বুকপকেটে তুমি পর্ব-০৮

0
20

#বুকপকেটে_তুমি
#লেখায়_জান্নাতুন_নাঈম
#পর্ব_৮

নুরুল ইসলাম খান একটি অন্ধকার ঘরে বসে আছে। ঘরটি এতটাই ছোট যে সে ঠিকমতো নড়াচড়া করতে পারছে না। প্রচণ্ড পিপাসায় তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বারবার চিৎকার করার পরেও কেউ তাকে একফোঁটা পানিও এনে দেয় না। ক্ষোভে ও হতাশায় নুরুল ইসলাম গালি দিতে থাকে, কিন্তু তার কথার কোনো জবাব কেউ দেয় না।

হঠাৎ দরজার খোলার শব্দ হয়। নুরুল ইসলাম চমকে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। একজন লোক ঘরের ভেতর ঢুকে। নুরুল ইসলাম অবাক হয়ে বলে উঠল, “তুমি? তুমি কীভাবে পারলে আমার সঙ্গে এমনটা করতে?”

লোকটি কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ তার কাছে এসে একটি ইনজেকশন পুশ করে দিল।ইনজেকশন দেওয়ার পর নুরুল ইসলাম হঠাৎ অনুভব করল তার শরীর দুর্বল হয়ে আসছে। হাত-পা যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে, এবং মাথা ধীরে ধীরে ভারী হয়ে উঠছে। নুরুল ইসলাম তার সামনে থাকা লোকটিকে আঘাত করতে চাইলো কিন্তু তার আগেই ফ্লোরে লুটিয়ে পড়লো।তার চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে যেতে শুরু করল।

সকালে নীলাঞ্জনা থানায় আসার জন্য তৈরি হয়ে নিল। অনেক সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও অর্ক তার বাসায় এসে উপস্থিত হলো। হঠাৎ অর্কর ফোন এলো। নীলাঞ্জনা রিসিভ করতেই বলল, “একটা খারাপ খবর আছে। নুরুল ইসলাম খান নিখোঁজ হয়ে গেছে। আমাদের আর থানায় যাওয়ার দরকার নেই।এই সময়ে থানায় অভিযোগ করলে আমরা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে পারি”

নীলাঞ্জনা বলল, “এখন কি করবো?”

অর্ক বলল, “যা হচ্ছে হতে দেও। তুমি অফিসে আসো বাকি কথা ওখানেই বলব”

নীলাঞ্জনা বলল, “আমি বুঝতে পারছি। আমি অফিসে আসতেছি।”

অর্ক বলল, “হ্যা আসো।আজ অনেক কাজ আছে।”

নীলাঞ্জনা অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। চারদিকে মানুষ নুরুল ইসলাম খানের নিখোঁজ নিয়ে আলোচনা করছে। কদিন আগে মাত্র আয়ান চৌধুরী নিখোঁজ হলো । এখন আবার নুরুল ইসলাম খান নিখোজ হয়েছেন। চারদিকে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। নীলাঞ্জনা নিজের ডেস্কে গিয়ে বসলো। নীলাঞ্জনার সিনিয়র অর্ক একটা ফাইল নিয়ে হাজির হলো। নীলাঞ্জনা কে ফাইল টা দিয়ে বলল, “এটা অনামিকার বিষয়ে ফাইল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তখন এই নিয়ে পদক্ষেপ নেয়া যাবে। এখন যদি এই বিষয়ে কিছু করতে যাই তাহলে বলবে নুরুল ইসলামের নিখোঁজ হওয়ার পিছনে নিশ্চিত আমাদের হাত আছে”

নীলাঞ্জনা বলল, “কি হচ্ছে বুঝতে পারছি না।অল্প কয়দিনের ব্যবধানে দুইজন মানুষ উধাও হয়ে গেল”

অর্ক বলল, “এইসব বের করা আমাদের কাজ না। আমি একটা ডকুমেন্টারি বানিয়েছি। তোমার কাজ সহজ হয়ে যাবে।আমরা আপাতত যেগুলো সংগ্রহ করেছি সেইগুলো দিব। একটু পর পুলিশ আসবে হয়তো। তখন আমরা আরো তথ্য জানতে পারবো”

নীলাঞ্জনা বলল, “কেন?”

সিনিয়র বলল, “সামান্য কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করবে।এই ছাড়া আর কিছু না”

দুপুরে অফিসার রাশেদ অফিসে এলো। নুরুল ইসলাম খানের নিখোঁজ হওয়ার কারণে সামান্য জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য। অফিসার রাশেদ নীলাঞ্জনা কে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় বলল, “তুমি এখন কিছু একটা করো? আমার বিশ্বাস তুমি পারবে। এইভাবে কদিন পর পর মানুষ নিখোঁজ হচ্ছে।এটা খুব চিন্তার বিষয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে”

নীলাঞ্জনা বলল, “সাধারণ মানুষ নিচ্ছে না।যারা নিখোঁজ হচ্ছে তারা অনেক উচু শ্রেনীর মানুষ”

অফিসার রাশেদ বলল, “কাল যে সাধারণ মানুষ নিখোজ হবে না তার কি কোন গ্যারান্টি আছে?”

নীলাঞ্জনা বলল, “আমি তো চেয়েছিলাম আয়ান চৌধুরীর বিষয়ে ডকুমেন্টারি তৈরি করতে কিন্তু নুরুল ইসলাম খান উনি মানা করলো। এখন উনি নিজেই নিখোঁজ।তো আমি এখন কি করবো বলেন?”

অফিসার রাশেদ বলল, “এই বিষয়ে ডকুমেন্টারি তৈরি করো।এই নিয়ে যতটুকু পারো চেষ্টা করো। আমার মনে হয় তুমি নিখোঁজ হবার কারন খুজে বের করতে পারবে”

নীলাঞ্জনা বলল, “নির্বাচন টা শেষ হোক। তারপর আমি এই নিখোঁজ হবার কারন খুজে বের করবো”

সন্ধ্যায় নীলাঞ্জনা বাড়ি ফিরে এলো।বাড়ি ফিরে আসতেই নীলাঞ্জনার বাবা বলল, “এত দেরী করে বাড়ি ফিরে এসেছে কেন?এত রাতে কেউ বাড়ির বাইরে থাকে?”

নীলাঞ্জনা বলল, “আমি তো এর থেকে অনেক রাত করেও বাড়ি ফিরেছি। আমি অফিস শেষ করে তবেই তো বাড়ি ফিরব”

নীলাঞ্জনার বাবা চিন্তিত স্বরে বলল, “ জানোই তো আশেপাশের পরিস্থিতি ভালো না।তাই আমার ভয় হয়”

নীলাঞ্জনা বলল, “ভয় নেই। আমার কিছুই হবে না”

নীলাঞ্জনা সোজা তার রুমে চলে গেল। বিয়ের আগ পর্যন্ত সে ঘর থেকে বেরোলো না। চারদিন নীলাঞ্জনা তার ঘরের মধ্যে থেকেই পার করে দিল।
প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত, তার একটাই চিন্তা।সে এখন তার পছন্দের মানুষ কে বিয়ে করতে যাচ্ছে।যত সময় পার হচ্ছে তত বিয়ের মুহুর্ত এগিয়ে আসছে।

শুক্রবার। চারদিকে হইচই বিরাজ করছে।আজ সেলিমের সাথে নীলাঞ্জনার বিয়ে। নির্বাচনের আগ মুহূর্তে বিয়ে হওয়ার কারণে তাদের বিয়ে খুব বেশি বড় হলো না। কোনরকম ছোট পরিসরে বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ করে নিল। সেলিম অবশ্য নীলাঞ্জনা কে কথা দিয়েছে নির্বাচনের ঝামেলা মিটলে বড় করে বউভাতের অনুষ্ঠান করবে।

একজন কাজী এসে নীলাঞ্জনা আর সেলিমের বিয়ে সম্পন্ন করে। নীলাঞ্জনা যখন কবুল বলে সেই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছিল সে যেন কোনো স্বপ্নের মধ্যে হাঁটছে। একদিকে শৈশব থেকে যত্ন করে গড়া জীবনের পাতা উল্টে যাচ্ছে, অন্যদিকে নতুন একটি অধ্যায়ের শুরু হচ্ছে। ছেলেবেলা থেকে যেখানে নিজের পরিচয় ছিল ‘আমি’, আজ থেকে সেটি ‘আমরা’তে রূপান্তরিত হচ্ছে। নীলাঞ্জনা এখন থেকে সেলিম রহমানের স্ত্রী।

সেলিম তার গাড়িতে করে নীলাঞ্জনা কে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। সরোয়ার গাড়ি চালাচ্ছে। সামনের সিটে সেলিমের বাবা বসে আছে। পিছনের সিটে সেলিম আর নীলাঞ্জনা বসে আছে। নীলাঞ্জনা মাথা নিচু করে বসে রইল। সেলিম মুখে রুমাল দিয়ে বসে আছে।তার চোখ দেখে মনে হচ্ছে সে বেশ খুশি।

বাড়ির সামনে গাড়ি এসে দাঁড়াল। সেলিম নীলাঞ্জনাকে কোলে নিয়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল। নীলাঞ্জনাকে সেলিমের রুমে বসতে দেওয়া হলো। সেলিম বলল, “অনেক গরম। এসব ভারী শাড়ি পরে থাকার দরকার নেই। সুতির শাড়ি পরে নাও।”

নীলাঞ্জনা বলল, “সেসব পরে হবে, কিন্তু আগে তুমি মোবাইল দাও।”

সেলিম জিজ্ঞেস করল, “কেন?”

নীলাঞ্জনা বলল, “ম্যারেড স্ট্যাটাস দিব। তুমি কি আজীবন সিঙ্গেল থাকতে চাও?”

সেলিম বলল, “মোটেও না। আমি তো বিবাহিত। সিঙ্গেল থাকতে যাব কেন?”

নীলাঞ্জনা বলল, “তাহলে মোবাইল দাও। আমি ম্যারেড স্ট্যাটাস দিব”

সেলিম হেসে বলল, “নেও মোবাইল।যা খুশি করো”

নীলাঞ্জনা বলল, “তা তো করবোই। এখন সবকিছুর উপর আমার অধিকার থাকবে। এমনকি আমার পছন্দের শার্ট পড়তে হবে। আমার পছন্দের পাঞ্জাবি পরতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি”

সেলিম বলল, “বুঝতে পারছি।সব তোমার ইচ্ছে মতো হবে”

নীলাঞ্জনা বলল, “মনে থাকে যেন।”

সেলিম আর কোন কথা বলল না। সোজা তার মায়ের সাথে দেখা করার জন্য চলে গেল। নীলাঞ্জনা সেলিমের মোবাইল হাতে নিয়ে আগে আগে মেসেঞ্জারে গেল। ম্যাসেঞ্জারে গিয়ে মনে মনে বলল বজ্জাত লোকের আইডি ভর্তি মেয়ে। সবগুলো ইনবক্সে মেসেজ দিয়ে রাখছে। যাইহোক একদিকে তো ভালোই হলো । আমার বজ্জাত জামাই কার মেসেজ দেখে না।খালি ফেসবুকের পাসওয়ার্ড নেই। সবগুলো মেয়েকে আনফ্রেন্ড করে দিব।

নীলাঞ্জনা মেসেঞ্জার থেকে বের হয়ে ফেসবুকে প্রবেশ করলো। রিলেশনশিপে গিয়ে ম্যারিড করে দিল।সাথে তার নিজের আইডি ট্যাগ করে দিল। প্রোফাইল পিকচারে তাদের বিয়ের ছবি দিয়ে ডাটা অফ করে দিল।

বৃষ্টি মুখর রাত পেরিয়ে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। বৃষ্টির অবিরাম স্রোতধারা থেমে গেছে সেই মাঝরাতেই।ভোর সকাল থেকে আবার অল্প অল্প বৃষ্টি পড়তে শুরু করে দিয়েছে।

ভোর ছয়টা । নীলাঞ্জনার ঘুম ভেঙ্গে যায়। বিবাহিত জীবনে নীলাঞ্জনার আজ প্রথম রাত। বারান্দায় এক চিলতে রোদ উঠেছে। সেলিম তখনো ও ঘুমোচ্ছে। নীলাঞ্জনা বারান্দায় গিয়ে দাড়ায়। সারারাত বৃষ্টি হওয়ায় ভেজা মাটির গন্ধ আসছে সেই সাথে বারান্দার সাথে ঘেঁষে জন্মানো কদম ফুলের গন্ধ । হঠাৎ সেলিম তার পাশে এসে দাঁড়াল। নীলাঞ্জনা পেছনে ফিরে তাকাল না। সেলিম বলল, “তুমি তো সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে পারো। এখন থেকে তোমার হাতেই সকালের চা খাওয়া যাবে”

নীলাঞ্জনা বলল, “আমি সকালেই ঘুম থেকে উঠি। কারন আমার সকাল সকাল অফিসে যেতে হয়”

সেলিম বলল, “গুড গার্ল।যাও ফ্রেশ হয়ে এক কাপ কফি বানিয়ে আনো।”

নীলাঞ্জনা সেলিমের দিকে তাকিয়ে বলল, “বাহ ! তুমি একাই কফি খাবে নাকি ?”

সেলিম বলল, “তোমার আমার দুইজনের জন্যই।আমরা দুজনেই কফি খাব”

নীলাঞ্জনা হেসে বলল, “তুমি বসো। আমি কফি বানিয়ে আনছি”

সেলিম বারান্দায় রাখা দোলনায় গিয়ে বসে পড়লো। বাইরে অল্প অল্প রোদ মেঘের মধ্য দিয়ে উঁকি ঝুঁকি মারছে।

একটু পরে নীলাঞ্জনা দুটো কফি হাতে বারান্দায় আসে।এক কাপ সেলিমের হাতে দিয়ে হাতে দিয়ে আরেকটা নিজের কাছে রাখলো। সেলিম কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “বাহ ! কফি তো ভালোই বানাও। এখন থেকে এটাই তোমার প্রতিদিনের রুটিন। প্রতিদিন সকালে আমার জন্য কফি বানাতে হবে। আমার প্রতিদিন ঘুম ভাঙবে তোমার হাতে কফি খেয়ে”

নীলাঞ্জনা হেসে বলল, “ঠিক আছে জনাব”

(চলবে)