বিষচন্দ্রিমা পর্ব-১১

0
2

#বিষচন্দ্রিমা
#পর্ব১১
#তামান্না_আনজুম_মায়া
বিয়ে বাড়ি থেকে ফিরে এসেছে প্রায় একমাস হতে চললো।
আবিরের মা*র্ডার কেইস নিয়ে পুলিশ তদন্ত করছে,সব মিলিয়ে শুভর সুযোগ হয়নি ফারাবী কানে কথা তোলার,জ্যাক পাটোয়ারী নিজের প্ল্যান পরিবর্তন করেছে,কিছু দিন পর সব কাজ আবার শুরু করতে বলেছে,আবিরের মৃত্যুর জন্য যে তাকেই সন্দেহ করবে ফারাফী এটা সে জানে।তাই কোনো ভুল পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না একটা ভুলেই সব কিছু এলোমেলো হয়ে যাবে।
ফারাবীর সাথে তরীর সম্পর্ক অনেকটাই ভালো,তরী ফারাবী যে একে অপর কে ভালোবাসা তা তাদের দেখলেই বুঝা যায়।কিন্তু কেউই স্বীকার করতে নারাজ।

পার্টি অফিস থেকে ফিরছে ফারাবী ভেবে নিয়েছে আজ তার মিসেস কে সে ভালোবাসার কথা জানাবে,না হয় তন্ময় তার পিঠের ছাল তুলে নিবে।ফারাবীর বিয়ে বাঁচাতে যেনো তার বন্ধুরা একদম উঠে পড়ে লেগেছে।
হাতে একগুচ্ছ সাদা গোলাপ নিয়ে বাইক এ উঠতে যাবে আবার তখনই এসে হাজির হয় শুভ।

ফারাবী হেসে জিজ্ঞেস করে
,,আরে শুভ ভাই তুমি কই থাকো বলোতো আজ তো পার্টি অফিসেও দেখলাম না এমপি সাহেব তোমাকে খুঁজলো অনেক।

,,আমাকে ছাড়াও তো কাজ ভালোই চলছে তরা সামলে নিচ্ছিস।যাই হোক একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার আছে,জানি না কিভাবে নিবি,তবে পার্টি অফিসের সাথে জড়িত বিষয় টা!

ফারাবী উৎসুক হয়ে বললো
,,হ্যাঁ বলো শুভ ভাই।

,,জ্যাক পাটোয়ারী মানে জামালের মেয়ে কে তরা সবাই খুঁজে পেয়েছিস?

,,না। তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি!

,,নিজের বাড়িতে রেখে অন্য কোথাও খুঁজলে কিভাবে পাবি ফারাবী!মেয়েটা কিন্তু তার বাপের সাথে মিলে আছে।

,,আমার বাড়িতে মানে, কে সে?

,,তোর বউ তরী!জ্যাক পাটোয়ারীর একমাত্র মেয়ে,তোর পিঠে ছু*ড়ি বসিয়ে দিবে কবে জানি,মেয়ে মানুষ কতোটা নাটকবা জ জানিস না তুই, বড় ভাই হিসেবে তোকে সাবধান করার ছিলো তাই বললাম।সব খবর আজই পেলাম!

ফারাবী চুপ রুইলো সে বিশ্বাসই করতে পারছে না তরী,তরী তার শত্রুর মেয়ে!যে মেয়েটা এতো সহজ সরল, যে মানুষটা ফারাবীর মনে দ্বিতীয় বারের মতো বসন্ত বয়ে এনেছে সে মানুষ টা আসলে একটা মরীচিকা! ফারাবীর তরীর ওই দিনের কথা গুলো মনে পড়লো,তার মানে তরী হাসির ছলে সত্যি টা বলেছিলো!
শুভ দূরে দাড়িয়ে দেখলো ফারাবীর চুপসে যাওয়া মুখ।
ফারাবীর যেনো নিজেকে এখন পাগল মনে হচ্ছে,বাইকের উপর রাখা ফুলগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিলো রাস্তায়।কেউ ভালোবাসার যোগ্য না কেউ না।সবাই শুধু অভিনয় করে অভিনয়!

ফারাবী স্প্রিড বাড়িয়ে দিলো বাইকের,পথে ফোন করে ডাকলো তন্ময় কে।
তন্ময় কে নিয়ে নিজের রুমে বসে আছে ফারাবী,তন্ময় কে সব ঘটনা বলার পর সে বিশ্বাস করছে না।তন্ময়ের এটা বুঝে আসছে না একটা মানুষের সাথে ফারাবী এতোদিন থাকার পর কি করে অন্য একটা মানুষের কথায় এক ঝটকায় অবিশ্বাস করতে পারে!
ফারাবীর কথা শুভ তাদের লোক হয়ে কেনো মিথ্যা বলবে?
তন্ময় বেশ বিরক্ত হয়,মানছে ফারাবী আগের বার ধোঁকা খেয়েছে তাই বলে তরীর মতো একটা মানুষ কে মিথ্যা অপবাদ দিবে কেনো?তরী কে একবার জিজ্ঞেস করলেই হয়।
তরী মাত্ররো রুমে আসলো,দরজায় দাড়িয়ে পড়ে সে ফারাবীর বলা কথা গুলো শুনে

,,আমি এতোদিন শুধু তরীর সাথে ভালোবাসা র নাটক করেছি,বাকি সব কিছুই ছিলো দেখানো,সবাইকে দেখানোর জন্য এসব করেছি আমি।তরীর মতো মেয়েকে ফারাবী নিজের যোগ্যই মনে করে না,এসব মানুষ দয়ার যোগ্য তাদের দয়া দেখানো যায় ভালোবাসা না!

ফারাবীর হঠাৎ এসব কথায় তন্ময় নিজেও চমকায়,কি হয়ে গেলো তার বন্ধুর যে এক ঘন্টা আগেও তরী তরী বলে মাথা খেয়ে ফেলছিলো সে বলছে এসব নাটক ছিলো!তন্ময়ের ভীষণ খারাপ লাগলো যদি তরীর সত্যি কোনো দোষ না থাকে তো ফারাবী তরী কে হারিয়ে ফেলবে,তখন আর আফসোস করা ছাড়া উপায় থাকবে না!
তরী রুমে আসলো নিঃশব্দে, তন্ময় দেখে হেসে কেমন আছে জিজ্ঞেস করলো।ফারাবীকেও খুবই স্বাভাবিক ভাবে বললো মা তাকে ডাকছে।
——–
তরী ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো দ্রুত,চোখ ফেটে কান্না আসছে তার ধ’ম বন্ধ লাগছে পুরো,শাওয়ার ছেড়ে নিচে বসে পড়লো ধপ করে।তার সাথেই কেনো?ফারাবী কে কতোটা বিশ্বাস করেছিলো,নিজের অজান্তেই ছেলেটাকে মন দিয়ে বসেছে সে।এর এই প্রতিদান দিলো তাকে নিয়তি।ভালোবাসা জিনিস টা কি ওর ভাগ্যতেই নেই,সবাই ছেড়ে চলে যায় এভাবে।ফারীর কেয়ার গুলা সব মিথ্যা?ফারাবীর হাসির মাঝে বলা কথা গুলো সব মিথ্যা, ফারাবীর দেওয়া ছোট্ট ছোট্ট মিষ্টি ছোঁয়া গুলোও মিথ্যা সব মিথ্যা সব কিছু।তরীর বুকে ব্যাথা করতে শুরু করলো,এই দ্বিতীয় বারের মতো ওর হৃদয়ে তীব্র ব্যাথার সৃষ্টি হচ্ছে,প্রথম হয়েছিলো মাকে হারিয়ে দ্বিতীয়ত প্রিয় মানুষটান নিপুণ ধোঁকায়।কি দোষ ছিলো তরীর? জবাব চাওয়ার ইচ্ছেটাও ম’রে গেলো তরীর।তরী চলে যাবে বহু দূরে যাবে এই মানুষটাকে দেখে প্রতিনিয়ত গুমরে মরা’র থেকে তরী পালিয়ে যাবে নিজেকে লুকিয়ে নিবে, কোনো গুপ্ত খাঁচায়।ফারাবী নামক অভিনেতার থেকে মুক্তি চায় সে।এ ছোট্ট জীবনে কম তো লাঞ্ছনা পায়নি।তবু কেনো সৃষ্টিকর্তা তার ভাগে কোনো সুখ দেয়নি।এ পর্যন্ত কখনো ভাগ্য কে দোষারোপ করেনি তরী তবে আজ তার মন মানছে না।কাঁদতে কাঁদতে এক সময় শান্ত হয়ে যায় তরী।
চুপচাপ বেরিয়ে আসে। বারান্দায় গিয়ে খোলা আকাশের পানে চোখ রাখে।বিষন্ন হৃদয়টাকে দেখানোর মতো কেউ নেই।এই পৃথিবীতে সে একা শুধুই একা।কাউকেই নিজের ভাবা উচিত নয়।

তরী আর একবারের জন্য ফারাবীর সামনে যায়নি।ফারাবীও আসেনি।
রাতের খাবার শেষে,তরী রুমে আসলো,ফারাবী ও আসলো, তরী নিজের দুঃখ আড়াল করেছে খুব সন্তর্পনে এ ক্ষেত্রে সে ভীষণ পটু মানুষের কাছে এতো সহজে দুর্বলতা প্রকাশ করে না সে।ফারাবী তো তরী কে শুনিয়ে সব গুলো কথা বললো,মেয়েটা কি শুনতে পায়নি?শুনলে এতোটা শান্ত আছে কিভাবে?তবে কি শুভর বলা কথা সত্যি তরী যদি সত্যি সত্যি ওকে ভালোবাসতো তো রিয়েক্ট করতো।কেনো ফারাবী এমন করেছে তা জানতে চাইতো।কিন্তু তেমন কিছুই তো হচ্ছে না।

ফারাবী গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো
,,তোমার বাবার নাম কি তরী?

এই প্রথম তরী কে তরী বলে ডেকেছে ফারাবী,তরী নিরব হাসলো।ছোট করে উত্তর দিলো

,,জামাল আহমেদ!
ফারাবী থমকালো তরী এতো সহজে নিজের বাবার আসল পরিচয় তাকে দিয়ে দিলো?কিন্তু কেনো?

,,সে এখন কোথায়?

,,জানি না।

,,তুমি জানো কিন্তু আমাকে বলবে না তাই তো?

,,যে মানুষ নিজ থেকে হারিয়ে যায় তাদের খবর কেউ জানে না ফারাবী।আমার কথা বিশ্বাস না হলে কিছু করার নেই আমার।

তরী কথাটি বলে চুপচাপ গিয়ে সোফায় শুয়ে পড়লো।আজ ফারাবী নামক মানুষটার পাশে ঘুমাতে খুব বেশি রুচিতে বাঁধছে। চোখ বন্ধ করে নিলো তরী,ঘুম দরকার অনেক ঘুম।যে ঘুম তাকে ভুলিয়ে দিবে সব রকম কষ্ট।

তরীর ধরা গলায় বলা কথাগুলো ফারাবীকে পীড়া দিলো ভীষণ ভাবে।মেয়েটা সব সময় চাপা স্বভাবের নিজের মনে কি চলছে তা অপর ব্যক্তিকে কখনো বলে না।তবুও বেশ কথা বলতো ফারাবীর সাথে।কিন্তু আজ সব কিছু কেমন অন্য রকম।মেয়েটা রাতে ঝগ ড়া করে এসে ওর বুকের উপরে ঘুমাতো।ফারাবী না করলে উল্টো জোর দেখাতো,ফারাবীর উপর অধিকার ফলাতো।আজ তার তেমন কিছুই ঘটলো না কেনো?এই দুরত্ব তো ফারাবী নিজে চেয়েছিলো।সেই নিরব কথাটা মেয়েটি বুঝে ঠিক দূরে চলে গেলো কিন্তু ফারাবী কেনো মানতে পারছে না কেনো?কেনো হৃদয় টা এতো পু’ড়ছে তার।

ফারাবী একবার ডাকলো
,,তরী খাটে এসে ঘুমাও!

তরী জবাব দিলো না।মেয়েটা মাত্ররো কয়েক মিনিটে ঘুমিয়ে গেছে!আগে তো ওর আধঘন্টা কথা না বললে ঘুম হতো না আর আজ?
ফারাবী বিছানায় বসে পড়লো,মাথায় হাত দিয়ে।নিজেকে এতোটা অসহায় কখনো লাগেনি তার।এই মেয়েটাকে ছাড়া সে ম’রে যাবে।ফারাবী চায় এ সব কিছু মিথ্যা হয়ে যাক।তরী শুধু তার থাকুক,তরীকে কিছুতেই হারাতে পারবে না কিছুতেই না।তরী যদি জ্যাকের সাথে মিলেও থাকে তার পরও ফারাবী তাকে হারাতে চায় না।কিছুতেই না!

সারারাত নির্ঘুম কাটলো ফারাবীর,চোখ বন্ধ করতে গেলেই বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। একটা আদুরে মুখ চোখের সামনে না দেখে নিজেকে পাগ’ল প্রায় লাগছে। একদিন ও হয়নি বাকি সময় কিভাবে থাকবে ফারাবী কিভাবে?

সকালে ঘুম থেকে আগে উঠলো ফারাবী সকালেও ঘুমটা আসেনি তার।তরী আজ উঠেনি,মেয়েটা তো আগেই উঠে তবে কি কোনো সমস্যা?
ফারাবী উঠে গিয়ে তরীর কপালে হাত রাখতে চাইলো।
তবে আজ হাত রাখতে দ্বিধায় ভুগছে ফারাবী মেয়েটাকে হুটহাট ছুঁয়ে দিতো,জড়িয়ে ধরতো।তরী এটা নিয়ে কতো অভিযোগ করতো।কিন্তু আজ হাত কাঁপছে ফারাবীর।চোখ বন্ধ করে কপালে হাত রেখে ফারাবী চমকে উঠলো, জ্বরে গাঁ পু’ড়ে যাচ্ছে!

ফারাবীর হাতের ছোঁয়ায় ঘুম ভেঙে গেলো তরীর।উঠে বসে পড়লো,ফারাবীর দিকে একবার তাকিয়ে পাশ কাটিয়ে নেমে গেলো।

ফারাবী অধৈর্য কন্ঠে বললো
,,তরী তোমার শরীরে জ্বর উঠছো কেনো?শুয়ে থাকো!

তরীর অতি শান্ত কন্ঠ
,,এরকম জ্বর আমার অহরহই আসে ফারাবী,এসবে আমার উপর তেমন প্রভাব ফেলে না।ছোট বেলা থেকেই অভ্যাস আছে,পৃথিবীতে যারা একা শূন্য মানুষ তাদের এসব সামান্য জ্বরে কিছু করতে পারে না।

আপনি দয়া করে আমাকে আর দয়া দেখাবেন না।নিতে পারবো না আমি, অনেক কৃতজ্ঞ আমি আপনার প্রতি।দোহাই আপনার নতুন করে আর পাল্লা ভারী করবেন না।আমার কিছু নেই ফারাবী আত্নসম্মান আছে,ওইটুকু কেঁড়ে নিবেন না।আমি আপনার মতো নিখুঁত অভিনেতা না,আমি অতি সাধারণ মানুষ আমাকে এবারের মতো মাফ করুন।আর করুনা দেখিয়ে ভালোবাসা ভিক্ষা দিতে আসবেন না।ভালোবাসা আমার জীবনে কোনো দিন ছিলো না,তাতে আফসোস ও ছিলো না।কিন্তু আপনার অভিনয় দেখানো ভালোবাসায় আমাকে আফসোস করিয়ে ছাড়লো সত্যি আপনি মহান।নিজের কথা রেখেছেন সবার সামনে নাটক করার কথা ছিলো।আর আমি কতো বোকা ওটাকে সত্যি ভেবে নিলাম।
ভুল করেছি ফারাবী শা’স্তি তো পেতেই হবে আমাকে!
তবে আর না প্লিজ অভিনয় জগৎ বাইরে বেরিয়ে আসুন আপনি আপনার মতো আমাকে আমার মতো থাকতে দেন।
কথা দিচ্ছি আপনার পথের কাটা কোনো দিন হবো না!
চলবে?