#বিয়ে
#লেখনীতে- ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৪
শায়লা চোখ টিপে হেসে বললেন,
— আমার ছেলে তোকে দেখে কবে যে দিন-দুনিয়া ভুলে যাবে আমি শুধু সেটাই ভাবছি!
অদ্রি শুধু হাসার চেষ্টা করলো। অমনি দরজা থেকে ভেসে আসলো ধ্রুবের গলা,
— তোমার এই মেয়েকে দেখে দিন-দুনিয়া ভুলে যাবে এই ধ্রুব? এই স্বপ্ন শুধু দেখেই যাও। এই দিন যেদিন আসবে সেদিন তোমরা যা বলবে আমি তাই করবো। নিজেকে যে কি ভাবে! হাহ,পাগলের সুখ মনে মনে!
বলেই ধ্রুব বাঁকা হাসলো। আর অদ্রি খিটমিট করে চাইলো ধ্রুবের প্রতি! শায়লা বোকার মতো দুজনকে দেখছে। তারপর মুখে কাঠিন্যতা এনে ওঠে দাঁড়ালো। ধ্রুবের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
— সেদিন আমরা যা বলবো তাই করবে?
ধ্রুব ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
— অবশ্যই।
— তাই? মনে থাকবে তো নাকি আবার পরে ভুলে যাবে?
ধ্রুব কনফিডেন্স নিয়ে বলল,
— যাবো না।
বলেই ধ্রুব অদ্রির দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। নিজ ঘরের দিকে পা বাড়ালো। অদ্রি প্রথমে একটু রেগে গেলেও নিজের মাথা ঠান্ডা রাখলো। ধ্রুব’র কথায় ওর কিছু যায় আসে না। তাই ওকে তেমন পাত্তা দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই, এমনকি আজ থেকে ধ্রুবকে সে আরো বেশি ইগনোর করবে! এদিকে শায়লা বিরক্তি নিয়ে ছেলের চলে যাওয়া দেখলেন। দরজাটা ভিড়িয়ে এসে অদ্রির প্রতি মনোযোগ দিলেন। ওকে জামা বেছে নিতে সাহায্য করলেন। অদ্রির লাগেজটা সে নিজেই গুছিয়ে এনেছে। মায়ের দেওয়া সব জামা, স্মৃতি নিয়ে এসেছে। বাবার দেওয়া কোনোকিছু এমনকি ফোনটা পর্যন্ত অদ্রি আনে নি। ফ্রেশ হয়ে এসে সেখান থেকে সুন্দর ফুলের কাজ করা লাইট পিংক একটা জামা পরলো অদ্রি। সাজলো না একটুও। তার জীবন এখন রংবিহীন। শায়লা ওকে দেখে বলল,
— মাশাল্লাহ! তুই জানিস তুই আসলেই একটা পুতুল?
অদ্রি লজ্জা পেয়ে বলল,
— মোটেও না।
— কেন? আগে কখনো কেউ বলেনি তোকে? এই তোর কোনো ছেলেবন্ধুও না?
অদ্রি থতমত খেয়ে বলল,
— আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড ছিলো না। এমনি ছেলেবন্ধু ছিলো।
শায়লা হেসে বলল,
— ধুর বোকা। জীবনে একটা প্রেমও করলি না কেমন মেয়ে তুই!
অদ্রি লজ্জা পেল,
— কি যে বলো না! তবে অনেক চিঠি পেয়েছি। কিন্তু কেউ সামনে এসে সাহস করতো না বলার।
শায়লা আফসোসের সুরে বলল,
— আহারে…
অদ্রি হেসে ফেললো। শায়লা তাড়া দিয়ে বলল,
— চল চল নিচে যাই। সবাই তোকে দেখতে হাসফাস করছে। আমিও বলে দিয়েছি আমার মেয়েকে বাজে কথা একদম না বলতে।
শায়লা অদ্রিকে নিয়ে নিচে এলো। অদ্রি সবাইকে সালাম দিলো, কুশল বিনিময় করলো। সবাই বলাবলি করলো মেয়ে খুবই সুন্দর, আদবকায়দা ভালো। কি সুন্দর সালাম দিচ্ছে। আজকালকার মেয়ে-বৌ’রা এসব ভদ্রতা জানে নাকি! অদ্রি সবার সাথে বসে গল্প করলো, অনেকের টুকটাক প্রশ্নের উত্তর দিতে লাগলো।
এদিকে দুপুরের খাবারের সময় হয়ে যাওয়ায় শায়লা জরিনাকে নিয়ে সব টেবিলে সাজাচ্ছেন। জরিনা এই বাড়ির সব কাজে শায়লাকে সাহায্য করে। বয়স ১৭। ছুটিতে গ্রামে গিয়েছিলো, ধ্রুবের বিয়ের খবর শুনে আজ ভোরেই এসে হাজির। অদ্রিকে তার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। বারবার গিয়ে ওর কি লাগবে না লাগবে তা জিজ্ঞেস করছে। এমন সময় আশফাক সাহেব এসে শায়লাকে জিজ্ঞেস করল,
— ধ্রুব কোথায়? এখনো ওঠেনি?
— ওঠেছে অনেক আগেই৷ দেখো গিয়ে ছাদে জিম করছে।
আশফাক সাহেব অবাক হয়ে বলল,
— এই ভরদুপুরে?
জরিনা জবাব দিলো,
— তা নয়তো কি খালুজান? ছাদে কাপড় দিতে গিয়া দেখলাম জিম করতাছে ভাইজানে। আমিও দেইখা পাশ কাটিয়ে চইলা আইছি। হুহ, বউরে মানবো না
কইলেই হয় নাকি!
শায়লা বলল,
— আমি ওকে এড়িয়ে চলার চেষ্টাই করছি!
আশফাক সাহেব মৃদু হাসলেন,
— ঠিক করেছো। কয়েকদিন এড়িয়ে চললেই বুঝতে পারবে নিজের ভুল।
— আমি এসব সিরিয়াসলি করছি না। যাতে অদ্রিকে মেনে নেয়, শত হলেও আমার একটা ছেলে।
— আমি তোমার পাশে আছি।
শায়লা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
— মাঝেমাঝে মনে হয় বিদেশে না গেলেই ভালো হতো।অন্তত ওর মধ্যে এই বিষয়গুলো নিয়ে অনীহা তৈরি হতো না। ওখানকার কালচারে ও অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে তাই এরকম একলা জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো তা আমি বেশ বুঝতে পেরেছি।
আশফাক সাহেব সহমত জানালেন,
— এখন আর কি করা! যার মন যেখানে যায়।
শায়লা বলল,
— যাইহোক, খাবার রেডি। সবাইকে খেতে ডাকো। আমি অদ্রিকে নিয়ে আসি। মেয়েটা কখন থেকে না খেয়ে আছে!
আশফাক সাহেব বললেন,
— ধ্রুবকে ডেকে নিয়ে আসি?
শায়লা বারকোশে মাংস সাজাতে সাজাতে উত্তরে বললেন,
— যাও। তবে বেশি আস্কারা দিও না। তুমিও একটু এড়িয়েটেরিয়ে চলবে। বুঝলে?
আশফাক সাহেব স্ত্রীর বুদ্ধি শুনে হেসে বললেন,
— তুমি পারোও বটে!
জরিনা বলল,
— দেখতে হইবো না খালাম্মাডা কার! এত সুন্দর বউ
আইনা দিছে এরপরেও নাকি ছেলে গো ধইরা বইয়া রইছে। এই আমি জরিনা কইয়া দিলাম, দুইদিনে
আপনেগো ছোড়া বউয়ের আঁচল ধরলো বইলা।
জরিনার মিষ্টি কথাবার্তা শায়লার ভারি মজা লাগলো। এজন্যই এই জরিনাকে এত পছন্দ তার। একবছর আগে দেশে ফেরার পর ওর সাথে মিলে কত কূট বুদ্ধি করেছে, ওকে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে তা শুধু সে-ই জানে। শায়লা তড়িঘড়ি করে সব কাজ শেষ করতে তাড়া দিলেন জরিনাকে। তারপর অদ্রিকে নিয়ে ডাইনিংয়ে এলেন। মেহমানরাও সবাই চলে এলো। গল্পগুজব, আড্ডায় মেতে ওঠলো পরিবেশ। অদ্রি এত হৈ-হুল্লোড় উপভোগ করছে। শায়লা ওকে লোকমা তুলে খাইয়ে দিচ্ছেন। অদ্রি মনে মনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো শায়লার প্রতি। আশফাক সাহেব ধ্রুবকে নিয়েই ডাইনিংয়ে এলেন। আর ধ্রুব শুধু বাবার কথা রাখতেই এসেছে। সবার সাথে সঙ সেজে হুল্লোড় করা ওর একদম অপছন্দ! মেহমানরা ওকে দেখে সবাই হল্লা বন্ধ করে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। ধ্রুব এত হুল্লোড় পছন্দ করে না, রাগও বেশি। কখন কার মুখের ওপর জবাব দিয়ে দেয় সেজন্য আত্মীয়রা ওকে বেশি ঘাটায় না। একমাত্র বাবা-মা’কেই ধ্রুব সমীহ করে চলে। ওদের ছাড়া অন্য কারো কথা ও খুব কমই রেখেছে। ধ্রুব টেবিলের ফাঁকা চেয়ারটাতে বসে পড়লো। জরিনা ওর প্লেটে খাবার তুলে দিতেই ভ্রু কুঁচকে তাকালো ওর দিকে।
জরিনা দাঁত বের করে হেসে বলল,
— খালাম্মা তার মাইয়ারে খাওয়াইতাছে। আজ থেইকা আমি আফনের ওয়েটার ভাইজান।
ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত ধ্রুবের প্লেটে
খাবার তুলে দেয় তার মা শায়লা। আজ পর্যন্ত এর
ব্যতিক্রম ঘটেনি। এই প্রথম ধ্রুব চেয়ে দেখলো তার সামনে বসেই তার মা অদ্রিকে নিজ হাতে তুলে
খাইয়ে দিচ্ছে। আর ওর খাবার বেড়ে দিচ্ছে কি-না এই জরিনা! দৃশ্যটা যে কতটা বিষাক্ত তা টের পেলো ধ্রুব।
মা তাহলে প্রতিশোধ নিচ্ছে? ভালোবাসা ভাগ করে দিচ্ছে তার নতুন মেয়েকে? ধ্রুবকে একদিনেই
পর করে দিলো? মা কিভাবে পারলো এটা? কষ্টে
ধ্রুবের বুক জ্বলছে। বুকে হাত দিয়ে চাপ অনুভব করতেই জরিনা চেঁচিয়ে ওঠলো,
— ভাইজানের কি হার্ড-এটাক হইছে?
ধ্রুব বুক থেকে দ্রুত হাত সরিয়ে বলল,
— হোয়াট দ্যা ল্যাঙ্গুয়েজ? হার্ড এটাক না হার্ট-অ্যাটার্ক।
রাস্কেল।
জরিনা ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে বলল,
— বুঝলেই হইছে। তয় আফনের কি কষ্ট হইতাছে নি? এমনে বুকে হাত দিয়া বইয়া আছেন কেন?
ধ্রুব ধমকে ওঠল,
— সামনে থেকে যাও নয়তো খু’ন করে ফেলবো কিন্তু।
মাথা খেয়ে দিচ্ছে একদম।
ধমক খেয়ে জরিনা চুপসে গেলো। সে দূরে সরে
পোলাওয়ের বাটি হাতে দাঁড়িয়ে রইলো। ধ্রুব বিরক্ত
হয়ে বলল,
— এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? যেতে বলেছি না?
অসহ্যকর মেয়ে একটা।
জরিনা আবারও দাঁত বের করে বলল,
— যতই বকেন কাম হইবো না। এই জরিনা পাইপাই কইরা যেমন কাম করে, তেমন পাইপাই ট্যাহা
নেয়। আজ থেইকা যহন আমিই আফনের
ওয়েটার তহন আফনের খাওন দেহার দায়িত্ব আমার। কহন কি লাগে না লাগে। উহু.. নড়মু না আমি এইহান থেইকা।
ধ্রুব’র হতাশ হয়ে খাবারে মন দিলো। মেহমান সবাই চুপ করে তামাশা দেখছে। আশফাক সাহেব অননেক কষ্টে হাসি চাপছেন। আর শায়লা এসবে ভ্রুক্ষেপ না
করে অদ্রিকে চিকেন ছিঁড়ে মুখে তুলে দিচ্ছেন। ধ্রুব আড়চোখে সবকিছু দেখলো আর ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে লাগলো। হঠাৎ অদ্রির চোখে চোখ পড়লো। চোখ আটকে গেলো ধ্রুব’র। মেয়েটাকে কি স্নিগ্ধ লাগছে! এতক্ষণ তো খেয়াল করেনি। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে ধিক্কার দিলো। এসব কি ভাবছে সে?
অদ্রির প্রতি নিজের রাগ বোঝাতে চাইলো দৃষ্টিতে,
কিন্তু অদ্রি এসবে মোটেও ভ্রুক্ষেপ করলো না। ধ্রুব মনে মনে ঠিক করলো সুযোগ পেলে অদ্রিকে সে দেখে নেবে। এতটুকু মেয়ে কিভাবে ওকে চোখ রাঙায়? সাহস হয় কীভাবে? এসব আদিক্ষেতা আর সহ্য হচ্ছে না ওর। দ্রুত খাবার খেয়ে এখান থেকে যেতে হবে ভেবে তাড়াহুড়ো করে যেইনা মুখে খাবার তুললো ওমনি গলায় আটকে গেলো। জরিনা মুখের সামনে পানির গ্লাস ধরে বলল,
— ভাইজান পানিডা খাইয়া লন। মনে হয় চুরি কইরা
কিছু খাইছিলেন।
ধ্রুব পানি খেয়ে রেগে বলল,
— মানে?
জরিনা কাচুমাচু হয়ে বলল,
— চুরি কইরা খাইলে নাকি গলায় আটকায়। আমাগো
গেরামের মানুষ কয়।
ধ্রুব বাক্যহারা হয়ে গেলো। এইখানে থাকলে নিশ্চিত জরিনা তার হাতের থাপ্পড় খাবে সেজন্য খাবার
শেষ না করেই ও ওঠে গেলো। একসময় আশফাক সাহেব মেহমানদের নিয়ে নিজের মতো খেয়ে ওঠে গেলো। সবাই যেতেই শায়লা এবার হেসে ফেললেন। জরিনাকে বললেন,
— তোর এই ওয়েটারের বুদ্ধিটাও দারুণ রে। আমিতো ছেলের চেহারার দিকে তাকাতেই পারছিলাম না।
হিংসায় ফেটে পড়ছিলো।
জরিনাও বেজায় ভাব নিয়ে বলল,
— আমার পেলেন সাকসেসফুল হইবোই।
অদ্রি ওদের কান্ড দেখে বেশ মজা পাচ্ছে। ধ্রুবকে নিয়ে ওর তেমন মাথাব্যথা নেই। লোকটা যে এই বিয়ে মেনে
নেয়নি সেটা ও ভালো করেই জানে। তাতে ওর কি?
অদ্রি নিজেও মন থেকে বিয়েটা মানতে পারছেনা। কিন্তু শায়লার এসব দুষ্টুমি আর মা-বোধক আচরণ
অদ্রির অনেকটাই ভালো লাগছে। জরিনাকেও ওর ভালো লাগছে। ধ্রুব’কেই শুধুমাত্র ওর ভয়ানক বিরক্ত লাগছে। জেদি, রাগী আর সবকিছুতে হম্বিতম্বি করা এধরণের ছেলেদের অদ্রি মোটেও পছন্দ করে না। খাওয়া শেষ করে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য ওপরে চলে গেলো অদ্রি। আপাতত শায়লার ঘরেই থাকছে ও। ব্যলকনির ফুলের গাছগুলো দেখতে দেখতে আচমকা চোখ পড়লো লনের বেঞ্চে বসে ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে ওর দিকে!
[ আপনারা নিজেদের মন্তব্য খুব কম জানান, তাতে লেখার আগ্রহ কমে যায়। সবাইকে জানানোর অনুরোধ রইলো। ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]
চলবে…