#বুঝে_নাও_ভালোবাসি।
#ফাহমিদা_তানিশা
পর্ব ১১
নির্ঝর শান্ত কন্ঠে বললো:তোর সাথে আর কে কে ছিল এই প্ল্যানে?
_আমার প্ল্যানে আমি অন্য কাউকে রাখবো কেনো?আমি একাই সব করতে পারি।আমি একাই সাকসেসফুল হতে পারি।
_আমার আম্মু নেই তো তোর সাথে?
মিতা খুব জোরে জোরে হাসলো। তারপর বললো: তোমার মায়ের নামটা আমার সামনে আনবেও না।তার জন্য আমার এমন একটা কাজ করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। আমি তোমাকে এতো ভালোবাসি সেটা তোমার মা খুব ভালো করে জানে।তবু সে আরওয়াকে মেনে নিয়েছে। তোমার মা যদি তোমাদের বিয়েটা না মানতো তখন তুমিও আরওয়াকে মেনে নিতে না। তোমার মা আরওয়াকে মেনে নিয়েছে বলেই তুমিও মেনে নিয়েছো। তাহলে সব দোষ তোমার মায়ের।আসলেই আমি একটা বড় ভুল করেছি। তোমার মাকেই মেরে ফেলা উচিত ছিল। তিনিই তো আমার বড় শত্রু।
মিতার মুখে তার মাকে নিয়ে এমন কথাগুলো শুনে নির্ঝর আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলো না। মিতার গালে কষিয়ে একটা চড় বসিয়ে দিলো সে।মিতা চড়টা খেয়ে ছিটকে গিয়ে পড়লো একটু দূরে। মিতার মা নির্ঝরকে থামালো। জোর গলায় বললো: তুমি আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমার মেয়েকে মারছো? তোমার এতো সাহস?
_আমার সাহসের আপনি দেখেছেন কি?আমি চাইলে এখন আপনাকেও মেরে দিতে পারি।যেই মা মেয়েকে এতটুকু শিক্ষা দিতে পারেনি সেই মাকে সম্মান দেওয়াটাও ভুল।
_যথেষ্ট বেয়াদব হয়েছো তুমি। তোমাকে আগে শিক্ষা দেওয়া উচিত। তারপর আমার মেয়েকে শিক্ষা দিবো।
খালার কথায় নির্ঝর তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো: আপনি এই নির্ঝর চৌধুরীকে শিক্ষা দিবেন? আগে দেখেন আমি আপনার মেয়ের কি করি।জাস্ট ওয়েট।
নির্ঝর মিতাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। একবার বাবার সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে মিতার বিষয়ে। তারপর মিতাকে সাইজ করতে হবে।গাড়ি চালাচ্ছে নির্ঝর আর মনে মনে মিতার কথাগুলো ভাবছে।মিতার কথাগুলো শুনে নির্ঝর বুঝতে পারলো তার মা এসবে নেই। সে শুধু শুধু তার মাকে ভুল বুঝলো।কি বোকার মতো একটা কাজ করলো সে। আগে কি একবার মায়ের কাছে যাবে ?মাকে সরি বলতে হবে। আবার ভাবলো, আগে সমস্যা সমাধান করবে তারপর মায়ের কাছে যাবে।ভাবনা অনুযায়ী তার বাবাকে ফোন দিলো নির্ঝর। কয়েকটা রিং হতেই তিনি ফোন রিসিভ করলেন। শান্ত গলায় বললেন:কি হয়েছে নির্ঝর?
_আপনি কোথায়? আপনার সাথে কিছু কথা ছিল।
_আমি বাসায় আছি। তুমি কোথায়? সরাসরি বলতে হবে?
_আচ্ছা আমি বাসায় যাচ্ছি।জাস্ট পাঁচ মিনিট।
_ওকে।
নির্ঝর ফোন কেটে দিয়ে গাড়ি দ্রুত চালিয়ে নিজের বাড়িতে গেলো।
আশরাফ চৌধুরী তার রুমে আছেন। নির্ঝর বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই তার বাবা জিজ্ঞেস করলো:কি বলতে চেয়েছিলে?
_আসলে আমি ভুল ভেবেছিলাম।আরওয়াকে আম্মু মারতে চায়নি। মিতা করেছে সব।
_কি করে জানলে এখন?
_আমি সেদিন সিসি ক্যামেরায় মিতাকে দেখেছি। তখন মনে করেছিলাম আম্মু মিতাকে দিয়ে কাজটি করিয়েছে। আজকে মিতার কাছ থেকে জিজ্ঞেস করার জন্য তাদের বাড়ি গেলাম।মিতা বললো সে করেছে সব।
আশরাফ চৌধুরী ছেলের দিকে তাকালেন। গম্ভীর গলায় বললেন:মিতাকে সিসি ক্যামেরায় দেখার পরেও তুমি হাসপাতালে সবার সামনে তোমার মায়ের দোষ দিয়েছিলে কেনো?
_তখন জানতাম না আম্মু এসব প্ল্যানে ছিলেন না সেটা।
_না জেনে আরওয়ার বাবা-মায়ের সামনে তোমার মাকে দোষারোপ করলে।তারা যদি কিছু বলতো তোমার মাকে তখন কি হতো? ভাগ্য ভালো তারা তোমার কথা বিশ্বাস করেননি। এভাবে না জেনে না শুনে অন্যদের দোষারোপ দেওয়ার প্রশ্নই হয় না।তার উপর নিজের মাকে দোষারোপ করছে। কেমন ছেলে আমার।
নির্ঝর মাথা নিচু করে আছে। আসলেই সে বড়ো ভুল করেছে। কিন্তু ভুল হওয়াটাই স্বাভাবিক।তার মায়ের কারণেই তো সে মাকে ভুল বুঝেছে। বলা যায়,এতে তার দোষ নেই।
আশরাফ চৌধুরী গম্ভীর গলায় বললেন: তুমি নাকি তোমার মায়ের সাথে এখন কথাও বলো না। এক্ষুনি তোমার মায়ের কাছ থেকে ক্ষমা চাইবে।
নির্ঝর তার বাবার কথামতো মাকে খুঁজতে গেলো।তার মা রান্নাঘরে আছেন। নির্ঝরের পেছন পেছন আশরাফ চৌধুরীও গেলেন ছেলেকে পর্যবেক্ষণ করতে। আশরাফ চৌধুরী পেছন থেকে মিসেস রুমানাকে বললেন: নির্ঝর তার ভুল বুঝতে পেরেছে। তোমাকে সরি বলতে এসেছে।
মিসেস রুমানা একবার ছেলের দিকে তাকালেন। মুচকি হেসে বললেন:ওর আমার কাছ থেকে ক্ষমা চাইতে হবে না। আমি দোষ করেছি তাই ও সত্যিটা বলেছে। আমি চাই আমার সন্তান এরকম স্পষ্টভাষী হোক।
আশরাফ চৌধুরী স্ত্রীর কথায় অবাক হলেন। শুধু আশরাফ চৌধুরী নয় রান্নাঘরে থাকা প্রতিটা মানুষ মিসেস রুমানার কথায় অবাক হলেন। তিনি আবার কোন দোষ করলেন। মিসেস রুমানা ধীর পায়ে নির্ঝরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। নির্ঝর চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো অনুশোচনা বা ঘৃণা তাকে জর্জরিত করছে। মিসেস রুমানা শান্ত গলায় বললেন: আমার বাকি দুটো ছেলে আর ওর মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। নির্ঝর কখনো আমার কথার বিরুদ্ধে যায়নি, আমার কথার অবাধ্য হয়নি।
কিন্তু আমি ওর অনেক ক্ষতি করেছি।
মিসেস রুমানা নির্ঝরের মুখে হাত রেখে বললেন: জানিস বাবা, আমি তোর ভালোর জন্য করেছিলাম।তোর ক্ষতি হোক বা তোর কোনো শত্রু হোক তা আমি চাইনি।তাই এমনটা করেছি।ক্ষমা তো আমার চাওয়া উচিত তোর কাছ থেকে,আরওয়ার কাছ থেকে।
আশরাফ চৌধুরী স্ত্রীর প্রতিটা কথায় অবাক হচ্ছেন।সব কথা তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ভ্রু কুঁচকে বললেন: রুমানা, তোমাদের মা-ছেলের কোনো কথা আমি বুঝতে পারছি না। প্লিজ আমাকে বুঝিয়ে বলো।
মিসেস রুমানা মেকি হাসি দিয়ে বললেন:সত্যিটা জানলে তুমিও তোমার ছেলের মতো আমাকে ঘৃণা করবে। কিন্তু আমার আর কোনো উপায় ছিল না। আমার মাথায় তখন শুধু একটাই বুদ্ধি ছিল আর আমি সেই বুদ্ধি অনুযায়ী কাজ করেছি।
আশরাফ চৌধুরী এবার রেগে গেলেন। রাগী গলায় বললেন: আমার বাড়িতে সবাই কি পুলিশের ট্রেনিং নিয়ে এসেছো?এতো ঘুরানো-প্যাঁচানো কথা বললে বুঝবো কি করে?
মিসেস রুমানা অপরাধী গলায় বললেন:আরওয়ার কিডন্যাপ আমি করিয়েছিলাম যাতে ওর বিয়েটা ভেঙে যায়।তাই নির্ঝর বিষয়টা জানার পর থেকে আমাকে ঘৃণা করে।
আশরাফ চৌধুরী যেন আকাশ থেকে পড়লেন।এসব কি করলো তার স্ত্রী?কেনোই বা করলো?তার বোন বা বাবা যদি এসব কথা জানতে পারে তাহলে কি অবস্থা হবে? বুঝতে পারছেন না আশরাফ চৌধুরী।
রাগী গলায় বললেন:আরওয়ার সাথে তোমার কিসের শত্রুতামি?এতো জঘন্য একটা কাজ করলে কেনো?
মিসেস রুমানার চোখে জল গড়িয়ে পড়ছে।কান্না জড়িত কন্ঠে বললেন: বাধ্য হয়ে করেছি যাতে ওর বিয়েটা ভেঙে যায় আর নির্ঝরের সাথে আরওয়ার বিয়ে হয়।
আশরাফ চৌধুরী অবাক হয়ে বললেন: তুমি হঠাৎ নির্ঝরের সাথে আরওয়ার বিয়ে হওয়ার জন্য এতো হাইপার হতে গেলে কেনো?এতোই যদি আরওয়াকে ঘরের বউ করার ইচ্ছা থাকতো তাহলে আগে বলতে।আমি আকরামের সাথে কথা বলে বিয়ে ঠিক করতাম।
_তখন তো এতো কিছু বুঝিনি। বুঝলাম তো রাশেদের সাথে আরওয়ার বিয়ে ঠিক হওয়ার পর।
আশরাফ চৌধুরীর মেজাজ বেশ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তিনি অনেক কষ্টে নিজেকে কন্ট্রোল করছেন। বারবার জিজ্ঞেস করার পরেও তার স্ত্রী তার সাথে লুকোচুরি খেলছে মতো করছে না কিছুতেই সত্যি কথা বলছে না। রাগী গলায় বললেন: বুঝতে পারছি না।খুলে বলো।
মিসেস রুমানা থামলেন। শান্ত গলায় বললেন: আরওয়া তখন ক্লাস টেনে আর নির্ঝর আর্মির ট্রেনিং এ।দুজনের অল্প বয়স।এই বয়সে তো মানুষ কতো কি ভুল করে। তারা দুজনেও একে অপরের প্রেমে পড়ে যায়। দুজনেই রিলেশনে জড়িয়ে পড়ে।আর এদিকে মিরাজ আরওয়াকে পছন্দ করতো।এটা নিয়ে নির্ঝর আর মিরাজ রোজ ঝগড়া করতো, রাস্তাঘাটে মারামারি করতো। একদিন মিরাজ আমাকে এসে বলে নির্ঝর আর আরওয়ার প্রেমের বিষয়টা। তখন আমি নির্ঝর থেকে জিজ্ঞেস করলে সে বলে মিরাজ সত্যি বলেছে। নির্ঝরের মুখে বিষয়টা সত্যি জানতে পারার পর আমার ভয় হয়। মিরাজ যদি রাগে ক্ষোভে নির্ঝরের ক্ষতি করে।তাই নির্ঝরকে রিকোয়েস্ট করি এই সম্পর্ক থেকে বের হওয়ার জন্য। ভেবেছিলাম, এই বয়সে আবেগ কাজ করে।বয়স হতে হতে সব ভুলে যাবে।তাই আগে আগে দুজন দুজনকে ভুলে যাক। আমার কথামতো নির্ঝর আরওয়ার সাথে ব্রেকআপ করলো। নিজেকে সবকিছু থেকে আড়াল করে নিলো।এমনভাবে থাকলো যেন সে আরওয়াকে ভুলে গেছে। আমিও ধরে নিয়েছিলাম ও আরওয়াকে ভুলে গেছে। কিন্তু যখন আরওয়ার বিয়ে ঠিক হলো তখন থেকে নির্ঝর অন্যরকম আচরণ করছিল।তখনই আমি বুঝতে পারলাম সে আরওয়াকে ভুলতে পারেনি।আমার কথা রাখতে দূরে থাকার চেষ্টা করছে।
আশরাফ চৌধুরী স্ত্রীর কথাগুলো শুনে পুরো অবাক। এজন্যই নির্ঝর সাথে সাথে বিয়েতে রাজি হয়ে গেলে। আশরাফ চৌধুরী মনে মনে হাসলেন। বাহ্!তার ছেলেকে তিনি প্রেম-পিরিতিতে ইনোসেন্ট মনে করতেন। কিন্তু এই ছেলে তলায় তলায় প্রেম করে ছ্যাঁকা খেয়ে উপুড় হয়ে আছে কে জানতো? আশরাফ চৌধুরী ছেলের দিকে একবার তাকালেন।সে এখনো মাথা নিচু করে আছে।রুমানা বেগম অর্ধেকটা বলে থামলেন।এতো কথা বললেন যে গলার পানি শুকিয়ে গেছে।তাই এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলেন। তারপর বলা শুরু করলেন
চলবে…