বিন্নি ধানের খই পর্ব-৫৯+৬০+৬১

0
347

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_৫৯
#মিদহাদ_আহমদ

রাতে খাবার রেডি করতে করতে শাশুড়ি আমাকে বললেন,

‘মারে, কিছু কি ভাবা যায় না?’

শাশুড়ির কথা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। ইঙ্গিতও বুঝতে পারলাম। আমি শাশুড়িকে ইশারায় চুপ করতে বললাম। জানালার থাইয়ের গ্লাসে দেখতে পেলাম ননাস রান্নাঘরের দিকে আসছে৷ ননাস রান্নাঘরে এসে জিজ্ঞেস করলো, রান্নায় ঝাল কম আছে কিনা। শাশুড়ি মা জবাব দিলেন,

‘হ্যাঁ রে মা। রান্নায় ঝাল কম। আমি তো জানি যে গল্প ঝাল খেতে পারে না।’

‘না ঘরে নতুন নতুন মানুষজন এসেছে তো। তাই যদি কেউ ঝাল বেশি দিয়ে দেয় তাহলে আমার মেয়েটা খেতে পারবে না।’

ননাসের এমন কথায় আজ থেকে কয়েক বছর আগে হলে আমি রাগ করতাম। হয়তো কিছু বলেও দিতাম মুখের উপর। কিন্তু এখন আর বলি না। আমি ভেতর থেকে দেখি, একজন মানুষের ধ্যান, জ্ঞান সব আমার মেয়েকে ঘিরেই। তিনি আমার মেয়ের ভালোই চাচ্ছেন।

ননাস রান্নাঘর থেকে বের হওয়ার সময়ে শাশুড়ি মাকে বলতে লাগলো,

‘মা দেখেছো মেয়েটা কত লক্ষ্মী! আল্লাহ মেয়েটার মাকে তার থেকে নিয়ে নিলেন। বাচ্চাটার জন্য বড্ড মায়া হয় আমার’

‘হ্যাঁ রে মা। আল্লাহর বিধান৷ এর বাইরে যাওয়ার হুকুম যে আমাদের নেই।’

ননাস গুনগুন করে গান ধরে চলে গেলো রান্নাঘর থেকে। শাশুড়ির চোখেমুখে উচ্ছ্বাস। আমারও সেই একই উচ্ছ্বাস। শাশুড়ি বললেন,

‘বুঝতে পেরেছিস নুপুর? তানিয়া কিন্তু বাচ্চা মানেই আদর, যত্ন আর মমতায় জড়িয়ে নেয়ার এক আখ্যান। বুঝতে পারছিস কিছু?’

আমার চোখেমুখে আনন্দ খেলে গেলো৷ মাকে বললাম,

‘আমি যা চিন্তা করছি, আপনিও তাই চিন্তা করছেন না তো?’

‘হ্যাঁ রে মা। আল্লাহ যদি আবার চান, আমার মেয়েটাকে যদি আবারও…’

আমি আর শাশুড়িকে শেষ কর‍তে দিলাম না৷ শাশুড়ির হাতে হাত রেখে, পাশের টুলে বসিয়ে বললাম,

‘আপনার পুত্রবধূ দেশে এসেছে না মা? দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে৷ সবকিছু একেবারে আগের মতো হয়ে যাবে। কোন চিন্তার কারণ থাকবে না। আল্লাহ আমাদের সব কথা শুনবেন।’

রাতে খাওয়ার পর ননাস তার সাথে করে গল্পকে নিজের রুমে নিয়ে গেলো। যাওয়ার আগে অদ্ভুতরকম ভাবে গল্প এসে আমার আর তার বাবার গালে চুমু খেয়ে গেলো৷ আমাকে বললো,

‘আম্মু আম্মু, কাল সকালে কিন্ডারজয় আনবা তো আমার জন্য?’

মেয়েটা আমাকে নিজ থেকে আম্মু বলে ডাকছে, এরচেয়ে আনন্দের, এরচেয়ে ভালোলাগার আর কী হতে পারে আমার জন্য! আসিফও এই একই বিষয় খেয়াল করলো। আসিফ তার মেয়ের গালে হাত দিয়ে টান দিয়ে বললো,

‘তোমার আম্মুকে আমি টাকা না দিলে সে আনবে কীভাবে?’

‘টাকা কেন দিবা না? এত্ত এত্ত টাকা দিবা আর আম্মু আমার জন্য এই এতোটা করে কিন্ডারজয় এনে দিবে। আমি খাবো। একা খাবো না, আমার যে বন্ধু আছে না নুরি, ওই মেয়েটা যে ক্লাসে খুব দুষ্টুমি করে, তাকেও দিবো। রিতিকাকেও দিবো। সবাইকে দিবো।’

কথাগুলো বলেই মেয়ের মুখে সে কী হাসি!

পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে আমার দেরি হয়ে যায়। এর মাঝে গল্পকে নিয়ে ননাস স্কুলে চলে গিয়েছেন। আসিফও কিছুক্ষণ পর অফিসে চলে যায়৷ আসিফ অফিসে যাওয়ার আগে শাশুড়ি তাকে টেবিলে বসিয়ে খাবার দিতে দিতে বললেন, তানিয়ার সাথে ওই ফারুক স্যারের কিছু করা যায় কিনা। আসিফ প্রথমে এক বাক্যে না বলে দিলেও পরে যখন আমার আর শাশুড়ির সাথেসাথে শ্বশুরেরও সম্মতি সে পেলো, সে জানালো যে সে দেখবে।

স্কুল থেকে গল্পের আসতে আসতে দুপুর দুইটা বেজে গেলো। ননাস গল্পকে খাইয়ে দিতে দিতে শাশুড়িকে বললো,

‘আজ আর্ট ক্লাস আছে বিকালে। গল্পকে নিয়ে আমি বের হবো।’

‘ওইযে গতদিন যে স্যার এসেছিলো তার আর্ট ক্লাস?’

‘হ্যাঁ।’

ননাস বিকালে বের হয়ে চলে গেলো গল্পকে নিয়ে৷

এদিকে অসুস্থ মুন্নিকে নিয়ে মুন্নির বাবা ফারুক স্যার আজ এসেছেন আর্ট ক্লাসে। গল্পকে ক্লাসে ঢুকিয়ে দিয়ে তানিয়া বসে আছে চেয়ারে। মুন্নি দূর থেকে গল্পকে দেখেই ছুটে আসে। গল্পও হাত টেনে কোলে তুলে নেয় মুন্নিকে। তারপর তাদের দুজনের সে কী আলাপ! ফারুক স্যার ক্লাসের জানালা দিয়ে দেখতে পান যে ওনার মেয়ে তানিয়ার কোলে উঠে কত আনন্দ করছে! এই আনন্দ ফারুক স্যারকেও ভরিয়ে তুলে প্রশান্তির ছোঁয়ায়। ক্লাস শেষ হতে হতে সন্ধ্যা ছয়টা হয়ে যায়৷ গল্প রুম থেকে বের হয়ে আসতেই তানিয়া জিজ্ঞেস করে,

‘আজকের ক্লাস কেমন হলো মামুণি?’

‘অনেক ভালো। আমি বাড়ি যাবো এখন ‘

‘আচ্ছা মা এসো। ‘

তানিয়া তারপর মুন্নিকে পাশে রেখে, গাল টেনে মুন্নির থেকে বিদায় নিতে নিতে বললো,

‘আন্টি আসি এবার? লক্ষ্মী মেয়েটা আমার।’

মুন্নি অনেকটা বিষন্ন হয়ে গেলো। শুধু মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানালো। তানিয়া গল্পকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো।

এরমাঝে ক্লাস শেষ হতে না হতেই আসিফ এসে আর্ট স্কুলে হাজির। আসিফকে দেখে আর্ট স্কুলের সবাই আসিফের সাথে কুশল বিনিময় করতে লাগলেন৷ নানাবিধ কৌশল, কীভাবে এসব করেন, এত ভালো ভালো প্রচ্ছদ কীভাবে করে এসব জানতে চাইলো সবাই। আসিফ সহাস্যে সবার জবাব দিলো। অপর্ণা ম্যাডাম জিজ্ঞেস করলেন সরাসরি,

‘আপনি কি কোন বিশেষ প্রয়োজনে…’

অপর্ণা ম্যাডামের কথা শেষ হওয়ার আগেই চলে এলেন ফারুক স্যার। ফারুক স্যার বললেন সবাইকে,

‘আপনারা হয়তো জানেন না, এই গুণী শিল্পী আমাদের স্টুডেন্টের বাবা।’

সবাই অনেকটা হতবাক হয়ে গেলো। ফারুক স্যার আর ভণিতা না করে বললেন,

‘আমাদের গল্পের বাবা তিনি।’

আসিফ সবার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে ফারুক স্যারকে বললো,

‘আপনার সাথে আমার আসলে একটা কথা ছিলো। যদি কিছু সময় দিতেন আপনি?’

‘হ্যাঁ অবশ্যই। আমার রুমে আসুন আপনি।’

ফারুক স্যারের সাথে আসিফ রুমে যাওয়ার আগ মুহূর্তে মুন্নি এসে আসিফের পথ আটকিয়ে বললো,

‘আমাকে কি ওই আন্টি এনে দিবা? সে চলে গিয়েছে আজও।’

আসিফ বুঝতে পারলো মুন্নি কার কথা বলছে। রুমে ঢুকে আসিফ সরাসরি ফারুক স্যারকে প্রপোজাল দিলো তানিয়ার বিষয়ে৷ সবকিছু খুলেও বললো। এও বললো, তানিয়া আর কখনো মা হতে পারবে না৷ আসিফের সব কথা নীরবে শুনলেন ফারুক স্যার। তারপর তিনি বললেন,

‘আপনি আসলে যা ভাবছেন তা ভুল। আপনার ভাবনার প্রতি আমি পূর্ণ সম্মান জানাচ্ছি তবে আমার পক্ষে তা পসিবল হবে না। আমি কখনোই আমার মুন্নিকে কষ্ট দিবো না। আজ চার চারটা বছর হলো আমার একার জীবন, আমার একার সংগ্রাম। আমার এই সংগ্রাম আমি চালিয়ে যেতে চাই এভাবেই।’

আসিফ আর কথা বাড়ালো না। ভালোমন্দ বলে শেষমেশ বিদায় নিয়ে চলে এলো।

রাতে বাড়ি আসতেই আসিফকে নিজের রুমে নিয়ে গেলেন আমার শাশুড়ি৷ আমিও আসিফের সাথেসাথে রুমে ঢুকলাম। আসিফ কল করে বলেছে যে সে সন্ধ্যায় যাবে দেখা করতে ফারুক স্যারের সাথে৷ শ্বশুর পত্রিকা থেকে চোখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন,

‘কী খবর? সে কিছু জানিয়েছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘কী বলেছে? রাজি?’

‘না। ফারুক স্যার রাজি নন। তিনি বলেছেন যে তিনি বিয়ে করতে পারবেন না। তার মেয়েকে আজ চার বছর হতে চললো তিনি একা একাই মানুষ করছেন৷ এই একার জীবনে তিনি আর দ্বিতীয় কাওকে আনতে পারবেন না।’

শাশুড়ি কেমন যেনো এগ্রেসিভ হয়ে উঠলেন৷ বললেন,

‘বললেই কী হলো? আমি কথা বলবো তার সাথে। বাড়ি গাড়ি, টাকা ফার্ণিচার যা যা লাগে আমি দিবো৷ টাকা পয়সা সোনা দানা কোন অপূর্ণতা আমি রাখবো না। আমার সাথে কথা বলিয়ে দে ছেলেটার।’

আমার রাগ উঠে গেলো। শাশুড়িকে বললাম,

‘মা, সবকিছু কি টাকা দিয়ে হয়? আর এই যে বললেন সোনাদানা টাকা পয়সা ফার্ণিচার দিয়ে ভরিয়ে দিবেন, এতে করে কি সুখ দিতে পারবেন নিজের মেয়েকে? নাকি টেলে দিবেন আবার নতুন নরকের মাঝে? আপনারা আসলে চান টা কী? নিজের সন্তানের ভালো? নাকি টাকা দিয়ে কেনা মেকি ভালোবাসা? কোনটা? একচুয়ালি আপনারা চান টা কী?’

শ্বশুরও তেড়ে গেলেন শাশুড়ির দিকে। তারপর বললেন,

‘একজন রাজি না হলে তো কিছু করার নেই৷ টাকা দিয়ে আর যাই হোক, সম্পর্ক, প্রেম, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর শান্তি কেনা যায় না আসিফের মা। এই এক জীবনে আর কতবার এই একই লেসন তোমাকে আমার শেখাতে হবে?’

(চলবে)

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_৬০
#মিদহাদ_আহমদ

ঘুমের ঘুরে ছোট্ট মুন্নি মুখে মুখে আওড়াচ্ছে,

‘তুমি যেও না আন্টি। তুমি আমাকে এসে আবার কোলে তুলে নাও। আব্বু সারাদিন ক্লাসে থাকে। আমার সাথে গল্প করার কেউ থাকে না।’

অসুস্থ মেয়ের মুখে এসব ঘুমের ঘুরে কথা শুনে আর নিজেকে সামলে নিতে পারেন না রফিক সাহেব৷ মনেমনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন, যাই হোক আসিফের দেয়া প্রপোজাল তাকে স্বীকার করে নিতেই হবে। দিনশেষে মেয়েকে ছাড়িয়ে তিনি কোন সিদ্ধান্তই নিতে পারেননি, আর পারবেন ও না।

এদিকে রাতে খেয়েদেয়ে আমরা রুমে এসেছি মাত্র। আসিফ আমাকে বললো,

‘ফারুক স্যার মানুষ ভালো। কী তার ব্যক্তিত্ব দেখেছো তুমি? সরাসরি মানুষটা না করে দিলো। চিন্তা শুধু একটাই, তার মেয়ের সুখ৷ তাইনা?’

আমি বললাম,

‘আর এদিকে আমি কেমন মা বলো, নিজের জন্য নিজের শিশু কন্যাকে ফেলে আমেরিকা বসে থাকলাম এতটা বছর?’

‘হয়েছে৷ এখন আর আপনার ইমোশনাল হওয়া লাগবে না।’

আসিফের মোবাইলে রিংটোন বাজলো এমন সময়ে। আসিফ আমাকে বললো,

‘ফারুক স্যারের নাম্বার থেকে কল।’

আমি চোখ ইশারায় কল ধরে স্পিকারে দিতে বললাম। আসিফ কল ধরলো। স্পিকারে দিলো। ওপাশ থেকে ফারুক স্যার বললেন,

‘আমি রাজি৷ আপনাদের কোন আপত্তি না থাকলে, আমি আমার মেয়ের জন্য শুধু এই বিয়ে করতে রাজি আছি।’

আসিফ বললো,

‘থ্যাংকস আ লট। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমি এদিকে কনফার্ম হয়ে আপনাকে জানাচ্ছি।’

আমি আর মুহূর্তও অপেক্ষা করলাম না৷ শাশুড়ির রুমের দিকে ছুটলাম।ননাস পানি খাওয়ার জন্য উঠে এসেছেন ডায়নিং রুমে। আমাকে এভাবে ছুটতে দেখে, তাও মায়ের রুমের দিকে, ননাস জিজ্ঞেস করে বসলেন,

‘কী?এতরাতে কী হলো? মায়ের রুমের দিকে কেন?’

আমি আমতা আমতা করে কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না। ননাস নিজেই আর কথা না বাড়িয়ে ফ্রিজের দিকে অগ্রসর হলেন পানির বোতল নিতে৷ আমি শাশুড়ির রুমে গেলাম। শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরে বললাম খুশির সংবাদটা। শাশুড়িও খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠলেন। শব্দ সংযত করতে ইশারায় বুঝালাম যে ননাস রান্নাঘরের আশেপাশেই আছে। শাশুড়িও চেপে গেলেন। শ্বশুর বিছানার ওপাশ থেকে বললেন,

‘এখন তোমার ননাসকে মানাবে কে?’

আমি শ্বশুরকে বললাম,

‘এই দায়িত্বটা আপনি আমার হাতে দিয়ে দিন বাবা। দেখবেন আমি কেমন করে মানাই।’

পরেরদিন সকালে গল্পকে স্কুলে দিতে নিয়ে গেলো ননাস। ননাস বাসা থেকে বের হওয়ার পর পরই আমি বের হয়ে যাই। শাশুড়ি জিজ্ঞেস করেন কোথায় যাচ্ছি। ওনাকে ইশারায় বলি যে এসে বলছি। আমি সরাসরি গাড়ি নিয়ে গল্পের স্কুলে চলে যাই৷ গল্পকে স্কুলের গেইটে ঢুকিয়ে ননাস গার্ডিয়ান ওয়েটিং রুমে বসা ছিলো। আমাকে দেখতেই ননাস বলে উঠলো,

‘তুমি এখানে? মেয়েকে নিয়ে আসতে হলে আমাকে বললেই হতো। আমি আসতাম না।’

ননাসের এমন হুটহাট কথা বলা আর বলার ধরণ আমার অনেকদিনের পরিচিত৷ ওনার কথায় না ধরে আমি ননাসের হাত ধরে রুম থেকে বের করে এনে বললাম,

‘এক জায়গায় যেতে হবে আপা।’

‘কোথায়?’

‘আপনি আসেন তো।’

ননাসের হাতে ধরে তাকে গেইট ক্রস করে গাড়ির সামনে নিয়ে এলাম। ননাস এবার বললো,

‘আশ্চর্য নুপুর! তুমি কোথায় নিয়ে যাবা আমাকে বলবা তো?’

‘বলবো। আগে আসেন আমার সাথে।’

কেক কোর্টে নিয়ে গেলাম আমি ননাসকে৷ ননাস বললো,

‘এখানে কারোর জন্মদিন নাকি? বা সামনে কারো জন্মদিন আসছে? এসব কী? এখানে নিয়ে এলে কেন? আমি বাচ্চা নাকি?’

‘আগে চলেন আমার সাথে আমি বলছি সব।’

ফেরদৌসী’স কেক এ ঢুকলাম আমি ননাসকে নিয়ে। ভেতরে আগ থেকেই বসা ছিলেন ফারুক স্যার আর মুন্নি। মুন্নি ননাসকে দেখেই উঠে এলো। জড়িয়ে ধরলো ননাসকে। আমি খেয়াল করলাম প্রচন্ড রাগে থাকা ননাস কেমন যেনো জল হয়ে গেলেন! মুন্নির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলেন,

‘আজ তোমার জন্মদিন মা? আমি তো জানতাম না। কোন গিফটও সাথে আনিনি।’

ফারুক স্যার পাশ থেকে বললেন,

‘না না। আজ মুন্নির জন্মদিন না।’

‘তাহলে?’

আমাদের কারো জবাব দেয়ার আগেই মুন্নি টেনে নিয়ে ননাসকে চেয়ারে বসালো। তারপর সে তার পাশে থাকা কেকের এক পিস ননাসের মুখে দিতে দিতে বললো,

‘তুমি কি আমার আম্মু হবা বলো? এভাবে রোজরোজ আমার ফেভারিট কেক খাওয়াবো তোমাকে।’

ননাস কেমন যেনো স্থির হয়ে গেল। বুঝতে পারলাম নিজেকে সামাল দিলো৷ কোন রিয়েকশন দেখালো না। ননাস কেক খেতে লাগলো নিশ্চুপে৷ ছোট মুন্নি ননাসের গালে হাত দিতে দিতে বললো,

‘কী হলো? তুমি চুপ করে আছো যে?’

‘বারোটা হয়ে যাচ্ছে। গল্পের স্কুল ছুটি হয়ে যাবে। আমি উঠছি এখন। আজ বৃহস্পতিবার।’

‘আর আমি যে তোমার সাথে গল্প করার জন্য আজ স্কুলেই যাইনি। তুমি কি আমার আম্মু হবা বলো?’

ননাস উঠে গেলো চেয়ার থেকে। আমি মনেমনে ভয় পেলাম ননাস কিছু বলে বসে কিনা। ননাস মুন্নির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো

‘মা আমি আসছি কেমন? পরে কথা হবে’

অনেকটা দ্রুত গতিতে প্রস্তান করলো ননাস। আমিও পেছন পেছন ছুটে এলাম। গাড়িতে উঠে বসলাম। কর্কশ গলায় ড্রাইভারকে এসি অন করতে বললেন তিনি৷ আমি কথা বলতে চাইলেও গ্লাসের জানালার দিকে মুখ তাক করে নীরবে বসে থাকলেন ননাস। কোন শব্দ আর তিনি করলেন না।
পুরো রাস্তায় ননাস একদম পিনপতন নীরবতা পালন করে গেলেন৷ গল্পকে রিসিভ করার সময়ে গাড়ির দরজা খুলার সময়ে শুধু আমার দিকে চেয়ে বললেন,

‘যা করেছো তা ঠিক করোনি নুপুর’

গল্পকে নিয়ে আমাদের বাসায় যেতে যেতে একটা বেজে গেলো। আসিফও চলে এসেছে অফিস থেকে। শাশুড়ি আমাকে একা পাওয়ার পায়তারা করছেন বুঝতে পারলাম। আমি শাশুড়ির রুমে গেলাম সুযোগ করে। শাশুড়িকে বললাম,

‘আপনি চিন্তা করবেন না। দেখবেন সব ঠিকঠাক হবে। শুধু সময়ের হাতে ছেড়ে দিন।’

দুপুরে সবাই খাবার টেবিলে খেতে বসলেও ননাস আসেননি। আসিফ উঠে গেলো উপরে তাকে ডেকে আনার জন্য। ননাস বিছানায় শুয়ে আছেন৷ আসিফ বার কয়েক খেতে আসার কথা বলার পরও ননাস বললেন যে তার খাওয়ার ইচ্ছা নেই। আসিফ নিচে নেমে এলো। আমি বুঝতে পারলাম তার এই রাগ, এই অভিমান আমার উপরেই হয়তোবা। আমি উঠে গেলাম। ননাসের রুমে ঢুকতেই ননাস আমাকে বললেন,

‘এখানে এসেছো কেন? আমি খাবো না বলে দিয়েছি মানে খাবো না।’

আমি পাশে গিয়ে বসলাম। ননাসের হাত আমার হাতের উপর তুলে নিলাম। কী তুলতুলে হাত ওনার! হাতের আঙুল ধরতে ধরতে ননাসকে বললাম,

‘আপা, জীবন কারোর জন্য কখনোই থেমে থাকে না আমাদের। আজ নাহয় কাল, আমাদের একদিন না একদিন ফিরে যেতেই হবে মহান রবের কাছে৷ কিন্তু যতদিন সুযোগ আছে ততদিন কেন এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমরা সুন্দরভাবে বাঁচতে পারবো না বলেন? কেন আমরা এই সুযোগের মাধ্যমে জীবন সাজাবো না? আজ আপনি ভালো থেকেও ভালো নেই৷ দুনিয়া বড্ড নিষ্ঠুর। এখানে মানুষের আপন বলতে কেউ নেই। আর আপন বলতে যারাই আছে, তারাই আবার মুহূর্তে নিজের পর হয়ে যায়৷ ছোট্ট মুন্নিকেই দেখেন। মেয়েটার কি এই বয়সে এত বড় কষ্ট নেয়ার কথা ছিলো? তার মা হারানোর কথা ছিলো? সেই এইটুকু জানের মধ্যে সে কেমন করে তার জীবন কাটাবে? কেমন করে কষ্ট সহ্য করবে? আমাদের জীবনের মানেই তো অন্যের কষ্টে নিজেকে উজাড় করে দেয়া। অন্যের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেয়া। সেই বিলানোর মাঝেই তো প্রকৃত সুখ আর ভালোবাসার প্রকাশ।’

এর মাঝে ননাসের মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠলো৷ ফারুক স্যারের নাম্বার থেকে কল। ননাস কল উঠালো। ওপাশ থেকে কে কথা বললো কিছুই বুঝতে পারলাম না। ননাস এপাশ থেকে উত্তর দিলো

‘হ্যাঁ মা খেয়েছি৷ তুমিও খেয়ে নিও কেমন? আর খেয়ে ঘুমিয়ে যেও। ‘

বুঝতে বাকি রইলো না মুন্নি কল করেছে। ননাস নেমে এলো নিচে খাবার খেতে। খাওয়া শেষ করে আবার সে রুমে চলে গেলো। শাশুড়ি আমার দিকে অসহায় চোখে তাকালেন। আমি শাশুড়িকে বললাম,

‘আপনি কোন চিন্তা করবেন না মা। দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে আর ননাসও রাজি হবেন। দেখে নিয়েন আপনি…’

(চলবে)

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_৬১
#মিদহাদ_আহমদ

সপ্তাহ খানেকের ভেতর সবকিছু গোছগাছ হয়ে গেলো। সবকিছু যেনো এক ঝটকায় গুছিয়ে যেতে শুরু করলো। ননাস রাজি হয়ে গেলো ফারুক স্যারকে বিয়ে করার জন্য৷ সেদিন রাতে আমাকে তার রুমে ডেকে নিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে তার সে কী কান্না! ননাস আমার কাছে জানতে চাইলো সে কী করবে এখন! একদিকে গল্প, অন্যদিকে তার মনের মধ্যে জাগ্রত হওয়া সুপ্ত বাসনা, কারো মা হওয়া, কারো স্ত্রী হওয়া, নিজের একটা সংসার হওয়া! সবকিছু যেনো এক ভয়ার্ত গোলকের মতো আটকে আছে তার জীবনে!

আমি ননাসকে সোজা বাক্যে বুঝিয়ে বললাম, তার উচিত নিজের জীবন নতুন করে শুরু করা। ননাস তারপর আবার বললো গল্পের কথা। আমি অনেক নির্ভরতা নিয়ে ননাসকে বললাম, গল্পের জন্য আমি আছি, মা আছেন, ওর বাবা আছে। ননাসের এখন মুন্নির প্রয়োজন। এক মা কীভাবে আরেক মা ছাড়া সন্তানকে এমন অসুখী দেখতে পারে? ননাস আর কোন কথা বলেনি সেদিন। আমি রুম থেকে চলে এলাম৷ বুঝতে পারলাম ননাসের সম্মতি আছে এই বিয়েতে। ঝটপট সবকিছুর আয়োজন হয়ে যেতে লাগলো মুহূর্তেই।

আজ বিকালে ফারুক স্যারের বড় বোন, দুলাভাই আর বড় ভাই আমাদের বাসায় আসবেন সব কথা পাকা করতে। কী কীভাবে হবে এসব। শাশুড়ি আসিফকে তার রুমে ডেকে পাঠালেন। আমিও গেলাম। আমাকে দেখে শাশুড়ির কিছু ইতস্তত বোধ হচ্ছিলো এমন আমি বুঝতেই পারছিলাম। তবুও সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। শাশুড়ি আসিফকে বললেন,

‘বাবা সবকিছু তো ঠিকঠাক। আমি শুধু চাচ্ছিলাম যে কাবিনটা যেনো শক্ত করে ধরা হয়। আর এই কাবিনের বিনিময়ে আমি তোর বোনকে এই বাড়ির একটা অংশ লিখে দিতে চাচ্ছি।’

আসিফের মাথা গরম হয়ে উঠলো। সে বললো,

‘মানে কী বলতে চাইছো মা? এতকিছু হয়ে যাওয়ার পরও তুমি সেই আগের মতোই আগের চিন্তায় আছো? মানে চাচ্ছো টা কী তুমি?’

‘আমি চাচ্ছি আমার মেয়ের নিশ্চয়তা। আর কিছু না।’

‘টাকাপয়সা,বাড়ি গাড়ি সব দিয়েও কি মেয়ের নিশ্চয়তা তুমি পেয়েছিলে বলো? পেয়েছিলে?’

আমি আসিফকে সামলে নিলাম। তাকে রুমে আসতে বললাম। রুম থেকে আসিফ বের হতে হতে শাশুড়ির দিকে চেয়ে বললো,

‘আমি দেখে নিবো এই বিয়েতে কেমন মনমানি তোমরা করো। আমিও দেখে নিবো।’

কাবিন নিয়ে আর কথা এগুলো না। বিকালে ফারুক স্যারের ভাই, ভাবি, বোন, বোনের জামাই, ফারুক স্যার নিজে আর তার সাথে করে মুন্নি আমাদের বাসায় এলেন৷ মুন্নি এসেই উপরের ঘরে চলে গেলো ননাসের কাছে। কিছুক্ষণ পর ননাস নিচে নেমে এলো ট্রেতে চা নিয়ে। সবাইকে চা দিলো৷ ফারুক স্যারের ভাবি ননাসকে দেখে বললেন,

‘সুন্দর। ডিভোর্স কয়বছর আগে হয়েছিলো জানি?’

এমন সরাসরি প্রশ্ন তিনি করে বসবেন এমনটা আমাদের ধারণায় ছিলো না। ফারুক স্যারের ভাই পাশ থেকে বললেন,

‘উফ রেশমি। কখন কী বলতে হয় কোন জ্ঞান দেখি নেই। চুপ করো। আচ্ছা আমরা কি কাবিনের বিষয়ে এখন কথা বাড়াতে পারি?’

বললেন ফারুক স্যারের ভাই। ফারুক স্যার পাশ কেটে বললেন,

‘আসলে কাবিনের বিষয়টা আমি ক্লিয়ার করতে চাই। শরিয়া বিধি মোতাবেক আমি বিয়ের আগেই কাবিনের টাকাটুকু পরিশোধ করতে চাচ্ছি। বিয়ের পরে না।’

ওনার মুখ থেকে এই কথা শোনার পর আমার খুব আনন্দ অনুভব হলো। একজন মানুষ তার স্ত্রীকে বিয়ের আগেই তার পাওনা বুঝিয়ে দিতে চাচ্ছেন যা কিনা ইসলাম সমর্থন করে, তার চেয়ে বড় আনন্দ আর কীসে হতে পারে?

শাশুড়ি ইশারায় আসিফকে ভেতরে আসতে বললেন। আসিফ উঠে গেলো। আমিও উঠে গেলাম। শ্বশুরও ভেতরে আসলেন। শাশুড়ি বললেন,

‘কাবিন আগে পরিশোধ করে দিবে এর মানে বুঝো? এর মানে কাবিন এক লাখ দেড় লাখ টাকা ধার্য করা হবে। এই কাবিনে কি তোর বোন তুই দিয়ে দিবি?’

শ্বশুর এবার সরাসরি শাশুড়ির বিরোধীতা করে বললেন,

‘আসিফের মা, তুমি সবসময় একটা স্বার্থ আর ভবিষ্যত নিয়ে ঘুরো। যদি এই বিয়েতে আল্লাহর হুকুম আর ইচ্ছা না থাকে তাহলে এই বিয়ে কোটি টাকার কাবিনেও টিকবে না। আর হুকুম হলে, এক টাকার কাবিনেও বিয়ে টিকে থাকবে৷ সব আল্লাহর হাতে ছেড়ে দাও এবার। আর ছেলে যেহেতু বিয়ের আগে কাবিন পরিশোধ করতে চাচ্ছে, এই সুযোগ তাকে দেয়া উচিত। এই সুযোগের দাবিদার সে। আর তা না হলে তুমি আল্লাহর কাছে দায়ী থাকবা। আল্লাহর কাছে।’

‘তুমি বুঝাও মাকে। আমি আর এসব নিতে পারছি না বাবা।’

শ্বশুরকে এই কথাগুলো বলে আসিফ রুম থেকে বের হয়ে আসলো। আমিও তার সাথেসাথে বের হয়ে আসলাম। এসে সোফায় বসতেই ফারুক স্যার বললেন,

‘আমি আসলে কাবিনের বিষয়টা…’

আমি ভেবেছিলাম ফারুক স্যার হয়তো লাখ দেড়লাখের মধ্যে কাবিন দিবেন। কিন্তু আমাদের ধারণার বাইরে গিয়ে তিনি বললেন,

‘আমি ওনাকে পাঁচ লক্ষ টাকা অগ্রীম পরিশোধ করতে চাচ্ছি কাবিনের জন্য। আর বাদবাকি আমার গ্রামে জমি আছে। খেতের জমি। সেই জমি থেকে এক কিয়ার জমি আমি ওনার নামে লিখে দিবো৷ আমার সামর্থ্য এটুকুই। আর আপনারা প্লিজ, যতো ছোট পরিসরে, যতো কম খরচে আমাদের হাতে আপনাদের বোন তুলে দিতে পারবেন, তাই করবেন। আমি শুধু এখান থেকে আমার বাচ্চার মা নিতে এসেছি। আর আমার বাচ্চার মায়ের জন্য আমি আর আমার বাচ্চা যা পছন্দ করবো, তাই হবে। এর বাইরে একটুকরা সুতোও যাবে না এখান থেকে।’

শ্বশুর বলে উঠলেন,

‘আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ বাবা। আমার কোন দ্বিমত নেই। আমার মেয়ের বিয়ের জন্য আমার পূর্ণ সম্মতি আছে।’

ফারুক স্যারের দুলাভাই পাশ থেকে তাকে কিছু বলতে চাইছিলেন বুঝছিলাম। ফারুক স্যার তাকে ইশারায় চুপ করে থাকতে বলে। কিছুক্ষণের মাথায় টেবিলে সব নাস্তা সাজানো হয়ে যায়। সবাই নাস্তা করতে বসে। শ্বশুর অফার করলেন, আজ বুধবার। আগামীকাল বৃহস্পতিবার মাঝ দিয়ে শুক্রবার যেনো বিয়ের তারিখ দিয়ে দেই। তিনি এও সম্মতি দিলেন যে বিয়ে একদম ঘরোয়া ভাবে শুধুমাত্র কয়েকজন আত্মীয়ের উপস্থিতিতেই হবে। তার কোন আপত্তি নেই।

শুক্রবার সকালেই ফারুক স্যার একটা গাড়ি করে বড় বোন আর ছোট মেয়েকে আমাদের বাসায় পাঠিয়ে দিলেন। ছোট্ট মুন্নি একটা লালা টুকটুকে বেনারসির ডালা নিয়ে বাসায় এসে ঢুকলো। ফারুক স্যারের বোন আমার শাশুড়িকে ডেকে তার হাতে একটা স্বর্ণের বক্স দিয়ে বললো,

‘এইটা খুলে দেখে নেন। এতে সোনার জিনিস আছে কিছু। একটা চেইন আর একজোড়া কানের দুল৷’

শাশুড়ি দেখলেন। ফারুক স্যারের বোন চলে গেলেন বের হয়ে। কিছু খেলেনও না। মুন্নি থেকে গেলো। সে তার মাকে সাজাবে। সোজা শাড়ির ডালা নিয়ে চলে গেলো উপরের দিকে। শাশুড়ি আমার দিকে তাকালেন। আমি শাশুড়িকে নিয়ে চললাম তার রুমে। বিছানায় বসিয়ে শাশুড়িকে বুঝাতে লাগলাম, এসব টাকা পয়সা, লাবন্য আর লোক দেখানোর মাঝে দুনিয়ার সুখ নেই। শাশুড়ি কান্না কর‍তে করতে বললেন,

‘এসব লিকলিকে চেইন দেয়ার চেয়ে না দেয়াটাই ভালো ছিলো। আর কাবিনের টাকা দিবে আগে, কই দিলো? দিয়েছে? এসব চেইন এনে দিয়েছে এসব আমার মেয়ের গলায় চড়াবো? আমার এত এত গহনা থাকতে?’

আমি শাশুড়িকে বুঝালাম। শাশুড়ি আমার কথা শুনতে নারাজ। ফার্ণিচার সাফ আসিফ নিষেধ করে দিয়েছে মাকে। এজন্য ফার্ণিচার নিয়েও তিনি আর কোন কথা বলতে পারছিলেন না। আমি শাশুড়িকে বেশ কিছুক্ষণ বুঝিয়ে নিয়ে চললাম ননাসের রুমের দিকে। ননাসের রুমের দরজা ফাকা করা ছিলো৷ ননাস আয়নার সামনে বসা। ননাসের দুই পাশে মুন্নি আর গল্প। দুজন মিলে এইটা ধরছে, ওইটা ধরছে। সাধারণ লাল বেনারসি আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিকে অপূর্ব লাগছে তাকে দেখতে। বাচ্চা দুইটা তাদের মাকে জড়িয়ে ধরছে দুইপাশ থেকে। ননাসও তাদের আদর করছে। আমি শাশুড়িকে বললাম

‘মা, এই ভালোবাসা আর আনন্দ টাকা দিয়ে কেনা যাবে বলেন? এরচেয়ে বড় কোন শান্তি আর আছে পৃথিবীতে?’

শাশুড়ির হাতে থাকা তার ভারি স্বর্ণের হার সমেত তিনি রুমে ঢুকলেন। ননাস পেছনে ফিরে তাকালো। শাশুড়ি ননাসের কাছে গিয়ে বললেন,

‘আমার মেয়েকে আজ অনেক সুন্দর লাগছে।’

তারপর একপাশে শাশুড়ি তার ভারি স্বর্ণের গহনা রেখে, আমার হাত থেকে ফারুক স্যারের বাসা থেকে দেয়া সোনার চেইন আর কানের দুল নিয়ে ননাসের গলায় আর কানে পরিয়ে দিলেন। তারপর আমার দিকে চেয়ে বললেন,

‘মারে, সুখ খুঁজে নিলে আর এতকিছুর প্রয়োজন হয় না। এই বিত্ত বৈভব ছেড়ে আমাদের সকলকেই তো চলে যেতে হবে একদিন। এই চলে যাওয়ার মাঝে আমরা ভুলে যাই আমাদের সুখের আসল ঠিকানা, মজে থাকি এই দুনিয়ার মায়ায়।’

দুপুরে ফারুক স্যার আসার সময় সাথে করেই কাবিনের টাকা পাঁচ লাখ আর জায়গার দলিল নিয়ে এলেন। বিয়ে হয়ে গেলো। খুব সামান্য আর সাধারণ আয়োজন করেই সম্পন্ন হলো আমার ননাসের বিয়ে। ননাসের বিদায়ের সময়ে গল্প বারবার আমাকে জিজ্ঞেস করছিলো,

‘মামুণি কোথায় যাচ্ছে মা? সে এভাবে সেজেগুজে তো কখনো কোথাও যায়নি।’

মুন্নি গল্পকে বলছিলো,

‘তোমার মামুণিকে আমার মা করেছি। কী মজা কী মজা। আমার মা।’

গল্প তখন স্থির চোখে দেখছিলো পা থেকে মাথা পর্যন্ত আমার ননাসকে। আমার ছোট্ট গল্পের ভেতর ভেতর কী অনুভব হচ্ছিলো আমি আন্দাজ কর‍তে পারছিলাম কিছুটা। ননাস গল্পকে জড়িয়ে সে কী কান্না শুরু করলো! গল্প তবুও ঠায়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কোন অনুভূতি তাকে নাড়া দিলো না যেনো। পেছনে এক বাচ্চাকে রেখে নতুন আরেক বাচ্চাকে ধরে নববিদায় হলো আমার ননাসের। একটা বাচ্চা আজ নতুন করে তার মা হারালো, আরেকটা বাচ্চা আজ নতুন করে তার মা খুঁজে পেলো। ভাঙ্গা গড়ার খেলায় এ যেনো এক জীবনের ছবি, জীবনের গল্প, গল্পের জীবন…

(চলবে)