বিন্নি ধানের খই পর্ব-৫০+৫১+৫২

0
328

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_৫০
#মিদহাদ_আহমদ

দুরদুর বুকে আমি মেসেজটা ওপেন করলাম। একবার চোখ বন্ধ করতেই চোখের সামনে যেনো ভেসে উঠলো আমার বাবার শাদা কাফন পরানো দেহের ছবি। বাবা উঠে বলছেন, ‘আমার স্বপ্ন তোকে পূরণ করতেই হবে’

আমি এক দীর্ঘশ্বাস নিলাম। চোখ খুললাম। পৃথিবী সমান আশা আমার সামনে ভেসে উঠলো। এই মুহূর্তের আগে আমি কল্পনাও করিনি আমার জন্য এতোটা আবেগমাখা স্বপ্নের দিন কখনো আসবে৷ ওপেন করলাম মেসেজ৷ খোদার হাতে সপে দিলাম আমার স্বপ্ন। মেসেজটা দেখার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। মেসেজটায় লেখা,

MBBS Admission
Result Info:
Roll: 2102591
Status: Not eligible

আমি বুঝে উঠতে পারলাম না কী করবো। আমার সামনে অন্ধকার ছেয়ে আসলো। আসিফ বললো,

‘কী হলো? কী মেসেজ?’

আমি মোবাইলটা আসিফের দিকে তাক করালাম। আসিফ মেসেজ দেখে সহাস্যে বলে উঠলো,

‘আরে চিল। কোন বিষয় ই না। তুমি যে এত বড় একটা এক্সামে বিয়ে, সংসার সামলে অংশ নিয়েছো এটাই অনেক।’

শাশুড়ি সামনেই ছিলেন৷ শাশুড়ি আমার কাধে হাত রেখে বললেন,

‘এই মেয়ে, এতো মন খারাপ করলে হয়? জীবন তো একটাই৷ উপরওয়ালা আমার এত সুন্দর লক্ষ্মীমন্ত বউকে কষ্ট দিতে চাননি। মেডিকেলে পড়লে হয়তো কম কষ্ট করতে হতো না তোমায়। দেখি আমি রান্নাঘরে যাই। কিছু রান্না করে আসি।’

আমি মনে মনে অবাক হলাম। আমার শাশুড়ি আজ দুই মাস হলো রান্নাঘরে যান না। আজ শুধু আমার জন্য রান্না করতে রান্নাঘরে যাবেন? শুধু আমাকে খুশি করতে?

আমি নিজেকে সামলে নিলাম। একজন সাধারণ পরীক্ষার্থীর আগে আমি একজনের স্ত্রী, একজনের পুত্রবধূ, কারোর ভাইয়ের বউ, কারোর ভাবি। আমাকে আমার সংসারধর্ম পালন করতে হবে৷ শাশুড়িকে বললাম,

‘না না মা। আপনি কেন রান্না করতে যাবেন? কোন কিছু হয়নি। আমি ঠিক আছি ‘

‘না না। আমি যাই। আমি যাই। তোর কচু চিংড়ি দিয়ে লতা পছন্দ না? আজ আমি রান্না করবো দাঁড়া।’

শাশুড়ি চলে গেলেন হেলেদুলে। আমি রুমে এলাম। বিছানায় বসলাম। আসিফ মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে আমার গালে হাত দিয়ে ধরে টেনে বললো,

‘এই মেয়ে? কী হলো? হয়নি আবার হবে৷ এমন মন খারাপের দরকার আছে বলো? আমার মিষ্টি বউয়ের মুখে এমন গুমট ভাব মানায়?’

আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। আসিফ আমার মাথায় হাত দিয়ে ধরে বললো,

‘আরে না না৷ বাচ্চা নাকি। কিছুই হয়নাই তো।’

আমি আসিফকে জড়িয়ে ধরলাম। কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। হাউমাউ করে কান্না করলাম। আসিফও আমাকে জড়িয়ে ধরলো। কিছুক্ষণ পর আসিফকে ছাড়লাম। সে টিস্যু এনে আমার চোখ মুছিয়ে দিলো। পানি এক গ্লাস সামনে এনে বললো,

‘খাও।’

আমি পানি খেলাম। মায়ের নাম্বার থেকে সেই মুহূর্তে কল এলো৷ আসিফ মোবাইল নিয়ে চলে গেলো রুমের বাইরে। আমার চোখের সামনে আমার বাবার স্বপ্ন ভেসে এলো৷ আমার মায়ের দোয়া উঠে এলো৷ আমার অসহায় বিধবা মা আর আমার এতিম দুই ভাইয়ের জন্য কিছু করার যে বাসনা ছিলো আমার সেই বাসনা যেনো উবে গেলো। আকাশে মেঘের ঘনঘটা থাকলেও সূর্যের তীব্র কিরণ আমাকে ঘিরে ধরলো। আমার স্বপ্ন, আমার ইচ্ছা, আমার ভালোলাগা সবকিছু যেনো উপর ওয়ালার ইচ্ছায় আমার থেকে যোজন যোজন দূরে চলে গেলো৷ শ্বশুর রুমের দরজায় এসে কাশি দিলেন এমন সময়ে৷ আমি উঠে দাঁড়ালাম। শ্বশুর ভেতরে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,

‘মারে, জানিস মেয়েদের ভাঙ্গতে নেই। এই এক জাতিই তো পুরো দুনিয়া ঠিকিয়ে রেখেছে। আজ যদি একটা নুপুর ভেঙ্গে যায় তাহলে আগামীকাল হাজারটা আসিফ ভেঙ্গে যাবে। জানিস ই তো এটাই সৃষ্টির নিয়ম যে যুগে যুগে আমাদের মায়েরা, আমাদের মেয়েরা শক্ত হাতে সবকিছু সামাল দিয়েছে। পরীক্ষাই তো এইটা তাইনা?’

আমি শ্বশুরের কথার কোন জবাব দিলাম না। শ্বশুর আমাকে বিছানায় বসালেন। চেয়ার টেনে এনে নিজে বসলেন। বললেন,

‘তোকে একটা গল্প শুনাই মা। একবার এক রাজার একজন মন্ত্রী ছিলো। মন্ত্রী খুবই খোদাভীরু একজন মানুষ। সব কিছুতে মন্ত্রী বলতো, যা হয়েছে সব আল্লাহর হুকুমেই হয়েছে এবং মঙ্গলের জন্যই হয়েছে। একবার হলো কি, রাজা গিয়েছেন জঙ্গলে শিকার করতে। সাথে রাজার ওই খোদাভীরু মন্ত্রীও ছিলো। রাজা হরিণ শিকার করার সময় ভুলে ভুলে তার নিজের বর্ষা নিজের পায়ের বুড়ো আঙ্গুলে গেথে যায়। প্রাসাদে আসার পর রাজবৈদ্য সেই বর্ষাটা বের করে আনেন এবং রাজার সেই বুড়ো আঙুল ও কেটে ফেলেন। রাজা চিরতরে আঙুল হারালেন। মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এতেও কি মঙ্গল?’

মন্ত্রী বললো,

‘জি জাহাপনা। এতেই আপনার মঙ্গল। এবং এটা ভালোর জন্যই হয়েছে৷ আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।’

রাজা রেগেমেগে একেবারে আগুন হয়ে গেলেন। মন্ত্রীর এত বড় সাহস সে রাজার এই পায়ের আঙুল চিরতরে কেটে ফেলাকে মঙ্গল বলছে? রাজা মন্ত্রীকে জেলে বন্দি করে ফেললেন। এভাবে কেটে গেলো বছর আটেক।

একদিন রাজা আবার জঙ্গলে গেলেন শিকার করার জন্য। এবার ভুলক্রমে তিনি বন মানুষদের কবলে পড়লেন। তারা দলবেধে রাজাকে নিয়ে গেলো তাদের সর্দারের কাছে। তাদের কোন এক পূজা ছিলো সেদিন৷ পূজোর নিয়ম একজন জীবন্ত নিঁখুত মানুষকে দেবতার উৎসর্গে বলি দিতে হবে। রাজার অবস্থা একদম নাজেহাল। তারা সবাই রাজাকে ধরেবেধে নিয়ে গেলো বলি দেয়ার জন্য। রাজার জীবন যায় যায় অবস্থা। যখনই রাজাকে তারা বলি দিবে, তারা দেখতে পেলো রাজার পায়ের বুড়ো আঙুল নেই। তাদের সর্দার বলি আটকে দিলেন। একজন খুত ওয়ালা মানুষকে তাদের দেবতার উৎসর্গে বলি দেওয়া যাবে না৷ তারা রাজাকে ছেড়ে দিলো। রাজা চলে এলেন তার প্রাসাদে। এসে তিনি মনে মনে ভাবলেন, তিনি যারপরনাই বেঁচে গেলেন এইবার। পরেরদিন রাজা জেলখানায় গেলেন৷ দেখলেন মন্ত্রীকে। মন্ত্রী এক সময় তার শিকারের সঙ্গী ছিলো তাই তাকে তিনি সব খুলে বললেন কী কী হয়েছিলো। মন্ত্রী বললো, দেখেন রাজা মশাই আপনার পায়ের আঙ্গুল কাটায় আমি বলেছিলাম না এতেই আপনার মঙ্গল? দেখলেন তো? আপনার মঙ্গল এতেই? আজ আপনার মাঝে খুঁত থাকায় আপনি বেঁচে গেলেন। নাহলে আপনাকে বলি হতে হলো। সবই আল্লাহর ইচ্ছা।

রাজা অবাক হলেন৷ সত্যিই তো। আজ তার পায়ের এই খুঁত না থাকলে তিনি হয়তো বেঁচেই থাকতেন না। তারপর রাজা আবার মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন,

‘এইযে তোমার জীবন থেকে আট বছর চলে গেলো, এতেও কি তোমার প্রভুর ইচ্ছা এবং ভালোর জন্যই?’

মন্ত্রী এবার কায়মনোবাক্যে জবাব দিলো,

‘হ্যাঁ জাহাপনা। আমার মঙ্গলের জন্যই।’

‘যেমন?’

‘যদি আপনি আমাকে বন্দি না করতেন তাহলে এবার আপনার শিকারের যাত্রায় আমিও থাকতাম। বন মানুষেরা আমাকেও আপনার সাথে বন্দি করে নিয়ে যেতো। তারপর যখন আপনার পায়ে খুঁত দেখতো আর আমি একজন নিঁখুত মানুষ সাথে থাকতাম তখন তারা আপনাকে ছেড়ে দিয়ে আমাকে বলি দিয়ে দিতো। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন৷ এজন্যই আপনি আমাকে বন্দি করেছেন।’

‘কী? কী বুঝলা বউমা? মন খারাপ কি আছে এখনও?’

শ্বশুরের বলা গল্পটা শুনে আমার ভেতরটা কেমন প্রশান্ত হয়ে উঠলো৷ আমি খুশি হয়ে গেলাম। শ্বশুরকে বললাম,

‘না বাবা। আল্লাহ যা করেন তা ভালোর জন্যই করেন৷ এতেও হয়তো আমার ভালো আছে।’

রাতে আসিফ আমাকে বুঝালো যে এসব কিছু না৷ সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আবার যেনো চেষ্টা করি। পরেরদিন দুপুরে শাশুড়ি আমাকে ডেকে নিয়ে ওনার মাথায় হাত ছুইয়ে কসম কাটালেন, আমি যেনো আর পড়াশোনা না করি। শাশুড়ি অনুনয় করে বললেন,

‘মা রে। আমি আর সহ্য করতে পারছি না এতো জ্বালা যন্ত্রনা। এখন আমি চাই তুই আমার সংসার সামাল দে। আমার ঘরটা আলোকিত করে রাখ৷ আমাকে মুক্তি দে।’

আমি শাশুড়ি মায়ের কথা আর ফেলতে পারলাম না। মনে মনে শপথ করলাম, আমি আর পড়াশোনা আগাবো না।

আসিফ এরপর অনেকবার চেষ্টা করেছে আমাকে মুভ অন করানোর। আসিফকে বুঝতে দেইনি আমার ভেতরে চেপে থাকা ইচ্ছাগুলো। তাকে বলেছি শুধু যে আমার পক্ষে আর পড়ালেখা কন্টিনিউ করা সম্ভব হবে না। আমার আর ইচ্ছা নেই পড়ালেখা আগানোর। আসিফ বেশ কয়েকবার কারণ জিজ্ঞেস করেছিলো। এও বলেছিলো যে আমি যেনো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে থাকি কমপক্ষে। কিন্তু আমার সিদ্ধান্তের কাছে বরাবর শাশুড়ির অনুরোধ ভেসে উঠেছিলো। তাই বারবার তাকে না করে দিয়েছিলাম। আমি চেপে রেখেছিলাম আমার স্বপ্নের আধারকে।

সপ্তাহ খানেকের মাথায় ননাসকে বাসায় নিয়ে আসা হলো। আল্লাহর অপার মহিমা, ননাস সুস্থ হয়ে গেলো পুরোপুরি। সব ধরণের জটিলতা যেনো কেটে গেলো একসাথে। এরই মাঝে মাস নয়েক কেটে গেলো। ননাস আবার আগের মতো হয়ে উঠেছেন। তার বেকিং বিজনেস এখন রমরমা। শহরে নামকরা বেকিং পেইজ তার। বাসায় তিনজন হেল্পিং হেন্ড ও রেখেছেন ননাস। প্রতিদিন অর্ডার আসে কমপক্ষে পঞ্চাশ ষাট টা কেক। এই কেক নিয়ে যখন ননাস মেতে থাকেন সর্বক্ষণ, তখন এক অপার আনন্দ অনুভব হয়৷ এদিকে বদরুলকে লন্ডন নিয়ে গিয়েছে তার মামাতো বোন। ফ্ল্যাট আর তাদের দুই তলা বাসা বিক্রি করে দেড় কোটি টাকা দেয়ার বিনিময়ে সে লন্ডন গিয়েছে।
মাস নয়েক পর তামান্নার একটা টুকটুকে ছেলে হলো৷ শ্বশুর শাশুড়ি আনন্দে আত্মহারা। ননাস, আমি, শ্বশুর, শাশুড়ি, আসিফ সহ সবাই গেলাম তামান্নার ছেলেকে দেখতে৷ বাড়িতেই হয়েছে নরমাল ডেলিভারি। যদিও শুনেছিলাম অবস্থা বেগতিক তার পরও তারা তামান্নাকে ডাক্তারে নেয়নি। ধাত্রী এনে বাড়িতেই ডেলিভারি করিয়েছে। তামান্নার শাশুড়ি আমার শাশুড়িকে বললেন,

‘এখন নাতির নানা বাড়ি থেকে নুয়াই নিয়ে আসছেন কবে? আমরা কিন্তু এক হাজার দাওয়াত দিবো। আগে বলে দিলাম। বড়লোক নানার প্রথম নাতি বলে কথা।’

‘কোন সমস্যা নেই। আপনি চিন্তা করবেন না। গরু দুইটা দিয়েই আমার নাতির নুয়াই হবে। নানাবাড়ি থেকে নিয়ে আসার কোন কমতি হবে না।’

খাওয়ার পর শাশুড়ি আর তামান্না রুমে বসে গল্প করছিলেন৷ আমি মায়ের সাথে কথা বলায় ছিলাম। কথা বলার এক পর্যায়ে জানালার পাশে থেকে শুনতে পাই শাশুড়ি তামান্নাকে বলছেন,

‘আল্লাহ যা করেছেন ভালোর জন্যই করেছেন৷ যদি নুপুর মেডিকেলে চান্স পেয়ে যেতো তাহলে আমার সংসার কর্ম দেখা সব উচ্ছন্নে যেতো। আমি এখন শান্তি। নুপুর আমার লক্ষ্মীমন্ত বউ। সে কেন ডাক্তার হবে? যেমন আছে তেমন ঘরকন্নার দায়িত্ব পালন করবে ‘

কথাটা শুনে আমার চোখ দিয়ে জল গড়ালো। আমার স্বপ্ন ভঙ্গের চেয়েও বেশি কষ্ট অনুভূত তখন তখন, যখন জানতে পারলাম আমার চান্স না হওয়াতে আমার শাশুড়ি খুশি হয়েছে। আর আমি তো তাঁর কথায় ই সেকেন্ড টাইমের প্রিপারেশন নেইনি। আসিফ আমাকে ঠিক ই বলেছিলো আমার চেষ্টা করার। কিন্তু সেই চেষ্টা আমিই যে না করে দিয়েছিলাম। আর আজ? আমার স্বপ্নের কাছে তাদের সংসারধর্ম বড় হয়ে উঠলো? আমার স্বপ্ন নয়?’

পুরো পৃথিবীকে আমার চোখের সামনে ছোট মনে হলো। আর্তনাদ ছেয়ে বসলো আমার শব্দহীন মন জুড়ে। একটা স্বপ্ন ভঙ্গের চেয়েও বেশি দুঃখ ভর করে যখন স্বপ্ন ভঙ্গে কারো আনন্দ উৎযাপন দেখা যায়৷ অদেখা অনেককিছু মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। ভাঙ্গা স্বপ্ন মানুষকে শেষ করে দেয় ভেতর থেকে। এই স্বপ্নেরা আকাশে উড়ে বেড়ানোর আগেই উবে যায়।

(চলবে)

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_৫১
#মিদহাদ_আহমদ

সে যাত্রায় আমার পড়াশোনার ইতি ঘটলো। কিন্তু কথায় আছে না, বিধাতা যাকে দিতে চান তাকে কেউ বঞ্চিত করে রাখতে পারে না। হয়তো বিধাতার ইচ্ছাতে এমন কোনকিছু আমার কপালে লিখা ছিলো। তিনি হয়তো তার সেই ইচ্ছার জন্যই আমাকে আমার আরাধ্য আমার স্বপ্ন মেডিকেলে চান্স দেননি৷ হয়তো তার বিধানে ছিলো অন্যকিছু।

বছর ঘুরতেই আমার কোলে এসে জায়গা জুড়ে নেয় আমার অংশ, আমার নাড়িছেঁড়া ধন, আমার মেয়ে। আমার গল্প। যেদিন সে পৃথিবীতে আসলো, সেদিন আমি যেনো পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে বড় খুশিটাই পেয়ে গিয়েছিলাম। আমি প্রেগন্যান্ট থাকা অবস্থায় আসিফ আমার সামনে বসে বসে প্রচ্ছদের সব কাজ করতো৷ আমি বসে বসে দেখতাম। মাঝেমধ্যে জিজ্ঞেস করতাম এইটা ওইটা কীভাবে কীভাবে করলো সে। আসিফ আমাকে বুঝিয়ে দিতো৷ এই বুঝাতে বুঝাতে কখন যে আসিফের সাথে হাত মেলাতে গিয়ে আমিও অল্প বিস্তর আঁকিবুঁকি শিখে ফেললাম তা আর ভাবনায় ই রাখে না। গল্প তখন আমার পেটে। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়া, ছাদে গিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করা আর গুনগুন করে গান গাওয়া ছাড়া সকালে আর কোন কাজ ছিলো না আমার। সকাল এগারোটার দিকে আসিফের অফিসের সহকারী একজন একগাদা আর্ট আর সিম্পল এনে, কার্টিজ পেপারে পিন করে সিম্পল দিয়ে চলে যান। আসিফ ঘুম থেকে উঠে কাজে হাত লাগায়। আমি তাকে বারবার বলতাম, অফিসের কাজ বাসায় কেন করে? অফিসে যায় না কেন। আসিফ আমার কথা শুনতো না। আসিফ বলতো,

‘আমার অংশ পৃথিবীতে আসতে চলেছে তোমার মাধ্যমে। এখন তোমার যত্ন শুধু একার না, তোমার সাথেসাথে আমাদের অনাগত সন্তানেরও যত্ন আমাদের করতে হবে। সন্তান শুধু তোমার একার না, এর প্রতি দায়িত্ব তো আমারও। তাইনা নুপুর?’

আসিফের এমন কথার শেষে আমি আর কথা বলতে পারি না। বলবো কীভাবে? এমন সময়ে সব মেয়েদের হয়তো ইচ্ছা করে তার নিজের মানুষটা তার কাছে থাকুক৷ তাকে ভরসা দিক। আসিফ একটা মুহূর্তের জন্য আমাকে একা ফিল হতে দেয়নি। শ্বশুর রোজ বিকালে গল্পের বই এনে জোরে জোরে পড়তেন আমার সামনে। আমি গল্প শুনে হাসতাম। মাঝেমধ্যে জিজ্ঞেস করতাম,

‘আমাকে গল্প শুনাচ্ছেন কেন বাবা?’

শ্বশুর হেসে হেসে জবাব দিতেন,

‘তোকে না, আমার ওই পুচকে দাদুভাইকে শুনাই৷ দাদুভাই দুনিয়ায় এলে তোর হাতের চা খাবো। চায়ের জন্য কতো উশখুশ করছে মন!’

আমি চা বানাতে যেতে চাইলে বাধা দেন এসে শাশুড়ি। তিনি না করে দিয়েছেন সরাসরি। এই নয়মাসে কোন ধরণের কাজ আমার করা যাবে না। এরই মাঝে একটা রেস্ট্রিকশন ও দিয়ে দিয়েছেন শাশুড়ি। আমি বাপের বাড়ি যেতে পারবো না। মাঝখানে বার দুয়েক মা এসে দেখে গিয়েছিলেন আমাকে। শাশুড়ি আমার মেয়ে গল্প দুনিয়ায় আসার আগেই যেনো এক মহা উৎসব আয়োজন করতে লেগে গিয়েছেন। বাড়িতে মহিলা কয়েকজন এনে, পুরোনো সুতি কাপড় ধূয়ে, মাড় দিয়ে শক্ত করে মিহি সুতোর কাজ করাতে লাগলেন। কী আদর আর দরদ মাখা সেই কাজগুলো!

গল্পের পেটে থাকা অবস্থাতেই আমি ছবি আঁকা রপ্ত করে ফেললাম। এইটা ওইটা ধরাধরি করতে করতে আসিফ আমাকে শেষমেশ শিখিয়েই ছাড়লো তার ছবি আঁকা। আমিও যেনো এক পৃথিবীর আগ্রহ খুঁজে পেলাম ছবি আঁকার মধ্য দিয়ে। পুরোদমে সংসারী হয়ে যেতে শুরু করলাম। এরই মাঝে তিন তিনটা বছর কেটে গেলো। গল্পের তিন বছর হয়ে গেলো। আঁকিবুঁকি নিয়ে টুকটাক কাজ, প্রচ্ছদ ডিজাইন করা এসব আমার সহজেই রপ্ত হয়ে গেলো। তামান্না বছর দুয়েক আগেই মিশিগান চলে গেলো তার ছেলেকে নিয়ে। হুট করে একদিন তামান্না কল করে আমাকে আর তার ভাইকে জানালো, আমরা দুজনে কেন হায়ার স্টাডির জন্য আমেরিকা আসি না। এখানে আর্ট কালচার নিয়ে কাজ করার দারুণ স্কোপ আছে। আমি তামান্নাকে না করে দেই৷ বিয়ের পাঁচ বছর পর, এখন আর নতুন করে পড়াশোনার ভার নেয়ার মতো মানসিক প্রস্তুতি আমার নেই।

সেদিন রাতে আসিফ আমাকে বললো,

‘এখন আবার শুরু করা যায় না নুপুর? সবকিছু নতুন করে? আবার নতুন এক শুরু?’

‘না আসিফ। এখন আমাদের গল্প হয়েছে। তাকে নিয়েই আমাদের সবকিছু। দেখো আমাদের গল্প এখন হাঁটতে পারে৷ তার ছোট ছোট ঠোঁট দুইটা এক করে যখন মা মা করে ডাকে, তখন কী যে ভালো লাগে! আমি এই ডাক শুনেই জীবন পার করে দিতে চাই।’

‘কিন্তু পড়াশোনা?’

‘পড়াশোনা তো অনেক করলাম। এখন আমার ঘর সংসার করি আমি’

আসিফ না সূচক মাথা নাড়ালো। আমি বুঝতে পারলাম ভেতরে ভেতরে আমার এই সিদ্ধান্তে সে সম্মত নয়। সপ্তাহ খানেক পর আসিফ জানালো সেন্ট্রাল মিশিগান কলেজে আর্ট কালচারের উপর ডিপ্লোমার জন্য আমার আর তার নিজের জন্য মাস্টার্সে সে আবেদন করেছে। আমি হেসে হেসে উড়িয়ে দিলাম তার কথাগুলো৷ তাকে বললাম,

‘ডাক্তারির জন্য পড়াশোনা করে এখন আবার আর্ট কালচার? আমাকে দিয়ে এসব হবে নাকি?’

‘কেন হবে না নুপুর? অবশ্যই হবে। জীবন কখন আমাদের কোনদিকে নিয়ে যায় তা কি আর আমরা জানি? এরই নাম তো জীবন।’

সেদিনের মতো আর আমাদের কথা এগোয় না। দিন দুই পরে একদিন ননাস আমার কাছে এসে বসে আমাকে বলতে লাগলেন,

‘নুপুর তুমি আমার পুচকে গল্পের জন্য চিন্তা করো না। আমি আছি না? ফুপু থাকতে কী চিন্তা আমার মেয়ের? গল্পের ফুপু এখনও জোয়ান। শরীরে ভারী শক্তি আছে তার। সে সামলে নিতে পারবে তার ভাইজিকে।’

‘ননাসের মুখে এই সামলে নেয়ার না নেয়ার কথা শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

‘কিছু বুঝিনি আপা।’

ননাস আমার মাথায় হাত রাখলেন। তারপর এক শীতল চক্ষুতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘তুই এই কয়েক বছরে শক্ত হাতেই আসিফের সাথে থেকে শিখে নিয়েছিস আর্টের কাজগুলো৷ দেখ, কতো মায়াভরা হাতে তুই এই কাজগুলো করিস। এখন তোর সময় এসেছে এগুলো নিয়ে উচ্চ পর্যায়ে কিছু করার৷ একটা ডিগ্রি অর্জন করার। আর কথা যখন গল্পের, তখন গল্পকে দেখার জন্য আমি আছি৷ আমিও তো গল্পের মা হই। তাইনা নুপুর? নাকি আমি গল্পের মা নই?’

‘না না আপা। আমার থেকে গল্পের উপর আপনার অধিকার বেশি। গল্প আমার না, গল্প আপনার মেয়ে। ও আপনার সবকিছু।’

আমি কথাটা বলতেই ননাস আমার বিছানার উপর ঘুমিয়ে থাকা গল্পকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলেন৷ ননাস আজ বছর খানেক থেকেই কেমন জানি চুপচাপ হয়ে গিয়েছেন। কেকের বিজনেস আর এগিয়ে নিতে পারেননি। ননাস সবচেয়ে বেশি ট্রমায় পড়েছিলেন, যেদিন বদরুল লন্ডনে কার এক্সিডেন্ট করে মারা যায়। খবরটা ননাস কোথা থেকে পেয়েছেন আমাদের কারোর জানা নেই। কিন্তু পেয়েছেন। ননাস তার নিজের ইচ্ছাতেই সেদিন তার রঙিন ভূষণ ছেড়ে সাদা কাপড় গায়ে তুলে নিয়েছিলেন। এরপর থেকে যাই পরেছেন ননাস, সব এমন সাদা রঙের। ঠোঁটে লিপস্টিক নেই, গায়ের আভূষণে রঙ নেই। কোনকিছু নেই। ভেতরে ভেতরে নিজেকে এক আজন্ম বিধবা হিসেবে মেনে নিয়েছেন যেন! একা একা নিজেকে সেটে দিয়েছেন গভীর একলা জীবনে৷

শাশুড়ি রান্নাঘরে আমাকে কথার ফাকে ঘোর আপত্তির সুরে না করে দিলেন৷ বললেন,

‘এখন আবার নতুন কী শুরু করেছে আসিফ? সে বললেই হলো? মেয়েকে রেখে আমেরিকা গিয়ে পড়াশোনা আবার কী? কোন কাজকাম পাচ্ছে না নাকি? তুমি নুপুর শুনে রাখো, সে যাই বলুক, যাই করুক তোমার যাওয়া হচ্ছে না’

মাস তিনেকের মাথায় আসিফের পাগলামি আরও বেড়ে গেলো। কিন্তু সবশেষে আমার হ্যাঁ সূচক সম্মতিই আমাকে নিয়ে গেলো আমেরিকায়। আমার পড়াশোনার কাছে৷ ভেতর থেকে হুট করে অনুভব করতে লাগলাম, আমাকে আমার নিজের জন্য কিছু করতে হবে৷ এখন যখন ঘর হয়েছে, বাচ্চা হয়েছে, এবার নাহয় নিজের জন্য কিছু করি। শাশুড়ির আপত্তি চড়া হয়ে উঠলেও শেষমেশ ননাস এগিয়ে আসেন। দুই হাত উজাড় করে আগলে রাখেন আমার গল্পকে। ননাস শাশুড়িকে বুঝালেন। বললেন আমাকে আমার মতো করে পড়াশোনা শেষ করার সুযোগ যেনো তিনি দেন। আসিফ আর্ট এন্ড কালচারের উপর মাস্টার্সের জন্য ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ পেয়ে গেলো। আমার ডিপ্লোমা কোর্সের জন্যও তারা ত্রিশ পার্সেন্ট স্কলারশিপ দিলো। ভূমি মাটি বাংলাদেশ আর আমার ননাসের হাতে আমার নাড়ি ছেড়া ধন আমার বাচ্চা গল্পকে দিয়ে আমি আর আসিফ পাড়ি জমালাম সুদূর আমেরিকায়। আসিফ আমাকে ভরসা দিতে দিতে বললো

‘গল্প এখানে তার আরেক মায়ের কাছে ভালোই থাকবে। আমরা আমাদের গন্তব্য পর্যন্ত যেতে চাই এখন। ড্রিম এমন এক জিনিস যা পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত মানুষ আর মানুষ হয়ে উঠতে পারে না।’

আমি আসিফের চোখেমুখে তার ড্রিম পূর্ণ হওয়ার উচ্ছ্বাস দেখছিলাম। আমি গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারছিলাম আসিফ তার এক সময়ের ড্রিম প্রজেক্ট, আর্ট কালচার নিয়ে পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে। তার এই সুযোগ আর উচ্ছ্বাস আমাকে ভেতর থেকে মুগ্ধ করে তুললো। অন্যদিকে আমিও হাতছানি দিতে লাগলাম আমার পড়াশোনার স্বপ্নে। এ যেনো এক নতুন উদ্দেশ্যে যাত্রা…

(চলবে)

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_৫২
#মিদহাদ_আহমদ

Coleman A. Young International Airport এ গিয়ে যখন আমরা ল্যান্ড করি, তখন আমার ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো৷ আমি কোথাও যেনো নিজের অস্তিত্ব ছেড়ে এসেছি। আমার গল্প যেনো আমাকে টানছে। মায়ের মন সব সময় সন্তানের জন্য আনচান করে উঠে। আসিফ আমার হাত শক্ত করে ধরলো৷ আমাকে ভরসা দিয়ে বললো,

‘টেনশনের কোনকিছু নেই নুপুর। দেখো আমাদের সামনে বিশাল পৃথিবী। আমরা আমাদের সেই পৃথিবীর খোঁজে এসেছি। আমাদের এখন এগিয়ে যেতে হবে আপন খোঁজার উদ্দেশ্যে। আমাদের ড্রিম পূরণের উদ্দেশ্যে।’

আমি আসিফের দিকে তাকিয়া চোখের পাতা ফেলে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলাম। সামনেই রাজীব আর তামান্না কার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তামান্নার হাত ধরে আছে সেই পুচকে রাফসান। রাফসানের বয়স দেখতে দেখতে চার হয়ে গিয়েছে। রাফসান বয়সের তুলনায় কিছুটা লম্বা। ঠিক তার বাবার মতোন হয়েছে যেনো। তামান্না আমাকে দেখিয়ে রাফসানকে বললো,

‘সি ইজ ইউর আন্টি। সে হেলো।’

‘হেলো আন্টি।’

আমি একটা চুমু খেলাম রাফসানের কপালে। রাফসানের শরীর থেকে বের হওয়া বাচ্চা সুলভ গন্ধ আমাকে মাতৃত্বের টানে অবস করে ফেললো। অজান্তেই ভিজে এলো চোখ দুইটা। আসিফ হয়তো বুঝতে পেরেছিলো। রাফসানকে আমার থেকে ছাড়িয়ে সে হ্যান্ড শেইক করলো রাফসানের সাথে। আমরা গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। রাজীব আমাদের নিয়ে একটা পিৎজা কোর্টে ঢুকলো। রাফসান বলে উঠলো,

‘চিকেন পিৎজা…নট স্পাইসি, নট স্পাইসি।’

তামান্না হেসে উঠলো৷ আসিফের দিকে চেয়ে বললো,

‘ভাগিনা তার মামার মতোই হয়েছে। সেও ঝাল খেতে পারে না। আর পিৎজাই ওর পছন্দ৷ এছাড়া ফার্স্টফুড সে কোনকিছু খায় না তেমন।’

আমার আবার মনে পড়ে গেলো আমার গল্পের কথা। আমার বানানো আলুর চিপস আর ম্যাকারোনি নুডুলস মেয়েটা সস দিয়ে খেতে দারুণ পছন্দ করতো! দুধদাঁত দিয়ে যখন কুটুস কুটুস করে আলুর চিপস কেটে খেতো, তখন তাকে কী দারুণ লাগতো! সস আঙুলে নিয়ে কাপড়ে লাগিয়ে একদম যা তা অবস্থা করে ফেলতো মেয়েটা! আমি বকাঝকা করলেও মেয়েটা ফিক ফিক করে হাসতো৷ কী জানি মায়ের বকাকে তার কাছে হাসি খেলা মনে হতো হয়তো!

এদিকে তানিয়াকে গল্পের সাথে একা একা কথা বলতে দেখলেন তানিয়ার মা। তানিয়া গল্পকে নিজের কোলে নিয়ে বলছে

‘এইতো মা। তোমার মা তোমার কাছে চলে এসেছে। আমার ছোট্ট মেয়েটা। আমার একমাত্র মেয়ে। ‘

কথাগুলো বলছে আর গল্পকে জড়িয়ে ধরছে সে। তানিয়ার মা দরজা খুলে রুমে ঢুকলে তানিয়া উঠে এসে এগ্রেসিভভাবে বলে বসে,

‘আরে দেখছো না আমার মেয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর তুমি এখন চলে এলা। তাও দরজা শব্দ করে খুললা। আমার সোনামনির ডিস্টার্ব হচ্ছে৷ বুঝো না কেন তোমরা। আমার বাবুটার কষ্ট হচ্ছে এখন।’

তানিয়াকে কিছু বললেন না তানিয়ার মা৷ চলে এলেন রুম থেকে। সপ্তাহ খানেক পরের ঘটনা৷ নুপুর কল করেছে আমেরিকা থেকে। প্রতিদিন ই কয়েকবার করে। ভিডিও কলে দেখে মেয়েকে৷ কথা বলে সবার সাথে। ঠিক তেমনি কল করেছিলো। কিন্তু বাধ সাধলো তানিয়া। সে গল্পকে ভিডিও কলে দেখাবে না। তানিয়াকে তানিয়ার মা বুঝানোর চেষ্টা করলেও তানিয়া বলে বসলো,

‘না। আমার মেয়েকে সে দেখবে কেন৷ আমার মেয়েকে কেন তাকে দেখতে দিবো? সে কেন দেখবে? শুধু শুধু আমি অন্যজনকে আমার মেয়ে দেখতে দিবো না। নজর লেগে যাবে। নজর লেগে যাবে। তোমরা আমাকে জোর করো না৷ সরো এখান থেকে।’

তানিয়া গল্পকে নিয়ে রুমের ভেতর থেকে লক করে দিলো। নুপুর আর জোর করলো না। নুপুরকে নুপুরের শাশুড়ি বললেন যে তানিয়া ঘুমিয়ে পড়েছে গল্পকে নিয়ে দরজা লাগিয়ে৷

একদিন তামান্নার মা খেয়াল করলেন তানিয়া গল্পকে মোবাইলে নুপুরের ছবি দেখিয়ে দেখিয়ে বলছে,

‘আম্মু ওই দেখো তোমার ফুপি। ফুপি।’

তারপর সে নিজের দিকে ইশারা করে বলতে লাগলো,

‘আয়ায়াম্মু। বলো মা আম্মু’

গল্পও আম্মু বলতে বলতে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়লো তানিয়ার উপর। হঠাৎ তানিয়া তার মাকে দরজায় দাঁড়ানো দেখলে সে ডেকে বলতে লাগলো,

‘মা দেখেছো আমার মেয়ে আমাকে মা বলে ডেকেছে? দেখেছো মা?’

তানিয়ার মা রুমে ঢুকলেন। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। উপরের দিকে তাকিয়ে মনের ভেতরে জাগ্রত হওয়া শঙ্কাকে হাতছানি দিলেন আনমনে। মুখে কিছুই বললেন না।

আসিফ মাস্টার্স শেষে পিএইচডির জন্য আবেদন করলো। আসিফের পিএইচডি থিসিস শেষের দিকে চলে আসলো আর এদিকে আমার ডিগ্রিও কমপ্লিট হয়ে যায়। আমি যেনো এক প্রশান্তির রেশ অনুভব করতে লাগলাম। আমি দেশে ফিরে আসতে চাইলেও আসিফ বাধা দেয়। আসিফ বলে,

‘শুনো, এখন মাস্টার্স কমপ্লিট করে পিএইচডি। এইটাই তোমার আসল গোল হওয়া উচিত। এছাড়া আর কোনকিছু না৷ আর দেশে আমাদের গল্প তো আছেই। মা আছেন, আপা আছেন। তাদের কাছে সুস্থ মতেই আছে আমাদের গল্প। কোন চিন্তা করার কিছু নেই। তুমি শুধুশুধু টেনশন নিচ্ছো কেন?’

শত বুঝানোর পরও আসিফ তার কথায় অটুট রইলো। সে জানিয়ে দিলো, আমি মাস্টার্স কমপ্লিট করে পিএইচডি শেষে তবেই দেশে ফিরতে পারবো। এর আগে না। শেষমেশ আসিফের কথার জেরে আমাকে মানতেই হলো। শাশুড়ি কল করে বারবার বলতেন, আমি যেনো দেশে চলে আসি। সবকিছু যেনো নিজের হাতে আগলে নেই আবার। আসিফকে বললাম, ভ্যাকেশনে দেশে যেতে। আসিফও রাজি হয়ে গেলো।

আজ সেই দিন। আজ আমি বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওনা হবো। মাত্র দুই সপ্তাহের জন্যই হোক, আমি আমার গল্পকে আমার কাছে পাবো। নিজের কাছে পাবো। আমার নাড়িছেঁড়া ধন আমার কাছে আসবে। প্লেইনে বসে বসে আসিফকে জিজ্ঞেস করছিলাম বারবার,

‘আমার গল্প অনেক বড় হয়ে যাবে তাইনা? এখন সে বলতেও শিখে গিয়েছে পুরোপুরি। ক্লাস ওয়ানে পড়ে৷ অনেক পটু হয়ে গিয়েছে না আমার গল্প? আমাকে চিনতে পারবে তো?’

‘আরে বাবা পারবে। আর কিছুক্ষণ মাত্র। কয়েক ঘন্টা। তার পরেই আমাদের গল্প আমাদের কাছে চলে আসবে। তাইনা? দুই সপ্তাহের জন্য মেয়েকে মন খুলে দেখো। কেমন?’

হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেইস ল্যান্ড করলো দুপুর তিনটায়। আধা ঘন্টা থেমে আবার যাত্রা শুরু করলো সিলেটের উদ্দেশ্যে। সিলেট এয়ারপোর্ট থেকে সবকিছু শেষ করে বের হতে হতে পাঁচটা বেজে গেলো। শ্বশুর এয়ারপোর্টে চলে এসেছেন আমাদের নিতে। শ্বশুরের সবকটা দাড়িতে যেনো পাক ধরে গিয়েছে৷ আমি সালাম করলাম তাঁকে পায়ে ধরে। শ্বশুর আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললেন,

‘জীবনে বহুত তারাক্কি করো মা। অনেক দোয়া করি৷ আল্লাহ তোমার সব স্বপ্ন পূর্ণ করুন’

বাসায় ঢুকতেই মায়ের হাতের মোরগ ভূণার গন্ধ পেলাম। আমার মায়ের হাতের। সেই মোরগের গন্ধ, আমাদের টিনচালা ঘরের মাটির চুলায় লাকড়ি দিয়ে রান্না করা ভূণার গন্ধ! শাশুড়ি মা আর আমার মা বাইরে চলে এলেন। শাশুড়িকে সালাম করলাম পায়ে ধরে। শাশুড়ি আসিফকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করে দিলেন৷ তারপর বলতে লাগলেন,

‘বাবা কতদিন হয় তোকে দেখিনা। কতদিন!’

আমার মন শুধু খুঁজে বেড়াচ্ছিলো গল্পকে। গল্প কোথায়। আমি বলার আগেই শাশুড়ি বললেন,

‘গল্প তার আর্ট টিচারের কাছে গিয়েছে নুপুর। তানিয়ার সাথে। আগামী পর্শুদিন তাদের একটা এক্সিবিশন আছে আর্টের। চলে আসবে কিছুক্ষণের মাঝে। আসো ভেতরে।’

আমার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আসিফ আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো একবার। তার এই হাসির মুখে থাকা কথাটা ছিলো এমন, ‘আসবে তো গল্প। এতো উতলা হয়ো না তো তুমি’ আমি এই কথাটা মনে মনে বুঝে নিলাম। বসলাম সোফায়। শাশুড়ি কাজের মেয়েকে ডেকে সব লাগেজ আমাদের রুমে নিয়ে রাখতে বললেন। আমি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম। এই সেই সিঁড়ি, এই সেই বাড়ি যেখানে আজ থেকে আট বছর আগে আমি বউ হয়ে এসেছিলাম। রুমের দরজা খুলতেই দেখলাম সবকিছু সেই আগের মতোই গোছানো। সব ঠিকঠাক। পরিবর্তন শুধু রঙে। আগে চার দেয়ালের এক দেয়ালে ছিলো ক্রিম কালার, মাথার পেছনে বেগুণি আর ঠিক সামনে সাদা আর গোল্ডেনের ছোপ ছোপ। অন্য দেয়াল জুড়ে কেভিনেট। এখন পুরো তিন দেয়ালেই সাদা। মাথার উপরে শুধু গাঢ় বেগুণি আভা। দেয়ালে সেটে রয়েছে শিল্পী হাসেম খানের বানানো আমাদের দুজনের সেই পোর্টেট! কী মায়া মাখা ছবিটা! জানালায় গিয়ে দাঁড়ালাম। হঠাৎ বেলের আওয়াজ। আমি রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। আসিফও আমার সাথে এলো। শাশুড়ি মা দরজা খুলে দিলেন। একটা ফুটফুটে সুন্দর পরির মতো বাচ্চা মেয়ে তার মোলায়েম দুই হাত দিয়ে শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরলো। আমার মায়ের হাতে ব্যাগ দিতে দিতে বাচ্চা মেয়েটা বললো,

‘জানো নানুভাই, আজ কী হয়েছে? আজ আমাদের ফাইনাল সিলেকশন ছিলো। আর আমি সিলেক্টেড হয়েছি। আজ আমি ভীষণ খুশি।’

‘আই লাভ ইউ আম্মু’ কথাটা বলেই সেই ছোট্ট মেয়েটা জড়িয়ে ধরলো তার পাশে থাকা সাদা শাড়ি পরিহিতা মহিলাকে। আমি মহিলার দিকে তাকালাম। লম্বা ইষৎ চুল আর সাদা শাড়িতে সবুজ পাড়ে শাড়ি পরা মহিলাটাই আমার ননাস তানিয়া।

(চলবে)