বিন্নি ধানের খই পর্ব-৪৪+৪৫+৪৬

0
328

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_৪৪
#মিদহাদ_আহমদ

পুরো মহল একেবারে চুপ হয়ে গেলো। ননাস নীরবে দাঁড়িয়ে আছে৷ বদরুল দুলাভাই বললো,

‘কী? কোনকিছু বলছো না যে?’

তারপর বদরুল দুলাভাই আসিফের সামনে এসে বললো,

‘ও না তোমার বোন হয়? জানো সে কি করেছিলো? জানো? তোমাকে যে আমি এক লাখ টাকা দিয়েছিলাম, সেই এক লাখ টাকা কেন দিয়েছিলাম জানো? তোমার বোনের কথায়। আর সে কেন দিয়েছিলো তোমাকে জানো? দিয়েছিলো এই ভেবে যে তুমি আবার নেশা করবে। নেশায় বুঁদ হয়ে যাবে। আর সম্পত্তি এই বাসা এই পরিবার সবকিছু সে একা একাই ভোগ করবে।’

আসিফ তেড়ে আসলো। দুলাভাই বললো,

‘না না না। রাগ দেখানো চলবে না। তোমার বোনকে জিজ্ঞেস করো। আমি মিথ্যা বলছি কিনা সত্য বলছি।’

ননাস হাউমাউ করে কান্না করে উঠে বললো,

‘আমি এসব করেছি। আমি এসব করেছি। আমি তোমার মোহে এতটাই আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলাম যে আমি কোনকিছু বাছবিছার করিনি। আমি শুধু তোমাকেই চেয়েছিলাম সব শেষে। আর যাই করেছি সব তোমার জন্য।’

শাশুড়ি মা ধীরপায়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন ননাসের দিকে। আমি তাঁকে হাত ধরে আটকালাম। আমি বুঝতে পারলাম এই মুহূর্তে কোন কথা বলা ঠিক হবে না। বদরুল দুলাভাইকে বললাম,

‘আপনি প্লিজ এখন এখান থেকে যান। প্লিজ।’

‘কেন? এসেছি যখন বলেই যাই। বলতে দোষ কোথায়।’

‘প্লিজ আপনি যান। প্লিজ’

‘দেখুন৷ এই মেয়েকে দেখুন। এই মেয়েকে আপনারা সবাই মিলে টর্চার করছিলেন না, এই মেয়েটাই এখন আপনাদের বাঁচাতে চাচ্ছে। আমি যেনো আর কিছু না বলি এজন্যই সে আমাকে চলে যেতে বলছে। আমি যাবো না। জানো আসিফ, তোমার সিগারেটে গাঁজা ছিলো গাঁজা। তোমার বোন জানতো সব। সব জেনেও সে আমাকে নিষেধ করেনি। আর তাকে আমি বিশ্বাস করবো? কোন যুক্তিতে আমি বিশ্বাস করবো? কোন কারণে? একে তো আমি বাবা হতে পারব না কোনদিন তোমার বোনকে নিয়ে থাকলে। তার উপর এসব? আমি কোন মীর জাফরের সাথে সংসার করতে পারবো না।’

আসিফ একেবারে থ বনে গেলো। আমি আসিফকে উপরে যেতে বললাম। আসিফ ননাসের সামনে এসে বললো,

‘আপা তুমি এমন করতে পারলা? তুমি? আমি না তোমার ভাই হই? আরে আমাকে বলতা যে তুমি সব চাও। আমার কোন লোভ নেই এসবে। কোন লোভ নেই। কিন্তু তুমি? এসব কেন করলা আপা? কেন?’

আসিফকে আমি উপরে যেতে বললাম। আসিফ আর কথা না বলে চলে গেলো উপরে। বদরুল দুলাভাই আমার সামনে এসে বললো এবার,

‘দেখেছিলা না মেয়ের সাথে কারে? ওইটা আমিই ছিলাম৷ আর মেয়েটা আমার মামাতো বোন। এসেছে লন্ডন থেকে। তাকে এই উইকেই বিয়ে করছি আমি৷ আর এই বিয়ের আগে তোমার ননাসকে ডিভোর্স দিচ্ছি৷’

কথাটা বলেই বদরুল দুলাভাই চলে গেলো।

পনেরো দিন কেটে গেলো। এর মাঝে বদরুল দুলাভাই আর তানিয়া আপার ডিভোর্স হয়ে গেলো৷ একদম নীরবে, নিভৃতে যেনো এই ডিভোর্স হলো৷ কেউ কোন আপত্তি করলো না৷ আমি শুধু খেয়াল করছিলাম, ডিভোর্স পেপারে সাক্ষার করার সময়ও তানিয়া আপার চোখ দিয়ে কোন জল এলো না। মানুষ অল্প শোকে কাতর হয়, অধিক শোকে পাথর হয়ে যায়। আসিফ সেদিনের পর থেকে আর কথা বলেনি আপার সাথে। মা শুধু একবার বলেছিলেন তাকে, বোন হয়ে সে ভাইয়ের সাথে এমন ব্যবহার কেমন করে করলো। ফ্ল্যাটটা বদরুলের নামে রেজিস্ট্রি হওয়ায় ফ্ল্যাটের দাবি আর কেউ করতে পারিনি আমরা। শ্বশুর বলে দিয়েছেন, দাবিও যেনো না করি। ডিভোর্স শেষে উকিল মারফতে ননাসের বিয়ের কাবিনের পনেরো লাখ টাকা বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছিলো বদরুল। ননাস সেদিকে চেয়েও দেখেনি। আমার সাজানো গুছানো সংসারে একেবারে নিমজ্জিত জলপুষ্প এসে গেলো যেনো। আসিফ কাজে যায় না আর আগের মতোন নিয়ম করে। শাশুড়ি রান্নাঘরে এসে রান্না করেন না নানা পদের ভর্তা ভাজি। মা অসুস্থ বাড়িতে। তামান্না কল করে বললো গতকাল, তার স্বামী নাকি কাল রাতে তার উপর হাত তুলেছে। তামান্না কান্না কর‍তে করতে আমাকে বললো,

‘ভাবি আমি আর সহ্য করতে পারছি না এখানে৷ আমার দিনটা ভালো কাটছে না। এখানের সব কয়টা মানুষ যেনো একেবারে আমার উপর উঠেপড়ে লেগেছে। আর কীভাবে কীভাবে যেনো জেনেছে যে আপার ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে৷ এ নিয়েও তারা আমাকে কম কথা শুনাচ্ছে না।’

আমি তামান্নাকে বুঝালাম। এও বললাম, মাকে যেনো সে এসব না বলে। মায়ের অবস্থা দেখে আমার ভয় হয়। একজন মানুষ ভেতর থেকে একেবারে ভেঙ্গে পড়েছেন যেনো। শ্বশুর এখন নীরবে ইজি চেয়ারে বসে পেপার পড়েন শুধু৷ আর দুই একবার আমাকে ডেকে চা দিতে বলেন। বরাবরের মতো আমি রান্নাঘরে ছিলাম। শ্বশুর ডাক দিলেন,

‘নুপুর, মা এদিকে আসো তো।’

‘হ্যাঁ বাবা বলেন।’

‘এক কাপ চা হবে? আর অল্প চিনি দিয়ে দিও কেমন?’

‘আচ্ছা বাবা।’

শ্বশুরের ডায়াবেটিস। তবুও আমাকে আবদারের সুরে বলেন যে সামান্য চিনি দিয়ে দিতে। আমিও না করি না। অল্প একটু দিয়ে দেই। জানি এতে ওনার জন্যই খারাপ। তবুও দেই। আমার যে বাবা নেই। বাবা থাকলে এমন আবদার আমাকে আমার বাবাও করতেন নিশ্চয়ই!

চা নিয়ে গেলাম কিছুক্ষণের মধ্যে। শ্বশুর পত্রিকার নিচ থেকে একটা কারেন্ট এফেয়ার্স বের করে দিয়ে বললেন,

‘এটা পড়ো।’

‘কেন বাবা?’

‘সাম্প্রতিক প্রশ্ন সব আছে এইটায়। এই মাসের শেষে ফার্স্ট ভিউ আর সামনের মাসের শুরুতে লাস্ট ভিউ বাজারে আসবে পত্রিকায় দেখলাম। আর কিছু বই অর্ডার দিয়েছি আমি পত্রিকা দেখে দেখে। তোমার কাজে লাগবে। মেডিকেলে তো সাধারণ জ্ঞান আসে। আর ইংরেজি নিয়ে আমার কাছে বসবা। আমি রাজশাহী ইউনিভার্সিটির ইংরেজির গ্রেজুয়েট করা স্টুডেন্ট। বুঝলা? এত বছর কাওকে পড়াইনি৷ পড়ানোর দরকার হয়নি অবশ্য৷ এখন বাসায় আছি, তোমাকে পড়াবো। কেমন?’

শ্বশুরের কথায় আমার চোখ দিয়ে জল চলে এলো। আমি কী বলবো বলে বুঝাতে পারছিলাম না তখন। আমি নিশ্চুপে হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে রুম থেকে বের হয়ে আসছিলাম। শাশুড়ি আমাকে পেছন থেকে ডাক দিলেন৷ আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। শাশুড়ি ডাক দিয়ে এসে আমাকে ধরে বসিয়ে সে কী কান্না! একেবারে নাস্তেনাবুদ অবস্থা যাকে বলে। শাশুড়ি আমাকে ধরে কান্না করতে করতে বলতে লাগলেন,

‘মারে, আমাকে ক্ষমা করে দে। আমি জানি তোকে যে কষ্ট দিয়েছিলাম সেই কষ্ট আমার মেয়েদের উপর এসে লেগেছে। তুই বলেছিলি আমার মেয়েরা সংসার করতে পারবে না সুখে। আর কারো অন্তর থেকে আসা বদদোয়া লাগলে জীবন একেবারে ছাড়খাড় হয়ে যায়। মারে তুই আমার মেয়ের মতো। তোর দোহাই লাগে তোর মনের কষ্ট তুই আমার উপর নিয়ে আয়৷ আমার দিল ডাকছে, আমার তামান্নাও শ্বশুর বাড়িতে শান্তিতে নাই।’

আমার মুহূর্তেই মনে পড়ে গেলো সেদিনের কথাটা। সেদিন কথায় কথায় ননাস আর ননদকে বলেছিলাম তারা দুজনে শান্তিতে ঘর সংসার করতে পারবে না। আমি শাশুড়ির চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললাম,

‘কী বলছেন মা এসব? আমি আপনার মেয়ে। তানিয়া আপা, তামান্না এরা আমার বোন। আর বোন হয়ে বোনের অভিশাপ লাগে বলেন? আমার ভুল হয়েছে মা আমি এমন কথা মুখ দিয়ে এনেছি। আমার নিজের লজ্জা হচ্ছে এখন।’

শাশুড়ি মায়ের চোখ নাক দিয়ে যেনো জলের বারিষা শুরু হয়েছে। হেলে পড়লেন আমার বুকে। কান্না জর্জরিত গলায় বললেন,

‘মারে, আমার মেয়ে দুইটার সাথে কেন এমন হচ্ছে! কেন!’

আমি কথা বলার জন্য উপযুক্ত শব্দ খুঁজে পেলাম না। দুই চোখ আমারও আর বাধ মানলো না। অজান্তেই নোনাজলে ভিজে উঠলো চোখের চারপাশ। রুমে এসে খুব কান্না করলাম। আল্লাহর কাছে মনে মনে বললাম, আমার রাগের মাথায় বলা ফরিয়াদ যদি তিনি কবুল করে ফেলেন, তাহলে যেনো তা আবার ফিরিয়ে নেন। আমি এমন ক্ষতি চাইনি মালিক।

রাতে খাবার নিয়ে ননাসের রুমে গেলাম। ননাস একেবারে ঝিম ধরে বসে রয়েছে। আয়নার দিকে তাকাচ্ছে। তাকে আমার দিকে ফিরিয়ে মুখে ভাত তুলে দিতে দিতে বললাম,

‘জানেন আপা, আমাদের স্কুলের সবচাইতে কড়া কিন্তু মমতাময়ী যে টিচার, রাশিদা আপা, উনার বিয়ের চার বছরের মাথায় বর মারা যায়। আপার কোন বাচ্চা ছিলো না। আপা তারপর বাকি জীবন স্কুলে শিক্ষকতা করেই কাটিয়ে দিয়েছেন। আপা কী বলে জানেন, আপা বলে যে, লাইফে যখন ফুল স্টপ বসে যাবে, ঠিক তখনি আমরা সেই ফুল স্টপের শেষে আরও দুইটা বিন্দু যোগ করে দিবো৷ তখন আর ফুল স্টপ, ফুল স্টপ থাকবে না। টু বি কন্টিনিউড হয়ে যাবে…। তাইনা?’

তানিয়া আপা তার কান্নায় ভাঙ্গা কন্ঠে আমাকে বললো,

‘জানিস নুপুর, জীবনের কত স্বপ্ন, কত আশা, কত ভরসা আমি দেখেছিলাম ওই মানুষটাকে নিয়ে! আর আজ কী হচ্ছে জানিস…’

এমন সময় ননাসের হোয়াটসঅ্যাপে ডাক দিয়ে একটা মেসেজ এলো৷ দেখলাম বদরুলের প্রোফাইল দেয়া ছবির আইডি থেকে মেসেজ এসেছে। তানিয়া আপা আমাকে দেখিয়ে বললো,

‘আজ সেই মানুষটা নতুন বিয়ে করে সংসার পাতছে। এই দেখ নুপুর।’

মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলাম এর আগেও কয়েকটা ছবি দিয়েছে লোকটা। আর এবার তার বিয়ে করা বউয়ের সাথে ছবি আর নিচে লিখে দিয়েছে,

‘কেমন বোধ করছো এবার? আমি আমার সংসার নতুন করে সাজালাম৷ নিজের মাথার ভেতরে থাকা কুবুদ্ধি নিয়ে নিজে বাঁচো’

আমি মেসেজটা দেখে আর অপেক্ষা করতে পারলাম না। সাথেসাথে তাকে কল দিলাম। কল দিয়ে সাবধান করে দিলাম, এরপর যদি এমন কিছু আসে তাহলে তার নামে সাইবার ক্রাইমে হ্যারেজ করার মামলা আমি নিজে দিবো।

ননাসখে খাইয়ে রুমে চলে এলাম। আসিফ সিগারেট খাচ্ছিলো নীরবে। হুট করে তার কাশি উঠলো। ঝুড়িতে কাশি ফেলার সময়ে খেয়াল করলাম, আসিফের কাশির সাথে মুখ ভর্তি রক্ত বের হচ্ছে। আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যেতে লাগলো। মাথার উপরের আকাশ বিলীন হয়ে যেতে লাগলো। মনের কোটর থেকে স্নাত হতে লাগলো বিষের বর্ষণ। চোখমুখ মলিন হতে শুরু করলো। আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলাম। কী দেখছি আমি এসব!

(চলবে)

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_৪৫
#মিদহাদ_আহমদ

আসিফকে এবার ধরে বসলাম আমি। আসিফ বললো,

‘আরে কী হয়েছে? ওসব কিছু না। তুমি এতো হাইপার হয়ো না।’

আমি আসিফের কথা শোনার পরিস্থিতিতে আর রইলাম না৷ সেই রাতেই ডাক্তারের এপোয়েনমেন্ট নিলাম। একবার চিন্তা করলাম শাশুড়িকে জানাবো। পরক্ষণেই ভাবলাম শাশুড়িকে জানানো যাবে না এখন। তিনি এমনিতেই দুঃশ্চিতার মাঝে আছেন।

ডাক্তার বিকালে বসেন আল হারামাইন হসপিটালে। আসিফের অফিসে যাচ্ছি বলে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম আমি৷ অফিসে গিয়ে দেখি আসিফ যেইসেই পেইন্ট আর তুলি হাতে নিয়ে কাজে বসা আছে। আমাকে দেখেই একটা হাসি দিয়ে বললো,

‘কী? আবার ইনভেস্টিগেশন করতে চলে এসেছো বুঝি?’

আসিফের এই মায়ামাখা মুখ দেখলে আমার ভীষণ ভালোলাগে। আজও ঠিক তেমন ভালোলাগা কাজ করছে। আমি ভাবনায় পড়ে গেলাম। আসিফ আঙুল দিয়ে চুটকি বাজিয়ে বলল,

‘কী মিসেস? কীসের চিন্তা? জামাই মারা গেছে বুঝি?’

আমার চোখ দিয়ে পানি চলে এলো। আসিফ উঠে এসে বললো,

‘আরে আরে আরে! বোকা নাকি তুমি? কান্না করছো কেন? আমি কিছু বললাম আর এমনি…’

‘কেন এসব বলবে? কেন?’

আমি জড়িয়ে ধরলাম আসিফকে। আসিফ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।

কিছুক্ষণের মাথায় তাকে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে গেলাম। ডাক্তার দেখালাম। ডাক্তার জানতে চাইলেন সমস্যা কী। আসিফ বললো যে কাশির সাথে রক্ত আসে এই যা। ডাক্তার আসিফকে জিজ্ঞেস করলেন,

‘স্মোকের সাথে বাজে অভ্যাস আছে কি?’

আসিফ কোনকিছু বললো না। আমি বললাম,

‘হ্যাঁ ডাক্তার।’

ডাক্তার কিছুক্ষণ মলিন মুখে প্রেসক্রিপশনের দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন,

‘এভাবেই কত পরিবার যে ধ্বংস হয়ে যায়, একেবারে শেষ হয়ে যায়…’

আমার বুকটা হুট করে কেঁপে উঠলো। ডাক্তার এসব কী বলছেন! ডাক্তার তারপর আমাকে বললেন,

‘আপাতত এই টেস্টগুলা দিচ্ছি। সবগুলো করাবেন। তারপর আসবেন। দেখছি কী করা যায়।’

‘ডাক্তার টেনশনের কোন…’

‘টেনশন কিনা জানা নেই। আপনি টেস্ট করিয়ে আসুন।’

তারপর আসিফের দিকে চেয়ে বললেন,

‘মিস্টার, বাজে অভ্যাস আপনাকে যেনো না খেয়ে বসে এর আগে অভ্যাসকেই আপনাকে খেতে হবে।’

টেস্ট করালাম সবকিছু। ফিরে আসার সময় ড্রাইভ করতে করতে আসিফ বললো,

‘কী এক ডাক্তার বাপু! সতেরো হাজার টাকার টেস্ট করাতে দিয়ে দিল! টাকা চাইলে টাকা দিয়ে দিতাম। কিন্তু না। সে কী করলো? এতগুলা টেস্ট আর মাথা ভর্তি টেনশন ঢুকিয়ে দিলো মনের মাঝে। এখন আবার আগামীকাল সকালে খালি পেটে এসে আরেকটা টেস্ট করাও। আমি এসব পারবো না।’

আসিফের কথাগুলো শুধু যেনো নীরবে আমি শুনছিলাম। কোন কথা ফিরতি বলার শক্তি আমার নাই।

বাসায় এসে আমার কোন কাজেই মন বসছিলো না। আসিফ সিগারেট টানতে টানতে বললো

‘পড়তে বসবে না? নাকি এভাবেই? ‘

আমি আসিফের কাছে গিয়ে সিগারেট ফেলে দিলাম টান মেরে। আসিফকে জড়িয়ে ধরে বললাম,

‘আর সিগারেট খাবে না। এসব আর না। হুইস্কিও না। সবকিছু না।’

আসিফ এবার যেনো নীরবে বসে থাকলো। আমি আসিফকে বললাম,

‘আমার কে আছে বলো? কে আমাকে স্বপ্ন দেখাবে বলো? আমার শুধু তোমাকে চাই আসিফ। এই টাকা পয়সা ধন বিত্ত সম্পূর্ণকিছুর বিনিময়ে শুধু তোমাকে চাই। আর কিছু না। আর কিচ্ছু না।’

রাতে ননাসের কাছে গিয়ে বললাম সবকিছু খুলে। এও বললাম যে ডাক্তারে গিয়ে সব টেস্ট করিয়ে এসেছি। ননাসের চোখ বেয়ে পানি নামলো। ননাস বিলাপ করতে করতে বললেন,

‘আমাদের পরিবারের উপর কার নজর লেগেছে। কার নজরে সবকিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে। সব যেনো একেবারে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আল্লাহ আমার একমাত্র ভাইটার সাথে কী করবেন আমি জানি না। আমি কিচ্ছু জানি না। আসিফ আমার সাথে ভালোকরে কথাও বলছে না। আমি বোন না, আমি বোন হয়ে তার সাথে কতকিছু করলাম! আল্লাহ আমাকে কখনো ক্ষমা করবেন না।’

আমি ননাসকে বললাম,

‘আপা এমন কেন বলছেন? আপনি রুমে আসেন৷ দেখবেন আসিফের সব রাগ গলে জল হয়ে গিয়েছে। আমি ভেতরে ভেতরে আর চেপে রাখতে পারছিলাম না ডাক্তার দেখানো আর টেস্ট করানো ঘটনাটা। তাই আপনাকে বললাম। আপনি রুমে এসে একবার আসিফের সাথে ভালোমন্দ কথা বলেন৷ দেখবেন সব ঠিক হয়ে গিয়েছে।’

ননাস কোন জবাব দিলেন না আমার কথার। বুঝতে পারলাম ভেতরে থাকা গ্লানি তাকেও শেষ করে দিচ্ছে। মানুষ যখন নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয়, তখন সেই মানুষ নিজেই নিজেকে জগতের সবচেয়ে বড় অপরাধী হিসাবে ভাবতে শুরু করে। অথচ সে জানে না, ভুলের অনুতপ্ত হওয়া মানুষ দুনিয়ার সবচেয়ে প্রফুল্ল চিত্তের মানুষ হয়ে থাকে।

ননাস কিছুক্ষণ পর আমাদের রুমে আসলেন। আসিফ ননাসকে দেখে একটা বই হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলো। তানিয়া আপা স্যুপ বানিয়ে এনেছেন। থাই স্যুপ আসিফের পছন্দের। ননাস স্যুপ এনে আসিফের সামনে ধরলে আসিফ আমাকে ডেকে বললো,

‘ওনাকে বলো স্যুপ নিয়ে চলে যেতে। যে আমার মৃত্যু কামনা করতে পারে, তার হাতের স্যুপ আমার না খেলেও চলবে’

আসিফ মানুষটা এমন! কোনকিছু ধরে বসলে আর ছাড়ে না। সে এখনও ভুলতে পারছে না ননাস তার সাথে কী করেছেন সেইটা। ননাস কান্না ভেজা চোখে চলে গেলেন রুম থেকে। যাবার আগে স্যুপ টেবিলে রেখে আমাকে বললেন,

‘নুপুর আমার ভাইকে খাইয়ে দিও পারলে।’

আমি আসিফের পাশে বসলাম। আসিফ তেড়ে রাগান্বিত গলায় আমাকে বললো,

‘এখন তুমি আমাকে উপদেশ দেয়া শুরু করবে নাকি? কোন উপদেশ না। চুপচাপ থাকো।’

আমি আসিফকে বললাম,

‘দেখো আসিফ, উনি তোমার বোন। মানুষের ভুল থাকতেই পারে। তাই বলে কি এভাবে? দেখো আপা এখন কত বড় মানসিক ট্রমার মধ্যে আছেন! আপাকে এখন আমাদের সঙ্গ প্রয়োজন। আমাদের ভালোবাসার প্রয়োজন। আর নাহলে একটা মানুষ এভাবে আমাদের সামনে শেষ হয়ে যাবে বলো?’

‘আর তিনি যা আমার সাথে করলেন? আমাদের সাথে করলেন?’

‘দেখো আসিফ, দুনিয়ার নিয়ম এমন। আর আপা তো একা করেননি। সঙ্গদোষে লোহা ভাসে। এমন একবার ভেবে দেখেছো? ওই পাষন্ড লোকটা আপার মোবাইলে তার নতুন বিয়ে করা ছবি পাঠাচ্ছে। তার থেকে আর কী আশা করা যায় বলো? তার প্ররোচনায় তো আপা এমন করেছেন৷ জানো, ছোট থাকতে খালা -ফুফুরা তাদের ভাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতো সেই ছড়াটা,

‘ভাইবোন মিলেমিশি তুলি কত ফুল
মিঠে পায়ে ঝরে পড়ে শেফালী বকুল’

মনে আছে তোমার? সেই ভাইবোনে এতো মান, এতো অভিমান কেমন করে হয়? এখানে তো শুধুই ভালোবাসা জায়গা করে নেয়। শত ভুল আর অভিমান এখানে নিমষেই কর্পুরের মতো উবে যায়! আর তুমি কিনা বাচ্চা ছেলের মতো নিজের সহোদরা বোনের উপর রাগ করে আছো আসিফ?’

আসিফ আমার কথাগুলো বুঝলো হয়তো। তবে কোন রেসপন্স করলো না। সকালে ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি উঠলো সে। আমাকে জাগিয়ে তুলে বললো,

‘আমার আর আপার জন্য কর্ণফ্লাক্স বানিয়ে নিয়ে আসতে পারবা আপার রুমে? একসাথে খাবো আমরা ভাইবোন মিলে। আর তুমি খেলে তোমার জন্যও একটা বানিয়ে নিয়ে এসো’

‘কিন্তু তোমাকে যে খালিপেটে টেস্ট…’

‘আরে ওসব একটু আধটু খেলে কিছু হয় না। তুমি নিয়ে আসো।’

আমিও আর না করলাম না। নিয়ে এলাম বানিয়ে। ভাই বোনের দূরত্বটা যদি কমে যায়, তাহলে একদিন যেনো শান্তি হয়ে যাবে। কিছুক্ষণ পর আবার আসিফের টেস্ট!

আপার রুমে ঢুকতেই দেখতে পেলাম গিটার বানিয়ে আসিফ গান গাইছে,

‘এক হাজারো মে মেরি এক বেহেন হে
সারে উমর হামে এক সাঙ্গ রেহনা হে
তুলো কাতারো কা, সাবকা কেহনা হে…’

আমার অজান্তেই কেমন জানি গাঁ কেঁপে উঠলো! তারা ভাইবোনেরা আজন্ম একসাথে থাকুক। কেউ কারো থেকে বিচ্ছিন্ন না হোক৷

এদিকে তামান্নার স্বামী রাজিব যেনো বিয়ের পর একেবারে চেইঞ্জ হয়ে গিয়েছে। বুঝতে শিখেছে৷ গতরাতে তামান্না কান্না করলে রাজিব তামান্নাকে বুঝালো, সংসারে একটু কষ্ট সহ্য করে নিতে হয়৷ রাজিব এও বললো, তার বাবা মায়ের সামনে সে কখনো কথা বলে না। তাদের মুখের উপর গিয়ে সে তামান্নার হয়ে কোনকিছু বলতেও পারবে না। বোনেরাই পরিবারের সব এখন৷ তাদের উপর গিয়েও রাজীব কোনকিছু বলতে পারবে না৷ তামান্না কান্না করতে করতে বললো

‘আমার বাবা মা কোনদিন আমার গায়ে হাত তুলেননি৷ কিন্তু আপা কী করলেন? আমার গায়ে হাত তুললেন? আমি ভাত একটু নরম করে ফেললাম বলে আমাকে চড় মারতে পিছু হাটলেন না?’

রাজিব তামান্নার হাত ধরে বললো,

‘আমি বুঝতে পারছি সব। তুমি একটু ধৈর্য্য ধরো৷ আমি আর কয়দিন ই বা আছি? বাবা মায়ের সাথে মনোমালিন্য হলে এই আবার তোমার উপর এসে পড়বে। সবাই বলবে যে বউ বাদ। সামনের মাসেই চলে যাচ্ছি। এরপর সব প্রসেসিং করে তোমাকে আমার কাছে নিয়ে যাবো। এর আগ পর্যন্ত প্লিজ একটু সহ্য করে নাও।’

এসব বলতে বলতে রাজিব তামান্নার চোখ মুছে দেয়। তামান্নাও নীরবে মনে মনে সবকিছু সহ্য করে যায়। নাহলে সে প্রতিবাদ না করার মেয়ে নয়। রান্না করার মেয়ে নয়। বোনের মতো যদি তার অবস্থা হয়, তাহলে তার বাবা মা দুজনের আস্ত থাকবে না। তারা বাঁচতে বাঁচতে মারা যাবেন।

রাত্রে আমি একাই গেলাম টেস্টের রিপোর্ট নিয়ে আসতে। রিপোর্ট আনতে আনতে রাত নয়টা। ডাক্তার এর মাঝে চলে গিয়েছেন। বাসায় রিপোর্ট নিয়ে এসে আমার আর রাত কাটছে না যেনো৷ একদিকে ভয়, অন্যদিকে আল্লাহকে বলছি, আল্লাহ যেনো এমন কোনকিছু না করেন যে আমার জীবন শেষ হয়ে যায়৷

পরেরদিন সন্ধ্যায় ডাক্তারের চেম্বারে গেলাম। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে রাত আটটা। ডাক্তার টেস্টের রিপোর্ট হাতে নিলেন। আমার দিকে চেয়ে মলিন মুখে বললেন,

‘আমার হাতে আর কোনকিছু নেই। আপনার হাতেও না।’

(চলবে)

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_৪৬
#মিদহাদ_আহমদ

আমার শরীর যেনো কেঁপে উঠলো। ডাক্তার আমার দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলেন। তারপর বললেন,

‘আপনার টেনশন করার কোন কারণ নেই। তবে আমার হাম্বল রিকুয়েস্ট ওয়াইফ হিসাবে আপনাকে যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হবে এখন থেকে।’

ডাক্তার এসব কথা কেন বলছেন আমি বুঝতে পারলাম না। ডাক্তারকে আবার ফিরতি জিজ্ঞেস করলাম,

‘আসিফের বড় কোন রোগ….’

‘আরে না না৷ বড় কোন রোগ না৷ আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। শুধু আপনাকে কিছু কথা বলবো৷ মনোযোগ দিয়ে শুনবেন।’

আমি যেনো এবার হাফ ছেড়ে উঠলাম। ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম,

‘আসিফের তাহলে কী হয়েছে?’

‘ব্রঙ্কাইটিস। ওইটা সম্পর্কে বুঝতে পারবেন আপনি নিজেই আশাকরি। আমাকে বুঝিয়ে দেয়া লাগবে না৷ তবে আমাকে যা করতে হবে তা হলো আপনাকে বুঝানো। আপনাকে এখন যে করেই হোক আপনার মিস্টারকে এই এডিকশন থেকে বের করে আনতে হবে৷ আর এজন্য আপনি কোন কোন পদক্ষেপ নিবেন তা আপনিই জানেন। সরি টু সে, আমি আশঙ্কা করেছিলাম ওবার ক্যান্সার বা এই জাতীয় কোনকিছু হলো কিনা৷ কারণ মেজরিটি পার্সেন্ট রোগীদের এই শঙ্কাটাই হয়৷ না তবে হাইপার হওয়ার কারণ নাই৷ আপনার মিস্টারের ও যদি এমন কিছু হতো, তাহলে আমাদের এই আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র হয়তো ওনাকে সাড়িয়ে তুলতো। কিন্তু ইমাজিন করেন এই একটা কারণে কত শত ফ্যামিলি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে! আপনারা এডুকেটেড ফ্যামিলির মানুষ এর ক্ষতি জানার পরও দূরে রাখতে পারছেন না কিন্তু ওইসব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষেরা যারা এর ভয়াবহতা জানতে পারছে না তাদের অবস্থা?’

আমার চোখ দিয়ে কান্না চলে এলো। ডাক্তার বললেন,

‘আপনি এমন করলে চলবে বলেন? আমি ডাক্তার কিন্তু তার পরও ডাক্তারির বাইরে গিয়ে একবার নজরুলে যাচ্ছি। নজরুল কী বলেছেন শুনেছেন? উনি বলেছেন,

‘কোন কালে একা হয়নি কো জয়ী পুরুষের তরবারি
প্রেরণা দিয়াছে শক্তি দিয়াছে বিজয়া লক্ষ্মী নারী’

মানে কী দাঁড়ালো? আপনার মিস্টারকে আপনি যদি জয়ী করতে চান, তাকে তার লাইফটাইমে হ্যাপি দেখতে চান আর সাথে সাথে আপনিও হ্যাপি থাকতে চান তাহলে আপনাকেই প্রেরণা দিতে হবে৷ আপনাকেই গোল সেট করতে হবে নেক্সট ইয়ার এই সময়ে আপনার স্বামীকে আপনি কোথায় দেখতে চান। কিছু ভুল বললাম?’

‘না ডাক্তার। থ্যাঙ্কিউ আপনাকে৷ আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো’

‘ওকে। আর আমি আরও কিছু টেস্ট দিচ্ছি এখন৷ আপাতত টেনশন মুক্ত৷ তবে ব্রঙ্কাইটিস থেকেও তো পরিত্রাণ পাওয়া লাগবে তাইনা? ওনাকে টোটালি স্মোক আর ড্রিংকস থেকে দূরে রাখতে হবে। আমি আরও তিনটা টেস্ট দিচ্ছি৷ করিয়ে নিবেন। আর তারপর আমি ওষুধ দিবো৷ তবে টেনশন করবেন না। এখন আপনার হাতে সবকিছু। আপনার একাগ্রতা আর ইচ্ছাই পারে আপনার মিস্টারকে সুস্থ করে তুলতে।’

ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে এলাম আমি৷ বাসায় না এসে সরাসরি আসিফের অফিসে গেলাম৷ আসিফ তার রুমে ছিলো না। পেইন্ট রুমে সবার সাথে বসে বসে পেইন্ট করছে দেখলাম। অবস্থা নাজেহাল। মাথায়, কাপড়ে পেইন্ট লাগানো৷ আমাকে দেখে বলে বসলো,

‘কী মিস্টারের মিসেস? চলে এসেছেন এখান অবধি? তাহলে আসুন পেইন্ট করায় মন দেন ‘

আমি আসিফকে টেনে তার রুমে নিয়ে এলাম। আসিফকে বসিয়ে বললাম,

‘তুমি চাও আমি বাঁচি না তুমি বাঁচো? কোনটা?’.
‘দুজনেই মরি ‘

‘বেশ৷ তাহলে আমাকে বিষ খাইয়ে মেরে দাও ‘

‘হুয়াই? কী হলো আবার?’

‘মেরে দাও আমাকে।’

‘আরে বাবা বলো আমাকে। কী হলো?’

‘তুমি কি স্মোক ছাড়বে?’

আমার সামনে হাসতে হাসতে আসিফ একটা সিগারেট ধরালো৷ বেল্ট দিয়ে মাথার উপরের চুল বাধতে বাধতে সিগারেটে টান দিয়ে ধোয়া ছেড়ে বললো,

‘এই হয়েছে যা। এতকিছুর পরে আসলা লাইনে। আমি দেখো কাজ করতে ছিলাম। ডেলিভারি না করতে পারলে খাবো কী?’

‘আর আমার চিন্তা?’

‘তোমার চিন্তাই তো করছি৷ তুমি বুঝতে পারছো না আমার কথা। তুমি কি এসব ছাড়বে?’

আসিফ কাছে চলে এলো আমার। কোমর ধরে নিজের মুখ আমার মুখের কাছে এনে ফিসফিস করে বললো,

‘ভালোবাসা পেলে সব ছাড়তে রাজি আছি। ভালোবাসা দিবে? বলো?’

আমি ছাড়িয়ে নিলাম নিজেকে। এবার কান্না করে বসলাম। আসিফ সিগারেট নিভিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,

‘এই বাচ্চাদের স্বভাব আর গেলো না তাইতো? কোনদিন ই যাবে না এসব স্বভাব। এভাবে বাচ্চাদের মতো কান্নাকাটি করা লাগে?’

এর মাঝে দুই সপ্তাহ কেটে গেলো৷ ননাস এখন কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছেন আগের থেকে৷ ননাস আগ থেকে বেকিং জানতেন। গতকাল রাতে একটা বেকিং পেইজ খুললেন৷ তানিয়াস কেক এন্ড পেস্ট্রি নামে। রাত একটায় ননাসের ইনভাইটেশন পেয়ে পেইজে জয়েন হলাম। সকাল থেকে দেখলাম ননাস রান্নাঘরে বেকিং করতে বিজি। কালকেই নাকি সে বেকিং করার ডাইস, নজেল, বাটার এসব অর্ডার করেছে। আমি আর শাশুড়ি মা রুমে বসে বসে বললাম, এমন কাজে যদি নিজেকে জড়িয়ে নিতে পারেন, তাহলে ওনার ই ভালো৷ এসব থেকে দূরে থেকে যতো নিজেকে সময় দিবে ততো নিজের জন্য ভালো৷ বিশাল এই ট্রমা থেকে তার বের হয়ে আসাটাই এখন বিশাল চ্যালেঞ্জ৷ এদিকে আগামী পর্শুদিন রাজীব আমেরিকা চলে যাবে৷ শাশুড়ি মা বাজারের এক বিশাল ফর্দ দিয়ে ড্রাইভারকে বাজারে পাঠিয়েছেন৷ এবারও শাশুড়ির এত পদের বাহারি খাবার বানানোর লিস্ট দেখে আমি মূর্ছা যেতে লাগলাম। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করেই বসলাম

‘এতকিছু কি তামান্নার জামাই খেতে পারবে?’

‘তামান্নার জামাই খাবে কেন? খাবে তো পুরো পরিবার। তুমি না নুপুর এখনও বুঝলা না৷ মেয়ের মাকে কতকিছু করতে হয়, দেখতে হয়।’

বিকাল থেকে একে একে ননাস, মা, আমি আর কাজের লোক তিনজন মিলে এসব বাহারি জিনিস বানাতে বসলাম। শাশুড়ি বলে দিলেন এক বিশাল ফর্দ। খাবারের তালিকাগুলো ছিলো এমন,

‘খাসির কোরমা, দেশি মোরগের রোস্ট, কাচ্চি বিরিয়ানির সাথে বাদামের বোরহানি, গরুর কলিজা, রূপচাদা মাছ ভাজা। ‘

আর ডেজার্ট আইটেম ছিলো,

‘কোনাফা, নওয়াবি সেমাই, জর্দা পোলাও, ফ্রুট কাস্টার্ড, নারিকেলের পায়েস আর হাতে বানানো গোলাপজাম। সাথে দুধ ওয়ালার স্পেশাল পাটিশাপটা।’

ননাস বললো সে একটা কেক বেক করবে পাঁচ পাউন্ডের৷ কেক একটা দেয়াই যায়৷ শাশুড়ি শেষমেশ জালি কাবাব এড করলেন লিস্টে। বাজার থেকে কেনা বাহারি মিষ্টি নিমকি দইয়ের ফর্দ তো আর বাকি রইলো!

এসব বানাতে গিয়ে আমি মনে মনে ভাবলাম, এখনও মেয়েরা কত অসহায় আমাদের সমাজে! আমরা মেয়েরাই মেয়েদের দাম দেই না ঠিকমতো! অথচ আমরা দেখছি যে দুনিয়া এগিয়ে যাচ্ছে, দুনিয়ার মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে৷ আর এই আগানোর বেলায় যে আমরা সমাজ ব্যবস্থার দায়ে যে একটা মেয়েকে তার নিজের কাছেই ছোট করছি এর কথা কি ভাবছি কখনো?

সকাল নয়টায় ঘুম থেকে উঠলাম। ননাসও রেডি, আমিও রেডি। আসিফ যাবে না৷ সে রাত্রে দেখে আসবে রাজীবকে। শ্বশুর আর শাশুড়িও যাবেন। ড্রাইবার সবকিছু গাড়িতে নিয়ে রাখলো৷ নিচে নামার সময়ে শাশুড়ি আমাকে তার রুমে ডেকে পাঠালেন৷ রুমে যেতেই শাশুড়ি আমাকে কিছুটা ভয়ার্ত গলায় বললেন,

‘তানিয়ার যাওয়া কি ঠিক হবে সেখানে?’

শাশুড়ির এমন কথা শুনে আমি যারপরনাই আশ্চর্য হলাম। তিনি এ কেমন কথা বলছেন!

শাশুড়ি আবার বললেন,

‘মারে আমার বড্ড ভয় হচ্ছে। যদি সেখানে গিয়ে কিছু হয়… আর সে রেডিও হয়ে গিয়েছে ইতোমধ্যে তাকে না করবো কীভাবে!’

আমি শাশুড়ির মুখ আটকে দিলাম। শাশুড়িকে বললাম,

‘যদি তানিয়া আপা এসব শুনতে পায় তাহলে কী ভাববে বলেন মা? আর কোনকিছু হবে না। দুনিয়া এতোটা নিচে নেমে যায়নি যে মানুষ একজন ডিভোর্স হওয়া মহিলাকে নিয়ে আপত্তি তুলতে পারে৷ আপনি কোন টেনশন করবেন না মা।’

শাশুড়ি মা নিভু নিভু গলায় বললেন,

‘আল্লাহ ভালো জানেন কী হবে। আল্লাহ জানেন ভালো।’ প্রিয় পাঠক নিচের বার্তাটা উপেক্ষা করে যাবেন না। গল্পের জন্য নিজের বার্তাটা পড়ুন।

চলবে..