বিবর্ণ বৈশাখে রংধনু পর্ব-৪+৫

0
202

#বিবর্ণ_বৈশাখে_রংধনু (২য় পরিচ্ছেদ)
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪
বহমান স্রোতস্বিনীর মতো সময়ের স্রোত বয়ে চলেছে। পেরিয়ে গেছে রুহানীর নিখোঁজের পাঁচ পাঁচটা দিন! এখন পর্যন্ত রুহানীর কোন খোঁজ কেউ পায়নি। পুরো সিলেট শহর বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়ে গিয়েছে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও ছাপা হয়েছে কিন্তু এখনো কোনো খোঁজ কেউ দিতে পারেনি। জাহানারা শেখ ও রহমত শেখকে মনে সাহস ও যাতে ভেঙে না পরে তাই রিহা তার স্বামীর সাথে এসে থাকছে। রিহা যেন এখন নিজের বাবা-মায়ের মনের মতো মেয়ে হয়ে উঠেছে।

আঁধার অম্বরপানে অনিমেষনেত্র মেলে দিকবেদিক হয়ে চেয়ে আছে আরহান। রকিং চেয়ারে অনবরত দুলছে সে। অক্ষিপটে কল্পনার ঘুরি যেন ডানা মেলে অতীতে ঘোরাফেরা করছে।

______

“তোমার কী হয়েছে রুহি? আজ আমার থেকে এতো পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছ কেন?”

রুহানী ছুটে গিয়ে গাছের আড়ালে লুকায়। অতঃপর হাতে থাকা ছোটো ডায়েরিতে কিছু লিখে,
“আজ তো আমি আপনার নাগালে আসবই না। কালকে আপনি আমার কথা শোনেননি। ”

লিখে কাগজটা ছিঁড়ে গোল করে আরহানের দিকে ছুঁড়ে দিল। তৎক্ষণাৎ আরহান ক্যাচ ধরে বলে,
“আরে ইয়ার প্লিজ।”

কাগজটা খুলে পড়তে পড়তে বলে,
“দেখো, সব মানলাম কিন্তু ওই কথাটা মানতে পারব না। ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড।”

দূর হতেই রুহানী মাথা নাড়ালো। মানে সে অসন্তোষ এখনও। আরহান হতাশ হয়ে বলে,
“তুমি জানো, আমার এসব রাজনীতি খুব একটা মন টানে না। বাবার কথায় তার বিজনেসের কাজ ধরেছি, মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছি। সবই তো করলাম। এখন আবার রাজনীতিও! আমি কয় দিক সামলাবো?”

রুহানী ইশারায় বুঝাল,
“আঙ্কেল খুব করে চাইছেন। প্লিজ আমি আংকেলকে কথা দিয়েছি আমি আপনাকে বোঝাবো।”

“তুমি তোমার আংকেলকে বলে দাও তুমি বুঝিয়েছো কিন্তু আরহান বোঝেনি। নরমাল বিষয় এটা নিয়ে এত ঝামেলা করার কি আছে। তাছাড়া বাবার রাজনীতিতে আমি কখনোই মাথা ঘামাইনি। আমার প্যাশনই ছিল অন্য কিছু।”

আরহানের কথা শুনে রুহানী দীর্ঘশ্বাস ফেলল অতঃপর লিখলো,
“মানলাম আপনার প্যাশন ছিল না কিন্তু আঙ্কেল তো চাইছেন। তাছাড়া এতে করে আপনি জনগণের জন্য কিছু করতে পারবেন। সাধারণ মানুষজনের পর্যন্ত আপনি পৌঁছাতে পারবেন। আমি আপনার মধ্যে সেই সামার্থ্য দেখেছি। আপনি খুব ভালো ও জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধি হবেন।”

রুহানী আবারও একই উপায়ে কাগজের টুকরোটা আরহানের কাছে পৌঁছালো। আরহান লেখাগুলো পড়ে হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আমি এত কম বয়সে এসব ঝামেলায় জড়াতে চাই না। যদি জড়াতেই হয় তাহলে আরো পরে। এখনই কেন? একবার জড়িয়ে পড়লে আমার জীবনের সব সময় ওখানেই চলে যাবে। বাবাকে দেখি তো। বাবা মাকে খুব ভালোবাসতেন। খুব খুব ভালবাসতেন। কিন্তু মায়ের সাথে অতটা সময় কাটাতে পারেননি। বাবা ব্যস্ত থাকতো রাজনীতি নিয়ে, ব্যবসা নিয়ে। আর মা তার পাইলটের জব নিয়ে। কিন্তু যখন মা ছুটির দিনে বাড়ি থাকত তখন প্রায় সময়ই বাবা ব্যস্ত থাকতেন। আমি চাইনা আমার জীবনটাও এরকম হোক। আমি তো চাই তোমার সাথে বেশি বেশি সময় কাটাতে। তুমি আমার পাশে থাকলে মনে হয় কোনো কষ্টই কষ্ট না। এইযে একসাথে তিন দিক সামলাচ্ছি।”

রুহানী এবার এগিয়ে এলো। এগিয়ে এসে আরহানের কাঁধে হাত রাখল। মিষ্টি করে হেসে ঠোঁট নাড়িয়ে নিঃশব্দে বলল,
“আপনি পাশে থাকলে আমার মনোবল বাড়ে। নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হয়। নয়তো আমার প্রতিব*ন্ধকতা জেনেও এতোটা ভালোবাসা পাব বলে ধারণাই ছিল না।”

“তুমি আবার নিজেকে ইনফিরিয়র ভাবা শুরু করেছ! এতো বলি, তুমি খারাপ পরিস্থিতির শি*কার। যা একদিন ঠিক হবে। হতেই হবে। ”

আরহানের দৃঢ় বিশ্বাসে রুহানী প্রসন্ন হাসলো। তারপর ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,
“আমিও চাই কথা বলতে। আমি চাই যাতে কেউ বলতে না পারে আরহান ইসরাক খানের স্ত্রী বোবা! আমার জন্য আপনি মানুষের কথা শুনুন আমি চাই না। কিন্তু মনে একটা ভয় রয়েই যায়। ১৮ বছরেও যে মেয়ে কথা বলতে পারল না! পারল না নিজের প্রতিবন্ধকতা থেকে বেরিয়ে আসতে! সে কি আদৌ কখনো কথা বলতে পারবে?”

“হুঁশ। এতো বাজে চিন্তা করো না। কেউ তোমাকে কিছু বলবে না। যে বলবে তার…..! কারও এমন সাহসই হবে না।”

“আপনি প্লিজ আংকেলের কথায় রাজি হয়ে যান। আমি আপনার মধ্যে একজন আদর্শ রা*জনীতিবিদের ছায়া দেখতে পাই। প্লিজ প্লিজ। নয়তো কাল থেকে আমি বাড়ি থেকেই বের হব না। তখন দেখব কীভাবে দেখেন আমায়!”

রুহানী বাচ্চাদের মতো নাক ফুলিয়ে বুকে হাত গুঁজে অন্যদিকে ফিরে রইলো। আরহান রুহানীর থুতনিতে হাত দিয়ে ওর মুখশ্রী একবার নিজের দিকে ঘোরায় তো রুহানী আবারও মুখ ফিরিয়ে নেয়। আরহান বলে,
“তবে তোমার বাড়িতে চলে যাব!”

তাও রুহানীর রাগ কমলো না। আরহান এবার হেসে ফেলল। সে বলল,
“আচ্ছা ঠিক আছে। আমি মেনে নিলাম তোমার কথা। আমি রাজি আছি। বাবা যাই করুক আমি রাজি। খুশি?”

রুহানী খুশিতে উছলে ওঠল। তারপর আরহানের হাত জড়িয়ে দূরে ফুচকাওয়ালাকে দেখিয়ে ইশারায় বলল,’ফুচকা খাবে।’ যেই বলা সেই কাজ। আরহান রাজি হয়ে গেল। অতঃপর ওরা দুজন একসাথে ফুচকা খেলো।

________

কল্পনার সুতো কে*টে বেরিয়ে আসলো আরহান। তার ঘরের দরজায় কেউ এসেছে। আরহান ভাবল, এটা তার দাদী। সে হাঁক ছাড়ল,
“তুমি এখন যাও দাদী। আমি কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই।”

“আমি তোমার দাদি না আরহান। আমি তোমার বাবা। ”

আরহান তার বাবার কণ্ঠ শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অতঃপর বলল,
“পূর্বের কথাটা তোমার উপরও লাঘু হয় বাবা। আমি কিছু সময় একা থাকতে চাই।”

আজমল খান এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলেন। তারপর বললেন,
“সন্ধ্যা থেকে তো একাই ছিলে। এখন রাতের এগারোটার বেশি বাজে। আর কতো একা থাকবে? ডিনার তো করে নাও। তুমি এভাবে না খেয়ে, না ঘুমিয়ে নির্ঘুম থাকলে বুঝি রুহানী ফিরে আসবে? বরং তুমি আরো দুর্বল হবে। রুহানীকে খোঁজার মতো শক্তি পাবে না।”

“আমি ওকে খুঁজি আমার মনের শক্তি দ্বারা বাবা। আমার শারীরিক শক্তি এসব ম্যাটার করে না। শারীরিক অসুস্থতা তো নিয়ম মেনে চলল, ঔষুধ খেলে ঠিক হবে। কিন্তু মানসিক অসুস্থতা যে দীর্ঘস্থায়ী! এই দীর্ঘস্থায়ী অসুখের একমাত্র ঔষুধ হচ্ছে রুহানী।”

ছেলের কথা শুনে আজমল খান হতাশ হলেন তিনি হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন
“আমরা তো খোঁজ জারি রেখেছি। তন্ন তন্ন করে খুঁজছি। কোথাও পাচ্ছি না। বিজ্ঞাপন ছাপা, সবকিছু হয়ে গেছে। তুমি একটু ধৈর্য ধরো। যারা রুহানীকে কিডন্যাপ করেছে তারা এখন পর্যন্ত কোন রকম যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি। কোনো মু*ক্তিপণও চায়নি। আমরা কী সূত্র ধরে ওদের দিকে আগাবো?”

“আমার মনে হচ্ছে রুহানী সিলেটে নেই! তাই সিলেটে খুঁজে কোনো লাভ নেই।”

_______আরহান নিজের সন্দেহের কথাটা বলা মাত্রই ঘুমন্ত রুহানীর সামনে বসা লোকটি অট্টস্বরে হেসে উঠে বলল,
“ইউ আর রাইট আরহান! তুই একদম সঠিক বুঝতে পেরেছিস। তোর রুহানী সিলেটে তো নেই। কিন্তু কোথায় আছে? দেখি, সেটা খুঁজে বের করতে পারিস কিনা।”

লোকটি এবার হুট করে হাসি থামিয়ে রুহানীর দিকে এগিয়ে গেল তারপর রুহানীর কপালের সামনে জড়ো হওয়া চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে বলল,
“ইউ আর সাচ অ্যা স্লিপিং বিউটি রুহানী। তোমার মুখের আদলে যেন একরাশ মায়া ভর করে আছে। মন তো করছে সারাজীবনের জন্য তোমাকে নিজের করে নেই! আরহানের কথা ভুলে যাও না তুমি! একদম ভুলে যাও। এনেছিলাম তোমাকে কষ্ট দিয়ে ধীরে ধীরে মা*রতে কিন্তু তোমার মায়ায় পড়ে গিয়ে এখন নিজেরই বেহাল দশা করে ফেলেছি। তাইতো যখনই সুযোগ পাই তোমাকে দেখার জন্য তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হয় সোনা। তুমি না ঘুমালে যে আমি তোমাকে শান্তিতে দেখতে পারব না! একদিন আস্তে আস্তে তোমার মন থেকে আরহান নামটা মুছে যাবে! তখন আমি নিজের নাম তোমার মনে গেঁথে দিব। তুমি হবে আমার রাজ্যের রানী! দুনিয়া থেকে দূর, আমার হৃদকুটিরে থাকবে।”

লোকটি আবারও পাগলের ন্যায় হাসতে শুরু করল।
_____

আজমল খান অবাক হয়ে দরজার জিজ্ঞাসা করলেন,
“তাহলে কোথায় থাকতে পারে রুহানী? তোমার কোন ধারনা আছে? বা কোন ক্লু পেয়েছো? পেলে বলো। এটা আমরা পুলিশকে দেব। ওদের হেল্প হবে।”

“না বাবা। পাইনি। তবে এটা শিউর যেই কিডন্যাপ করে থাকুক না কেন সে খুব চতুর। এই কয়েকটা দিন আমাদের ভ্রমের মধ্যে রেখেছে। আমরা তো আগেই বুঝতে পেরেছি কি*ডন্যাপের উদ্দেশ্য কোন টাকা পয়সা না। অন্য কোন উদ্দেশ্য। আর সেই উদ্দেশ্যটা কোন আপন মানুষদেরই থাকতে পারে।”

“তোমার কাকে সন্দেহ হয় আরহান?”

“সন্দেহের তালিকাটাতো ধরতে পারছি না বাবা! একবার ভেবেছিলাম হয়তো রিহা কিন্তু… কিন্তু না। রিহার এসব করে কী লাভ? যদি রিহা এসব করতেই চাই তো রুহানীকে সরিয়ে ফেলতে চাই তো তবে এত বছর অপেক্ষা করত না। রিহা ছোট থেকেই রুহানির উপর রাগ কারণ তোমায় মনে কর তোর রুহানি তার পাওনা ভালোবাসা ভোগ করছে। অবশ্য তা কিঞ্চিৎ সত্যও। রহমত শেখ ও জাহানারা শেখ রুহানীর ওই নিঃসঙ্গ সময়ে রিহাকে কোন না কোন ভাবে অবহেলাই করেছে রুহানীকে সময় দিতে গিয়ে। তাই ছোট্ট রিহার মস্তিষ্কে ছোট থেকে জন্ম নেওয়া রুহানীর প্রতি আ*ক্রোশ ক্রমশ বাড়ছিলই। তাই আমার মনে হয় না রিহা এরকম কিছু করতে পারে। যদি করত তবে আগেই করত। তাছাড়া আমি যখন রিহার সাথে কথা বলেছি তখন রিহার চোখ মুখের রুহানীর খোঁজ পাওয়ার জন্য সত্যিই উৎকণ্ঠা ছিল। এখন আর কাকে সন্দেহের তীরে আনবো, সেটাই বুঝতে পারছি না।”

আজমল খান আরহানের কাঁধে হাত রেখে বলেন,
“এসব চিন্তা করে বের করতে হলেও তোমাকে নিজের শরীরের খেয়াল রাখতে হবে। তুমি অসুস্থ হয়ে গেলে তোমার মস্তিষ্ক কাজ করবে না। তখন তুমি কিভাবে খুঁজে বের করবে? একটু তো এসে খেয়ে নাও। ভাবো তো, রুহানী ফিরে এসে যখন জানতে তুমি এরকম অনিয়ম করেছ তখন রুহানী কি তোমাকে বাহবা দিবে?”

আরহান এবার হেসে ফেলল। সে বলল,
“উঁহু। মুখ ফুলাবে। আমার সামনেই আসবে না।”

“তাহলে চলো। একটু খেয়ে নাও। দুপুরেও খাওনি। খালি পেটে নাকি সন্ধ্যায় ব্ল্যাক কফি খেয়েছ। এতো উদাসীন তুমি!”

আজমল খান ছেলেকে টেনে উঠিয়ে খাওয়াতে নিয়ে গেলেন।

চলবে ইনশাআল্লাহ,
রিচেক করা হয়নি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

#বিবর্ণ_বৈশাখে_রংধনু (২য় পরিচ্ছেদ)
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৫
ঘুম থেকে উঠে রুহানী মাথা চেপে ধরে বসে আছে। প্রচন্ড ভার ভার লাগছে পুরো শরীর। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়ার দশা। আশেপাশে পানি খুঁজেও পানি পায় না সে। হঠাৎ তার খেয়াল হলো সে অন্য কোথাও আছে। বেশ বিলাশবহুল কক্ষে নিজেকে আবিষ্কার করে কিঞ্চিত নয়, বেশ অবাক হয়েছে রুহানী। ঘড়িতে সময় দেখল সকাল ৭ টা। দ্রুত বিছানা থেকে নেমে জানালার কাছে গিয়ে থাই খুলতে নিতেই দরজা খোলার শব্দ কর্ণগোচর হয়। পেছন ফিরে চেয়ে দেখে রাফাত!

হঠাৎ অপরিচিত জায়গায় রাফাতকে দেখে ভীষণ খুশি হয় রুহানী। রাফাত নাস্তার ট্রে হাতে ভেতরে ঢুকে টেবিলে ট্রেটা রাখতেই রুহানী তার কাছে ছুটে আসে। রুহানীর চোখে খুশি চকচক করতে দেখে রাফাত তাচ্ছিল্য হাসে। রুহানী ইশারায় বুঝাচ্ছে,
“তোমরা আমাকে কীভাবে খুঁজে পেলে? আরহান কোথায়?”

তারপর রুহানী জবাবের অপেক্ষা না করে দরজার কাছে গিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আরহানকে খুঁজতে থাকে। তা দেখে রাফাতের দাঁত কিড়মিড় করে ওঠে। রাগে সে রুহানীর হাত ধরে হেচকা টান দিয়ে নিজের সামনে এনে দাঁড় করায়। রাফাতের এহেন কঠোর ব্যবহারে রুহানী হতভম্ব নজরে তাকায়। রাফাত দাঁতে দাঁত পিষে বলে,

“আরহান নেই এখানে। বুঝতে পেরেছ? আরহান এখানে নেই। তাই ওকে খুঁজো না।”

রুহানী ইশারায় বলে,
“কোথায় ও?”

“যেখানে থাকার সেখানেই আছে।”

এই বলে রাফাত রুহানীর হাত ছেড়ে খাবারের ট্রে এর কাছে যায়। তারপর বলে,
“আসো খেয়ে নাও।”

রুহানী নিজের কাঙ্ক্ষিত জবাব না পেয়ে রাফাতের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ইশারায় বুঝায়,
“কোথায় আরহান?”

রাফাত বিরক্ত হয়ে রুহানীর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
“বললাম তো নেই। বারবার প্রশ্ন করছ কেন? খেয়ে নাও।”

রুহানীও নিজের বাক্যে বহাল রইল। সে ইশারায় বলল,
“আরহানকে ভিডিও কল করো। আমি ওকে দেখব।”

রাফাত এতোটা সময় নিজেকে কাবু করে রাখলেও এখন আর পারছে না। রুহানীকে ধা*ক্কা দিয়ে ফে*লে দিয়ে চিৎকার করে বলল,
“আরে তোকে আমি এখানে এনেছি কি আরহানের সাথে ভিডিও কলে কথা বলাতে? আমি তো আরহানকে কখনও জানতেই দিব না তুই কোথায় আছিস! তুইও আর কখনো আরহানের কাছে যেতে পারবি না। এই কথাটা কান খুলে শুনে রাখ আর মা*থায় ঢুকিয়ে রাখ। বুঝেছিস? তোকে কি*ডন্যা*প আমিই করেছি। এই লন্ডনে তোকে আনতে আমার কতোটা কা’টখোর পু*ড়াতে হয়েছে জানিস? টানা সাতাশ ঘণ্টা তুই সেন্সে ছিলি না। ইমিগ্রেশন ফাঁকি দিয়ে তোকে এখানে এনেছি। অবশ্য পাইলট হওয়াতে সুবিধা তো হয়েছেই। আমার রেফারেন্সে আমার লোকেরা তোকে এখানে আনতে পেরেছে। একদম নতুন পরিচয়ে! কিছুদিন আগেই এক অ্যা*কসিডেন্ট কে*সে চেহারা খারাপ হওয়া মৃ*ত মেয়ের পরিচয় তোকে দেওয়া হয়েছে। তাতে আমাকে সাহায্য করেছে আমারই চাচা। তোর আরহানের এতো গার্ডের সামনে দিয়ে তোকে উড়িয়ে নিয়ে এলাম কিন্তু আরহান বুঝতেই পারল না। সো স্যাড!”

রুহানী মেঝেতে বসে হতভম্ব চিত্তে বিমূঢ় হয়ে রাফাতের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। রাফাত রুহানীকে এভাবে দেখে উচ্চস্বরে হাসে। অতঃপর মেঝেতে ওর পাশে বসে দুঃখী ভাব করে বলে,

“শ*ক হয়েছ না? ইশ! কতো বড়ো ধোঁ*কা! বন্ধু যখন শত্রু! তাই না? নাকি ঘর শত্রু বিভীষণ! কোনটা? যাইহোক, এখন ভালো মেয়ের মতো খেয়ে নাও তো। তারপর তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। যা দেখে তুমি কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলবে! ওহ উফস! আমি ভুলেই যাই যে তুমি কথা বলতে পারো না! ভাষা আর হারাবে কী! ”

রাফাত এবার উঠতে নিলে রুহানী ওর শার্টের কলার ধরে চিৎকার করে কিছু বলতে চেয়ে গলায় প্রচণ্ড ব্যাথা অনুভব করায় ছেড়ে দিয়ে কাশতে শুরু করে। রাফাত দ্রুত গ্লাসে পানি ঢেলে রুহানীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

“কথা বলার এত চেষ্টা কেন তোমার? তুমি কেন মানতে চাও না? এই মৌনতাই তোমার আজীবনের সঙ্গী! এখন চুপচাপ নাস্তা খেয়ে নাও। তারপর তোমার জন্য ধা*মাকাদার কিছু আছে। যেই কারণে তুমি আজ এখানে। জানতে চাও না? কী তোমার দোষ? কেন আজ তুমি এখানে? আমি জানি তুমি জানতে চাও। তাই যা বলছি তাই করো। যদি না মানো তবে তোমার সাথে খা*রাপ কিছু হবে বলে রাখলাম।”

কথাগুলো বলে রাফাত দরজা লক করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। রুহানী মেঝেতে বসে কাঁদতে থাকে।

__________

“দেখ দোস্ত, এভাবে আর কতদিন বসে থাকবি। রুহানীর খোঁজ তো চলছেই। সেটা চলতে থাক। তুই তোর পড়ালেখা, জব এসবে আর গাফিলতি করিস না। যত ব্যস্ত থাকবি তত মন খারাপ কম থাকবে। নিজেকে ব্যস্ত রাখ। ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটগুলোতে আমি তোর জায়গায় যাচ্ছি, কিন্তু তুই অন্তত ডোমেস্টিক ফ্লাইটগুলোতে যেতে পারিস। পাইলট হয়ে আকাশে উড়া তোর শখ, তোর স্বপ্ন। তোর মন ভালো করতে পারবে এটাই। কতগুলো দিন পেরিয়ে গেল। কিড*ন্যা*পাররা এখনো কোন ফোন বা ক্লু ছাড়েনি। আমরা কি বেসিসে রুহানীকে খুঁজবো?

আরহান ফ্লোরে বসা অবস্থায় বিছানায় মাথা হেলিয়ে হতাশ চিত্তে বলে,
“ওকে কোথায় পাব রাফাত? আমার কিছু ভালো লাগছে না। সবকিছু কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। রুহানী কোথায় হারিয়ে গেল? কোথায় পাব ওকে?”

“ধৈর্য্য ধর আরহান। আমি এখন যাই। নাস্তা করব। শরীরটাও খারাপ লাগছে।”

“হু।”

আরহান কল ডিসকানেক্ট করে কৃষ্ণাভ অন্তরিক্ষে নির্নিমেষ চেয়ে রইল। গভীর রাত। ভোরের আলো ফুটতে এখনও ঢের বাকি। হঠাৎ তাহাজ্জুদের নামাজের কথা মনে পরলো। এই সময়টা তাহাজ্জুদের জন্য সর্বোত্তম। দোয়া কবুলের সময়। আরহান দ্রুত অজু করে এসে নামাজে দাঁড়ালো। নামাজের সিজদাহতে রুহানীর সহি-সালামত ফিরে আসার দোয়া করল।

অপরদিকে রহমত শেখ ও তার স্ত্রী তাহাজ্জুদের নামাজ শেষ করে বসেছে। জাহানারা শেখ পানি খেতে বেড সাইড টেবিল থেকে জগ নিয়ে দেখেন তাতে পানি নেই। তিনি স্বামীকে বললেন,
“আজ মনে হয় পানি রাখতে ভুলে গেছে।”

“আচ্ছা আমি এনে দিচ্ছি।”

এই বলে রহমত শেখ জগটা নিয়ে নিচে ডাইনিং টেবিলের কাছে যান। জগে পানি ভরে আসার সময় রিহার ঘরের দরজার নিচ দিয়ে আলো জ্বলতে দেখে সেদিকে যান। রিহা এখন একা ঘরে। ওর স্বামী তিন দিন ছিল তারপর কাজ পরাতে ফিরে গেছে। রহমত শেখ দরজার টোকা দিলেন। বার কয়েক টোকা দেওয়ার পরেও দরজা না খোলাতে তিনি ফিরে যেতে সিঁড়ির কাছে যেতেই দরজা খুলে রিহা বেরিয়ে এলো।

“বাবা, তুমি এতো রাতে?”

রহমত শেখ পেছনে ঘুরে দেখেন তার মেয়ে শুভ্র হিজাব পরিহিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে। রহমত শেখ কিঞ্চিত অবাক হলেন। তিনি জিজ্ঞেসা করলেন,
“তোমার ঘরের আলো জ্বলছিল। তাই ভাবলাম, কী করছিলে? দেখতে এলাম।”

“ওহ আচ্ছা। নামাজ পড়ছিলাম।”

মেয়ের জবাব পেয়ে রহমত শেখ অবাক হলেও ভীষণ খুশি হলেন। তিনি মুচকি হেসে সিঁড়ি দিয়ে উপরে চলে গেলেন।

________

কিছু সময় পর রাফাত রুহানীর ঘরে এসে দেখল রুহানী খাবার খায়নি। শুধু পানিটুকু খেয়েছে। এখন সে জানালার পাশে হেলান দিয়ে নিরলস বসে আছে। রাফাত মুখাবয়বে কোনো প্রতিক্রিয়া পদর্শন করল না। রুহানীর থেকে খানিক দূরত্বে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল,
“খাওনি তাই না? এই কয়েকদিন পানির সাথে ড্রা**গ মিশিয়ে দিলে ঠিকই খেয়ে নিতে। আজ ভাবলাম, তোমাকে হুঁশে রাখা জরুরী। যাইহোক, চলো। তোমার সারপ্রাইজ দেখিয়ে আনি।”

রুহানী ভাবশূণ্য ভঙ্গিতে পূর্বের ন্যায়ই বসে আছে। যেন রাফাতের কোনো কথা তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি। রাফাত ওর এমন ব্যবহার দেখে হুট করে বলে ওঠল,
“সাফাকে মনে আছে?”

রুহানী হঠাৎ সাফার নাম শুনে চট করে রাফাতের দিকে ফিরল। রাফাত মাথা নুইয়ে তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“মনে থাকবে না আবার! যার জীবন তছনছ করে দিয়েছ, তাকে ভুলবে কী করে? তাই না?”

রুহানী জানালার পাশ থেকে উঠে রাফাতের সামনে এসে দাঁড়ায়। অতঃপর ইশারায় বলে,
“কী বলতে চাইছ? আমি কী করেছি?”

রাফাত তাচ্ছিল্য হেসে জানালার দিকে অগ্রসর হয়ে পকেটে হাত গুঁজে বাহিরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলে,
“হাহ্! এখন জানো না? তুমি তো আবার সবকিছু না জেনেই করো!”

রাফাতের কথার এতো পহেলি রুহানীর মস্তিষ্ক বুঝতে পারছে না। সে রাফাতের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে রাফাতকে নিজের দিকে ঘুরায়। তারপর খোলশা করে বলতে বলে। রাফাত রুহানীর চোখের দিকে কয়েক সেকেন্ড নিষ্পলক চেয়ে থেকে কোনো মৌখিক জবাব না দিয়ে হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়। পাশের ঘরে নিয়ে একপ্রকার ছুঁ*ড়ে ফেলে। তারপর বলে,
“নিজের চোখেই দেখে নাও।”

ছুঁড়ে ফেলার দরুণ রুহানী হাতে ব্যাথা পেয়েছে। ব্যাথায় চোখ-মুখ কুঁচকে উঠে বসে দেখে বিছানায় কেউ একজন শুয়ে আছে ও বিভিন্ন মেডিকেল যন্ত্রপাতি লাগানো। তা দেখে তার কৌতুহলী মনের ইচ্ছায় উঠে দাঁড়ায়। বিছানায় শুয়ে থাকা ঘুমন্ত মানুষটাকে দেখে রুহানী দুই পা পিছিয়ে যায়। অবাকতার রেশে মুখে হাত চলে যায় তার। রাফাতের দিকে তাকিয়ে আঙুল বরাবার বিছানায় শুয়ে থাকা মানুষটাকে দেখালে রাফাত ভাঙা স্বরে বলে,

“হ্যাঁ ও সাফা। দেখেছ ওর কী অবস্থা? টানা এক মাস হসপিটালে মৃত্যুর সাথে ল*ড়াই করে সে এখন কো*মাতে।আমার ছোটো হাস্যজ্জ্বল বোনটার জীবনে তুমি অমাবস্যার গ্রহণ হয়ে এসেছ। আই হেইট ইউ রুহানী শেখ। আই হেইট ইউ।”

রুহানী হতবাক হয়ে একবার রাফাতের দিকে তাকায় তো একবার ঘুমন্ত সাফার দিকে তাকায়।

চলবে ইনশাআল্লাহ,