বিষাদনীড়ে মায়াতরী পর্ব-৪২+৪৩+৪৪

0
214

বিষাদনীড়ে মায়াতরী [৪২]
প্রভা আফরিন
_

বৃষ্টি শেষে প্রকৃতি আবারও শান্ত। ঝকঝকে আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘেদের দল উজ্জ্বলতা হারাচ্ছে।। সন্ধ্যার ম্লানতায় মেহেরুন বানু মন্থরগতিতে ছেলের ঘরে ঢুকলেন। বাতি জ্বা’লিয়ে জানালার কপাট বন্ধ করে দিলেন। ইদানীং খুব মশা হয়েছে। আজকের বৃষ্টিটা তার প্রাদুর্ভাব কিছুটা কমিয়েছে। তবুও তিনি কয়েল ধরালেন। রাখলেন দরজার কোণায়। রবিউল খন্দকার লম্বা হয়ে শুয়ে আছেন বিছানায়। চোখ মেলে দেখছেন আম্মা কি কি করছে। মেহেরুন বানু ছেলের পাশে এসে বসলেন। এই ক্রমশ বার্ধক্যের দিকে ধাবিত ছেলেটি উনার প্রথম সন্তান। যখন তিনি সংসারের গুরুত্বই বুঝতে শেখেননি বিয়েটা হয়ে গেল। পুতুলের সংসার রেখে নিজের সংসারে এলেন। স্বামী সদা গম্ভীর, প্রতাপশালী এক ব্যক্তি। দরকারের বাইরে তাকে পাওয়াই যেত না। প্রেম তো দূরে থাক। এদিকে বাড়িতে শ্বাশুড়ির দাপটে মাথা তুলতেই কলিজা কেঁপে উঠত। ভালো বউ, ভালো স্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করার আগেই কোলজুড়ে ছেলেটি চলে এলো। ঠিক যেন পুতুল, জীবন্ত খেলার পুতুল। এরপর ভালো বউ, স্ত্রী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাধে চাপল ভালো মা হওয়ার দায়িত্ব। চৌদ্দ বছরের কিশোরীর সে কী ব্যস্ততা!

মেহেরুন বানু শ্বাশুড়ির কাছে ভালো বউয়ের তকমাটা কোনোকালেই পাননি। উনার জাদরেল শ্বাশুড়ি বউদের দমিয়ে রাখতেই বেশি ভালোবাসতেন। চোখে ভয়, বশ্যতা দেখতে পছন্দ করতেন। তিনিও মন যোগানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন, পেরে উঠতেন না। স্বামী তো সংসারের সাত-পাঁচে কখনোই জড়াতেন না। তবে ভালো মায়ের তকমাটা পেয়েছিলেন ছেলে যেদিন স্নেহ-মমতা বুঝতে শিখেছিল। এরপর কতগুলো বছর পেরোলো, সবদিকে ব্যর্থ মেহেরুন বানু নিজের সাফল্য এই ছেলের মাঝেই পেলেন। শেষ বয়সে এসে কোল আলো করে একটি মেয়ে জন্মালো। সকলের আদরের করবী। ফুলের মতোই নরম দেখতে, অথচ কা’টার মতো তার স্বভাব। সেই মেয়েকে তিনি বড়ো করতে পারলেন, কিন্তু বুঝেই উঠতে পারলেন না। উনার ভেতরে সমাহিত সমস্ত ঔদ্ধত্য ও বংশের তেজ নিয়ে বিকশিত হলো সে। এরপর! অকালেই ঝরে গেল। নি’ষ্ঠুর এ পরিনতির জন্য দায়ী শুধু একটি ভুল। একটু অবিশ্বাস। যা কতগুলো জীবন বদলে দিলো!
তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“নিগম আইছে গেরামে।”

রবিউল খন্দকার একপলক চোখ বুজে মাথা নাড়লেন। অর্থাৎ এ সম্পর্কে তিনি অবগত। মেহেরুন বানু আবার বললেন,
“পালি আইজ তার লগে দেখা করতে গেছিলো। লুকাইয়া।”

রবিউল খন্দকার চমকালেন। বাঁকানো ঠোঁটে, অস্পষ্ট শব্দে বললেন,
“কেমনে জানছে?”

“কারো মুহে হুনছে মনে হয়। লেখাপড়া করাই, মাইয়া তো মূ’র্খ না। সবই বোঝে।”

রবিউল খন্দকারকে চিন্তিত দেখায়। তিনি বেশ খানিকক্ষণ মৌন রইলেন। এরপর বললেন,
“পালি বড়ো হইছে। তার এইবার সব জানা দরকার।”

“একটু আগেই আমারে জিগাইতাছিল নিগমের ব্যাপারে। ধমক দিয়া থুইয়া আইছি।”

“এইডা ঠিক করেন নাই আম্মা। মাইনষের কাছে হুনলে ভুল বুঝব। তারচেয়ে আপনে ওরে বুঝাইয়া কইয়েন। মাইয়াডা তো এহন আমাগোই। আমাগোরে খারাপ ভাবুক আমি চাই না।”

মেহেরুন বানু দ্বিধায় ডুবে গেলেন। রবিউল খন্দকার বললেন,
“পালির লইগ্যা আমি একখান সিদ্ধান্ত নিছি আম্মা।”

“কী সিদ্ধান্ত?”
মেহেরুন বানুর ঢিলে চামড়ায় নিমজ্জিত অদৃশ্যপ্রায় সাদাটে ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত হয়। রবিউল খন্দকার অনেকটা আশা নিয়ে ধীরে ধীরে বললেন,
“পালিরে আমাগো হিমাদের লইগ্যা রাইখা দিলে কেমন হয় আম্মা? বাড়ির মাইয়া বাড়িতেই থাকব।”

মেহেরুন বানু যারপরনাই বিস্মিত হলেন। উত্তেজিত গলায় বললেন,
“পাগল হইছোস? জুলেখা মাইডারে দুই চোক্ষে সহ্য করতে পারে না। আমি যদি না থাকতাম এতদিনে শেষ কইরা দিতো। হের কাছে আমি সারাজীবনের লইগ্যা পালিরে দিমু? আমি চোখটা বুঝলেই হেয় মাইয়াডারে ছি’ন্ন’ভিন্ন কইরা দিবো। তোরা তো আর বাড়িত থাকবি না যে দেখবি। পালি শত অ’ত্যা’চার সইহ্য কইরাও কোনোদিন মুখ ফুইটা কইব না। পালির জীবনডা আমি নিজের হাতে ন’ষ্ট করতে চাই না। তারচেয়ে ওরে কোনো কলেজ হোস্টেলে ভর্তি করাইয়া দিতে পারলে ভালা হইত।”

“হিমাদ যদি আগলায় রাখতে পারে…”

“হিমাদ! হাহ! হেয় মা পাগল ছেড়া। মা যা বুঝাইব তাই বুঝব। বাদ দে।”

“পালির একটা ভবিষ্যত আছে না? আমার রাইসমিলডা ওর নামে লেখাপড়া কইরা দিমু ভাবতাছি।”

মেহেরুন বানু সতর্ক দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকালেন। এরপর গলা খাদে নামিয়ে বললেন,
“হেইডা দিলে দেহন যাইব। কাউরে জানাইয়া দেওন যাইব না।”

রবিউল খন্দকার এবার যারপরনাই চমকে গেলেন। দেড়মাসে বাড়িতে কি অভাবনীয় পরিবর্তন! যেই জুলেখার কোনো কথাকে পাত্তাই দেওয়া হতো না, তারই জন্য তটস্থ থাকতে হচ্ছে! এতটাই আধিপত্য ছড়িয়েছে জুলেখা! রবিউল খন্দকারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ধিকি ধিকি ক্রো’ধ জ্বলে ওঠে।
“আমার লইগ্যা দোয়া করেন আম্মা। আল্লাহ জানি আমারে আরেকটু সোজা হওনের শক্তি দেয়। ওই দুশ্চ’রিত্রা মহিলারে শিক্ষা না দিয়া আমি ম’রতে চাই না।”

“আল্লাহর কাছে দিন-রাইত কান্দি। তুই সুস্থ হবি, আবার নিজের পায়ে খাড়াবি। ম’রনের আগে জানি তা দেইক্ষা যাওনের তৌফিক দেন আমারে।”

ঘরে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এলো। রবিউল খন্দকার অনেকক্ষণ পর বললেন,
“জুলেখার একমাত্র দুর্বলতা হইলো হিমাদ। হিমাদও মা পাগল। আমি জানি জুলেখা হিমাদরে উল্টাপাল্টা বুঝায়, তার দুঃখের লইগ্যা আমাগোরে দোষী বানায় দেইখ্যাই ছেড়াডা আমার থাইকা দূরে থাকে। কোনোদিন মন খুইল্যা কথা পর্যন্ত কয় না। হেদিন শখ কইরা মোটর সাইকেল চাইলো, তাও দিলাম না। আমার অসুখের লইগ্যা ওর পড়ালেখাও থাইমা গেল। হয়তো আমারেই দো’ষী ভাবতাছে। হিমাদের লগে কথা কওন দরকার আম্মা। এই ভুল বোঝাবুঝি না মিটলে জুলেখা আরো পাইয়া বইব। ওরে দমানের একমাত্র পথ হিমাদ।”

“যা ভালা বুঝোস কর।”
___________

চন্দ্র তারকাখচিত, ঝকঝকে আকাশের দিকে তাকালে মনেই হচ্ছে না আজ বৃষ্টি হয়েছে। প্রকৃতি দ্রুতই নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে। মনে হচ্ছে একটি নিরুত্তাপ দিনের শেষে নিস্তেজ প্রকৃতির গা বেয়ে আঁধার নেমেছে। পালি হারিকেনের চিমনি পরিষ্কার করে কেরোসিন ভরলো। তারপর আগুন ধরিয়ে আঁচ বাড়িয়ে দিলো। ইলেক্ট্রিসিটি নেই দুপুর থেকে। সে হারিকেন নিয়ে দাওয়ায় বের হতেই চোখ পড়ল একটি ব্যাঙের ওপর। লাফিয়ে উঠান পেরোচ্ছে। পালি মনোযোগ দিয়ে তার উঠান পেরোনো দেখল। হারিকেন বাড়িয়ে ধরল যেন আঁধারে ব্যাঙের পথচলায় কোনো অসুবিধা না হয়৷ সেটা দৃষ্টিসীমা অতিক্রম করতেই পালি ব্যাঙের মতো দুটো লাফ দিয়ে থেমে গেল। হিমাদের নিস্তব্ধ দৃষ্টি তারই কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করছে। পালি নিজেকে সামলে নিল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হিমাদ কিছু বলার আগেই বলে উঠল,
“একদম ব্যাঙের ছাও বলবে না।”
“ঘটা করে বলার কী আছে? তুই তো ব্যাঙের ছাও-ই।”
পালি মুখ কালো করে বলল,
“আমি তোমার ফুপির ছাও।”
“সেটা জন্মসূত্রে। স্বভাবসূত্রে কার কার ছাও বলতে গেলে বই হয়ে যাবে।”
রাগে-দুঃখে পালির নাকের পাটা সংকুচিত, প্রসারিত হচ্ছে। হিমাদ তা পাত্তা না দিয়ে বলল,
“আমার ঘরে হারিকেন দিয়ে যা।”

পালি শুনতেই পায়নি এমন ভঙ্গিতে তরতর করে চলে গেল চিত্রার ঘরে। হিমাদ ভাইয়ের ওপর তার ভীষণ রাগ জন্মেছে। দুপুরে ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলায় সে টাল সামলাতে না পেরে দুই ঢোক পানি খেয়ে ফেলেছে। ছি! ভাবতেই গা গুলিয়ে উঠছে। আবার এখন ব্যঙ্গ করল! দেবে না সে হারিকেন। নিশ্চয়ই পরেরবার সামনে পড়লেই হিমাদ ভাই বলবে,
“বে’য়া’দব, চরম বে’য়া’দব হয়েছিস।”
হিমাদ ভাইয়ের মুখ থেকে শব্দটা শুনলে পালিরও পালটা বলতে ইচ্ছে করে,
“তুমি মহামান্য সিনিয়র বে’য়া’দব।”
বড়োদের সম্মান দিতে হয় বলেই মহামান্য শব্দটি যোগ করা। সম্মানে অসম্মানে কা’ট্টি হয়ে যাবে। সে নিষ্পাপ থাকবে।

পালি মনের কথাগুলো চিত্রাকে বলতেই সে হেসে গড়িয়ে পড়ল বিছানায়। পালি চোখ ছোটো করে বলল,
“তুমি হাসছো বুবু? হিমাদ ভাই আমাকে বারবার পশু-প্রাণীর ছাও বানিয়ে দিচ্ছে। মা শুনলে কত কষ্ট পেত বুঝতে পারছো?”
“পারছি না।”
বলে চিত্রা আবারো হেসে ফেলল। পালি বুঝল বুবুর মন ভালো হয়েছে। সে গা ঘেঁষে বসল। বুবুর হাত ধরে অনুনয় করে বলল,
“ও বুবু, আমাকে মায়ের গল্প বলো না। আমি মায়ের বাপের বাড়ি থাকার গল্প কিছুই জানি না। বাবার সাথে মায়ের কীভাবে আলাপ হলো? বিয়েটা কীভাবে হলো? আমাকে বলো না!”
চিত্রার নির্ভার হাসি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। উদিত হলো তাচ্ছিল্যের অবাঞ্ছিত হাসি। সে পালির মুখে হাত বুলিয়ে বলল,
“আমি বলতে পারব না সোনা। তুই চামেলি খালার কাছে যা। তিনি তোর মায়ের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ছিল।”

পালি তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ায়। বুকের ভেতর তীব্র উত্তেজনা দামামা বাজায়। অজানা কিছু জানার আগ্রহ তাকে সম্মোহনীর মতো টানছে। চোখের তারায় এক পলকের জন্য নিগম সেনের মুখশ্রী ভেসে ওঠে।

চলবে…

বিষাদনীড়ে মায়াতরী [৪৩]
প্রভা আফরিন
_

রেজাউল খন্দকার ও মেহেরুন বানুর সুদীর্ঘ দাম্পত্যের জীবনে শেষ বয়সের এসে অপ্রত্যাশিত ভুলের থেকে একটি নয়নাভিরাম ফুল ফুটলো। নাম তার করবী। বিধাতা যেন সযত্নে লালিত বাগানের সমস্ত ফুলের সম্মিলিত সৌন্দর্য ও সুবাস ঢেলে দিয়েছে তার মধ্যে। করবীর উপস্থিতি যেন সুবাসের ন্যায় প্রকৃতিতে ভেসে বেড়ায়। চক্ষুদ্বয় মুগ্ধতায় বিবশ হয়। সেই সুবাসে মাতাল হলো গ্রামে বেড়াতে আসা চনমনে যুবক নিগম সেন। সদ্য ডাক্তারি পাশ করে উচ্চতর ডিগ্রি লাভের জন্য বিলেত যাওয়ার জন্য মনস্থির করেছিল সে। মাঝে কিছুদিন মায়ের সঙ্গে থাকা। সুমিত্রা দেবী ছেলের বিদেশ গমন নিয়ে অতিশয় সংশয়ে ছিলেন। ভীনদেশের চাকচিক্য, সম্ভাবনাময় ও বিলাসবহুল জীবন পেয়ে অনেকেই আর ফিরতে চায় না। তাই তাকে বিবাহ করিয়ে দেশে শিকড় গেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে ছিলেন তিনি। সেই শিকড়ের মূল হিসেবে ঠিক করেছিলেন আরেক মেডিকেল পড়ুয়া প্রতিবেশী কন্যা সৌদামিনীকে। অন্যদিকে নিগম পরিনতি জেনেও অপ্রতিরোধ্য অনুভূতির কবলে একেবারে বি’প’র্যস্ত হয়ে গেল। করবী, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এই ষোড়শীর তরে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলল। তাদের পরিচয় হয়েছিল বিদ্যালয়ের। নিগম একই বিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছে, শিক্ষকদের তার ওপর স্নেহ ছিল। নিগমকে দেখিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যতের অনুপ্রেরণা নিতে বলত। কৃতি ছাত্রদের বেলায় সমস্ত শিক্ষকই তাই করেন।

সদা কৌতুহলী করবীকে ডাক্তার, মেডিকেল শব্দগুলো আকর্ষণ করল। সে নিজে থেকেই নিগম সেনের কাছে ডাক্তারি নিয়ে জানতে চাইত। একই গ্রামের মেয়ে, তারউপর অগাধ দুর্বলতা, নিগম অতি যত্নে এক একটা শব্দ ব্যয় করত তার প্রতি। যেন শব্দের আঘা’তও তার গায়ে না লাগে। করবীর ফরসা মুখে সামান্য লাজুকতা, ক্রো’ধ বা অস্বস্তি ভর করলেই র’ক্ত জমে। সেই মুখশ্রীর উপমা হিসেবে নিগম তাকে র’ক্তকরবী বলে ডাকত। ধর্ম ও বয়সের তফাতে, তার স্নেহ নিংড়ানো ডাক সকলে অতি সাধারণ হিসেবেই গ্রহণ করেছিল। মানুষের সেবায় নিজেকে সমর্পণের এক ক্ষুদ্র আকাঙ্খার বিজ নিগম করবীর ভেতর বপন করতে সক্ষম হয়েছিল। তার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে করবীর কিশোরী মন ডাক্তারির প্রতি দুর্বার আকর্ষণ অনুভব করে। বাড়িতে সারাদিন বলে বেড়ায় সে ডাক্তার হবে, মেডিকেলে পড়বে। ডিগ্রি আনতে বিলেত যাবে।

মেহেরুন বানুর চিন্তাভাবনা নারী শিক্ষার ব্যাপারে ততটা উন্নত ছিল না। তিনি রক্ষনশীল মনোভাব পোষণ করে আসছেন। উত্তরাধিকার সূত্রে কিংবা বলা চলে সামাজিক ব্যবস্থার মাধ্যমে তা পেয়েছেন। মেয়ে যোগ্য হওয়া মাত্রই তাকে পাত্রস্থ করাই ছিল উনার একমাত্র ইচ্ছে। করবী ভীষণ একরোখা স্বভাবের হওয়ায় ভাবতেন, মেয়েকে বেশি আশকারা দিলেই হাতের বাইরে চলে যাবে। তারওপর করবীর রূপ নিয়ে ভয় তো ছিলই। মানুষের নজর থেকে বাঁচিয়ে রাখতে মেয়েকে বাড়ির বাইরে যেতে দিতেন না। আব্বা মা’রা যাওয়ার পর করবীর সকল আবদারের কেন্দ্রবিন্দু ছিল তার ভাইজান রবিউল খন্দকার। করবী যখন জানায় সে ডাক্তার হতে চায় রবিউল খন্দকার বাচ্চা ভোলানোর মতো কথাগুলো মেনে নিয়েছিলেন। করবীর ইচ্ছেতেই তাকে বিজ্ঞানের বিষয়গুলো পড়ানোর জন্য নিগমকে বিলেত যাওয়ার আগ পর্যন্ত গৃহশিক্ষক নিয়োগ দিতে চেয়েছিলেন। মেহেরুন বানু শুরুতেই সে প্রস্তাব নাকচ করলেন। মেয়েকে একলা একজন পুরুষ পড়াবে তা তিনি মানবেন না। ফলে আরো তিনজন ছেলে-মেয়ে নিয়ে নবম-দশম শ্রেণি মিলিয়ে চারজনের একটি ব্যাচ হিসেবে নিগম সেনের কাছে পড়তে শুরু করল করবী। অন্যদিকে নিগম সেন ততদিনে নিজের মধ্যে দ্ব’ন্দ্বে মেতে উঠেছে। সে বাস্তবতা ও হৃদয়ের সং’ঘা’তে না পারে করবীকে ভুলে যেতে, না পারে অনুভূতি ব্যক্ত করতে।

মেহেরুন বানু দরকারের ছাড়া করবীর বাইরে যাওয়া খুব একটা পছন্দ করতেন না। করবী প্রকাশ না করলেও মাকে কিছুটা ভয় পেত। ফলে সময় কাটাতে সে রোজ শেষ বিকেলে ছাদে পা ঝুলিয়ে বসে থাকত। সেখান থেকে বাড়ির সামনের সড়ক সম্পূর্ণ দৃষ্টিগোচর হয়। এমনই অলস বিকেলে করবী খেয়াল করল একটি ছেলেকে সে রোজ একই সময় সড়ক ধরে হেটে যেতে দেখতে পায়। দেখতে উষ্কখুষ্ক, জামাকাপড় মলিন। ছেলেটা যে গরীব, তা তার বসনেই পরিষ্কার ফুটে ওঠে। তবে নজর বিলাসী। নাহলে কি খন্দকার বাড়ির অমূল্য ফুলেই দৃষ্টি থমকায়! সে সড়ক ধরে ধুলো পায়ে হেটে যাওয়ার সময় উঁকিঝুকি, ইতিউতি করে করবীকে দেখে। ভাবখানা এমন যে, সে চু’রি করতে এসেছে। কিন্তু চু’রি না করেই পালিয়ে যাচ্ছে। করবী বুঝতে পারার পর থেকে ব্যাপারটা উপভোগ করতে শুরু করে, এবং কয়েকদিন পর হুট করেই ছাদে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। ছেলেটি এসেছে, সড়কের পাশে হাটাহাটি করেছে। করবীর দেখা না পেয়ে বিক্ষিপ্ত, নিভন্ত মুখে ফিরে গিয়েছে। দুদিন পর তাকে ভড়কে দিয়ে করবী সরাসরি তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ছেলেটি ভড়কালো, থমকালো, ক্ষণকালের জন্য বো’বা-ব’ধির হয়ে গেল। করবী গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করেছিল,
“নাম কী আপনার?”
“ম..মহসিন।”
“ও বাড়ির দিকে তাকিয়ে কী দেখেন রোজ?”
“আপনেরে।”
“দূর থেকে স্পষ্ট দেখেন না মনে হয়। সামনে থেকে দেখুন।”
মহসিন আর দাঁড়ায়নি। ঝরের গতিতে স্থান ত্যাগ করেছিল। এরপর অনেকদিন তাকে আর সে পথে দেখা যায়নি। ভয়েই আসেনি।

নিগম সেনের বিলেত যাওয়ার কাগজপত্রের কাজ চলছিলো। সময়ও এগিয়ে আসছিলো। কিন্তু আগের মতো মন থেকে তাগিদ পেত না। সব তাগিদ থমকে গিয়ে সমর্পিত হয় নবযৌবনা, স্রোতস্বিনী মেয়েটির চরণে। এক অনিশ্চিত জীবন তাকে ক্রমেই আষ্টেপৃষ্ঠে আলিঙ্গন করছিল। সৌদামিনীর উজার করা ভালোবাসাও তাকে স্পর্শ করতে পারছিল না। নিগম সেন যে করবীকে জীবনসঙ্গীনি রূপে চাইত তেমনও নয়। এমনটা ভাবার দুঃসাহসও তার হয়নি। কিন্তু মেয়েটির মায়া তাকে সর্বাঙ্গে গ্রা’স করে ফেলেছিল।

নিগম বিধবা মায়ের জন্য বাড়ি মেরামতের কাজ ধরলে করবীদের পড়ানো নিয়ে বিপ’ত্তি বাধল। করবীর ইচ্ছেয় সমাধান দিলেন রবিউল খন্দকার। একটি মাটির ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে নিগমের থাকা ও পড়ানোর ব্যবস্থা করে দেওয়া হলো। যত দিন না বাড়ির কাজ হচ্ছে নিগম সেই ঘরেই তার মাকে নিয়ে থাকতে পারবে। সুমিত্রা দেবী বাছ-বিচার করে চলা মানুষ। সবার সাথে সখ্যতা থাকলেও ছোঁয়াছুঁয়ি বিশেষ পছন্দ করেন না। তিনি রয়ে গেলেন বড়ো জায়ের বাড়ি। নিগম সেসব বাছ-বিচার এর তোয়াক্কা না করে এসে উঠল রবিউল খন্দকারের মাটির ভিটেয়। এখান থেকে করবীর সান্নিধ্য লাভ আরো সহজ হলো।

করবীর সঙ্গে জুলেখার সম্পর্কটি অনেকটা ছাড়াছাড়া। বাড়ির সকলের সঙ্গেই জুলেখার সম্পর্ক নেভানো হারিকেনের মতো গুমোট, ভাবলেশহীন।বিয়ে হয়ে আসার পর করবী তার ভাবীকে চোখে হারাতো। সময় গড়াতে টের পেয়েছে সে ভাবীর বিরক্তির কারণ। এরপর করবীও ভাব কমিয়ে দেয়। তারা একজন আরেকজনকে খুব একটা পছন্দ করে না। আবার একজন আরেক জনের ব্যাপারে নাকও গলায় না। তবে করবীকে নিয়ে স্বামীর আহ্লাদ জুলেখা ঠিক হজম করতে পারে না। তার নিজেরও দুটি সন্তান আছে। আরেকটি গর্ভে। সংসারটা তো তারই। অথচ বিবাহযোগ্য ননদ ঘাড়ের ওপর দাপিয়ে বেড়ায়! জুলেখা অবশ্য বাইরের দিক থেকে মাছের মতো শান্ত এক প্রাণী। তার অন্তরের ব’হ্নি’শিখা বাইরে থেকে বোঝা দুষ্কর।

জুলেখার সংসারের প্রতি গা ছাড়া ভাবের আরও একটি সুক্ষ্ম কারণ ছিল। করবীর পরিণত, সতর্ক দৃষ্টিতে খুব সহজেই তা ধরা পড়ে গেল। জুলেখার কারো সঙ্গে ভাব রয়েছে। আড়ালে-আবডালে, নিরালায় কারো সঙ্গে দেখা করে সে। করবী প্রথমবার দেখল নিশ্চিত হতে, দ্বিতীয়বার তাকে হাতেনাতে ধরল। তবে লোকটি পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। ভাবীর এমন অধঃপতনে ঘৃ’ণায় করবীর শরীর রি রি করে ওঠে। পরিবারের সম্মান ও সন্তানদের কথা ভেবে সে জুলেখাকে হু’মকি দেয়, শোধরাতে বলে। জুলেখা মুখ বুজে মেনে নিল, শান্ত রইল। করবী সম্পূর্ণ বিষয়টি চেপে যায় বাড়ির লোকদের থেকে। সেটাই তার কাল হলো।

নিগম সেন রবিউল খন্দকারের মাটির বাড়িতে সর্বসাকুল্যে থাকল পাঁচদিন। এরমধ্যেই সে জ্বরে আক্রান্ত হলো। জ্বরে মুখ-চোখ লাল হয়ে গেল। নিগম সে কথা মাকে জানালো না। কাউকেই জানাতে চায়নি। একা একাই মেডিসিন নিয়ে পড়ে রইল বিছানায়। তখন ঋতুতে সবে গ্রীষ্মের পদচারণা শুরু হয়েছে। ঝড়-ঝঞ্ঝার কোনো সময়কাল নেই। করবী বই-পুস্তক নিয়ে পড়ার ঘরে ঢুকতেই দেখল নিগম সেন এলোমেলো হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। জ্বরে মুখ শুকিয়ে গেছে। নিগম সেন করবীকে দেখে বলল,
“র’ক্তকরবী৷ আজ যে তোমায় চোখ জুড়িয়ে দেখা হবে না। আমি বেশিক্ষণ চাইতে পারছি না। চোখ জ্বা’লা করছে। তুমি কী আমার পাশে একটু বসবে?”

বাকি তিনজন পড়তে এলে করবী তাদের পড়াবে না বলে বাড়ি পাঠিয়ে দিলো। বালতি ভরে পানি তুলে মাথা ধুইয়ে দিলো। সন্ধ্যা নাগাদ ঝড় উঠল। করবীর মন অচেতনপ্রায় মাস্টারমশাইকে একা ফেলে যেতে সায় দিলো না। ধীরে ধীরে আধার ঘন হলো। দমকা হাওয়ার ভারে গাছ নুইয়ে মাটি স্পর্শ করে। মাটির ঘরের টিনের ছাউনিতে ডালপালা সং’ঘা’ত করে। বৃষ্টির ফোঁটা ঝরে ঝমঝম শব্দে। করবী নিকষিত আঁধারে ক্ষীণ এক টুকরো প্রদীপ আগলে বসে থাকে। বাজের শব্দে কেঁপে কেঁপে ওঠে তার দেহ। মনেপ্রাণে চায় ভাইজান আসুক, এ অবস্থা থেকে তাকে ও মাস্টারমশাইকে উদ্ধার করুক। রাত ঘন হয়, ঝড়ের তেজ বাড়ে, ভাইজান আসে না। করবী অপেক্ষা করতে করতে একসময় নিগম সেনের পাশেই খাটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

ঝড় কখন থেমেছে ওদের কারো জানা নেই। রাত কতটা হয়েছে তাও নয়। জুলেখার চিল চিৎকারে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে করবী। নিগম সেন তখনো জ্বরের মৃদু ঘোরে বিরাজমান। চেচামেচি শুনে চোখ মেলল। গ্রামের মানুষ এসে হাজির তার ঘরের দরজায়। জুলেখা ডাকাডাকি করে লোক জড়ো করে ফেলেছে। আঁধারঘরে ভিন্ন ধর্মের যুবক-যুবতী একসঙ্গে রাত্রিযাপন করছে! উপস্থিত গ্রামবাসীর অন্তরে চাপা আগুনে জুলেখা ঘি ঢালল যেন। কোথা থেকে কি হয়ে গেল বোঝার আগেই করবীকে চুলের মুঠি ধরে উঠানের কাদায় ছুড়ে ফেলা হলো। নিগম সেনকে আ’হ’ত করে বেধে ফেলা হলো কাঁঠাল গাছের সঙ্গে। ধেয়ে এলো নানান কু’রু’চিপুর্ণ মন্তব্য। কান ঝাঝরা করে দেওয়া শব্দবা’ণ। নিগম বিস্ময়ে করবীর দ’লিত মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল।

রবিউল খন্দকার বাড়িতে ছিলেন না। মেহেরুন বানুকে নিয়ে গঞ্জের হাসপাতালে গিয়েছিলেন দুপুরে। সঙ্গে এনামও গিয়েছিল। ফিরতে ফিরতে রাত গড়িয়েছে অনেকটা। রবিউল খন্দকারকে দেখেই মানুষের হম্বিতম্বি শিথিল হলো। জুলেখা ততক্ষণে সরে পড়েছে। মাকে দেখতে পেয়ে কর্দমাক্ত করবী চিৎকার করে আশ্রয় চাইলো। তার কোলে মুখ লুকাতে চাইলো। মেহেরুন বানু তাকে আশ্রয় দিলেন না। লজ্জায়, ঘে’ন্নায়, অ’প’মানে মেয়ের গালে ক’ষিয়ে চ’ড় লাগালেন। করবীর কান্না থেমে গেল তখনই। অনুনয় করে বলল,
“আমাকে একটিবার বিশ্বাস করো মা।”
তার কথাগুলো ক’দ’র্য শব্দের মাঝে হারিয়ে গেল। মেহেরুন বানু তাকে টেনে বাড়ি নিয়ে এলেন। রবিউল খন্দকার সম্পূর্ণ ঘটনায় বাক্যহারা হয়ে রইলেন। গাছের সঙ্গে বাধা, আঘা’তে জর্জরিত, জ্বরে বি’প’র্যস্ত নিগম সেন সারা রাত ভিজল বৃষ্টির জলে, আর করবী চোখের জলে।

পরদিন ঈদগাহ মাঠে সালিশ বসল বিরাট সমারোহে। পুরো গ্রামের মানুষ উৎসুক হয়ে দেখতে এলো খন্দকার বাড়ির মেয়ের লা’ঞ্ছি’ত রূপ। করবীর সহপাঠীরা সাক্ষ্য দিলো তারা আগেই সন্দেহ করেছিল নিগম সেন করবীর প্রতি দুর্বল। গত রাতে একঘরে পাওয়াটা তো জলের মতো সব পরিষ্কার করে দেয়। ছেলে-মেয়ে জাতের নাম খুইয়েছে। নিগম সেনের গায়ে জুতা মা’রা হলো। ঘোষপাড়া থেকে তাদের একঘরে করে দেওয়া হলো। সেদিনই মাকে নিয়ে নিগম সেন গ্রাম ত্যাগ করেছিল। রবিউল খন্দকারের উপস্থিতিতে করবীকে প্র’হার করতে না পারলেও কুৎ’সি’ত রটনা ঠিকই ছড়িয়ে ছিল। সমস্ত ঘটনার ধাক্কায়, সম্মানহানি হয়ে রবিউল খন্দকার বোবা হয়ে রইলেন। করবীর থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিলেন।

বিপুল মোক্তার আগে থেকেই করবীর জন্য পাগল। বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছিল। করবী নিজেই নাকচ করেছিল। খন্দকারদের ওপর একটা চাপা রাগ ছিল মোক্তারদের। করবী ব’দ’নাম হওয়ার পর তাদের অসহায়ত্বের সুযোগে নিজেদের উদারতা প্রদর্শন করতে নাজমুল মোক্তার করবীকে মোক্তার বাড়ির বউ করার প্রস্তাব দেন। রবিউল খন্দকার মাথা হেট করে সঙ্গে সঙ্গে তা গ্রহণ করেন। এক সপ্তাহের মধ্যেই তাদের বিবাহের আয়োজন করা হয়।
করবী মহসিনের দেখা পেয়েছিল বিয়ের আগেরদিন। সরাসরি তার হাত ধরে সকলের সামনে বলেছিল বিয়ে যদি হয় তার ক’ল’ঙ্কিত জীবনের সমাধান তবে সে মহসিনকেই বিয়ে করবে। চিরতরে নির্বাসন নেবে পরিচিত মানুষগুলোর থেকে। নয়তো তার লা’শ ভাসবে নদীতে। রবিউল খন্দকারের কি যে হয়েছিল সেদিন! তিনি হুজুর ডাকিয়ে বিয়ে পড়িয়ে দিলেন। সেদিনই অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে এক কাপড়ে করবী খিলানচরে যাত্রা করে। শালুগঞ্জ থেকে তার চির নির্বাসন ঘটেছিল।

দিন কয়েক পরের কথা। মেহেরুন বানু করবীর সমস্ত কাপড় গুছাতে গিয়ে একটি কালো মলাটের মোটা ডায়েরি খুঁজে পান। রবিউল খন্দকার দেখে বুঝলেন করবীর ডায়েরি। উপরে বড়ো করে লেখা ‘করবীকথন’। যার প্রথম দিকে ছিল ছেলেমানুষী কথাবার্তা। আর শেষদিকে যা ছিল রবিউল খন্দকারের ভাবনার অতীত। করবী জুলেখার ব্যাপারে সমস্ত কথাই তাতে লিখে রেখেছিল। কেউ ডায়েরি ধরবে তা ভেবে লেখা নয়। নিজের সঙ্গে নিজের কথা। সেই কুৎসিত রাতে নির্দোষ দুজন মানুষকে সারাজীবনের ক’ল’ঙ্ক লেপন করা, মা ও ভাইজানের প্রতি তীব্র অভিমান সবই লিখেছিল। রবিউল খন্দকার জুলেখাকে ডাকলেন। প্রথমে স্বাভাবিক স্বরে জানতে চাইলেন। এরপর প্র’হা’র করলেন। জুলেখা প্র’হারের য’ন্ত্র’ণায় টিকতে না পেরে একে একে সমস্তটাই স্বীকার করে। রবিউল খন্দকার এতটাই উত্তেজিত ছিলেন যে জুলেখা পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা তা ভুলে বসেছিলেন। রাগে হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে পি’টি’য়েছিলেন তাকে। জুলেখার গর্ভপাত হলো সেদিনই। তাকে বাপের বাড়িতেও ফেলে আসা হয়েছিল। কিন্তু ছেলে-মেয়ে দুটির মুখের দিকে তাকিয়ে শেষমেষ এ সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসতে হয়েছিল।

করবীকথনের শেষ লাইনটি লেখা ছিল মেহেরুন বানুর প্রতি। করবী আজন্ম অভিমান আঁকড়ে কলমের আ’চ’রে লিখেছিল,
“অবিশ্বাসের পরিণামস্বরূপ আমি তোমায় উপহার দিলাম এক জনম আফসোস।”
মেহেরুন বানুর সেই আফসোস জনমেও ঘুচল না। হয়তো আফসোসের দ’গ্ধ’তা থেকেই পরিবর্তিত এই মেহেরুন বানুর আবির্ভাব হয়। যিনি হয়ে উঠবেন আম্রপালির অবিভাবক।
_________

পালি বুকভেজা কান্নায় ডুবে নানির সামনে বসে আছে। মেহেরুন বানু নিজেই সমস্তটা খুলে বলেছেন। তিনি কাঁপছেন। চোখ-মুখ ফ্যাকাসে। বিড়বিড় করে বললেন,
“সে আসলে নিজে নির্বাসন নেয় নাই। আমারেও নির্বাসন দিয়া গেছিল। ম’রন ছাড়া এই আফসোসের হাত থাইকা আমার মুক্তি নাই।”

পালি ছুটে বের হয়ে গেল ঘর থেকে। চিত্রার ঘরে গিয়ে তাকে সপাটে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল।
“বুবু, আমার কষ্ট হচ্ছে বুবু। আমি কেন শুনলাম এসব?”
চিত্রা পালিকে বুকে চেপে ধরে চুপ রইল। পালির কান্না থামল অনেকটা সময় পর। মুখ তুলে বলল,
“তোমার খুব কষ্ট হয়, তাই না বুবু?”
চিত্রা গড়িয়ে পড়া উষ্ণ জলের ধারাটি মুছে ফেলল। বলল,
“নাহ, আমি তো মানিয়েও নিয়েছি।”
একটু থেমে বলল,
“জন্মদাত্রী মা তো, মন থেকে ঘৃ’ণা করতে পারি না। তুই আব্বাকে ভুল বুঝিস না, দাদিকেও না। কষ্ট পেয়ে পেয়ে তারা নিঃশেষ হয়ে গেছে।”

পালি সারাটি রাত শুধু সকাল হওয়ার অপেক্ষায় রইল। নিগম সেনের সঙ্গে তার আবার দেখা হতেই হবে।

চলবে…

বিষাদনীড়ে মায়াতরী [৪৪]
প্রভা আফরিন
_

নিগম সেন আজ ঢাকা ফিরে যাচ্ছেন। সকাল সকাল খবরটা পেয়ে পালি কয়েক মুহূর্তের জন্য স্থবির হয়ে গেল। খানিক বাদেই র’ক্তকণিকায় চঞ্চলতা সৃষ্টি হলো যখন জানতে পারল নিগম সেন রওনার হওয়ার আগে তার সাথে একবার দেখা করতে সিক্ত আকুলতা প্রকাশ করেছে। সেই বার্তা নিয়ে নিলয়কে সকাল সকাল পালির খোঁজে খন্দকার বাড়িতে উপস্থিত হতে হলো। জুলেখা তাকে পালির সঙ্গে দেখা মাত্রই ভ্রু কুঞ্চিত করলেন। এরপর জোরপূর্বক ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললেন,
“ভালা আছো নিলয় আব্বা? তোমার আব্বা-আম্মা ভালা?”
“জি চাচি, ভালো আছি।”
“হঠাৎ কি মনে কইরা আইলা?” কথাটা নিজের কানেই একটু কর্কশ শোনালো। জুলেখা সঙ্গে যোগ করলেন,
“এমনে তো কুনুদিন ডাইকা-ও আনতে পারি না।”
নিলয় একবার পালির দিকে তাকালো। পালি চোখের ইশারায় বারন করতেই সে বলল,
“আসলে পরীক্ষার পরে তো আমাদের পুরোনো বইগুলো কোনো কাজে লাগছে না। তাই সেগুলো নিচু ক্লাসের ছেলে-মেয়েদের দিয়ে দেব ভাবছিলাম। সেজন্যই পালির পুরোনো বইগুলো নিতে এসেছি।”
জুলেখা সে কথা বিশ্বাস করলেন কিনা বোঝা গেল না। তিনি কণ্ঠে তুলো ছুঁইয়ে বললেন,
“বও, নাশতা কইরা যাও। চাচির বাড়ির তে খালি মুহে যাইয়ো না।”
“আজ থাক। আমি খেয়ে এসেছি। এখন আরো কয়েক যায়গায় যাব।”
“তোমার আপারে দেহি না কয়দিন ধইরা। কইয়ো আমার লগে দেহা করতে।”
“বলব।”
নিলয় পালিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তোর বইগুলো বেধে ফেল। পারলে নিজে গিয়ে একটু বাদে গিয়ে দিয়ে আসিস। আমার সময় নেই একদম।”

পালির ঠোঁটে কৃতজ্ঞতার হাসি ফুটল। ছেলেটা কিছু না জেনেও তার পরম উপকার করে গেল। নিলয় বাড়ির সীমানা পেরোতেই জুলেখা বললেন,
“চেয়ারম্যানের ছেড়ার লগে এত কিয়ের মাখামাখি? লাইন বাধাইছোস নাকি?”
পালির কান গরম হলো। বড়োদের মুখে এ ধরনের কথাবার্তা শুনলে এমনিতেই তার লজ্জা লাগে। মামির জেরার মুখে পড়ে তার মধ্যে বিরক্তি ও অস্বস্তি দুটোই একসাথে মাথাচাড়া দিলো। সে বলল,
“তেমন কিছুই নয় মামি। আপনি বেশি চিন্তা করবেন না।”
“বেশি চিন্তা না করন লাগলেই ভালা। চেয়ারম্যানরা আইজ বাদে কাইল আমাগো কুটুম হইব। আমি চাই না তোগো কারণে হেই সখ্যতা বি’গ’ড়ায় যাক। নিজের আখের গুছাইতে গিয়া আমার ছেড়ার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ধ্বং’স করিস না। কথাখানি মাথায় রাইখ্যা চলিস।”
জুলেখা চলে গেলে পালি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মানুষটার ওপর তার যতটা না ঘৃ’ণা, তার চেয়েও বেশি ক’রুণা। সংসারটি ছাড়া দ’ম্ভ করার মতো ওনার কেউ নেই, কিছুই নেই।

পালি বাড়ি থেকে বের হতে হতে বেলা হয়ে গিয়েছে। সূর্য মাথায় উঠি উঠি করে মেঘের আড়ালে লুকোচুরি খেলছে। সে বাড়ির পেছনের মেহগনি বন পেরিয়ে খালপাড়ে গেল। খালপাড় থেকে ডিঙি নৌকায় চড়ে একাই লগি বেয়ে চলে গেল ঘোষপাড়ার ঘাটে। নিগম সেন এই ঘাট থেকেই রওনা হবেন রেলস্টেশনের উদ্দেশ্যে। সুতরাং এ ঘাটেই দেখা হবার সম্ভাবনা বেশি। কিছুক্ষণ পরই তার অনুমান ঠিক হলো। নিগম সেন বড়ো নৌকায় লাগেজ তুলতে এসেই কড়া রোদে একটি ছিপছিপে মেয়েকে লগি হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেলেন। উভয়ের দৃষ্টি সমান্তরাল হতেই নিগম সেন স্নেহজড়ানো হাসি ফোটালেন ঠোঁটে। যেন তিনি এমন কিছুই দৃষ্টিগোচর করতে উদগ্রীব হয়ে ছিলেন। পালি লাফ দিয়ে ঘাটে নেমে কোমড়ে গুজে রাখা আঁচল খুলে মুখ গলা মুছতে মুছতে নিগম সেনের সামনে এসে দাঁড়ালো।
“আপনি আজই চলে যাচ্ছেন?”
“যেতে হচ্ছে।”
“ছুটি কাটানো শেষ?”
নিগম সেন সে কথার উত্তর না দিয়ে হাসলেন। পালি বলল,
“আবার কবে আসবেন?”
“নিজে থেকে আসব কিনা জানি না। তুমি ডাকলে হয়তো সাত সমুদ্র, তেরো নদী পেরিয়ে ছুটে আসব। যদি ডাকো!”
পালি হেসে ফেলল। একই সঙ্গে চোখদুটি শ্বেতাভ জলে ছলছল করে ওঠে। কণ্ঠে ছুঁয়ে যায় শ্রাবণের আর্দ্রতা। বলল,
“ক্ষমা করবেন।”
“কীসের জন্যে?”
“আমার পরিবার অতীতে যা ঘটিয়েছে, যে অ’ন্যায় আপনার সঙ্গে করেছে…”
পালির কণ্ঠ রোধ হয়ে আসে। নিগম সেনের স্নেহমাখা হাতখানি উঠে আসে তার মস্তকে।
“পাগলি মেয়ে, আমার স্মৃতিশক্তি ভীষণ দুর্বল, জানোতো। কিছুতেই দুঃখ পুষে রাখতে পারে না৷ সময়ের স্রোতে ভাসিয়ে দেয়।”
“প্রিয় মানুষের দেওয়া দুঃখ-ও?”
“আমার প্রিয় মানুষ আমায় কখনো দুঃখ দেয়নি।”

কথার মাঝেই তিনি কেমন ঘোরে ডুবে যেতে লাগলেন। পালি কিছুটা সময় চুপ রইল। ছোটো ছোটো ঢেউ এসে ধাক্কা দিচ্ছে ওর পায়ের কাছে। সূর্যরশ্মিতে বালুতীর চিকচিক করছে। পালি আড়ষ্টতা ভেঙে সাহস সঞ্চার করে বলল,
“আপনি বিয়ে করেননি কেন?”
“বিয়েটা একেক জনের কাছে একেক রকম বন্ধন।কারো কাছে হয়তো নিঃসঙ্গতা কাটানোর মাধ্যম, কারো কাছে বংশ বৃদ্ধির, আবার কারো কাছে ভালোবাসার পূর্ণতা। কেউ হয়তো পরিবারের চাপে বিবাহ নামক বন্ধন গলাধঃকরণ করে। ছন্দহীন, নিষ্প্রাণ সংসার বয়ে বেড়ায়। আবার কেউ শুধু জীবনের নিয়মেই বিয়ে করে। বাঁচতে হবে বলে বাঁচা, সংসার করা মানুষের প্রচলিত ধর্ম বলে সংসার করা। একসময় আয়ু ফুরাবে। আর টুক করে ম’রে যাবে। আমার কাছে বিয়ে আলাদা কোনো গুরুত্ব বহন করে না। আমার জন্য বেঁচে থাকতে আমিই যথেষ্ট। আর যদি বলো সুখের কথা, আমি কল্পনায় সুখী মানব। হৃদয়ে স্মৃতির আলপনা এঁকে সর্বসুখে ভেসে বেড়াই।” একটু থামলেন নিগম সেন। সঙ্গে যোগ করলেন,
“কিছু মনে কোরো না, বড়োদের মতো কথা বলছি। আমি জানি তুমি বুদ্ধিমতি।”
পালি মুগ্ধ হলো। কথাগুলো খুব পছন্দ হলো তার। দুজনের মাঝে হুট করেই স্বতঃস্ফূর্ততা এসে গিয়েছে। পালি নিঃসংকোচে জিজ্ঞেস করল,
“আমার মাকে এখনো ভালোবাসেন?”
“উহু।”
“বাসেন না?” পালি যেন খানিক ব্যথিত হলো। কিন্তু তার তো খুশি হওয়ার কথা। আব্বা ছাড়া অন্য ব্যক্তি মাকে ভালোবাসবে কেন? কিন্তু সত্যি হলো পালির মন খারাপ হয়েছে। নিগম সেন যেন এক মুহূর্তের জন্য প্রেমিক পুরুষ হয়ে উঠলেন। পূর্ণ আবেগে ডুবে ফিসফিসিয়ে বললেন,
“আমি যাকে ভালোবাসি সে কারো মা নয়, কারো স্ত্রী নয়। সে এক কিশোরী। তার পদধ্বনি উত্তাল হাওয়ার মতো ধেয়ে এসে হৃদয়ে ঝড় তোলে, কণ্ঠের শ্রুতি হৃদয়ে সুবাস ছড়ায়, তার দর্শনে চক্ষুদ্বয় বিবশ হয়। সে চির কিশোরী হয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো আমার বুকে ঘাপটি মে’রে আছে। একসময় আমার চামড়া কুঞ্চিত হবে, চুল-দাত পড়ে যাবে। তখনো সে চির অমলিন হয়ে, র’ক্তকরবীর ন্যায় রাঙা রূপে আমার চোখের সামনে ঘুরে বেড়াবে।”
পালির কান্না পাচ্ছে। ঠেলেঠুলে সুনামি বইতে চাইছে। বুজে আসা স্বরে বলল,
“আমার খুব আফসোস হচ্ছে, সেই কিশোরীর রূপ আমার স্মৃতিতে নেই।”
“তোমার কাছে মায়ের রূপ আছে। আমার কাছে তা নেই। আমাদের দুজনের কাছে সে দু’রকম সুন্দর। এই যাহ! কাঁদছো যে? আমি কি তোমায় দুঃখ দিয়ে ফেললাম?”
পালি নাক টেনে বলল,
“আমি কিন্তু আপনাকে পছন্দ করে ফেলেছি।”
নিগম সেন ছলছল চোখে চেয়ে হেসে ফেললেন। মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করার ভঙ্গিতে বললেন,
“এ আমার সৌভাগ্য রাজকন্যা। তুমি যে আমার অদেখা র’ক্তকরবীর অংশ। তার সঙ্গে জড়িত সবই আমার কাছে বিশেষ। তুমিও। পারলে তোমায় চু’রি করে নিয়ে যেতাম।”
অনেকটা সময় নিরবে কেটে গেল। ঘাটে আসা-যাওয়া করা অনেকের নজরই তাদের ওপর পড়েছে। তারা কেউ পাত্তা দিলো বলে মনে হলো না। পালি স্বাভাবিক হয়ে বলল,
“আরেকটা প্রশ্ন আছে।”
“বলো।”
“সৌদামিনী আন্টিকে বিয়ে করলেন না কেন?”
“বিয়ে করাই যেত। মেয়েটা আমাকে ভীষণ ভালোবাসত। এখনো বাসে, আমিও বাসি। কিন্তু সব ভালোবাসায় মন দেওয়া যায় না। নিজেকে উজার করে দেওয়া যায় না। একটা হৃদয়বিহীন শরীরের সঙ্গে সংসার করার কষ্টটা আমি তাকে দিতে চাইনি। দেখা যেত দুদিন পর হাড়ি-পাতিল আছড়ে বলছে, ‘তোমাকে বিয়ে করা আমার সবচেয়ে বড়ো ভুল ছিল।’ একদম টিপিক্যাল বউদের মতো।”
পালি ও নিগম সেন একত্রে হেসে ফেলল।
“সৌভাগ্যের বিষয় হলো, সৌদামিনী দেরিতে হলেও নিজেকে গুছিয়ে নিতে পেরেছে। বিয়ে করেছে। তাতে আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হয়নি।”

পালির মুগ্ধতা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। মানুষটা কি সুন্দর কথা বলে! সে বলল,
“আমি একটা জিনিস ঠিক করেছি। আপনাকে না বললে শান্তি পাচ্ছি না।”
“কি সেটা?”
“আমি ডাক্তার হতে চাই। মায়ের অপূর্ণ ইচ্ছেটা পূরণ করতে চাই।”
“শুধু মায়ের অপূর্ণ ইচ্ছে পূরণ করতে হলেই হবে না। নিজের ইচ্ছেশক্তি থাকতে হবে। ভালোবাসতে হবে। আমি জানি তুমি পারবে। আমার টেলিফোন নাম্বারটা রাখো। ঢাকায় পড়তে গেলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। অন্য কোথাও গেলেও যেকোনো প্রয়োজনে আমাকে বলতে সংকোচ করবে না। আমি সব সময় তোমার পাশে আছি।”

বিষন্ন দুপুরে তপ্ত বালির ওপর দিয়ে এক চির অম্লান প্রেমিক বুকে এক পৃথিবী প্রেম নিয়ে চলে যাচ্ছে। পালি বিমুগ্ধ চোখে চেয়ে দেখে, শুধু র’ক্তকরবী নয়, তাকে হৃদয়ে পুষে রাখা প্রেমিক পুরুষটিরও চির তরুণ।
______________

হিমাদের সঙ্গে পালির কথাবার্তা নেই সপ্তাহখানিক ধরে। হিমাদ কথা বলছে না তাই পালিও কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। তাদের মধ্যে কথা হয়ই বা কখন! আজ প্রায় সাত বছর সে মামাবাড়িতে আছে। হিমাদ ভাইয়ের সঙ্গে তার কথা হয়েছে হাতেগোনা কয়েকবার। সেটুকুর মাঝে বেশিরভাগই পালিকে ধ’ম’কানো, কাঁদানো, কিংবা তা’চ্ছিল্য করেছে হিমাদ। কেউ বিশ্বাস করবে? ষোড়শীর বয়সের সমাপ্তিলগ্নে পালির নিজেরই তা বিশ্বাস হয় না। অবশ্য তার সম্পূর্ণ জীবনটাই যে অবিশ্বাস্য রকমের সত্য।
বিকেলে পালি পুরো ছাদ ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে পা ভাজ করে বসল। এমন সময় হিমাদের ভারী স্বর কানে এসে ধাক্কা দিলো।
“একা একা কি করিস?”
“আমি আবার দোকা পাব কই?”
“প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন?”
হিমাদের স্বরে বিরক্তির আভাস। পালি সে কথার উত্তর না দিয়ে মুচকি হেসে আবার জিজ্ঞেস করল,
“তুমি আজ জলদি চলে এলে?”
হিমাদ মাথা নেড়ে ওর পাশে বসে পড়ল। পালি সচকিত হয়। বলল,
“এখানে বসলে কেন? ছাদ গরম হয়ে আছে।”
“তুই তো বসে আছিস।”
“আমি তো রান্নাঘরের ধোঁয়াতেও বসতে পারি। তুমি পারবে না।”
“আজাইরা প্যাচাল রাখ।”
পালি অধৈর্য গলায় বলল,
“তুমি যাও এখান থেকে, নয়তো আমি উঠি।”
“আমি এখানে থাকলে কি অসুবিধা?”
“মামি আমাদের একসাথে দেখলে ব’ক’বে।”
পালির মিনমিন করে বলল কথাখানা। হিমাদ পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে পালির দিকে তাকায়। কথাটির মর্মার্থ বুঝতে তার অসুবিধা হয় না। পালি উঠে যেতে নিলে খপ করে হাত বাহু টেনে ধরে আবার বসিয়ে দিলো।
“আমি কেন তোকে অপছন্দ করি কারণটা শুনবি না?”
পালি অবাক হয়ে হিমাদের মুখপানে তাকায়। খেয়াল করে হিমাদ ভাইয়ের চোখেমুখে কেমন ক্লান্তি লেপ্টে আছে। চোখদুটি লালচে হলুদ। দাড়ি-গোঁফ কা’টে না ঠিকমতো। পালি উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করল,
“তোমার কি হয়েছে হিমাদ ভাই? এমন দেখাচ্ছে কেন? রাতে ঘুমাও না?”
“ঘুমাব। খুব ঘুম পাচ্ছে। আগে তোর এতদিনের প্রশ্নের উত্তরটা দিয়ে যাই।”

পালি চুপ রইল। অধীর হয়ে অপেক্ষায় রইল হিমাদ কখন বলা শুরু করবে। হিমাদ সময় নিল খানিক। হয়তো জড়তায়। এরপর মুখ খুলল,
“আমি আমার মাকে খুব ভালোবাসি জানিস। আব্বাকেও বাসতাম, কিন্তু ফুপি যে বছর আমাদের ফেলে চলে গেল, সে বছর থেকে আর বাসতাম না।”
“কেন?” পালি সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল।
হিমাদ ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ইশারা করে বলল,
“কথার মাঝে কথা বলবি না।”
পালি মাথা কাত করে। হিমাদ আবার বলতে শুরু করে।
“ফুপিকে আমি ভীষণ ভালোবাসতাম। আমার ছোটোবেলার খেলার সঙ্গী ছিলেন তিনি। চলে যাওয়াটা মানতেই পারিনি। কেন গিয়েছিলেন তাও বুঝতাম না। মনমরা হয়ে গিয়েছিলাম। সারাদিন ঘরে থাকতাম। তখন মায়ের সঙ্গেই বেশি থাকা হতো। মা আমাকে সবসময় একটু বেশিই ভালোবাসে। তখন মায়ের পেটে আমার আরেক ভাই বা বোন। চিত্রা আর আমি তো পিঠোপিঠি, সেভাবে কোনো বাচ্চার সান্নিধ্য পাইনি। তাই বাচ্চাটা নিয়ে খুব খুশি ছিলাম। এমন সময় দেখলাম আব্বা আমার অন্তঃসত্ত্বা মাকে মে’রে র’ক্তা’ক্ত করে দিয়েছেন। আমার চোখের সামনে মা র’ক্তে ভেসে যাচ্ছে। মাটিতে শুয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদছে। আব্বা থামছে না, কেউ এগিয়ে গিয়ে ধরছে না। এক সময় মা আমার চোখের সামনে নিস্তেজ হয়ে জ্ঞান হারায়।”

হিমাদের গলা ধরে আসে। সব যেন তার চোখের সামনে ঘটছে। সে দুহাতে মুখ ঢেকে ফেলে। পালি নরম হয়ে গেল। মায়ের র’ক্তা’ক্ত দেহ ওইটুকু বয়সের ছেলে-মেয়েদের কেমন লেগেছিল তা তার চেয়ে ভালো কে জানে? তার চোখের সামনেই তো মা একটু একটু করে… পালি ভাবতে পারে না। টুপ করে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে চোখের ধার বেয়ে। সে হিমাদের পাশ ঘেঁষে বসে। হিমাদ নড়ল না। খানিক বাদে নত মস্তকে আবার বলতে শুরু করল,
“সেই থেকে আব্বার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা শিথিল। আব্বা কাছে টানলেও আমি এগোতে পারি না। মায়ের সেই ক’রুণ রূপটা আমি ভুলতে পারি না। মায়ের দুঃখটা আমায় গ্রা’স করে নেয়। দূরত্ব বাড়ায়। চিত্রা আব্বা বলতে পাগল। আব্বাও তাকে অনেক বেশি ভালোবাসে। এ নিয়ে আমার মধ্যে আলাদা কিছু কাজ করেনি। কিন্তু তুই যখন এলি খেয়াল করলাম আব্বার আদর, ভালোবাসা তোর প্রতি উপচে পড়ছে। এটা আমার সহ্য হলো না। ছোটো থেকে যে সান্নিধ্যটুকু আমি পাইনি বা বলা চলে এড়িয়ে গিয়েছি আব্বা তার সমস্তটাই অন্য আরেকজনকে দিচ্ছে! আমার মধ্যে ধীরে ধীরে হিং’সা জেগে উঠছিল। তবুও ফুপির মেয়ে, মা হারা ভেবে চুপ ছিলাম। কিন্তু যখন আমার সি’গা’রেট খাওয়ার ব্যাপারটা জানাজানি হলো, আমি নিশ্চিত ছিলাম তুই-ই জানিয়েছিস কথাটা।”
“তোমার ভুল ধারণা। আমি কাউকে কিচ্ছু বলিনি।” পালি প্রতিবাদ করে ওঠে।
“বললাম না কথার মাঝে কথা বলবি না?”

পালি চুপসে গেল। ‘আর বলব না’ কথাটা বলতে গিয়েও সামলে নিল। নাহলে পুরোটা শোনা হবে না। হিমাদ আবার বলতে লাগল,
“তখন আমায় বাড়ি থেকে দূরে পাঠানোর রাগটাও তোর ওপর গিয়ে পড়েছিল। মায়ের কাছে শুনলাম আব্বা নাকি আমার না হওয়া ভাই-বোনের জায়গাটা তোকে দিয়েছে। ভাবছে তুই-ই সেই অনাগত সন্তান। ভাগ্যের লিখনে নতুন রূপে ফিরে এসেছিস। শুনে আমার মাঝে হিং’সাটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। সব ন’ষ্টের গোড়া তুই, তুই না এলে আমার সাথে এসব কিছুই হতো না, এমন নানান অভিযোগ পুষেছিলাম ভেতরে ভেতরে। ভাবতাম আব্বাকে আমি ভালোবাসি না। কিন্তু অবচেতনে তুই যে আব্বাকে কেড়ে নিচ্ছিস তাও সহ্য করতে পারতাম না। এমন অনেক কারণে তুই আমার অপছন্দের শীর্ষ তালিকায় নাম লিখিয়েছিস। বড়ো হতে হতে অবশ্য ভাবনায় বদল এসেছে। ছেলেমানুষী ভাবনা অনেকটাই বদলেছে। কিন্তু তোর প্রতি আমার একটা সুক্ষ্ম হিং’সা এখনো জ্ব’লে ওঠে। আব্বা যখন অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ল, সেই প্রথম বোধহয় আমি টের পেলাম আব্বাকে আমি কতটা ভালোবাসি। সদা তেজি মানুষটার ওই রূপ আমার সহ্য হচ্ছে না। এই সময়টায় খেয়াল করলাম আব্বা তোকে যেমন আগলে রেখেছে এতদিন, এখন তুইও আব্বাকে তেমনই আগলে রাখছিস। কিন্তু, কিন্তু গত কয়েকদিনে আমি এলোমেলো হয়ে গেছি। আমার ভাবনার মহল ভেঙে গুড়িয়ে গেছে। দাদি আমায় এসব কেন শোনালো? আমার বিশ্বাস করতে ক’ষ্ট হচ্ছে। এ বাড়িতে থেকেও আমি এসব কিছুই জানি না! এতটা ব’ধিরত্ব নিয়ে আছি! নাকি সবটাই মিথ্যা!”

হিমাদের কণ্ঠস্বর উত্তেজিত হয়ে ওঠে। পালি তার হাত চেপে ধরে। আরকিছু বুঝতে বাকি নেই।
“আর বোলো না। আমি বুঝতে পারছি।”
হিমাদ স্বাভাবিক হতে সময় নেয়। এরপর বলে,
“ফুপির কাছে আমরা সবাই অ’প’রাধী। কিন্তু মাফ চাওয়ার সুযোগটা নিয়তি ছিনিয়ে নিয়েছে। অনু’শো’চনায় দ’গ্ধ করতেই বোধহয়! তোর কাছেও মুখ দেখানোর উপায় নেই।”
“মায়ের সাথে হওয়া অ’ন্যায়ের হিসেব আমার সঙ্গে কেন? আমি তো সেসব পরিস্থিতি সহ্য করিনি।”
“তোর সঙ্গেও অ’ন্যায় হয়েছে। তোর কাছেও আমরা অ’প’রাধী হয়ে গেছি। ক্ষমা তো…”
“চুপ, চুপ, আর বোলো না। আমি এসব শুনতে চাই না। তোমরা আমাকে ঠাঁই দিয়েছো। পেলে-পুষে বড়ো করছো। অকৃত্রিম ভালোবাসা পেয়েছি। এই বা কম কি? আমায় এসব ভারী কথার বোঝা চাপিয়ে দিয়ো না।”

পালি হিমাদের হাতখানা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বসে রইল। হিমাদ আর কোনো কথা বলল না। হাত সরিয়েও নিল না৷ দুজনে নিরবে, নিভৃতে দেখল ক্লান্ত, শ্রান্ত, রক্তিম সূর্যটি দিনের সব রঙ, আলো, কোলাহল শুষে নিয়ে পশ্চিমে যাত্রা করছে। হয়তো তাদের ভেতরকার জড়তা, তিক্ততাটুকুও সেই সঙ্গে প্রস্থান করছে।
___________

দিন কয়েক পরের কথা। গ্রীষ্মের দাপট সবে প্রকৃতিতে জাকিয়ে বসেছে। এমনই এক নিরাক পড়া দিনে চিত্রার হাতে দুটি চিঠি এসে পৌঁছালো। একটি সাম্যের, অন্যটি রনি তথা রবিনের। চিত্রা কি ভেবে যেন রবিনের চিঠিখানাই খুলল। গুটিকয়েক শব্দ তাতে হা’হা’কার করছে।

প্রিয় চিত্রাফুল,

আমার নামের ফুলটি ঝরে যাক
অমূল্য স্মৃতি হয়ে হৃদয়ে শোভা পাক
তোমার পাতাঝরা দিনে নতুন বসন্ত আসুক
নব প্রণয়ের পরশ মেখে রঙিন ফুল ফুটুক
আমি নাহয় হলাম ধুলোমাখা ডায়েরির পাতা
যাতে ম্লান হয়েছে অনুরাগের অপূর্ণগাঁথা
তুমি তাকে বিষাদের বুকশেলফে সাজিয়ো
স্মৃতির মায়ায় একটু ছুঁয়ে দিয়ো।

ইতি,
শুধুই রনি।

চিত্রা বারবার বাক্যগুলো আওড়ায়। তার মুখটা অনুভূতিশূন্য। কিন্তু বুকের ভেতর হতে হুট করে কিছু একটা হারিয়ে গেল যেন। চিত্রা সেই হারিয়ে যাওয়া জিনিসটা আর খুঁজে পেল না। সে আর সাম্যের চিঠিখানা খুলে দেখল না। তা পড়ে রইল ড্রয়ারের অন্ধকার খোপের ভেতর।

চলবে…