#বিবর্ণ_আলোকবর্ষ
#পর্বঃ৯
#লেখিকাঃদিশা মনি
আলো মায়ার রুমে এসে বসেছিল। মায়া বাইরে থেকে রুমে এসে আলোকে দেখে বিরক্তিতে ভ্রু কুচকে ফেলে।
আলো মায়াকে বলে,
‘আমি জানি তুই কখনো আমাকে নিজের বোন ভাবিস নি। সবসময় আমাকে নিজের শত্রুই ভেবে গেছিস। বিশ্বাস কর তুই আমি কখনো তোর খারাপ চাইনি। আজও চাইনা তাই বড়বোন হিসেবে তোকে একটা পরামর্শ দিতে চাই। তুই সাজিদ ভাইয়ের সাথে নিজেকে জড়াস না। লোকটা এর আগেও তোকে ঠকিয়েছিল। তাকে বিশ্বাস করে দ্বিতীয় বার আর একই ভুল করিস না।’
আলোর কথা শুনে ক্ষেপে যায় মায়া। সজোরে আলোর গা’লে থা’প্প’র বসিয়ে দেয়। আলো স্তব্ধ হয়ে যায় আকস্মিক ঘটনায়। মায়া রাগে ফোসফোস করে বলে,
‘আমি খুব ভালো করেই জানি তুই এই কথাটা কেন বলছিস। নিজে তো সুখী হতে পারিস নি তাই তুই চাসনা যে আমি সাজিদ ভাইয়ের সাথে সুখে সংসার করি। তোকে খুব ভালো করে চেনা আছে আমার। ছোটবেলা থেকে আমার সুখ তুই সহ্য করতে পারিস না৷ এর আগেও সাজিদ ভাইকে আমার থেকে তুই দূরে করে দিয়েছিলি। নিজের ভালোবাসার জালে ফাসিয়েছিলি সাজিদ ভাইকে যার ফলে সাজিদ ভাই সেবার আমায় কষ্ট দিয়েছিল। এখন যখন দেখছিস সাজিদ ভাই আবার আমাকে নিজের জীবনে ফিরিয়ে নিতে চাচ্ছে তখন নতুন নাটক শুরু করেছিস। সাজিদ ভাইকে পাওয়ার এত বাসনা থাকলে বল না গিয়ে একরাতে যেন তোর চাহিদা পূরণ করে দেয়।’
মায়ার কথাটা শুনে আলোর মন ঘৃণায় ভরে ওঠে। মায়াকে জোরে একটা থা’প্প’র মে’রে আলো বলে,
‘আমি তোর ভালোর জন্যই বলেছিলাম। সেখানে তুই কিনা আমার সম্পর্কে এত বাজে মন্তব্য করলি। ছি! তোকে নিজের বোন ভাবতেও ঘৃণা হচ্ছে। একদিন তুই নিজের ভুল ঠিক বুঝতে পারবি। সেদিন আফসোস করেও কোন লাভ পাবি না।’
আলো আর এক মুহুর্ত ব্যয় না করে মায়ার রুম থেকে বেরিয়ে আসে। মায়া নিজের গালে হাত দিয়ে রাগে ফুসতে থাকে।
১৭.
সজীব আজ অনেকদিন পর নিজের মামার বাড়িতে এসেছে। উদ্দ্যেশ্য মোনালিসার সাথে দেখা করা।
মোনালিসার মা-বাবা অনেক আগে একটি দূর্ঘটনায় মারা গেছে। তারপর থেকে মামাবাড়িতেই থাকে সে।
সজীব তার মামাবাড়িতে আসতেই তার বড় মামী লুবনা এসে বলে,
‘সজীব তুই এসেছিস। দেখ না মোনালিসা সকাল থেকে রুম থেকে বের হয়নি। এতবার করে ডাকলাম তবুও দরজা খুলছে না। আমার খুব ভয় করছে। তোর মামাও বাড়িতে নেই। মেয়েটা যে এত সমস্যা সৃষ্টি করে কি আর বলব।’
‘তুমি চিন্তা করো না মামি। আমি দেখছি কি হয়েছে।’
সজীব গিয়ে দুইবার দরজায় টোকা দেয় কিন্তু মোনালিসার কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যায়না। ভয়ে সজীবের পুরো শরীর কাপতে থাকে। তার মনে হতে থাকে মোনালিসা নিজের কোন ক্ষতি করল না কি।
সজীব আর অপেক্ষা করতে পারে না। দরজাটা এবার জোরে ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেলে। ভেতরে গিয়া যা দেখে সেটার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না।
মোনালিসা অচেতন হয়ে পড়ে আছে এলোমেলো বিছানায়। তার হাত গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। সজীব জ্ঞানশুন্য হয়ে ছুটে যায় মোনালিসার কাছে। মোনালিসাকে কোলে নিয়ে পাগলের মতো ছুটতে থাকে হাসপাতালের উদ্দ্যেশ্যে।
মোনালিসার হাতে শক্ত করে কিছু ধরে রেখেছিল। সজীব হাতটা আলগা করতে দেখতে পায় একটি চিঠি। সজীব চিঠিটা পকেটে রেখে মোনালিসাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
মোনালিসার ট্রিটমেন্ট শুরু হয়। সজীব পকেট থেকে চিঠিটা বের করে পড়তে শুরু করে। সেখানে লেখা,
‘আমি জানি আমার এই সিদ্ধান্তটা নেওয়া একদম ঠিক হয়নি। আ’ত্ন’হ’ত্যা মহাপাপ সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি। বর্তমান পরিস্থিতিতে বেচে থাকার চেয়ে এই পদ্ধতিটাই আমার কাছে সহজ মনে হলো। আমি বাচতে চেয়েছিলাম কিন্তু সাজিদ ভাই আমায় বাচতে দিল না। ভুলটা আমারই সজীবের মতো হিরাকে ফেলে সাজিদের মতো কাচের পেছনে ছুটছিলাম। তাই ক্ষতবিক্ষত তো হতেই হতো। সাজিদকে খুব ভালোবেসেছিলাম আমি। যখন তার বিয়ের খবরটা পাই তখন আর নিজেকে সামলাতে পারি না। পুরো পৃথিবীটা আমার জন্য যন্ত্রণাদায়ক হয়ে গিয়েছিল৷ বুকে একরাশ যন্ত্রণা নিয়ে আমি আর থাকতে পারছিলাম না৷ তাই এই পথটা বেছে নিতে হলো। তোমরা সবাই আমাকে ক্ষমা করে দিও। জীবনে শুধু একটাই আফসোস থেকে যাবে সাজিদকে সুখী দেখা। আমি চাই সাজিদ যেন তার পাপের উপযুক্ত শাস্তি পায়। নাহলে আমি কোনদিনও শান্তি পাবোনা কখনো না।’
চিঠিটা পড়ে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নেয় সজীব। সাজিদকে নিজের ভাই ভাবতে তার নিজের উপর রাগ হচ্ছে। সজীব নিজের কাছে নিজেই শপথ করে সাজিদকে তার কর্মের উপযুক্ত শাস্তি সে নিজের হাতে দেবে।
১৮.
আলো নিজের অশান্ত মনকে শান্ত করার জন্য একা একা একটু বাইরে ঘুরতে বেরিয়েছে। তখন মায়ার কথাগুলো শোনার পর থেকে আলোর মন মানসিকতা একদম ভালো নেই।
আলো আপনমনে হাটছিল আচমকা পেছন থেকে কেউ আলোর শাড়ির আচল টেনে ধরে। আলোর রাগ এতে আরো বেড়ে যায়। কোনকিছু ভাবনা চিন্তা না করেই আলো পিছন ফিরে ব্যক্তিটির গালে থা’প্পর বসিয়ে দেয়।
জসিম অগ্নিদৃষ্টিতে তাকায় আলোর দিকে। তাকে চোখ দেখে মনে হচ্ছিল আলোকে ঝ’ল’সে দেবে।
আলোকে রাস্তায় এভাবে যেতে দেখে জসিম। তখন তার মাথায় দু’ষ্টু’মি আসে। আলোকে বিরক্ত করার জন্য তার আচল টেনে ধরে আর তখনই আলো তাকে এভাবে থা’প্পর মা’রে।
জসিমের দিকে তাকাতেই ভয়ে আলোর গলা শুকিয়ে যায়। জসিমকে গোটা মহল্লার সবাই চেনে। সে যে কতটা ভয়ানক আলোর সেই সম্মন্ধে যথেষ্ট জ্ঞান আছে। এভাবে ভরা রাস্তায় জসিমকে এভাবে মা’রার ফল যে কতটা মারাত্মক হতে পারে সেটা ভেবেই আলোর অন্তরাত্মা কেপে ওঠে।
জসিম সবার সামনেই আলো’কে হু’ম’কি দেয়,
‘কাজটা তুই ভালো করলি না আলো। ভেবেছিলাম তোকে ভালোবেসে নিজের ঘরের বউ করে নিয়ে যাবো৷ এখন তোর আর তোর বাবার এরকম ব্যবহার দেখে আমার সেই ইচ্ছা নেই৷ খুব অহংকার না তোদের বাপ বেটির। তোদের এই অহংকার কিভাবে শে’ষ করতে হয় সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি। এবার তোরা দেখবি জসিমের আসল রূপ। এমন হাল করবো যে লোকসমাজে মুখ দেখাতে পারবি না।’
কথাগুলো বলে জসিম চলে যায়। রাস্তায় উপস্থিত অনেক মানুষ এতক্ষণ দাড়িয়ে কথাগুলো শুনছিল। প্রত্যেকেই অদ্ভুত ভাবে আলোর দিকে তাকায়। একজন তো এগিয়ে এসে বলে,
‘তুমি সত্যিই ভুল করেছ আলো। জসিমকে আমরা সবাই খুব ভালো করে চিনি। এমনিতেই তুমি ডিভোর্সি হয়ে পড়ে আছো। এখন যদি জসিম আরো বড় কোন ক্ষতি করে দেয় তখন কি হবে? নিজের ভালো পাগলেও বোঝে।’
আলো কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। ভয় তার বুকেও বাসা বাধে। একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে দ্রুত পায়ে হেটে বাড়ির দিকে রওনা দেয় আলো৷ এখন বাইরে থাকাটা তার জন্য মোটেও সুবিধার নয়।
আলো বাড়িতে এসেই নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পরে। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গিয়েছিল আলো। জোনাকি সবেমাত্র রান্নাবান্নার কাজে মালেকা বেগমকে সাহায্য করে রুমে এসেছিল। আলোকে এই অবস্থায় দেখে জোনাকিরও খুব চিন্তা হয়৷ জোনাকি আলোর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
‘কি হয়েছে আলো তুই এত ভয় পাচ্ছিস কেন? সাজিদ ভাইয়ের কথা ভেবে। আমি আম্মুর কাছে ওনার ব্যাপারে সব শুনলাম। উনি যে এত খারাপ মানুষ বের হবেন সেটা আমার কল্পনাতেও ছিল না। তুই কোন চিন্তা করিস না আলো। উনি তোর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আমি তোর আপু আছি না আমি তোকে আগলে রাখব।’
আলো জোনাকিকে জড়িয়ে ধরে কাদতে কাদতে জসিমের ব্যাপারে পুরোটা তাকে বলে। জোনাকি সব শুনে হতবাক হয়ে যায়। বোনের চিন্তায় সেও ভীত হয়ে পরে।
‘কাজটা তুই ঠিক করিস নি আলো। জসিম যা ভয়ানক লোক এখন না জানি কি করে। এখন থেকে আর তুই বাড়ির বাইরে যাবি না। যখন যা প্রয়োজন হবে আমায় বলবি। আমি এনে দেব।’
‘ঠিক আছে আপু।’
জোনাকি আলোকে নিশ্চিত হতে বললেও নিজে স্বস্তিতে নিঃশ্বাস নিতে পারছিল না। জসিম যে আলোর কোন ক্ষতি না করে চুপ হয়ে বসে থাকবে না সেটা জোনাকি খুব ভালো করেই জানে।
অন্যদিকে,
জসিম তার চ্যালাদের সাথে কথা বলছিল আলোর ব্যাপারে।
‘শোন তোরা যে করেই হোক আলোকে তুলে আনতে হবে। আমি যে পরিকল্পনা করেছি সেই অনুযায়ী কাজ করবি। এবার ঐ শা’লী টের পাবে জসিমের সাথে পা’ঙ্গা নেওয়ার পরিণাম কি হতে পারে।’
চলবে ইনশাআল্লাহ