বিন্নি ধানের খই পর্ব-২২+২৩+২৪

0
412

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_২২
#মিদহাদ_আহমদ

‘তুমি তানিয়া আপাকে কেন ডেকেছো?’

কোন জবাব দিলো না আসিফ৷ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে নিজে নিজে বলে বসলো,

‘কিছু একটা করতে হবে। কিছু একটা করতে হবে আমার।’

আমি আসিফের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আসিফ আমার দিকে ফিরে তাকালো। তারপর সে বললো নিজ থেকে,

‘কি? কিছু হয়েছে?’

‘তুমি আপাকে কেন আসতে বললা?’

‘আসতে বলেছি কারণ সে সব ঠিক করে দিয়ে যাবে।’

‘মানে?’

‘কোন মানেটানে নাই। যা বলছি তাই।’

আমার মাথায় বাজ পড়ে গেলো। আসিফকে সরাসরি বলে বসলাম,

‘এই মদের নেশা তোমাকে মানুষ থেকে অমানুষে পরিণত করে ফেলেছে। তুমি কোন বোধশক্তির মানুষ নও। তুমি নিজে কখন কী করো তার কি কোন কন্ট্রোল আছে নিজের উপর?’

‘তোমার কি কোন সমস্যা নুপুর?’

আমি আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইলাম আসিফের কথা শুনে। তার দিকে অবাক চোখে চেয়ে বললাম,

‘তুমি আসলেই কি চলে যাওয়ার কথা ভাবছো?’

আসিফ জবাব দিলো না। তানিয়া আপার নাম্বার থেকে কল এলো। আসিফ কল রিসিভ করলো৷ লোকেশন জানিয়ে দিলো আবার৷ আধা ঘন্টার ভেতরে আমার ননাস আর ননাসের জামাই আমাদের চার তলার ছাদের উপর ছোট এক রুমের বাসায় এসে হাজির। তারা বাসা এসে ঢুকতেই আসিফ আমাকে ডাক দিয়ে বললো,

‘দিয়ে দাও। এক্ষুণি দিয়ে দাও।’

‘কী?’

আসিফ আমার হাত ধরে আমার আঙুল থেকে ডায়মন্ডের আংটিটা খুলে নিলো। আমার ননাসের হাতে আংটিটা দিয়ে বললো,

‘এইটা নিয়ে যাবার জন্যই বলেছিলাম এখানে আসতে৷ এখন আসতে পারো তোমরা।’

ননাস আসিফকে বললো,

‘কী আইটা?’

‘আংটি। তুমি দিয়েছিলে না নুপুরকে? নিয়ে চলে যাও।’

ননাস আসিফকে ধরে বললেন,

‘ভাই! তুই আমাদের খুব আদরের ছিলি ছোটবেলা থেকে। জানি না সেই আদরের ছোট ভাই দিনকে দিন এমন পরিবর্তন হয়ে গেলো কীভাবে! জানিস, তোকে নিয়ে আমাদের কত স্বপ্ন ছিলো? কত আবেগ ছিলো?’

‘হুম। সব শেষ। আমি কোন স্বপ্ন পূর্ণ করতে পারিনি। এখন তুমি তোমার দেয়া আংটিটা নিয়ে চলে যাও আপা। আমি ভালো আছি। একা আছি। দেখি কিছু করতে পারি কিনা। আর না করতে পারলে কোন সমস্যা নাই। না খেয়ে, ক্ষুদার্ত হয়ে, অনাহারে মারা যাবো। তবুও তোমাদের ঘরে আর যাবো না।’

ননাসের স্বামী আসিফকে বললেন,

‘এইতো শালাবাবু ঠিক বলেছো। লাইফে নিজে কিছু করা আর অন্যের উপর থেকে করা দুটোর মধ্যে ফারাক অনেক।’

তারপর দুলাভাই ননাসের দিকে চেয়ে বললেন,

‘দেখে নিও, সে ঠিকই এবার কিছু একটা করবে। আর করবে না শুধু, ভালো ভাবেই করবে। এইটা আমার একান্ত বিশ্বাস।’

ননাসের চোখ বেয়ে পানি নামলো। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,

‘কিছু খেয়েছো তোমরা?’

আমি না সূচক মাথা নাড়ালাম। ননাস তার ব্যাগ থেকে একটা ছোট টিফিন ক্যারিয়ার বের করলেন। তারপর আসিফকে ফ্লোরে বসিয়ে বললেন

‘তোর পছন্দের ভূণা খিচুড়ি আর ডিম করে এনেছি। খেতে হবে৷ না করলে চলবে না। নুপুর, তুমিও বসো।’

এমন সময়ে কলিংবেল বেজে উঠলো। আমি উঠে গিয়ে দরজা খুললাম। এক মধ্য বয়সী মহিলা দাঁড়ানো। তিনি বললেন,

‘কিতাগো মাই? নয়া আইছো দেখাত আইলাম। কিতা করইন তোমার জামাইয়ে? ভিতরে জুতা লইয়া আইরাম। আমার জুতা ছাড়া হাঁটার অভ্যাস নাইনু এরদায়।’

উনি বাড়িওয়ালির স্ত্রী৷ আমি উনাকে ভেতরে নিয়ে এলাম। বসানোর মতো কোন জায়গা নেই। কোন আসবাবও নেই৷ জিজ্ঞেস করলেন,

‘ঘরো কিতা লাখড়ি সেট নাইনি? তোমার বিয়াত আইছেনানি কিতা?’

আমাকে কাটিয়ে ননাস বললেন,

‘আন্টি সব আছে। আমরা আসলে পুরোপুরি সেট করিনাই তো। আজকালকের ভেতরে সব এসে যাবে।’

‘অহ আইচ্ছা। তুমি খে এইনোর?’

‘সে আমার ভাইয়ের বউ হয়।’

‘আইচ্ছা তে আইজ যাইগিয়া। আইমুনে বাদে।’

বাড়িওয়ালি মহিলা চলে গেলেন। আসিফ আমার ননাসকে বললো,

‘এসব দেখানো ভালোবাসার প্রয়োজন নাই আপা। তোমাকে আংটি দিনে ডেকে এনেছি। আংটির দাম কত আমার জানা নেই, তবে দামি হবে। আমি কারো কোন দায় নিয়ে থাকতে চাই না।’

‘বোনের ভালোবাসা দায় হবে কেন? জানিস আমি বুঝতে পেরেছি ভালোবাসা কী জিনিস? যেই নুপুরকে আজ এতটা দিন আমি খারাপ ভেবে এসেছিলাম সেই নুপুর আমার জন্য কথা বলেছে তোর দুলাভাইয়ের সাথে। আর তাকে আমি কী না কী বলেছি! আমার লজ্জায় শেষ হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে এখন। এই নুপুর আমার হয়ে কথা বলেছে। আর আজ আমি আমার চোখের সামনে দেখছি, নুপুর আমার বিগড়ে যাওয়া ভাইকে আলোর পথে আনছে৷ ভালোবাসায় মানুষ কী না পারে!’

আমার ননাসের কথাগুলো শুনে আমার চোখে অশ্রু চলে এলো। আসিফ ননাসকে বললো,

‘আংটি নিয়ে চলে যাও আপা।’

দুলাভাই বললেন,

‘দেখো শালাবাবু, জীবন সব সময় থমকে যায় না। মাঝেমধ্যে জীবন নতুন করে চালাতে হয়৷ আর এই চালানোর জন্য মাথা ঠান্ডা করে কাজ করতে হয়৷ বসে থাকলে হয় না, থমকে গেলেও হয় না। সব সময় ভরসা রাখতে হয় নিজের উপর। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে হয়। আজ আমি এখানে এসেছি কেন জানো? কারণ এই মেয়েটা। তোমার স্ত্রী সম্পর্কে আমার শালা বউ হলেও, সে আমার চোখমুখ খুলে দিয়েছে। আমাকে বুঝিয়েছে সম্পর্কের মানে টা কী! আর তার জন্যই আজ আমরা দুজন নতুন বাসায় উঠেছি। পরিবার থেকে বের হয়ে এসেছি।’

‘কী বলছো দুলাভাই? কী এসব আপা?’

‘হ্যাঁ রে আসিফ৷ তোর দুলাভাই আর আমি বাসা থেকে বের হয়ে এসেছি। আভিজাত্য আর টাকায় শান্তি আছে কিনা জানি না, এবার নাহয় সাধারণ ভাবে বেঁচে দেখি৷ দেখি জীবনের মানে কোথায় দাঁডায়। এই মানুষটাকে সাথে করে কীভাবে থাকতে পারি।’

দুলাভাই তার পকেট থেকে একটা হাজার টাকার ব্যান্ডেল বের করলেন৷ তারপর আসিফের হাতে দিয়ে বললেন,

‘এখানে এক লাখ টাকা আছে। মনে করো আমি তোমাকে ধার দিয়েছি। আমাকে এক বছরের মধ্যে ফেরত দিয়ে দিতে হবে। আর সুদ হিসাবে আমাকে একটা পারফিউম আর তোমার বোনকে আড়ং এ এক্সক্লুসিভ একটা ড্রেস দিয়ে দিলেই হবে। নতুন সংসার, নতুন ঘর, নতুন জীবন। সব নতুন করে শুরু করো শালাবাবু। এই টাকাটা তুমি ধরো ‘

আমি ননাসের দিকে তাকালাম। তার চোখ যেনো আকুতি করে বলছে তার ভাইকে, ‘টাকাটা নিয়ে নে’

অন্যদিকে আমি চিন্তায় বিভোর হচ্ছি, আসিফ যদি আবার নেশা শুরু করে তখন?

দুলাভাই এক প্যাকেট সিগারেট বের করে আসিফের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,

‘এইটাও রাখো’

(চলবে)

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_২৩
#মিদহাদ_আহমদ

*গ্রুপে এড হয়ে তারপর গল্প পড়বেন৷

আসিফ একবার আমার দিকে তাকালো। আরেকবার তার বোনের দিকে। এদিকে মনের ভেতরে আমার জাগ্রত হওয়া শঙ্কা যে কাটছেই না। আসিফ কী করবে এই টাকার? যদি কোন খারাপ পথে সে ব্যয় করে বসে?

আমার ননাস তার স্বামীর হাত থেকে টাকা এনে ধরিয়ে দিলেন আসিফের হাতে। আসিফ না না করে উঠলো। ননাস তার দিকে চোখ ইশারায় বললেন,

‘রাখ’

আসিফ দেখলাম অপ্রস্তুত হয়ে উঠলো কেমন জানি৷ দুলাভাই আসিফের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেব,

‘শালাবাবু, সংসার করছো, এখন দায়িত্ব নিতে শিখো৷ দায়িত্ব না নিলে পরের জীবন পার করবা কীভাবে? এজন্য তো দায়িত্ব নেয়া শেখা উচিত আগে। তাইনা?’

আসিফ চুপ করে থাকলো। আমার দিকে তাকালো আরেকবার। আমি কেন জানিনা ইশারায় তাকে টাকাটা রাখতে বললাম৷ ননাস তার ভাইকে জড়িয়ে ধরে বললো,

‘খুব খুশি হলাম রে ভাই। খুব খুশি হলাম। তুই এই টাকাটা রেখেছিস ভেবে আমার যারপরনাই ভালো লাগছে। আমি জানি আমার ভাই এখন ঠিক আগের মতো হয়ে উঠবে। দায়িত্ব নিতে জানবে৷ সংসারী হবে৷ জানিস ভাই, সব মেয়েরা স্বপ্ন দেখে একটা নিজস্ব সংসারের। একটা নিজস্ব দুনিয়ার। এই দুনিয়া ছেড়ে কেউ কখনো বাঁচতে পারে না৷ আর এই বাঁচার মানেটাই তো সংসার। দেখ, তোর দুলাভাইকে আঁকড়ে রেখে আমি আমার সংসারের স্বপ্ন দেখেছি। তাকে দেখেই আমি বাঁচতে শিখছি। আজ এত বছর পরও আমাদের কোন সন্তান নেই। কিন্তু…’

দুলাভাই আমার ননাসের মুখের সামনে হাত এনে তাকে চুপ করতে বললো। খেয়াল করলাম দুলাভাইর চোখের কোন ঝাপসা হয়ে আসছে। দুলাভাই বললো,

‘আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি তানিয়া৷ কখনো এই ভালোবাসার মধ্যে অন্য কোনকিছু যেনো বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। কখনোই না।’

ননাস তার স্বামীকে জড়িয়ে ধরলো। আসিফ দেখতে লাগলো চোখ ভরে। আর আমি মনে মনে খুশি হলাম এই ভেবে যে, দুজন মানব মানবী তাদের নিজের মতো করে জীবন আবার গড়তে শুরু করেছে৷

বাইরে বৃষ্টি শুরু হলো। সিলেটে এই বৃষ্টি এই রোদ। একবার সিলেট বাতিঘরে সমরেশ মজুমদার এসেছিলেন৷ আমি আবার ওনার ভক্ত। কালবেলা, কালপুরুষ, উত্তরাধিকার পড়ে কতোবার যে সেই গল্পের চরিত্রে নিজেকে আবিস্কার করেছি আর কল্পনায় বিভোর হয়েছি তার ইয়াত্তা নেই৷ সমরেশ মজুমদারকে দেখার জন্য আমি সেই গ্রাম থেকে সিলেট বাতিঘরে আসি। সামনাসামনি প্রশ্নোত্তর পর্বে ওনাকে জিজ্ঞেস ও করেছিলাম,

‘সিলেটের কোন জিনিস আপনার ভালো লাগে?’

সমরেশ মজুমদার মাইক হাতে কাঁপা কাঁপা গলায় বলেছিলেন, সিলেটের চা বাগান আর বৃষ্টি ওনাকে পুরোপুরি দার্জিলিং দার্জিলিং ফিল দেয়৷ অন্ধকারে নিয়ে এসে আলোয় ছেড়ে দিলে দার্জিলিং এর বাগান আর সিলেটের বাগান দুটোকে গুলিয়ে ফেলবে যে কেউ৷ আর বৃষ্টিও।’

ননাস আসিফকে বললো,

‘আজ শেষ ইফতার। ইফতারে এই ভূণা খিচুড়ি আর ডিম খেয়ে নিও তোমরা। আগামীকাল ঈদ। আর এই এখানে একটা পাঞ্জাবি আর একটা শাড়ি আছে৷ নুপুর, এই শাড়িটা কেমন হয়েছে বলো?’

ননাস আমার হাতে একটা গাঢ় বেগুনি রঙের কাতান শাড়ি তুলে দিলেন৷ কী সুন্দর এর রঙ! একেবারে চোখ জুড়ানো। এমন শাড়ি দেখেছিলাম আমাদের স্কুলের সাগরিকা ম্যাডামের পরনে। ম্যাডামের গায়ে শাড়িটা যা মানাচ্ছিলো না! কপালে কালো টিপ পরে ম্যাডাম যখন আমাদের ক্লাস নিচ্ছিলেন, তখন শাড়িটা দেখে দেখেই আমি এক অপার মুগ্ধতায় ভাসছিলাম। আমি হাসিমাখা মুখে বললাম,

‘অনেক সুন্দর হয়েছে আপা। আমি এমন শাড়ি এর আগে কখনোই পরিনি৷ কী মিষ্টি!’

‘তোমার থেকে বেশি মিষ্টি নয় অবশ্যই? আমার ছোট ভাইয়ের বউ যেমন গুণবতী, তেমন রূপবতীও।’

দুলাভাই বললো,

‘কী তানিয়া? এমন কেন বলছো? নজর লেগে যাবে না? দেখো দেখো শালাবাবুও তোমার দিকে চেয়ে আছে। সে মাশাআল্লাহ। কুইক।’

‘বোনের উপর বড় বোনের নজর লাগে বলো? সুন্দর ও সেখানে দোয়ায় পরিনত হয়।’

আমি আমার ননাসের কথায় মুগ্ধ হয়ে উঠলাম। ভেতরে ভেতরে আমার মন জোড়ায়ে বইতে লাগলো খুশির ঝলকানি। তিনি আমাকে নিজের বোন ভাবছেন! আল্লাহ মনে হয় আজ নাহয় কাল, মানুষের চাওয়াগুলো পূর্ণ করে দেন নিশ্চয়ই৷ আমি ডাক্তার হতে চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম একটা ঘরকন্নার কাজ করতে। সুন্দর বর, সুন্দর মন, সুন্দর মানুষের সহচার্য পেতে। আল্লাহ হয়তো আমার কিছু চাওয়া পূর্ণ করছেন। কিছু চাওয়া হয়তো স্বপ্নেই থেকে যাচ্ছে। যা হয়তো কখনো পূর্ণতা পাবার নয়৷

কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি থামলো। এই থমকে থমকে বৃষ্টি আমার পছন্দের না। এক নাগাড়ে যে বৃষ্টি হয় সেই বৃষ্টি এক মোহনীয় গানের সুর বানিয়ে ফেলে। মাটিভেজা গন্ধ বাতাসে ওড়ে। সেই বাতাসের ঘ্রাণ শুকতে মনে কী এক আন্দোলন শুরু হয়! মনে হয় যেনো উপর থেকে আসা স্বর্ণের ঘ্রাণ, ভূমিতে ছড়িয়ে পড়েছে। আকাশে বাতাসে ছড়াচ্ছে তার প্রেমের আর্তনাদ। মানুষ হয়ে উঠছে মোহনীয়। আয়োজনে প্রেম দাবি করছে যেনো গোটা প্রকৃতি৷ ননাস আর ননাসের স্বামী বাসা থেকে বের হয়ে চলে গেলো। আসিফ সিগারেট ধরালো একটা। দুলাভাইয়ের এই সিগারেট দেয়াটা আমার পছন্দ হলো না৷ একের পর এক সিগারেট ফুকতে লাগলো আসিফ পাগলের মতো। সন্ধ্যায় ইফতার শেষে সে বেরিয়ে গেলো৷ আমি বাসায় একা একা বসে ছিলাম৷ কোনকিছু ভালো লাগছিলো না দেখে ওড়না মাটিতে বিছিয়ে নামাজ পড়তে বসলাম৷ কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে উঠে গিয়ে দরজা খুললাম। ভেবেছিলাম আসিফ হবে৷ কিন্তু না। বাড়িওয়ালি এসেছেন৷ এসেই উনি আদেশের সুরে বলতে লাগলেন,

‘তোমার বাসা থেকে জুতার ছাপ একেবারে নিচ পর্যন্ত। টাইলসে যে দাগ পড়লো এগুলো কে পরিস্কার করবে শুনি? নিচে লেখা দেখোনাই যে জুতা পরে সিঁড়িতে উঠা নিষেধ? নাকি এইটা দেখিয়ে দিতে হবে? আর আজ সকালে তুললাম এক ট্যাংকি পানি৷ সন্ধ্যা হতে না হতেই শেষ হয়ে গেলো? তোমরা তো দেখছি বাসার অবস্থা নাজেহাল করে ছাড়বা। এমন করলে তো চলবে না৷ এমন চলবে না।’

কথাগুলো বলতে বলতে বাড়িওয়ালি মহিলা চলে গেলো৷ আরও কী জানি বললো সে। আমি শুনলাম না৷ দরজা লাগাতেই আবার হাক ছেড়ে জোর গলায় বললো,

‘বাপের দরজা নাকি? এত জোরে লাগাইলা? দরজা ভাঙ্গলে কি কিনে দিবা?’

আমি আর কথাও বললাম না৷ দরজাও খুললাম না৷ মানুষ যেনো এখন কেমন জানি ভয়াবহ হয়ে যাচ্ছে দিনদিন৷ আমাদের সেই গ্রামে, একজন অন্যজনের ঘরে যাওয়া, একসাথে মিলেমিশে থাকা, সবার কাজে আগ বাড়িয়ে হাত লাগানো, বিকাল হলেই চুলে বিলি দেয়া, সাঁঝ নামার আগে কাচা আম মাখানো কিংবা রোজ রোজ রত্না বুবুর ঘর থেকে জলপাই আচার নিয়ে আসার দিনগুলো কি আর খুঁজে পাবো না? সহজ সরল মানুষের ভীড়ে কি আমি আর আমার চিরচেনা মানুষদের পাবো না? শহুরে মানুষ কেমন জানি জড়তা নিয়ে বাস করে৷ মানুষ মানুষের সাথে মিশে না

আমার মোবাইলে কল এলো৷ জায়নামাজে বসে কল ধরলাম৷ মা কল দিয়েছেন৷ জিজ্ঞেস করলেন কোথায় আছি৷ আমি বললাম,

‘যেখানে থাকার সেখানেই আছি ‘

‘যেখানে থাকার মানে?’

‘যেখানে থাকার মানে যেখানে থাকার সেখানেই৷ কেন কল দিয়েছ? কিছু বলবে?’

‘জামাই কই?’

‘জানি না। বাইরে গিয়েছে।’

মায়ের সাথে কথা বলার মুড আমার আর রইলো না। কল কেটে দিলাম। এরপর মায়ের মোবাইল থেকে আরও কল এলো দুইটা। আমি রিসিভ করলাম না। কেন করবো? মানুষের ভীড়ে এখন কি আর মানুষ পাওয়া যায় দুনিয়ায়?

ইমাম সাহেব মাইকে ঘোষণা করছেন আগামীকাল সকাল ৮ টায় ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হবে। আমার প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছে৷ ঘরে এক বিন্দুও কিছু নেই৷ বাইরে বৃষ্টি হওয়ায় কিছুটা ঠান্ডা ঠান্ডা আবহ কাজ করছে রুমে। আর নাহলে ছাদের গরমে এতক্ষণ অতিষ্ঠ হয়ে যেতাম। রুম ফ্যান ও নেই যে বাতাস দিবে।

রাত বেড়েই চলছে। এদিকে আসিফ আসছে না৷ আমার ভেতরে ভেতরে শঙ্কা বেড়েই চলছে। আসিফ কী তবে আবার মদ খেতে চলে গেলো? আমার শঙ্কা আরও গভীর হলো যখন আসিফকে কল দিলাম। কয়েকবার কল রিং হওয়ার পর সে ধরে বললো,

‘কী হলো? আমার আসতে দেরি হবে।’

‘কোথায় তুমি?’

‘যেখানে থাকার সেখানে।’

আসিফ কল কেটে দিলো। তার গলা শুনে আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না সে কোথায় আছে। আকাশ থেকে নেমে আসা বৃষ্টির মতো আমার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াতে লাগলো।

এদিকে তানিয়ার স্বামী তানিয়াকে হেসে হেসে বলছে,

‘তোমার কথামতো এক লাখ দিয়ে এলাম। এবার ঠিকঠাকমতো শালাবাবু নেশা করলেই হয়৷ আর যে মদখোর নেশাবাজ তোমার ভাই, টাকা হাতে এসেছে এখন এসব ছেড়ে কি থাকতে পারবে? পারবে না। এক লাখেও হবে না। তারপর আবার চলে আসবে। খোঁজে টাকা নিবে। আমিও দিবো।’

তানিয়া হেসে হেসে বললো,

‘এছাড়া কি আর কোন উপায় আছে বলো? তাই করতে হবে এবার৷ একে এভাবে শেষ না কর‍তে পারলে আমাদের সব যাবে। সব হাতছাড়া হবে। সব, সব, সব।’

অন্যদিকে আসিফে মা নুপুরের মাকে কল করে জিজ্ঞেস করলেন,

‘আমি যেমন বলেছিলাম আপনি তেমন করেছেন তো বেয়ান? জানি নুপুর আপনাকে খারাপ ভাববে৷ আসিফও আমাকে খারাপ ভাবছে। কিন্তু কিছুই করার নেই। যে ছেলেকে ঘরে রেখে আমি ঠিক করতে পারিনি, আজ সেই ছেলেকেই আমার নিজ হাতে নিজ থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছি শুধুমাত্র ভালোর রাস্তায় আনানোর জন্য। দুজনের সংগ্রামের জীবন হয়তো তাদেরকে নতুন এক জীবন দিয়ে দিবে। আমার একমাত্র ছেলের জীবন এভাবে নেশায়, মদে, নারীতে কাটুক এইটা মা হয়ে আমি আর দেখতে পারছি না। আজ যদি এমন না করতাম আমি, তাহলে হয়তো তার বোধশক্তি জাগ্রত হতো না। সে সংসারী হোক, বুঝুক সবকিছু এইটাই আমি চাই।’

‘হ্যাঁ বেয়ান। এজন্য আমিও তাদের এখানে থাকতে দেইনি। আপনার বলা মতোই তাদেরকে ইচ্ছা করেই চলে যাওয়ার রাস্তা করে দিয়েছি৷ জানি না ছেলেমেয়ে দুটো কেমন আছে এখন। আমার মন কেমন করছে যেনো তাদের জন্য’

‘কোন চিন্তা করবেন না। আল্লাহর কাছে দোয়া করুন৷ আল্লাহ অবশ্যই তাদের সাথে আছেন। তাদেরকে সাহায্য করবেন। তাদের পথ দেখাবেন৷ আচ্ছা বেয়ান আমি রাখি এখন।’

‘আচ্ছা। আসসালামুয়ালাইকুম’

‘ওয়ালাইকুমুস সালাম।’

তানিয়ার স্বামী তানিয়াকে জিজ্ঞেস করলো,

‘সব সম্পত্তি তোমার নামে হবে তো?’

‘আরে ছেলেই যখন থাকবে না তখন আমার ই তো হবে। আর বাকি থাকলো তামান্না। দেখি তার সাথে কী করা যায়৷ তুমি আমাকে কিছু সময় দাও। সময়ের কাজ সময়েই করবো। আসিফ নেশা করবে তো আবার?’

‘কেন নয়? এজন্যই তো টাকা দিলাম তাকে। আর সিগারেটের ভেতরেও গাঁজা ভরে দিয়েছি মিক্সড করে৷ যা চড়বে না একদম!’

স্বামী স্ত্রী পাষাণের মতো একে অন্যের গায়ে পড়ে হাসাহাসি করতে লাগলো।

রাত একটা হয়ে গেলেও আসিফের আসার কোন নাম নেই। হয়তো কোন বারে পড়ে আছে অজ্ঞান হয়ে। আমার মন বারেবারে ভেঙ্গে যেতে যেতে এখন কেমন জানি অসার হয়ে উঠেছে৷ অনুভূতি বলে কোনকিছু আর অবশিষ্ট রইলো না আমার।

(চলবে)

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_২৪
#মিদহাদ_আহমদ

*গ্রুপে এড হয়ে তারপর গল্প করবেন। কপি করে (অবশ্যই কার্টেসি সহ) অন্য কোথাও পোস্ট করার আগে অনুমতি নিবেন। শেয়ার করতে পারবেন। উন্মুক্ত

একটা দশের দিকে আমার ননাসের নাম্বার থেকে আমার নাম্বারে কল এলো৷ আমি কল রিসিভ করলাম। ননাস আমাকে জিজ্ঞেস করলো,

‘আসিফ বাসায় এসেছে নুপুর?’

আমি কিছুক্ষণ মৌণতা অবলম্বন করলাম। কিছু বলার আগেই ননাস বললেন,

‘কী আর করার! তোমার ভাগ্যটাই খারাপ৷ হয়তো দেখো কোথাও অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে৷ আল্লাহ তোমার ভালো করুক। আমার কিচ্ছু করার নাই। একমাত্র ভাইটা যে কেন এভাবে বিগড়ে গেলো আমি জানি না।’

আমি ননাসের কথায় কান্নায় ভেঙ্গে গেলাম। নিজেকে সামলাতে পারলাম না৷ কল কেটে দিলাম। মাটিতে নামাজ পড়ার জন্য যে ওড়না বিছিয়ে ছিলাম, সেই ওড়নায় লুটুপুটি খেয়ে কান্না করতে লাগলাম৷ আকাশ ফেটে হতে লাগলো মেঘের গর্জন। কারেন্ট নিয়ে নিলো। অন্ধকার ঘর আমার জীবনেও যেনো অন্ধকার নিয়ে এলো।

এদিকে তানিয়া কল রাখতেই তানিয়ার স্বামী বদরুল তানিয়াকে জিজ্ঞেস করলো,

‘কী বলেছে সে? আসিফ মাতাল হয়ে ঘরে ফিরেছে?’

‘আরে তুমিও না৷ মাতাল হয়ে কেউ ঘরে ফিরে বলো? আচ্ছা অনেক রাত হয়েছে। কিছু খেয়ে নেই৷ কাল আবার ঈদ। ঈদের রান্নাবান্না সব করা শেষ।’

তানিয়া রান্নাঘরে গেলো৷ মাকে কল করলো৷ তানিয়ার মা কল রিসিভ করলেন। তানিয়া তার মাকে নাকি গলায় বললো,

‘এসব ঠিক করলা না মা। জানি না ভাইটা আমার কোথায় আছে, কেমন আছে। হয়তো দেখো কোন জায়গায় মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পড়ে আছে। অন্য সময় হলে ঘরে পড়ে থাকতো। এখন হয়তো রাস্তায়৷ এভাবে ছেলেটাকে উচ্ছন্নে যেতে দিচ্ছো তোমরা!’

মেয়ের কথা শুনে আসিফের মা মনে মনে আল্লাহকে বললেন, আল্লাহ যেনো এমন কোনকিছু আর না করেন৷ এমন দিন যেনো আর না আসে তার ছেলের জীবনে৷ আল্লাহ যেনো নিজের ইচ্ছাতে তার ছেলের জীবন সুখময় করে তুলেন। তানিয়াকে জিজ্ঞেস করলেন,

‘ঈদের সবকিছু করা শেষ?’

‘হ্যাঁ মা। তুমি কী করেছো?’

‘সেমাই, হালিম, চটপটি আর বুন্দিয়া। তুই?’.

‘আমি সকালে সেমাই করবো৷ আর কিছু না৷ কে খাবে বলো? শ্বশুরবাড়ি যদি থাকতাম, তখন না হয় কথা ছিলো৷ অনেক জ্বালিয়েছে এরা আমাকে। জানো মা, তোমার জামাইর মতো মানুষ হয় না। কাল দুপুরে তোমার জামাইকে নিয়ে আসছি বাসায়।’

‘হ্যাঁ। আমিও বলতাম। চলে আসিস কাল দুপুরে। আর নাহয় সকালেই চলে আসিস। কেমন?’

‘আচ্ছা মা রাখছি এখন৷ ওর জন্য খাবার রেডি করতে এসেছি রান্নাঘরে।’

‘আচ্ছা।’

রাত দুইটা ছুঁই ছুঁই। বাসার কলিংবেলের শব্দ পেয়ে উঠে গেলাম আমি। অবসন্ন মনে দরজা খুললাম। আমি জানি সামনে দেখতে পাবো আসিফকে। মাতাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চয়ই! গা থেকে গন্ধ বের হচ্ছে তার হয়তো!

কিন্তু না। আমি দরজা খুলতেই আসিফ বলে উঠলো

‘এতক্ষণ লাগে দরজা খুলতে। এগুলো ধরো ধরো ‘

আসিফের হাত ভর্তি বাজার। নুপুর আসিফের হাত থেকে ব্যাগগুলো নিতে নিতে আসিফ বললো,

‘দরজা খুলা রাখো৷ নিচে একটা মিনি ফ্রিজ, খাট, চুলা আর হাড়িপাতিল আছে। এগুলো তুলছে ছেলেটা। আজ যা বাজার করেছি বুঝছো! একেবারে নাই। টুইটুম্বুর অবস্থা। ঈদের আগের রাতে এত বৃষ্টি! রাস্তাঘাট সব একেবারে কাঁদায় ভরে উঠেছে। বন্দর বাজারে তো হাঁটাই যাচ্ছে না। তুমি ব্যাগের বাজারগুলো সব রান্নাঘরে রেখে এসো।’

আসিফ নিচে নেমে গেলো। তার ভেজা চুলগুলো জড়ো হয়ে আছে যেনো। একটা লোক ফার্ণিচারগুলো উঠিয়ে ফিক্সড করে দিয়ে গেলো। আসিফ বাথরুমে ঢুকলো। গোছল করে বের হয়ে এলো৷ আমি রান্নাঘরে ছিলাম। অবাক মনে বাজারগুলো দেখছিলাম। ব্যাগ থেকে একে একে সেমাই, দুধ, চাল, ডাল, তেল, মোরগ আর কচু শাক বের করালম। আসিফ এসেই পেছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। তার গোছল করা শরীর আমার শরীরে লাগতেই আমি ঠান্ডায় কেঁপে উঠলাম। পেছন ফিরে দেখলাম একটা টু কোয়ার্টার প্যান্ট পরে সে দাঁড়িয়ে আছে। আমি একটা টিশার্ট এনে দিয়ে বললাম,

‘এইটা গায়ে জড়িয়ে নাও।’

আসিফ টিশার্ট পরতে পরতে বললো,

‘কী হয়েছে? চোখ ফোলা ফোলা কেন? ‘

আমি জবাব দিলাম না৷ আসিফ আমার চুয়াল ধরে আমার মুখটা উঁচিয়ে ধরলো। আমাকে বললো,

‘কী হয়েছে? অভিমান?’

তারপর সে তার সুরেলা গলায় গেয়ে উঠলো,

‘আমারে আসিবার কথা কইয়া
মান করে রাই গিয়াছে ফিরিয়া
আমি আর কতকাল থাকবো রাধে গো?
মান করে রাই, গিয়াছে ফিরিয়া’

আমি আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না৷ জড়িয়ে ধরলাম আসিফকে। আমার অজান্তেই দুই চোখ দিয়ে অশ্রুধারা বইতে শুরু করলো। আসিফকে বলতে লাগলাম,

‘আমার সাথে মজা কর‍তে খুব ভালো লাগে? জানো আমি কেমন ছিলাম এই কয়েক ঘন্টা? জানো আমি কী না কী ভাবছিলাম? তুমি যদি আবারও এমন করো। আবারও ওমন হয়ে যাও? যদি আবারও এসব…’

আসিফ আমার মুখে হাত দিয়ে আটকে দিলো। তারপর আমার হাত তার মুখ বরাবর উঠিয়ে চুমু খেয়ে বললো,

‘ভয় পেয়েছো খুব?’

আমি বাচ্চা মেয়েদের মতো আবারও তাকে জড়িয়ে ধরলাম। আসিফ আমার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,

‘আই এম সরি। আমি তোমার প্রেমে পড়ে গিয়েছি নুপুর। আই লাভ ইউ৷ জানি না তুমি আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছো। আমি বুঝতে শিখেছি পরিবার কী জিনিস, সংসার কী জিনিস। জানো, দুলাভাইর দেয়া টাকাটা নিয়ে আমি ঠিকই মদ খেতে চলে গিয়েছিলাম। বসেও ছিলাম। পরক্ষণেই নিজেকে সংযত করলাম। নিজেকে বুঝালাম, আমার সংসার আছে, আমার ঘরে এক সুন্দরি বউ আছে, আমার নুপুর আছে। আমাকে এসবে মানায় না। আই লাভ ইউ নুপুর। আজ লাভ ইউ ‘

আমি অনুভব করতে লাগলাম আসিফের ভেতরে থাকা ভালো মানুষের নিশ্বাস। একজন মানুষ কতটুকু ভালোবাসতে পারলে এভাবে নিজের এক জন্মের খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করতে পারে। আসিফ আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,

‘এক মিনিট। আমি আসছি।’

তারপর আসিফ রুমে গিয়ে একটা প্যাকেট নিয়ে এলো রান্নাঘরে৷ আমি জিজ্ঞেস করলাম,

‘কী এতে?’

‘আরে দেখাচ্ছি।’

আসিফ প্যাকেট খুললো। দেখলাম একটা সাদা গাজরা আর এক পাতা কালো টিপ, আর দুই ডজন সিলভার কালারের চুড়ি। আসিফ এগুলো আমার হাতে দিয়ে বললো,

‘ আগামীকাল আপুর দেয়া ঈদের শাড়িটার সাথে এগুলো পরলে তোমাকে দারুণ মানাবে।’

আমি হেসে কুটিকুটি হয়ে গেলাম৷ লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম। এ যেনো এক নতুন কুড়িতে প্রবেশ করার উদ্যম। শিহরণে বেঁচে থাকা নতুন প্রেম। আলোর ছটাকে মিশে থাকা ভালোবাসার রঙ৷ মানুষের মনের ভেতরে প্রবাহমান সিন্দু নদ।

আসিফ বললো,

‘আরেকটা কথা বলার আছে।’

‘কী?’

আসিফ রুমে গিয়ে একটা একশো এম এল এর হুইস্কির বোতল নিয়ে এসে দেখিয়ে বললো,

‘এইটা নিয়ে এসেছি। আপনাকে দেখাচ্ছি৷ জানি আপনি না করবেন। তার পরও আমি ছাড়তে পারলাম না। অনেক আটকিয়ে রাখলাম। তবুও নিয়ে এলাম। যদি আপনি কিছু মনে না করেন, তাহলে এইটা শুধুমাত্র আজ আর কালের জন্য? ঠিক আছে?’

আমি হ্যাঁ বা না কিছুই বললাম না। শুধু ভেতরে ভেতরে ভেবে নিলাম, একজন মানুষ যে কিনা প্রতিদিন প্রায় এক লিটারের উপর মদ গিলতো, সে যদি আজ দুইদিনে ৫০ এম এল মদ খেতে চায়, তাহলে তাকে নিষেধ দিয়ে না, তাকে ভালোবেসে দূরে নিতে হবে। ভেতরে ভেতরে পণ করে বসলাম, আসিফ যখন দুই পা এগিয়ে এসেছে নব জীবনের দিকে, আমাকে তখন দুইশো পা এগিয়ে আসতে হবে। আমার এই জীবন এখন শুধু সংগ্রামের না, নতুন করে মানবজন্ম শুরু করার। এক নতুন পৃথিবী গড়ে তোলার।

আসিফ বললো,

‘আমার খুব ক্ষুধা পেয়েছে? রান্না করবা না?’

আমি বললাম,

‘হ্যাঁ করছি৷ তুমি গিয়ে রেস্ট নাও।’

‘না। আজ একসাথে রান্না করবো।’

‘পারবা তুমি?’

‘কেন পারবো না? আরে রান্না একটা আর্ট। এই আর্ট আবার পারা না পারার কি আছে? তুমি কাটিকুটি করে ফেলো। আমাকে হাড়ি বসিয়ে দাও। আমি রান্না করে ফেলি।’

‘হাড়ি? হাড়ি কোথায়?’

‘অহ শিট! আমি হাড়ি আনতে ভুলে গিয়েছি৷ এখন রান্না করবো কীভাবে?’

‘কীভাবে?’

‘কীভাবে?’

‘আচ্ছা আমি দেখছি পাশের ফ্ল্যাট থেকে নিয়ে আসা যায় কিনা।’

‘মাত্র আজ এলাম আর এক্ষুণি! আমিও না সবকিছু আনলাম কিন্তু রান্না করবো যেখানে সেটাই তো নিয়ে আসা হলো না।’

‘আচ্ছা বাবা সমস্যা নেই। আমি দেখছি পাশের ফ্ল্যাটে গিয়ে।’

ঈদের আগের রাত। প্রায় সবাই সজাগ। আমি আমাদের ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে পাশের ফ্ল্যাটে বেল চাপলাম। আসিফ আমার সাথে সাথে এলো। সে দরজায় দাঁড়ানো। পাশের ফ্ল্যাট ঠিক সামনাসামনি৷ কলিংবেল দেয়ার সাথে সাথেই এক মহিলা এসে দরজা খুলে দিলো। বয়স চব্বিশ পঁচিশ হবে। গায়ের রঙ শ্যামলা। চুল রঙ করা। পরনে টিশার্ট আর স্কার্ট। মুখে হাসি এনে বললো,

‘অহ আপনারা নতুন এসেছেন না আজ?’

‘হ্যাঁ। এই রাতে আপনাকে একটু ডিস্টার্ব দিতে আসলাম। একটা হাড়ি কি দেয়া যাবে? আমাদের হাড়িপাতিল কিচ্ছু নেই আপাতত’

‘হ্যাঁ অবশ্যই।’

মেয়েটা একটা হাড়ি এনে দিলো ভেতর থেকে। আসিফ দরজায় দাঁড়ানো ছিলো। সে আসিফকে দেখে বললো,

‘উনি কি আপনার স্বামী?’

‘হ্যাঁ।’

‘সো স্মার্ট! মাশাআল্লাহ! চোখ আটকে যায় যেনো!’

আমি মেয়েটার থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় ঢুকলাম। আসিফকে বললাম,

‘তোমাকে কে বলেছে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে?’

‘কেন? আমাকে সুন্দর বলায় হিংসা হয় বুঝি?’

এদিকে নিজেদের ফ্ল্যাটে তানিয়া রান্নাঘরে খাবার রেডি করছে। অন্যদিকে তানিয়ার স্বামী বদরুলের মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠলো। বদরুল কল রিসিভ করলো৷ ওপাশ থেকে বদরুলের মা বদরুলকে জিজ্ঞেস করলেন,

‘কীরে? কাজ কতটুকু?’

‘উহু! এভাবে কল করলে হবে? যদি সে দেখে ফেলে? আমার কাজ আমাকে করতে দাও না। মা বাবা ছাড়া, পরিবার ছাড়া এভাবে একটা ভাড়া বাসায় একা একা ঈদ করছি তো তোমাদের জন্যই তাইনা? এভাবে একটা মেয়ে যার সাথে আমার কোন ফিউচার নেই, যার কোন সন্তান হবে না তার সাথে আমি আমার জীবন কাটিয়ে দিতে পারি বলো? আর তোমার ভাইয়ের মেয়ে তো আবার আসছেই দেশে সামনে৷ আমাদের তখন বিয়ে হবে। এখন তানিয়াকে বশ করে ওর বাবার সব সম্পত্তি যদি আমার অংশীদারদের করে নিতে পারি, তাহলে কাজের কাজ কিছু একটা হলো৷ এজন্য এই মেয়েটাকে এখন পজেটিভ রাখা লাগছে। নাহলে আমার কি আর এতো ইচ্ছা যে আমি তার ভাইয়ের হাতে এক লাখ টাকা তুলে দিবো?’

খোদেজা বেগম ওপাশ থেকে এক লাখ টাকা শুনে তব্দা খেয়ে গেলেন৷ জিজ্ঞেস করলেন,

‘এক লাখ টাকা? কেন?’

‘উফ! এইটা ইনভেস্ট। কোটি কোটি টাকার মালিক হতে হলে কয়েক লাখ টাকা তো খোয়াতেই হয় তাইনা? ওর ভাই তো জানোই বউয়ের হাত ধরে বাড়ি ছাড়া এখন। শাশুড়িও নানা কথা শুনিয়ে তাকে বের করে দিয়েছে৷ এখন সে ছন্নছাড়া হওয়ার সবচেয়ে বড় সুযোগ৷ হাতে এক লাখ টাকা মানে সে আবার নেশা করতে যাবে। নেশা করবে৷ বুদ হয়ে রইবে নিজের দুনিয়ায়৷ আর অন্যদিকে আমি আমার সব কাজ করতে থাকবো৷ কৌশলে সবকিছু হাতিয়ে নিবো৷ দেখবা তখন আমাদের আর কোন চাহিদা থাকবে না। কিছুদিন কষ্ট করো মা। আর কিছুদিন মাত্র। এদের এভাবে ছাড়লে হবে না।’

খোদেজা বেগম বললেন,

‘দেখ বাবা, যে মেয়েটা সম্পত্তির লোভে তার আপন ভাই, তার মায়ের পেটের ভাইকে খারাপ পথে ঠেলে দিতে একটুও ভাবে না, সে কাল সম্পত্তির জন্য তোকেও দূরে ছেড়ে দিতে এক মুহূর্তও ভাববে না। আমি আগে ভাগে সাবধান করে দিচ্ছিন’

‘হা হা। এইটাইতো মা। দুনিয়ার মানুষজন সব আজকাল কেমন জানি এক অদ্ভুত পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। সামান্যতম মানবিকতা মানুষের মাঝে নাই। আচ্ছা মা কল রাখছি এখন। পরে কথা হবে৷’

বদরুল কল রেখে পেছন ফিরে তাকালো। পেছন ফিরতেই দেখে পানির গ্লাস হাতে তানিয়া দাঁড়িয়ে। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে উঠলো সে।

(চলবে)