#বুঝে_নাও_ভালোবাসি।
#ফাহমিদা_তানিশা
পর্ব ০৩
আশরাফ চৌধুরী পকেট থেকে ফোনটা বের করে কাকে যেন ফোন করলেন। শান্ত কন্ঠে বললেন: তুমি কোথায়? তোমার সাথে কথা আছে। আরওয়াদের বাসায় আসো।
ইনগেজমেন্টের পুরো আয়োজন আরওয়াদের বাড়িতে হওয়ায় রিদুয়ান মোস্তফার ফ্যামিলি, আত্নীয়-স্বজন সবাই এসেছিল। রিদুয়ান মোস্তফা চলে যাওয়ায় তারা সবাই আরওয়াদের বাড়ি থেকে যার যার মতো করে চলে গেলো। এখন শুধু কনেপক্ষের মেহমানেরা আছে।আরওয়ার বাবা-মা দুজনেই তখন থেকে এক জায়গায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছেন।তারা মহা বিপদে আছেন বলা চলে।মেয়ের বিয়েটা দিলেও সমস্যা হতো পরে গিয়ে আর এখন ভেঙে দেওয়াতেও সমস্যা হচ্ছে।
সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।বোনের পাশে আশরাফ চৌধুরী কপাল কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছেন।আর এক কোণে আরওয়া দাঁড়িয়ে আছে।তার চোখে জল। এই বিয়ে নিয়ে তো তার কোনো আগ্রহ ছিল না। তাহলে চোখে জল আসছে কেন?সে বুঝতে পারছে না। হয়তো তার বোন মারওয়ার কথা ভেবেই চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে।তার বিয়েটা না হওয়ায় মারওয়াও আটকে গেলো।
মিনিট দশেকের মাথায় বিদ্যুৎ গতিতে কেউ রুমে ঢুকলো।আরওয়া মাথা তুলে সেদিকে তাকাতেই একটু চমকালো। নির্ঝর এসেছে।আরওয়া তাকে খুব ভালো করে পর্যবেক্ষণ করছে।বাম হাতের অনেকটা অংশ জুড়ে ব্যান্ডেজ লাগানো। চোখ দুটো ফুলে আছে। হয়তো গতকাল থেকে ঘুমাইনি সে। কপালের এক পাশে ব্যান্ডেজ। একেবারে নাজেহাল অবস্থা তার।আরওয়া তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেও সে কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। শান্ত কন্ঠে বললো: আমাকে ডেকেছেন? কোনো সমস্যা?
_হুম সমস্যা তো অনেক। এখন এতো কিছু বলতে চাই না। শুধু বলতে চাই তোমার একটা কাজ করতে হবে।
বাবার কথায় নির্ঝর ভ্রু কুঁচকে তাকালো। আবারো শান্ত কন্ঠে বললো:কি করতে হবে বলুন?
_তোমাকে বিয়ে করতে হবে।
আশরাফ চৌধুরীর কথা শুনে আরওয়া ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। চোখ বড় বড় করে নির্ঝরের দিকে তাকালো। কিন্তু নির্ঝরের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।যেন সে আগে থেকেই জানে তার বাবা কি বলবেন। একটু থেমে নির্ঝর ছোট গলায় বললো: ওকে।
আশরাফ চৌধুরী বেশ অবাক হলেন ছেলের এমন প্রতিক্রিয়া দেখে। তিনি মনে মনে বেশ ভয়ে ছিলেন ছেলেকে রাজি করাতে পারবেন কিনা ভেবে।যে ছেলেটাকে এতো দিন এতো চেষ্টা করে বিয়ের নামটাও মুখে উচ্চারণ করাতে পারেনি কেউ,আজ সে ছেলেটা এককথায় “ওকে” বলছে।সে একবার জানতেও চায়নি কাকে বিয়ে করবো?বা হুট করে এমন কথা কেন?
আরওয়ার মা আশরাফ চৌধুরীকে থামিয়ে দিয়ে বললেন: ভাইয়া,এসব কি বলছো? আমার মেয়েটার কপাল খারাপ। সেই দায়টা কেন নির্ঝরের ঘাড়ে চাপাচ্ছো?ওর তো কোনো দোষ নেই।থাক কপালে যা যা আছে তাই হবে। নির্ঝরের তো পছন্দের কেউ থাকতে পারে। এভাবে ওকে জোর-জবরদস্তি করার কোনো প্রয়োজন নেই।
বোনের কথা শুনে আশরাফ চৌধুরী রাগী গলায় বললেন: তুই কম কথা বল।আমি কখন ওকে জোর-জবরদস্তি করলাম?এসব নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। তুই তোর মতো আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত থাক।
এবার আকরামুল হক বললেন:ভাই,বললেই হলো?ভাবির সাথে কথা বললেন না?বাড়ির অন্য সদস্যদের সাথে কথা বললেন না?এভাবে একক মতামতে এতো বড়ো একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া বোকামি।
_বোকামি হলে বোকামি। তবু আমি একাই সিদ্ধান্ত নিবো। নির্ঝর তুমি এখন যাও। আরওয়া আর রাশেদের কাবিনের কোনো ডকুমেন্ট রাখবে না।
নির্ঝর কিছু না বলে হনহন করে বেরিয়ে গেলো।আরওয়া বোকার মতো তাকিয়ে আছে সেদিকে। আশরাফ চৌধুরী আকরামুল হককে বললেন:চলো চলো, অনেক কাজ বাকি আছে। আমি চাইনা আর কোনো সমস্যা হোক।
আবার আরওয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন:মা, রুমে গিয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে নে।এমনেও অনেকটা দূবল হয়ে আছিস।
মামার কথামতো আরওয়া রুমে চলে গেলো। আজকে নিজেকে তার খেলনা পুতুল মনে হচ্ছে।যার যেভাবে খুশি সেভাবে খেলবে তাকে নিয়ে। ইচ্ছে করছে মাকে গিয়ে বলতে,”নির্ঝর ভাইয়ের সাথে আমার যায় না। আমি উনাকে বিয়ে চাই না।”কিন্তু মনের কথাটা ভয়ে সে মুখে আনতে পারছে না। মাকে এখন বলতে চাইলে তিনি বলবেন “এতো কলঙ্ক নিয়ে কোথায় যাবি?নির্ঝর তোকে দয়া দেখিয়ে বিয়ে করবে বলছে এটাই অনেক কিছু।”তখন তার মুখটা কোথায় থাকবে?তাই চুপ থাকাটা বেটার। রুমে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়লো। শুয়ে শুয়ে সে গতকালের কথাগুলো ভাবছে।
গতকাল রাতে…..
গতকাল রাতে আরওয়া আর তার বান্ধবী নিশা শপিং করতে গিয়েছিল। কেনাকাটা করে ফেরার পথে আরওয়া নিশাকে নামিয়ে দিয়ে তাদের গলির কাছাকাছি আসতেই চার-পাঁচজন তার রিকশাটা থামিয়ে দেয়। মুখে মাস্ক থাকায় সে কাউকে চিনতেও পারেনি।একজন খুব ভদ্র ভাষায় বলে:আপু, আপনার আমাদের সাথে যেতে হবে। রিকশা থেকে নামুন।
ছেলেটার কথা শুনে আরওয়া জিজ্ঞেস করে:কে আপনি? আপনার সাথে কেন আমি যাবো?
_আমি কে তা বলা যাবে না। তবে আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে।
_আমি যাবো না। আমি তো আপনাদের চিনি না।
_তাহলে জোর-জবরদস্তি করে নিয়ে যেতে হবে। আপনি কি তা চাইছেন?
_আপনাদের তো আমি চিনি না। শুধু শুধু আমার পেছনে পড়ে আছেন কেন?
_এতো কথা বলতে হবে না। আসলেই মেয়ে মানুষকে কথা বলার সুযোগ দেওয়াটাই বোকামি।এই ওরে ধর।আর একটাও কথা বলার সুযোগ দিবি না।
একজন আরওয়ার মাথায় বন্দুক তাক করলে সে ভয়ে চুপসে যায়।আর কোনো কথা বলবে সেই সাহসটুকু এখন সে পাচ্ছে না।দুজন তাকে জোর করে ধরে একটা গাড়িতে তুললো। তারপর চোখগুলো বেঁধে ফেললো।আর আরওয়া ভয়ে বরফের মতো জমে আছে। চোখ বন্ধ অবস্থায় তাকে কোথায় নিয়ে গেছে ছেলেগুলো সে জানে না।
ঘণ্টাখানেক গাড়ি চলার পর থামলো কোনো এক গন্তব্যে। চোখ বন্ধ অবস্থায় সে অনুমান করেছিল তার পাশে কোনো এক মেয়ে আছে। মেয়েটা তাকে ধরে কোনো এক জায়গায় নিয়ে গিয়ে বেঁধে রাখলো।মুখ, চোখ, হাত-পা সব বাধা অবস্থায় সে কতোক্ষণ ছিল জানে না। বিপদের মূহুর্তে সময়টাও ফুরায় না।তাই আরওয়া জানে না সে কতোক্ষণ ছিল সেখানে। মনে হয়েছিল অনেক হাজার বছর সে এই ঘরে আটকে আছে। বসে থাকতে থাকতে সে বাঁধা অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়ে।
আকস্মিক প্রকট আওয়াজে আরওয়ার ঘুম ভাঙে। কিন্তু চোখ দুটো কাপড় দিয়ে বাঁধা থাকায় সে বুঝতে পারে না কিসের এতো আওয়াজ। অনুমান করতে পারছিল ভাঙচুর হচ্ছে। খানিকক্ষণ পর কেউ এসে তার হাতগুলো খুলে দেয়।তখনি সে দ্রুত চোখের কাপড়টা খুলে বেশ অবাক হয়। নির্ঝর তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।তার হাত থেকে ভীষণ রক্ত পড়ছে। কপালের একটা অংশ থেকেও রক্ত পড়ছে। চারপাশে তাকাতেই বুঝতে পারলো এতোক্ষণ এখানে মারামারি চলছিল।তাকে যে ছেলেগুলো আটকে রেখেছে তারা মাটিতে পড়ে আছে।তাদের অবস্থা বেশ জঘন্য। পুলিশের লোকেরা ছেলেগুলোকে এই অবস্থাতেই ধরে নিয়ে গেলো। নির্ঝর আরওয়ার সাথে কোনো কথা না বলে পুলিশদের সাথে বেরিয়ে গেলো।আরওয়ার সাথে কোনো কথা বললো না।সে বেরিয়ে গিয়ে একজন মহিলা পুলিশকে পাঠালো আরওয়াকে।সে এসে বললো: ম্যাম, স্যার বলেছেন আপনাকে স্যারের গাড়িতে উঠতে।
মেয়েটির কথা মতো আরওয়ার এসে নির্ঝরের গাড়িতে উঠলো।তখনও নির্ঝর একবার জিজ্ঞেস করেনি তুমি কি ঠিক আছো? ছেলেগুলো কারা ছিল? বা একবারের জন্য সান্ত্বনা দিয়ে বললো না ভয় পেয়ো না আমি আছি।পুরো পথটা জুড়ে দুজনেই চুপচাপ। নির্ঝরের হাত থেকে রক্ত পড়ছে তখনো।আরওয়ার বেশ ইচ্ছে করছে হাতটা ব্যান্ডেজ করে দিতে। কিন্তু সেই সাহস বা অধিকার তার নেই। ইচ্ছে করছে একবার বলতে, গাড়িটা থামিয়ে কোনো হাসপাতালে গিয়ে ব্যান্ডেজ করে আসুন। কিন্তু সে চায় না নির্ঝরের সাথে কোনো কথা বলতে। একটু পর নির্ঝর নিজেই গাড়ি থামালো।গাড়ি থেকে কোনো কথা না বলে একা একা নেমে গেলো। মিনিট দশেক পর ফিরে আসলো একটা কেকের প্যাকেজ আর জুস নিয়ে।আরওয়াকে কিছু না বলে প্যাকেটটা পাশে রেখে সে আবারো গাড়ি ড্রাইভ করতে শুরু করলো। আরওয়া জানে খাবারগুলো তার জন্য এনেছে। কিন্তু নির্ঝর একবার খেতেও বললো না।আরওয়া জানে সে খেতে বলবেও না। আবার না খেলেও তেজ দেখাবে।তাই সে নিজ থেকে প্যাকেটটা নিয়ে খেয়ে নিলো।
আরওয়াদের বাড়ির গেইটে এসে নির্ঝর গাড়ি থামালো।একবার নামতেও বললো না সে।আরওয়া একবার নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে নিজ থেকেই নেমে গেলো।আর আরওয়া নামতেই নির্ঝর আবার গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেলো।
আরওয়া বাসায় আসার পর থেকে তাকে নানা জন নানা কথা বলছে।কেউ বলছে মেয়ে পালিয়ে গেছে,কেউ বলছে কার সাথে গেছিস?এসব প্রশ্ন শুনতে শুনতে সে ভুলেই যাচ্ছে তার কি বলা উচিত। তখন থেকে কতো কি ঘটে গেল আরওয়া তা জানে না।সব তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। নির্ঝরের কথা ভাবতেই আরওয়ার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। নির্ঝরকে বিয়ে করাটা কি যৌক্তিক হবে? নাকি আবারো তাকে ভালোবাসার মায়ায় পুড়তে হবে? আবারো সব লাঞ্ছনা সহ্য করতে হবে? বুঝতে পারছে না আরওয়া।
চলবে….