#বিবর্ণ_বৈশাখে_রংধনু
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১২
আরহান রুহানীকে আলতো হাতে নরম স্বরে ডাকে।
“রুহানী কোথায় হারালে?”
আরহানের মৃদু স্বরে ডাকও যেন রুহানীকে ভয় পাইয়ে দিল। ধড়ফড়িয়ে উঠে কিঞ্চিত দূরে সরে গেল। গলা দিয়ে পীড়াদায়ক গোঙ্গানি বের হচ্ছে। রুহানীর এহেন অবস্থা দেখে আরহান ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে,
“এমন করছ কেন তুমি? রিল্যাক্স হও প্লিজ। কিছু হয়নি। এভরিথিং ইজ ফাইন।”
আরহান যতোই রুহানীকে শান্ত করতে চাইছে রুহানী ততোই হাইপার হয়ে যাচ্ছে। তার শ্বাস উঠে যাচ্ছে। চোখ-মুখ র*ক্ত বর্ণ ধারণ করছে। ক্রমাগত শরীর ঝাঁকি দিয়ে ঠান্ডা হচ্ছে সেই সাথে ঘাম! প্যা*নিক অ্যা*টাক করেছে ওর। আরহানও এবার ভয় পেয়ে যায়। দ্রুত রুহানীকে নিজের সাথে চেপে ধরে শান্ত করার প্রয়াস করে তারপর সময় জ্ঞাপন না করে দ্রুত কোলে তুলে নিয়ে হাঁটা শুরু করে। আরহান বুঝতে পারছে রুহানীর শরীর তার ভার ছেড়ে দিচ্ছে। তাই সে অনবরত কথা বলতে শুরু করে।
“চোখ বন্ধ করবে না। কিছু হয়নি। পাখির শব্দ শুনতে থাক। ওভারথিংকিং করবে না। ভালো কিছু ভাব। তোমার ফেভারিট কাজ, খাবার সব। ভাবতে থাক। মাইন্ড ডাইভার্ট করো।”
আরহান পায়ের গতি বাড়াচ্ছে। ঢাল দিয়ে সাবধানে নেমে প্রায় পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে রুহানীদের বাংলোর কাছে পৌঁছে যায়। দারোয়ান একটা ছেলের কোলে রুহানীকে দেখে ছুটে এসে জিজ্ঞাসা করেন,
“কী হয়েছে আপার?(সিলেটি ভাষাকে কনভার্ট)”
“গেইট খুলেন আঙ্কেল। মিসেস জাহানারা শেখকে ডাকুন।”
দারোয়ান দ্রুত বড়ো গেইট খুলে দেয় যাতে আরহান আরামছে রুহানীকে নিয়ে ঢুকতে পারে। অতঃপর দ্রুত পায়ে বাড়ির ভেতরে গিয়ে জাহানারা শেখকে বলেন। আরহান রুহানীকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করা মাত্রই জাহানারা শেখ অস্থির কণ্ঠে শুধান,
“কী হয়েছে ওর? এমন প্যা*নিক অ্যা*টাক কেন করছে?”
“আন্টি রুহানী কি কোন ইনহেলার ইউজ করে? ওটা দ্রুত নিয়ে আসুন। ওর শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি অনেক কমে এসেছে।”
আরহানের কথা শুনে জাহানারা শেখ দ্রুত রুহানীর ইনহেলার নিয়ে এসে আরহানের হাতে দেয়। আরহান রুহানীকে এক বার পাম্প দিয়ে আস্তে আস্তে মাথায় হাত বুলাতে থাকে। জাহানারা শেখ রুহানীর পিঠে ম্যাসাজ করতে থাকে। জাহানারা শেখ ইনহেলার নিয়ে আরেকবার দিতে চাইলে আরহান বাধ সাধে।
“না আন্টি। একবারই। এটা রিলিফার। একবারই দিবেন। একসাথে একাধিকবার দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে। এয়ারওয়ে ব্লক হয়ে যেতে পারে। রুহানী একটু স্টেবল হলে তারপর দেখা যাবে।”
জাহানারা শেখ মাথা দুলিয়ে মেনে নেন। সার্ভন্টকে ডেকে পানি আনতে বলে। আস্তে আস্তে কয়েক মিনিটের মধ্যে রুহানীর শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হতে শুরু করে। তারপর জাহানারা শেখ ওকে পানি খাইয়ে আরহানকে জিজ্ঞেসা করে,
“ওর এরকমটা কিভাবে হলো?”
“রুহানীকে দেখেছিলাম ও ছবি তুলছিল। তখন আমি পেছন থেকে ডেকে আমি আমার পালিত খরগোশটাকে আমি নিয়ে এসেছিলাম সেটা দেখাতে আসতে বলেছিলাম। যখন ও পেছনে ঘুরে আমার কাছে আসতে নিবে তখনি ওর কানের কাছ ঘেষে একটা গু*লি গিয়ে সামনের গাছে বসা একটি পাখিকে আঘা*ত করে। তারপরই ওর এই অবস্থা?”
জাহানারা শেখ ভীত হলেন। হড়বড়িয়ে বলেন,
“গু*লিটা কি ওকে উদ্দেশ্য করে ছিল? তুমি শু*টারের চেহারা দেখেছ? কে সে?”
জাহানারা শেখের উৎকণ্ঠা আরহান বুঝল। সে বলল,
“না আন্টি। আমি তো চেহারা দেখিনি। তাছাড়া এখানে শি*কা*রিরা আড়ালে পাখি শি*কার করে। যে গু*লি করেছে সে কোন শি*কা*রি হবে। তাছাড়া আজ তো ছুটির দিন। কোনো শ্রমিক নেই চা বাগানে। তাই হয়তো এই সুযোগে পাখি শি*কা*র করতে এসেছিল। তারপর আমাদের দেখে পালিয়ে গেছে। আপনি হাইপার হবেন না। আজকে চা বাগান অনেকটাই নির্জন।”
আরহান জাহানারা শেখকে যা বুঝিয়েই শান্ত করতে চাক না কেন, জাহানারা শেখের মনের মধ্যে ভয় রয়েই গেছে। আঠারো বছর আগের ঘটনার কি তবে পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে? তিনি তার শঙ্কা আরহানকে বুঝতে দিলেন না। ঠোঁটকোলে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বললেন,
“তুমি যদি সময় মতো ওকে না সামলাতে তাহলে যে আজ কী হতো জানি না বাবা। অনেক অনেক ধন্যবাদ।”
“না আন্টি, ধন্যবাদ দিতে হবে না। বিপদে পাশে দাঁড়ানো সব মানুষের কর্তব্য।”
আরহানের কথায় জাহানারা শেখ মুচকি হেসে বলেন,
“তুমি বসো। আমাদের সাথে নাস্তা করবে।”
আরহান হাতঘড়ির দিকে চেয়ে বলে,
“আন্টি, আজ না। দাদী অপেক্ষা করে আছে। আমি না যাওয়া অবধি তিনি খাবেন না। তাছাড়া আজ তো আপনাদের সাথে আবার দেখা হচ্ছে।”
“একটু তো কিছু মুখে দাও। জুসটাই নাহয়। এটা আমি না শুনব না। পাঁচ মিনিট বসো। ফ্রেশ মালটার জুস আনছি।”
জাহানারা শেখ আরহানের আর একটা কথাও শুনলেন না। তিনি রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। আরহান রুহানীর কাছে গিয়ে ফ্লোরে হাঁটু মুড়ে বসে। রুহানী চোখ বন্ধ করে সোফায় গা এলিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। আরহান ওর ঘন পাঁপড়িযুক্ত মুদিত নয়নজোড়া দিকে চেয়ে কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিলে তৎক্ষণাৎ রুহানী চোখ খুলে তাকায়। আরহান জিজ্ঞাসা করে,
“এখন ঠিক লাগছে?”
রুহানী ইশারায় হ্যাঁ বোধক বুঝিয়ে উঠে বসে। আরহান বলে,
“জানি তোমার একাকি প্রকৃতিতে ঘোরাফেরা করতে ভালো লাগে। কিন্তু সব সময় তো আর বিপদ বলে কয়ে আসে না। যেমন দেখো আজকে যদি ওখানে আমি না থাকতাম তাহলে তুমি এই গু*লির শব্দে ওখানেই সেন্সলেস হয়ে পড়ে থাকতে। তারপর তোমাকে কে বাঁচাতো? কারণ আজকে কোন শ্রমিক চা বাগানে যাবে না। ফাঁকা বাগানে তুমি কোথায় আছ কে জানত? সেদিনও তুমি একা একা নির্জন চা বাগানে রাতের বেলায় বেরিয়ে পরেছিলে। তোমার কি এটা ভাবনায় আসেনি এই অন্ধকারে তোমার কোন বিপদ হলে তোমাকে কে বাঁচাতো? দুইবার তুমি আমার সামনে পড়েছ বলে কি প্রতিবার আমি থাকব? একটু কেয়ারফুল হও। কাউকে সাথে করে নিয়ে বের হও। আর আমি এটাও জানি তুমি তা করবে না! তোমার চোখ-মুখ বলে দিচ্ছে তুমি বারবার একা একা চা বাগানে ঘুরতে বেরিয়ে পরবে।”
আরহানের প্রথম দিকের কথাগুলোতে রুহানী মাথা নিচু করে শুনছিল কিন্তু তার শেষোক্ত কথায় রুহানী মুখে হাত দিয়ে হাসে। আরহান বলে,
“দাদী বলল, তোমরা নাকি এখানে পার্মানেন্ট থাকতে এসেছ? এখানেই নাকি ভর্তি হয়েছ?”
রুহানী হ্যাঁ বোধক মাথা দুলালে আরহান বলে,
“বছরের প্রায় মাঝামাঝিতে ভর্তি হলে। পড়াশোনায় মনোযোগ দাও। তা কোন সাবজেক্টে?”
রুহানী ঠোঁট নাড়িয়ে নিঃশব্দে বলে,
“বোটানি।”
“বোটানি?”
আরহানের প্রশ্নে রুহানী মাথা নাড়ায়।
“তাহলে তো ভালোই। প্রকৃতিকে বইয়ের পাতায় পড়বে। বেস্ট অফ লাক।”
ততক্ষণে জাহানারা শেখ জুস নিয়ে চলে আসলে আরহান জুস খেয়ে বিদায় নিয়ে চলে যায়। তারপর জাহানারা শেখ রুহানীকে নিয়ে রুহানীর ঘরে যায়। রুহানী তার চাচিকে ইশারায় বলে যেন চাচাকে ঘটনাটা না বলে।
“কেন বলব না? সেফটির ব্যাপার এটা।”
রুহানী খাতায় লিখে,
“আরহান তো বলল, এমনভাবে আড়ালে পাখি শি*কার হয়। পাখিটা তো র*ক্তাক্ত অবস্থায় জমিনে পরেছিল। তুমি চাচুকে বলো না। টেনশন করবে। আমি একটু ঘুমালে ঠিক হয়ে যাব। তারপর তো দাওয়াতে যেতে হবে। তাই না? প্লিজ বলো না।”
জাহানারা শেখ লেখাটা পড়ে বলেন,
“এখন না বলি তবে তোমার পায়ে আমি লাগাম টানতে ঠিক বলব। হুটহাট একা একা বের হওয়া বের করছি।”
রুহানী মায়াবি দৃষ্টিতে তাকালেও জাহানারা শেখ তা আগ্রাহ্য করে ওকে রেস্ট করতে দিয়ে বাহিরে চলে যান। চাচির চলে যাওয়া দেখে রুহানী লম্বা নিঃশ্বাস ত্যাগ করে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করে।
_____
“আজকেও পারলে না? আজ কতো মুক্ষোম সুযোগ ছিল। আজ যদি গু*লিটা পাখির গায়ে না লেগে রুহানীর শরীরে লাগত তবে সব কাহিনী খ*তম! কিন্তু আমি যে কয়েকটা অপ*দার্থকে রেখেছি! কিচ্ছু হবে না তোমাদের দিয়ে। কোনদিন যেন আমি তোমাদেরকেই পৃথিবী ছা’ড়া করি! ”
ফোনের অপরপাশ থেকে হুং-কার শুনে লোকগুলো তটস্থ হলো। বড়ো ঢোক গিলে বলল,
“মাফ করবেন। ওই ছেলেটা না থাকলে আজকেই কাজ হয়ে যেত। এরপর থেকে আমরা যথাসম্ভব চেষ্টা করব। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।”
“তাই যেন হয়। আবারও নতুন সুযোগ খুঁজো। কোনোভাবেই ধরা পরা চলবে না। এমন ভাবে সব করবে যাতে সা*পও ম*রে লাঠিল না ভাঙে!”
“জি জি। মনে থাকবে।”
ফোন ডিসকানেক্ট হয়ে যায়।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
#বিবর্ণ_বৈশাখে_রংধনু
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১৩
আরহান বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎ করে তার খোরগোশটার কথা মনে পড়ায় ছুটে চা বাগানে গিয়েছে। আশেপাশে বেশ কয়েকবার নাম ধরে ডেকেও খোরগোশটার কোনো পদধ্বনি পায় না। আরহান অস্থির হয়ে খুঁজছে তখন তার ফোন বেজে উঠলে পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে তার দাদী ফোন করেছে। আরহান রিসিভ করে উৎকণ্ঠিত হয়ে বলে,
“দাদী, আমি একটু পরে কথা বলছি। বনিকে খুঁজে পাচ্ছি না। ওকে যে একা রেখে গিয়েছিলাম। এখন কোথায় যে গেল!”
আয়েশা খানম বলেন,
“ও তো তোর ডাক শুনলেই চলে আসে। ভালো করে খোঁজ।”
“হ্যাঁ খুঁজতেছি। তুমি নাস্তা করে নাও। আমি ওকে খুঁজতে থাকি। বায়।”
আরহান আয়েশা খানমের কল কেটে প্রায় ঘণ্টা দুয়েক খোরগোশটাকে খুঁজে। অতঃপর না পেয়ে সেখানেই বসে থাকে।
_____
রহমত শেখ বাংলোতে ফিরে রেস্ট করে এখন বেলা বারোটা বাজলে নিজের স্ত্রীকে বলেন,
“জাহানারা, রুহানী কি তৈরি হয়েছে?”
“সবে একটু আগে ঘুম থেকে উঠিয়ে এসেছি। রেডি হয়ে যাবে।”
“ওর মা*থাব্যথা কমেছে?”
জাহানারা শেখ জোরপূর্বক হেসে বলেন,
“হ্যাঁ। কমেছে। এখুনি এসে পড়বে।”
জাহানারা শেখ স্বামীকে সকলের ঘটনাটা খুলে বলেননি। তিনি বলেছেন রুহানী মা*থাব্যথার কারণে ঘুমিয়ে আছে।
এদিকে রুহানী ওয়ারড্রব খুলে বেশ চিন্তিত। সে কোন জামাটা পড়বে বুঝে উঠতে পারছে না। অবশেষে নীল গাউন ও কালো থ্রিপিসের মধ্যে কালো থ্রিপিসটাই বেছে নিল। তারপর চুলগুলো খোলা অবস্থায় সেট করে হালকা সাজ বলতে, পাউডার, কাজল ও লিপস্টিক। কানে মাঝারি সাইজের এন্টিক ঝুমকা ও হাতে এন্টিক চুড়ি পড়ে তৈরি হয়ে নিচে গেল। জাহানারা শেখ ওকে দেখে বলেন,
“মাশাআল্লাহ। কারও নজর না লাগুক।”
তিনি রুহানীর কানের কাছে কাজল ছুঁইয়ে দিলেন তাতে রুহানী হালকা হাসে। ছোটো থেকে দেখে আসছে জাহানারা শেখ সবসময় ওদের দুই বোন তৈরি হলে এভাবে কাজল লাগাতেন। এখন রিহা না থাকায় শুধু রুহানীর সাথে করেন। রহমত শেখ হেসে বলেন,
“নজর কা*টানো হলে চলো। আমাদের রুহানী সাজলেও সুন্দর না সাজলেও। চলো তো এবার।”
উনারা রওনা করলেন। বাগানের মাঝের রাস্তা দিয়ে মেইন গেইটের কাছে যাচ্ছে তখন দেখল, দারোয়ান রুষ্ট মনে কিছু একটা হাতে করে নিয়ে আসছেন। রহমত শেখ ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলে অপেক্ষা করছেন। এদিকে রুহানী কৌতুহলী হয়ে দারোয়ানের কাছে এগিয়ে গেল। তারপর দেখল দারোয়ানের হাতে একটা বাচ্চা খোরগোশ। রুহানী দারোয়ানকে ইশারায় জিজ্ঞেসা করে,
“কী হয়েছে?”
দারোয়ান রুষ্ট কণ্ঠে জবাব দেয়,
“আপামনি, আমি বাগানের কোনার দিকে বারোমাসি গাজর চাষ করি। এই শ*য়*তা*ন খোরগোশটা আমার বাগানে ঢুকেছে। কই থেকে যে আসলো!”
রুহানী দারোয়ানের কথা শুনে খোরগোশটাকে নিজের কোলে নিল। তারপর ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দারোয়ানকে ইশারায় যেতে বলল। দারোয়ান খোরগোশটাকে ব*কতে ব*কতে চলে গেল। রহমত শেখ রুহানীকে গাড়িতে উঠতে ডাকলে সে খোরগোশটাকে সাথে নিয়ে নিল। দারোয়ানকে দেখে রেগে আছে মনে হচ্ছে। রেগে কোথায় না কোথায় ফেলে দেয়! তাই নিজের সাথেই নিয়ে নিল।
আরহানদের বাড়ির গেইট দিয়ে গাড়ি ঢুকলে প্রথমেই রুহানীর নজর কাড়ে বিশাল বাগানবিলাশের ঝাড়। তিন রঙের বাগানবিলাশের গাছ একসাথে বিধায় গোলাপি, সোনালি ও সাদা এই ত্রিরঙের মিশেলে দারুণ ফুটে ওঠেছে। রুহানীদের গেইটের কাছে গোলাপি বাগানবিলাশটাই শুধু আছে তাও এতো বড়ো ঝাড় না। এতোদিন যত্ন করা হয়নি বলে ওদের বাগানে ফুলের গাছ নিতান্তই কম। কিছু জায়গায় রুহানীরা আসার আগে ফুলসহ গাছ এনে লাগানো হয়েছে।
গাড়ি গিয়ে বাড়ির সামনে থামে। আয়েশা খানম ও আজমল খান ওদের স্বাগতম করতে বাহিরে এসেছে। গাড়ি থেকে সবার নামার পর রুহানী খোরগোশটাকে সাথে নিয়ে নামল। আজমল খান ও আয়েশা খানম সবাইকে উষ্ণ অভ্যর্থনা দেওয়ার পর আয়েশা খানমের নজর খোরগোশটার উপর গেলে তিনি অবাক হয়ে বলে ওঠেন,
“আরে, বনি তোমার কাছে? এদিকে আরহান ওকে লাগাতার খুঁজর না পেয়ে হয়রান।”
কথাটা শুনে রুহানী একবার আয়েশা খানমের দিকে তাকায় তো একবার খোরগোশটার দিকে। জাহানারা শেখ আয়েশা খানমকে জিজ্ঞাসা করেন,
“খোরগোশটা আপনাদের? ওকে দারোয়ান আমাদের বাগানে পেয়েছে। তারপর রুহানী ওকে সাথে করে নিয়ে এসেছে।”
“হ্যাঁ। ও আরহানের বনি। বনির বাবা-মাও এখানে আছে। আরহান সকাল থেকে বনিকে খুঁজে পাচ্ছে না। তোমরা ভেতরে এসো, আমি আরহানকে ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি। ছেলেটা বোধহয় এখনো খুঁজে চলেছে।”
জাহানারা শেখ মুচকি হেসে সম্মতি দিলেন কিন্তু রুহানীর মন খারাপ হয়ে যায়। এটুকু সময়ে খোরগোশ বাচ্চাটা তার বেশ মনে ধরেছে। একে এখন ফিরিয়ে দিতে হবে বলে একটু মন খারাপ করছে। তারপর ওরা বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। আয়েশা খানম আরহানকে ফোন করে দিলে আরহান দ্রুত বাড়ির পথ ধরে।
খোরগোশটা রুহানীর কোল থেকে নিজেই নেমে গিয়ে নিজের বাবা-মায়ের কাছে চলে যায়। তার পিছু পিছু রুহানীও যায়। আরহানের ঘর! খোরগোশটা আরহানের ব্যালকনিতে থাকে। রুহানী সেখানে গিয়ে দেখল, আরও দুটো খোরগোশ ও বেশ কিছু লাভবার্ড আছে। পাখির মত্ত হয়ে কিচিরমিচির শুনতে শুনতে প্রায় অনেকটা সময় চলে গেছে। হঠাৎ নিজের পেছনে কারও উপস্থিতি বুঝতে পেরে পেছনে ঘুরে দেখে আরহান। আরহানকে নিজের দিকে পলকহীন চেয়ে থাকতে দেখে কিঞ্চিত অস্বস্তিতে পরে যায়। রুহানী পাখির খাঁচাতে মৃদু শব্দ করলে আরহান নিজের দৃষ্টি নিচু করে। অতঃপর বলে,
“থ্যাংকিউ সো মাচ। আমি ভেবেছিলাম বনিকে হারিয়েই ফেলেছি।”
রুহানী বিপরীতে হালকা হাসে। আরহান আবার বলে,
“এখন ঠিক আছ?”
ইশারায় রুহানীর হ্যাঁ বোধক জবাব শুনে আরহানও মৃদু হাসে। রুহানী ঠোঁট নাড়িয়ে বিনা শব্দে বলে,
“আমি যাই তাহলে। ওর খেয়াল রাখবেন। অনেকটা ছোটো।”
“হুম।”
রুহানী সেখান থেকে চলে এসে তার চাচি ও আরহানের দাদীর আড্ডায় বসে। আরহানের দাদী বলছেন,
“ছেলের বউয়ের মৃত্যুর বারো বছর পেরিয়ে গেছে। আমিই এই দুই বাপ-ছেলের সাথে আছি। ছেলেকে প্রথম প্রথম অনেক বলেও আরেকবার বিয়ে করাতে পারিনি। এখন নাতিকে মাঝেমধ্যে বিয়ের কথা বলি কিন্তু সেও কথা উড়িয়ে দেয়। তোমরাই বলো, এই বুড়ো বয়সে কি আমি একা একা পারি? একা একা কাজের লোকদের সাথে থাকি। আর ভালো লাগে না।”
জাহানারা শেখ হেসে বলেন,
“ছেলেরটা শুনেছেন বলে কি নাতিরটাও শুনবেন নাকি? একটা ভালো মেয়ে খুঁজে জোড় করে বিয়ে করিয়ে দিন। আপনার নাতি আবার পাইলট। দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ায়। আপনি তো সারাদিন একাই থাকেন।”
“আরহানের মাও পাইলট ছিল। কাছে থাকত না কিন্তু ছুটির সময় আমাকে একা ছাড়তেই চাইত না। মেয়েটার অসুস্থতা, মৃত্যু সব এতো দ্রুত হয়েছিল যে কিছু করেও লাভ হয়নি। ওদের তো ছয় মাস অন্তর রুটিন চেকআপ হয়। তখনি ওর ধরা পরে ওর ব্লাড ক্যান্সার। খুব দ্রুত সেটা ছড়িয়ে পরে। আমার ছেলে ওকে সিঙ্গাপুরেও নিয়েছিল। তাও হায়াত না থাকলে কী করা বলো? চলে গেল মেয়েটা। আর আমার হায়াত দেখো!”
কথাগুলো বলে আয়েশা খানম চোখ মোছেন। জাহানারা শেখ নিরবে তাকে স্বান্ত্বনা দিতে থাকেন। ওইযে কথায় আছে না? চোখের জল ছোঁয়াচে! একজনকে দেখে আরেকজনের হৃদয় ব্যথিত হয়। রুহানীর চোখেও অশ্রুকণারা ভীড় জমিয়েছে। যেকোনো সময় গড়িয়ে পরার অপেক্ষা মাত্র।
আরহান নিচে নেমে দেখে তার দাদী চোখ মোছছেন। সে লম্বাশ্বাস ফেলে দাদীর কাছে গিয়ে পেছন থেকে গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
“উফ দাদী! এতো কাঁদো কেন তুমি? চোখের পানি বেশি হলে আমাকে ধার দাও। আমার পাখিদের পানির অভাব হবে না!”
“যাহ্ শ*য়*তা*ন!”
দাদীর আলতো মা*রা*র অভিনয়ে আরহান হাসে। ওরা আবার টুকটাক আড্ডায় মেতে উঠলে আরহান গভীর দৃষ্টিতে রুহানীকে দেখতে থাকে। মেয়েটার চোখের কাজল ঈষৎ ছড়িয়ে গেছে। তাতে অবশ্য তাকে আরহানের কাছে অন্যরকম সুন্দর ঠেকছে। আরহানের এই হৃদয়াঙ্গনে বিচরনের মধ্যেই সদর দরজা থেকে এক মেয়েলি স্বর ভেসে আসে।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
রিচেক হয়নি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।