বিবর্ণ বৈশাখে রংধনু পর্ব-১০+১১

0
200

#বিবর্ণ_বৈশাখে_রংধনু
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১০
দেখতে দেখতে আরো কয়েকটা দিন পেরিয়ে গেল। রুহানীর কলেজে ভর্তি কার্যক্রমও শেষ হয়েছে। এইতো রবিবার থেকেই ক্লাস শুরু করবে। আজ শুক্রবার। রহমত শেখ গতকালকেই ঢাকা গিয়েছেন। আরও আগে যাওয়ার কথা থাকলেও রিহার শ্বশুরবাড়িতে একটা ছোটো রিসেপশন পার্টির অ্যারেঞ্জমেন্ট ছিল এবং যার পরেরদিনই রিহা তার স্বামীর সাথে লন্ডনে চলে যাবে। পার্টিটা ঝামেলাহীন ভাবেই কে*টে গেছে।

রুহানী ড্রাইভারকে বইয়ের লিস্ট দেখে বই কিনতে দিয়ে এখন বাগানের পেছন দিকটায় হাঁটতে গিয়েছে। সকাল এগারোটা বাজে। কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে না। তপ্ত গরমে নাভিশ্বাস উঠার দশা। রুহানী যেখানে গিয়েছে সেখানে গাছের ছায়ায় কিছুটা শীতলতা। হঠাৎ দেয়াল টপকিয়ে একটা ঢি*ল রুহানীর পাশে এসে পরল। আচানক এমনটা হওয়ায় রুহানী বেশ চমকে গিয়েছে। ঢি*লটা কাগজে মোড়ানো। রুহানী সেটা হাতে তুলে নিয়ে খুলে দেখল। কাগজটাতে লেখা,

“সাবধান!”

লেখটা দেখে কিয়ৎ মুহূর্ত রুহানী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইল। কে তাকে সাবধান করতে চাইছে আর কী-সের জন্যই বা সাবধান করতে চাইছে তা তার বোধগম্য হচ্ছে না। ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়ার দরুণ পরে থাকা শুকনো সুঁ*চালো ডালের খোঁ*চায় পায়ের একটু চামড়া একটু ছিঁ*লে গেছে। জ্বা*লাপো*ড়ার উদ্রেক হলে জায়গাতেই বসে হাতের কাছে পাওয়া দূর্বাঘাস কঁচলে নিয়ে ক্ষত স্থানে লাগায়। বেশ সামান্যই ছিঁ*লেছে। কিছুক্ষণ যত্রই বসে থেকে উঠে বাড়ির ভেতরে চলে যায়।

_______

শুক্রবার সন্ধ্যায় বাড়িতে আসে আরহান। এই কয়েকদিন সিলেটেই আসতে পারেনি। আজ এসেই দাদীর সাথে কিছুক্ষণ খু*নশুঁটি করে নিজের ঘরে চলে গেছে। লন্ডন থেকে ঢাকার ফ্লাইটে ফিরে আবার অন্য এক দেশের ফ্লাইটেও গিয়েছিল। লম্বা ঘুম ছাড়া ক্লান্তি কমবে না। ঘুমানোর আগে দাদী আরেকবার রুমে এসে বলে,

“না খেয়ে ঘুমাবি না। প্রতিবার এমন করিস। আমাকে এসে মুখে তুলে খাইয়ে দিতে হয়! এখনও কি বাচ্চা তুই?”

আরহান দাদীকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী কণ্ঠে বলে,
“তুমি খাইয়ে দিলে আমার খিদে না পেলেও খেতে ইচ্ছে করে। মনে হয় খাবারের স্বাদটাই বেড়ে গেছে।”

নাতির কথা শুনে আয়েশা খানম হেসে নাতির হাতে আলতো চ*ড় দিয়ে বলেন,
“যাহ্‌ পা*গল! কয়দিন পর ঘরে বউ এলে এই অভ্যাস বদলাতে হবে তো। বউয়ের সামনে দাদীর হাতে খাবি নাকি!”

“বউয়ের সামনে খাব কী! বউকে সাথে নিয়ে খাব। তখন তোমার ডিউটি ডাবল হবে। তারপর বাচ্চা হলে বাচ্চাকেও সাথে নিয়ে খাব। বুঝলে?”

আয়েশা খানম হেসে আরহানের হাত ছাড়িয়ে ওকে সামনে এনে বলেন,
“হ্যাঁ বুঝেছি। এখন নিচে আয়। খেয়ে ঘুমা।”

“আচ্ছা তুমি যাও আমি আসছি।”

আয়েশা খানম চলে গেলে হাত-মুখ ধুঁয়ে নিচে আসে।

________

পরেরদিন সকালে নাস্তার পর রুহানী তার চাচিকে ও একজন সার্ভেন্ট নিয়ে হাঁটতে বের হয়েছে। জাহানারা শেখ রুহানীকে বলেন,
“জানিস? আপুরও চা বাগান অনেক পছন্দের ছিল। তোর জন্মের আগে যখন আপু নিঃসঙ্গ অনুভব করত তখন ভাইয়া আপুকে নিয়ে এখানে চলে আসতেন। এই বাংলোটাও ভাইয়া আপুর জন্য বানিয়েছিলেন। এমনকি আপুর প্রেগনেন্সির সময় আমরা সবাই এই বাংলোতেই ছিলাম।”

রুহানী তার চাচির কথা শুনতে শুনতে মুচকি হাসে। পথে চা শ্রমিকদের সাথে হাসি বিনিময় করছে। তখনি একটু দূরে হট্টগোলের শব্দ রুহানী সেদিকে এগিয়ে যেতে ধরলে জাহানারা শেখ ডেকে ওঠেন,
“কোথায় যাচ্ছিস?”

রুহানী ইশারায় দেখালে তিনিও সঙ্গে চলেন। সেখানে গিয়ে দেখেন এক বৃদ্ধ চা শ্রমিক মাটিতে বসে আছেন। এইটুকু সময়ে সে যতোটা কুঁড়ি সংগ্রহ করেছিল সব ছড়িয়ে গেছে। প্রায় দুই ঘণ্টা যাবত কষ্ট করে সে বেশ অনেকটাই পাতা সংগ্রহ করেছিলেন। রুহানী বৃদ্ধ লোকটাকে কাঁদতে দেখে পাশে গিয়ে বসেন। ইশারায় বৃদ্ধ লোকটিকে কাঁদতে মানা করে। বৃদ্ধ লোকটি দুঃখ করে বলে(সিলেটি ভাষাকে বুঝিয়ে লিখা),

“মা রে, আমার এতোক্ষণের সব কষ্ট শেষ হয়ে গেল। এহন পাতা সংগ্রহ শুরু করলেও এক ঝুড়ির টাকা কম হবে।”

বৃদ্ধ লোকটির ভাষা রুহানীর বোধগম্য হতে খানিক সময় লাগে। কিছুটা বুঝলেও বাকিটা ভেবে নিয়েছে। রুহানী বৃদ্ধ লোকটিতে থামতে বলে মাটি থেকে যেটুকু পেরেছে পাতা উঠাতে থাকে। জাহানারা শেখ অন্য শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে বলে,
“আপনারা যার যার কাজে যান।”

সবাই চলে গেলে রুহানী সার্ভেন্টকেও ইশারায় ডেকে পাতা তুলতে বলে। সার্ভেন্টটা কাজে হাত লাগানোর পর রুহানী হঠাৎ আরও এক জোড়া হাত লক্ষ্য করে সেই হাতের মালিকের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে যায়। আরহান! আরহান রুহানীকে মৃদু হাসি উপহার দিয়ে পাতা তুলতে থাকে। তারপর বৃদ্ধ লোকটার কাছে গিয়ে বলে,

“দাদু, আজকে আপনি রেস্ট করেন। আমি আজ আপনার জন্য পাতা তুলে দিব। আজ আমার কোনো কাজ নাই।”

বৃদ্ধ লোকটি (সিলেটি ভাষায়) বলল,
“না বাবা, তুমি কেন কষ্ট করবা। আমিই যতোটুকু পারব করে নিব।”

“উহুঁ। আপনি বসেন। আমি হেল্প করব। আপনার শরীর ক্লান্ত বলেই পরে গেছেন। একটু রেস্ট করেন।”

রুহানী, আরহান ও বৃদ্ধ লোকটার কথা শুনছে। আরহানের কথা বুঝতে পারছে বলেই বৃদ্ধ লোকটি কী বলেছে তা ধরে নিতে পেরেছে। আরহান কাঁধে একটা ঝুড়ি উঠিয়ে পাতা সংগ্রহ করতে যেতে নিলে রুহানী তার হাত ধরে বসে।
আরহান তাতে অবাক হয় না, বরং চোখে হেসে বলে,
“কী? হঠাৎ হাত ধরলেন যে?”

রুহানী ইশারায় বললে আরহান বলে,
“স্বাভাবিক ভাবে বলুন। ইউ নো, আমি লিপরিড করতে পারি।”

রুহানী এবার ঠোঁট নাড়িয়ে নিঃশব্দে বলে,
“আমিও হেল্প করতে চাই।”

“শিউর। তাহলে আরও ভালো হয়।”

রুহানী খুশি হয়ে পাতা সংগ্রহ করা শুরু করে। জাহানারা শেখ তাতে বেশ খুশি হোন। তিনি রুহানীকে বলেন,
“তুই তবে থাক। আমি শেফালীকে রেখে গেলাম। দুপুরের আগেই কিন্তু চলে আসবি।”

রুহানী মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়। তারপর নিজের কাজে মনোযোগ দেয়।

________

ঢাকার অফিসে রহমত শেখ ও রিফাত কেবিনে বসে কথা বলছে। রহমত শেখ বলেন,
“তুই পারবি আমার কম্পানিটা সামলাতে। এই কম্পানিতে আমাদের তিন ভাই-বোনের অংশীদার আছে। আর তুই কতো নিঁখুত ভাবে কাজ করিস। জানি বাবা তোর জন্য সময়টা খুব চাপের। কিন্তু রুহানীর জন্য কী করব বল? ঢাকাতে ওর মন না টেকার কারণটাও তুই জানিস।”

“না মামা, আমি পারব। তুমি সিলেটের ব্রাঞ্চটার দায়িত্ব নাও। ওখানে প্রায়ই চু*রির ঘটনা ঘটে। ওটাকে ঠিক করতে পারলে আমাদের কম্পানি আরও শক্তিশালী হবে। আর রুহানী এখানে কম সহ্য করেনি। প্রকৃতির কাছে থাকলে ওরও মন ভালো থাকবে। বড়োমামীর মতো রুহানীও প্রকৃতিপ্রেমী হয়েছে।”

তৎক্ষনাৎ কেবিনের দরজা ঠা*স করে খুলে যায়। প্রবেশ করেন রিফাতের বাবা নজরুল আহমেদ। তিনি রুষ্ট স্বরে বলেন,
“আমার সহজ সরল ছেলেটাকে দিয়ে তো ভালোই কাজ করিয়ে নিচ্ছ। মুখেই বলো কম্পানিতে অংশীদার কিন্তু কাজেকর্মে কর্মচারীর মতো।”

“থামো বাবা। কী-সব বলছ!”

নজরুল শেখের কথা শুনে রিফাত তাকে থামাতে গেলে রহমত শেখ বাধা দেন। তিনি বলেন,
“উনি তো ঠিকই বলেছে রিফাত! তোমার নামে তো আমি কিছুই দেইনি। চারটা ব্রাঞ্চের একটা রিহা দেখে আর বাকি তিনটা আমার কাছে। তোমার কাছে তো কিছুই নেই। আজ থেকে থাকবে। ঢাকার ব্রাঞ্চের সিইউ এখন থেকে তুমি। ওটা নিয়ে কালকে আ*ইনী কাজ হবে।”

এই বলে রহমত শেখ নিজের কেবিনে চলে যান। রিফাত তাকে কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু তিনি দাঁড়ালেন না। রহমত শেখ চলে যেতেই নজরুল আহমেদ বাঁকা হাসেন। রিফাত দ্রুত এসে উত্তেজিত হয়ে তার বাবাকে বলে,
“কেন করছ এসব? তুমি কি কিছু জোড়তে জানো না? তোমাকে বলতে বলতে আমি টায়ার্ড। এতোবার নিষেধ করেছিলাম, রিহাকে না জানাতে। তাও তুমি তাই করলে। কেন?”

নজরুল আহমেদ ছেলের কাঁধে হাত রেখে বলেন,
“তোমার জন্য মাই সন। তুমি তো নিজের ভালো বুঝো না। তাই বাবা হিসেবে আমাকেই বুঝতে হয়। কয়েকদিন পর তুমিও বাবা হবে, তখন তুমিও বুঝবে।”

এই বলে নজরুল আহমেদ কেবিন থেকে বেরিয়ে যান। রিফাত কপালে হাত ঘষতে ঘষতে চেয়ারে বসে।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

#বিবর্ণ_বৈশাখে_রংধনু
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১১(অতীত খোলসা)
প্রথমদিন ক্লাসে এসে রুহানী বেশ অস্বস্তিতে পরল। শ্রেণী শিক্ষক রুহানীকে সবার সামনে নতুন ছাত্রী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর অনেকেই ওর সাথে কথা বলতে আসছে কিন্তু ও হাসি বিনিময় ছাড়া কিছুই করতে পারছে না। শ্রেণী শিক্ষক বলতে ভুলে গিয়েছেন যে রুহানী কথা বলতে পারে না। কেউ কেউ তো রুহানীর পেছনে ও পাশের বেঞ্চে বসেও ওকে “এটি*টিউটের দোকান” বলে অ্যাখ্যা দিয়ে ফেলেছে! রুহানী নিরবে সবটা শুনেই গেল। এর আগেও নিজেকে নিয়ে অনেক কথা শুনেছে। তাই এসব নিয়ে মনে বেশি কষ্ট নিল না।
ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলে জাহানারা শেখ ডাকেন,

“এদিকে আয়। খাবার খেয়ে নে। কতো বেলা হয়ে গেছে। আমার ডায়াবেটিসের জন্য খেয়ে নিয়েছিলাম। শরীর খারাপ করছিল।”

রুহানী মুচকি হেসে চেয়ার টেনে বসে। জাহানারা শেখ খাবার বাড়তে বাড়তে বলেন,
“কাল তো তোর ভার্সিটি বন্ধ। তোর চাচাও সকালে রওনা হবে। আমরা দুপুরে মেয়র সাহেবের বাসায় দাওয়াতে যাব।”

রুহানী খেতে শুরু করে। জাহানারা শেখ উৎসুক কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেন,
“প্রথমদিন কেমন লাগল?”

রুহানী খেতে খেতেই চাচির দিকে না তাকিয়ে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়াল। তার চাচি আবার প্রশ্ন করেন,
“কোনো ফ্রেন্ড হয়েছে?”

এবার রুহানী না বুঝালে, জাহানারা শেখ বলেন,
“হয়ে যাবে। প্রথমদিন তো। তুই খেয়ে পড়তে যা। পড়াতে অনেকটা পিছিয়ে আছিস তো। তোর চাচাকে বলব, বাসায় একটা টিউশন রাখতে। আগের পড়াগুলোও বুঝে নিবি।”

রুহানী আবারও ঘাড় নাড়ায়। তারপর খাওয়া-দাওয়া শেষে রুমে চলে আসে। বই নিয়ে টেরেসে বসে। বই প্রথম থেকে নিজে যতোটুকু বুঝে পড়তে শুরু করে। আস্তে আস্তে সূর্যিমামা পশ্চিমাকাশে ঝুঁকতে শুরু করেছে। আসরের আজানও পড়ল। রুহানী নামাজটা পড়ে চা বানাতে গেল। চা বানিয়ে চাচির সাথে বাগানে গিয়ে বসে।

________

রহমত শেখ আজকে রিফাতকে কম্পানির ঢাকার ব্রাঞ্চের সিইউ ঘোষনা করে দিয়েছেন। এখন থেকে সে সিলেটের ব্রাঞ্চটাই দেখবেন তবে সব ব্রাঞ্চের খবরাখবর তার কাছে আসবে। সব কাজ শেষ করে নিজের কেবিনে বসা মাত্রই তার ফোন বেজে ওঠে। ফোনের স্ক্রিনে রিহা নামটা দেখে রহমত শেখ কল রিসিভ করে জিজ্ঞেসা করে,

“কেমন আছো?”

রিহার জবাব,
“ভালো। তুমিও নিশ্চয়ই ভালোই আছো। ভাতিজির জন্য ঢাকা ব্রাঞ্চের সব দায়িত্ব রিফাত ভাইকে বুঝিয়ে দিলে। আমার জন্য কখনো করেছ এমন?”

মেয়ের অভিযোগে রহমত শেখ তপ্তশ্বাস ফেলেন। ক্লান্ত কণ্ঠে বলেন,
“তোমার সব জেদ, সব আহ্লাদ আমি পূরণ করেছি। শুধু মাত্র..”

রহমত শেখকে তার কথা শেষ করতে না দিয়েই রিহা বলে ওঠে,
“শুধুমাত্র তোমার ভাতিজির ব্যাপারে নো কম্প্রোমাইজ! কিন্তু নিজের মেয়ের ক্ষেত্রে ঠিকই কম্প্রোমাইজ করে চলেছ।”

রহমত শেখ নিরবে শুনে গেলেন। জবাব কী আর দিবেন! মেয়ের ভুল গুলোকে ঠিক করতে শা*সন করতে তিনি মেয়ের চোখেই খারাপ হয়ে গেছেন। নিরব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“এসব নিয়ে আর কিছু বলবে।”

“না। এসব নিয়ে আর কিছু বলার নেই। যা বলতে কল করেছি, জিহানের বাবা বলছেন উনি আমাদের ইটালির ব্রাঞ্চের সাথে মিলে কাজ করতে চান। আমি তাতে রাজি। উনাদের কম্পানিরও একটা ব্রাঞ্চ ইটালিতে খুলবেন।”

“করো। আমার প্রবলেম নেই।”

“হুম। রাখছি।”

রিহা কল ডিসকানেক্ট করলে রহমত শেখ চেয়ারে গা এলিয়ে দেন। বেশ ক্লান্ত লাগছে তার। আগামীকাল সকালের ফ্লাইটে সিলেটে ব্যাক করবেন।
—-
নজরুল আহমেদ আজ বেশ খোশ মেজাজে আছেন। তা দেখে রিক্তা শেখ রুগ্ন স্বরে শুধালেন,
“আজ এতো খুশি যে?”

নজরুল আহমেদ বাঁকা হেসে বলে,
“আমার উদ্দেশ্যের দ্বিতীয় ধাপ কম্পিলিট। এখন শেষ ধাপটা হলেই সব আমার!”

“মানে?”
রিক্তা শেখের কৌতুহলী প্রশ্নের জবাবে নজরুল আহমেদের গা ছাড়া রুষ্ট জবাব,
“তুমি এসব জেনে কী করবে? তোমার ছেলের সাফল্যে খুশি হও। তোমার ভাই রিফাতকে ঢাকা ব্রাঞ্চের সিইউ করে দিয়েছে।”

খবরটা শুনেই রিক্তা শেখ হতবাক হয়ে গেলেন। তিনি বিস্মিত কন্ঠে বললেন,
“কবে? কখন? রিফাত তো আমাকে এই ব্যাপারে কিছু বলল না!”

তখন রিফাত তার মায়ের ঘরে এসে মায়ের প্রশ্নের জবাবে বলে,
“আমি চেয়েছিলাম মামাকে আটকাতে। কয়েকবার বুঝিয়েছি। কিন্তু মামা আমার কথা শুনল না। তাই তোমাকে বলা হয়নি, তাছাড়া কাল তোমার প্রেসার ডাউন ছিল।”

“তোর মামার হঠাৎ করে কী হলো? ও কি অসুস্থ? রুহানীর বিয়েটা হয়নি তাই কি খুব প্রেশারে আছে?”

“না মা। বাবার কথায়!”

রিক্তা শেখ এবার স্বামীর দিকে চাইলেন। এবার তিনি আসল বিষয়টা বুঝতে পেরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,
“আমার ভাইয়ের কম্পানির প্রতি তোমার লা*লসা গেল না!”

নজরুল আহমেদ, তার স্ত্রীর কথা শুনে বেশ অপমান বোধ করলেন। তিনি তেড়ে এসে ক্ষীপ্র স্বরে বলতে লাগলেন,
“তোমার ভাইয়ের কোম্পানি মানে কী? তোমার বাবা তোমাদের তিন ভাই-বোনকে কোম্পানি লিখে দিয়েছেন। তুমি যদি তোমার অধিকার বুঝে নিতে না চাও তাহলে আমিও কি বসে থাকবো নাকি? সব তোমার ওই বড়ো ভাইয়ের বো*বা মেয়ের জন্য সে*ক্রিফা*ইস করে দিতে চাইছ? তোমার ছোটো ভাইও তো নিজের মেয়ের কথা ভুলে ভাইয়ের মেয়ের প্রতি দরদ দেখায়। আমার ওসব আলগা দরদ নেই বুঝলে!”

রিক্তা শেখ বা রিফাত কেউই নজরুল আহমেদের কথার বিপরীতে কোন প্রত্যুত্তর করল না। নজরুল আহমেদ রুম রেগে থেকে বেরিয়ে গেলে, রিফাত তার মায়ের পাশে বসে।

“বাবার কথা বাদ দাও। আমি তো ঠিক আছি। কোনো কিছু মামার অনুমতি ছাড়া আমি করব না। মামা চাইছেন সিলেট ব্রাঞ্চটাকে বাড়াতে। ওটাতেই তিনি এখন ফোকাস করুক।”

রিক্তা শেখ ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
“তুই আছিস বলেই আমার ভাইটা এতোদিক সামলাতে পারছে।”

রিফাত মায়ের হাতে চুমু দিয়ে মায়ের ঔষুধের সময় হলে ঔষুধ খাইয়ে দিল।

_______

ভোরে নামাজ পড়ে চা বানিয়ে কিছুক্ষণ পাঠ্যবই পড়ে রুহানী বেরিয়েছে হাঁটতে। আজ চা বাগান ফাঁকা থাকবে। শ্রমিক দিবস যে তাই। একাকি চা বাগানে হাঁটতে হাঁটতে রুহানী নিজের ফোনে ছবি তুলছে। এদিকে যে কেউ তার দিকে নিশানা করে রেখেছে তা তার দৃষ্টির আড়ালে। ছবি তুলতে তুলতে হঠাৎ কারও ডাকে পেছনে ফিরলে দেখে আরহান আসছে। আরহান রুহানীকে কিছু দেখাতে ডাক দিল। রুহানী ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালে আরহান বলে,

“আরে মেয়ে! পরে তোমার এই ভ্রুঁ কুঁচকানো এসব দেখব। এখন এসে দেখে যাও এখানে একটা ছোট কিউট ও খরগোশের বাচ্চা আছে।”

খরগোশের বাচ্চার কথা শুনে রুহানী উৎসুক হয়ে যেতে নিলে আচমকা রুহানীর পাশ দিয়ে একটা গু*লি ক্রস করে সামনের গাছে বসে থাকা একটা পাখির গায়ে আ*ঘা*ত করল। তৎক্ষণাৎ কাণ্ডে রুহানী হতচকিত হয়ে মাটিতে চোখ-মুখ খিঁচে কানে হাত দিয়ে বসে পরেছে। আরহানও ভীষণ অবাক। তার সামনেই সদ্য মৃত পাখিটি পরে আছে। না! এই পাখি তো খায় না। শালিক পাখি এটা। আরহান গু*লির উৎস খুঁজতে সেদিকে ছুটে গেলে দেখতে পায় কেউ একজন দৌঁড়ে পালাচ্ছে। আরহান সেদিকে যেতে নিয়ে বুঝল যে ধরতে পারবে না। তখন জলদি করে রুহানীর কাছে এসে দেখে রুহানী ক্রমাগত হাপাচ্ছে। আরহান ওর পাশে বসে বলে,

“রিল্যাক্স। কিছু হয়নি। তুমি শান্ত হও। প্যানিক করো না।”

কিন্তু রুহানী ক্রমাগত ঘামছে। আরহান চাইছে রুহানীর মাথায় হাত রাখতে কিন্তু ইতস্তত করছে। কয়েকবার হাত সরিয়ে নিয়ে অবশেষে সক্ষম হলো। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

“কোনো শি*কারি ছিল। পাখি শি*কার করা অ*পরাধ। তাই মানুষ দেখে পালিয়ে গেছে। তুমি শান্ত হও। তাছাড়া আজ চা বাগান ফাঁকা। এই সুযোগটাই হয়তো শি*কারি নিতে চাইছিল।”

রুহানী অশ্রুসিক্ত নয়নে এক নজর আরহানের দিকে তাকায়। তারপর নজর হটিয়ে চোখ বন্ধ করে। তার অক্ষিপটে ভেসে উঠে আবছা এক ভয়ানক স্মৃতি। যা তার ছোট্ট হৃদয়ে বেশ বিরূপ প্রভাব ফেলেছিল। তারই চোখের সামনে তার বাবা-মায়ের হ*ত্যা!”

ফ্ল্যাশব্যাক,
রবিউল শেখ ও হাসনেয়ারা শেখ স্বপরিবারে তখন সিলেটে। উনারা রুহানীকে নিয়ে হাঁটতে বেরোনোর পর হাসনেয়ারা শেখ বলেন,
“চলো লুকোচুরি খেলি।”

রবিউল শেখ ভেবে বলেন,

“তোমরা দুইজন লুকাও আমি তোমাদের খুঁজে বের করব। অবশ্য তোমাদের দুইজনকে খুঁজে বের করতে আমার দুই মিনিটও লাগবে না।”

হাসনেয়ারা শেখ তীক্ষ্ম দৃষ্টি ফেলে স্বামীর কথার বিরোধীতা করে বললেন,
“তুমি চ্যালেঞ্জ করছ? দেখো এবার! খুঁজে পাও কী-না!”

“আচ্ছা যাও দেখি লুকাও।”

বাবা-মায়ের দুষ্টু-মিষ্টি ঝ*গড়া দেখে ছোটো রুহানী খিলখিল করে হেসে ওঠে। জায়গাটা বেশ নিরব। বিকেলের সময়টাতে ভালো লাগছে। রবিউল শেখ মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে বলেন,

“মা, তুমি কিন্তু তোমার আম্মুর থেকে আলাদা লুকাবে। হ্যাঁ? তোমার আম্মুকে তো আমি এক লহমায় খুঁজে পাব। সে তো লুকাতে জানেনা। বুঝেছ?”

রুহানী মুখে হাত দিয়ে হেসে বলে,
“ইয়েস পাপ্পা।”

“তুমি আমার মেয়েকে এসব কী শিখাচ্ছ? যাও আমরা লুকাব। তারপর দেখি কীভাবে খুঁজে পাও!”

স্ত্রীর রাগী মুখশ্রী দেখে রবিউল শেখ হেসে বলেন,
“আচ্ছা দেখব।”

তারপর হাসনেয়ারা শেখ ও রুহানী আলাদা আলাদা লুকিয়ে পরে। কিছুক্ষণের মধ্যে একটা বি*কট শব্দে হাসনেয়ারা শেখ ভয় পেয়ে বেরিয়ে আসেন। তার ভয় হতে লাগল। তিনি দ্রুত স্বামীর খোঁজ করে যেতে লাগলেন। কিছুটা সামনে যেতেই স্বামীর র*ক্তাক্ত দেহ ভূপতিত দেখে যত্রই স্থির হয়ে যান। তার সামনে এক মুখোশ পড়া ব*ন্দুকধা*রী দাঁড়ানো। এদিকে রুহানী বি*কট শব্দে বেশ ভয় পেয়েছে। সে যেখানে লুকিয়েছে, সেখান থেকে রাস্তাটা দেখা যায়। ভয়ে সে কানে হাত দিয়ে বসে পরেছে। তার মা তার থেকে চার-পাঁচ কদম সামনে দাঁড়ানো। হাসনেয়ারা শেখ হাতের ইশারায় রুহানীকে বের হতে মানা করছেন। ছোটো রুহানী মায়ের ইশারা বুঝে বা না বুঝেই ভয়ে কুঁকড়ে আড়ালেই রইল। তারপর আরেকটা গু*লি! গু*লির শব্দে পাখির ঝাঁকও যেন ভয় পেয়ে আরেকবার নিজেদের লুকানো স্থান থেকে উড়ে গেছে। রুহানী এবার চোখের সামনে মায়ের র*ক্তাক্ত দেহ দেখে এতোটাই ভয় পেয়েছে যে সে তৎক্ষণাৎ সেন্স হারায়। ভাগ্যক্রমে ব*ন্দুকধা*রী লোকটি নিজের কাজ শেষ করে পালিয়ে গিয়েছিল নয়তো রুহানীও জীবিত থাকত না।

তারপর সন্ধ্যবেলা পু*লিশের মাধ্যমে রুহানী উদ্ধার হয় তাও বেহালদশায়।

ফ্ল্যাশব্যাক এন্ড।

চলবে ইনশাআল্লাহ,