বুঝে নাও ভালোবাসি পর্ব-১৩

0
139

#বুঝে_নাও_ভালোবাসি।
#ফাহমিদা_তানিশা

পর্ব ১৩

নির্ঝর ঘুমের ঘোরে আর‌ওয়ার ঘাড়ে নিজের মাথাটা রেখে শুয়ে পড়লো। নির্ঝর শুতেই আর‌ওয়ার ঘুম ভেঙে গেলো। সে চোখ খুলতেই দেখলো নির্ঝর তার পাশে। নির্ঝর শান্তিমতো ঘুমাচ্ছে।আর‌ওয়াও যেহেতু বিছানা থেকে উঠতে পারছে না, হাঁটতেও পারছে না তাই সেও শুয়ে থাকলো।

নির্ঝরের ঘুম ভাঙলো প্রায় ঘন্টা দুয়েক পর। চোখ খুলতেই আর‌ওয়ার সাথে চোখাচোখি হলো তার। চোখ পড়তেই আর‌ওয়া অন্যদিকে তাকালো। নির্ঝর একপলক আর‌ওয়ার দিকে তাকিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো। আর‌ওয়া এখনো অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। নির্ঝর ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।আর‌ওয়া সেদিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে ভাবছে, নির্ঝর একবার জিজ্ঞাসাও করলো না তার কেমন লাগছে? ভাবতেই চোখ ছলছল করছে।

একটু পর রিস্তা আসলো আর‌ওয়ার কাছে।আর‌ওয়া রিস্তাকে দেখে বিছানা থেকে উঠে বসলো।রিস্তা হেসে বললো:ঘুম হয়েছে দুজনের?
আর‌ওয়া শুধু জবাব দিলো: হ্যাঁ।
দুজনেই গল্প করতে করতে প্রায় সন্ধ্যা গড়িয়ে পড়েছে।নিশু তখন আসলো আর‌ওয়ার জন্য নাস্তা নিয়ে।নিশুর সাথে আর‌ওয়ার সম্পর্ক বেশ গভীর না হলেও দুজনেই মুটামুটি ভালোই মিশে। কিন্তু নির্ঝরের ছোট ভাইয়ের ব‌উ রশ্মি একটু অন্যরকম।সে মিশবে তো দূরের কথা কথা না বলেই উল্টো এড়িয়ে যায় আর‌ওয়াকে। কারণটা ঠিক কি সেটা আর‌ওয়া বুঝতে পারে না।রশ্মি যেহেতু কথা বলতে চায় না তাহলে আর‌ওয়া কেনো আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যাবে?তাই আর‌ওয়াও চুপ।

এদিকে নির্জর থানায় এসেছে মুনিরকে সিসি ক্যামেরার ফুটেজটা দিতে।ধীর পায়ে মুনিরের রুমে গেলো সে।মুনির নির্ঝরকে দেখে উঠে দাঁড়ালো। হ্যান্ডশেক করে দুজনেই সামনা-সামনি বসলো। নির্ঝর শান্ত কন্ঠে বললো:আসলে তুই বলেছিলি আম্মু-আব্বুকে বলে মিতার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে। কিন্তু আমি চাই না এই বিষয়ে আর আম্মু-আব্বুর সাথে কথা বলি।
_কেনো?
_কারণ আম্মু কখনো চাইবে না আমি মিতার এগেইনস্টে মামলা করি।কারণ এতে দুই বোনের মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট হবে আর মিতার বদনাম হবে। শুধু আম্মু নয়, কোনো খালা হয়তো এটা চাইবে না।কিন্তু আমি চাই মিতার শাস্তি হোক।এমন জঘন্য কাজ করতে পারে যারা তাদের শাস্তি হ‌ওয়া উচিত।
_তো কি করবি এখন?
_দেখ আম্মুর সাথে যদি এই বিষয়ে আলাপ করতে যাই, তাহলে আম্মু আমাকে বলবে মিতাকে ক্ষমি করে দিতে আর আমি আম্মুর কথা রাখতে পারবো না। তখন আম্মু কষ্ট পাবে।আমি তাই যা করবো একেবারে করতে চাই।
_তার মানে দাঁড়ালো তুই এখন মিতার বিরুদ্ধে মামলা করতে চাস?
_হুম এখনি করবো।আর সবকিছু জানাজানি হ‌ওয়ার আগে তুই মিতাকে গ্রেফতার করবি।
_ওকে ঠিক আছে। তুই মামলা করে নে।বাকিটা আমি দেখছি।

নির্ঝর মিতার বিরুদ্ধে মামলা করে ভদ্র ছেলের তো সোজা বাসায় চলে আসলো। অপরাধের শাস্তি অপরাধী পাবে তাতে তার কোনো কষ্ট নেই।মনে মনে সে আরো খুশি।এই মিতার জন্য আর‌ওয়া কতো কষ্ট পেয়েছে।মিতাকে তো বোঝাতে হবে সে কার পেছনে পড়েছে।কতো সাহস মিতার! নির্ঝর ভালোবাসাকে কষ্ট দিবে না। নির্ঝর এসব ভেবে মুচকি হাসে।

বাসায় এসে রুমে যেতেই দেখলো আর‌ওয়া, রিস্তা আর নিশু আছে রুমে। তিনজনেই একসাথে গল্প করছে। নির্ঝরকে দেখে নিশু রুম থেকে উঠে যাচ্ছিল তখন নির্ঝর থামালো তাকে। শান্ত গলায় বললো:ভাবি আপনি থাকেন। আমি বরং অন্য রুমে যাচ্ছি।
নিশু হেসে বললো: তুমি ছিলে না তাই এলাম।ভাবছি আর‌ওয়ার একা একা বোরিং লাগবে। তুমিও নেই। বেচারি একা একা কি করবে?তাই এসেছিলাম।এখনো তো তুমি চলে এসেছো। তাহলে আমরা চলে যায়।
রিস্তাও নিশুর সাথে তাল মিলালো। খিলখিলিয়ে হেসে বললো: ঠিক বলেছো ভাবি। ওদের একটু একলা ছাড়া উচিত।

এই বলে দুজনেই হাসলো। আর‌ওয়া বোকার মতো তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।আর নির্ঝর রিস্তার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো।রিস্তার তাতে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।সে হেসেই চলেছে তখন থেকে। নির্ঝর মনে মনে ভাবছে,সে তো এখনো আর‌ওয়ার সাথে কথা বলে না। তাহলে এখন যদি ভাবি আর রিস্তা চলে যায় আর‌ওয়ার সত্যিই বোরিং লাগবে।একে তো মেয়েটা অসুস্থ।তার উপর এভাবে সারাদিন চুপচাপ শুয়ে থাকতে থাকতে আরো অসুস্থ হয়ে যাবে। দ্রুত সে ভাবিকে আর রিস্তাকে থামালো। শান্ত গলায় বললো: আমার কিছু কাজ আছে। আপনারা থাকেন আমি গেলাম।
রিস্তা থামিয়ে দিয়ে বললো:তোর কি কাজ?তুই তো এখন ছুটিতে আছিস। তাহলে কোন কাজে যাবি?
_সব কি তোকে কৈফিয়ত দিতে হবে? বেয়াদব।
রিস্তা রেগে গেলো। রাগী গলায় বললো:আর‌ওয়া শুনলে তোমার জামাই আমাকে বেয়াদব বলেছে।এই আমি থাকবো না তোর ব‌উয়ের সাথে। তুই থাক। বেয়াদব বলেছিস না? তোকে সুদে আসলে দেখাবো।

রিস্তা হনহন করে চলে গেলো।নিশুও রিস্তার পেছনে পেছনে ধীর পায়ে চলে গেলো। নির্ঝরের এখন মনে মনে রাগ হচ্ছে। একটা কথার জন্য রিস্তা চলে গেলো।কি দরকার ছিল তার কথাটা বলার? এখন আর‌ওয়া কি করবে একা একা। পরক্ষনেই ভাবলো চলে গেছে ভালোই হয়েছে।সে আর‌ওয়ার সাথে থাকতে পারছে। কথা না বললেও তো সময়টা একসাথে কাটবে। মনে মনে হাসলো নির্ঝর। বিছানার একপাশে গিয়ে বসলো সে। আর‌ওয়ার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সংকোচ লাগছে আবার। নিজেকে বেশ অসহায় লাগছে এখন তার। একবার ভাবে কথা বলবে তো আবার সংকোচ লাগে।আর‌ওয়া চুপচাপ বসে আছে।পাশে যে একটা মানুষ বসে আছে সেটা নিয়ে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। নির্ঝরের সাথে একটু কথা বললে কি এমন হয়? উত্তর পায় না নির্ঝর। নিজেকে কন্ট্রোল করলো সে। সিদ্ধান্ত নিলো অনায়াসে একবার সরি বলে ফেলবে। যদি একবার কথা বলতে পারে তবে জড়তা কেটে যাবে। তারপর সব আগের মতো হয়ে যাবে। কিন্তু সমস্যা একটাই। মহা সমস্যা। নির্ঝরের গলা আটকে যাচ্ছে।কথা বলতে গেলেই থেমে যাবে।

তখনি কেউ তাদের রুমের দরজা জোরে জোরে ধাক্কালো। নির্ঝর দ্রুত উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখলো তার মা দাঁড়িয়ে আছেন।তিনি রাগী দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন।তার চোখ ছলছল করছে। নির্ঝর বুঝতে পারলো তার মা কেনো এসেছেন। নিশ্চয় মিতার খবরটা জানতে পেরেছেন তিনি।তাই চোখে জল তার। নির্ঝর শান্ত চোখে তার মায়ের দিকে তাকালো।তার মায়ের চোখ বেয়ে এখন জল গড়িয়ে পড়ছে। নির্ঝর শান্ত কন্ঠে বললো:কি হয়েছে?
_তুমি জানো না?
_আমি যা জানি তাতে আপনার কান্না করতে হবে এমন কিছু দেখছি না।তাই জিজ্ঞেস করলাম আপনার কি হয়েছে?
_এসবের কি খুব দরকার ছিল?
_কোন সবের?
_নির্ঝর, তুমি আমাকে জোকার পেয়েছো? তুমি জানো না আমি কি বলতে চাচ্ছি?
মায়ের কড়া গলা শুনে নির্ঝর থামলো।তার মা বললেন: আমাদের বাসার মধ্যে যা কিছু হয়েছে তা আমাদের বাসার সদস্যরা সমাধান করবে। তোমার দাদা আছেন,বাবা আছেন।তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে সমাধান করবে। তুমি ঘরের বিষয়টাকে বাইরে নিয়ে গিয়েছো কোন সাহসে?
_বিষয়টা কি এখনো ঘরের মধ্যে সীমাবদ্ধ?
_অবশ্য‌ই। আমাদের ঘরের সদস্যদের মধ্যে হয়েছে। তাহলে আমরা আমরা সমাধান করতে পারি।থানা, পুলিশ এসবের কোনো দরকার নেই।
_দরকার আছে বলেই করেছি।
নির্ঝরের মা এবার রেগে গেলেন। চিল্লিয়ে বললেন: তোমার সাথে কথা বলার বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট আমার নেই। তুমি সাইড হ‌ও।আমি ভেতরে যাবো।
_ভেতরে যাবেন কেনো?
_আমি আর‌ওয়ার সাথে কথা বলবো।

মিসেস রুমানা নির্ঝরকে সরিয়ে দিয়ে আর‌ওয়ার কাছে গেলেন। শান্ত গলায় বললেন: নির্ঝর কি করেছে তুমি জানো?
আর‌ওয়া অবাক হয়ে বললো: আমি জানি না।কি হয়েছে?
_নির্ঝর মিতার নামে মামলা করেছে থানায়।মিতাকে পুলিশ গ্রেফতার করতে এসেছে এখন।
আর‌ওয়া অবাক হয়ে বললো: মিতা আপুর বিরুদ্ধে কেনো মামলা করবে উনি?
নির্ঝর মায়ের পেছন পেছন এসে বললো: আম্মু আপনি আর‌ওয়ার সাথে এই বিষয়ে কথা বলবেন না।মিতা কি কি করেছে এসবের কিছুই জানে না আর‌ওয়া। আমি মিতার বিরুদ্ধে মামলা করেছি আর বেশ করেছি।
নির্ঝরের মা বললেন:মিতা আর‌ওয়াকে মারতে চেয়েছে তাই মিতাকে কিভাবে শাস্তি দিবে তা শুধু আর‌ওয়াই বলবে। তুমি বলার কে?
_আপনি জানেন না আমি বলার কে?স্বামী হিসেবে আর‌ওয়াকে নিরাপত্তা দেওয়া আমার কর্তব্য।মিতা আমার স্ত্রীকে খুন করতে চেয়েছে। আমি তাই আমার দায়িত্বটা পালন করছি।এতে আপনার কিছু বলার প্রয়োজন নেই।
_তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলছো?
_হুম বলছি। আপনাকেও যে মামলা দিই নাই তার জন্য শোকর করেন।ভাগ্নির নামে বেশি ওকালতি করতে আসলে আপনাকেও আপনার ভাগ্নির সাথে পাঠিয়ে দিবো।
নির্ঝর বেশ রেগে কথাগুলো বললো।তার মেজাজ খুব খারাপ হয়ে আছে সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
মিসেস রুমানা ছেলের আচরণে খুব মর্মাহত হলেন।আর‌ওয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন: তুমি একটু নির্ঝরকে বোঝাও।আমি আর পারছি না এসব নিতে।

মিসেস রুমানা কথা শেষ করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।আর‌ওয়া বুঝতে পারছে না ঠিক কি কি হয়েছে।এখনো তাকে কেউ এসব বিষয়ে বলেনি।সে বুঝতে পারছে না নির্ঝরকে কি বোঝাবে? সে কি একবার নির্ঝর থেকে জানতে চাইবে? কিছু তো করতে হবে তাকে। হয়তো তার মা জানবে সবটা। মাকে একবার ফোন করলে সব জানতে পারবে ‌এই ভেবে আর‌ওয়া ফোনটা খুঁজতে লাগলো।তার বালিশের নিচ থেকে ফোনটা নিতেই নির্জন এসে ফোনটা নিয়ে নিলো।আর‌ওয়া সেদিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। নির্ঝর অন্য দিকে তাকিয়ে বললো: নিশ্চয় ফুফিকে ফোন দিতে যাচ্ছো। তোমার এসব কথা বলতে হবে না।কানেও নিতে হবে না। আমার সিদ্ধান্ত আমি নিবো। তুমি জাস্ট রেস্ট করো।

নির্ঝর এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলো।কথার ঘোরে বলে ফেলায় তার গলা কাঁপেনি এবার।যাক ফাইনালি সে আর‌ওয়ার সাথে কথা বলেছে। মনে মনে খুব খুশী লাগছে তার।আর‌ওয়া এখনো নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে আছে।সে হয়তো বুঝতেই পারেনি নির্ঝর তার সাথে কথা বলবে।আর‌ওয়ার বোকার মতো চাইনি দেখে নির্ঝর মনে মনে হাসলো।মেয়েটা সত্যি বোকা। সেই সাথে তার চাইনিটাও বোকা।আর‌ওয়া একটু থেমে জিজ্ঞেস করলো:মিতা আপু কি করেছে?

চলবে….