বুকপকেটে তুমি পর্ব-০১

0
32

#বুকপকেটে_তুমি
#লেখায়_জান্নাতুন_নাঈম
#সূচনা_পর্ব

শরৎকাল চলছে । নদীর পাড় গুলোতে অসংখ্য কাশফুল ফুটে আছে।নীলাঞ্জনা নদীর পাড়ে বসে সেসব দৃশ্য দেখতে থাকে।
আশেপাশে অনেক মানুষ এসে নদীর পাড়ে বেড়াতে এসেছে।কেউ দোলনায় বসে আছে ,কেউ নাগরদোলায় চড়ছে, কেউ হাঁটাহাঁটি করছে কিংবা কেউ ছোট্ট টুলে বসে আছে।
নীলাঞ্জনা নওশীন কে নিয়ে দোলনায় বসে আছে। নওশীনের হাতে কটা কাশফুল রাখা। নওশীন একবার সেগুলোর দিকে তাকায় আরেকবার নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে।ধুর দুর্দান্ত থেকে নৌকা চলার দৃশ্য মুগ্ধ ভাবে তাকিয়ে দেখে। হঠাৎ কাশফুল নাড়তে নাড়তে বলল, “ওইযে দূরে ছেলেটাকে দেখছি বউ বাচ্চা নিয়ে এসেছে যে?”

নীলাঞ্জনা বলল, “যাকে তাকে দেখে ক্রাশ খাওয়ার অভ্যাস আমার নাই”

নওশীন বলল, “আমি কি সারাদিন ছেলেদের উপর ক্রাশ খাই নাকি? এইযে ছেলেটা দেখছিস এটা বৈখাশীর স্বামী ছিল যে নাসির।”

নীলাঞ্জনা ছেলেটির দিকে তাকালো।ছেলেটি তার বউ বাচ্চা নিয়ে দিব্যি নদীর পাড়ে ঘুরতে এসেছে। নীলাঞ্জনা বলল, “ফালতু পোলাপান”

নওশীন বলল, “বৈশাখীর জন্য খারাপ লাগছে”

নীলাঞ্জনা বলল, “লয়ালিটি হলো অনেক দামী জিনিস।যার তার কাছে এটা আশা করা যায় না।তা না হলে কি বৈশাখীর মতো সুন্দরী বউ রেখে অন্য মেয়ের প্রতি নজর যায়। বৈশাখীর বাড়ি গিয়েছিলাম কদিন আগে।বলল তার ছেলের সাথে তার বাবা কোনদিন দেখা করতে আসেনি। এখানে দেখ কীভাবে দ্বিতীয় সংসারের বউ মেয়ে নিয়ে ঘুরতে আসছে”

নওশীন বলল, “শুনলাম নাসির রাজনীতিতে যোগ দিয়েছে। সে সেলিম রহমানের দলে যোগ দিয়েছে। কদিন পরেই তো নির্বাচন আসছে। উপজেলা চেয়ারম্যান পদে তিনি এবার ও নির্বাচনে দাঁড়াবেন”

নীলাঞ্জনা বলল, “সেলিম দুইবার চেয়ারম্যান হয়েছে। এবারেও হয়তো জয়ী হবে। তবে শুনেছি ওর নামে অনেক অভিযোগ আছে। তবে থানায় কোন মামলা নেই। কেইবা মামলা করতে যাবে।”

নওশীন বলল, “কিছুদিন আগে সেলিমের ভাই নেশা করে গাড়ি চালাতে গিয়ে এক বৃদ্ধ লোককে মেরে ফেলেছে।কেউ ভয়ে কিছুই বলতে পারে নি”

নীলাঞ্জনা বলল, “সেলিমের গডফাদার আবার আরেকজন।তার পাওয়ারে খুব উড়াউড়ি করছে কিন্তু এই উড়াউড়ি বেশি টিকবে না”

নওশীন শেষের কথাটা ঠিকমতো শুনতে পেল না।বলল, “কি বললি”

নীলাঞ্জনা বলল, “কিছু না।তুই রাজনীতির আলাপ বাদ দে তো। আমি এখানে রাজনীতির আলাপ করতে আসি নাই”

নওশীন বলল, “জানো আমি বিশ্বাস করতাম মানুষ যাকে ভালোবাসে তার ক্ষতি করতে পারে না। বৈশাখী সবসময় ভুল ছিল।বলতো ওর স্বামী নাসির তাকে ছাড়া কারো কথা ভাবতেই পারে না। আমি নিজেও ওর কথা বিশ্বাস করতাম কারণ আমরা নিজেরাই তো দেখেছি ওরা কত সুখে সংসার করছে।অথচ আমি ভুল ছিলাম। বৈশাখী ও ভুল ছিল। শেষ পর্যন্ত নিজের স্বামী তাকে ধোঁকা দিয়ে আরেকজন কে বিয়ে করে নিল তাও আবার বৈশাখীর বেস্টফ্রেন্ড সুমিকে”

নীলাঞ্জনা বলল, “আমার মনে আছে কলেজে লেখাপড়া করার সময় বৈশাখী কলেজের ক্যান্টিনে কোন খাবার খেত না।পায়ে হেঁটে কলেজে আসতো যাতে কিছু টাকা বাঁচাতে পারে ।সেই টাকা তার স্বামীর জন্য রেখে দিত।কত কষ্ট করেছে মেয়েটা। চাকরির সব টাকা তার স্বামীকে দিয়ে দিত।মেয়েটার জন্য খারাপ লাগছে।”

নওশীন বলল, “হ্যা।ওর বাবা মা পর্যন্ত ওর খারাপ সময়ে পাশে ছিল না”

নীলাঞ্জনা বলল, “আমার আগেই সন্দেহ ছিল নাসিরের উপর। আমি তো আর তোর মতো বোকা না।এইসব বৈঈমানি আমার চোখে ধরা পড়ে যায়।ও আমাকে বিশ্বাস করতো না তাই তখন কিছু বলিনি।”

নওশীন বলল, “তোদের সাংবাদিকদের সবকিছুতেই সন্দেহ”

নীলাঞ্জনা বলল, “কারন আমরা সত্য টা বুঝি । নিজের চোখে দেখি”

সন্ধ্যায় নীলাঞ্জনা বাড়ি ফিরে গেল।বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখলো অফিসার রাশেদ শিকদার দরজার বাইরে অপেক্ষা করছে। নীলাঞ্জনা বলল, “কি খবর শিকদার সাহেব?”

অফিসার রাশেদ বলল, “খুব বড় ঝামেলা হয়েছে।আজ দুপুরের পর থেকে বিরোধী দলের নেতা আয়ান চৌধুরী কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নির্বাচনের এই সময়ে নেতার নিখোঁজ হয়ে যাওয়া মানে বুঝতে পারছ”

নীলাঞ্জনা বলল, “কোন জায়গা থেকে কিডন্যাপ হয়েছে?”

অফিসার রাশেদ বলল, “কিডন্যাপ বলছো কেন?”

নীলাঞ্জনা বলল, “কিডন্যাপ করেনি তো কি জামাই আদর করতে নিয়ে গেছে”

অফিসার রাশেদ বলল, “বাড়ি থেকেই নিখোঁজ হয়ে গেছে”

নীলাঞ্জনা বলল, “সি সি ক্যামেরায় কিছু ধরা পড়েনি?”

অফিসার রাশেদ বলল, “এটাই তো সমস্যা।আজ থেকে দুই দিন আগেই কেউ সব সিসি ক্যামেরা নষ্ট করে দিয়েছে”

নীলাঞ্জনা বলল, “বাহ খুব চমৎকার”

অফিসার রাশেদ বলল, “তুমি যদি পারো তবে একটু বিষয়টা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করো”

নীলাঞ্জনা বলল, “ঠিক আছে”

নীলাঞ্জনা বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো। ভেতরে কিছু অপরিচিত মানুষ দেখা যাচ্ছে এবং নীলাঞ্জনার বাবা তাদের সাথে বসে গল্প করছে। নীলাঞ্জনা রুমের ভেতর গিয়ে বসার সাথে সাথে তার মা ও ভাবি সিনথিয়া এসে হাজির হলো। সিনথিয়ার হাতে একটা আকাশী রঙের শাড়ি। সে শাড়িটা দেখিয়ে বলল, “তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও।”

নীলাঞ্জনা বলল, “এই অসময়ে শাড়ি পরবো কেন?”

নীলাঞ্জনার মা মিসেস সালমা বললেন, “তোমাকে ছেলে পক্ষ দেখতে এসেছে। তোমার বাবা চায় তুমি এই ছেলেকে বিয়ে করো। তুমি তো জানোই, অনেক দিন ধরে তোমার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে। আশাকরি তুমি আমাদের নিরাশ করবে না। আশাকরি এই বিয়েতে তোমার মত থাকবে”

নীলাঞ্জনা আর কথা বাড়াল না। শাড়িটা পড়ে প্রস্তুত হয়ে নিল। খুব বেশি সাজল না। তার মা তার হাতে চায়ের ট্রে ধরিয়ে বললেন, “চা নিয়ে পাশের রুমে যাও। ছেলেপক্ষ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।”

নীলাঞ্জনা চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে পাশের রুমে চলে গেল। নীলাঞ্জনার বাবা তাকে বসতে বললো। নীলাঞ্জনা একটা চেয়ারে বসলো।

একজন অপরিচিত ব্যক্তি নীলাঞ্জনা কে প্রশ্ন করলো , “নাম কি তোমার?”

নীলাঞ্জনা বলল, “আমার নাম নীলাঞ্জনা রহমান”

অপরিচিত ব্যক্তিটি বলল, “আমার নাম সরোয়ার সিদ্দিকী। আমি পেশায় একজন ডাক্তার”

নীলাঞ্জনা বলল, “আমি পেশায় একজন সাংবাদিক। নতুন সাংবাদিক হিসেবে চাকরিতে জয়েন করলাম”

সরোয়ার নীলাঞ্জনার দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিলো।বলল, “তুমি এখন যেতে পারো”

নীলাঞ্জনা নিজের রুমে চলে গেল। নীলাঞ্জনা চলে যেতেই সরোয়ার বলল, “ আপনার আমার মেয়েকে পছন্দ হয়েছে।খুব শীঘ্রই আপনার মেয়েকে আমি বিয়ে করতে চাই”

নীলাঞ্জনার বাবা আতিক রহমান বলল, “এতো ভালো খবর।”

সরোয়ার বলল, “এই মাসের শেষেই আমি বিয়েটা করতে চাই”

আতিক রহমান বলল, “মাস শেষ হতে তো আর মাত্র অল্প ক’দিন বাকি”

সরোয়ার বলল, “আপনার কোন অসুবিধা নেই তো?”

আতিক রহমান বলল, “না আমার কোন অসুবিধা নেই।”

সরোয়ার বলল, “তাহলে এই মাসের ২৮ তারিখ বিয়েটা হয়ে যাক। জানেনই তো সামনের মাসে আবার নির্বাচন । আমার ভাই নির্বাচনে দাঁড়িয়েছে।তাই অনেক ঝামেলা। আশাকরি নীলার এই বিয়েতে কোন আপত্তি নেই”

আতিক রহমান বলল, “ওর এই বিয়েতে কোন আপত্তি নেই”

সরোয়ার বলল, “আমি তবে আজ আসি।বাকি কথা আমার বাবা আর বড় ভাই বলবে”

সরোয়ার চলে গেল। এইদিকে নীলাঞ্জনা রুমের এসে শাড়ি খুলেই বিরোধী দলের নেতা আয়ান চৌধুরীর বিষয়ে নিখোঁজ হবার পিছনে কারণ খুঁজতে লাগল।খাটের উপর ল্যাপটপ নিয়ে নীলাঞ্জনা কাজ করেই যাচ্ছে।এই পর্যন্ত অনেক মানুষ অনেক কিছু লিখেছে আয়ান চৌধুরীর নিখোঁজ হবার বিষয়ে। নীলাঞ্জনা কাজের ফাঁকে সিনিয়র কে ফোন দিয়ে বিস্তারিত বলে কল কেটে দেয়।কাল থেকে আয়ান চৌধুরীকে নিয়ে কাজ করবে।এই বিষয়ের উপর একটা ডকুমেন্টারি বানানোর ইচ্ছা আছে নীলাঞ্জনার।গত কয়েক বছর ধরে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হঠাৎ করেই উধাও হয়ে যাচ্ছে। পূর্ববর্তীতে তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এমনকি লাশ অবধি খুঁজে পাওয়া যায় নি।গত ছয় মাস আগে একজন ডাক্তার একটা মেয়ের খুনের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ করেই নিখোঁজ হয়ে যায়। হাসপাতাল থেকে নাইট ডিউটি করে বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্য বের হয়। এরপর থেকে এই ডাক্তার কে আর খুঁজে পাওয়া যায় না ।গত এক বছর আগে একজন সাংবাদিক ঠিক এইভাবে নিখোঁজ হয়ে যায়। এরকিছু দিন পর এই কেস তদন্ত করতে গিয়ে একজন পুলিশ অফিসার নিখোঁজ হয়ে যায়।

নীলাঞ্জনা আয়ান চৌধুরীর ফেসবুক আইডিতে গেল। ফেসবুকে আয়ান চৌধুরীকে ট্যাগ দিয়ে অনেকেই নানা রকম পোস্ট করেছে। আয়ান চৌধুরীর নিখোঁজ হওয়ায় অনেকে দুঃখ প্রকাশ করছে। আবার কেউ কেউ বলছে আয়ান চৌধুরী নির্বাচনের আগে ইচ্ছে করে নিখোঁজ হবার নাটক করছে যাতে প্রতিপক্ষ কো দোষারোপ করতে পারে। নীলাঞ্জনা ধৈর্য্য ধরে আইডির পোস্ট দেখতে থাকে। হঠাৎ একটা পোস্ট নীলাঞ্জনার নজরে চলে আসে।যেটা গতকাল সন্ধ্যায় পোস্ট করা হয়েছে। সেখানে আয়ান চৌধুরী লিখেছেন প্রজেক্ট কে নামের একটা ভয়ংকর প্রজেক্ট মানুষের আড়ালে তৈরি করা হচ্ছে।এতে অনেক মানুষের প্রাণ চলে যেতে পারে। আমি বেঁচে থাকলে প্রজেক্ট কে এর সাথে জড়িত সকলের মুখোশ ফাঁস করে দেব।

নীলাঞ্জনা খুব আগ্রহী হয় এই প্রজেক্ট কে এর বিষয়ে। নিশ্চয়ই এই প্রজেক্টের মধ্যে কোন ব্যাপার আছে।তাই এই পোস্ট করার সাথে সাথে তাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে।এই কিডন্যাপ হয়তো প্রজেক্ট কে তে জড়িত মানুষরাই করিয়েছে। যাতে কেউ তাদের গোপনীয়তা প্রকাশ করতে না পারে। কিন্তু কি এই প্রজেক্ট কে।

চলবে।