বিবর্ণ বসন্ত পর্ব-২০

0
172

#বিবর্ণ_বসন্ত
২০তম_পর্ব
~মিহি

সুমির মন আজ বেশ ভালো। ইমাদ তার বড় বোনের সাথে দেখা করাতে নিয়ে এসেছে তাকে। সুমির মুখের ঔজ্জ্বল্য ডাক্তার আফ্রিনের নজর এড়ালো না। সোহরাবের সাথে কথা বলে সুমির সাথে দেখা করার এ নাটকের রচয়িতা সে নিজেই। ডাক্তার হিসেবে দেখা করলে সুমি অধৈর্য হতো, ঠিকঠাক উত্তর দিত না কিন্তু এখন সুমি তার মনের কথাই বলবে। ইমাদ ওয়াশরুমের বাহানায় সুমি ও আফ্রিনকে কথা বলার সুযোগ দিয়ে নিজে সরে যায়। আফ্রিন ভেবেই রেখেছে কিভাবে কথা শুরু করতে হবে।

-‘সুমি, ইমাদের কিন্তু খুব রাগ তা জানো?’

-‘হুম, বকেছিল আমাকে।’

-‘ইমাদের রাগের জন্যই বুঝি তাকে পছন্দ করে ফেলেছো?’

-‘না না! বরং ওনার রাগ আমার প্রচণ্ড ভয় লাগে।’

-‘রাগের জন্য ফ্যামিলিতে সবাই ওকে কিছুটা অপছন্দ করে। রাগ জিনিসটাই এমন। ও কিন্তু বোঝে না ও কতটা রাগী! আমাদের কাছে আমাদের চরম মাত্রার রাগও জায়েজ মনে হয়।’

সুমি থমকে গেল। রাগ শব্দটা তার মস্তিষ্কে বাড়ি খাচ্ছে। অযথা রাগ দেখানো স্বভাবটা তো ইদানিং সুমির মধ্যেও দেখা যায়। ইমাদের সামান্য বকাতে সুমি বড়সড় কাণ্ড বাঁধিয়ে ফেলেছে অথচ সুমি প্রতিনিয়ত পরিবারের সবার সাথে রাগ দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। এটা কি ঠিক? সুমি অনুতপ্ত হলো। অনুশোচনার অনলে নিজেকে দগধ হতে দেখল বন্ধ চোখে। অবশ্য এ অনুশোচনা হওয়ারই ছিল। সুমির মধ্যকার ভালো সত্তার অস্তিত্ব তখনো তো মুছে যায়নি। হয়তোবা খারাপ সত্তাটা মাথাচাড়া দিয়ে ঠেছিল কিন্তু ভালোর অস্তিত্ব কতদিনই বা দমিয়ে রাখা যায়?

-‘সুমি, তুমি ঠিক আছো?’

-‘জ্বী আপু, আমার আসলে একটা দরকারি কাজ মনে পড়ে গেছে। আমি আসি?’

-‘ইমাদ আসুক, ড্রপ করে দিবে তোমাকে।’

সুমি কিছুক্ষণ ভাবলো। ইমাদ আসা অবধি অপেক্ষা করা যায় দেখে সুমি বসলো। আফ্রিন কথা এগোলো।

-‘ইমাদের কথা তো অনেক বললাম, এবার তোমার কথা বলো সুমি।’

-‘আমার কথা কী বলবো আপু? আমি কেমন তা তো উনি জানেন।’

-‘বাহ রে! তুমি নিজের সম্পর্কে নিজে বলবে না?’

সুমি দ্বিধায় পড়লো। নিজের সম্পর্কে বলা? এ অভিজ্ঞতা তো তার নেই। কী বলবে নিজের সম্পর্কে? আগে যেমন ছিল, তেমন তো আর সে নেই। এ সুমির মধ্যে তো সবটাই খুঁত। সুমির এ পরিবর্তন সে নিজে অনুধাবন করতে পারছে এখন।

-‘সুমি? কোথায় হারিয়ে গেলে?’

-‘কোথাও না আপু।’

-‘নিজের সম্পর্কে বলতে পারাটা সবচেয়ে কঠিন কাজ সুমি। নিজের ভালো খারাপ কিংবা তুচ্ছ কোন বিষয়ও বলে ওঠা অনেকটা অসাধ্য সাধনের মতো। ইমাদ এসেছে, আজ যাও। কিছু খাওয়া হলো না তো। আরেকদিন কিন্তু দেখা করবে আমার সাথে।’

-‘আচ্ছা আপু।’

সুমি আফ্রিনের থেকে বিদায় নিয়ে ইমাদের সাথে বেরিয়ে এলো। সুমির মাথায় আপাতত একটা চিন্তা বেশ কিছুক্ষণ ধরে ঘুরঘুর করছে। সুমি নিশ্চিত হতে পারছে না আসলে কী করবে।

_________________________

সাজিয়া অনামিকার চুলে তেল দিয়ে দিচ্ছেন। অনামিকা ফোনে মায়ের সাথে কথা বলছে। অন্তরা বেগম তার খোঁজ খবর নিচ্ছেন। কথার মাঝে হঠাৎ কলিং বেল বাজলো। সাজিয়া অনামিকাকে বসিয়ে দরজা খুলতে গেলেন। দরজা খুলতেই সুমি দু’হাতে দুটো বয়াম এনে অনামিকার কোলে রাখলো। সুমির এমন আচমকা আগমনে অনামিকা খানিকটা অবাক হলো। গতকাল রাতে অযথা চেঁচামেচি করে সুমি সেই যে দরজা লাগিয়েছিল, তারপর থেকে তার সাথে অনামিকার কথা হয়নি। এখন হঠাৎ আচারের বয়াম সমেত সুমির আগমন অনামিকার কাছে খানিকটা বিস্ময়করই ঠেকলো। সুমি পরম স্নেহে অনামিকার হাতজোড়া ধরে নত মুখে ক্ষমা চাইলো। অনামিকা মুচকি হাসলো। সুমির প্রতি তার ক্রোধ কস্মিনকালেও ছিল না। সুমিকে সে সর্বদাই নিজের বোনের মতো দেখেছে। ছোট বোন অপরাধ করে স্বীকার করলে তাকে ক্ষমা করে দেওয়াটা অনামিকার কাছে অতি আনন্দের।

-‘ভাবী, তোমার জন্য আম আর বরই এর আচার এনেছি। তেঁতুলেরটা কাল আনবো। আমি কিন্তু আমার ভাতিজীর নাম ঠিক করবো। এ দায়িত্ব আমার।’

-‘ভাতিজী? তুমি কী করে বুঝলে মেয়েই হবে?’

-‘বুঝি বুঝি। দেখো আমার মতো একটা কিউট কিউট মেয়ে হবে।’

-‘আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ কবুল করুক।’

সুমি অনেকদিন পর প্রাণ খুলে হাসছে। আফ্রিনের সামান্য কথাটুকুই যেন তাকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে। সুমি অনামিকার সাথে গল্পে মেতে উঠেছে। সাজিয়া দূরে দাঁড়িয়ে সবটাই দেখছেন। অনামিকার আগমন যেন সব নেতিবাচকতা ছাপিয়ে তোলে। মেয়েটা সাক্ষাৎ গুণবতী। সাজিয়া সুমি আর অনামিকার গল্পগুজব লক্ষ্য করলেন অনেকটা সময় নিয়ে। হাসি বোধহয় সংক্রামক, দেখতে দেখতে কখন নিজেও ওদের দলে যোগ দিলেন বুঝতেই পারেননি সাজিয়া। তিনজনের হাসির কলরবে মুখরিত উঠোনে ঝরা পাতাগুলোও যেন আজ প্রাণ পেল। অবাক আকাশমণ্ডলী চেয়ে দেখলো নারীতে-নারীতে আন্তরিকতা, কী নিদারুণ প্রেমপ্রীতি।

___________________

মাত্র কলেজ থেকে বেরিয়েছে তন্বী। সুমি না থাকায় একাই যাতায়াত করতে হয়। তাছাড়া সুমির বাড়ি থেকে তার বাড়িটাও উল্টো পথে। বাধ্য হয়ে একাকী নির্জন রাস্তাটাতেই তন্বীর সাহস জমিয়ে পথ চলতে হয়। আজ হাঁটতে হাঁটতে আচমকা এক মধ্যবয়সী মহিলার দেখা পেল তন্বী। মহিলাটি তন্বীকে বেশ ভালোমতো দেখলেন। নাম পরিচয় জিজ্ঞাসা করাতে তন্বী কিছুটা বিরক্ত হলো। নাম ব্যতীত আর কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিল না সে। খানিকটা রাগ দেখিয়েই এগোলো। মহিলাটি তন্বীর চলার দিকে তাকিয়ে রইলো। অতঃপর মুখে পান পুরে চিরায়ত হাসি হাসলো। তন্বী তখনো জানতো না আরেক নতুন আপদ তার ঘাড়ে জুটতে চলেছে।

কলেজ থেকে ফিরে হাতমুখ ধুতে ধুতেই সেই মধ্যবয়সী মহিলা এসেছেন তন্বীর বাড়িতে। মহিলাকে দেখামাত্র তন্বী ভূত দেখার মতো চমকালো। রাহেলা বানু তন্বীকে ঘরে যেতে বললেন। তন্বীর কৌতূহলী মন ঘরে যেতে না চাইলেও রাহেলা বানুর চোখ রাঙানি এড়ানোর উপায় নেই। তন্বীর মাঝে মাঝে নিজেকে আবর্জনা মনে হয়। ছোট থেকেই দাদুবাড়ির আদর সে পায়নি, বাবাও অকালে ছেড়ে চলে গেছেন, মায়ের সাথে সম্পর্কটা কখনোই স্বাভাবিক ছিল না। একজন শিশু মায়ের মধ্যে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠতম বন্ধু দেখতে পায় অথচ ছোট বয়স থেকেই তন্বী মায়ের মধ্যে দেখেছিল এক আতঙ্ক যে আতঙ্ক তাকে আজীবন দাবিয়ে রেখেছে।

বিকেলের দিকে বৃষ্টি এলো। তন্বীর ইচ্ছে হলো একটু ভিজতে, অনেকদিন মন খুলে কাঁদতে পারেনি সে। বৃষ্টিতে ভিজলে চোখের পানিগুলোকে মুক্ত করতে পারবে। এখানেও বাধা, নিষেধাজ্ঞা। রাহেলা বানু নিষেধ করলেন বৃষ্টিতে ভিজতে। জানালার ফাঁক গলে হাতটা বাড়িয়ে যেটুকু বৃষ্টির ফোঁটা স্পর্শ করা যায় তাতে আঙুলটুকুও ঠিকমতো ভেজে না, এটুকু জলে প্রাণের ক্লেশ মেটানো কি সস্তা? বাধা ভেঙে গুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে হলো তন্বীর। একটু বৃষ্টিতেই তো ভিজতে চেয়েছে সে। এটুকু নিশ্চয়ই পাপ নয়? রাহেলা বানুর কথা না শুনে ঘণ্টা দুয়েক লুকিয়ে বৃষ্টিতে ভিজলো তন্বী। সন্ধ্যের আগে আগে ঘরে ঢুকে গা মুছে নিল। মনটা শান্ত হলো তার। অনেকদিনের জমানো যন্ত্রণাগুলো মুক্ত করতে পারার তৃপ্তি দিব্যি মনে মনে আনন্দ জোগাচ্ছে। এ তৃপ্তির কাছে বাকি সবকিছু নেহাতই তুচ্ছ।

রাত দশটা নাগাদ তন্বীর ভয়ানক জ্বর এলো। ১০২° ছুঁই ছুঁই। রাহেলা বানু ওষুধ খাওয়ালেন, জলপট্টি দিলেন। বৃষ্টিতে ভেজা নিয়ে তন্বীকে বকার এক লম্বা স্ক্রিপ্ট বানালেন। তন্বীর সেদিকে মন নেই। এ বৃষ্টি তার মনকে তৃপ্ত করেছে। মনের তৃপ্তির কাছে সামান্য জ্বর তুচ্ছ। রাহেলা বানুর বকাঝকাও তন্বীর কাছে তেতো লাগছে না, জ্বরের ওষুধটাও মিঠা লাগছে। মন তৃপ্ত থাকলে যে সবকিছু মধুর লাগে, তা আরেকবার নতুন করে বুঝলো তন্বী আর এ বোধটাই তাকে শক্তি দিল মনের কথা শুনে বাঁচার। ভীতু মন নিয়ে অনেক তো হলো পথচলা, এবার নাহয় মনের কথা শুনেই যুদ্ধে নামুক সে।

চলবে…