বুকপকেটে তুমি পর্ব-০৫

0
19

#বুকপকেটে_তুমি
#লেখায়_জান্নাতুন_নাঈম
#পর্ব_৫

সেলিম একটা রেস্টুরেন্টর সামনে গাড়ি থামালো। গাড়ি থামিয়ে রেস্টুরেন্টের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। নীলাঞ্জনার দিকে একবার তাকিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করেও থেমে গেল। নীলাঞ্জনার মুখের দিকে তাকিয়েই বোঝা যাচ্ছে তার মন খারাপ।দুজনেই গাড়ি থেকে নেমে রেস্টুরেন্টের ভেতরে প্রবেশ করলো এবং একটা টেবিলে গিয়ে বসলো।চারপাশের আরামদায়ক পরিবেশও যেন নীলাঞ্জনার চিন্তাগ্রস্ত চেহারায় কোনো প্রভাব ফেলতে পারলো না। তার চোখে যেন অনেক ভাবনা খেলা করছে।
একটা অল্প বয়সী চিকন ছেলে তাদের কাছে এসে দাঁড়াল।বলল, “ডিনারে আপনারা কি খাবেন?”

সেলিম নীলাঞ্জনার দিকে আড়চোখে তাকালো। নীলাঞ্জনা ইশারায় বলল সেলিমই যেন খাবার অর্ডার দেয়।সে কিছু অর্ডার দিবে না। সেলিম খাবার অর্ডার দিল। অর্ডার পেয়ে ছেলেটা চলে গেল।

সেলিম কিছুক্ষণ নীরবে নীলাঞ্জনার দিকে তাকিয়ে থাকলো। অবশেষে ধীরে ধীরে বললো, “তোমার এত মন খারাপ কেন নীলাঞ্জনা?”

নীলাঞ্জনা সেলিমের দিকে চোখ তুলে তাকাল।বলল, “আমি বুঝতে পারছি না কি বলবো। আমি জানি না এই মুহূর্তে আমার কি করা উচিত”

সেলিম কয়েক মুহূর্তের জন্য চুপ করে থেকে সে গভীর নিঃশ্বাস ফেললো।বলল, “আমি জানি এই মুহূর্তে কোন পরিস্থিতিতে আছো। তুমি এখন তোমার মনের কথা শুনো আর কিছু না”

নীলাঞ্জনা বলল, “আব্বাকে কী বলবো জানি না। আমি তো কীভাবে বলবো যে এই বিয়েটা আমি করতে চাইনা”

সেলিম বলল, “তুমি সরোয়ারের সাথে কথা বলে দেখো।”

নীলাঞ্জনা বলল, “হ্যা আমি ওকে বুঝিয়ে বলবো”

রাতে সেলিম নীলাঞ্জনা কে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে আবার নিজের বাড়িতে ফিরে এলো। ঘরের ভেতর প্রবেশ করতেই দেখলো সরোয়ার তার ঘরে বসে অপেক্ষা করছে। সরোয়ার হেসে বলল, “এতরাতে আবার কোথায় গিয়েছিলে?”

সেলিম বলল , “নীলাঞ্জনাকে বাড়ি পৌঁছে দিলাম।”

সরোয়ার বলল, “সেই তো সন্ধ্যায় বেরিয়েছিলে।এখন রাত দশটা বাজে।বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসতে এত সময় লাগে?”

সেলিম ইতস্তত করে বলল, “একটু কাজ ছিল”

সরোয়ার বলল, “একটা মজার বিষয় কি জানো নীলাঞ্জনা আমার বউ। ওকে আমার বাড়িতে আসতে বলেছিলাম যাতে বিয়ের আগে নিজের শ্বশুর বাড়ি কেমন হবে বা বিয়ের শপিং করেছি সেগুলো দেখাব।সে আমার প্রশংসা না করে তোমার প্রশংসা করলো। এমনকি যেখানে আমার সাথে সময় কাটানোর কথা ছিল।সেই জায়গায় আজ সারাদিন তুমি ওর সাথে ছিলে”

সেলিম বলল, “বিয়ের শপিং আমি করেছি তাই প্রশংসা করেছে।”

সরোয়ার বলল, “ও আমাকে কাল দেখা করতে বলেছে। যাইহোক তুমি ওর আশেপাশে একদম যাওয়ার চেষ্টা করবে না। আমি চাই না কেউ আমার স্ত্রী কে বিরক্ত করুক”

সেলিম বলল, “স্ত্রী তো হবে বিয়ের পর।দেখা যাক বিয়েটা হয় কিনা”

সেলিম কথাটা আস্তে বলায় সরোয়ার শুনতে পেল না। সরোয়ার রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

পরদিন সকালে নীলাঞ্জনা অফিসের জন্য রেডি হচ্ছে। নীলাঞ্জনার মা এসে দাঁড়াল।বলল, “কোথায় যাচ্ছো?”

নীলাঞ্জনা বলল, “অফিসে যাচ্ছি”
নীলাঞ্জনার মা বলল, “আর তো মাত্র কটা দিন।এখন অফিস না গেলে হয়না?”

নীলাঞ্জনা বলল, “আম্মা আমি অফিসে যাচ্ছি মামার বাড়িতে না।যে ইচ্ছে করলে যাব ইচ্ছে করলে যাব না।আজ অবশ্য সরোয়ার সিদ্দিকীর সঙ্গে দেখা করবো। আমি একটু দেখা করতে বলেছি”

নীলাঞ্জনার মা কিছু বলতে চাইলো কিন্তু তার আগেই নীলাঞ্জনা অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। অফিসে গিয়ে ডেস্কে বসতেই সহকারী নাদিয়া পাশে এসে দাঁড়াল।

নাদিয়া বলল, “শুনলাম তোমার নাকি সেলিম রহমানের ভাইয়ের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে”

নীলাঞ্জনা বলল, “হ্যা। সরোয়ার সিদ্দিকী নাম উনার। সেলিম রহমান অবশ্যই সরোয়ারের আপন ভাই না। চাচাতো ভাই মনে হয়”

নাদিয়া বলল, “উনার বয়স অনেক বেশি।বয়সে এত বড়ো এক লোকের সাথে তোমার পরিবার কীভাবে বিয়ে ঠিক করলো?”

নীলাঞ্জনা বলল, “বাবা খুব অসুস্থ।তাই উনার কথা ফেলতে পারি নি। তবে সরোয়ার মানুষ টা খারাপ না”

অশ্রুসিক্ত নয়নে অভিমান বুকে চেপে কথাগুলো বললো নীলাঞ্জনা।

নাদিয়া তার কলিগ নীলাঞ্জনার কষ্টটা উপলব্ধি করতে পারছে।মাধ্যমিক পরীক্ষার পরেই বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল নাদিয়ার মা। নীলাঞ্জনা বলল, “তবে আমি সরোয়ার কে আজ দেখা করতে বলেছি।তাকে বোঝানোর চেষ্টা করবো যে এই বিয়েতে আমার মত নেই”

নাদিয়া বলল, “হ্যা, হ্যা।না পারলে আমাকে বলো আমি ওকে বুঝিয়ে বলবো”

নীলাঞ্জনা হেসে বলল, “থাক তোমার কিছু করতে হবে না। আমি পারবো। আচ্ছা একটা হেল্প করো”

নাদিয়া বলল, “কি হেল্প?”

নীলাঞ্জনা বলল, “এখানে নুরুল ইসলাম খানের সময়কালে কোন কোন মেয়ে চাকরি পেয়েছে বলতে পারো?”

নাদিয়া বলল, “আছে চার পাঁচ জন মেয়ে।কেন বল তো?”

নীলাঞ্জনা বলল, “এখানে কেউ একজন অনামিকা ছদ্মনাম ব্যবহার করে আমার কাছে মেইল পাঠিয়েছে।”

নাদিয়া বলল, “মেয়েটা কি বলেছে?”

নীলাঞ্জনা বলল, “মেয়েটা বলেছে যে নুরুল ইসলাম খান নাকি মেয়েদের চাকরি দেয়ার নাম করে অপ্রীতিকর আচরণ করছে।তো অনামিকাও এইভাবে চাকরি পেয়েছে। এখন নুরুল ইসলাম খানের কাছে অনামিকার কিছু ছবি ও ভিডিও আছে।সে নাকি এইসবের ভয় দেখিয়ে অনামিকা কে ব্লাকমেইল করছে”

নাদিয়া বলল, “কেমনে চাকরি পাইছে?”

নীলাঞ্জনা বিরক্ত হয়ে বলল, “আরে বোঝা না”

নাদিয়া বলল, “বুঝছি।তুই মেইল দেখা।”

নীলাঞ্জনা মেইলে দেখাতে দেখাতে বলল , “মেয়ের য় ও ইং ব্যবহারে সমস্যা আছে । মানে সঠিক ব্যবহার জানে না। তুমি কি জানো এখানে এইরকম সমস্যা কারো আছে কিনা”

নাদিয়া বলল, “এইরকম দুইজন আছে। একজনের নাম রুহানি অন্যজন দিবা”

নীলাঞ্জনা বলল, “ওদের ফোন নাম্বার দিও তো। আমার দেখতে হবে এদের মধ্যে কে অনামিকা।হুট করে কারো উপর অভিযোগ তোলা যাবে না। এরজন্য অনামিকার সাথে কথা বলতে হবে তারপর নুরুল ইসলাম খানের বিরুদ্ধে প্রমাণ খুঁজে বের করতে হবে”

নাদিয়া বলল, “তুমি চিন্তা করো না। আমি এই কাজে তোমাকে হেল্প করবো।দিবার সাথে আমার একটু পরিচয় আছে। আমি দেখবো যে সে অনামিকা কিনা”

নীলাঞ্জনা বলল, “তুমি সাবধানে কথা বলো। কারন সে অনামিকা না হলে সমস্যা হতে পারে”

নাদিয়া বলল, “হ্যা আমি জানি।এই অভিযোগ আমাদের বসের বিরুদ্ধে।তাই সাবধানে কাজ করতে হবে।কাল তুমি চলে যাওয়ার পর উনি তোমার টক শোয়ের ব্যাপারে কথা বলছিল। উনি বলল তুমি নাকি শো অনেক ভালো করেছ তবে উনি তোমার থেকে আরো ভালো আশা করেছিল।”

নীলাঞ্জনা বলল, “যা করেছি তাই অনেক। হুট করে না জানিয়ে লাইভের আয়োজন করা। আমি বলেছি পরের বার এমন করলে আমি চাকরি ছেড়ে দিব । আমার কাছে অনেক অপশন আছে”

নাদিয়া চলে গেল। নীলাঞ্জনা তার ডেস্কে বসে কাজ শেষ করে নিল।কাজ শেষ করে পুরো অফিস হেঁটে হেঁটে দেখলো। নীলাঞ্জনা ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখছে কে এই অনামিকা। নীলাঞ্জনা রুহানির পাশে গিয়ে বসল।বলল , “হেই অনামিকা তুমি কি আমাকে একটা হেল্প করতে পারবে?”

রুহানি বলল, “আপু আপনি তো আমার নামই ভুলে গেছেন। আমি অনামিকা না। আমি রুহানি”

নীলাঞ্জনা অবাক হওয়ার ভান করে বলল, “অহ আমি ভাবলাম তুমি অনামিকা”

রুহানি বলল, “কোন ব্যাপার না। আপনি বলুন আপনার কি হেল্প লাগবে?”

নীলাঞ্জনা বলল, “এক কাপ চা বানিয়ে দিতে পারবে?”

রুহানি বলল, “আপনি ডেস্কে গিয়ে অপেক্ষা করুন। আমি এক্ষুনি চা বানিয়ে আনছি”

নীলাঞ্জনা বলল, “ধন্যবাদ। আমার না খুব মাথা ব্যথা করছিল।চা খেলে যদি একটু ভালো লাগে”

নীলাঞ্জনা ডেস্কে গিয়ে বসলো। রুহানি অনামিকা না এইটুকু বুঝতে পারছে। তাহলে বাকি রইলো দিবা। এখন জানতে হবে দিবাই কি অনামিকা কিনা।

দশ মিনিট পর রুহানি চা নিয়ে হাজির হলো। নীলাঞ্জনা বলল, “অনেক ধন্যবাদ। তুমি আরেকটা হেল্প করতে পারবে?”

রুহানি বলল, “অবশ্যই”

নীলাঞ্জনা বলল, “একটু দিবা কে ডেকে দিও তো।বলো আমি ওর সাথে দেখা করতে চাই”

রুহানি বলল, “অবশ্যই”
রুহানি চলে গেল। একটু পর দিবা এসে হাজির হলো। নীলাঞ্জনা বলল, “তুমি কি ফ্রি আছো অনামিকা?”

দিবা বলল, “আমি দিবা”

নীলাঞ্জনা বলল, “অং আচ্ছা দিবা। তুমি কি ফ্রি আছো?”

দিবা বলল, “হ্যা কেন?”

নীলাঞ্জনা বলল, “আমার একটু বেরেতো হবে।খুব জরুরী একটা কাজে বাইরে যেতে হবে। আমার সামান্য কিছু কাজ আছে। তুমি কি এইগুলা করে দিবা”

দিবা বলল, “আপনি যেতে পারেন। আমি আপনার কাজ গুলো করে রাখবো”

নীলাঞ্জনা বলল, “অনেক ধন্যবাদ”

নীলাঞ্জনা অফিস থেকে বেরিয়ে গেল। অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা হাসপাতালের সামনে চলে গেল। সরোয়ার প্রায় এক ঘন্টা ধরে হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নীলাঞ্জনা সরোয়ারের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।বলল, “সরি। অফিসের খুব কাজের চাপ ছিল।অন্য কাউকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে আসতে আসতে অনেক দেরী হয়ে গেল”

সরোয়ার বলল, “ব্যাপার না।চলো কোথাও গিয়ে বসা যাক। এখানে এখানে নতুন একটা ক্যাফে তৈরি হয়েছে ।বেশ ভালো”
নীলাঞ্জনা বলল, “চলুন তাহলে”

হাসপাতালের একটু সামনেই ক্যাফের অবস্থান।ক্যাফের বাইরে ফুল বাগানের সাথে বসার ব্যবস্থা ছিল। দুজনে ওখানেই বসে পড়লো। সরোয়ার বলল, “আমি খুব ভয় পাচ্ছি। আমি জানি না তুমি আমাকে কি বলতে চাও। তুমি প্লীজ এটা বলো না যে তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাও না”

সরোয়ারের কথার মাঝে একটা ছেলে এসে উপস্থিত হলো। নীলাঞ্জনা বলল, “দুইটা কফি আর কিছু না”

সরোয়ার বলল, “আরো কিছু অর্ডার দেও”

নীলাঞ্জনা বলল, “না। আমার শরীর ভালো না। বাইরের খাবার বেশি খাবো না।”

সরোয়ার বলল , “অসুস্থ নাকি?”
নীলাঞ্জনা বলল, “ ভয়ের কিছু নেই। হালকা জ্বর হয়েছে আর কিছু না”

সরোয়ার আশেপাশে এক নজর তাকিয়ে চারপাশের পরিবেশ টা দেখে নিল।বলল, “এই জায়গাটা সুন্দর না? আচ্ছা তুমি আমাকে কি বলতে চাও বলো?”

নীলাঞ্জনা বলল, “আমি আসলে কীভাবে বলবো বুঝতে পারছি না। তবে এই বিয়েতে আমার সত্যিই মত ছিল না। আব্বা এত অসুস্থ যে না করতে পারিনি”

সরোয়ার কিছু বলল না কেবল মাথা নিচু করে বসে রইল। নীলাঞ্জনা আবার বলতে শুরু করল।বলল, “আমি একজন কে ভালোবাসতাম কিন্তু আমি জানতাম না যে সেও আমাকে ভালোবাসে”

সরোয়ার বলল, “সে নিশ্চয়ই আমার ভাই”

নীলাঞ্জনা বলল, “হয়তো”

সরোয়ার এবার রেগে গেল।বলল, “এটা কি মজা পেয়েছ। তুমি ভালোবাসা নিয়ে বলছো হয়তো। এখানে হয়তো আসে কীভাবে?”

নীলাঞ্জনা বলল, “হ্যা আমি সেলিম কে ভালোবাসি। আমি বলছি না বিয়ে করতে পারবো না। তবে আপনি বিয়েটা ভেঙ্গে দিলে আমি খুশি হবো। আমি অসুস্থ আব্বুকে এই কথা বলতে পারবো না। এভাবে যদি আমাদের বিয়ে হয় তাহলে কি আমরা সুখী হবো?”

সরোয়ার বলল, “না ।কারন তুমি অন্য কাউকে ভালোবেসো।ঠিক আছে আমি তোমার বাবাকে না করে দিব। তবে তোমার বিয়ে হবে।পাত্র হিসেবে আমি থাকবো না এই আরকি”

সরোয়ার বলল, “জানো আমি ও তোমাকে ভালোবাসি কিন্তু ভালোবাসা জোর করে পাওয়া যায় না।এটা কোন গোল্ড মেডেল না যে প্রতিযোগিতা করে জিতে নেব। ভাইয়া অনেক দিন ধরে কোন মেয়ের সাথে কথা বলতে দেখিনা। আমি জানতাম না তুমি সেই মেয়ে যাকে ভাইয়া মন দিয়ে ফেলেছে”

নীলাঞ্জনা বলল, “আমার আপনার জন্য খারাপ লাগছে কিন্তু আমার হাতে কিছু নেই”

সরোয়ার বলল, “তুমি মন খারাপ করো না। তোমার আর ভাইয়ার বিয়ে আমি দিব আর ২৮ তারিখেই”

(চলবে)