বিবর্ণ বসন্ত পর্ব-১৮

0
177

#বিবর্ণ_বসন্ত
১৮তম_পর্ব
~মিহি

আজ তন্বীর বিয়ে। অভ্রের মা গত পরশু হঠাৎ তিনদিন পর বিয়ের তারিখ ঠিক করায় বিপাকে পড়লেন রাহেলা। তন্বীর বাবা গত হয়েছেন অনেক আগে তবে তার পেনশনের টাকায় ভালোভাবেই দিন কাটছে রাহেলার। এখন বিয়ের জন্য সব ঠিকঠাক করা তার একার কর্ম নাই। তন্বীর এক চাচা আছেন, তিন বাড়ি পরেই তাদের বাড়ি। জমি-জমা সংক্রান্ত বিবাদে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরত্বে এ বাড়ি কিনেছিলেন রাহেলার স্বামী। তারপর থেকে এই বাড়িটাকেই শ্বশুরবাড়ি মেনে এসেছে রাহেলা। বহুদিন যোগাযোগ না থাকলেও এখন সৌজন্যের খাতিরে তন্বীর বিয়েতে তার চাচা-চাচী, দাদা-দাদীকে নিমন্ত্রণ করেছেন। রাহেলা চাচ্ছেন বিয়েটা লুকিয়ে-চুরিয়ে শেষ করতে। বিশেষ করে সাজিয়া কিংবা অনামিকার কানে পড়লে এ বিয়ে আর সম্ভব হবে না। বিশেষ কোনো আয়োজন নেই। তন্বীকে একটা লাল বেনারসি পড়ানো হয়েছে। অভ্রের মাও চাচ্ছেন ঘরোয়াভাবে বউ ঘুরে তুলতে। একবার বিয়েটা হয়ে গেলে পরে বড়সড় অনুষ্ঠান করবেন। তিনি অভ্রকে বলেছেন আজ শুধু আকদ হবে। অভ্র বিশ্বাস করেছে। বিয়েটা সে করবে না তা নিশ্চিত, আকদেই কিছু একটা করে বিয়ে ভাঙতে হবে। যে নাদিম সবসময় শত্রু ভেবে এসেছে, সে-ই নাদিম ভালোবাসার খাতিরে পুরো ভার্সিটির সামনে অভ্রের পা অবধি ধরতে দ্বিধা করেনি শুধুমাত্র ভালোবাসার জন্য তবে অভ্র কেনইবা অন্যের ভালোবাসা কাড়তে যাবে? মাকে বোঝানোর জন্য প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে অভ্র কিন্তু তন্বীর বাড়িতে এসে দেখে অন্য কাণ্ড। কাজী সাহেব এসে বসে আছেন। অভ্র বুঝতে পারলো সে ফাঁদে পড়ছে। এ ফাঁদ যেন তেন ফাঁদ নয়, তার মা আফরিন আরা চৌধুরীর পাতানো ফাঁদ। এ থেকে উত্তরণ সহজ হবে না তাও নিশ্চিত।

তন্বীর হাত পা কাঁপছে। অনামিকাকে সে বিয়ের কথা জানিয়েছিল। অনামিকা কি তাকে বাঁচাতে আসতে পারবে? নাকি এখানেই সব স্বপ্ন শেষ! তন্বীর অশ্রুকণাগুলো বাধা মানছে না। রাহেলা তন্বীকে নিতে আসলেন। তন্বী এবার জোরে কেঁদে উঠলো।

-‘মা, আমি এ বিয়ে করবো না। তুমি প্লিজ এ বিয়ে ভেঙে দাও।’

-‘থাপ্পড় দিয়ে সব দাঁত ফেলে দিব। পিরিতির ভূত আবার চড়ছে মাথায়? একদম গলা কেটে ফেলে দিয়ে আসবো যদি বিয়ে নিয়ে কোনোরকম না না শুনি।’

-‘কিন্তু মা..’

-‘চুপচাপ চল। কাজী সাহেব অপেক্ষা করছেন।’

তন্বীকে কিছুটা জোর করেই ড্রয়িংরুমে এনে বসালেন তন্বীর মা। অভ্র কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আছে। তার মা তাকে বলে দিয়েছেন অভ্র যদি এ বিয়ে না করে তবে অভ্রের মা উপমার চাকরি খাবেন। উপমা অভ্রের মায়ের পি.এ। বয়সে অভ্রের চেয়ে দুই বছরের বড়। উপমার প্রেমে পড়াটাই অভ্রের সবচেয়ে বড় দোষ। এখন সে দোষের মাশুল দুজনকেই গুণতে হচ্ছে। উপমা চাকরিটা হারালে অনেক বড় ধাক্কা খাবে। এমনিতেই লোনের বোঝা তার একার কাঁধে। সব মিলিয়ে অভ্র ধর্মসংকটে পড়ে গেল। না পারছে সইতে আর না পারছে কইতে। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে সুরাহার জন্য প্রার্থনা করে যাচ্ছে। এ বিয়ে হলে একাধারে চারটে জীবন নষ্ট হয়ে যাবে।

______________________________

অনামিকার হাত চেপে ধরে বসে আছে তন্বী। রক্তচক্ষু মেলে সেদিকে তাকিয়ে আছেন রাহেলা বানু। মাঝেমধ্যে তার ইচ্ছে করছে অনামিকার চুলের মুঠি ধরে তাকে ঘর থেকে বের করে দিতে কিন্তু তিনি পারছেন না। সোহরাব আর সাজিয়া একপাশে দাঁড়িয়ে। সুমিকে সোহরাব এক বান্ধবীর বাসায় ছেড়ে এসেছে। তন্বীর এ আচমকা বিয়ের কথা তাদের জানানোই হয়নি! একমাত্র তন্বীর চাচা-চাচী এবং দাদা-দাদীকে জানানো হয়েছিল কিন্তু তারা আসেন নি। সাজিয়া রাগে রাহেলাকে অনেক কথাই শুনিয়েছেন। ঘটনাটা মূলত অনামিকার দ্বারাই শুরু। অনামিকাকে তন্বী তিনদিন আগে ফোন করে বিয়ের কথা জানিয়েছিল। অনামিকা তখন আর শ্বশুরবাড়িতে ফেরেনি। তন্বীর জন্য কী করা যায় ভাবতে থাকে। শেষমেশ বুদ্ধি আসে পুলিশি নাটকের। থিয়েটারের কিছু বন্ধুদের পুলিশ সাজিয়ে বিয়েটা ভেঙে দেয় অনামিকা। তন্বীর এখনো আঠারো হয়নি, কাজী সাহেবও বিয়ে না পড়িয়ে চলে যান। অভ্রের মা জোর করে বিয়ে দিতে চাইলে এবার অভ্রই বেঁকে বসে। সে উপমাকেই বিয়ে করবে। অভ্র দরকার পড়লে নিজে উপার্জন করে উপমাকে ভালো রাখবে। আফরিন আরা পরবর্তীতে আর কিছু বলেননি। ছেলের পছন্দ মেনে নিয়ে চলে গেছেন। এখন রাহেলা সালিশ বসিয়েছেন অনামিকাকে নিয়ে। অনামিকা ইচ্ছে করে তন্বীর বিয়ে ভেঙেছে এটাই তার অভিযোগ।

-‘আচ্ছা ছোটো, তোর আক্কেল কবে হবে? তন্বীর এখনো আঠারো হয়েছে?’

-‘অনামিকাকেও এই বয়সেই নিজের ছেলের জন্য এনেছিল। ও না হয় ছ’মাসের বড় ছিল। মূল কথা হলো আমার মেয়ের বড়লোক ঘরে বিয়ে হচ্ছিল এটা মানতে পারোনি তোমরা।’

-‘তুই এমন ভাবিস আমাদের? ছিঃ! আর অনামিকাকে আমরা এইটুকু বয়সে এনেছি? তোর মেয়ে সবে ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে। অনামিকাকে আমরা এনেছিলাম আরো পরে। তাছাড়া অনামিকা তন্বীর চেয়ে কমসেকম দু’বছরের বড় তা জানিস? পড়াশোনা দেখেই বয়স আন্দাজ করে ফেললি?’

-‘তোমাদের অহেতুক কথা আমি শুনতে চাচ্ছি না। তোমার বৌমাকে আমার মেয়ের জীবনে নাক গলাতে কেউ বলেছে? কেন গলালো সে? তাও পুলিশ ডেকে? আমার মান ইজ্জত কোথায় থাকলো বলতে পারো?’

-‘তুই যেটা করছিলি সেটা আইনের চোখে অপরাধ। তাও তো অনু আসল পুলিশ আনেনি।’

রাহেলা বানু অবাক চোখে তাকালেন। ‘আসল পুলিশ আনেনি’ কথাটার মানে তিনি বুঝতে পারছেন না।

-‘আসল পুলিশ আনেনি মানে?’

-‘মানেটা আমি বলছি ফুফু। পুলিশ নকল ছিল।’

-‘তুমি এই নাটকটা কেন করলে অনামিকা?’

-‘তন্বী এই বিয়ে করতে চায় না।’

-‘সেটা ওর দুদিনের চাওয়া। কার জন্য বিয়ে ভাঙছে? ঐ নাদিম? ঐ ফকিন্নি কয় টাকা খাওয়াবে ওরে? দুদিন পর অভাব আসলে তো ঠিকই আমার ঘাড়ে এসে বসে থাকবে।’

-‘ফুফু, ও নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। ও কারো উপর কেন নির্ভরশীল হবে।’

-‘এই মেয়ে, তোমাকে এত কথা বলতে কে বলছে? তুমি আমার আর আমার মেয়ের ব্যাপারে নাক গলানোর কে?’

-‘ফুফু, তন্বী আর আপনি কি আমার পরিবারের কেউ নন?’

-‘পরিবার! হাহ! হাসালে। তোমার পরিবারে কী হচ্ছে তার ছিটেফোঁটাও তুমি জানো? এ কয়দিন ধরে কী চলছে কিচ্ছু জানো? পরিবার নিয়ে হায় রে মাতামাতি। নিজের ঘরের ঠিক নাই, আরেকজনের ঘরের সমস্যা মিটাইতে আসছে।’

অনামিকা বিব্রত হলো। নিজের ঘর ঠিক নাই! কী হয়েছে তার পরিবারের? সব তো ঠিকই আছে। অনামিকা বুঝে উঠতে পারছেনা কাকে প্রশ্ন করবে। সোহরাবকে প্রশ্ন করলে কি সে উত্তর দিবে?

-‘সোহরাব, ফুফু এসব কী বলছে? কী জানিনা আমি? কী হয়েছে বাড়িতে? কী লুকোচ্ছো তুমি?’

-‘অনামিকা, শান্ত হও। কিছু হয়নি বাড়িতে। ফুফু রাগের মাথাব্যথা বলেছে।’

-‘রাগের মাথায় মিথ্যে বলবে ফুফু? সোহরাব তুমি আমার থেকে কিছু লুকোচ্ছো। বলো কী হয়েছে? বলো…’

অনামিকা আর কিছু বলতে পারলো না, হঠাৎই সোহরাবের গায়ের উপর নেতিয়ে পড়লো। সোহরাব শক্ত করে ধরলো অনামিকাকে। আচমকা কী হলো মেয়েটার? সোহরাব অনামিকাকে কোলে করে বিছানায় শুয়ে দিল। তন্বীদের বাড়ি থেকে একটু দূরেই এক ডাক্তারের বাসা। তন্বী তাকে ডাক দিল। বাড়ির পরিস্থিতি ক্ষণিকের মধ্যেই একেবারে বদলে গেল। সোহরাব অনামিকার চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে পড়লো। সাজিয়া শেখ তো ভেঙেই পড়লেন। এক মেয়ের অসুস্থতা সামলাতে পারছেন না সেখানে আরেক মেয়ে শয্যাশায়ী। পৃথিবীটা তিতকুটে লাগছে তার। ডাক্তার আসতে যত সময় লাগছে সোহরাবের হৃদস্পন্দন তত কমে আসছে। অজানা আশঙ্কা তাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলছে। ডাক্তার এসে অনামিকার চেক-আপ করলেন। এখনো জ্ঞান ফেরেনি তার। ডাক্তারের মুখে চিন্তার ভাঁজ দেখা দিল। বাইরে এসে মলিন মুখে তিনি বললেন, ‘একটা দুঃসংবাদ আছে।’

চলবে…