বিষচন্দ্রিমা পর্ব-০৪

0
2

#বিষচন্দ্রিমা
#পর্ব৪
#তামান্না_আনজুম_মায়া
ভোরের আলো ফুটেছে সেদিকে খেয়াল নেই রুমে থাকা দুইজন মানুষের, বেঘোরে ঘুমাচ্ছে তারা, দিন দুনিয়ার কোনো খবর যেনো না জানলেও চলবে এখন।জোরে জোরে দরজা ধাক্কাচ্ছে কেউ তরী চোখ মুখ কুঁচকালো কিন্তু চোখ খুললো না, ফারাবীর ও একই অবস্থা সে তো পারলে উঠে গিয়ে দরজার অপর পাশের ব্যক্তিকে এক চ*ড় বসিয়ে দিবে।
বিয়ে করে পড়েছে মহা ঝামে*লায় এমন এক বউ ঝুটেছে কপালে ঘুমাতেও দেয় না শান্তিতে মেয়েটা ঘুমানোর সময় ঘন্টা খানেক বক বক করেছে,ঝগ ড়া না করলে মনে হয় এর শান্তি মিলে না।
রাতের বেলা খাটে ঘুমানো নিয়ে করলো কাহিনি।বিরক্ত নিয়ে কথা গুলো আবছা ঘুমের মাঝেই ভাবলো।
ফারাবীর ঘুম হালকা হয়ে এসেছে তখন পাশ থেকে কারো ঘুম জড়ানো কন্ঠ শুনে থমকে যায়।কন্ঠে কিছু তো একটা আছে!ফারাবী চট করে চোখ খুলে তাকায়

তরী চোখ বন্ধ করেই বলছে

,,এই ভাই যা না গিয়ে দেখ দরজায় কে এলো।

ফারাবীর সব মুগ্ধতা যেনো এক নিমিষেই শেষ, এই মেয়ে তাকে সোজা ভাই বানিয়ে দিয়েছে! আবার তুই করে বলছে ফারাবী রাগী কন্ঠে বললো

,,এই কে তোমার ভাই?কিসের ভাই কবেকার ভাই?

তরী চোখ খুলে এবার, ঘুমের তালে ভুলেই গেছিলো সে কোথায় আছে।চোখে মুখে বিরক্তির রেশ টেনে বললো
,,ওফ!আচ্ছা আমার ভুল হয়েছে আমি মানছি,এখন ঘুমাতে দেন প্লিজ,ঘুম থেকে উঠে আমি আপনার কাছে ক্ষমাও চেয়ে নিবো তাও এখন নো ঝগ*ড়া রাতে এই শা*লা ঝগ*ড়ার চক্করে ঘুমাতে পারিনি!

তরী চোখ বন্ধ করে ফেলতেই ফারাবী মুখ্যম এক বুদ্ধি পেয়ে গেছে তরী কে জ্বা লানোর।দরজা কাছে গিয়ে দরজা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকলো আয়রা।ফারাবী কে পাশ কাটিয়ে গিয়ে বিছানার কাছে দাড়ালো, তরী আবার ঘুমিয়ে গেছে।
আয়রা ডাকলো
,,ভাবি উঠো জলদি।
তরী পিটপিট করে চোখ তুলে আয়রা কে দেখে সোজা হয়ে বসে পড়লো।
আয়রা ভ্রু কুঁচকে তাকালো একবার বিছানার দিকে।মাঝখানে বালিশ দিয়ে ইন্ডিয়া পাকিস্তানের বর্ডার করে রেখেছে।
আয়রার প্রশ্ন বিদ্ধ চোখ দেখে ফারাবী বললো

,,আর বলিস না আয়রা, তোর ভাবি রাতের বেলা নিজ থেকে ঝ*গড়া বাঁধিয়েছে পরে বিছানায় বর্ডার করে ঘুমিয়েছে!

তরী তেরে গিয়ে বললো
,,কি বললেন আপনি আমি ঝ*গড়া করি?

আয়রা চেচিয়ে উঠে বলে

,,এই থামো তোমরা, দিদুন দ্রুত নিচে নামতে বলেছে তোমাদের বাড়ির নতুন বউ হিসাবে ভাবি আজ রান্না করবে।

তরী কথা শোনা মাত্ররো পারলে কেঁদে দিবে একন ভাব জীবনে রান্না তো দূর চুলার ধারেই তো যায় নি, এবার কি হবে।ফারাবী তরীর দিক তাকিয়ে বাঁকা হাসলো এই মেয়ের মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে কিচ্ছু পারে না।তরী ফারাবীর দিকে করুন চোখে তাকালো, ফারাবী পাত্তা না দিয়ে শিস বাজাতে বাজাতে ওয়াশরুমে চলে গেলো।

——-
ড্রয়িং রুমে সবাই উপস্থিত, তরী তো সায়েবা শেখ কে বলেই দিয়েছে মা আমি কিন্তু এসব পারি না, এখন কি হবে।তিনি নিজেও চিন্তিত শাশুড়ী উপর কথা বলতে পারবেন না তিনি।তরী মুখটা বাংলার পাঁচ করে দাড়িয়ে আছে, ফারাবী পাশে দাড়িয়ে মজা নিচ্ছে।

জাহেরা শেখ থমথমে কন্ঠে বললেন

,,নাত বউ, তুমি আর ফারাবী মিলে আজ রান্না করবে!

কথাটা বলার সাথে সাথে দিন দুনিয়ার সব চিন্তা ভুলে তরী হেসে দিলো, হাসিটুকু শুধু ঠোঁট এলানো পর্যন্তই সীমাবদ্ধ, ফারাবীর যেনো চোখ ফেটে বেরিয়ে আসার উপক্রম,সে অধৈর্য কন্ঠে বললো

,,আমাকে এসবে টানছো কেনো দিদুন!

,,এ কেমন কথা দাদু ভাই তোমার বউ, তো তোমাকেই সাহায্য করতে হবে।যাও যাও দুজন রান্না ঘরে।

সবাই মিলে এ প্রকার ঠেলে রান্না ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে।

তরী গিয়েই সিঙ্কের পাশে পা ঝুলিয়ে বসে পড়লো,তরী স্বাভাবিক ভাবেই বললো

,,আমি রান্না করতে পারি না,আপনি করুন!

ফারাবী চোখ গরম করে তাকিয়ে বললো

,,আমিও পারি না।

,,তাহলে পারেন টা কি?

ফারাবী বাঁকা হেসে তরীর দিকে এগিয়ে এসে বললো
,,দাঁড়াও দেখাচ্ছি!

তরী পলকহীন ভাবে তাকিয়ে আছে বুঝার চেষ্টা করছে ফারাবী কি করতে চায়।ফারাবী নিজের শার্টের দুই একটা বোতাম খুলতেই তরী চোখ খিঁচে বন্ধ করে বললো
,,অস ভ্য লোক।আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম আপনি একটা চরিত্র হীন লোক!

ফারাবী এবার রেগে তরীর চোয়াল চেপে ধরেছে,দাঁতে দাঁত পিষে বললো

,,কি বললে তুমি?ধারনা আছে তোমার, সেই প্রথম দিন থেকে শুনে আসছি যা মুখে আসছে বলে যাচ্ছো, মেয়ে মানুষ বলে এতোদিন কিছু বলিনি তোমায়।এটাই লাস্ট ওয়ার্নিং এর পর এরকম কোনো কথা বলার আগে দশবার ভাববে,না হয় আমি নিজের সীমা ছাড়িয়ে যাবো বলে দিলাম!

ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠলো তরী,তার পরও মুখে কাঠিন্যতা বজায় রেখে বললো
,,যা খুশি করেন আপনি, যা সত্যি তা বলতে দু বারও ভাববো না আমি।

তরী সামনে ঝুঁকে ছিলো ফারাবী পেছন থেকে কারো কন্ঠে ছিটকে দূরে সরে দাঁড়ায়।

,,আরে ছোট ভাই রোমান্স করার অনেক সময় পাবে,এখন রান্না টা করে ফেলো দুজনে,আজ কিন্তু তোমাদের রান্নাকৃত খাবারই খাবো আমরা।সবাই অপেক্ষায় আছি।

তরী মাথা নিচু করে বসে আছে ফারাবী একবার তাকালো তার দিকে,তরীর চোখে পানি চিক চিক করছে, ফর্সা গালে ফারাবীর আঙুলের চিহ্ন স্পষ্ট। বেশ সময় দুজন নিরব ভাবে বসে রইলো কি করবে কিছুই বুঝলো না হঠাৎ তরীকে একা রেখেই ফারাবী রান্না ঘর ছেড়ে চলে গেলো তরী বসে আছে চুপচাপ, রান্না ঘরে থাকা সব কিছু চোখ বুলিয়ে দেখে যাচ্ছে।রাগে দুঃখে চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা জল।আধঘন্টার মধ্যে ফারাবী ফিরে আসলো তবে সদর দরজা দিয়ে না।রান্নাঘরের জানালার কাছে এসে ডাকলো
,,আঙ্গিনা!
তরী চমকালো পর পর নিজেকে সামলে নিয়ে তাকালো জানালার বাহিরে,ফারাবী আর কোনো শব্দ উচ্চারন করেনি হাতে থাকা খাবারের প্যাকেট গুলা এগিয়ে দিলো তরীর দিকে।তরী বিনা বাক্যে নিয়ে নিলো।খাবার গুলো সাজিয়ে টেবিলে রাখতে লাগলো একে একে।পুরোই চুপচাপ হয়ে আছে সে।সবাই খাবার টেবিলে এসে বসলো,খাবার শুরু করলেন জাহেরা শেখ।ফারাবী একবার তাকালো তরীর চুপসে যাওয়া মুখটার দিকে।খাওয়ার মাঝপথে জাহেরা শেখ তরীকে ডাকলো,সবাই এখনও খাবারে হাত দেয়নি।জাহেরা শেখ হাসি মুখে তরীর দিকে একটা বক্স এগিয়ে দিলেন পরে বললেন

,,প্রথম রান্না করেছো তাই এটা আমার পক্ষ থেকে তোমার জন্য ছোট উপহার।
তরী অস্বস্তি নিয়ে তাকালো সে তো রান্না করেনি মিথ্যা বলে উপহার নেওয়া তো ঠিক নয়।তরী মনে মনে সাহস সঞ্চয় করলো।ঢোক গিলে গয়েবার ঠোঁট ভিজিয়ে বললো

,,আসলে দিদুন, রান্না আমি করিনি।আপনার নাতি বাহির থেকে নিয়ে এসেছে।আমি রান্না করতে পারি না!

পুরো খাবার টেবিলের সবার মুখে আ ত ঙ্ক এই বুঝি জাহেরা কোনো কঠিন বাক্য শুনিয়ে দেয় মেয়েটিকে।ফারাবী নিজেও অবাক হয়, তরী সত্যি বলে দিবে এটা ভাবেনি সে।

জাহেরা শেখ হেসে ফেললেন চেয়ার ছেড়ে উঠে,তরীর নিচু করে রাখা মুখটা উপরে তুলে বললেন

,,আমি জানি তুমি রান্না করতে পারো না।দেখতে চেয়েছিলাম দুই উজবুক মিলে কি করো।সত্যি আমার নাতির এলেম আছে বলতে হবে,বউয়ের কথা ভেবে একদম কিনে এনেছে খাবার তাও লুকিয়ে।আমি এটাই চেয়েছিলাম।দুজন সব সময় যাতে নিজেদের কে সামলাতে পারো একে অন্যের ঢাল হতে পারো।পরস্পরের অসুবিধে বুঝতে পারো।আমি খুশি তোমাদের কাজে।

সায়েবা শেখ তৃপ্তির হাসি হাসলেন। সবাই হাসলো শুধু মুখে হাসি নেই দুজন মানুষের।খাবার খাওয়া শেষে সবাই উঠে গেলো

তরী বিনা বাক্য তৈরি হয়ে এসেছে ভার্সিটি যাবার উদ্দেশ্যে।ফারাবী নিচে এসে তরী কে একনজর দেখলো,সে হাফ ছেড়ে বাচলো যেনো এই মেয়ে কথা না বলা মানেই শান্তি।থাকুক মুখ বন্ধ করে কিন্তু এর সাথে তো সে কোনো মতেই যাবে না।

ফারাবী তরীর দিকে তাকিয়ে উঁচু কন্ঠে বললো

,,আঙ্গিনা তুমি এক কাজ করো বাবার সাথে চলে যাও একটু কষ্ট করে, আমার এখনই একবার পার্টি অফিসে যেতে হবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং আছে না হয় তোমাকে ছেড়ে আমি কিছুতেই যেতাম না।রাগ করো না প্লিজ!

তরী তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ,এই ছেলের তেল দেওয়া মার্কা কথা শুনে ওর গাঁ পিত্তি জ্ব লে যাচ্ছে।এতো নাটকের কি আছে নিজের দিদুনের সামনে ভালো কতো দিন থাকতে পারবে সত্যি একদিন না একদিন বেরিয়ে যাবেই।তরী ছোট করে বললো

,,সমস্যা নেই আমি বাবার সাথেই যাবো।
ফারাবী এক মুহুর্তও আর দাঁড়ায় নি,তার সত্যি মিটিং আছে না থাকলেও এই মেয়ের সাথে যাবে না।

জয়নাল হক বুঝলেন ছেলে ইচ্ছা করে এমন করেছে।তিনি নিজেই তরীর সাথে বের হলেন।

———–
বর্তমান এমপি সাহেব অনেকটাই ভরসা করেন ফারাবী কে সে তার সব সিদ্ধান্ত বলতে গেলে ফারাবীর কথায়ই নিয়ে থাকেন ছেলেটার বয়স কম হলেও কাজে খুবই দায়িত্বশীল ।তার উপর সে পার্টি অফিসের সভাপতি।

ফারাবী পার্টি অফিসে পৌঁছাতেই এগিয়ে আসলো তাদের দলের ছেলেরা,তামিম,অয়ন,তন্ময় ফারাবীর ভার্সিটি ফ্রেন্ড সাথে দলের সদস্য।
তামিমের কন্ঠ অধৈর্য শুনালো সে বলা শুরু করলো

,,ফারাবী জ্যাক পাটোয়ারির একটা মেয়ে আছে!খবরটা আজকেই পেলাম।জ্যাক খুবই দুরন্তর লোক নিজের মেয়েকে আমাদের বিরুদ্ধে গুটি হিসেবে ব্যাবহার করতে পারে।

,,জ্যাক তো বিয়ে করেনি বাচ্চা আসলো কোথা থেকে?
আর মেয়ের বয়সই বা কতো?

তন্ময় বললো
,,জ্যাক একটা বেজ*ন্মা লোক! শা*লা নিজের বউরে নিজেই খু*ন করছে।

,,মেয়েকে বাঁচিয়ে রেখেছে কেনো তাহলে?

,,মেয়েটা নিশ্চয়ই বাপের মতো হইছে না হয় এই জ্যাক তাকেও মে*রে ফেলতো।
ফারাবীর কপালে ভাজ পড়লো,মনে মনে বললো এই মেয়ে মানুষের চক্কর কি শেষ হবার নয়!একটার পর একটা শুধু মেয়ে ঘটিত কান্ড।

,,মেয়ের ডিটেইলস? দেখতে কেমন এসব কিছু জানিস?
অয়ন বললো
,,না!ডেটাবেজে এরকম কোনো তথ্যই নেই। জ্যাক কেই তো এখন পর্যন্ত কেউ চিনে না।দেখিনি পর্যন্ত জ্যাকের কেইস নিয়ে যে অফিসার তদন্ত করছে তার থেকে জানতে পারলাম মেয়েটির বয়স হয়তো আঠারো থেকে বাইশের মধ্যে হবে!

,,জ্যাকের স্ত্রীর কোনো তথ্য পাওয়া গেছে?

,,না মহিলাকে মে*রে গু ম করে দিয়েছে।বাড়ির কোনো সদস্য সম্পর্কেও কেউ অবগত নয় তাহলে হয়তো জানা যেতো কিছু একটা।
অফিসার মাহিন ভীষণ চাপে আছে বেচারার নতুন জয়েনিং তার উপর এরকম তেঁদড় এক কেইস!

,,তামিম মেয়েটার খবর বের কর যত দ্রুত সম্ভব! মেয়ে মানুষ হচ্ছে কেউ*টের মতো।তাদের সহজ সরল বদনের পিছনে থাকে আস্ত এক শয়*তানের বসবাস!এরা পারে শুধু।ছলনা করতে, এরা বিশ্বাস ভঙ্গ করতে ওস্তাদ।এদের মতো দূর্ত প্রানী একটাও নেই।

তামিম তাকালো ফারাবীর দিকে সে জানে বন্ধুর মনের কষ্ট। স্বপ্না কে ভীষণ ভালোবাসতো ছেলেটা, মেয়েটা কিনা শ ত্রু পক্ষের স্পা*ই ছিলো!এতো সহজে মিশলো বুঝাই গেলো না কিছু।সত্যি নারীর মাঝে বিরাজ করে দুনিয়ার বড় বড় সব রহস্য!
চলবে…