বিন্নি ধানের খই পর্ব-৩+৪+৫

0
389

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_০৩
#মিদহাদ_আহমদ

বিয়ের রাতে স্বামীর দ্বারা এক প্রকারের ধর্ষণ হয়েছিলো আমার। কী করেনি লোকটা আমার সাথে! চোখ বেয়ে টপাটপ অশ্রু আর সাথে আমার জমে থাকা আর্তনাদ আমাকে ভেতর থেকে নিশ্বেষ করে দিচ্ছিলো যেন! এ কোন নরকে আসলাম আমি৷ তার সাথেসাথে আসিফের মুখের অশ্রবণীয় সেই কথাগুলো! কথায় কথায় গালিগালাজ! বাজে ভাষা ব্যবহার করে সে বলছিলো,

‘টাকার লোভে বিয়ে করেছিস, তখন তো তোকে খেতেই হয়। একটা না একটা কাজে লাগ৷ তবে তোকে আমি আমার স্ত্রী মানি না। এই বিয়েই আমি মানি না।’

ভোর হতেই যেনো সেই রাতের সমাপ্তি ঘটলো৷ ইতি ঘটলো এক নরকীয় যন্ত্রনার। আমি ফ্রেশ হয়ে শাড়ি পরে এসে বসে রইলাম খাটের এক কোণে। এরমধ্যে আসিফ সিগারেট খেয়ে, টু কোয়ার্টার প্যান্ট পরে খালি গায়ে কোলবালিশ সাথে করে ওপাশ ফিরে শুয়ে রইলো৷ কিছুক্ষণ পর ননদ এসে আমাকে ডেকে নিয়ে গেলো বাইরে। বাবা এসেছেন নাস্তা নিয়ে। ননদ আর ননাস মিলে এসব খুলছিলো। ননাস আমাকে সরাসরি বলেই বসলো,

‘এই পরোটা আর ফার্মের মোরগী ভূনা দিয়ে তোমাদের নাস্তা হয়তো হয়, আমাদের নাস্তা হয় না। রান্নাঘর থেকে কাজের মেয়ে ট্রেতে করে চায়ের সাথে বিস্কুট নিয়ে যাচ্ছিলো। আমার ননাস ওকে দাঁড় করিয়ে বিস্কুটের প্লেইট রেখে বললো

‘ওসব ড্রাইকেক বড়লোকের খাবার। গরীবের পেটে ওসব হজম হবে না।’

কথাটা ডায়নিং রুমে থাকা সবাই শুনতে পেলো যেনো! আমি দেখলাম সকালের নাস্তার এক টিফিন ক্যারিয়ারে গরুর কলিজিও আছে। আমার মনে পড়ে গেলো আমার ছোট ভাইটার কথা! মাস দুয়েক আগে টিভিতে কলিজা রান্না দেখে সে আবদার করেছিলো তাকে কলিজা রান্না করে খাওয়াতে। বাবা আনতে পারেন নাই। আজ হয়তো সকালে সে কলিজি খেয়েছে। এই শান্তিতে আমি পূর্ণ থেকে গেলাম।

দুপুর নাগাদ আমার বাড়ি থেকে এক গাড়ি ভর্তি লোকজন আমাদের এই সিলেট শহরের আলিসানে আসলো। আমাদের বাড়ির লোকজনেরা আমাদের এই বিশাল অট্টালিকা চেয়ে চেয়ে দেখছিলো শুধু। আমাকে আমার রুমে নিয়ে গেলেন আমার মা। আমাকে বিছানায় বসিয়ে রেখে বললেন,

‘মারে, সব ঠিকঠাক আছে তো এখানে?’

আমি মাকে বলার আগেই মা আমাকে জড়িয়ে ধরব বললেন,

‘জানি মা সব ঠিকঠাক নেই। তোর মামা আমাকে আগেই বলেছে সবকিছু। আর দামান্দ ছেলে মানুষ। এখন হয়তো অসুবিধা আছে, হচ্ছে৷ দেখবি মা সব ঠিক হয়ে যাবে। আর ওসব তো ওর আগের সম্পর্ক। সেই সম্পর্ক কেউ মেনে নেয়নি। তাইতো বিয়ে দিয়েছে। আর নাহলে কি আর আমাদের মতো গরীব ঘরের মেয়েকে কেউ বিয়ে করে আনে?
জানিস মা, তোর শ্বশুর বাড়ি থেকে আমাকে নগদ তিন লক্ষ টাকা দিয়েছে। আমি তোর বাবাকে বলিনি৷ তোর বিয়ের জন্য মানুষটা ঋণ নিয়েছে পাঁচ লাখ টাকা। ঘরের টিন ফুটা। আসছে বর্ষার আগে যদি ঠিক না করাই, তাহলে তোর অসুস্থ বাবা আর ছোট ছোট ভাই বোনদের নিয়ে থাকবো কীভাবে? তুই হয়তো ভাবছিস তোর মা তোর সাথে অবিচার করেছে। কিন্তু মা দেখ, এই যে বিশাল ঘর, এই যে দুই মুঠো খাবার, সম্মান, এতকিছু তুই এই ঘরে পাচ্ছিস, এরচেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে? এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে? আমার মতো বাসন মেজে, মাটির ঘর টিপতে টিপতে তো তো দিন পার করা লাগবে না। এরচেয়ে তো তুই অনেক ভালো আছিস রে মা। অনেক ভালো আছিস। দেখিস মা, তুই এখানে অনেক ভালো থাকবি৷ পেট ভরে ভাত খেতে পারবি, একবেলা শান্তিতে ঘুমাতে পারবি। মা যাই করেছি শুধু তোর ভালোর জন্যই করেছি। এখানে বিন্দুমাত্র আমার নিজের স্বার্থ নাই রে মা।’

মায়ের এই কথাগুলো শুনে আমি থ বনে গেলাম। আমার অনুভূতি শক্তি একেবারে শেষ হয়ে এসেছে যেনো৷ মুখের বাসা উবে গেলো মুহূর্তেই। বলার কোন ইচ্ছা আমি পেলাম না ভেতর থেকে। শুধু দুই চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। মা তার আচল দিয়ে আমার চোখের কোণা মুছতে মুছতে আবার বলা শুরু করলো,

‘দুনিয়া অনেক কঠিন রে মা। এই দেখ, লোকজন তোর কত সুনাম করছে, তোর ভাগ্যের তারিফ করছে, এই ভাগ্যের জন্য হলেও অনেক কিছু আমাদের বিসর্জন দিতে হবে। আমাদের মেনে নিতে হবে। এছাড়া আর এই গরীব ঘরের মেয়েদের কোন উপায় নেই, কোন জীবন নেই।’

আমি মাকে এবার বললাম,

‘তোমার ভাইও তাহলে আমাকে বিক্রি করে চার লাখ টাকার মালিক হয়েছে তাইনা?’

মা আমার মুখ চেপে ধরলেন৷ আমার হাতে শক্ত করে ধরে বললেন,

‘এসব কী বলছিস তুই? যা মুখে আসছে তা? তোর শ্বশুর বাড়ির লোকজন তাকে দিয়েছে মেয়ে খুঁজে এনে দেয়ার জন্য৷ সে তোকে না দিলে অন্যকে এনে দিলেও এই টাকা নিতো৷ এখানে তুই অন্যায়ের কী দেখিস? কী বলছিস এসব?’

‘অহ! বুঝতে পেরেছি। তাহলে আমার মা আমাকে তিন লাখে, আর আমার মামা আমাকে চার লাখে এই আলিশানে বিক্রি করে দিয়েছে। এইতো?’

এমন সময়ে আমার ছোট ভাই আমার রুমে এসে ঢুকলো। আমাকে জড়িয়ে ধরে সে বললো,

‘জানো জানো আপু, আজ সকালে আমি পেট ভরে গরুর কলিজা খেয়েছি। আমি কলিজা এর আগে জীবনেও খাইনি৷ এতো স্বাদ! ইশ। তুমি থাকলে না, তোমাকেও খাইয়ে দিতাম। আমার তো দারুণ লেগেছে৷ মা আমাকে পুরো জামবাটির অর্ধেক বাটি খেতে দিয়েছে আপু। আজ একদম আমার মনভরে খাওয়া হয়েছে ‘

কথাগুলো বলেই আমার আট বছর বয়সী ভাই আমাকে জড়িয়ে ধরলো।

(চলবে)

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_০৪
#মিদহাদ_আহমদ

মাস দুয়েক যেতে না যেতেই শাশুড়ি সবার সামনে প্রকাশ্যে বলে বেড়াতে লাগলেন, আমার মামাকে চার লাখ আর আমার মাকে তিন লাখ টাকা দিয়ে আমাকে এনেছেন তিনি এই ঘরে। আত্মীয়-স্বজন সবার সামনেই যেনো আমি এক লোভী, অপরাধী হয়ে উঠলাম। আমার আত্মসম্মান বলে কোনকিছুই এই বাড়িতে নেই যেনো। বাড়িতে গিয়ে গতমাসে মামাকে এনে সামনাসামনি আমি জিজ্ঞেস ও করেছিলাম, কেন তিনি আমার সাথে এমন করলেন! কেন তিনি আমাকে জেনেশুনে এই নরক যন্ত্রনার মাঝে ঢাললেন! যে ছেলের রাত কাটে মদের বার আর নারীতে মত্ত হয়ে, যে ছেলে আমাকে বিয়ে করতে অসম্মতি জানিয়েছিলো, যে ছেলের সাথে আরও কত মেয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো, জেনেশুনে কেন সেই ছেলের ঘরে আমাকে পাঠালেন!

মামা সেদিন আমাকে জবাব দিয়েছিলো,

‘আমার বোনকে তোর বাবার ঘরে বিয়ে দিয়ে আমি কী পেয়েছি? আমার একমাত্র বোন বাসন মাজতে মাজতে, সংসারে বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে, মাটির বেড়া দেওয়া ঘর আর ধান মাড়াতে মাড়াতে জীবন পার করে দিলো। আমি মামা হয়ে এই একই জীবন তোকেও দেখতে দিতে পারতাম?’

মাও এসে মামার সাথে এক হয়ে গেলো যেনো! মা আমাকে বসিয়ে বুঝালো

‘দেখ মা, তোর এত বড় বাড়ি আছে, আলিশান আছে৷ শ্বশুর, শাশুড়ি পরিবার আছে। দুবেলা দুই মুঠো খেতে পারছিস। আর কী চাই?’

আমার ফ্যালফ্যাল করা চোখে তখন আর আটকাতে পারলো না৷ কান্না আসা চোখ নিয়ে মাকে বললাম,

‘আমি কি আমার বাবার ঘরে অভুক্ত থেকেছি মা? তুমি কি একদিনও অভুক্ত থেকেছো? বাবা কি তোমাকে এক দিনের জন্যও মানসিক কষ্টে রেখেছিলো?’

মা বললো,

‘দেখ মা, মানসিক কষ্টের চেয়েও বড় কষ্ট কী জানিস? না পাওয়া। আমার না পাওয়া আমাকে আজীবন শেষ করে দিয়েছে। আমি চাই না আমার এই না পাওয়া আমার মেয়েকে ভর করুক।’

তারপর মা আমার সামনে তার হাত দুইটা তুলে ধরে দেখিয়ে আমাকে বললো,

‘এই দেখ! এই দেখ আমার হাত দুটো। কী দেখছিস? রঙ উঠা দুই গাছা সিটি গোল্ডের চুড়ি তাইনা? এই হাতে কখনো স্বর্ণ কী জিনিস আমার চেখে দেখা হয়নি। দেখ তোর হাত দু খানা। দুই দুই করে চারগাছা স্বর্ণের চুড়ি। কে পরেছে এমন? আমাদের আশেপাশের কোন ঘরের মেয়ে এমন স্বর্ণের চুড়ি পরে আছে? হাতের দশ আঙুলের মাঝে পাঁচ পাঁচটা স্বর্ণের আংটি, নাকে হীরার নাকফুল, গলায় ভারি চেইন, এসব কার আছে? কাদের আছে রে মা? এই মা কি কখনো তার মেয়েকে এমন দেখতে চায় না? এমন দেখাও কি পাপের?’

আমার ভেতরতা আরও নিশ্বেষ হয়ে যেতে লাগলো। আমার হাতের স্বর্ণের চুড়ি যে আমাকে চিরতরে বেধে রেখেছে! আমাকে কুন্ঠিত করে রেখেছে নিজের স্বপ্নের কাছে, নিজের ইচ্ছার কাছে, নিজের সবকিছুর কাছে। বাবা এমন সময় ঘরে এসে ঢুকলেন৷ আমি বাবার পাশে গিয়ে বসলাম। বাবা জিজ্ঞেস করেছিলেন কেমন আছি৷ সবাই কেমন শ্বশুরবাড়িতে। আমি অবলীলায় মুখে হাসি এনে মিথ্যা বলেছিলাম বাবাকে,

‘আমি খুব ভালো আছি।’

বিকালেই গাড়ি চলে আসে আমার বাবার মাটির বেড়া আর টিনের চালা দেয়া বাড়ির সামনে। টয়োটা প্রভোক্স নাম। কালো রঙের গাড়ি। যেনো চকচক করছে! আমার ছোট ভাই বোনেরা গাড়ির সামনে পিছে থেকে সরছেই না যেন! আমাকে এসে জিজ্ঞেস করছে,

‘আপু এই গাড়িটা দুলাভাইয়ের গাড়ি? সত্যিই নাকি?’

সহাস্যমুখ এনে ভাইদের বলেছিলাম,

‘হ্যাঁ এইটা তোদের দুলাভাইয়ের গাড়ি।’

ভেতরে ভেতরে আমি আবার নিষ্পেষিত হচ্ছিলাম কাকে আমার ভাইদের পরিচয় দিচ্ছি দুলাভাই হিসাবে! সেই পাষণ্ড অমানুষকে?

আমি বের হওয়ার সময়ে সেদিন মায়ের ঠিক আগের কান্ডই চলতে লাগলো। সবাইকে ডেকে এনে আমাকে বিদায় দেয়া। আমার বুঝতে বাকি রইলো না, এই বিদায়ের মাঝে ছিলো লোক দেখানোর বিদায়। মা আমাকে না, বরং আশেপাশের বাড়ির লোকদের ডেকে এনেছিলো আমার গাড়ি দেখানোর জন্য! মানুষের স্বপ্ন এমনও হতে পারে! অথচ আমার যে কখনো এসবে টানতো না। আমার যে এসবে আকৃষ্ঠ করতো না।

এদিকে শাশুড়ি আর ননদ ননাস মিলে আমার জীবনটাকে নরকে পরিণত করে দিতে লাগলো। রাতে ইয়াশ দেরি করে মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরতো রোজ রোজ৷ ননাস কল করে আর নাহলে সকালে বাসায় এসে রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে সে কী কথা শুনাতো আমাকে!
অশালীন ভাষার বহর আর সাথে সাথে বলতো,

‘নারী হয়ে জন্মেছো, জামাই ধরে রাখতে পারো না? নাকি জামাই ধরে রাখার কোন মতলব নাই? কোনটা?’

আমি শুধু নীরবে সয়ে যেতাম এসব। কোন কথা বলতাম না। কোন প্রতিবাদও না৷ আমার ভেতরের আমিটা যেনো কোথায় মারা গিয়েছিলো, সেইটা হয়তো আমিও জানি না।

প্রথম রমজানের ইফতারে আমার শ্বশুরবাড়ির সবার মন ভরেনি। আগামীকাল রমজানের বড় ইফতারি আসবে আমার বাড়ি থেকে। শাশুড়ি শুনলাম সকাল থেকেই একে ওকে দাওয়াত দিচ্ছেন আর বলছেন, ‘আগামীকাল আমার ছেলের শ্বশুর বাড়ি থেকে বড় ইফতারী আসবে৷ আপনারা সবাই চলে আসবেন।’

শ্বশুর এদিকে প্যান্ডেল বাধাতে লাগলেন ছাদে। শাশুড়ি এসে বললেন,

‘শুনো, বেশি কাওকে বলিনাই। একান্ত কাছের লোকজন, আত্নীয়-স্বজন সব মিলিয়ে দাওয়াত দিয়েছি দেড়শো জনের মতো। তোমার বাবাকে আগেই কল করে জানিও দিও যে কমপক্ষে দুইশো লোকের ইফতারি যেনো পাঠায়। আর ঈদের কাপড় এখন দিতে সমস্যা হলে, এখন দেওয়ার প্রয়োজন নেই৷ ঈদের বাকি আছে সপ্তাহ দুয়েক। কয়েকদিন পর ঈদের কাপড় দিলে চলবে।’

শাশুড়ির বলা কথাগুলো আমি নীরবে শুনলাম শুধু। নিরুপায় একদিনে আর অন্যদিকে ক্ষোভে, রাগে মাকে কল করে বললাম,

‘শুনো মা, তোমার বড়লোক মেয়ের সম্মান তো তোমাকে দেখতে হবে তাইনা? এসব ফকিন্নি ঘরের ইফতারি তো আমার বাড়িতে দিলে চলবে না। আর প্রথম রমজানে যা দিয়েছো, তাতে আমার মান থেকে অপমান বেশি হয়েছে। আগামীদিনের ইফতারিতে কি কি দেয়ার পরিকল্পনা চলছে জানতে পারি কি?’

মা আমাকে বললেন,

‘আরে আমি বুঝেছি মা। আসলে তোর বাবার হাতে টাকা ছিলো না তো। এখন দেখ, তোর বাবা ধান বিক্রি করেছে গত সপ্তাহে তোর বাসায় ইফতারি দিবে বলে। খুব ঘটা করেই দিবে। তুই কোন চিন্তা করিস না। আমরা সবকিছু দিয়েই দিবো যাতে তোর কোন শরম না হয়। তোর বাবা বলেছে আগামীকাল সব মিলিয়ে চল্লিশ জনের ইফতার আমরা পাঠাতে পারবো। টাকা বারো হাজার লোকটা আলাদা করেই রেখেছে তোর বাড়িতে ইফতারি দিবে বলে। সবকিছু কিনেই পাঠাবো৷ আর হ্যাঁ, খেজুর, দই, ফলফ্রুট সব যাবে মা। কোন চিন্তার কারণ নেই। তুই কিচ্ছু চিন্তা করিস না।’

মায়ের মুখে জন চল্লিশের ইফতারি দেয়ার খবর শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম যেনো! কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম আমি সেই মুহূর্তে।

(চলবে)

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_০৫
#মিদহাদ_আহমদ

ইফতারিতে শাশুড়ির আবদার, কমপক্ষে যেনো দুইশো লোকের ইফতার আসে আমার বাপের বাড়ি থেকে। এদিকে আমার মা, উৎসাহ, আমেজ নিয়ে বলছে, বাবা ধান বিক্রি করেছেন, আগামীকাল ঘটা করে চল্লিশ জনের ইফতারি নিয়ে আসবেন! আমার গরীব মা বাবার কাছে চল্লিশ জনের ইফতারি নিয়ে আসাটা যেটা ঘটা করে আসা হিসাবে পরিগণিত হচ্ছে, সেই ঘটা করে ইফতারি নিয়ে আসলে আমার শাশুড়ি মা আমাকে কথা শুনাতে আস্ত রাখবেন না। আমি কিছুক্ষণ চুপ রইলাম ফোনের মাঝে। মা আমাকে আমার উৎসাহ নিয়ে বললেন,

‘নুপুর, বাড়িতে যে মোরগ পেলেছিলাম না, ওগুলা সব আজ জবাই করে ফেলেছি। গুণে গুণে চারটা মোরগ। দেশি মোরগের পোলাও দেখিস তোর শ্বশুর বাড়ির সবার পছন্দ হবে।’

এদিকে আমি মনে মনে ভাবছি, মোরগে আমার শ্বশুরের এলার্জি৷ এই বাড়িতে কেউ মোরগ খায় না। তার উপর আগামীকাল মোরগ পোলাও নিয়ে আসলে অবস্থা বেগতিক হয়ে যাবে।’

এদিকে মা আবার বললেন,

‘জানিস নুপুর, প্রথমে ভেবেছিলাম ত্রিশ জনের ইফতারি দিবো, পরে ভাবলাম কম হয়ে যাবে। চল্লিশ জনের ইফতারি আসবে। তুই কোন চিন্তা করিস না ‘

অন্যদিকে আমার শাশুড়ি মা আশা করে বসে আছেন দুইশো জনের ইফতারির!

আমি এবার নিজের বাধ ভেঙ্গে ফেললাম। জানি আমার অসহায় বাবা মায়ের কোন উপায়েই এই বিশাল অঙ্কের টাকার আয়োজন করে দুইশো লোকের ইফতারি নিয়ে আসা সম্ভব না। আমি আমার রুমের ভেতরের কোণায় বসে, উচ্চকণ্ঠের সাথে মাকে বললাম,

‘যখন সব নিয়ম মেনে চলতে পারবে না, তখন কেন আমাকে বিয়ে দিয়েছো এমন ঘরে? বামুন হয়ে চাদে হাত দেয়ার স্বপ্ন কেন দেখেছো? কেন আমাকে এই নরকে ফেলেছো? এখন আবার কেনই বা তাদের সমানে তাল মেলাতে পারছো না? কেনই বা এমন অসহায়ের মতো আমার কাছে এসবের ফিরিস্তি দিচ্ছো মা।’

আমি বুঝলাম আমার এই আকস্মিক কথায় আমার মা তথমথ খেয়ে গিয়েছে। আমি মাকে সরাসরি বললাম এবার,

‘জানো আমার শাশুড়ি কতজনকে দাওয়াত করেছেন? জানো বাসার ছাদে প্যান্ডেল হচ্ছে আমাদের এখানে? জানো আগামীকাল বিশাল আয়োজন করা হচ্ছে ইফতারির। আর সেই ইফতারি আসবে তাদের পুত্রবধূর বাপের বাড়ি থেকে। চল্লিশ জনের ইফতারি না কিন্তু, এক এক করে পুরো দুইশো জনের। আর তোমার মোরগ পোলাওয়ের ইফতারি না৷ গরুর পোলাও, খাসির রেজালা, ভালো ভালো ফল, মন সমান ছানার দামি মিষ্টি, অর্ধ মন চিকন জিলিপি আরও কত কি! আর তুমি কিনা আমাকে হিসাব দিচ্ছো জন চল্লিশের? মা আমার কথা শুনতে কষ্ট হবে তোমার। হচ্ছেও হয়তো। তবে কেন এমন করতে গেলে? কেন এমন অসমতার মাঝে নিজেকে জড়িয়ে নিলে? কেন আমার অসুস্থ বাবাকে এখন চাপ দিয়ে মেরে ফেলছো প্রতি ক্ষণে ক্ষণে? আর তোমাদের ধান কি খুব বেশি উপরি থেকে যাচ্ছে আমার বিয়ের পর? যা ধান পাও, সেই ধানের চাউলেও তো আমি থাকতে মাস চারেকের বেশি যেতো না। এখন বুঝি সেই মাস চারেকের ধানও বিক্রি করতে বসেছো? এখানে এসির ভেতরে, আলিশানের ভেতরে, দামি শাড়ি, দামি গহনা, হাত ভর্তি সোনার চুড়ির মাঝে আমার আটকা জীবনের বিনিময়ে তোমরা মরে যাবা এখন? এটাই কি জীবন? আমার স্বপ্নগুলোও ভেঙ্গে দিলা! আমার ইচ্ছা ছিলো মেডিকেলে পড়ার৷ ডাক্তার হওয়ার৷ আমার সেই ইচ্ছাগুলো? আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেলো৷ সবকিছু… ‘

আমার কথাগুলো সব মা শুনলো। মা কোন উত্তর দিলো না তেমন করে। শুধু বললো,

‘আচ্ছা আমি দেখছি।’

আমি ঠিক বুঝতে পারলাম, মা নিশ্চয়ই আবুল চেয়ারম্যানের ভাগনার কাছে যাবে এই সন্ধ্যারাতে। তারপর ঠিক সে সেখান থেকে কড়া শোধে টাকা চেয়ে আনবে। আর সেই কড়া শোধের টাকা পরিশোধ করতে আমার অসুস্থ বাবার মাঠের কাজ বিকালে শেষ হওয়ার কথা, সেই কাজ বাবা নিশ্চয়ই সন্ধ্যা পর্যন্ত বাড়িয়ে নিবে৷ বিনিময়ে আমার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা ইফতার করবে। দুইশো লোক জানবে, তাদের ছেলের বিয়ে করা বউয়ের বাড়ি থেকে ইফতার এসেছে! আহা! কী আয়োজন, কী সমারোহ!

মায়ের সাথে এমন কথা বলার পর আমি নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলাম না৷ কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম আমি৷ কিছুক্ষণ পর পিঠে কার যেনো ঠান্ডা হাত অনুভব হলো আমার৷ আমি পেছন ফিরে তাকালাম। একটা টিশার্ট আর টু কোয়ার্টার প্যান্ট পরা আসিফ দাঁড়িয়ে আছে। আমি ভয় পেয়ে গেলাম৷ উঠে দাঁড়ালাম৷ আসিফ আমার হাত টেনে ধরলো৷ আমাকে বিছানায় বসালো৷ তারপর বললো,

‘আমি সব কথা শুনতে পেয়েছি৷ আমি বারান্দায় বসা ছিলাম। মদ খাচ্ছিলাম। জীবনটা আসলেই অনেক কঠিন৷ মানুষের চাওয়ামতো কোন কিছুই হয়না। জানো নুপুর, আমার তখন সদ্য ইন্টার শেষ হয়েছে৷ আমি অনেক ভালো আঁকতাম। আমার সব সময় আঁকাআঁকির নেশাই ছিলো প্রচন্ড। সেভাবে কারোর কাছে আমি শিখিনি। ইন্টারের পর আমার ইচ্ছা আমি ঢাবির চারুকলাতে পড়বো। আমার এই ইচ্ছাটা যখন বাসায় জানলো সবাই, তারপর বাসায় সে কী হট্টগোল! মায়ের সাফ নিষেধ, আমি চারুকলায় পড়তে পারবো না। আমাকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে হবে। সাইন্স বেকগ্রাউন্ডের ছাত্র হলেও সাইন্সের সাবজেক্টে আমার কোন আগ্রহ ছিলো না৷ আর্টকালচারেই যেনো আমি আমার সবকিছু খুঁজে পেতাম। আমার শান্তি, আমার ইচ্ছা, আমার মুক্তি…
সব সব সব। মায়ের কথায় ভর্তি হলার ইঞ্জিনিয়ারিং কোচিং এ। অন্যদিকে আমি ভেতরে ভেতরে প্রিপারেশন নিতে লাগলাম ঢাবির চারুকলার৷ আমার ইচ্ছা আমাকে পূরণ করতেই হবে৷ পরিচিত কিছু বড় ভাইদের সাথে পরিচয় ছিলো আগ থেকেই৷ তারা আমাকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছে৷ তারপর আমি দিলাম পরীক্ষা। আমার ঢাবিতে হয়ে গেলো চারুকলায়। অন্যদিকে ইঞ্জিনিয়ারিং আর এ ইউনিটের কোথাও হলো না৷ বাসায় আমার উপর ক্ষেপে গেলো সবাই৷ একদিকে বাসার সবাই চায় আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ি, অন্যদিকে আমি চাই আমি চারুকলায় পড়বো। জানো নুপুর, আমাকে কখনো বাইরে যেতে দেয়া হতো না, আমাকে টিভি দেখতে দিতে হতো না, আমাকে কোন মানুষের সমান মূল্যই দেয়া হতো না এই ঘরে৷ একা একা, নিজের জীবন সম্পূর্ণ একাই আমি গড়ে নিয়েছি যেনো৷ সর্বক্ষণ টিচার, হুজুর, স্কুল তারপর বাসায় এসে আবারও পড়া, এই যেনো আমার রুটিন হয়ে দাঁডিয়েছিলো৷ ঢাবির চারুকলায় যেদিন ভর্তি ছিলো আমার, বাবা আমাকে সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলেন সেদিন। কিন্তু হায়, আমি জানতাম না সেইটা ছিলো আমার স্বপ্ন ভঙ্গের দিন। বাবা নিজে গিয়ে আমার ভর্তি ক্যান্সেল করে দিয়ে এলেন৷ এইতো জীবন। আমার অধরা জীবন আমার থেকে ছিনিয়ে নেয়া হলো৷ আমাকে একঘরে বন্দি জীবন আবার এক করে নিতে হলো।

তারপর তো দেখছোই৷ নারীতে আসক্ত হলাম।খারাপ সঙ্গ পেলাম। মদ আর নারী ছাড়া আমার এখন চলেই না৷ দুটোর নেশায় আমি বেঁচে আছি যেনো!

আচ্ছা শুনো নুপুর, আগামীকাল যদি ইফতার নিয়ে না আসতে পারেন তোমার বাবা, তাহলে এখানে আবারও তোমার জীবন নরকে চলে যাবে। আমি পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে আসবো কাল সকালে তোমার বাবার কাছে। তুমি কল করে বলে দিও তোমার বাবাকে। আর এই টাকা যে আমি দিচ্ছি, বাসায় যেনো কেউ বিন্দুমাত্রও টের না পায়।’

কথাগুলো বলেই আসিফ আমার ঠোঁটের সাথে তার ঠোঁট লাগিয়ে দিলো। আজ তিন মাসের মধ্যে এই প্রথম যেনো আমি অন্যরকম আসিফকে অনুভব করতে লাগলাম। মানুষ একাকী থাকতে থাকতে নিজের ভেতরের নিজেকে কখন যে ভুলে যায়, তা সে কল্পনাও করতে পারে না হয়তো….

(চলবে)