ। ”
” এই ছাড়ুন বলছি। নামাজ পড়তে হবে। যান অজু করে আসুন। এই রাতে নামাজ পড়তে হয় সেই চিন্তা না করে শুধু অ’শ্লী’ল কথাবার্তা বলছে! ” কুহু তাহমিদের থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য মোচড়ামুচড়ি করছে।
” আমি কি একবারও বলেছি নামাজ আদায় করবনা। আমিতো শুধু বউকে চুমু দিয়েছি এবং দিব। কারন আমি দেখতে চাই, আমার বউ কত কাঁপতে পারে। বউয়ের কাঁপার কারন হওয়ার মধ্যেও আনন্দ আছে। ”
তাহমিদের এহেন কথায় কুহু লজ্জায় শেষ হয়ে যাচ্ছে।
” আপনি কি আমাকে ছাড়বেন? নাকি আমি দিদুনের কাছে যাব? বলছি যে নামাজ পড়তে হবে, তবুও উল্টাপাল্টা কথা বলেই যাচ্ছে! বেশরম লোক একটা। শরীরে লজ্জাশরমের বালাই নেই। ”
” দিদুনের কাছে যেয়ে লাভ নেই সুন্দরী। ঘুরেফিরে আমার কাছেই আসতে হবে। এই রুমটাই এখন তোমার পারমানেন্ট ঠিকানা। আর রুমের মানুষটা তোমার ব্যাক্তিগত সম্পদ। তোমার সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার সঙ্গী। ভয় পেলে যেমন তার বুকেই তোমাকে মুখ গুঁজতে হবে, তেমনি কষ্ট পেলেও তার বুকই কাঁদার স্থান, আবার তার কারনে লজ্জায় লাল হলেও তার বুকই ভরসা। এবং সবশেষে চরম সুখের দিনেও তার বুকেই তোমার সুখ। এবার বল কোথায় যাবে এই রুম এবং রুমের মানুষটা রেখে? ”
তাহমিদ কথা বলার মাঝেই কুহুকে নিজের দিকে ফিরিয়ে, বুকে জরিয়ে নেয়। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে অনুভব করে সুখের এই ক্ষন।
” বউ, আমার বুকে মাথা রেখে কেমন অনুভব করছ? একটা সুখ সুখ অনুভূতি শরীর-মনে দোলা দিচ্ছে, এটা কি অনুভব করতে পারছ? এরপর কখনও নিজের রুম ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে ইচ্ছে করবে? ”
কুহু তাহমিদের কথার উত্তর না দিয়ে মুচকি হাসে।
আসলেই এই সুখের কোন নাম নেই।
দুজন একসাথে নামাজ আদায় করে। তাহমিদ কুহুকে নিয়ে বিছানায় যায়।
” এবার একটু ঘুমাও। সারারাত ঘুমাওনি, আবার সারাদিন অনেক ধকল গেছে। তুমি শুয়ে পর, আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। ”
” আপনি ঘমাবেননা! আপনারও তো রাতে ঘুম হয়নি! ”
” আমি দুপুরে, সন্ধ্যার পর ঘুমিয়েছিলাম। তাই এখন ঘুম আসবেনা। তুমি কথা না বলে চুপটি করে ঘুমাও। আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে, তোমাকে দু-চোখ ভরে দেখব। এখন চোখ বন্ধ কর, আমার কাজে বাঁধা দিওনা। ”
” আপনি ভেতরে ভেতরে রে’গে আছেন? ”
” তোমার কেন মনে হল আমি রে’গে আছি? কার ওপর রা’গ’ব আমি! ”
” সবুজের ওপর। আমি জানি আপনি ওর ওপর রে’গে আছেন। ”
” আজকের এই পবিত্র রাতে, সুখের মুহূর্তে তার কথা মনে করে আমার সুখের বারোটা বাজিয়ে দিওনা। ঐ কু’লা’ঙ্গা’রে’র নাম নিয়ে আজকের রাতের মাধুর্য নষ্ট করোনা। এখন চোখ বন্ধ কর। নইলে এবার সত্যিই রে’গে যাব। ”
কুহু ঝট করে চোখ বন্ধ করে। তাহমিদ হেসে কুহুর চুলে আঙুল চালায়।
চলবে…