বিষাদ বৃক্ষ পর্ব-১৬

0
37

#বিষাদ_বৃক্ষ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ১৬

আনতারা ভেবেছিল চারিদিকে থাকবে ঘুটঘুটে অন্ধকার। তবে তেমন কিছুই দেখা গেল না। চারিদিকে চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে। মৃদু মৃদু বাতাস। আনতারার ভয় এবং ভালো দুটোই লাগছে।
তাই সে আজাদের পাশাপাশি হাঁটার চেষ্টা করছে। কেননা যতই চাঁদের আলোয় ভেসে যাক তার কাছে রাত তো রাতই। অবশ্য আগের মত জড়সড় ভাবটা নেই। কেন নেই? আনতারা জানে না। অথচ বাবা ছাড়া কারো সাথে এত সহজে সে মিশেছে বলে মনে পড়ে না।

আর এই দিকে এই লোক। কি সুন্দর করে বলল, — ঘুরতে যাবে? এই ঘোরার নমুনা। নিজের মতো হাঁটছে। কোন টু শব্দ নেই। এই যে আনতারা তার সাথে হাঁটতে গিয়ে হাঁপিয়ে গেছে, সেই খবরও নেই।

আনতারা মুখ ফুলালো! কেন, কোন অধিকারে সে জানে না। মুখ ফুলাতেই তার হাঁটার গতিও কমে গেল।

আজাদ সাথে সাথেই পেছনে ফিরে তাকালো। এরকম নিস্তব্ধ রাতে আজ সে প্রথম বের হয়নি। প্রায়ই বের হয়। চাঁদের আলো যখন গলে গলে পড়ে তার হাঁটতে ভালো লাগে। এমন না মধ্য রাত। এগারোটার মতো হবে। গ্রামের মানুষ সন্ধ্যাে হতে না হতেই ঘুমিয়ে পড়ে। অতিরিক্ত দরকার ছাড়া এতো রাতে কেউ সজাগ থাকে না।

সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে আজাদ বলল, — কি হয়েছে?

আনতারা উত্তর দিল না। সে পাশে তাকালো। একটা ডোবার মতো। কি সুন্দর তাতে চাঁদটা ভেসে বেড়াচ্ছে।

— কেউ কি তোমাকে বলেছে তুমি অত্যন্ত একগুঁয়ে একটা মেয়ে।

আনতারা ফিরে আজাদের দিকে তাকালো। তার চাউনি নিষ্পাপ । সে এমন ভাবে তাকিয়ে রইল যেন এই শব্দ জীবনেও শুনেনি। অথচ তার জায়গায় অন্য কোন মেয়ে থাকলে এতক্ষণে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠত।

আজাদ ঠোঁট টিপে হাসলো! হেসে ডাকলো, — আনতারা।
আনতারা গাল ফুলিয়ে আস্তে করে বলল, — হুম।

— কথা টা ঠিক না। তুমি একগুঁয়ে না। তোমার বাবা তোমাকে আহ্লাদ দিয়ে দিয়ে এমন বানিয়েছে। সবার কাছে তুমি আহ্লাদই আশা কর।

আনতারা ঠোঁট টিপে হালকা হাসলো! কথাটা কিছুটা হলেও সত্য।

— না আসলে ব্যাপারটা তেমনও না। তুমি অতিরিক্ত সুন্দর তো। ছোট বেলা থেকে সবার কাছে অতিরিক্ত প্রশংসা শুনে শুনে অভ্যস্ত। তাই সবার কাছে সেই রকমটাই আশা কর। সবাই তোমাতে মুগ্ধ হবে, না হলেই মুখে তালা মেরে গাল ফুলিয়ে রাখ।

আনতারা দাঁড়িয়ে গেল। তার ঠোঁট টিপে হাসিও বন্ধ হয়ে গেল। এটা একদম সত্য না। আজাদ অবশ্য আগের মতোই বলল, — না আসলে ব্যাপারটা আগের তেমনের মতো তেমনও না। তেমনের আগে আহ্লাদও না। এমনও হতে পারে তোমার বাবার আহ্লাদরের আগে একগুঁয়েও না। আসলে তুমি ব্যাপারটা কি?

আনকারা হা করে তাকিয়ে রইল। তার সোজা মাথায় জট পাকিয়ে গেল। সে কি বলবে ভেবেই পেল না। অথচ বাবার আহ্লাদের কথা শুনে সে কত খুশি হয়েছিল।

আজাদ অনেক কষ্টে হাসি দমালো। বলল, — আচ্ছা থাক বাদ দাও। যেমনই তুমি, কি আর করার। বিয়ে তো আর চাট্টি খানি কথা না। যা হবার হয়ে গেছে। মিলে ঝিলে আপোষ করে নেবো।

আনতারা মন খারাপ করেই বড় একটা শ্বাস ফেলল! আসলে সে নিজেই বুঝতে পারছে না, নিজে কি? সে ফেলেই বলল, — আমি বাড়িতে যাব।

— যাও! আমি কি ধরে রেখেছি নাকি?

আনতারা আবার মুখ ফোলালো! এই লোকের সাথে আসাই তার ভুল হয়েছে। সে মুখ ফুলিয়েই বলল, —
আমি একা যেতে পারব না।

— না পারলে নেই? বলেই আজাদ আবার এগুলো। আনতারাও তার পিছু পিছু হাঁটতে লাগলো। ফিরে যাওয়া কি, দাঁড়িয়ে থাকা কি, কোনটাই তার দ্বারা সম্ভব না।

সে হাঁটতে হাঁটতেই ক্লান্ত ভাবে বলল, — আমরা কোথায় যাচ্ছি?

আজাদ নির্বিকার ভাবে বলল, — সামনে একটা শ্মশান আছে, সেখানে।

আনতারা আবারো থমকে দাঁড়িয়ে গেল। এতক্ষণ সে এক হাতে মাথার ঘোমটা চেপে রেখেছিল। আজাদের কথা শুনেই হাত ফসকে তা পড়ে গেল।

আজাদ আবারো ফিরে তাকালো। আনতারার গায়ে আজ খয়েরি শাড়ি। কালো পাড়। খয়েরি রং চাঁদের আলোতে কালো মনে হচ্ছে। এগুলো সব তারই কেনা। অবশ্য পছন্দ করে বিশেষ কোন রং কিনেছে এমন না। দোকানে গিয়ে বলেছে, বাসায় পরার মতো স্বস্তি দায়ক কাপড় দিন।

দোকানদার দাঁত কেলিয়ে বলেছে, — কি রঙের দেবো ?

সে তো জীবনে এসব কিনেনি। রং আবার কি? তার কাছে রং মানে লাল, সাদা, কালা। তাই দোকানে যতগুলো রং ছিল সব একটা করে নিয়ে এসেছে।

আনতারার গায়ে গহনা নেই। নাক, কানেতো এমনিতেই পরতে পারে না। গলায়, হাতে যা’ও থাকে শোয়ার আগে সব খুলে ফেলে। রাতের অন্ধকারে চাঁদের এই মিষ্টি আলোতে যেন আনতারার মুখ আকাশের তারার মতোই জ্বলজ্বল করছে। তার মনে হলো এই মেয়ের নাম সার্থক।

সে যেতে যেতেই বলল, — আমি যেখানে যাই। সেখানে তুমি নিঃসন্দেহে যেতে পার। আমি যত খারাপই হই। বেঁচে থাকতে অন্তত তোমার গায়ে ফুলের টোকাও লাগবে না।

আনতারা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল! এক’ই মানুষ অথচ কত রঙে কথা বলে। মাঝে মাঝে খুব আপন মনে হয় আবার মাঝে মাঝে খুবই অচেনা, সে মুখ গোঁজ করে বলল — ওমন মুখে বড় বড় কথা সবাই বলে।
— আচ্ছা?
— হুম।
— তাহলে তো প্রমাণ দিতে হয় ?
— আমার প্রমাণ লাগবে না। আমি এমনিতেই ঠিক আছি।

আজাদ হাসলো । আনতারা এগুলো না।,বলল, — একটু জিরিয়ে নিই?

আজাদ সাথে সাথেই থামলো। আনতারার শুধু মুখে মায়া না, কন্ঠ, হাঁটা, চলা, এমনকি এই যে কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে, সেখানেও।

সে দাঁড়াতেই আনতারা নিচু স্বরে বলল, — এই আপনার ঘুরতে নেওয়া? এখন দৌড় খাওয়াচ্ছেন।

— আমিতো আর জানতাম না, পিপীলিকার পায়ে পায়ে হাঁটো তুমি। এবার জানলাম। সামনে বার থেকে চিন্তা ভাবনা করে বলবো।

— আমি আর কখনো আপনার সাথে কোথাও যাব না।

— সময় বলবে।

— উঁহু! একদম না।

আজাদ হাসলো! আনতারা আঁচল টেনে গলা মুখের ঘাম মুছলো। মুছে বলল — এর চেয়ে তো ঘরেই ভালো ছিলাম। নেয়ে ঘেমে শেষ। এই বারো হাত কাপড়তো আর আপনার গায়ে না। আবার বলে পিপীলিকার হাঁটা।

— তুমি যে এতো কথা জানো এতদিন তো বুঝতেই পারিনি।

আনতারা একটু থমকালো! সে নিজেও খেয়াল করেনি সে স্বাভাবিক ভাবে আজাদের সাথে কথা বলছে। সে আবার মুখ ফুলিয়েই বলল, — আপনি যে খারাপ, সেটা বোঝা যায়?

আজাদের সোজা উত্তর — না যায় না।

— তো?

আজাদ আবারো হাসলো! তবে কিছু বলল না। আনতারাই বলল, — এভাবে প্রায় ঘুরের আপনি?

— প্রায় না তবে মাঝে মাঝে।

— কেন?

— আগের গুলোর কোন কারণ নেই, এমনিই। তবে আজকের পেছনে কারণ আছে।

— কি?

— সত্য বলবো না মিথ্যা?

— মিথ্যা কেন বলবেন?

আজাদ বাঁকা হাসলো। হেসে বলল, — তখন তুমি আমাকে টানছিলে। টানা বোঝ মেয়ে? বলেই আনতারার দিকে তাকালো।

আনতারা স্তব্ধ হয়ে গেল। এই লোকতো সত্যিই সত্যিই খারাপ। সে তো এমনিই মুখে মুখে বলছিল।

আজাদ আগের মতোই বাঁকা হেসে বলল, — এবার বুঝেছো মিথ্যা কেন বলব।

আনতারা কোন রকম বলল, — আমি বাড়িতে যাব।

আজাদ আগের মতোই বলল — যাও! নিষেধ করেছে কে? বলেই সিগারেটের প্যাকেট বের করল।

আনতারা বড় বড় চোখ করে বলল, — আপনি সিগারেট খান?

— হ্যাঁ।

— কেন?

আজাদ স্বাভাবিক ভাবেই বলল — ভার্সিটিতে থাকতে একদিন বন্ধুদের সাথে খেলাম। তারপর মহব্বত হয়ে গেল। আমার মহব্বত খুবই বিপজ্জনক। একবার হলে আমি সেই মহব্বতের জিনিস ছাড়তে পারি না। কোন অবস্থাই না।

— এই কয়দিনে তো আপনাকে একবারও খেতে দেখিনি?

— বাসার কেউ জানে না তাই দেখোনি ।

— এই যে আমি এখন জেনে গেলাম?

আজাদ সিগারেট ঠোঁটে রেখে আগুন জ্বালাতে জ্বালাতে বলল, — তুমি আমার অনেক কিছুই জানবে। যা আর কেউ জানবে না।

— আমি সবাইকে বলে দেবো।

— ইচ্ছে হলে বলবে তবে আমি শাস্তি দেব।

— কিসের শাস্তি?

— এই যে এতো কষ্ট করে নিজেকে সংযত রাখছি সেটা রাখবো না।

আনতারা আবারো স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তার জীবন বরই ছোট। আর এই ছোট জীবনে এতো ঠোঁট কাটা, লাজ-লজ্জা, সংকোচহীন ছেলে সে জীবনে দেখেনি।

তখনি নিস্তব্দ রাত ভেদ করে একটা শব্দ ভেসে এলো। দূর থেকে একটা চিকন আলোর রশ্মি রাস্তায় পড়তে লাগলো। আনতারা চমকে গেল। আর যাই থাক এতটুকু জ্ঞান তার আছে। রাত দুপুরে কোন বাড়ির কোন বউকে কেউ এভাবে রাস্তায় দেখলে ভালো বলবে না। সে ভয় মাখা চোখে আজাদের দিকে তাকালো।

আজাদের মধ্যে অবশ্য তেমন হেলদোল দেখা গেল না। এই ওত্র এলাকায় শুধু একজনের কাছেই বাইক আছে। সেটা চেয়ারম্যান। এতো রাতে কাজ কি ? সে ভ্রু কুঁচকেই সিগারেট পায়ে পিষলো । পিষে আনকারা হাত ধরে ঝট করে ঝোপের ভেতরে ঢুকে গেল।

আনতারা ভয়ে শেষ। যদি সাপ টাপ থাকে। না থাকলেও জঙ্গল ভরা পোকা মাকড়। পোকা মাকড়ের কথা মনে পড়তেই তার শরীর শিরশিরিয়ে উঠল। আর সে চাপতে চাপতে বলতে গেলে আজাদেন বুকের সাথে লেপটে গেল।

আজাদ না কিছু বলল, না নড়লো চড়ল। সোজা চুপচাপ দাড়িয়ে রইল।

সকাল হতেই আনতারা চেখে সরষে ফুল দেখলো। কেননা, তাকে দেখেই মুর্শিদা বলল, — ঘুরে ফিরে তো অনেক খাইলা। এবার একদিন শ্বশুর বাড়ির মানুষদের ভূরিভোজ করাও। নাকি সেই কপাল আমার নাই, যে দু- একদিন পুতের বউদের রান্না- বান্না খাব।

আনতারা ঢোক গিললো। সে রান্না জানে। তবে এতো বড় বড় মাটির উনুনে রান্না তো ভালোই কখনো চোখেও দেখেনি। সে ঢোক গিলেই এগিয়ে গেল। তার সাথে শবনমও এগুলো। তাকে এগুতে দেখতেই বিথী চোখ পাকিয়ে বলল, — তুমি যাইতেছো কেন?

— একটু দেখিয়ে দিই। প্রথম বার করবে। কোন কিছু তো খুঁজো পাবে না ?

— অনেক দরদ না। বড় ভাইকে বলি তারপর দেখি কোথায় কোথায় দরদ তোমার?

শবনম মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল! আমেনার আজকেও শরীর ভালো। তার শরীর ভালো হলেই সে বাইরে এসে বসে। সে বিরক্ত মাখা কন্ঠে বলল, — বিথী শবনম তোমার বড় ভাবি। লেহাজ করে কথা বলবি।

বিথী আগের মতোই সমান তালে বলল, — আমার ইচ্ছা। ভাই আমার, ভাবি আমার।

আমেনা মুর্শিদা দিকে তাকিয়ে বলল, — ভাবি বউরা বাড়ির। কাজকর্ম, লেহাজ দু- দিন পরে শেখালেও হবে। তাদের জন্য তো আমাদের কেউ কথা শোনাতে আসবে না। কিন্তু মেয়ে! সেটার জন্য অবশ্যই শুনতে হবে। তাই পারলে আগে মেয়েকে একটু কিছু শেখাও।

মুর্শিদা আঁচল টেনে ঘাড় সোজা করে বলল, — কথা শোনাবে এমন বাসায় মেয়েই দেব নারে আমেনা। মেয়ে আমার যক্ষের ধন, অন্য মানুষদের মত তো হাতে পায়ের নিচে না।

আমেনা কষ্ট পেল। পাবেই না কেন? পুরোনো ঘা, একটু খোঁচা লাগলেই ব্যথার টগবগিয়ে উঠে। তবে সে আর তাদের কিছু বলল না। শবনমের দিকে তাকিয়ে বলল, — তুমি যাও বড় বউ। প্রথম বার হাত পা পুড়িয়ে ফেলতে পারে।

শবনম হালকা হেসে এগিয়ে গেল। আমেনা বিথীকে সম্পূর্ন অদেখা করে মিথিকে বলল, — তুইও যা। কেটে টেটে এগিয়ে দে। না দেখলে শিখবি কিভাবে। মেয়ে হয়ে জন্মেছিস। যতোই বাপ, দাদার নাম থাক, রুপ থাক। চুলো গুঁততেই হবে, যা।

মিথি মুখ ফুলিয়ে বলল, — নাহার ফুপু, সোহাগী আছে তো?

আমেনা চোখ রাঙিয়ে বলল, — যাবি তুই।

মিথি বিরক্ত হয়েই এগিয়ে গেল। বিথী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। আমেনা অবশ্যই ফিরেও তাকালো না। সে আবার ধীরে ধীরে ভেতরে চলে গেল। যেতে যেতে রমিজকে ডাকলো। মিথির বাবা দু- দিন হলো বাড়িতে ফিরছে না। একটু খোঁজ নেওয়া দরকার।

চলবে……