বিবর্ণ আলোকবর্ষ পর্ব-১২+১৩

0
229

#বিবর্ণ_আলোকবর্ষ
#পর্বঃ১২+১৩
#লেখিকাঃদিশা মনি

জোনাকি আর আলো যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয় তখনই সজীব তাদের কাছে এসে বলে,
‘একটু অপেক্ষা করে যা তোরা। যাওয়ার আগে একটা ড্রামা তো দেখে যা।’

জোনাকি জিজ্ঞেস করে,
‘কি ড্রামা দেখার কথা বলছো সজীব ভাই?’

‘চল গেলেই দেখতে পারবি।’

জোনাকি ও আলো সজীবের সাথে যেতে লাগল।

বিয়ের আসরে বসে ছিল সাজিদ এবং মায়া। মায়া আজ এত খুশি যে বলে বোঝাতে পারবে না। একেতো সাজিদের সাথে বিয়ে হচ্ছে তার উপর বোনাস হিসেবে আলো, জোনাকি আজ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। মায়ার মনে হচ্ছিল আজ তার জীবনে সবথেকে খুশির দিন।

এই খুশি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়না। কাজী সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করার আগেই সজীব এসে বলে,
‘এটেনশন প্লিজ। আপনাদের অবগতির জন্য জানানো হচ্ছে যে আজ এখানে কোন বিয়ে হবে না। অনেক হিসাব নিকাশ নেওয়া বাকি। এখন সেই হিসাবই নেওয়া হবে।’

সাজিদ খুব রেগে যায় সজীবের এমন কথায়। দেলোয়ারা সজীবকে জিজ্ঞেস করে,
‘এসব তুই কি বলছিস সজীব? আজ তোর ভাইয়ের বিয়ে আজকের দিনে
এ আবার কেমন কথা? এটা মজা করার সময় নয়। কাজী সাহেব আপনি বিয়ে পড়ানো শুরু করুন।’

‘দাড়াও আম্মু। আগে আমার পুরো কথাটা শোন। সাজিদ ভাইকে তার পা’পের শা’স্তি পেতে হবে।’

সজীবের কথা শুনে দেলোয়ারা হতবাক হয়ে যান। সাজিদ এবার উঠে এসে সজীবকে বলে,
‘তোর এইসব নাটক বন্ধ কর। আমার বিয়ে দেখতে এসেছে সবাই। তোর নাটক দেখতে নয়।’

সজীব বাকা হেসে বলে,
‘তোমার বিয়ে! হা হা হা। এতগুলো মে’য়ের সর্বনা’শ করে এখন তুমি শান্তিতে বিয়ে করে নিজের জীবন অতিবাহিত করবে। সেটা তো হতে পারে না।’

‘মা,,নে কি,,, বলছি,,,স এসব তুই সজীব।’

‘ঠিকই বলছি ভাইয়া। তোমার এই ভালো মানুষির মুখোশ আজ আমি সবার সামনে টে’নে ছি’ড়ব। চলে এসো তোমরা।’

একে একে ছয়-সাতজন মেয়ে সেখানে উপস্থিত হয়। সবার চোখে সাজিদের জন্য এক’রা’শ ঘৃ’ণা।

সাজিদ তাদের সবাইকে দেখে চিনতে পারে। এরা প্রত্যেকেই সাজিদের সাথে সম্পর্কে ছিল। সাজিদ এদের সবার স’র্বনা’শ করে তাদের ছেড়ে দিয়েছিল। ভয়ে ঘামতে থাকে সাজিদ।’

সাজিদের ঘামার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে সজীবের খুব হাসি পায়৷ আলো এসে সরাসরি সাজিদের মুখে থু’থু দেয়। সবার সামনে আলো বলে,
‘এই শ’য়’তান পি’শা’চটা আজ অব্দি অনেক মেয়ের জীবন ন’ষ্ট করে দিয়েছে। মেয়েদের ভালোবাসার জালে ফাসিয়ে তাদের সাথে প্রতারণা করেছে।’

সজীব দেলোয়ারার সামনে এসে বলে,
‘আম্মু জানো শুধু এই মেয়েদের নয়, ভাইয়া মোনালিসারও,,,,,’

সজীব দেলোয়ারাকে সব বলে। সব শুনে দেলোয়ারা স্তব্ধ হয়ে যায়। মোনালিসা তার বোনের মেয়ে হলেও তাকে নিজের মেয়ে ভাবত দেলোয়ারা৷ সেই মেয়েটার যে এতবড় ক্ষতির কারণ তার ছেলে সেটাই তাকে পিড়া দিচ্ছে।

সজীবের বাবা সব শুনে খুব রে’গে যান। তার ছেলে যে এত খারাপ সেটা তার কল্পনাতেও ছিল না৷ সবার সামনে সাজিদের গালে থা’প্প’র মা’রে তার বাবা। এতক্ষণে পুলিশও এসে গেছে প্রতারণার মামলায় সাজিদকে গ্রে’ফ’তার করার জন্য।

সাজিদের বাবা স্পষ্ট তাকে জানিয়ে দেয়,
‘আজ থেকে তুই আমার কাছে মৃ’ত। জীবনে কোনদিনও আর আমার সামনে আসবি না৷ বেচে থাকতে তোর ঐ মুখ আর আমি দেখতে চাইনা।’

সাজিদ সবাইকে অনুরোধ করে তাকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য। কেউ সাজিদের দিকে মুখ তুলেও তাকায় না। আলো সাজিদকে বলে,
‘তুমি অনেক অন্যায় করেছ সাজিদ ভাই। এতদিন আমি ভাবতাম আমার জীবনের সবথেকে বড় ভুল আতিককে বিয়ে করা। এখন বুঝতে পেরেছি আতিককে বিয়ে করার মতো তোমাকে ভালোবাসাটাও আমার জীবনের সবথেকে বড় ভুল। এখন জেলে গিয়ে নিজের অন্যায়ের শাস্তি ভোগ কর।’

সাজিদ রক্তিম চোখে আলোর দিকে তাকায়। তার রাগী চোখই জানান দিচ্ছিল সে আলোকে সামনে পেলে তাকে মে’রেই ফেলত।

পুরো ঘটনায় হতবিহ্বল হয়ে গেছে মায়া। কোথায় সে ভেবেছিল আজ সাজিদের সাথে তার বিয়ে হবে। সে বউ হয়ে সাজিদের বাড়িতে পা রাখবে। সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেল।

পুলিশ সাজিদকে গ্রে’ফ’তার করে নিয়ে যায়। এখানেই শে’ষ হয় আলোর জীবনের আরেকটি কালো অধ্যায়।

২৩.
‘আমাকে এভাবে আটকিও না আম্মু। আমি আগে থেকেই জানতাম আমার জীবন এত সহজ হবে না। আমার জীবনে বিবর্ণ আলোকবর্ষ পারি দেওয়াই নিয়তি৷ সেখানে সুখ আশা করা হাস্যকর।’

আলোর কথা শুনে মালেকা বেগম বলেন,
‘আমি তো বললাম তুই কোন চিন্তা করিস না। আমি আছি তোর পাশে।’

‘কয়’লা ধুলে ম’য়লা কখনো যায়না আম্মু। আমার গায়ে যে ক’লঙ্ক লেগেছে সেটা কখনো দূর হবে না। এখানে থাকলে প্রতি’নি’য়ত আমাকে ক’টু কয়হা শুনতে হবে। তার থেকে ভালো আমি দূরে চলে যাই।’

আলোর কথাগুলো শুনে মালেকা বেগম কি উত্তর দেবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। সাজিদকে গ্রে’ফ’তার করা হয়েছে এটা জানার পরেও আলোকে নিয়ে কথা থামছে না৷ লোকজন এখনো মনে করে আলোর চ’রিত্র ভালো না। জসিম-সাজিদের পক্ষে কথা বলতেও মানুষ দ্বিধাবোধ করছে না অথচ আলোর পাশে গুটিকয়েক মানুষই শুধু আসে।

মায়া আলো, জোনাকির সব জামাকাপড় এনে বারান্দার ফেলে বলে,
‘তোরা দুই বোন চলে যা এই বাড়ি থেকে। তোদের দেখলে আমার মাথায় রা’গ উঠে যা’চ্ছে। তোরা ইচ্ছা করেই সাজিদ ভাইকে ফাসিয়ে আমাদের বিয়েটা বা’ন’চাল করেছিস। এ’ক্ষুনি বেরিয়ে যা।’

‘এটা আমার বাড়ি তাই কে থাকবে আর কে থাকবে না সেই সিদ্ধান্ত আমি নেবো তুমি না।’

আসাদুল করীমের উক্ত কথায় চুপ হয়ে যায় মায়া। আসাদুল করীম এগিয়ে আসে আলোর কাছে।

‘আমি জানি এর আগে আমি তোকে অবিশ্বাস করেছিলাম। তখন পরিস্থিতিই এমন ছিল যে,,তুই আমার মেয়ে। আমি থাকতে কেউ তোকে কিছু বলতে পারবে না। তুই কোথাও যাওয়ার কথা ভাবিস না। এখানেই থাক তোরা।’

তাদের কথার মাঝে জোনাকি বলে,
‘সেটা হয়না আব্বু। তুমি মানুষের মুখের কথা বন্ধ করতে পারবে না। তাছাড়া আমি শুনছি আমাদের একঘরে করার কথা চলছে। আমি চাইনা এমনটা হোক। আমাদের চলে যাওয়াই ঠিক হবে। তোমরা কোন চিন্তা করো না আমরা নিজেদের সামলে নেব।’

আসাদুল করীম, মালেকা বেগম তাদের অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেও আলো ও জোনাকি নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল। অবশেষে আসাদুল করীম হার মেনে নিয়ে বলেন,
‘ঠিক আছে তোরা যা ভালো করিস কর। আমার কথা যখন শুনবিই না তখন যা যেখানে ইচ্ছা।’

জোনাকি ও আলো নিজেদের জামাকাপড় তুলে নিয়ে চলে যাচ্ছিল এমন সময় মালেকা বেগম তাদের আটকান। মালেকা বেগম তাদের কাছে এসে বলে,
‘আমি জানি আমি তোদের জন্ম দেইনি। তবুও আমি তোদের মা আর তোরা আমারই সন্তান। যেদিন প্রথম বিয়ে করে এই বাড়িতে এসেছিলাম সেদিন তোদের মতো ফুটফুটে দুটো পড়িকে দেখেছিলাম। জোনাকি একটু বড় ছিল সে তো প্রথম প্রথম আমার কাছেই আসত না। আলো অনেক ছোট ছিল দুই বছর হবে হয়তো। সেই ছোট মেয়েটাই প্রথম আমায় মা বলে ডেকেছিল। আলোর মাধ্যমে আমি মাতৃত্বের সাধ অনুভব করি। তোরা জানিস আমারও না অনেক ছোটবেলাতেই মা মা’রা গিয়েছিল। তারপর আমার আব্বু আবার বিয়ে করেন। ছোটবেলা থেকে সৎমায়ের অ’ত্যা’চার সহ্য করতে হয়েছিল। তিনিই টাকার লোভে এক বিবাহিত ব্যক্তির মানে তোদের আব্বুর সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দেন। প্রথমে আমি এই বিয়েটা নিয়ে মোটেই খুশি ছিলাম না। সবসময় রাগ হতো। তোদের মেয়ে হিসেবে পেয়ে সেই রাগ আমার চলে গিয়েছিল৷ নিজের সৎমায়ের থেকে অত্যা’চার পেয়ে আমার মনে যেরকম রাগ জমে ছিল আমি চাইনি একইরকম ক্ষোভ তোদের আমার প্রতি জন্ম নিক। আমি তো জানি মা না থাকলে পৃথিবী কত কঠিন তাই তোদের মা হয়ে ওঠার চেষ্টা করি। জানিনা আমি কতটা সফল তবে আমি নিজের সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি।’

কথাগুলো বলে মালেকা তাদের অপেক্ষা করতে বলে নজের রুমে চলে যায়। নিজের জমানো সব টাকা এনে তিনি জোনাকির হাতে তুলে দেন। সাথে নিজের কান থেকে সোনার দুল খুলে দিয়ে বলেন,
‘এগুলো নিয়ে যা কাজে লাগবে। তোরা যেখানেই থাকিস আমার সাথে একটু যোগাযোগ রাখিস। তাহলে আমি শান্তি পাবো।’

জোনাকি ও আলো মালেকা বেগমকে জড়িয়ে ধরে অনেক কাদে৷ তারপর বিদায় নিয়ে চলে আসে।

২৪.
সজীব বাইরে দাড়িয়ে ছিল। আগামীকালই সে বিদেশে চলে যাবে। আলো আর জোনাকিকে যেতে দেখে বলে,
‘এতরাতে কোথায় যাচ্ছিস তোরা?’

‘ঢাকায় যাচ্ছি জীবনটা নতুন করে শুরু করতে।’

আলোর সহজ সরল উত্তর। যার বিপরীতে সজীব একগাল হেসে বলে,
‘আমিও কাল বিদেশে চলে যাচ্ছি মোনালিসাকে সাথে নিয়ে। মেয়েটা যে বেচে গেছে এটাই অনেক। ও যতই আমাকে ভুলে যাক আমি ওকে ভালোবাসি এখনও। তাই ওর সাথে বাকি জীবন কা’টাতে চাই। ‘

আলো মৃদু হেসে বলে,
‘তুমি কত সহজে ক্ষ’মা করে দিতে পারলে। সত্যিকারের ভালোবাসা বুঝি এমনই হয়। তোমাদের ভবিষ্যত জীবন সুখের হোক।’

কথাটা বলে জোনাকির হাতে ধরে এক অজানা গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে আলো।
চলবে ইনশাআল্লাহ
>>আসসালামু আলাইকুম। আপনারা অনেকেই আগে থেকে সজীবকে আলোর নায়ক ভাবছিলেন বাট সজীব এই গল্পের নায়ক নয়। সে শুধু একটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিল। পরবর্তী পর্বে আলোর নায়ককে সামনে আনব ✨

#বিবর্ণ_আলোকবর্ষ
#পর্বঃ১৩
#লেখিকাঃদিশা মনি

আলো জোনাকির হাত ধরে ঢাকা শহরে পা রাখে। ট্রেন থেকে কমলাপুর রেলস্টেশনে নামে তারা। ভাগ্যের কি পরিহাস একদিন এই শহর থেকেই নিজের বাড়িতে আলোকে ফিরে যেতে হয়েছিল আশ্রয়ের খোঁজে। আজ আবার নিজের বাড়ি থেকে ঢাকায় ফিরে আসতে হলো।

আলো এটা নিয়ে খুব চিন্তায় আছে যে এত বড় শহরে তারা কোথায় থাকবে। এখানে তাদের আপন বলতে যে কেউ নেই। জোনাকি বুঝতে পারে আলো কি ভাবছে।

‘যাদের কেউ নেই তাদের আল্লাহ আছে আলো। আমাদের কোন একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এখন চল আমার সাথে। আজকের রাতটা নাহয় স্টেশন বসেই কা’টিয়ে দেই।’

আলো মৃদু হাসে। এই অনিশ্চিত জীবনে এখন তাদের কিছুই করার নেই। আলোর ঘুম আসছিল না। জোনাকি বলে,
‘তোর ঘুম আসছেনা তাইনা? তাহলে চল আমি তোকে ছোটবেলায় যেমন গল্প শোনাতাম তেমন গল্প শোনাই।’

‘এখন আর আমি ছোট নই আপু। যখন ছোট ছিলাম তখন রাজপুত্র রাজকন্যার গল্পগুলো শুনে খুব ভালো লাগত। এসব গল্প শুনে আমিও স্বপ্ন দেখতাম আমার জীবনেও এরকম রাজপুত্র আসবে। এখন আমি বুঝতে পেরেছি বাস্তবতা আসলে কি। আমার জীবনের বাস্তবতা হলো বিবর্ণ আলোকবর্ষ পারি দেওয়া।’

‘একটু ভালো চিন্তাভাবনা কর আলো। এমন কেউ তোর জীবনে আসতে পারে যে তোকে আলোকিত করবে। তোর বিবর্ণ আলোকবর্ষে রং নিয়ে আসবে।’

‘বেচে থাকব কিনা তারই নিশ্চয়তা নেই আর তুমি আমায় এসব স্বপ্ন দেখাচ্ছ।’

‘ধূর পাগলী আমরা বাচবোনা কেন? আমরা অনেক ভালোভাবে বাচব। আমি ঠিক করেছি তোকে এখানকার একটি ভার্সিটিতে ভর্তি করাবো। ইন্টার পাশ করার পর তুই আর পড়লি না। তোকে আবার পড়তে হবে আলো। নিজের পায়ে দাড়াতে হবে। মাথা নিচু করে আমাদের বাড়ি থেকে চলে আসতে হয়েছে। আমি চাই মাথা উচু করে তুই আবার ফিরে যাস।’

‘শুধু আমার কথা বলছ কেন আপু? তুমি আর পড়বেনা?’

‘কি যে বলিস তুই। আমি আবার কখন ভালো ছাত্রী ছিলাম। কোনরকম টেনেটুনে পাস করতাম। সেখানে তুই এ প্লাস পেয়ে ইন্টার পাস করেছিস। বিয়ে না করে পড়াশোনা চালিয়ে গেলে আজ তোর অবস্থা এমন হতো না। আমি দেখি যদি কোন কাজ পাই। তুই এখন ঘুমা।’

আলো হাসে। জোনাকি মোটেও খারাপ ছাত্রী নয়। এটা ঠিক আলো অনেক মেধাবী ছাত্রী। তবে জোনাকিও পড়াশোনায় মোটামুটি ভালোই ছিল।

২৫.
স্টেশনজুড়ে ভিড় বাড়তে থাকে। আলোকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে জোনাকি। ভোরের আলো ফুটেছে আরো অনেক আগেই। আলো জোনাকিকে দেখে জোনাকিকে খুব বিধ্বস্ত লাগছিল।

‘কি হয়েছে আপু? তোকে এরকম লাগছে কেন?’

‘কিছু না চল আমাদের যেতে হবে।’

‘কোথায় যাবো আমরা?’

‘কাল রাতে একজন মহিলার সাথে আমার দেখা হয়েছিল। উনি আমাকে নিজের ঠিকানা দিয়েছেন প্রয়োজন হলে যোগাযোগ করতে বলেছেন। এখন তার কাছেই যাব চল।’

আলো জোনাকির কথা শুনে উঠে পড়ে। জোনাকির সাথে যেতে থাকে। জোনাকিকে দেখে কয়েকজন বলাবলি করে,
‘এটা সেই মেয়েটা না? কাল রাতে ছিনতাইকারীর হাত থেকে যে একজন মহিলার ব্যাগ বাচিয়ে আনল। মেয়েটার সাহস আছে বলতে হবে। একা কিরকম নিজের জীবনের ঝুকি নিয়ে ছুটে গেলো। ছিনতাইকারীটা তো মেয়েটার বড় কোন ক্ষতি করে দিত যদি আরো কয়েকজন সেখানে চলে না আসত।’

‘হুম। কাল দেখলাম তো যেই মহিলার ব্যাগ উদ্ধার করে দিল তিনি ওকে টাকা দিতে চাইলে বলল কোন সাহায্য লাগবে না। তখন হাতে কার্ড দিয়ে চলে গেল। মেয়েগুলো মনে হচ্ছে খুব অসহায়।’

জোনাকি একটি সিএনজি দাড় করালো। আলোকে নিয়ে সেই সিএনজিতে উঠে নির্দিষ্ট ঠিকানায় যেতে বলল।

ঠিকানায় পৌছে তারা দেখলো দুইতলা বিশিষ্ট একটি বাড়ি। দেখে মনে হচ্ছে ভালোই অবস্থা আছে। জোনাকি বাড়ির ভেতরে যেতে চাইলে দারোয়ান তাকে আটকে দেয়। জোনাকি তার কাছে থাকা কার্ড দেখিয়ে বলে,
‘সুমনা ম্যাম আমাদের আসতে বলেছেন।’

তখন দারোয়ান তাদের ভিতরে যেতে দেয়। বাড়ির ভেতরে গিয়ে তারা দেখে বাড়িটা বাইরে থেকে যতটা না সুন্দর ভিতরে তার থেকেও বেশি সুন্দর। আলো চকিত হয়ে যায় বাগান দেখে। কত সুন্দর বাগান। তাতে রঙ বেরঙের কত ফুল। আলো একটি ফুল ছি’ড়তে গেলে মালী এসে বলে,
‘কি করছেন এটা বর্ণ ভাইয়ের অনেক পছন্দের ফুল। এটা ছি’ড়বেন না।’

বর্ণ নামটা শুনে তারা দুজনেই অবাক হয়। আলো ভাবতে থাকে এই বর্ণ কে হতে পারে? জোনাকির কথায় আলোর ভাবনায় বিচ্যুতি হয়। জোনাকির সাথে বাড়ির ভিতরে যায় তারা। কলিং বেজ বাজানোর অনেকক্ষণ পরও যখন কেউ আসেনা তখন আলো দ্বিতীয়বার কলিং বেল বাজায়।

এবার একজন বেশ মোটাসোটা মহিলা এসে দরজা খুলে দেয়। আলো আর জোনাকিকে দেখে তিনি ভ্রু কুচকে বলেন,
‘কি চাই?’

‘আমরা আসলে সুমনা ম্যাডামের সাথে দেখা করতে এসেছি।’

‘ম্যাম এখন ব্যস্ত আছে। কোন ভি’ক্ষে’টি’ক্ষে দিতে পারবে না যাও এখান থেকে।’

কথাটা বলে তাদের মুখের উপরই দরজা লাগিয়ে দেয় জরিনা। জরিনা এই বাড়ির কাজের লোক। সবাই তাকে পরিবারের লোক ভাবে। আর এটাতেই তার খুব অহংকার। অহংকারে মাটিতে পা ফেলার উপায় নেই।

জরিনা দরজা লাগানোর পরপরই সুমনা সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসেন। এসেই জরিনাকে জিজ্ঞেস করেন,
‘কলিং বেলের শব্দ শুনলাম কে এসেছিল?’

‘দুটো মেয়ে এসেছিল। বলল আপনার সাথে দেখা করতে চায়। ওদের দেখে তো আমার ভিক্ষু’কই মনে হলো। কেমন নোংরা জামাকাপড় পরা। তাই বললাম চলে যেতে।’

‘তুমিও না জরিনা। আমার সাথে কাল স্টেশনে একটা মেয়ের দেখা হয়েছিল। মেয়েটা আমায় কত সাহায্য করল। ওকে আমি আমার ঠিকানা দিয়েছি। মেয়েটা খুব অসহায় সাথে ওর বোনও আসে। ওরা তো আসতে পারে। তুমি যাও দরজাটা খুলে দাও।’

জরিনা বিড়বিড় করতে করতে দরজাটা গিয়ে খুলে দেয়।

২৬.
আলো এতক্ষণ জোনাকির সাথে রাগারাগি করছিল। এভাবে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেওয়ায় যে তার সম্মানে লেগেছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে।

জরিনা দরজা খুলে মুখে ভেংচি কে’টে বলে,
‘ম্যাম তোমাদের ভিতরে ডাকছে। চলে এসো।’

জোনাকি যেতে চাইলে আলো বাধা দিয়ে বলে,
‘কোথাও যাওয়ার দরকার নেই আপু। আমাদের প্রথমে এত অপমান করল ভিক্ষুক বলল এখন আবার কোন মুখে যাব। চল আমরা ফিরে যাই। না খেয়ে ম’রে যাব তবু অপমানিত হবো না।’

‘মাথাটা একটু ঠান্ডা কর আলো। এখন আমাদের যা পরিস্থিতি তাতে এত সম্মান নিয়ে ভাবলে চলবে না। চুপচাপ চল আমার সাথে।’

আলো কিছু বলতে চাইছিল। জোনাকি তার কোন কথা না শুনে টেনে ভেতরে নিয়ে যায়। সুমনা সোফায় বসে নিউজ পেপার পড়ছিল। জোনাকি তার সামনে গিয়ে বলে,
‘আসসালামু আলাইকুম ম্যাডাম।’

‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। তুমি সেই মেয়েটা না যে কাল রাতে আমায় সাহায্য করেছিলে। কি যেন নাম তোমার,,,,জোনাকি রাইট?’

‘জ্বি ম্যাডাম। আর আমার সাথে যাকে দেখছেন ও হলো আমার বোন আলো।’

‘তোমরা কি ঢাকার স্থানীয়? নাকি অন্য কোথাও থেকে এসেছ?’

‘আমরা ঢাকার নই। আমাদের বাড়ি জামালপুর। খুব অসহায় হয়ে ঢাকায় এসেছি একটু আশ্রয়ের খোঁজে।’

‘বুঝলাম। তো ঢাকায় কি তোমাদের চেনাজানা কেউ আছে?’

‘না নেই।’

‘তাহলে এখানে কোথায় থাকবে তোমরা? আর কি করবে?’

জোনাকি কিছু বলতে পারে না। সুমনা তখন বুঝতে পারে তাদের অবস্থা।

‘তুমি যেহেতু আমার উপকার করেছ তাই আমিও তোমার উপকার করতে চাই। আমার ঐ ব্যাগে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ফাইল ছিল যেগুলো চু’রি হয়ে গেলে অনেক সমস্যা হতো। তোমাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আমি করে দেব। এখন আপাতত তোমরা রেস্ট নাও। জরিনা তুমি ওদের গেস্ট রুমে নিয়ে যাও।’

জরিনা ইতস্তত হয়ে বলে,
‘ওরা তো অতিথি নয় তাহলে গেস্ট রুমে কেন থাকবে?’

‘বেশি প্রশ্ন না করে তোমায় যা বলছি তাই করো। নিয়ে যাও ওদের।’

জরিনা খুব রেগে যায়। এই মেয়েগুলোর জন্য তাকে এত কথা শুনতে হলো। মনে মনে তাদের অনেক গালি দিয়েও মুখে মিষ্টি হাসি নিয়ে বলে,
‘চলো আমার সাথে তোমাদের গেস্ট রুমে নিয়ে যাই।’

আলো ও জোনাকি জরিনার সাথে গেস্টরুমের দিকে যেতে থাকে। যাওয়ার সময় আলোর চোখ আটকে যায় দেওয়ালে টাঙানো একটা ছবিতে। আলোকে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে জরিনা বলে,
‘এটা এই বাড়ির ছেলে বর্ষর ছবি।’

বর্ষ নামটা শুনে আলোর মনে অন্যরকম একটা অনুভূতির সৃষ্টি হয়।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨