বুকপকেটে তুমি পর্ব-০৪

0
15

#বুকপকেটে_তুমি
#লেখায়_জান্নাতুন_নাঈম
#পর্ব_৪

বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই সরোয়ার তাকে তার রুমে নিয়ে গেল বিয়ের জিনিস পত্র দেখাবে বলে। খাটের উপর বিয়ের সাদা রঙের জামদানি শাড়ি রাখা।

নীলাঞ্জনা অবাক হয়ে বলল, “বিয়ের শপিং কি আপনি করছেন?”

সরোয়ার বলল, “ নেতা পছন্দ করে কিনছে?”

নীলাঞ্জনা বলল, “নেতার পছন্দের তারিফ করতে হয়”

সরোয়ার বলল, “হ্যা। ভাইয়ার চেয়েছ অনেক ভালো। শুধু গার্লফ্রেন্ড চয়েজ করতে পারে না ঠিকমতো।”

নীলাঞ্জনা অবাক হয়ে বলল, “তোমার ভাইয়ের বিয়ে হয়নি?”

সরোয়ার বলল, “না। এখন অবশ্য সিঙ্গেল।দুই বছর ধরে কোন প্রেম পিরিতি করে না”

নীলাঞ্জনা বলল, “আমি ভাবতেই পারছি না উনি সিঙ্গেল।”

সরোয়ার বলল, “ ভাইয়া হলো রেড ফ্লাগ। তবে বিয়ে করেনি এখন ও।এত বড় হয়েছে নিজেও বিয়ে করে না। আমাদের ও বিয়ে দেয় না”

পিছন থেকে সেলিম উত্তর দিলো , “আমি যদি রেড ফ্লাগ হই।তুই তাহলে রেড ফরেস্ট।বলে দিব নাকি তোর বউকে”

সরোয়ার বলল, “তুমি ও না। তুমি দেখছি হবু বউয়ের সামনে ইজ্জত নিয়ে টান দিচ্ছো”

সেলিম বলল, “অনেক হয়েছে। নীলাঞ্জনা খাবার খাবে।এত সময় হয়ে গেছে ও এখন ও দুপুরে খাবার খায়নি”

নীলাঞ্জনা বলল, “কোন সমস্যা নেই। আমার এইরকম প্রায় দেরি হয়”

নীলাঞ্জনা ডাইনিং টেবিলে বসে অপেক্ষা করতে লাগল। কাজের মহিলা শেফালী খালা একে একে খাবার আনতে লাগলেন। নীলাঞ্জনার উল্টো পাশে সেলিম এসে খাবার খেতে বসল।

এরপর শেফালী খালা শেষ পদের খাবার টেবিলে রেখে ধীর পায়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। নীলাঞ্জনা চুপচাপ সেলিমের দিকে তাকিয়ে রইল। সেলিম একমনে খেতে থাকলেও তার নজর নীলাঞ্জনার থেকে সরলো না। দুজনেই নিরবে খাবার শেষ করে নিতে লাগল।
কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর নীলাঞ্জনা মৃদু স্বরে বলল, “আমি খাবার খাওয়া শেষে বাড়ি ফিরে যেতে চাই। আমি খুব ক্লান্ত। আমি বাড়ি ফিরে গিয়ে বিশ্রাম নিব”

সেলিম বলল, “তোমাকে এখন অনেক দুর অবধি গাড়ি করে যেতে হবে। তুমি এখানে বিশ্রাম নেও। এরপর সন্ধ্যায় বাড়ি দিয়ে আসবো। তোমার এখানে অসুবিধা হলে আমার বাড়িতে বিশ্রাম নিতে পারো”

নীলাঞ্জনা অবাক হয়ে বলল, “আপনি এখানে থাকেন না?”

সেলিম হেসে বলল, “এটা সরোয়ারের বাড়ি। আমার বাড়ি সরোয়ারের বাড়ির ডান পাশের দোতলা বাড়িটা।”

নীলাঞ্জনা মাথা নাড়ল, কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছিল। তবে ক্লান্তি যেন তার সমস্ত শরীর আর মনে ছড়িয়ে পড়েছে।সে বলল, “ঠিক আছে
তা হলে আজ না হয় আপনার বাড়িতেই বিশ্রাম নিই। সন্ধ্যায় কিন্তু আমাকে বাড়ি পৌছে দিতে হবে।”

সেলিম সম্মতি জানিয়ে বলল, ” আমি সন্ধ্যায় তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেব। তুমি কোন চিন্তা করো না”

নীলাঞ্জনা আর কথা না বাড়িয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল।বলল, “চলুন তাহলে”

সেলিম বলল, “আর খাবে না?”

নীলাঞ্জনা বলল, “না”

সেলিম খাবারের প্লেটেই হাত ধুয়ে বলল, “ঠিক আছে।তাহলে চলো যাওয়া যাক।”

নীলাঞ্জনা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো। সেলিমের দোতলা ছোট বাড়ি।বাড়ির সামনে ছোট একটা সুইমিং পুল রাখা আছে।বাড়ির আশেপাশে অনেক গুলো ফুলের বাগান আছে।পুলের এক পাশে বিশ্রাম নেয়ার জন্য ছোট কুঁড়েঘর আছে। সেলিম নীলাঞ্জনা কে নিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো।
বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই সেলিম তার বাবা মায়ের সাথে ও বোনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।
সেলিম বলল, “ও নীলাঞ্জনা।ও একটু বিশ্রাম নিবে। আয়শা ওকে বিশ্রাম নেয়ার জন্য একটা রুম দেখিয়ে দেও”

আয়শা বলল, “আমার সাথে এসো।”

নীলাঞ্জনা আয়শার সাথে চলতে লাগল। একটা রুম দেখিয়ে দিয়ে আয়শা বলল, “তুমি এখানে বিশ্রাম নেও।এটা কিন্তু ভাইয়ারই রুম”

নীলাঞ্জনা কিছু বলতে চাইলো তার আগেই আয়শা চলে যায়। নীলাঞ্জনা বেশ অবাক হয় আয়শা তাকে তার ভাইয়ের রুম দেখিয়ে দেয়ার জন্য।

নীলাঞ্জনা দরজা খুলে ধীরে ধীরে খাটের দিকে এগিয়ে গেল। ক্লান্ত চোখে চারপাশটা একবার দেখে নিল। সেলিমের ঘরটা খুব অগোছালো অবস্থায় পড়ে আছে। চারদিকে জিনিস পত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। নীলাঞ্জনা বিশ্রাম নেয়ার আগে পুরো ঘরটা পরিষ্কার করে নিল।রুম পরিস্কার করে খাটের উপর বসে পড়ল।খাটে বসে পড়তেই শরীরটা ভারী মনে হলো। সে চোখ বন্ধ করে নিজের মনে ভাবল, কতদিন হলো নিজের জন্য কিছু সময় বের করা হয়নি। চারদিকে ব্যস্ততা, দৌড়ঝাঁপ—কিছুতেই যেন নিস্তার নেই। নীলাঞ্জনা তার ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।

সোফায় সেলিম বসে আছে। সেলিমের বাবা জাকারিয়া রহমান বলল, “ও সরোয়ারের পছন্দের মেয়ে তাই না?”

সেলিম বলল, “হ্যা”

জাকারিয়া বলল, “সে নিজের শ্বশুর বাড়ি না বিশ্রাম নিয়ে এখানে বিশ্রাম নেয়ার জন্য চলে এসেছে। ব্যাপার টা কি বলো তো?”

সেলিম বলল, “নীলাঞ্জনা ওখানে থাকতে চায়নি তাই বললাম এখানে বিশ্রাম নিতে। তবে একটা কথা অস্বীকার করা যাবে না যে বউ হিসাবে নীলাঞ্জনা মাশাআল্লাহ”

জাকারিয়া বলল, “তোমার বউ হলেও পারতো”

সেলিম বলল, “এভাবে বলো না।তা না হলে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ফেলবো”

জাকারিয়া বলল, “তোমাদের দুজনের লাইভ দেখলাম। নীলাঞ্জনা খুব নার্ভাস ছিল।হয়তো তুমি ছিলে বলে”

আয়শা বলল, “নীলাঞ্জনা তো পুরো লাইভে একবার ও ভাইয়া দিকে তাকায় নি।মনে হচ্ছিল ভাইয়ার চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস নেই।ভুলে নজর চলে যেতেই সাথে সাথে চোখ নামিয়ে ফেলেছে”

সেলিম বলল, “তোমরা ও না”

আয়শা বলল, “নীলাঞ্জনা আমার ভাবি হলে আমার খুব ভালো লাগবে।”

সেলিম বলল, “ভাবি তো হচ্ছেই”

সেলিম আর তার বাবা ও বোনের সাথে কথা বাড়াল না।আর একটু কথা বললেই তারা তাকে পাগল বানিয়ে ছাড়বে। সেলিম নিজের রুমে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য চলে গেল। দরজা খুলে দেখলো নীলাঞ্জনা তার রুমে ঘুমিয়ে আছে।সেলিম তাকে দেখে কিছু বলতে গিয়ে ও থেমে গেল। নীলাঞ্জনা ঘুমিয়ে আছে।নীলাঞ্জনার ক্লান্ত মুখ দেখে সে বুঝল এখন তাকে ডাক দেয়া ঠিক হবে না। নীলাঞ্জনার ক্লান্ত মুখ দেখে সেলিমের অনেক মায়া হলো। সেলিম আলমারি থেকে একটা কাথা নামিয়ে নীলাঞ্জনার গায়ের উপর দিয়ে দিল।
সেলিম নিঃশব্দে রুমের জানালার পর্দা টেনে দিল, যাতে আলোটা একটু কম হয়।এতে নীলাঞ্জনার ঘুমের কোন অসুবিধা হবে না।বাইরে বিকেলের রোদ একটু একটু করে কমতে শুরু করেছে। সেলিম পাশের রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। সন্ধ্যায় সেলিম তার রুমে এসে দেখলো নীলাঞ্জনা তখন ও ঘুমিয়ে আছে। সেলিম কি করবে বুঝতে পারছে না। নীলাঞ্জনা কে ঘুম থেকে ডেকে তোলা ঠিক হবে না। আবার সন্ধ্যায় বাড়ি দিয়ে না আসলে নীলাঞ্জনা রাগ করবে। সেলিম খাটের এক কর্নারে গিয়ে বসে পড়লো। আনুমানিক রাত আটটার দিকে নীলাঞ্জনার ঘুম ভাঙল। চোখ খুলতেই দেখলো সেলিম তার পাশেই বসে আছে। নীলাঞ্জনা বলল, “আপনি এখানে কি করছেন?”

সেলিম বলল, “এটা আমার রুম। আমি অবশ্য এতক্ষণ পাশের রুমে ছিলাম।একটু আগেই এখানে এসেছি”

নীলাঞ্জনা, “আপনার বোন বলল এখানে ঘুমাতে।সে অবশ্য বলেছিল এটা আপনার রুম”

সেলিম বলল, “ও একটা ফাজিল।ওর কথা বাদ দেও”

নীলাঞ্জনা বলল, “তাহলে বাড়ি যাওয়া যাক?”

সেলিম বলল, “হ্যা।নিচে আম্মা তোমার জন্য নাস্তা বানাচ্ছে। তুমি নিচে গিয়ে নাস্তা খাও। আমি ততক্ষণে রেডি হয়ে নেই। এরপর তোমাকে বাড়ি দিয়ে আসবো”

নীলাঞ্জনা হাত মুখ ধুয়ে ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসলো। সেলিমের বাবা মা দুইজনে সোফায় বসে টিভি দেখছে। সেলিমের মা নুরবানু বলল, “নাস্তা খেয়ে নাও নীলাঞ্জনা”

আয়শা নীলাঞ্জনার দিকে নাস্তার প্লেট এগিয়ে দিল। নীলাঞ্জনা ধীরে ধীরে নাস্তা খেতে লাগল। একটু পর সেলিম এসে বলল, “আমি রেডি।চলো তাহলে যাওয়া যাক”

নীলাঞ্জনা বলল, “আমি ও রেডি আছি”

নুরবানু বলল, “আজকের রাতটা এখানে থেকে যাও নীলাঞ্জনা ”

নীলাঞ্জনা বলল, “না আন্টি।কাল সকালে আমার অফিস আছে। এখন অফিসে অনেক কাজের চাপ”

সেলিম বলল, “আমি গাড়ি আনতে যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি এসো।”

কথাটা বলেই সেলিম চলে গেল। নীলাঞ্জনা বলল, “আন্টি আমি তবে আসি। আপনাদের সাথে ভালো সময় কাটলো”

জাকারিয়া রহমান বলল, “তোমার সাথে তো গল্পই করা হলো না।”

নীলাঞ্জনা বলল, “অন্য একদিন গল্প করবো আঙ্কেল। আমি তবে গেলাম।”

নীলাঞ্জনা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। সেলিম নিচে গাড়ির ভেতরে অপেক্ষা করছে। নীলাঞ্জনা গাড়িতে উঠে বসতেই সেলিম গাড়ি স্টার্ট করলো। সরোয়ার বারান্দা থেকে সবকিছু দেখছিল। নীলাঞ্জনা সরোয়ারের হবু বউ। সরোয়ার সময় কাটাবে বলে নীলাঞ্জনা কে ডেকে এনেছিল ।অথচ নীলাঞ্জনা সারাদিন সেলিমের সাথে ছিল। সরোয়ারের এই নিয়ে বেশ রাগ হয়। কিন্তু সেলিমের কাছে গিয়ে এইসব বলার সাহস তার নেই। সরোয়ার মনে মনে বলে আর তো মাত্র কয়েকটা দিন। এরপর নীলাঞ্জনা আমার বউ হয়ে আসবে । ভাইয়া তখন কিছুই করতে পারবে না।

নীলাঞ্জনা জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। সেলিম নিচু স্বরে বলল, “তুমি চাইলে আমরা একটা রেস্টুরেন্টে ডিনার করতে পারি”

নীলাঞ্জনা বলল, “আমার কোন অসুবিধা নেই।”

সেলিম বলল, “কাছেই একটা রেস্টুরেন্ট আছে।যাবে ওখানে?”

নীলাঞ্জনা বলল, “চলুন”

সেলিম বলল, “এই মুহূর্তে তোমার মনে আমার সম্পর্কে কি ধারণা আছে বা তুমি আমাকে নিয়ে কি রকম মনোভাব রাখো এটা কি জানতে পারি?”

নীলাঞ্জনা বলল, “কয়দিন পর আমার বিয়ে।এই মুহূর্তে বলা ঠিক হবে কিনা জানিনা”

সেলিম বলল, “তুমি হয়তো সরোয়ার কে বিয়ে করতে চাইছো না”

নীলাঞ্জনা বলল, “হ্যাঁ”

সেলিম বলল, “আমি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর পাইনি”

নীলাঞ্জনা বলল, “আমি যদি বলি হয়তো আমি আপনাকে পছন্দ করি তবে কি আপনি অবাক হবেন?”

সেলিম বলল, “আমি মোটেও অবাক হব না। তুমি বললে আমি এখুনি তোমাকে বিয়ে করে গাড়ি ঘুরিয়ে আবার আমার বাড়িতে নিয়ে যাব। সত্যি বলতে আমি এটা করতে পারবো।আর এই কাজের জন্য আমি সরোয়ার কে ভয় পাই না কিংবা সে আমার কাছে কৈফিয়ত চাইতে পারবে না”

নীলাঞ্জনা বলল, “আমি এখন ও এইসব নিয়ে ভাবিনি। তবে আপনি অসাধারণ একজন মানুষ। শুধু আপনার বেডরুম একটু বেশি এলোমেলো থাকে”

সেলিম বলল, “তুমি আমার রুম পরিস্কার করেছ তাই না?”

নীলাঞ্জনা বলল, “হ্যা”

সেলিম বলল, “তুমি চাইলেই আমাকে ভালোবাসতে পারো। রাজনীতি করলেই সবাই খারাপ হয় না। আমি মানুষ টা খারাপ না”

(চলবে)