বিষাদনীড়ে মায়াতরী [২৮]
প্রভা আফরিন
_
শ্বশুর বাড়িতে একদিন থাকার কথা থাকলেও সাম্য রইল দু’দিন। তাতে খুব একটা সুবিধা হলো না। চিত্রা প্রথম দিন তাকে যতটা সময় দিয়েছে পরের দুদিনে তেমনটা মোটেও দেয়নি। সেদিন রাতে উঠানে বসে গল্প করার সময় আলো নিভে গেলে আঁধারের সুযোগ নিয়ে অতর্কিতে চিত্রার গালে ছোটো একটি হা’মলা চালায় সে। যার ফলে দুদিন যাবত চিত্রা তার সামনে এলেই লজ্জায় পালিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য এটাকে লজ্জা পাওয়া বলে নাকি এড়িয়ে চলা সাম্য ঠিক বুঝতে পারছে না। আজ দুপুরে তারা নিবাসপুর ফিরে যাবে। সকালে ঘুম থেকে উঠে সাম্য আজ বাইরে যায়নি। সে জানে একটু পরই চিত্রা আসবে। তার দরকার-অদরকার সম্পর্কে খোঁজ নেবে। মেয়েটা তাকে যত্নে রাখতে ভুলছে না। তার কোনো দায়িত্বে অবহেলাও করেনা। শুধু মনের ভেতরই ঢুকতে দিচ্ছে না।
সাম্যকে উঠতে না দেখে চিত্রা এলো না। সে প্রথমে পালিকে পাঠালো দুলাভাইকে ডেকে নিতে। কিন্তু সাম্য চিত্রাকে ডাকতে বলে পুনরায় বিছানায় গড়াগড়ি করছে। বাধ্য হয়ে একটু পর চিত্রা ঘরে ঢুকল। জানালার কপাট খুলে দিয়ে দিনের প্রথম ভাগের রোদ গায়ে মেখে প্রশ্ন করল,
“আপনার কী শরীর খারাপ?”
সাম্য উঠে বসে ওর দিকে তাকালো। আঁচলের নিচে মেয়েটার খোলা চুল ছড়িয়ে আছে। পেলব রোদ্দুর খেলে যাচ্ছে ত্বকের ওপর। সাম্যের বুঝি রোদ্দুরকেও হিং’সে হলো। সে গম্ভীর মুখেই বলল,
“জানি না।”
সাম্যের গলার গাম্ভীর্য টের পেয়ে চিত্রা চিন্তিত চোখে এগিয়ে এলো খাটের কাছে। নতুন জামাই প্রথমবার শ্বশুর বাড়ি এসে অসুস্থ হওয়া মোটেও ভালো কথা নয়। চিত্রা কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আলতো করে সাম্যের কপালে হাত ছোঁয়ায়।
“তাপ নেই তো। রাতে ঘুম হয়েছে?”
সাম্য মাথা নাড়ে। ঘুম ভালো হয়েছে। তবে? কয়েকদিনে চিত্রা বুঝে গেছে সাম্য মোক্তার বাড়ির আদরের ছেলে। সবার ছোটো বলে তার প্রতি সকলের স্নেহ ও আশাকারাও বেশি। কোনো কারণে অসন্তুষ্ট হলো! নাকি সরে সরে থাকায় রাগ করল সেটা নিয়েও খানিক সন্ধিহান হলো চিত্রা।
“আপনি কী রাগ করেছেন?”
সাম্য তখন আবেশে বিভোর। চিত্রার গায়ের মেয়েলি গন্ধটা ইতিমধ্যে তার নিকট মাতাল করা সুগন্ধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুগ্ধতায় খেই হারিয়ে বলল,
“করাটা স্বাভাবিক নয় কি? তুমি শুধু পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছো।”
“আর পালাবো কই? আজই তো ফিরে যাচ্ছি আপনার বাড়ি।”
“আমার বাড়ি কী তোমার বাড়ি নয়?”
“হু, আমাদের বাড়ি।”
সাম্যের ঠোঁটে এতক্ষণে হাসি ফুটে উঠল। সে আলতো করে চিত্রার হাত মুঠোয় পুরে নেয়। ইশারা করে পাশে বসতে। চিত্রা বসল। বলল,
“আপনার সঙ্গে একটা কথা ছিল।”
“নিঃসঙ্কোচে বলো।”
“আমি আরও পড়তে চাই।”
“অবশ্যই। এতে আমার কোনো আপত্তি নেই।”
“কিন্তু আব্বা-আম্মা?”
“অসুবিধা হবে না। আমি কথা বলব। কিন্তু..”
“কিন্তু কী?”
“শহরে নিয়ে ভর্তি করালে হয়তো মা একটু দ্বিমত করতে পারে।”
“সমস্যা নেই। আমি এখানকার কলেজেই ভর্তি হবো।”
সাম্য হাসল। চিত্রা ভড়কে দিয়ে ওর গাল টেনে দিলো।
“কিন্তু আমার সমস্যা আছে। আমার পড়াশোনা শহরে। তোমাকে এখানে রেখে তো আমি ওখানে গিয়ে থাকতে পারব না। থাকতে চাইও না। মাকে ঠিক মানিয়ে নেব।”
চিত্রা এ নিয়ে কথা বাড়ালো না। সে একটু একটু নাক টানছে। সাম্য তা খেয়াল করে বলল,
“ঠান্ডা লাগল কী করে?”
“রোজ সকালে গোসল করে।”
কথাটা শেষ করেই সে সাম্যের মুখের দিকে তাকালো। তার আহ্লাদী স্বামীর হাসি কান অবধি ছড়িয়েছে। এই মিচকে হাসি মোটেও সুবিধার নয়। পরের কথাটা কী হতে পারে আন্দাজ করতেই চিত্রা তড়িঘড়ি করে সরে দাঁড়ালো। ব্যস্ত গলায় বলল,
“হাত-মুখ ধুয়ে নিন। আব্বা আপনার সাথে নাশতা করার জন্য অপেক্ষা করছেন।”
চিত্রা দ্রুতপায়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় শুনতে পেল সাম্য উচ্চস্বরে হাসছে।
মেহেরুন বানু এই দুদিনে সাম্য চিত্রাকে পর্যবেক্ষণ করে বুঝেছেন সম্পর্কটা ছাড়াছাড়া। সাম্য এগিয়ে এলেও চিত্রা এগোতে পারছে না। এজন্য দুজনের একসাথে থাকাটাও ভীষণ জরুরী। চিত্রা চলে যাওয়ার সময় তিনি বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
“মাইয়ারা হইলো তরলের মতো। যেই পাত্রে রাখব তারই আকার ধারণ করব। যদি সে বরফও হয়, পবিত্র সম্পর্কের ভালোবাসা, অধিকারবোধের তাপে গলতে গলতে তারে তরল হইতেই হইব। নিজেরে বরফ কইরা না রাইখা একবার স্বামীর বুকে মাথা রাখ। সব সময় ভালোবাইসা বুকে মাথা রাখতে হইব এর কোনো মানে নাই। একটু নির্ভার হইতেও মাথা রাখা যায়। সংসার করতে ভালোবাসার চেয়েও শ্রদ্ধাবোধ জরুরী। নইলে ওই সংসারে সুখ দূরে থাক, ভালোথাকাও টিকে না। নিজের ইচ্ছার পাশাপাশি সাথের জনের ইচ্ছারেও সম্মান দিবি। আমি জানি আমার নাতনি তা পারব।”
চিত্রা সারাপথ সেসব কথাই ভেবে গেল। দুপুরের সূর্যটা পশ্চিমে খানিক মাথা হেলিয়েছে। রোদের প্রতিফলনে নদীতে ঢেউ তোলা উত্তার জলরাশি ঝকঝক করছে। উড়ে আসা এলোমেলো বাতাস আলিঙ্গন করছে ট্রলারে বসা নবদম্পতিকে। ছইয়ের ভেতর শুধু সাম্য ও চিত্রা আছে। সাম্য হাত বাড়িয়ে চিত্রাকে কাছে ডাকে। চিত্রা মানা করল না। সঙ্গীর ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে তার কাছে গেল। সাম্য ওকে একহাতে জড়িয়ে ধরলে চিত্রা নিজ থেকেই বুকে মাথা রেখে ভর ছেড়ে দেয়। খানিক নির্ভার হতে। সাম্য মুচকি হেসে তাকে দুহাতে আগলে নেয়। দুজনের কেউ কোনো কথা বলে না। তবুও নিশ্বাসের উত্তাপ যেন ফিসফিস করে অনেক কিছুই বলে যায়। চিত্রার জড়তা হয়তো তখনই কা’টতে লাগল।
____________
নিবাসপুর
নিবাসপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাফর মোক্তার বাড়িতে এসেছে নতুন বউকে দেখতে। তার আপ্যায়নের আয়োজনও কম নয়। চিত্রাকে দেখে তিনি বললেন,
“বউ তো না যেন চান্দের একটা টুকরা খসে পড়ছে আকাশ থাইকা। চোখ জুড়াইয়া গেল।”
জাফল মুখ খুলে চিত্রার প্রশংসা করলেন। সাম্যের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করে দোয়া করতেও ভুললেন না। তবে জাফরের মুখে সৌন্দর্য নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের প্রশংসা শুনতে চিত্রার খানিক অস্বস্তি হলো। কেন জানি লোকটার চোখের সামনে থাকতে ইচ্ছে হলো না। বেশিক্ষণ থাকতেও হলো না। রাজিয়া ভেতরে নিয়ে চলে গেলেন। বললেন,
“পুরুষ মানুষ দেখতে আইলে বড়ো কইরা ঘোমটা দিয়া সামনে যাইবা। পুরা মুখ দেখানের দরকার নাই।”
চিত্রা মাথা কাত করে। এবার সে দোতলায় আলাদা ঘরে উঠেছে। হেনা অবশ্য জোর করেছিল তার ঘরেই থাকতে। রাজিয়া কি ভেবে যেন আলাদা ঘরে দিলেন। হাসনার বড়ো মেয়ে, আট বছরের তমা থাকবে তার সাথে।
আজও হেনার ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ঝগড়ার চাপা আওয়াজ পেল সে। কী এমন কারণ যার জন্য দুজনে এত দ্ব’ন্দ্ব? পরক্ষণেই চিত্রা নিজের কৌতুহল দমায়। স্বামী-স্ত্রীর গোপন বিষয়ে এত আগ্রহ থাকা অনুচিত। তবে তমা তার কৌতুহল বাড়িয়ে দিলো। হেনা ও উজ্জ্বলের রাগারাগি শুনে সে ফট করে বলে ফেলল,
“খালা আবার বড়ো মামাকে নিয়ে খালুর সঙ্গে ঝ’গড়া বাধিয়েছে।”
“তোমার বড়ো মামাকে তো দেখলাম না।”
“খালা বাড়িতে থাকলে বড়ো মামা আসে না।”
“কেন?”
“জানি না। কিন্তু অনেক ঝ’গড়া হয়।”
চিত্রা এ নিয়ে তমার সঙ্গে কোনো কথা বলল না। ছোটো বাচ্চার এসব না জানাই ভালো। ফজিলা রাতের খাবারের জন্য ডাকতে এলে চিত্রা তাকে প্রশ্ন করল,
“তমার বড়ো মামা কী বাসায় থাকেন না?”
“রবিন ভাইয়ের কথা কও?”
চিত্রা মাথা নাড়ে। ফজিলা নিচু গলায় বলল,
“থাকব কেমনে? হেনা আপায় বাড়িত আইলে বড়ো চাচায় ভাইজানরে কামের উছিলায় বাড়িততে সরায় দেয়।”
“কেন? হেনা আপার সঙ্গে ওনার কী ঝামেলা?”
“হেগো মইদ্যেই তো সব ঝামেলা।”
“মানে?”
“হেনা আপায় ছুডুকাল থাইকা রবিন ভাইয়ের লইগ্যা পাগল। বিয়ার কথাও উঠছিল। কিন্তু বড়ো চাচা, মেজো চাচা কেউ মাইনা লয় নাই। রবিন ভাইয়েরে কামের উছিলায় পাঠায় দিলো শহরে আর হেনা আপারে জোর কইরা বিয়া দিলো উজ্জ্বল দুলাভাইয়ের লগে। বিয়ার কয়দিন ঠিক আছিলো। হেরপর শুরু হইলো বে’হা’ইয়াপনা। এই বাড়িত একবার আইলে আর যাইতে চায় না। উজ্জ্বল ভাই কাম ফালাইয়া ছুইটা আহে বউ নিয়া যাইতে। হেনা আপায় যায় না। বিয়ার এত বছর হইছে একটা পোলাপাইনও লয় না। কি জানি খায়। এদিকে রবিন ভাইয়েও বিয়া করে না। উজ্জ্বল ভাই দেইখা এত ধৈর্য ধইরা আছে। অন্য বেডার ঘরে পড়লে লা’ত্থি দিয়ে কোমর বে’কাইয়া দিত।”
“পরিবার এই সমস্যার সমাধান করতে বসেনি?”
“বইছে কতবার! চাচিয়ে কত মা’রা যে মা’রছে। দুইদিন চুপ থাইকা আবার যেই কি সেই।”
চিত্রা অবাক হলো সবটা শুনে। উজ্জ্বল ভাই এত ভালো একজন মানুষ। অথচ এত বছরেও পুরোনো ভালোবাসা ভুলে হেনা তাকে ভালোবেসে গ্রহণ করতে পারল না? চিত্রার মনে ভয় ঢুকে যায়। সে পারবে তো?
চলবে…
বিষাদনীড়ে মায়াতরী [২৯]
প্রভা আফরিন
_
নিবাসপুর
কাক ডাকা ভোরে একটি ইঞ্জিন চালিত নৌকা এসে থামল মোক্তার বাড়ির পেছনের ঘাটে। চারিদিকে তখনও ভালো করে আলো ফোটেনি। বিল থেকে ভেসে আসা কোমল হাওয়া প্রকৃতিকে পরম আবেশে জড়িয়ে রেখেছে। রবিন গলুই থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়ল। মুহূর্তেই ঘাটছোঁয়া স্বচ্ছ পানি ঘোলা হয়ে গেল। জলের অস্থিরতা টের পেয়ে দল বেধে নির্বিঘ্নে ভেসে বেড়ানো মাছেরা হুড়োহুড়ি করে রণে ভঙ্গ দিলো। রবিন ঘাটে নেমে স্বচ্ছ পানির দিকে এগিয়ে চোখেমুখে পানি ঝাপটা দিলো বারকয়েক। তার নির্ঘুম চোখদুটি ক্লান্তিতে লাল হয়ে আছে। অনেকক্ষণ বসে থাকায় পা দুটি ঝিমঝিম করছে। সে হাত-পা ঝারা দিয়ে বাড়ির দিকে গেল। পাশাপাশি দুটি ভবনের সামনে বিস্তৃত এক শ্যাওলা পড়া উঠান। কোমড়ে আঁচল গুজে উঠান ঝাঁট দিচ্ছিলো ফজিলা। রবিনকে দেখে প্রথমে ভুত দেখার মতো চমকে উঠল সে। বুকে থুতু ছিটিয়ে বলল,
“ভাইজান আইছেন?”
রবিন বিরক্ত হয়ে ভরাট কণ্ঠে উত্তর দিলো,
“ক্যান? আমারে দেখা যায় না?”
ফজিলা থতমত খেয়ে গেল। তবে দমে গেল না। প্রবল আগ্রহে জিজ্ঞেস করল,
“আপনে সাম্য ভাইয়ের বিয়ার দিন আইলেন না ক্যান?”
“কাম আছিলো।”
“সমস্যা নাই। সাম্য ভাইয়ের এক নাম্বার বউভাতে তো থাকতে পারেন নাই। দুই নাম্বার বউভাতে থাকতে পারবেন। এক্কেবারে ঠিক দিনে আইছেন, ভাইজান।”
“দুই নাম্বার?” রবিন ভ্রু কুচকালো।
“হ, হেইবার বউভাত হইলেও বাসর হয় নাই। হের লইগ্যা আইজ সাম্য ভাইয়ের আরেকবার বউভাতে আয়োজন কইরা বাসর সাজাইব।”
রবিন সেসব কথায় খুব একটা আগ্রহ দেখালো না। সে হেলেদুলে পুরোনো ভবনের দিকে এগিয়ে গেল। ফিরোজা সবে নামাজ পড়ে সদর দরজা খুলেছে। ছেলেকে দেখে যারপরনাই চমকে উঠলেন। এগিয়ে এসে কপালে, মাথায় হাত বুলিয়ে বাষ্পীভূত কণ্ঠে বললেন,
“এতদিন পরে বাড়ির কথা মনে পড়ল বাপ?”
রবিন মিষ্টি করে হাসল। মায়ের হাত ধরে চুমু খেয়ে বলল,
“তোমার হাতের রান্ধার কথা মনে পড়তেই ছুইটা আইলাম। খিদা লাগছে। ঘরে যা আছে দেও।”
ফিরোজা ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন ছেলেটা কেমন শুকিয়ে গেছে। চুল-দাড়িও বোধহয় নিয়মিত কা’টে না। রবিন চট্টগ্রামে ছিল। সেখানে কোথায় থেকেছে, কী খেয়েছে কে জানে? মায়ের মতো করে কেউ যত্ন নিতে পারে নাকি? তিনি রবিনকে গোসল করতে পাঠিয়ে ছুটলেন নতুন ভবনে। ফিরোজা ও রাজিয়ার রান্নার হাড়ি আলাদা হলেও সাম্যের বিয়ে উপলক্ষে এক সপ্তাহ যাবত একই বাড়িতে রান্নার ব্যবস্থা হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই ওনার ঘরে এখন রান্না করা কোনো খাবার নেই। তিনি গিয়ে দেখলেন রাজিয়া চুলায় আগুন ধরিয়েছে সবে৷ বললেন,
“রাইতের বাইচা যাওয়া ভাত-তরকারি আছে?”
“ফজিলা ভাতে পানি দিয়া থোয় নাই, তরকারি জ্বাল দিতেও ভুইলা গেছিলো। সব খাওন নষ্ট হইয়া গেছে। ফালাইয়া দিছি। বাসি খাওন খুঁজোস ক্যান?”
“রবিন আইছে হবায়। খিদা লাগছে পোলাডার। এহন কী দিমু সামনে?”
রাজিয়া চমকে উঠলেন। একটু ভেবে বললেন,
“এক কাম কর, কলার ছড়াডা নিয়া দে আপাতত খিদা কমুক। আমি জলদি কয়ডা রুটি বানাইয়া ডিম খোলা দিয়া দিতাছি।”
“আইচ্ছা।”
ফিরোজা চলে যেতে নিলে রাজিয়া পিছু ডাকলেন,
“আর হুন, তর পোলারে আইজ এই বাড়িত আইতে দিস না। আজকের দিনে কোনো ঝামেলা হোক চাই না।”
ফিরোজার মুখ কালো হলো। বলতে ইচ্ছে করল,
“আপনের মাইয়ার লইগ্যা কি আমার পোলা স্বাধীন মতো চলতে পারব না? ঘরে বহাইয়া থুমু? পরের পোলারে দোষ দেওনের আগে নিজের মাইয়ারে সামলান।”
আফসোস! ফিরোজা বলতে পারে না। ছেলেটা অনেকদিন পর ফিরেছে। কোনো ঝামেলা হোক তিনিও চান না। ফিরোজা কলার ছড়া নিয়ে দিতে রবিন মুখ বেঁকালো। কাল রাত থেকে পেটে কিছুই পড়েনি। ভেবেছিল বাড়িতে এসে পেট ভরে ভাত খেয়ে একটা ঘুম দেবে। তাও কপালে জুটল না। রবিন মনে মনে তাচ্ছিল্য করে,
“হাহ কপাল! একটা ছোটো ইচ্ছাও যদি ঠিকঠাক পূরণ হইতো!”
অগত্যা খিদের জ্বালায় পর পর দুই হালি কলা পেটে চালান করে দিলো সে। ফিরোজা বলে গেলেন সজাগ থাকতে। তবে রবিনের অবাদ্ধ চোখ সে আদেশ মানলো না। বিছানা দেখা মাত্রই অদৃশ্য এক নিদ্রারাজ্য তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকল। তাতে সায় দিয়ে রবিন বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়া মাত্রই বিভোর হয়ে তলিয়ে গেল।
আজ সাম্য-চিত্রার ফুলসয্যাসহ ছোটো করে আরো একটি বউভাতের আয়োজন করা হয়েছে। অতিথিরা প্রায় সকলেই বিদায় নিয়েছে। এই আয়োজন হচ্ছে ঘরোয়াভাবে। নিজেদের মাঝে রেষারেষি থাকলেও ফিরোজা দায়িত্ব নিয়ে কাজে সাহায্য করতে কার্পণ্য করেন না। বাড়ির ছেলেমেয়েগুলোকে তিনি একটু বেশিই ভালোবাসেন। তবে ছোটো বউ নাজনীনকে কোনো কাজেই পাওয়া গেল না। সে খুব একটা যে কাজে হাত দেয় তাও নয়। বড়ো ঘরের মেয়ে বলে খানিকটা নাক উঁচু স্বভাবের। বয়সে বেশিই ছোটো বলে বড়ো দুই জা মুখ কালো করলেও মেনে নেন। তবে এবার নাজনীনের আগ্রহ না দেখানোর আরও একটি কারণ আছে। বউভাতের দিন মেহেরুন বানু একঘর ভর্তি মানুষের সামনে তার দুর্বলতা নিয়ে তাচ্ছিল্য করেছেন। চিত্রা ব্যতীত এ বাড়ির মেয়ে-বউদের থেকে সব দিক দিয়ে নাজনীন এগিয়ে। শিক্ষা, যোগ্যতা, রূপ কিংবা বংশে। তবুও তার সকল আভিজাত্য গুড়িয়ে যায়, তাচ্ছিল্যের কারণ হয় শুধু এই একটা দিকে এসেই। সে বন্ধ্যা নারী। বিয়ের নয় বছর পেরিয়েছে, এখনও অবধি সন্তানের মুখ দেখতে পায়নি। তার আড়ালে যে মানুষ বিপুলকে আরেকবার বিয়ে করতে বলে সে বুঝতে পারে। তাই কাউকেই বিশ্বাস করতে পারে না। বিপুলকে অনেকবার পালক সন্তান এনে দিতে বলেছিল। বিপুল স্পষ্ট বলেছে, বাচ্চা হলে নিজের নয়তো নয়। এরপর সে নিজের স্বামীকেও বিশ্বাস করতে পারে না। বিপুল অবশ্য ভরসা দেয় সে আর বিয়েশাদি করবে না। কিন্তু অস্তিত্ব সংকটে ভোগা নাজনীন সদা সতর্ক। কেউ না আবার কানপড়া দিয়ে তার স্বামীর মন বদলে দেয়! শ্বাশুড়ি রমিজা তো সন্তান হয় না বলে তাকে দেখতেই পারেন না। দিনরাত ছেলের আবার বিয়ে দেওয়ার নাম জপ করেন। সেদিন মেহেরুন বানু ঘরভর্তি মানুষের সামনে তাকে তাচ্ছিল্য করার পর নাজনীন যখন স্বামীর কাছে কান্নাকাটি করল বিপুল বলে দিলো দোষ নাকি নাজনীনেরই। তাকে কে বলেছিল আগ বাড়িয়ে করবীর মেয়ের জন্ম-পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তুলতে? এই নিয়ে বিস্তর এক ঝগড়াও হয়ে গেছে দুজনের মাঝে। নাজনীন তাতে আরও ফুঁ’সে উঠেছে। ফলে তার চাপা ক্ষো’ভ খন্দকার বাড়ির মেয়ে হওয়ায় চিত্রার ওপরও পড়েছে।
সাম্য সকাল থেকে চিত্রার আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। নানান ইশারায় প্রেম নিবেদন করছে। আশপাশ দিয়ে হেটে যাওয়ার সময় তার অবাদ্ধ আঙুল চিত্রার গা ছুঁয়ে যাচ্ছে। এমনকি চোখ মারতেও ভুলছে না। তার এমন বে’হায়াপনায় চিত্রা যারপরনাই অতিষ্ঠ। বারবার সতর্কভাবে আশেপাশে তাকাচ্ছে এই বুঝি কেউ দেখে নিল৷ এই বুঝি লজ্জায় ডুবে ম’রতে হলো। অথচ সাম্য ভ্রুক্ষেপহীন। জগতে সে, তার আদুরে বউ এবং উড়ুউড়ু মন ছাড়া যেন বাকিসব দৃষ্টিসীমার অলক্ষ্যে। অধীর হয়ে প্রহর গুনছে কখন দিনটা কেটে যাবে। চিত্রা তার হৃদয় ছাড়িয়ে সমগ্র অস্তিত্বে এসে জড়িয়ে নেবে। এই অপেক্ষার মাঝেও সে সুক্ষ্ম সুখ অনুভব করছে।
ভাদ্র মাসের তপ্ত দুপুরে সূর্য মাথার ওপর উঠে যেন দামামা বাজাচ্ছে। চিত্রা গোসল শেষে খোলা জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো। বাইরে যতদূর চোখ যায় থৈথৈ স্বচ্ছ জলরাশি। বিল থেকে উড়ে আসা মৃদুমন্দ বাতাস ওর দেহে সতেজতা বিলিয়ে দিচ্ছে। চিত্রা চুল থেকে গামছা খুলে নিল। গামছাটি গোল গোল করে ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে নিয়ে চুলগুলো সামনে এনে দুটি ঝারা দিতেই একজোড়া হাত পেছন থেকে এসে ওকে জাপটে ধরল। চিত্রা চমকে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ধাতস্থ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এই অবাদ্ধ হাত ও তার নিয়ন্ত্রক বাপের বাড়ি থেকে ফেরার পর ওর আরাম কেড়ে নিয়েছে। সে কটমট করে তাকালে সাম্য বলে উঠল,
“আরেহ! এই চোখদুটোকেই তো খুঁজছি। এই রাগি, গম্ভীর চোখদুটোই তো কড়া চাহনি দিয়ে আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছিল।”
চিত্রা একইভাবে তাকিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল,
“এটা আমাদের ব্যক্তিগত রুম নয়। কেউ চলে আসবে।”
সাম্য ঝকঝকে হেসে বলল,
“ব্যক্তিগত রুমেই তো নিতে চাই।”
“আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে।”
“এই অপেক্ষার আদৌ শেষ হবে তো? চিত্রা হরিণের হৃদয়ের নাগাল পাব তো?”
চিত্রা কোনো কথা বলল না। সাম্য আরেকটু নিবিড় হয়ে ওকে মিশিয়ে নেয় নিজের সঙ্গে। ফিসফিস করে বলে,
“আমি যে খুব বেশি অধৈর্যবান মানুষ। ভুলগুলো একটু সামলে নিয়ো।”
চিত্রা চুপ রইলো। অনেকটা সময় নিয়ে একে অপরের নিঃশ্বাস গোনা হলো। সাম্য আরও কিছুটা অবাদ্ধ হতে চাইলে চিত্রা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। তা দেখে সাম্য বলে উঠল,
“হুম, স্বভাবে বউ বউ গন্ধ পাচ্ছি এবার।”
“আপনি কী কখনো একটু লজ্জা পান না?”
“না, তবে দিতে পারি। যেমন ধরো…”
কথা শেষ হওয়ার আগেই চিত্রা দুহাতে জোর করে ঠেলে ওকে ঘর থেকে বের করে দরজা আটকে দিলো। দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে শুনতে পেল সাম্য ঝরঝরে গলায় হাসছে।
দুপুরে খেতে বসে সকলে জানতে পারল রবিন বাড়ি ফিরেছে। তবে সে সেই যে সকালে ঘুমিয়েছে এখনও ওঠেনি। কথাটা শুনে সকলের মাঝে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া ভেসে উঠল। আঁড়চোখে হেনাকে দেখতেও ভুলল না কেউ কেউ। হেনা আজ বেশ সেজেগুজেই রয়েছে। তবে সাম্য খুশি হলো। সে খাওয়া শেষে গেল ভাইয়ার সঙ্গে দেখা করতে। রবিন তখন ঘুমে অচেতন। সাম্যের ডাকাডাকিতে কপাল কুচকে বলল,
“বিয়া করছোস, বউয়ের আঁচলের তলায় থাকবি এক বছর। তা না কইরা আমার ঘুম ক্যান হারাম করোছ?”
সে আবারও ঘুমে তলিয়ে গেল। সাম্য হতাশ হয়ে ফিরে এলো। রবিনের ঘুম ভাঙল সন্ধ্যার আগে। বাইরে তখন রঙ মিলান্তি গোধূলি। রবিনের অবসর বেশিক্ষণ টিকলো না। বড়ো চাচা তাকে খামারে ডেকে পাঠালেন। মোক্তারদের গরুর ব্যবসা। নাজমুল মোক্তার তাকে বললেন গরুর একটা বড়ো চালান নিয়ে তাকে রাতের মধ্যে ট্রলারে চেপে বের হতে হবে। রবিন বাড়ি ফিরে শান্ত কণ্ঠে মাকে জিজ্ঞেস করল,
“হেনা এহনো আছে?”
“আছে।”
“ওর জামাই?”
“সেও আছে।”
রবিন লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই দায়িত্ব অন্য কাউকে দেওয়া যেত। কিন্তু বড়ো চাচা তাকে ইচ্ছে করে পাঠাচ্ছে। এমনিতেও রবিন ও বাড়িতে ঢুকত না। গরু ট্রলারে তুলে সব গুছিয়ে নিতে নিতে রাত দশটা গড়ালো। ট্রলারে ওঠার ঠিক আগ মুহূর্তে কী ভেবে সে কাউকে না জানিয়েই বাড়ি ফিরে এলো। সকলে এখন নতুন ভবনে। রবিন ভাবল সাম্যের সঙ্গে কথা বলে যাবে। ছেলেটাকে এখনও শুভেচ্ছা জানানো হয়নি। সাম্যের বউয়ের জন্য উপহারও এনেছে। দেখা করে উপহারটা দিয়েই যাবে ভাবল। রবিন ব্যস্ত পায়ে ছুটে গেল নতুন ভবনে।
চিত্রাকে সাজানো হয়েছে লাল বেনারসিতে। গা থেকে ছড়াচ্ছে কাঁচা ফুলের সুমিষ্ট ঘ্রাণ। অপরূপ মুখশ্রীতে প্রসাধনী যোগ করেছে নজরকাড়া সৌন্দর্য। খানিক বাদেই তাকে সাম্যের ঘরে নিয়ে যেতে এলো হাসনা। চিত্রা এক পা এক পা করে যত সামনে এগোচ্ছে, ভেতরে এক ধরনের উৎকন্ঠা জেগে উঠছে। ঘর থেকে বেরিয়ে কয়েক কদম এগোতেই পেছন থেকে একটা কন্ঠ ভেসে এলো। চিত্রা চকিতে পেছনে ফিরে তাকায়। ক্ষণেই তার হাত-পা জমে গেল। নড়াচড়ার শক্তি যেন একেবারে উবে গেছে। হাসনা খুশি হয়ে ডাকল,
“ভাইজান, এইদিকে আসো।”
এরপর চিত্রাকে আস্তে করে বলল,
“রবিন ভাইজান আইতাছে। তোমার ভাসুর হয়।সালাম করবা।”
চিত্রা থরথর করে কেঁপে ওঠে। দেহের ভারসাম্য রাখতে ব্যর্থ হয়। চারিদিকে হুট করেই অন্ধকারে ছেয়ে গেল। চোখ বোজার আগে টের পেল একজোড়া হাত ওকে আগলে নিয়েছে।
চলবে…
বিষাদনীড়ে মায়াতরী [৩০]
প্রভা আফরিন
_
চিত্রার ঘুম ভাঙল মাঝরাতে। ঘামে শরীর ভিজে গেছে। বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করছে। পিটপিট করে তাকাতেই দেখল আলো-আঁধারের অমসৃণ ছায়ার ভেতর শুয়ে আছে সে। দুর্বল চোখজোড়া যেদিকেই দৃষ্টিপাত করে গোলাপ ও রজনীগন্ধার লাল-সাদা তরঙ্গ ভেসে ওঠে। হাত নাড়াতে গিয়ে খেয়াল হলো তা অন্য কারো হাতে বন্দি। চিত্রা চকিতে ঘাড় ঘোরায়। ওর পাশেই সাম্য বেহুশ হয়ে ঘুমাচ্ছে। হৃৎস্পন্দন স্বাভাবিক হওয়ার বদলে আরো বেড়ে গেল। আজ তাদের বাসর রাত! সে বাসর ঘরে! চিত্রার ধাতস্থ হতে সময় লাগে। এলোমেলো ভাবনা নিয়ে সে বিছানা ত্যাগ করে। দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়ে মেঝেতে। স্বামী, সংসার, বাসর সব ছাড়িয়ে তার চিন্তায় আধিপত্য ছড়ায় একটি চিরচেনা মুখশ্রী। স্মৃতির পাতা হাতড়ে বেড়ায় কিছু লুকায়িত বাসনা, না পাওয়া, আক্ষেপ। মনের ভেতর হানা দেয় বিষাদস্মৃতি। যার শুরুটা সেই চৈতি দুপুরে…
জলের তেষ্টায় হাসফাস করতে থাকা কিশোরীর জীবনে প্রেমের বৃষ্টি নিয়ে আগমন ঘটেছিল ছিপছিপে দেহের এক পুরুষের। গঠন দেখে অনুমান করার উপায় ছিল না সে কিশোর নাকি যুবক। কিশোরীর সাথে প্রথম সাক্ষাতেই তার বিনয় প্রকাশ পেল। মুখ দেখে অবস্থা বুঝে নেওয়ার ক্ষমতা যে তার আছে তা নিশ্চিত হতে সময় লাগল না। এরপরই কিশোরীকে লণ্ডভণ্ড করে দিলো তার একটি সম্বোধন, ‘চৈতালির চিত্রাফুল।’
ছোট্টো একটি সম্বোধন, অথচ কিশোরীর প্রথম যৌবনের ওপর এর আধিপত্য বিস্তার করল মহামারির মতো। কিশোরীর মনে হলো তার নামের মতো সুখশব্দ পৃথিবীতে দুটি নেই। কয়েকদিন পরই জানতে পারল সেই লোকটি তার আব্বার কর্মচারী। কাজের সূত্রে তাদের বাড়িতে আসা-যাওয়াও করে টুকটাক। অথচ অপার সৌন্দর্যের অধিকারী মেয়েটির দিকে তাকায়ই না। কিশোরীর অভিমান হয়। এই যে সে সেজেগুজে আশেপাশে ঘুরঘুর করে, শরবতের জায়গায় নোনা পানি খেতে দেয়, বৈদ্যুতিক তার কে’টে বাড়িতে ডেকে আনার মতো নানান হঠকারী কাজের মাধ্যমে তাকে নাস্তানাবুদ করার চেষ্টা করে, তবুও লোকটার সামান্যতম হেলদোল নেই! লোকটার নির্লিপ্ততা কিশোরীকে আরও দুঃসাহস দেখাতে প্রশ্রয় দেয়। সমাজ-সংসারের সীমাবদ্ধতা ভুলে, হৃদয়ের আকুলতাকে প্রশ্রয় দিয়ে সে বারবার ছুটে যায় লোকটার কাছে। কিন্তু পাষাণ মানুষটা তাকে ভীষণ ভয় পায়। ভয় পায় সমাজকে, অসম ভালোবাসাকে। কিশোরীর মন অতো জটিল ভাবনায় উদ্বিগ্ন হতে চায় না। সে লোকটার প্রণয়ে নিমগ্ন হতে চায়। আরো বেপরোয়া হতে চায়। তাকে নিয়ে ভেসে বেড়ায় নদীর বুকে, প্রণয় মেশায় স্রোতের জলে, আকুলতা ভেসে বেড়ায় বাতাসের সঙ্গে। কিন্তু বিপরীতের লোকটা সংকোচ কাটাতে পারে না। কিশোরীকে আপন করে নেয় না। কিশোরী অধৈর্য হয়৷ রাগে, দুঃখে কেঁদে ফেলে৷ লোকটার গায়ের শার্ট কা’মড়ে, খা’মচে, জোরপূর্বক ছিড়ে ফেলে। লোকটা বাধা দেয় না, আপনও করে না।
পরিবার সব জেনে গেলে লোকটার প্রাণের মায়ায় কিশোরী তার আরাম-আয়েশের জীবন ছেড়ে এক লহমায় অনিশ্চিত জীবন গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হলো। নিশীথের আলোকশূন্য পথে নিজের নতুন ঠিকানা গড়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে সে বেরিয়ে এলো চিরচেনা গন্ডি ছেড়ে। কিন্তু হায়! কিশোরীর সকল প্রচেষ্টাকে পর্যদুস্ত করে লোকটি সেই নিরালোকে হারিয়ে গেল।
এরপরের দিনগুলো ছিল অমাবস্যার চেয়েও ঘুটঘুটে। কিশোরীর দিবস কাটে না, রাত্রি ফুরায় না। বুকের ভেতর অপেক্ষা পুষে সে নিরবে অশ্রুস্নান করে। আশায় বুক বাধে, সে হয়তো ভয়ে পালিয়েছে! ভীতু কিনা! একদিন ঠিক আসবে। শীত যায়, বসন্ত যায়, গ্রীষ্মের দাবদাহের পর বর্ষার পদধ্বনিতে মুখরিত হয় প্রকৃতি। কিশোরীর হৃদয় জলশূন্যতায় চাতক পাখির মতো পথ চেয়ে থাকে। এই বুঝি সে আসবে, প্রণয়ের জল আবারো তাকে সিক্ত করবে। কিশোরীর প্রথম প্রেম, অপেক্ষা, আকাঙ্ক্ষা ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে চিরতরে হেরে গেল যেদিন সে কবুল শব্দটি তিনবার জিভ দিয়ে উচ্চারণ করল।
আজ এতদিন পর সেই মুখটা কেন এলো তার সামনে? কেন তাকে আবার এলোমেলো করে দিলো? চোখ বোজার আগে যে মুখটা সে দেখেছিল তা কী ভ্রম ছিল? হলেই বোধহয় ভালো হতো। অন্তত এভাবে প্র’তারিত হয়ে চিত্রা পুনরায় ভেঙে পড়ত না। কিন্তু আফসোস! ওই নিষ্ঠুর মানুষটাকে চিনতে যে তার সামান্যতম ভুল হয়নি। এক জীবনের শত আক্ষেপ যার নামে বিসর্জন গেছে সেই কিনা তার স্বামীর বড়ো ভাই! সম্পর্কে তার ভাসুর! এরচেয়ে জ’ঘন্য শব্দ বোধহয় সে আগে শোনেনি। চিত্রা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। দু-হাতে চুল খা’মচে ধরে। যাকে একটু দেখার জন্য, যার কণ্ঠসুধা পানের জন্য সে একবুক ভালোবাসা নিয়ে প্রতিক্ষায় ছিল, সেই কিনা তার মানসিক অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ালো! অনেকটা সময় মুখ চেপে কেঁদে চিত্রা চোখ তুলে তাকায় খাটের দিকে। হারিকেনের টিমটিমে আলোয় সাম্যের ঘুমন্ত মুখখানা নিষ্পাপ দেখাচ্ছে। এই লোকটার সঙ্গে সে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ। তার সকল চাওয়া-পাওয়া এই মানুষটাকে ঘিরেই আবর্তিত হওয়ার কথা। তাকে মন থেকে গ্রহণ করার সময়ই রনি এসে সব এলোমেলো করে দিলো। চিত্রার ইচ্ছে হয় সব ভুলে যেতে। রাতের আঁধারে রনির হাত ধরে পালিয়ে যেতে। সব সংশয় কাটিয়ে মনের মতো সংসার সাজাতে সাধ জাগে। পরক্ষণেই ই মনে পড়ে সে যে রনি নয়, রবিন। যাকে চিত্রা চেনে না, যার সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। ভাগ্য এ কেমন নরক য’ন্ত্রণায় ফেলল তাকে?
রাত্রি তখন শেষ ভাগে। হারিকেনের আলোটা মৃ’তপ্রায়। বদ্ধ ঘর ও নেতানো ফুলের সংমিশ্রণে ঝাঝালো গন্ধ ছড়িয়েছে চারিদিকে। নিস্তব্ধতা ভেঙে এক করুণ আ’র্তনাদ দেয়ালে বারি খায়। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ছুটে যায় সাম্যের। চিত্রাকে এলোমেলো অবস্থায় মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে চমকে ওঠে সে। তড়িঘড়ি করে নেমে তাকে দুহাতে আকড়ে ধরে।
“চিত্রা, কী হলো তোমার? এখানে কী করে এলে?”
চিত্রা কাঁদছে। গলা ছেড়ে হাউমাউ করে কাঁদছে। সাম্য কিছু বুঝতে না পেরে আবার জিজ্ঞেস করল,
“অসুস্থ লাগছে? নাকি দুঃস্বপ্ন দেখেছো? এই মেয়ে, কিছু তো বলো।”
চিত্রা ভাঙা গলায় অস্পষ্ট স্বরে বলল,
“আমার সমস্ত জীবনটাই যে দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কেন হলো এমনটা?”
চিত্রা নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে সাম্যের বুকে ঢলে পড়ে। সাম্য দুহাতে আগলে নেয়। পিঠে হাত বুলিয়ে নরম গলায় বলে,
“কী বলছো এসব? কান্না থামাও, তাকাও আমার দিকে।”
চিত্রার শরীর আবারো ছেড়ে দিচ্ছে। সে বিড়বিড় করে বলতে থাকে,
“ঠকিয়েছে, সবাই ঠকিয়েছে আমায়। আমার বিশ্বাস নিয়ে ছেলেখেলা করেছেন আপনারা।”
সাম্য ঘাবড়ে গেল। চিত্রাকে অপ্রকৃতস্থের মতো করতে দেখে সে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। এর আগে কারো অসুস্থতা সামলানোর অভিজ্ঞতা নেই তার। বিদ্যুৎ নেই অনেকক্ষণ। অতি ক্ষীণ শিখায় হারিকেন জ্বলছে খাটের পাশে। সেই ম্লান আলোয় চিত্রার শুকনো মুখ, ভেজা কার্ণিশ ও এলোমেলো অবস্থা দেখে সাম্যের বুকটা কেঁপে ওঠে। ঠিক করে কাল সকাল হতেই ডাক্তার ডাকবে। সে চিত্রাকে কোলে নিয়ে খাটে ওঠে। বুকে নিয়ে শুয়ে তার কান্না থামানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে। একসময় চিত্রার কাঁপুনি কমে। কান্না থেমে ফোঁপানোতে রূপ নেয়। স্থির দেহের সমস্ত ভার স্বামীর ওপর ছেড়ে দিয়েছে। হারিকেনের আলো তখন একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেছে। আধারের মাঝে চোখ মেলে সাম্য হঠাৎ বলে উঠল,
“চিত্রা, এই বিয়েতে কী তুমি অসুখী?”
চিত্রা সাম্যের ওপর থেকে সরে পাশের বালিসে মাথা রাখে। নিঃশব্দে যতটা সময় গড়াতে থাকে সাম্যের উৎকন্ঠা বাড়তে থাকে। এক সময় চিত্রা মৃদু স্বরে বলল,
“আমাদের বোধহয় আরো কিছুটা সময় দরকার।”
এরপর তাদের মাঝে আর কোনো কথা হলো না। শুধু ভারী শব্দে একটি দীর্ঘশ্বাস নির্গত হলো সাম্যের বুকের ভেতর হতে। চিত্রা সেই দীর্ঘশ্বাসের গভীরতা পরিমাপ করল না। সারারাত আর ঘুমালোও না। বাসর ঘরের ফুলগুলো তার সঙ্গেই নেতিয়ে বাসি হলো।
_________
ভোরের আলো ফুটতেই চিত্রা ঘর থেকে বের হলো। সাম্য তখন ঘুমে বিভোর। বাড়ির কেউই তেমন ওঠেনি। চিত্রা দোতলার সিড়ির কাছে দাঁড়িয়ে হঠাৎ চমকে উঠল। নিচতলার দহলিজ ঘরে রবিন দাঁড়িয়ে আছে। চিত্রা আবারো এলোমেলো হতে শুরু করে। দৌড়ে ছুটে যেতে নিয়েও থেমে গেল। রবিনের সামনে মোক্তাররা তিন ভাইও উপস্থিত আছে। নাজমুল ও নুরুল মোক্তারের মাথায় টুপি। বোধহয় মসজিদ থেকে ফিরেছে সবে। বিপুল ঘুম থেকে উঠে এসে বেজায় বিরক্ত। নাজমুল মোক্তারের ভাব-ভঙ্গি বেশ উত্তেজিত। কিছু একটা নিয়ে রবিনকে ব’কছে। রবিন চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। কোনো হেলদোল দেখা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর সে বেরিয়ে গেল দহলিজ ঘর থেকে। একবারও আশেপাশে তাকালো না। চিত্রা ভাবল, এই সুযোগ কথা বলার। এখনো সকলে ঘুম থেকে ওঠেনি। সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে কারো চোখে পড়ার আশঙ্কা কম। তাকে সাতসকালে কেউ খুঁজবেও না। কিন্তু ভাগ্য সহায় হলো না। সিড়ি দিয়ে নামতেই রাজিয়ার সামনে পড়ল সে। তিনি ভ্রু কুচকে বললেন,
“এমনে হুড়াহুড়ি কইরা কই যাও?”
চিত্রা থতমত খেয়ে গেল। বলল,
“কোথাও না। এখানেই হাটছিলাম, আম্মা।”
“কাইল যা ডর-ই না দেহাইলা! সাম্য যদি ঠিক সময় আইয়া না ধরত মাথাডা ফাটতো। শইল এহন কেমন?”
“ভালো। আমি একটু উঠানে হাটাহাটি করি?”
“হাটাহাটির দরকার নাই। কহন আবার মাথা ঘুইরা পড়বা। তহন তোমার বাপের বাড়ির মানুষ কইবো মাইয়ারে কাম করাইয়া রোগী বানাইছি। ঘরে যাও।”
চিত্রা বাধ্য হয়ে ওপরে উঠল। কিন্তু শান্ত হতে পারছে না। তার মাথায় হাজারো প্রশ্নেরা উঁকি দিতে শুরু করেছে। লোকটার আসল পরিচয় যে রবিন এবং সে এ গোষ্ঠির বড়ো ছেলে তা নিয়ে চিত্রার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তাহলে কেন সে রনি নামের ছদ্ম পরিচয় গ্রহণ করল? কেন নিজেকে এতিম দাবি করে শালুগঞ্জে কাজ নিল? কী স্বার্থ তার? চিত্রাকে যে তা জানতেই হবে। রবিন নামের প্র’তারকের কাছ থেকে এর উত্তর আদায় করতেই হবে। কেন তার আবেগ নিয়ে এভাবে ছেলেখেলা করল? মুহূর্তেই চিত্রার মনে পড়ে ফজিলার বলা কথাটা। তাহলে কী হেনা আপার সঙ্গে সম্পর্ক আছে বলেই চিত্রাকে পায়ে ঠেলেছিল সে? আশকারাই বা কেন দিয়েছিল? চিত্রা কি তবে ভুল মানুষকে প্রেম নিবেদন করেছিল? রবিন চিত্রার পাগলামিকে উপভোগ করেছিল হয়তো। প্র’তারকের সামনে নিজেকে এতটা সস্তা করে তুলে ধরায় চিত্রার নিজের ওপর ঘৃণা চলে এলো।
তারচেয়েও বড়ো কথা রবিন যে ছদ্ম পরিচয়ে শালুগঞ্জে ছিল তা এ বাড়ির কেউ জানে বলে তো মনে হচ্ছে না। কারো আচরণেই তা বিন্দুমাত্র প্রকাশ পায়নি। চিত্রা মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করে। যে করেই হোক রবিনের মুখোমুখি তাকে হতেই হবে। এমন সময় সাম্য এসে ওর হাত ধরে টেনে ঘরে নিয়ে গেল।
চলবে…