বৃষ্টির রাতে পর্ব-২৪+২৫

0
274

#বৃষ্টির_রাতে
#রূবাইবা_মেহউইশ
(২৪+২৫)

“টু কোল্ড কফি, টু ক্রাশ স্পেশাল বার্গার উইদ চিলি সস এন্ড…. আর কি আছে আজকের স্পেশাল?”

অর্ডার দিতে দিতে সুপ্রভা ওয়েটারকে প্রশ্ন করলো। সে এই শপটাতে প্রায়ই আসতো মেহরিনকে নিয়ে কখনো কখনো ক্যাম্পাসের অন্য ফ্রেন্ডদের নিয়েও। এখানে প্রায় প্রতিদিনই কোন একটা আইটেমের ওপর দারুণ অফার দেয়। শপের স্লাইডিং ডোরটার ওপরে আজ সে বার্গার অফার দেখেই ঢুকেছে। আজকের বার্গারের নামটা বেশ মজার লেগেছে তার ‘ক্রাশ স্পেশাল বার্গার’। তাসিন ঢুকেই বলেছিলো সে শুধুই কফি অথবা চা নেবে কিন্তু সুপ্রভার মনে হলো চা কফিতে হবে। মূলত তার নিজেরই হবে না প্রচুর খিদে পেয়েছে। বাইরে সন্ধ্যা নেমেছে আলস্য মেখে সেই অলসতা ছিলো তাসিনের গায়েও। কিন্তু এই যে পাশে বসে চটপটে তুফানি মেয়েটা একের পর এক সাইক্লোন গতিতে কখনো খাবার অর্ডার দিচ্ছে আবার কখনো তাকে এটাসেটা বলছে শুনে এই অলসতা আর ক্লান্তি কেমন যেন যাই যাই করছে। সুপ্রভাকে সে ইতস্তত করেই জিজ্ঞেস করেছিলো এখানে বুথ নেই? সে কথাতেও মেয়েটা ফট করে বলল, “টেনশন নিচ্ছেন কেন এখনকার ট্রিট আমার পক্ষ থেকে পরেরটা আপনি দিবেন এবং অবশ্যই সেটা বড় মাপের হতে হবে।” এটুকু বলেই আবার একটু ঝুঁকে সে তাসিনের মুখোমুখি এসে ফিসফিসিয়ে বলল, “আপনি চাকরি বাকরি করেন তাই আপনারটা বিগেস্ট হতে হবে।”

ঠোঁট টেনে প্রশস্ত হেসে স্বগোতক্তি করলো, “শুধু ঝড়-তুফান না কিছুটা পাগলও বটে!”

“কিছু বললেন?”

“হ্যাঁ বললাম তবুও আমার ক্যাশ করতে হবে। কালকেই পেমেন্ট করবো বলে এলাম আর নিজের হাত খরচার জন্যও লাগবে।”

“ওহ আচ্ছা , আছে তবে আপনাদের কোয়ার্টার গলিতেই ছোট খাটো মার্কেট আছে সেখানেই ডাচ্-বাংলা আছে আর…”

সুপ্রভা কথা শেষ করার আগেই তাসিন বলল, “ওহ তাহলেই হবে।”

দুজনের কথার মাঝেই তাদের কফি আর বার্গার চলে এলো। তাসিন নিশ্চুপ সে প্রথমেই কফি টেনে নিলো সামনে তা দেখে সুপ্রভা বাঁধ সাধলো।

“আগে বার্গার খান তাতে স্পেশাল একটা কিছু আছে।”

তাসিন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে সুপ্রভা কিছু না বলে বার্গারটা তাসিনের সামনে দিল। সে নিজেরটাও নিয়ে বড় এক কামড় বসিয়ে মুখভঙ্গি বদলে ফেলল। তাসিন দেখে ভাবলো হয়তো দারুণ স্বাদে হয়তো এমনটা করলো। সেও নিজেরটাতে কামড় বসিয়ে আবার কফির কাপে চুমুক দিলো। কয়েক সেকেন্ড না গড়াতেই চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠেছে তাসিনের আর সুপ্রভা তো একেকটা কামড় বসিয়েই কেমন তৃপ্তির আওয়াজ করছে৷ প্রতি কামড়েই আহা! আহ্ কি স্বাদ! এমন সব উক্তি বলছে। তাসিন থ হয়ে চেয়ে রইলো সুপ্রভার মুখের দিকে মেয়েটার সেদিকে খেয়াল নেই। তাসিন বাকরুদ্ধ হয়ে ছলছলে চোখে তাকিয়ে রইলো শুধু । সুপ্রভার বার্গার প্রায় অর্ধেকটা শেষ হতেই সে দৃষ্টি উঁচিয়ে তাসিনের দিকে তাকালো। যেন, মাত্রই তার মনে পড়লো তার সামনে একজন জলজ্যান্ত মানুষ বসে আছে।

“আরে খাচ্ছেন না কেন?”

মুখ ভর্তি খাবার চিবুতে চিবুতে বলায় কথাটা স্পষ্ট হলো না সুপ্রভার কিন্তু তাসিন বুঝতে পেরেছে কি বলছে। সে কোনমতে মুখটা খুলে বলল, “এটাই তোমার বিশেষ বার্গার?”

সুপ্রভার প্রথমে হাসি পেলেও এবার খারাপ লাগলো তাসিনের লালচে মুখটা দেখে। ঠোঁট দুটোও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কেমন রক্ত জমে আছে যেন! বুঝতে পারলো তাসিন ঝাল একদমই হয়তো খেতে পারে না কিন্তু সুপ্রভারই অন্যায় হলো এভাবে না জিজ্ঞেস করে চিলি সস দিতে বলাটা৷

“স্যরি বুঝতে পারিনি আপনি যে ঝাল খেতে পারবেন না।”

তাসিনও বোকা বনে গেল কি বলবে মেয়েটাকে! কত উৎসাহ নিয়ে এসেছে তাকে ট্রিট দিবে বলে৷ সে কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, ইটস ওকে, আমি আসলে এমন ঝাল খেতে পারি না৷ তরকারির মোটামুটি রকম ঝাল খাই কিন্তু আলাদা কোন খাবারে মরিচটা সহ্য হয় না।”

কথার ফাঁকেই তাসিন হাতের ঘড়িটাতে চোখ বুলালো। আটটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি৷ তার এবার ফিরে যাওয়া উচিত আর সুপ্রভারও নিশ্চয়ই হোস্টেলে ঢোকার একটা নির্দিষ্ট টাইম থাকবে৷ সে কফিটা শেষ করে বলল, “তোমার হোস্টেলে কখন ফিরতে হবে? মানে লাস্ট টাইম!”

“নয়টায়। আমার সমস্যা নেই এখানেই তো।”

কথার জবাব দিতে দিতে সুপ্রভা তাসিনের বার্গারটা থেকে বিফ আর টমেটো পিসটা আলাদা করে দিলো৷ ওয়েটারকে ডেকে কেচাপ আনিয়ে তাসিনের দিকে ঠেলে দিলো, “এপাশটা খান এখানে খুব একটা লাগেনি চিলি সসটা আর সাথে কেচাপও নিন খারাপ লাগবে না।”

তাসিন খেতে চাচ্ছিলো না কিন্তু সুপ্রভা যেভাবে বলল তারপর আর না করতে ইচ্ছে হলো না। তাদের আশপাশ জুড়ে আরো অনেকগুলো টেবিল। সেখানে লোকজনও আছে মোটামুটি রকম। তাসিন বিফ পিসটাতে কামড় বসিয়ে আবার ঘড়িতে তাকালো৷ আটটা সাত বেজে গেছে। তার হাতে নির্দিষ্ট কিছু সময় আছে এরপরই হয়তো মা কল দিবে, মামী কল দিবে। কিন্তু তার এখন কিছুতেই এখান থেকে বের হতে ইচ্ছে করছে না বরং সুপ্রভার তেজি, ঝাঁঝালো কথার সাথে নিজেরও একটু খুনসুটিতে মেতে ওঠার সাধ জাগছে৷ সুপ্রভার বার্গার শেষ, সে কফিটাতে চুমুক দিয়ে আফসোসের সুরে বলল, “ইশ, ঠান্ডা হয়ে গেল। কিন্তু টাকা দিয়ে কিনে তো নষ্ট করতে ইচ্ছে হয় না।”

কথাটা শুনে তাসিনের খুব ইচ্ছে করছিলো একবার বলে, “আমি খেয়ে নিচ্ছি দাও তো।”

কিন্তু এ কথা বলাটা ঠিক হবে না ভেবে কিছু বললো না। সুপ্রভা এক চুমুকে কফিটা শেষ করে বসা থেকে উঠলো। ওয়েটারকে ডেকে বিল মিটিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে গিয়ে আবার থামলো৷ তাসিন বসা থেকে মাত্রই দাঁড়িয়েছিলো। সুপ্রভাকে থামতে দেখে জিজ্ঞেস করলো, “কি হলো?”

“বার্গারটা নষ্ট করার কোন মানেই হয় না।” বলেই সে টিস্যুতে মুড়িয়ে তাসিনের আধ খাওয়া বার্গারটা হাতেই নিয়ে নিলো৷ সে বড় পার্স বা হ্যান্ড ব্যাগ কিছুই আনেনি সাথে। পাতলা একটা চামড়ার চিকন পার্স তাতে টাকা আর ফোনটা নিয়ে এসেছিলো। তাই বার্গারটা টিস্যুতে পেঁচিয়ে হাতে নিয়েই বের হলো৷ তাসিন দেখলো মেয়েটা সপ্রতিভ অথচ এমনটা অন্য কোন মেয়ে করলে হয়তো তাদের মধ্যে আড়ষ্টতা দেখা যেত৷ বরং বেশিরভাগ মানুষই এই এঁটো খাবারটা নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারতো না। উল্টো কেউ এটা নেওয়ার কথা বললে অন্য কেউ ভাবতো এটা ছ্যাচড়ামি।

সন্ধ্যে পেরিয়ে গেছে সেই কখন এখনো তুহিন বাড়ি ফেরেনি। মাছুমা চিন্তিত হয়ে মাইশাকে বকছে আর বলছে, সুযোগ পেলেই ফোন হাতে বসে পড়িস। তুহিন এখনো বাড়ি ফেরেনি দেখিসনি একটা ফোন করতে কি যায় তোর!

হঠাৎ মায়ের এমন চেঁচিয়ে উঠা সুর শুনে ভয় পেয়ে গেল মাইশা। সে সন্ধ্যার আগ থেকেই ফোন নিয়ে বসেছিলো এখনো ফোন নিয়েই বসে আছে৷ তার নিজস্ব ফোন নেই এটা তার মায়ের ফোন। কিন্তু তার হাতেই থাকে বেশিরভাগ সময়৷ স্কুল আর পড়াশোনার বাইরে সে ফোন নিয়ে ফটোগ্রাফি করে আবার বিভিন্ন এ্যাপে এডিটিংও করে৷ তার শখের কাজ এগুলো কিন্তু বাড়িতে কম্পিউটার থাকা সত্ত্বেও তুহিন ধরতে দেয় না৷ আর ভালো একটা ডিএসএলআর আছে তাসিনের সেটাও ধরার অনুমতি নেই তাই তার সকল শখ মায়ের ফোন দিয়েই পূরণ হয়। আজ তুহিন ভাইয়া এখনো বাড়ি ফেরেনি তা সে খেয়াল করেনি। মায়ের বকুনি খেয়ে ভাইয়াকে ফোন করলো কয়েকবার কিন্তু কল ঢুকলো না। মাকে বলতেই মা আবার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন৷ কিন্তু সময় যখন আরো আধ ঘন্টা গড়ালো তখন আর শান্ত থাকতে পারলেন না। তুহিন কখনোই সন্ধ্যার পর বন্ধুদের সাথে বাইরে থাকে না। সারাদিনের রুটিন তার যেমনই হোক সন্ধ্যার পর সে নিজের বাড়িতে কিংবা ফুপির বাড়িতে থাকবে৷ পড়াশোনার কোন সমস্যা হলেই ফুপির বাড়ি যায়। আয়না আর সে একসাথেই পড়তে বসে, আগে একজন টিউটরও রাখা হয়েছিলো দুজনের একসাথে পড়ার জন্য। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর দুজনেই কোচিংয়ে পড়ে। মাছুমার চিন্তা হচ্ছিলো খুব তাই সে তাসিনের বাবাকে ফোন দিলেন। আফছার মীর ব্যস্ত ছিলেন তবুও ছেলে বাড়ি ফেরেনি বলে একজনকে পাঠালেন বাজারে আর তুহিনের বন্ধুদের কাছে খোঁজ নিতে। বাড়ি থেকে মাছুমা পটলকেও পাঠিয়েছেন৷ রাত প্রায় নয়টার পর বাজারের পেছনের দিকে একটা পরিত্যক্ত সুতার কারখানার পেছনে হৈ চৈ শোনা গেল। বাজারের প্রায় বেশিরভাগ মানুষই একটু একটু হৈ চৈ শুনে সেদিকে গেল। দশ মিনিটের মধ্যেই জায়গাটাতে বড় রকম একটা জটলা বেঁধে গেল। কেউ কেউ চেঁচিয়ে আবার বলছে থানায় গিয়ে একটা খবর দিতে। বাজারের কাছাকাছি থানা হওয়ায় তৎক্ষনাৎ পুলিশ অব্দি খবর হয়ে গেল বাজারের পেছনে মারামারি হচ্ছে। মারামারিটা করছে মীর বাড়ির ছোট ছেলে আর এস আই এর ছেলে। তাদের সাথে আরো কয়েকজনও আছে কিন্তু মারামারির মূলে আছে তুহিন আর রায়হান। আফছার মীরও ঘটনা শুনে এসেছেন ঘটনা স্থলে ততক্ষণে দুজনের রক্তারক্তি কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। পুলিশের বড় অফিসার এহসান থানায়ই ছিলো সেও এসেছে৷ অফ ডিউটিতে থাকায় সে ইউনিফর্মে ছিলো না কিন্তু ডিউটিরত অন্য এক অফিসার এসেছেন। পুলিশের সামনে আর এলাকার কেউ কিছু বলতে চাইলো না বিধায় পুলিশই দুজনকে ছাড়িয়ে নিলো। তুহিনের ঠেঁট কেটেছে, ডান হাতের কব্জির ওপরেও খানিকটা কাটা। ফল কাটার ছুরিতে কাটায় আঘাত গভীর নয়। আর রায়হানের নাক দিয়ে অঝোরে রক্ত ঝরছে৷ দুজনকেই বাজারের এক ক্লিনিকে নিয়ে দুজনেরই ঔষধপত্রাদি দিয়ে এহসান বড়দের নিয়ে একটা চায়ের দোকানে বসলেন। তুহিন আর রায়হানকে নিয়ে কথা শুরু করার আগে এহসান অভিভাবকদের ডাকলেন। আফছার মীর পাশেই ছিলেন শুধু অনুপস্থিত ছিলো রায়হানের বাবা। তিনি পোস্টিংয়ে খুলনায় আছেন আর রায়হানের বাড়িতে বড় বলতে তার মা আর দাদা আছেন। দাদা বয়স্ক লোক আসতে পারেননি আর তার মাও খুব একটা বাড়ির বাইরে বের হননা। এহসান নিজেই অভিভাবক হয়ে প্রথমে ঘটনা শুনল এবং যতটুকু বুঝলো একটা মেয়েকে উদ্দেশ্য করে দুজনের মধ্যে ঝামেলা সৃষ্টি হয়েছে৷ মেয়েটি তুহিনের ফুপাতো বোন আয়না। সবিস্তারে ঘটনা শুনে জানা গেল রায়হান মেয়েটিকে সবসময় ডিস্টার্ব করে আর আজকে বিকেলে কোচিং থেকে ফেরার সময়ও তাই করেছে। তুহিন আজ আগেই বাড়ি চলে এসেছিলো বলে আয়না একা ফিরছিলো। এহসানের মনে পড়লো রায়হানকে সে বাজারে আগেও একদিন দেখেছিলো একটি মেয়ের সাথে কথা কাটাকাটি করছে। তার মনে হয়েছিলো মেয়েটি বোধহয় তার প্রেমিকা হবে হয়তো কারণ মেয়েটিকে সে যখন জিজ্ঞেস করেছিলো কি হয়েছে মেয়েটি কথাটা এড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু আজ বুঝতে পারলো হয়তো কোন কারণে মেয়েটি সেদিন বলেনি সত্যটি৷ কেন জানি সেদিনের ঘটনা মনে করতেই এহসানের চোখে ভেসে উঠেছে মেয়েটির মুখ। বাচ্চা একটা বয়সে তাদের সুপ্রভার চেয়েও অনেক ছোট হবে৷ ঘটনার মূল বিষয়বস্তু বুঝতে কারোই সমস্যা হয়নি বরং সব শুনে আফছার মীর নিজেও তেড়ে গেলেন রায়হানকে মারতে। এহসান থামিয়ে দিলো এবং রায়হানের ব্যবস্থা তার বাবাকে দিয়েই করাবে বলে আশ্বস্ত করলো। ঝামেলা মোটামুটি রকম মিটিয়ে দিতেই আফছার তুহিনকে নিয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন৷ বাজারে অবশ্য এই নিয়ে আরও দু চারদিন যে চায়ের দোকানগুলো রমরমা থাকবে তা বেশ বুঝতে পারছে সবাই৷ এহসান নিজে রায়হানকে নিয়ে তার বাড়ি গেল। রায়হানের মাকে সামনে রেখেই তার বাবাকে ফোন করে সবটা জানালো।

প্রতিদিন আটটার পর থেকেই মায়ের ফোন কল আসা শুরু হয়। কিন্তু আজ ঘড়ির কাটা নয় পেরিয়ে প্রায় দশের কাছে চলে এসেছে এখনো কল আসেনি। তাসিনও গ্যারেজে জমায়েত হওয়া সকলের খেলা দেখা আর ক্যারাম খেলার চক্করে পড়ে নিজেও কল করেনি। রাতের খাওয়া শেষ হতেই সে একমগ কফি বানিয়ে বেলকোনিতে বসেছিলো। সন্ধ্যায় সুপ্রভার সেই এঁটো বার্গার নিয়ে যাওয়ার কথাটা মনে পড়তেই সে ডাইনিংয়ে নিজের খাবার খুব সচেতনতার সাথে নিয়েছিলো। আজ কেন জানি মনটা বলছিলো একটা ভাতও নষ্ট করা ঠিক হবে না৷ পেটে খুব বেশি জায়গাও নেই তার কারণ সুপ্রভার সাথে কফি খেয়ে আসার পরও সে নিজের রুমে বসে আরেক মগ কফি বানিয়ে খেয়েছে। ভাগ্যিস সে বাড়ি থেকে আসার দিন চা, কফির সব উপকরণ আর ইলেক্টিক মগটাও এনেছিলো। ভাত দু বেলা কম খেতে পারলে, চা, কফিতে কমতি সহ্য হয় না তার। এজন্যই প্রয়োজনীয় কত জিনিস ফেলে এগুলোই আগে ব্যাগে রেখেছিলো সে। ক্যারাম খেলা চলাকালীনও নিচে সবাই একসাথে চা খেয়েছে। এখন আবার রাতের খাওয়া শেষ হতেই অভ্যাস বশে কফি নিয়ে বসলো বেলকোনিতে। এপার্টমেন্টে ফিরে এসেই দেখলো গেইটের ভেতর ওয়্যারড্রোব রেখে গেছে ভ্যানওয়ালা। এতেই তার নিজের ওপর মেজাজ খারাপ ছিল। তখন সাথে সাথে চলে এলে ভ্যানওয়ালা আর দোকানের লেকটিকে দিয়েই সেটা ওপরে নেওয়া যেত। তার ভুলের জন্যই সেটা তাকে নিজে এবং গেইটের দারোয়ান আর বাগানের মালিকে ডেকে তা ওঠাতে হলো। এতে অবশ্য তার একটু খারাপ লাগলো নিজের কাছে ক্যাশ টাকা পয়সা না থাকায়। সংকোচ ভরে বলতে হলো তাদেরকে, চাচা কিছু মনে করবেন না আমি কালকে আপনাদের পারিশ্রমিকটা দেই! মানে আমার কাছে ক্যাশ কিছুই নেই আর আসার সময় এটিএম বুথও খোলা পাইনি। তাসিনের দিকে তাকিয়ে দারোয়ান বলল, “আরেহ কিছু লাগবো না স্যার।”

তাসিন কৃতজ্ঞতার হাসি হেসেছিলো তখন তবুও মনে মনে ঠিক করলো কাল দুজনকেই কিছু দিয়ে দেবে। কফির মগ খালি করে সে মাকে ফোন দিলো। প্রথম দফায় কেউ কল তুললো না পরেরবার মাইশা কল তুলে হিঁচকি তুলে কাঁদতে লাগলো। তাসিন উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলো কি হয়েছে আর তাতে মাইশার কান্না দ্বিগুণ হলো। তাসিন অবশ্য ভয় পেয়ে গিয়েছিলো অশনি চিন্তায় পরমুহূর্তেই মায়ের কথা শুনে বুঝলো মাইশা তার ঢং কন্যা বরাবরের মতোই আহ্লাদী হয়ে কেঁদেছে৷ তুহিনের অবস্থা দেখে মা ভয় পেয়ে গেছেন এবং পরে পুরো ঘটনা জেনে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। আর মা চিন্তিত মানে বাড়ির প্রত্যেকের ওপর দিয়েই সেই চিন্তার ঝড় তুফান বয়ে যাবে একটু আধটু। মানে মাইশার ওপর দিয়েও বকাঝকার তুফান বয়েছে একটু। তাসিনের হঠাৎ করেই খুব হাসি পেয়ে গেল একটা কথা মনে করে। সুপ্রভার এমন হুটহাট ঝগড়াটে আচরণ তার মায়ের সাথে অনেকটাই মিলে। আবার উদারতাও তার মায়ের মতোই ওই মেয়েটার। কিন্তু প্রচণ্ড ক্রোধও জেগে উঠছে মস্তিষ্কে রায়হানের কথা শুনে। কত বড় কলিজা কারো তার বোনদের দিকে নজর দেয়! তাসিন বাড়ি থাকলে তো বোধহয় আরও বড় কোন দূর্ঘটনা ঘটে যেত৷ মুহূর্তেই তাসিনের রাগে মুখ থমথমে হয়ে উঠলো। মাছুমাও বুঝি ফোনের ওপাশ থেকেই টের পেলেন ছেলের রাগ তাই বললেন, আপাতত ঝামেলা মিটে গেছে। ওই ছেলে আর কখনো সাহস করবে না আয়নার দিকে তাকানোর।এমন আরো অনেক কথা বলে ফোন রাখলেন মাছুমা। তাসিনও কিছু সময় শান্ত হয়ে গেল তবে মাথায় রাখলো ঘটনাটা। সে এখানে বসেই কোন এক ব্যবস্থা করিয়ে ফেলবে যেন রায়হান তো দূর কেউ যেন তার বাড়ির মেয়েদের দিকে তাকাতে না পারে। রাতের আবহাওয়া আজ প্রচণ্ড গরম। সন্ধ্যায়ও ঝড়ো বাতাস বইলো আর এখন হঠাৎ করেই হাওয়া গরম আর ঝলসানো মনে হচ্ছে। তাসিনের দু চোখে ঘুম নেই কিন্তু ঘুমানোটা জরুরি৷ ভাবলো একটু ফেসবুকিং করে না হয় সময় কাটানো যাক! যেমন ভাবা তেমনই কাজ, অনলাইনে এসেই প্রথমে নোটিফিকেশন চেক করলো। তাতে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় স্বজন অনেকের রিয়াক্ট, কমেন্টের ছড়াছড়ি। সেগুলো পড়তে পড়তেই মনে হলো সুপ্রভার সাথে পরিচয়টা এখন আর এতোটাও আনকোরা নয় আইডিতে এড করাই যায়। কিন্তু মেয়েটার আইডি নেমই তো জানা নেই৷ আবার মনে হলো থাক কি দরকার যেচে পড়ে এড করার পরে না আবার হ্যাংলা ভেবে বসে। কথাগুলো ভাবলেও মনটা আকুপাকু করলো তার আইডি নাম জানার জন্য৷ আন্দাজ লাগিয়েই সুপ্রভা নাম লিখে সার্চ করলো৷ বেশি সময় লাগলো না মেয়েটাকে খুঁজে পেতে। থ্রি মিউচুয়াল দেখতেই চোখ ছানাবড়া তাসিনের। অস্ফুটে উচ্চারণ করে উঠলো, বাহ্, সো ফাস্ট! মিউচুয়াল চেক করতেই দেখতে পেল তার তিন বন্ধুই যুক্ত আছে মেয়েটার সোশ্যাল একাউন্টে। বুঝতে পারলো শুধু তার সাথেই সাপে নেউলে ব্যাপার ছিলো সবসময় বাকিদের সাথে তো একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। ফোনেই সময়টা দেখে নিলো রাত এগারোটা বাজে। আর জেগে থাকার মানে হয় না তাই বেলকোনি ছেড়ে রুমে গেল তাসিন। ফোনটা সাইলেন্ট মোডে রেখে চার্জে বসিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। ঘুম আসতে সময় লাগলেও বারোটার আগেই সে ঘুমে তলিয়ে গেল।

সুপ্রভা রাতের খাবারটা হোস্টেল ডাইনিং থেকে এনে নিজের রুমে রেখে দিয়েছে। সন্ধ্যায় রেস্টুরেন্টের বার্গার অপচয় রোধ করার চক্করে সে তার পেট ফুল করে নিয়েছে অথচ ভুলেই গিয়েছিলো হোস্টেলে তার ভাগের খাবারটা নষ্ট হবে। সকাল এবং দুপুরের খাভার না খেলে সেগুলো ফুটপাতের কয়েকটা বাচ্চা আসে রোজ তাদেরকেই সুবিধামত দিয়ে দেয় হোস্টেলেরই কয়েকজন লোক। কিন্তু রাতের খাবার কেউ নেয় না। আসলে সে বাচ্চাগুলো দুপুর পর্যন্তই ঘুরঘুর করে। রাতের খাবারটা নষ্ট করার ইচ্ছে হলো না বলে সুপ্রভা খাবারটা রুমে এনে রেখেছে। যে করেই হোক রাতেই তার পেটে খিদে লাগিয়ে এগুলো খেয়ে নিতে হবে। রাত জাগলেই তার খিদে পায় আর তখন সে শুকনো খাবার খায় যা তার মিনি ড্রয়ারটাতে থাকে৷ কিন্তু আজ সেগুলো না খেয়ে ভাত তরকারি খাবে৷ রাত এগারোটা অব্ধি ভালোই পড়াশোনা চালিয়ে গেল৷ বিপত্তি বাঁধলো সে এরপর আর জেগে থাকতে পারছে না৷ ঘুমে ঢুলুঢুলু অবস্থা । কিন্তু আজ তো সে বিকেলে মরার মত পড়ে অনেক লম্বা ঘুম দিয়েছিলো। বার বার হাই তুলছে আর বইয়ের পাতা ওলট পালট করলো৷ নাহ্ ঘুম তো কিছুতেই তাকে ছাড়ছে না কি করা যায়! ভাবতে ভাবতেই মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। এই মুহুর্তে সবাইকে ফোন করে করে জ্বালালে কেমন হয়! প্রথমেই সে ভাবীকে কল দিলো৷ মীরা মাত্রই রান্নাঘরের কাজকর্ম সেরে দোতলায় যাচ্ছিলো। সুপ্রভার ফোন পেয়ে খুশিই হলো বেশ। কথার শুরুতেই মীরা জানালো তৈয়াবের বিয়ের ডেট দিতে যাবে আগামী মাসে সুপ্রভার পরীক্ষার নোটিশ পাওয়ার পর। ডেট মূলত তার পরীক্ষার তারিখের পরই রাখবে বলে জানিয়েছে তার বড়দা। ভাইয়ের বিয়ে আর একমাত্র বোন পরীক্ষার চিন্তা নিয়ে বিয়েতে থাকবে এ অসম্ভব৷ সুপ্রভার তো ভারী খুশি লাগছে ভাবতেই তার আরো একটা ভাবী হবে। বাড়িতে বিয়ের আয়োজন হলে সব আত্মীয়স্বজন আসবে, সে নতুন নতুন অনেকগুলো ড্রেস নেবে এবার। বড়দার বিয়ের সময় সে খুব ছোট ছিলো তবুও ভাবীর সাথে মিলিয়ে নাকি তার অনেকগুলো ড্রেস কিনেছিলো এবারও তাই করবে। ভাবী-ননদে অনেকটা সময় গল্প করে ফোন রাখলো। তারপরই ফোন দিলো টিয়াকে। বেচারি নাক মুখ ফুলিয়ে কথা বলল। মুরাদের সাথে নাকি ঝগড়া হয়েছে একটু আগেই । মুরাদ বলেছে টিয়ার রান্না নাকি পানসে৷ এই নিয়ে সেকি রাগ, ঝগড়া তার কিন্তু মুরাদ চুপচাপ পানসে বলেও সব খাবার একাই খেয়েছে। এখন শ্বাশুড়ি মায়ের কাছে অভিযোগ করে এসে আবার সুপ্রভাকেও বলছে সব অভিযোগের সুরেই। কিছুটা সময় টিয়াকে দিয়ে আবার ফোন দিলো মাকে৷ এই একটা জায়গায় এসে সবসময় হতাশায় ডুবে যায় সে। মা মানুষটা কখনোই যেন তার প্রতি টান অনুভব করে না। একটামাত্রই তো মেয়ে সে তবুও এত অবহেলা কেন! পরপর অনেকবার কল করেও মাকে পাওয়া গেল না। যেন ইচ্ছে করেই মা তার ফোনকল ইগনোর করে। চোখের কোণে জল ছলছল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া বাকি। মন খারাপের ভারী এক হাওয়া বইতে লাগলো বুকের ভেতর৷ আজ তিনদিন হলো সে বাড়ি থেকে রেগে এসেছে। একটাবারও কি মায়ের মনে হয়নি মেয়েটার খোঁজ নেই! আশ্চর্য! মায়েরা নাকি মেয়ে বড় হলে চিন্তায় দু চোখের পাতা এক করতে পারে না অথচ তার মা যেন তার বড় হওয়ারই অপেক্ষা করছিলেন৷ এখন সে একটু বড় হতেই তিনি ঝাড়া হাত পা হয়ে তাকে আল্লাহর ওয়াস্তে ছেড়ে দিয়েছেন। বাইরের গুমোট গরম ভাবটা এবার সুপ্রভার তনু- মন উভয়েই ছেয়ে গেল। কান্না আটকে সে ফোনটা নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো৷ এই মুহুর্তে নিজেকে তার বড্ড অসহায় আর এতিম বলেই মনে হলো। রাতের খাবারটা সত্যিই নষ্ট হবে আজ। এই বিষন্ন মন নিয়ে খাওয়া তো দূর এক ঢোক পানিও গিলতে পারবে না।

নিয়মমাফিক সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে নির্দিষ্ট সময়ে নাশতা ছেড়ে অফিসে পৌঁছুলো তাসিন। সারাটাদিন খুবই মনযোগে কাজ শেষ করেছে৷ কালকের ভুলগুলো যেন পুনরায় না হয় তাই আজ কম্পিউটার আর নিজের ডেস্ক ছেড়ে খুব একটা উঠেও দাঁড়ায়নি৷ কফি খাওয়ার অভ্যাসটাতে আজ কড়াকড়ি ভাটা পড়েছিলো তার। পিয়নকে ডেকে কোন মতে বিকেলের দিকে এক কাপ চা খেয়েছে। একাধারে কম্পিউটারে কাজ করতে করতে টের পেল সে চোখে খুব ঝাপসা দেখছে৷ ভুলটা নিজেরই তা বুঝতে সময় লাগেনি কিন্তু আজকেই যে করে হোক টাকাটা তুলতে হবে। অফিস থেকে বেরিয়ে টাকা ক্যাশ করিয়ে প্রথমেই গেল ফার্নিচার শপে৷ সেখানকার টাকা ক্লিয়ার করেই মনে পড়লো তার সুপ্রভাকে ট্রিট দেওয়ার কথাটা। কিন্তু আজও তাতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে মেয়েটাকে যেচে পড়ে এই সন্ধ্যাবেলায় বাইরে না আনাটাই ব্যাটার হবে বলে মনে করলো তাসিন। ফিরে গিয়ে দারোয়ান আর মালিকেও দুশো দুশো করে টাকা দিলো সে। দুজনেই কেমন যেন লজ্জায় কুঁকড়ে ছিলো। তাসিন এক প্রকার জোর করেই তাদের হাতে টাকাটা গুঁজে দিয়েছিলো। রেগুলার নিয়মে গ্যারেজে আবারও খেলার আসর জমলো৷ রাতে খাওয়ার পর কফি, বেলকোনি আর ফেসবুক। সুপ্রভার কথা মনে পড়লেও কেন জানি যেচে তাকে আর নক করার মত ইচ্ছেটা হলো না তাসিনের। এভাবেই কেটে গেল আরো তিনদিন সুপ্রভার সাথে কোন প্রকারেই যোগাযোগ করা হলো না তাসিনের। তারপরই শুক্রবার ছুটিরদিন ; সুপ্রভা নিশ্চয়ই ফ্রী আছে ভেবে তাসিন তাকে ছোট্ট করে একটা বার্তা লিখলো, “ট্রিটের দিনক্ষণ কি এ বছরেই ঠিক করা হবে?”

মেসেজটা সেন্ড করেই তাসিন চোখ বুঁজে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো৷ আজ শুক্রবার হলেও তার ছুটি নেই। মান্থলি ছুটির ইস্যু করা হয়েছে অফিসে গেস্ট অফিসারদের জন্য। তাসিনেরও তাই মাসে একবারই টানা চারদিন ছুটি থাকবে। আজ সুপ্রভা ট্রিট নিতে চাইলে তাসিন ভেবে রেখেছে ডিনার ট্রিট দিবে৷ কিন্তু নাহ্ তার মেসেজের জবাবটা আর এলো না সেদিনটাতে৷ তাসিনের অপেক্ষা লম্বা হয়ে গেল এরপরও একটা সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে সুপ্রভার কোন জবাব আসেনি। তার অপেক্ষা এবার ধৈর্য্য পরীক্ষার মত হয়ে যাচ্ছে। এরই মাঝে হুট করেই আরেক ঘটনা ঘটে গেল। বাড়ি থেকে মা হঠাৎ করেই তার বিয়ের জন্য প্রেসার ক্রিয়েট করলেন। বোকার মত তাসিন মায়ের এমন আচরণের কোন অর্থ খুঁজে পেলো না। মা শুধু ফোন করেই বলেন, “আমি তোকে এক মাসের মধ্যেই বিয়ে করাবো।”

প্রায় কয়েকটাদিন মায়ের এই এক বাক্যেই তার সাথে কথা হতো আর প্রতিটাদিনই তাসিন কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইতো কি হয়েছে? তারপর একদিন হুট করে বললেন, “আয়নার সাথে তোর আগামী সপ্তাহে বিয়ে। তুই তো চারদিনের ছুটিতে আসবি তখনই হবে। আমি আয়োজন করছি।”

চলবে