বিরোধীদলীয় প্রেম
পর্ব – ১৯
আফরোজা আক্তার
[দয়া করে কেউ কপি করবেন না]
সা’দ যখন মাহাকে নিয়ে একটা বাড়ির সামনে যায় তখন সন্ধ্যা। সূর্য ডুবে গেছে। চারদিক অন্ধকার হচ্ছে। অল্প সংখ্যক পাখি আকাশে উড়ছে। সম্ভবত ওদের নীড়ে ফেরার সময় হয়েছে। সা’দ মাহার হাত ধরে টানতে টানতে বাড়ির ভেতরে যায়। সেখানে মধ্যবয়সী একজন মহিলা সা’দকে দেখে এগিয়ে আসেন। সা’দের কাছে এসে হাসিমুখে বলে, ‘কেমন আছো সা’দ বাবা। কতদিন পর আসলা।’
সা’দ সালাম জানিয়ে মাহাকে তার বউ বলে পরিচয় করায়।
‘রানু খালা আজ রাতটা এখানেই থাকব। রাতের খাবারটা আপনি নিজ হাতে রান্না করবেন।’
এ কথা শুনে রানুর হাসি যেন থামে না। তিনি বলেন, ‘নতুন বউ নিয়া আসছ। আমারে আগে ফোন করবা না? দেখো তো, কী রান্না করি এখন আমি?’
‘কিছু না থাকলে আলু ভর্তা করবেন। আমি উপরে যাচ্ছি।’
মাহাকে নিচে রেখেই সা’দ উপরে চলে যায়। মাহার সামনে এসে রানু বললেন, ‘বাহ! কী সুন্দর গো তুমি! বিয়ের পর এই প্রথম আসলা এই বাড়ি।’
মাহা কিছুই বুঝতে পারছে না। এটা কার বাড়ি। সা’দ কেন তাকে এইখানে নিয়ে এসেছে। সব কিছু তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ডাইনিং টেবিলের ওপর হ্যান্ড ব্যাগটা রেখে মাহা রানুকে জিজ্ঞেস করে, ‘এটা কার বাড়ি?’
রানু হালকা ভ্রু কুঁচকে হাসেন। বলেন, ‘ও মা! কার বাড়ি মানে। এইটা সা’দ বাবার বাড়ি। এমন আরেকটাও বাড়ি আছে। ওইটা সায়েম বাবার। বড় সাহেব তার দুই ছেলের জন্য দুই জায়গায় এমন দুইটা বাড়ি বানাইছে। বড় সাহেব হইলেন সৌখিন মানুষ। শখ করে দুই ছেলেকে দুইটা বাড়ি উপহার দিছেন। সা’দ বাবা আগে এইখানে অনেক আসত। বিয়ের পর আর আসে নাই। আজকে আসল তোমারে নিয়া।’
মাহা এখনও ভাবছে তাকে এখানে কেন এনেছে সা’দ। রানু খালা রান্নাঘরে যাওয়ার পর মাহা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে। ডানে বামে সব মিলিয়ে পাঁচটা ঘর। মাঝে বিরাট বড় লাউঞ্জ। ডান পাশে একদম কর্ণারের ঘরে আলো জ্বলতে দেখে মাহা সেদিকেই এগোয়। দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই দেখে সা’দ স্লাইড ডোর খুলে সিগারেট টানছে। মাহা ভেতরে প্রবেশ করে। স্লাইড ডোরের অপর পাশে লম্বা বারান্দা। মাহা সেখানে দাঁড়িয়ে সা’দের মুখোমুখি হয়। বলে, ‘আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছ সা’দ?’
সা’দ মাহার কথার পাত্তা না দিয়ে আপন মনে সিগারেট টানছে। সা’দের এই এড়িয়ে চলা মাহাকে ক্ষতবিক্ষত করে। এবার মাহা সা’দের পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরে। বলে, ‘আমার প্রশ্নের জবাব দাও। আমাকে কেন নিয়ে এসেছ এখানে? আমি৷ বাড়ি যাব।’
সা’দ তখনও চুপচাপ। সা’দের এই নীরবতা মাহার সহ্য হচ্ছিল না। সে দেয়ালে একটা ঘুষি মেরে ঘর থেকে বের হতে নিলেই সা’দ তাকে আঁটকায়। সা’দ ভেবে পায় না এইটুকু মেয়ের এত শক্তি কোথা থেকে আসে। এত রাগ কেন তার শরীরে। সা’দ মাহার হাত ধরে দরজার পাশে থাকা দেয়ালে চেপে ধরে। বলে, ‘এত তেজ কেন শরীরে, হ্যাঁ।’
মাহার চোখে ততক্ষণে পানি জমে গেছে। সে বলে, ‘তুমি কী মনে করো। তেজ তোমার একারই আছে?’
‘পুরুষ রাগলে বাদশা আর নারী রাগলে কী হয়, জানো তো।’
‘নারীর ভালোবাসা যেমন তীব্র তেমনি নারীর ঘৃণাও তীব্র। তেজ নিয়ে আর না-ই বলি। এবার নারীকে রাগলে কী বলে তাতে কিছু আসে যায় না।’
‘আমার প্রতি তোমার ঘৃণাও কিন্তু তীব্র।’
★★
রাত বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে মাহার অস্থিরতা। নামমাত্র খেয়েছে সে। সন্ধ্যার পর সা’দের সঙ্গে আর কথা হয়নি তার। সা’দকে ঘরে না পেয়ে মাহা রানু খালার কাছে যায়। জিজ্ঞেস করে, ‘খালা, সা’দকে দেখেছেন?’
রানু খালা হাসিমুখেই জবাব দেন, ‘সা’দ বাবায় ছাদে গেছে। যাও তুমি।’
‘এত রাতে ছাদে!’
‘ভয়ের কারণ নাই। যাও তুমি। ছাদের থিকা আইসা ঘুমাইয়া যাইও দুইজনে। আমি শুইতে গেলাম।’
রানু খালা রান্নাঘরের পাশে থাকা ছোট ঘরটায় চলে গেলেন। মাহাও ছাদের দিকে অগ্রসর হয়। সা’দ ছাদে পায়চারি করছে। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। মাহাকে ছাদে দেখে সে এগিয়ে আসে। বলে, ‘এখানে এসেছ কেন? গিয়ে শুয়ে পড়ো।’
‘তুমি শোবে না?’
‘পরে। আমার ঘুম আসছে না।’
‘কেন? ভার্সিটিতে জড়িয়ে ধরেছে যে তাকে মনে পড়ছে বুঝি?’
‘বাড়তি কথা বলবে না। যাও এখান থেকে।’
‘ঘরে বউ রেখে বাইরে মেয়েদের সাথে ফূর্তি করতে পারত। আমি বললেই দোষ।’
সা’দ হাতে থাকা সিগারেটটা মুচড়ে ভেঙে ফেলল। দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে মাহার দুই বাহু শক্ত করে ধরল।
‘ঘরের বউকে তো ভালোবাসতেই চেয়েছিলাম। ইনফ্যাক্ট ভালোবেসেই তো তাকে বউ বানিয়েছিলাম। কী লাভ হলো? আমার সর্বনাশ করার জন্য আমার ঘরের বউ আমারই শত্রুর সঙ্গে ফোনালাপ শুরু করে দিল। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা পর্যন্ত করেছে। একমাত্র আমাকে ঘৃণা করে নিজের চরম ক্ষতি করতে বসেছিল। মরণপথ থেকে তুলে নিয়ে এসেছি তাকে আমি। এবার বলো ফূর্তি কে করেছে?’
সা’দের কথায় অপমানিতবোধ করে মাহা। সা’দ এতটাই শক্ত করে তার হাতটা ধরেছে যে সে ব্যথা পাচ্ছে। কিন্তু এই ব্যথার কথা মুখ ফুটে বলছে না। সে শুধু সা’দকে দেখছে। ঘোলাটে আলোতে সা’দের উজ্জ্বল মুখটা তাকে কাবু করছে। ইচ্ছে করছিল সা’দের বুকে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়তে। সা’দ কী ভাববে, এই পরিস্থিতিতে এমন একটা কাজ করা উচিত হবে কি-না এইসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে মাহা বাম হাতে সা’দের ঘাড় স্পর্শ করে। পা উঁচু করে সা’দের ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়। মাহার ঠোঁটের স্পর্শ অনুভব করতেই সা’দ মাহার হাত ছেড়ে দেয়। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় সা’দ। মাহা আরও শক্ত করে জড়ায় সা’দকে। কিছু সময় পর ছেড়েও দেয়। সা’দের কপালে নিজের কপাল ঠেকিয়ে বলে, ‘ফিরোজকে আমি চিনতামও না সা’দ। সে যে তোমার শত্রু সেটাও জানতাম না আমি। নারী যে বোকা প্রকৃতির হয় জানোই তো। নারীরা তো জন্মগতভাবেই বাঁকা। কিন্তু এতটুকু নিশ্চিত থাকো যে তোমার বউ কারো সঙ্গে ফূর্তি করেনি। লুকিয়ে দেখা করা বলতে একদিনই শুধু দেখা করেছিলাম এর বেশি কিছু না। আর শেষবার তো ও আমাকে মেরে ফেলার জন্য নিয়ে গিয়েছে। তোমার বউ কারো সঙ্গে ফূর্তি করেনি সা’দ।’
সা’দের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দুই কদম পিছিয়ে যায় মাহা। চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘তোমার প্রতি ঘৃণা যে কখন ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে তা আমারও অজানা সা’দ। আমি ভালোবাসি তোমাকে। হ্যাঁ সা’দ, আই লাভ ইউ।’
মাহা দৌড়ে নিচে চলে যায়। সা’দ বোকার মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ মাহার কথাগুলো শুনছিল। মাহার বলা কথাগুলো তার তেমন মনে নেই। শুধু তার বলা শেষের কথাটা কানে বাজছে। সা’দ আই লাভ ইউ।
★★
ঘরে গিয়ে মাহাকে না পেয়ে সা’দ বারান্দায় যায়। মাহা বারান্দার একটা কোণায় বসে বসে কাঁদছে। সা’দ ধীর পায়ে মাহার সামনে এসে দাঁড়ায়। হাঁটু গেড়ে বসে। সা’দের অস্তিত্ব টের পাওয়ার পরেও মাহা সা’দের দিকে তাকায়নি। সা’দ মাহার থুতনিতে হাত রেখে নিজের মুখোমুখি করে। ভারী কন্ঠে বলে, ‘তবে কি আমি নেব আমাদের বিরোধীদলীয় প্রেমের এখানেই ইতি হলো? আমি কি ভেবে নেব আমি যা চেয়েছিলাম তা আমি পেয়ে গেছি?’
মাহা পরবর্তীতে আর কোনো কথা বলেনি। ঝড়ের গতিতে সা’দের বুকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সা’দও পরম যত্নে মাহাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘তোমাকে এখানে নিয়ে আসার কারণটা এখন বুঝেছ?’
সা’দ মাহার ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়। মাহা সা’দের পিঠে নিজের নখ বসায়। সা’দ মাহাকে কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দেয়। মাহার বুক থেকে ততক্ষণে আঁচল সরে গেছে। ঘরের প্রতিটা জানালায় পর্দা পড়ে। স্লাইড ডোর বন্ধ হয়। পুরো ডোরে পর্দা পড়ে। কিছু সময় পর লাইটটাও অফ হয়ে যায়। মাহা তখন সা’দকে দুই হাতে নিজের মধ্যে লেপ্টে নেয়।
আকাশের হঠাৎ কী হলো কে জানে, বেশ জোরে জোরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। প্রকৃতিও জানান দিচ্ছে তুফান আসছে৷ যে তুফান মান অভিমানের পাহাড় ভেঙে চুড়ে গুড়িয়ে দিবে।
চলমান…………….