#বিবাহিতার সাতকাহন
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১১
চোখ খুলতেই ভয় পেয়ে গেলাম। ঝাঁপসা চোখগুলো আনমনে হয়ে নুহাশের মলিন ক্লান্ত মুখটার দিকে তাকাল। ভেবেছিলাম পাশের বাসার ছেলেটা রুমে ঢুকে পড়ল না তো! সে ভেবে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এখন কিছুটা শান্ত লাগছে এটা ভেবে যে নুহাশ আমার পাশে বসা। তবে নুহাশের ক্লান্ত চেহারাটা আমাকে ভীষণ পিড়া দিচ্ছে। হালকা গলায় কিছু বলার আগেই নুহাশ বলে উঠল
“এভাবে দরজা খুলে শুয়ে ছিলে কেন? কোনো অঘটন ঘটার সম্ভবনা যদিও নেই। কারণ এ এরিয়ায় সব পুলিশ পরিবার থাকে। চোর ঢুকার সাহস পাবে না। তবুও তো অঘটন বলে কয়ে আসে না। কখন কী ক্ষতি হয়ে যায় বলা যায় না। তাই সবসময় সাবধান থাকায় উচিত।”
আমি হালকা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম
“সত্যি বলতে জার্নি করে এসেছি। আর খুব ক্লান্ত ছিলাম। সব মিলিয়ে আমার শরীরটা নেতিয়ে পড়েছে। কখন যে চোখ লেগে আসলো টেরই পাই নি। আর তুমি তো বলেছিলে ডিউটিতে থাকবে। আসতে দেরি হবে। তাহলে এত দ্রুত চলে আসলে কীভাবে?”
নুহাশ হেসে উত্তর দিল
“কেন দ্রূত আসাতে খুশি হওনি বুঝি?”
আমি লজ্জা মাখা মুখে উত্তর দিলাম
“খুশি কেন হব না? বরং একটু বেশি খুশিই হয়েছি। একা একা ভীষণ ভয় ও লাগছিল। পাশের বাসার আন্টি এসে অনেকক্ষণ কথা বলে গেল। কিছু দরকার লাগলে আনতে বলল। ভালোই সবাই। তবুও তোমাকে ছাড়া ভীষণ একা লাগে। অদ্ভুত এক মায়া তোমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। নুহাশ আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবে?”
নুহাশের বুঝার ক্ষমতা হয়তো ছিল না আমার কথার গভীরতা বুঝার। সে বিরক্ত গলায় উত্তর দিল
“মুমু এখন কিছু সম্ভব না। আমি অনেক ক্লান্ত। একটু ঘুমানো দরকার।”
বলেই শুয়ে পড়ল। আমার ক্লান্ত চোখগুলো তার দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকাল। আমার আবদার ছিল কী আর সে বুঝল কী। ছোটো ছোটো ভালোবাসার খন্ড রোমান্স গুলো সে কী কখনও বুঝবে না নাকি বুঝেও না বুঝার ভান ধরে থাকবে। আমি আর কথা বাড়ালাম না। বেহায়ার মতো শুয়ে তাকে জড়িয়ে ধরতে নিলাম। সে আমার হাত, পা সরিয়ে দিয়ে বলল
“মুমু আমাকে এভাবে ধরো না। গায়ে সুরসুরি লাগে। আমি একা থেকে অভ্যস্ত। কারও স্পর্শ পেলে ঘুমাতে পারি না। আনইজি লাগে।”
আমি ওপাশে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পড়লাম। আশা ছিল নুহাশ এসে আমাকে ঝাঁপটে ধরবে। তবে সে আশায় আশা রয়ে গেল। চুপচাপ শুয়ে শূন্যতায় ভুগে, শূন্য চোখে ঘুম পূন্য হয়ে আসলো। চোখ দুটোতে রাজ্যের ক্লান্তি যেন নেমে আসলো। নুহাশের সাথে আমার বয়সের পার্থক্য ভালোই। তাই হয়তো নুহাশ এ যুগের চাওয়া পাওয়া রোমান্স ভালোবাসা কম বুঝে৷ নাহয় তার হয়তো এসব বুঝার ক্ষমতা হয়ে কখনও উঠে না।
লাল আভা পশ্চিম আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে। সকাল হয়েছে জানান দিচ্ছে। কপালটা কুচকে উঠলাম। নিজেকে বেশ শান্ত শীতল লাগছে। দরজার খটখট আওয়াজ কানে আসছে। আমি বিছানা ছেড়ে উঠলাম। নুহাশ এখনও ঘুমাচ্ছে। আমি তাকে আর ডেকে তুললাম না। সরাসরি দরজার কাছে গেলাম। এলো চুলগুলো কোনোরকম খোপা করলাম। তারপর জোর গলায় বললাম
“কে?”
ওপাশ থেকে হালকা আওয়াজ আসলো
“আপু পাশের বাসা থেকে পিয়াস। মা নাস্তা পাঠিয়েছে সেটা দিতে এসেছি।”
আমি দরজাটা খুললাম। হাতে টিফিন বক্স নিয়ে পিয়াস দাঁড়িয়ে। আমাকে পিয়াস দেখেই হালকা হেসে খাবার গুলো বাড়িয়ে দিয়ে বলল
“আপনাদের জন্য। আর কিছু লাগলে আমাকে বলবেন।”
তারপর একটা কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে বলল
“এখানে আমার নম্বর আছে। আপনার যা লাগে আমাকে বলবেন।”
আমি কাগজটা হাতে নিয়ে, খাবার গুলো নিয়ে মাথা নেড়ে দরজা লক করে দিলাম। নিজেকে ফ্রেশ করে নিলাম। এর মধ্যেই নুহাশ উঠল। আমাকে ডেকে বলল
“মুমু নাস্তা বানানোর প্যারা আজকেই নিতে হবে না। আমি বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসতেছি।”
আমি নুহাশকে আটকে দিয়ে বললাম
“তা আর দরকার হবে না। পাশের বাসার আন্টি খাবার পাঠিয়েছেন। তাই খেয়ে নিলেই হবে। তুমি কি অফিসে চলে যাবা এখন?”
” তা তো যেতেই হবে। রাতে কিছু একটা বলে ডিউটি না করে চলে এসেছি। এখন তো আর বাহানা দিলে চলবে না। যা আছে তাই দাও। ”
আমি খাবার গুলো গুছিয়ে টেবিলে দিলাম। নুহাশকে খেতে দিলাম। আশা করছিলাম সে আমাকে বলুক মুমু তুমিও পাশে বসে খাও। তবে সে সেটা না বলেই গপাগপ খেয়ে নিল। তারপর বের হতে নিল। বের হওয়ার আগে আমি তার কাছে একটা উষ্ণ ছোয়া আশা করছিলাম। তবে সেটাও নিরাশায় পরিণত হলো। মেয়েদের এক্সপেকটেশন সত্যিই অনেক বেশি। তারা টাকা পয়সা চায় না। তারা দামি দামি গহনা চায় না। তবে তারা ভালোবাসা পেতে চায়। একটা ছোট্ট ফুল, ছোট্র ঠোঁটের ছোয়া, উষ্ণতায় মাখানো জড়ানো আবেশ। এগুলো সত্যিই মেয়েরা বেশি করে চায়। বিশেষ করে অতি আবেগী মেয়েরা। আমার মতো মেয়েদের তো টাকা দিয়ে ঘায়েল করা যায় না বরং ভালোবাসার উষ্ণ আবেশ দিয়ে ঘায়েল করা যায়। এই যে চাওয়ার পর না পাওয়া ঘিরে ধরে সেটা মেনে নিতেও বড্ড কষ্ট হয়। অনেকটা বুকে চিনচিন করে ব্যথা করতেছে। মুখটায় মলিনতা ফুটে উঠল। মলিন মুখেই দরজাটা বন্ধ করে টেবিলে এসে খেতে বসলাম।
এর মধ্যেই দরজায় খটখট আওয়াজের শব্দ। ভাবলাম নুহাশ এসেছে। তবে দরজা খুলে লক্ষ্য করলাম পাশের বাসার আন্টি এসেছে। হাতের দিকে টিফিন বক্সটা এগিয়ে দিয়ে বলল
“সকালে নাস্তা বানানোর প্রেসার নিতে হবে না। এখানে তোমার আর নুহাশের জন্য খাবার আছে খেয়ে নিও।”
আন্টির কথা শুনে কিছুটা অবাক হলাম। কারণ পিয়াস একটু আগে খাবার দিয়ে গিয়ে বলল আন্টি পাঠিয়েছে তাহলে আন্টি আবার খাবার পাঠাল কেন। এসব ভাবতে ভাবতেই খাবার গুলো হাতে নিয়ে আন্টির পেছন দিকে তাকালাম। লক্ষ্য করলাম পিয়াস দাঁড়িয়ে। এক কানে হাত দিয়ে আরেক হাত দিয়ে না করছে কিছু বলার জন্য। আমি চুপচাপ খাবার গুলো হাতে নিয়ে আন্টিকে ভেতরে আসতে বললাম। আন্টি তাড়া দিয়ে বলল
“না রে মা আমার কাজ আছে। পরে আসব আবার এখন গেলাম।”
একথা বলে আন্টি চলে গেল। আমি পিয়াসের দিকে ত্যাড়া চোখে তাকিয়ে বললাম
“আমাকে একটু আগে যে খাবার দিয়ে গেলে সেগুলো কে দিছে তুমি নাকি তোমার মা। আর এমন করলে কেন?”
পিয়াস মাথা নীচু করে বলল
“আমিই এনেছিলাম আপনাদের জন্য। এটা মাকে বলবেন না। আপনাকে দেখলে অনেক মায়া লাগে তো তাই। প্লিজ কিছু মনে করবেন না।”
আমি পিয়াসের দিকে কড়া চোখে তাকালাম। আমি বুঝতে পারছি না ছেলেটা চাচ্ছে কী। তাই বেশ কড়া গলায় বললাম
“তুমি দ্বিতীয়বার আর এমন করবে না। আজকে করেছো আমি কিছু মনে করে নি। পরের বার এমন করবে না। মনে থাকবে?”
পিয়াস মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। আমি দরজাটা লাগাতে নিলেই সে মাথা নীচু করে আবার বলে উঠল
“আপনাকে অনেক সুন্দর লাগে।”
কথাটা বলে সে দৌড়ে চলে গেল। আমি বোকার মতো দরজাটা লাগিয়ে রুমে আসলাম। বুঝতে পারছি না পিয়াস এমন কেন করছে। কী চলছে তার মনে। মনে শুধু এসবেই চলছে। সাত পাঁচ, নয় ছয় ভেবে খাবার খেতে লাগলাম।
কিছুক্ষণ পর বাজার নিয়ে আসলো এক কাকা। নুহাশ পাঠিয়েছে। দুপুর গড়িয়ে আসছে। রান্না করতে হবে। রান্নায় খুব একটা পারদর্শী না আমি৷ কারণ আমি পরিরবারের সবার ছোটো মেয়ে তাই কাজ খুব একটা করিনি কখনও। তাই রান্নার হাত পাকা না।
তবুও কোনোরকম সাহস করে কাটাকুটি রান্না বসাতে লাগলাম। গ্যাসের বার্নার জ্বালাতে গিয়ে যেন হাত কাঁপছে। কোনোরকম গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে নিলাম। তারপর রান্না বসালাম। ভাত প্রায় হয়ে এসেছে। মাড় গালতে নিয়ে হাতে পড়ে গেল। হাতটা জ্বলে পুড়ে যেন ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছে। হাত দুটো ঠান্ডা পানিতে ধুয়ে নিলাম। তারপর দুটো হাতে টুথপেস্ট মেখে নিলাম। হাত দুটো ফ্যানের নীচে দিয়ে রাখলাম। একটু আরাম পাচ্ছি তবে জ্বলছেও প্রচুর।
কলিং বেলের আওয়াজটা আবারও বেজে উঠল। দৌঁড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখলাম পিয়াস দাঁড়িয়ে। কিছুটা রেগে গিয়ে কিছু বলতে নিব এমন সময় মুখটা যেন বন্ধ হয়ে গেল। বিদ্যুৎ এর শক যেন সারা শরীরে ঝিম ধরিয়ে দিল।
কপি করা নিষেধ