বিরোধীদলীয় প্রেম
পর্ব – ১৮
আফরোজা আক্তার
[দয়া করে কেউ কপি করবেন না]
সারারাত নির্ঘুম কেটেছে মাহার। পাশেই সা’দ গভীর ঘুমে মগ্ন থেকেছে। না ঘুমোনোর কারণে মাথা ব্যথাও করছিল। তাই এক চুলায় নিজের জন্য চা চড়িয়েছে। সকালের নাস্তা নিজে বানাবে বলেই রান্নাঘরে এসেছে। এই ক’দিনে নওমির কাছ থেকে টুকটাক অনেক রান্নাই শিখেছিল সে। সা’দ সকালের নাস্তায় পরোটা, ভাজি পছন্দ করে। সা’দের পছন্দানুযায়ী নাস্তা বানাবে মাহা। চা বানিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিতেই রাহেলা বেগম পেছনে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘কী ব্যাপার মাহা, এত সকালে তুমি রান্নাঘরে!’
চায়ের কাপ ঠোঁটে ছুঁতেই পেছন থেকে শাশুড়ির কন্ঠস্বর শুনে মাহা কেঁপে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে পেছনে তাকায় মাহা। রাহেলা বেগম হেসে বলেন, ‘কী হলো, কেঁপে উঠলে কেন?’
মাহা নিচু স্বরে বলল, ‘চা খাবেন মা?’
‘তুমি বানিয়েছ?’
‘হ্যাঁ।’
‘তাহলে দাও। আজকে বড় বউয়ের খবর নেই।’
‘আমিই আজ তাড়াতাড়ি এসেছি।’
‘বুয়া চলে আসবে কিছুক্ষণ পর। তুমি কিছুতে হাত দিও না।’
‘বুয়া এসে অন্য কাজ করুক। আমিই নাস্তা বানাচ্ছি।’
‘শরীর তো এমনিতেই অসুস্থ তোমার। আগুনের কাছে থাকলে শরীর আরও খারাপ লাগবে।’
‘নাহ মা। আমি ঠিক আছি।’
মাহা আস্তে আস্তে সবটা করে নিচ্ছিল ওই সময় নওমি রান্নাঘরে আসে। মাহা প্রায় সময় খেয়াল করে সকালবেলা নওমির চুল অর্ধেক ভেজা থাকে। নওমি যে সকালে গোসল করে এটা তার বুঝতে বাকি নেই। স্বামী সুখটা নিজেই পায়ে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।
★★
টেবিলে সা’দ একাই বসেছিল। সবাই আগে খেয়ে বেরিয়ে গেছে। সা’দকে নাস্তা সার্ভ করে দেয় মাহা। সা’দ প্লেটে হাত রাখতেই চা খেতে খেতে নওমি বলে, ‘লিডার সাহেব, আজকে নাস্তা কিন্তু আপনার সহধর্মিণী বানিয়েছে। খেয়ে রিভিউ দিন প্লিজ।’
সা’দের পেটে যে ক্ষুধাটা ছিল নওমির কথা শুনে সেই ক্ষুধাটা নিমিষেই উধাও হয়ে গেল। প্লেট থেকে তার হাতটা সরে যায়। যা সহজেই মাহার চোখে পড়ে। এই দৃশ্যটি নওমির চোখও এড়ায়নি। সে সঙ্গে সঙ্গে বলে, ‘কী ব্যাপার, হাত সরিয়ে নিলে যে। খাও।’
সা’দ জুসের গ্লাস হাতে নেয়। তারপর পুরো জুসটা শেষ করে। চেয়ার ছেড়ে উঠে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। মাহা বেশ বুঝতে পারে তার হাতের রান্না সা’দ খাবে না বলেই শুধু জুসটুকু খেয়েই চলে গেছে। নওমির মুখটা কালো হয়ে গেল। কঠিন গলায় বলল, ‘ও এমন করল কেন? ও লিডার ওর ক্যাম্পাসে। ঘরে লিডারগিরি দেখালে ওর খবর আছে। এই মাহা দুপুরের রান্নাটাও তুমিই করবে। রাতের টাও। আমি দেখতে চাই ও ক’দিন না খেয়ে থাকে। আশ্চর্য! এই ছেলের মতিগতি কিছুই বুঝি না।’
মাহা একটা কথাও বলেনি। সে সোজা ঘরে যায়। সেখানে সা’দ বের হবার জন্য তৈরি। জলছাপের সাদা পাঞ্জাবিতে অপূর্ব লাগছিল সা’দকে। হাতে ঘড়ি। বাম হাতে গাড়ির চাবি আর মোবাইল। কালো সালগ্লাসটা চোখে লাগাতে লাগাতে বের হবে এমন সময় পথ আঁটকে দাঁড়ায় মাহা। মাহার চোখে চোখ পড়তেই দ্রুতই সানগ্লাসটা পরে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু মাহার হাত তাকে বাধা দেয়।
‘দাঁড়াও সা’দ, আমার কথা শুনে যাও।’
সা’দ ফোন চাপতে চাপতেই জবাব দিল, ‘কিছু বলবে?’
‘নাস্তা খেলে না কেন?’
‘খেলাম তো।’
‘শুধু জুস।’
‘সকাল সকাল এত হেভি নাস্তা না করাই ভালো।’
‘তুমি এই নাস্তাটাই খেতে যদি নাস্তাটা আমি না বানিয়ে ভাবী বানাত। আমি বানিয়েছি বলেই কি নাস্তাটা খেলে না?’
মাহা যে সঠিক বলছে এটা সা’দও জানে। সে চুপচাপ ফোন চাপছে। মাহা দেখছে সা’দ আপন মনে ফোন টিপছে। মাহা এবার সা’দের দিকে দুই পা এগোয়। সা’দের বুকে হাত রেখে বলে, ‘আমাকে ইগনোর করছ কেন সা’দ?’
পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাচ্ছে সা’দ। কিন্তু মাহার জন্য পারছে না। বাধ্য হয়েই বলে, ‘এভাবে পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছো কেন, এটা কোন ধরনের অভ্যাস? সরো। জায়গা দাও। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
মাহাও কম যায় না সে আরও এগিয়ে এসে দাঁড়ায়। সা’দ আরও রেগে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘বাড়াবাড়ি করছ কিন্তু এখন। সরো।’
‘সরব না। কী করবে?’
‘মাথা গরম করিও না মাহা। আমি একটা কাজে যাচ্ছি। সরে দাঁড়াও।’
‘মাথা গরম হলে কী হবে?’
সা’দের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছিল। কেন যেন মাহার এই আচরণটা সে মানতে পারছে না। চারপাশে তাকিয়ে মাহায় গলায় চাপ দেয়। তবে খুব জোরে না। তার খেয়াল আছে মাহা অসুস্থ। মাহার গলায় চাপ দিয়ে বলে, ‘খুন করে ফেলব।’
মাহা হাসে। বলে, ‘তবে বাঁচিয়েছ কেন?’
‘নিজ হাতে তোমাকে খুন করার জন্য।’
‘তাহলে খুন করেই ফেল।’
সা’দ কিছুক্ষণ মাহার দিকে তাকিয়ে থাকে। কালো সানগ্লাসের জন্য সে সা’দের চোখ জোড়া দেখতে পাচ্ছে না। নিজ হাতে সা’দের সানগ্লাস খোলার চেষ্টা করে। কিন্তু তাকে এই সুযোগ না দিয়ে কায়দা করে সা’দ সেখান থেকে বেরিয়ে যায়।
মাহা সেখানেই থাকে। তার খুব কষ্ট হচ্ছে। দম বন্ধ লাগছে। চোখের কোণে আসা পানি পড়তে না দিয়ে দরজা বন্ধ করে মাহা।
গাড়িতে বসে চাপা নিঃশ্বাস ফেলে সা’দ। মাহার এই ভালোবাসা তাকে অস্বস্তিতে ফেলছে। সে এসব কিছুর থেকে দূরে থাকতে চাচ্ছে। গাড়ি স্টার্ট দেয়। দেখতে দেখতে গাড়িটা অনেক দূরে চলতে থাকে।
★★
ভার্সিটিতে সবাই ভীষণ খুশি। সা’দের এই জিত সবার কাছে যেন সুখকর বিষয়। সবাই ফুল দিয়ে গ্রহণ করছে তাকে স্টুডেন্ট পলিটিক্সের লিডারকে। সা’দের এই লুক৷ ভার্সিটির অধিকাংশ মেয়েকে কাবু করেছে। এতটা স্মার্ট এর আগে কখনো লাগেনি তাকে। হাঁটুর বয়সী মেয়েদেরও ক্রাশ হয়ে গেল সা’দ।
মাইকের সামনে এসে হেসে হেসে সা’দ যখন কিছু কথা বলছিল তখন চেয়ারে বসা কিছু মেয়ের চোখ সা’দের দিকে আঁটকে থাকে। তাদের প্রত্যেকেরই ইচ্ছা করছিল সা’দকে নিজের জীবনসঙ্গী করার। কিন্তু সেটা সম্ভব না। স্টেজ থেকে নেমে সা’দ সোজা ক্লাব ঘরে যায়। সা’দের পেছন পেছন তখন একটা মেয়েও ক্লাব ঘরের দিকে পা বাড়ায়। সা’দ গিয়ে সেখানে দাঁড়াতেই মেয়েটিও তার পেছনে এসে দাঁড়ায়। মিষ্টি কন্ঠে বলে, ‘কংগ্রেচুলেশন সা’দ।’
সা’দ ঘুরে দাঁড়ায়। এই ভার্সিটিতে সাধারণত কোনো মেয়ে তার নাম ধরে ডাকে না। মেয়ের সাহস দেখে সা’দ খানিকটা অবাক হয়। মেয়েটা কয়েক পা এগিয়ে আসে। ফ্লাওয়ার বুকেটা সা’দের দিকে এগিয়ে বলে, ‘জয়া, ফাইনাল ইয়ার।’
সা’দ বুকে গ্রহণ করে বলে, ‘থ্যাংকস।’
‘ভার্সিটিতে সবাই আপনাকে ভয় পায় কথাটা কি সত্যি?’
সা’দ হাসে। বলে, ‘আপনার কী মনে হয়?’
‘সবার মুখে আপনার নাম শুনি। সেই সাথে এটাও শুনি যে তারা আপনাকে ভয় পায়। আমি কিন্তু আপনাকে ভয় টয় পাই না।’
‘হ্যাঁ। তা আপনার কথার টোন শুনেই বুঝতে পারলাম।’
‘সবার মতো আপনাকে ভাই ডাকতে ইচ্ছা করল না। তাই নাম ধরেই ডাকলাম।’
সা’দ কিছু বলল না। মেয়েটাকে বসতে বলা উচিত মনে করে চেয়ার এগিয়ে দেয় সা’দ। তারপর ইশারায় বসতে বলে। মেয়েটা না বসে সা’দের গলা জড়িয়ে ধরে। তারপর নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নেয়। মেয়ের এমন আচরণে সা’দ বোকা বনে যায়। সে কিছু বলার আগেই জয়া বলে, ‘আই লাভ ইউ সা’দ। এতদিন ভয়ে বলতে পারিনি। তবে আজ ভয়কে জয় করেই বললাম, আই লাভ ইউ।’
সা’দ জয়ার দুই বাহুতে হাত রাখে নিজের থেকে আলাদা করবে বলে। ঠিক তখনই ক্লাব ঘরের দরজা থেকে কেউ একজন সা’দের নাম উচ্চারণ করে। সা’দ দরজায় তাকিয়ে দেখে সেখানে মাহা দাঁড়িয়ে আছে। কলাপাতা রঙের একটা কটন শাড়ি পরে। মাহা এক দৃষ্টিতে সা’দকে দেখছে। চোখ থেকে বিরতিহীন পানি পড়ছে। মাহার পাশে মিমিও দাঁড়িয়ে আছে। আর আশেপাশে সা’দের ভাই বন্ধুরা। সবাই সা’দ আর জয়াকে এই অবস্থায় দেখে ফেলেছে। বেশ ভালোভাবে ফেঁসেছে সে। সা’দ জয়াকে ধাক্কা দিয়ে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দেয়। তারপর ধীর পায়ে মাহার দিকে এগোতে এগোতে বলে, ‘মাহা, প্লিজ কাম ডাউন। যা দেখেছ এমন কিচ্ছু না। আমি তো জাস্ট.. মাহা, লিসেন।’
মাহার অনুভব হচ্ছে সে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। তার কষ্ট হচ্ছিল। দাঁড়াতেও পারছিল না ঠিক মতো। তার এমন অবস্থা দেখে মিমি পেছন থেকে ধরে রাখে তাকে। আশিক শুভ্রও বুঝতে পারছে যে মামলা জটিল আকার৷ ধারণ করেছে। সা’দ মাহার সামনা-সামনি এসে দাঁড়ায়। মাহার ক্লান্ত চেহারা সা’দের বুকে ছুরি চালাচ্ছে। মাহার চোখের পানি যেন তাকে অভিশাপ দিচ্ছে। সা’দ বলে, ‘মাহা, এমন কিছুই না। ট্রাস্ট মি।’
মাহার হেঁচকি উঠে। কম্পিত কণ্ঠে বলে, ‘ভালো হতো সেদিন যদি ফিরোজ আমায় মেরে ফেলত। তাহলে অন্তত আমায় এভাবে তিলে তিলে মরতে হতো না। আমি তোমার শহরে এগোতে শুরু করলাম আর তুমি তোমার শহরটাই বদলে নিলে সা’দ! এইজন্যই বুঝি আমায় এত ইগনোর করছিলে তুমি। থ্যাংক ইউ সো মাচ সা’দ। থ্যাংক ইউ।’
মাহা সেখানে আর দাঁড়ায়নি৷ সা’দ চিন্তিত হয়ে মিমি, আশিক,শুভ্রর দিকে তাকায়। বলে, ‘হোয়াট ইজ দিস ইয়ার?’
আশিক বলে, ‘ভাই, আমরা কিছু জানি না। আমরা স্টেজ থেকে নামতেই দেখি ভাবী। বলল আপনার জন্য নাকি সারপ্রাইজ আছে৷ আমাদের সবাইকে নিয়ে এখানে এলো৷ আর এসেই…’
এরপর মিমি বলে, ‘সা’দ ভাই, এসব কী?’
সা’দ মিমিকে এক্সপ্লেইন করতে যাবে তখনই জয়ার কথা মনে পড়ে তার। সে ঘুরে পেছনে তাকায়। আগুন ঝরা চোখে হুংকার ছেড়ে বলে, ‘হেই ইউ, গেট আউট।’
জয়াও সেখান থেকে বের হয়ে যায়। সা’দ আর এক মিনিটও সময় নষ্ট করেনি। সে দৌড়ে ভার্সিটির গেটে যায়। মাহাকে আঁটকাতে হবে তার। মাহা ততক্ষণে গেট থেজে বেরিয়ে গেছে। রাস্তা পার হবে তখনই সা’দ তার হাত ধরে। কাঁদতে কাঁদতে মাহা বলল, ‘হাতটা ছাড়ো সা’দ। ওই মেয়েকে গিয়ে ধরো যে তোমার বুকে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ছিল। ছাড়ো আমাকে।’
মাহা বেশ উত্তেজিত হয়ে গেছে। তার পক্ষে এতটা উত্তেজিত হওয়া উচিত না। সা’দ মাহাকে হেঁচকা টানে নিজের কাছে আনে।
‘রাস্তার মাঝখানে সিনক্রিয়েট কোরো না। গাড়িতে বোসো।’ বলে মাহাকে টেনে গাড়িতে বসায়। মাহা যাতে বেরুতে না পারে সেজন্য গাড়ির দরজাও লক করে দেয়। তারপর নিজে গাড়িতে বসে গাড়ি স্টার্ট করে। মাহা গাড়িতে বসেও উঁচু গলায় বলছিল, ‘গাড়ি থামাও তুমি। আমি নামব। আমায় গাড়িতে কেন বসিয়েছ। আমি তো তোমার সঙ্গে কোথাও যাব না। গাড়ি থামাও তুমি। তুমি গিয়ে ওই মেয়ের সঙ্গে ঘোরো। যাও।’
সা’দ মাহার দিকে একবার তাকাল। দেখল মাহার চোখ, গাল, নাক লাল হয়ে গেছে। অনর্গল কেঁদে যাচ্ছে সে। সা’দ কিছু না বলে গাড়ির স্পিড বাড়ায়। কিছু সময় পর গাড়ি গাজীপুরের দিকে যায়।’
চলমান…………………..