বিবর্ণ আলোকবর্ষ পর্ব-২২

0
245

#বিবর্ণ_আলোকবর্ষ
#পর্বঃ২২
#লেখিকাঃদিশা মনি

পুরো বাড়িতে সাজসাজ রব। আজ বর্ণর সাথে এলিনার এনগেজমেন্ট। বর্ণর কাছে পুরো ব্যাপারটা এখনো সারপ্রাইজ রাখা হয়েছে।

এলিনা আর বর্ণ ছোটবেলা থেকেই বন্ধু। এলিনা অনেক বছর থেকে বিদেশে থাকে। এখন দেশে ফিরে এসেছে। তাই সুমনা সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাদের এনগেজমেন্টের।

আলো জোনাকিকে কাল এই ব্যাপারে বলেছিল। বর্ণর এনগেজমেন্টের কথা শুনে প্রথমে খারাপ লাগলেও নিজেকে জোনাকি বোঝায় যে এটাই ঠিক। বর্ণ তার কাছে আকাশের চাদ। বামন হয়ে চাদে হাত দিতে চায়না জোনাকি।

জরিনা আজ ব্যস্ত দিন পার করছে। সুমনা এরমাঝে জরিনার সামনে এসে বলে,
‘তোমার মনে আছে জরিনা আমি আর জ্যোতি সবসময় চাইতাম আমাদের যদি ছেলে-মেয়ে হয় তাহলে তাদের বিয়ে দিয়ে দিতে। কত মিল মহব্বত ছিল আমাদের মাঝে। আজ যদি জ্যোতির কোন মেয়ে থাকত তাহলে আমার ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দিতাম। কিন্তু আফসোস জ্যোতির কোন খোজই নেই। কত খুজলাম তাও পেলাম না। না জানি কোথায় আছে।’

‘এখন আর এসব ভেবে কি হবে ম্যাম। এখন আপনি বর্তমান নিয়ে ভাবুন।’

জরিনা নানান কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়। এলিনা এরমধ্যে তার পরিবার নিয়ে হাজির হয়। এলিনা এসেই সবার আগে সুমনাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে,
‘আন্টি হাউ আর ইউ? আমি এখন আগের থেকেও সুন্দরী হয়ে গেছি তাইনা?’

এলিনার এমন প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় সুমনা। নিজেকে ধাতস্থ করে জবাব দেয়,
‘আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছি। তুমি সুন্দর হয়েছ ঠিকই বাট মেকআপ একটু বেশি হয়ে গেছে।’

এলিনা আয়না বের করে নিজেকে একবার দেখে বলে,
‘এটা তো ফ্যাশন আন্টি। আপনি বুঝবেন না। বর্ণকে আসতে দিন ও ঠিকই বুঝবে।’

জরিনা জুস এনে সবাই কে দেয়। এলিনা জুস থেকে নাক মুখ কুচকে বলে,
‘এসব কি? জুস আমি খাই না। আমার বিয়ার লাগবে।’

এলিনার কথায় জরিনা বিষয় খায়। বিড়বিড় করে বলে,
‘এ কেমন মেয়ে আল্লাহ? এই মেয়ে কিনা আমাদের বর্ণর বউ হবে। মুখে কোন কথাই আটকায় না। আর কি পোশাক পড়েছে। নাউজুবিল্লাহ।’

৪৩.
আলো নিত্যদিনের মতো আজও ভার্সিটিতে এসেছে। রুহি আর লতা নিজেদের মধ্যে কি নিয়ে যেন কথা বলছে। আলো তাদের কথা শুনতে পাচ্ছে না আর শোনার কোন আগ্রহ নেই।

রুহি আচমকা আলোর সামনে এসে বলে,
‘তোমার বর্ষ স্যারকে কেন পছন্দ নয় আলো? ওনার মতো এত হ্যান্ডসাম,রিচ ছেলেকে তো সব মেয়েরাই পছন্দ করে।’

আলো কথাটা শুনে বলে,
‘সব মেয়েদের সাথে আমাকে গুলিয়ে ফেলার মানে নেই। সবার পছন্দ এক না। তাছাড়া আমি লাইফে একা থাকতে চাই। কারো সঙ্গের প্রয়োজন নেই আমার।’

‘কোন মানুষ জীবনে একা থাকতে পারে না আলো। আমার জীবনকে সুন্দর করে সাজানোর জন্য পাশে কাউকে দরকার হয়।’

‘আমার জীবন আমি একাই সাজাতে পারব। এর আগে তো একজন দায়িত্ব নিয়ে আমার সাজানো জীবন নষ্ট করে দিয়েছিল। আতিক,,, নামটা শুনলেই আমার ঘৃণা হয় এখন।’

‘এই আতিক আবার কে? তোমার সাথে তার কি সম্পর্ক।’

আলো মুচকি হাসে।

‘আতিক আমার প্রাক্তন স্বামী। বিয়ে নামক জিনিসটার সাথে আমার অনেক আগে পরিচয় হয়ে গেছে। যে তিক্ততা আমি অনুভব করেছি তাতে ভবিষ্যতে আর কাউকে বিয়ে করার ইচ্ছে নেই। তোমরা এটা বলতে পারো সবাই এক হয়না। ভেবে দেখো মানুষ কিন্তু পরিবর্তনশীল। অনেক মানুষই আছে যারা মুখোশ পড়ে ঘোরে ভালো মানুষের। আজকালকার যুগে মানুষ চেনা এত সহজ নয়।’

আলো আতিক,সাজিদ, তার বাড়ি ত্যাগ করে ঢাকায় আসা সব গল্প বলছে।
রুহি, লতা দুজনেই অবাক হয়ে দেখতে আলোর দিকে। আলো কখনো নিজের জীবনের ব্যাপারে কাউকে কিছু বলে নি। আজ আলো বলছে আর ওরা মনযোগ দিয়ে শুনছে।

আলোর জীবনের সবকিছু শুনে লতা,রুহি দুজনের মুখই ফ্যাকাসে হয়ে যায়। তারা জানতোই না মেয়েটার সাথে এতকিছু হয়েছে। আলো লতার উদ্দ্যেশ্যে বলে,
‘রুহি না বুঝুক অন্তত তোমার আমার ব্যাপারটা বোঝা দরকার। রুহি হয়তো জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়নি কখনো কিন্তু তুমি তো হয়েছ। তোমাকে তো আমি আগেও বলেছিলাম লতা।’

আলো আর কোন কথা না বলে উঠে চলে যায়। লতা আর রুহি একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে। লতা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
‘আমাদের আলোকে সময় দেওয়া উচিৎ। জোর করে কোন কিছু করা ঠিক নয় রুহি। আমার বিশ্বাস আছে যে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।।’

রুহি বলে,
‘আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে চাইব তিনি যেন আলোর সব কষ্ট দূর করে দেন।’

আলো একটু দূরে থেকে ওদের সব কথা শুনতে পায়। খুব খুশি আলো এখন ওদের মতো এত ভালো বন্ধু পেয়ে। আসলে মানুষের জীবনে সবকিছু খারাপ হয়না। ভালো-খারাপ,দুঃখ-কষ্ট মিলিয়েই মানুষের জীবন।

আলো যাওয়ার সময় মুখোমুখি হয় বর্ষর। বর্ষ বলে,
‘মম আমাকে বলেছে তোমাকে সাথে করে নিয়ে যেতে। আজ একটা ক্লাস করেই আমাদের যেতে হবে। কারণ আজ বাড়িতে অনুষ্ঠান।’

আলো মাথা নাড়িয়ে চলে যায়। আলো যাওয়ার পর বর্ণ বর্ষকে ফোন করে।

‘বর্ষ তুই আমাকে এনগেজমেন্টের কথা বলে ঠিক করেছিস। শোন তুই তো জানিস আমি জোনাকিকে পছন্দ করি। অন্য কারো সাথে এনগেজমেন্ট কিভাবে করি? তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি বিদেশে চলে যাব। এখন আপাতত এয়ারপোর্টে আছি। কিছুক্ষণ পর ফ্লাইট। তুই ঐদিকটা সামলে নিস। আচ্ছা বাই।’

বর্ষকে কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বর্ণ কলটা কে’টে দেয়। বর্ষ খুব রেগে যায় বর্ণর এরকম ছেলেমানুষিতে। এখন কিছু বলতেও পারছে না আবার সহ্য করতেও পারছে না।

৪৪.
ক্লাস শেষে বর্ষ আলোকে বলে,
‘চলো এখন।’

আলো প্রস্তুত হত বর্ষর সাথে যাওয়ার জন্য। তাদেরকে একসাথে যেতে দেখে রুহি আর লতা। দুজনেই খুশি হয়। রুহি লতাকে বলে,
‘দেখলে তো ওরা একসাথে। আমার খুব খুব খুব ভালো লাগছে ওদের একসাথে দেখে। একসাথে কত সুন্দর মানায় ওদের। আল্লাহ ওদের সবসময় একসাথে থাকার তৌফিক দান করুক। আমীন।’

বর্ষর সাথে গাড়িতে ওঠে আলো। আলো পিছনের সিটে বসে। বর্ষর ইচ্ছা করছিল তাকে সামনের সিটে বসতে বলতে কিন্তু পারছিল না।

রুহি গাড়ির ক্লাসে এসে টোকা দিয়ে বলে,
‘আলো তুমি কি স্যারকে ড্রাইভার ভেবেছ নাকি? স্যারদের সম্মান দিতে জানো না।’

‘কি বলছ তুমি রুহি?’

‘ঠিকই বলছি। যাও সামনে গিয়ে বসো।’

আলো নিজের সিটে অনড়ভাবে বসে থাকে। রুহি এবার বর্ষকে বলে,
‘স্যার আপনি কিছু বলবেন না? এই মেয়েটা আপনাকে ড্রাইভার বানিয়ে দিচ্ছে।’

‘আমি কোন ড্রাইভার না। আলো সামনে এসো।’

আলো না বলতে যাবে কিন্তু বর্ষর রাগী মুখে তাকিয়ে থেমে যায়।

এদিকে বর্ষ নিজেকে শাবাশি দিতে থাকে।
‘বাহ বর্ষ মাহমুদ বাহ্। এত সুন্দর রেগে যাওয়ার অভিনয় কি করে করলে তুমি।’

আলো অগত্যা সামনের সিটে এসে বসে। রুহি সফলতার হাসি দিয়ে গান গাইতে গাইতে চলে যায়।

বর্ষ গাড়ি চালানো শুরু করে। কিছুদুর যাওয়ার পর আচমকা গাড়ির সামনে একজন লোক চলে আসে। বর্ষ গাড়ি থামিয়ে লোকটাকে গালি দিতে থাকে।
‘দেখে চলতে পারেন না স্টুপিড।’

আলো চুপ থাকতে না পেরে বলে,
‘আমার তো মনে হয় আপনি গাড়ি চালাতে পারেন না স্যার। সেদিনও,,,’

‘কি বললে আমি গাড়ি চালাতে পারি না। ঠিক আছে আমি দেখিয়ে দিচ্ছি আমি গাড়ি চালাতে পারি কিনা।’

কথাটা বলে দ্রুতবেগে গাড়ি চালাতে শুরু করে বর্ষ। আলোর খুব ভয় লাগছিল। দোয়া দরুদ পড়তে পড়তে বলে,
‘আপনি অনেক ভালো ড্রাইভ করেন। আপনাকে তো নোবেল দেওয়া উচিৎ। গাড়ি থামান এখন।’

‘না আমি দেখিয়ে দেব আমি ড্রাইভ করতে পারি। তুমি চুপচাপ বসে থাকো।’

আলো চোখটা বন্ধ করে ভয়ে। চোখটা খুলতেই প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যায়।

‘সামনে ট্রাক,,,নাহ,,,’
চলবে ইনশাআল্লাহ