#বৃষ্টির_রাতে
#রূবাইবা_মেহউইশ
(২৬)
প্রেমের টানে নয় শুধুই আবেগের তাড়নায় পড়ে আয়না মস্ত এক ভুল করে বসলো। একদিন কলেজ থেকে ফিরে এসে লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে মায়ের সামনে বলে বসলো সে তাসিন ভাইকে ভালো বাসে। বাড়ির প্রায় প্রত্যেকেই বুঝতো এ কথাটা তবুও সরাসরি এর আগে কখনো মুখের ওপর বলেনি আয়না। কিন্তু সেদিন তার কি হলো কে জানে মুখের ওপর কথাটা বলে বসলো। তার মা অবশ্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলো এমন কথা শোনার জন্য কিন্তু তাসিনকে নিয়েও ভাবতেন তিনি৷ ভাতিজা নিজ থেকে না চাইলে কোনদিনও মুখ ফুটে বিয়ের কথা তুলতে পারবেন না। কিন্তু কিশোরী আয়নার মন সে মুহূর্তে আবেগ আর তাসিনের মোহে পড়ে বেহায়া হয়ে পড়লো। মাকে বলে ক্ষান্ত হয়নি সে মামীর সামনে গিয়েও একই কথা বলল আর সে কথা তাদের আড়ালে দরজার বাইরে থাকা তাসিনের বাবাও শুনে ফেলল৷ তিনি অতি সাদাসিধা লোক, কম শিক্ষিতও কিন্তু অবিবেচক নন৷ ভাগ্নির কথা শুনে এক মনে খুশিই হলেন। ঘরের মেয়ে ঘরেই থাকবে এরচেয়ে ভালো আর কি হতে পারে কিন্তু অন্য মন সতর্ক করলো৷ যুগটা আর তাদের নেই ছেলের মন কি চায় তা না জেনে শুধু আগাম খুশি হলেই চলবে না। তারা এ যুগের না হয়েও তো এমন মন বিভেদ নিয়ে সংসারটা করছে। অন্যদের দিকে তাকানোর দরকার নেই তার আর মাছুমার দিকে তাকালেই হয়। মাছুমার বিয়েটা তার বাবা মতের বিরুদ্ধে দিয়েছিলেন। আফছার অশিক্ষিত তার চালচলনে গ্রাম্য ছাপ স্পষ্ট। মাছুমা চট্টগ্রাম শহরের মেয়ে , বি.এ পাশ তারওপর বাপের বাড়িতে বাড়ি, গাড়ি আগের জমানা থেকেই ছিল। বলতে গেলে রাজকন্যার মত জীবন ছিলো তার কোন এক বিপদে আফছারের মধ্যে কোন এক সততার ঝলকানি দেখে মাছুমার বাবা মহিউদ্দিন হঠকারী এক সিদ্ধান্ত নিয়ে ছোট মেয়েকে তুলে দিলেন আফছারের হাতে। সে সময়কার মেয়ে বলেই মাছুমা কান্নাকাটি করলো তবুও বিয়ে ভাঙার মত সাহস দেখাতে পারেনি। এরপর কতগুলো বছর এক ছাঁদের তলায় জীবন কাটালো, নারী পুরুষের দৈহিক আকৃষ্টতায় দুনিয়ার বুকে নিজেদের অস্তিত্বও আনলো কিন্তু এতেই কি সব সুখ! মোটেই না। প্রিয় মানুষটির চোখে যখন জীবন যাপনের তৃপ্ততা না পাওয়া যায়, তার হাসি মুখটাতেও যখন বিষাদ ধরা পড়ে তখন আর সংসারটাতে সুখ বলে কিছুই পাওয়া যায় না। আফছারের জীবনেও তাই, মাছুমা হাসি মুখে সংসারটা আগলে রাখলেও কোন কোন এক বিজন রাতে আফছার অনুভব করতো তার প্রিয় নারীটি অস্থির চিত্তে আছে, বিষাদিত হয় তার কিছু কিছু মুহূর্তে আবার বাপের বাড়ি বড় কোন অনুষ্ঠানে যখন তার সব লাখপতি আত্মীয়ের ভিড়ে আফছার যখন শার্টের সাথে লুঙ্গি পরে থাকতো তখন খুব আড়ালে লুকিয়ে নিতো মাছুমা নিজেকে। তবে সেই লুকানোর কারণটা শুধুই তার স্যুট কোট পরা আত্মীয়ের ভেতরে আফছারের লুঙ্গি পরা পরিচ্ছদ নয় বরং আফছারকে মন থেকে না মানতে পারার অকাট্য সত্যই প্রকাশ করত ৷ আফছার বুঝেও না বোঝার চেষ্টা করতো নিজ স্বার্থে। তার মূর্খ অশিক্ষিত মনটা যে ওই রমনীর প্রেমে পড়ে কঠিন বিদ্বেষী ছিল তাকে কিছুতেই হারাতে চাইতো না। রূপকথার দানবের আত্মা রাখা তোতা পাখির মতোই আফছারের আত্মাটাও মাছুমাতে ছিল বলেই সে স্বার্থপর হয়ে এতগুলো বছর মাছুমাকে ছাড়তে চায়নি। আজ যখন নিজের সন্তানদের নিয়ে ভাবার সময় এলো তখন সে একটুও ভুল করতে চায় না। তাসিন বিয়ে করবে তাকে যাকে সে মন থেকে চাইবে। মাইশা, তুহিনের বেলায়ও তেমনই হবে। ভাগ্নিটার জন্য কষ্ট হচ্ছে বলেই আবার সিদ্ধান্ত নিলো সরাসরি তাসিনের সাথে কথা বলবে। কিন্তু তার ভাবনার চেয়ে দ্রুত গতিতে মাছুমা কাজটা করে ফেলল। দু সপ্তাহ হলো ছেলেটা ঢাকায় আছে তারমধ্যে দেড় সপ্তাহ ধরেই মাছুমার কথা কাটাকাটি চলছে ছেলের সাথে। সে আয়নাকেই বাড়ির বউ করবে এবং সেটা যত দ্রুত সম্ভব। তাসিন প্রথম প্রথম ঠান্ডা মাথায় মাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেও এখন আর ধৈর্যে কুলায় না তার। এদিকে ধৈর্য্যের পরীক্ষা তো তার সুপ্রভাও কম নিচ্ছে না। মেয়েটা মেসেজ পাওয়ার পরদিনই ডিনারের প্রস্তাব গ্রহণ করলো। রাত নয়টা অব্দি তাসিন অপেক্ষা করলো সুপ্রভার দেওয়া ঠিকানায়। চমৎকার এক রুফটপ রেস্টুরেন্টে তাসিনের সময় কেটেছিলো উত্তেজনায় অপেক্ষা করে। আটটা থেকে ঠিক নয়টা পর্যন্ত এরপরই অপেক্ষাটা বড্ড ফিকে আর অত্যধিক বিরক্তিকর লেগেছিল।একটা পর্যায়ে সেই বিরক্তি রাগেও পরিণত হয়েছে তার কারণ এতগুলো দিনেও সুপ্রভা তার সাথে যোগাযোগ করেনি এমনকি সেদিন সে অনুপস্থিত ছিল সে উপলক্ষেও একটা ছোট বার্তা দিতে পারতো কিন্তু দেয়নি। আজও সারাদিন অফিস করে রুমে ফিরে তার মনটা তেতো হয়ে রইল। মা ফোন দিচ্ছে বারবার তাই ফোন সাইলেন্ট করে কফি বানাচ্ছে তাসিন। আজ আকাশটা বিকেল থেকেই মেঘলা হয়ে ছিলো এখন আবার থেকে থেকে বিজলীর চমক আর এলোমেলো হাওয়া জানান দিচ্ছে ধরণী ভিজবে অতিসত্বর। বুকের ভেতর দু দিককার ক্রোধ যেন জ্বালিয়ে দিচ্ছে আর তা নেভাতেই এই বৃষ্টিটা প্রচণ্ড দরকার। কফি বানানো শেষ হতেই তাসিন বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। কয়েক সেকেন্ড না গড়াতেই তার চোখে মুখে বাতাসের তোড়ে জাপটে এলো বৃষ্টির ফোঁটা। ফোনের আওয়াজটা তার গত দেড় সপ্তাহ ধরেই প্রচণ্ড মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলেই আজ আর ফোনটাকে সাথে রাখলো না। বর্ষণে আজ শুধু ধরণী নয় আধভেজা হলো তাসিন আর তার কফিটাও। কফি শেষ করে আধঘন্টার বৃষ্টিতে ভিজে চুপচাপ ভাবনায় বিভোর রইলো। প্রথম ভাবনাটাই ছিলো সে কেন সুপ্রভার ওপর রেগে আছে? মেয়েটা তো কোনভাবেই কমিটেড নয় তার সাথে ডিনার করার। আর না সুপ্রভার কোন দায় আছে তার প্রতি তবে হ্যা একটু তো অন্যায় করেছে সেদিন অপেক্ষা করিয়েও না এসে। আর দ্বিতীয় ভাবনা আয়নাকে নিয়ে। এই পুচকি মেয়েটা যা শুরু করেছে তাতে নির্ঘাত তাসিন বাড়িতে থাকলে কষে তাকে দুটো থাপ্পড় মেরে বিয়ের সাধ মিটিয়ে দিত। বৃষ্টি থেমে গেছে কফির খালি মগটা নিয়ে রুমে ফিরে কাপড় বদলালো তাসিন। আজ আর রাতে খাওয়া সম্ভব নয়। টেনশন আর রাগে আজকাল প্রায়ই তার খিদেটা নষ্ট হয়ে যায়। ঘরের বাতি বন্ধ করে শুয়ে পড়লো বিছানায়। ফোনের স্ক্রীণে আবারও আলো জ্বলে উঠেছে৷ তাসিন ইচ্ছে করেই ফোনটা চেক করলো না। সেই এক প্যাচাল কান পচাবে তারচেয়ে বরং ঘুমটাকে কাছে টেনে নেওয়াই উত্তম৷ পরে ভেবে কিছু একটা করতে হবে আয়নার।
গুনে গুনে আজ চৌদ্দটা দিন বাড়িতে বন্দী থেকে হাঁপিয়ে উঠেছে সুপ্রভা। হাতটা ভাঙার কি খুব দরকার ছিলো? রাগে সেদিন মোবাইলটা ফ্লোরে না মেরে সৌহার্দ্যের মাথায় মারা দরকার ছিলো। শা*লা আবা*লের জন্যই ওরকম পিচ্ছিল রাস্তায় সে ওভাবে আছাড় খেয়েছে আর এই হাতটার নাজেহাল। মনে মনে বেশ আফসোসও হচ্ছে তাসিনের কাছ থেকে ট্রিটটাও নেওয়া হলো না। ইশ, বুকের ভেতর ধকধকানি আবারও শুরু হলো ওই অসহ্যকর লোকটার কথা মনে করে। আর এখন রাগটাও হচ্ছে মায়ের ওপর। এতগুলো দিনে নতুন একটা ফোন আর তার সিমটাও সে হাতে পেল না শুধুমাত্র মায়ের কারণে। আচ্ছা মা কি ভাবছে সুপ্রভা সত্যিই কোন ছেলের সাথে ডেটে গিয়ে ওরকম একটা দূর্ঘটনা ঘটিয়েছে! কিন্তু কি করে সম্ভব? সে তো আসল ঘটনা কাউকেই বলেনি। শুধু বলেছে বৃষ্টিতে পথ পিচ্ছিল ছিলো আর সে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়েই পিছলে পড়েছিল। তারপরও কেন বলল, কপাল ভালো রাস্তায়ই ছিলে গড়িয়ে যদি পুকুরটাতে পড়তে! মূল ঘটনা, তাসিনের ওয়্যারড্রোব কেনার দিন রাতেই তাসিনের ডিনার ট্রিট মেসেজটা পেয়ে সে অতি উত্তেজনায় রাতভর ঘুমাতে পারেনি। এত উত্তেজনা কেন হয়েছিলো সে জানে না শুধু মনে পড়ছিলো চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসার পথে তাসিনের বুকে নিজেকে দেখার সেই ভোরটা। ঘুমঘুম আর সরল চোখে তাসিনের তাকিয়ে থাকা, নিঃশ্বাস চেপে তার থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া। আর এবারও ঢাকায় যাওয়ার পথে একই ঘটনা ইচ্ছাকৃত ঘটানো। আসল সত্যি এটাই এবার মধ্যরাতে সুপ্রভা জেগেছিলো। নিজের পাশে তাসিনকে দেখে প্রথমে ভড়কে গেলেও কিছু সময়েই নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়েছিলো। তারপরই প্রথমে যে কথা মনে হয়েছিলো, এটা কি কাকতালীয় নাকি কোন কারণ আছে! এভাবে প্রতিবারই তাদের অজান্তেই কেন তাদের দেখা হয়ে যাবে! এটা কি তাকদীরের কোন ইশারা! নিজেই নিজের ভাবনাতে হেসে ফেলে সুপ্রভা। কেমন সিনেমেটিক একটা ভাবনা ছিলো আর তাসিনের গায়ের গন্ধটা আবারও সেই প্রথম দিনের মত নাকে লেগেছিল খুব করে। চোখ বুঁজে আপনাআপনি ঢলে পড়েছিলো তাসিনের কাঁধে যেন এলকোহলের মত টানছিলো তাকে। মনের মাঝে এক সুপ্ত ভালোলাগার শুরুটা হয়েছিলো কক্সবাজার থেকেই কিন্তু তা যে কখনো এতখানি গাঢ় হবে তা কি ভেবেছিলো তারা! দু প্রান্তে দুজন মানুষের ভাবনার জগত একটাই। অথচ দুজন দুজনার ভাবনা সম্পর্কে কিছুই জানে না। সংকোচ আর দ্বিধায় কখনো মন খুলে অনুভূতিকে অনুভব করার সাহসটাও আসে না তাদের মাঝে। হাত ভাঙার পরই সৌহার্দ্য সুপ্রভাকে হাসপাতালে ভর্তি করায়। সারাদিন হাসপাতালে কাটিয়ে বাড়িতে ফোন করে সুপ্রভার অবস্থার কথা সৌহার্দ্য নিজেই সুপ্রভার বড়দাকে জানায়। আর তাতেই রেগে হাসপাতালে বসেই ফোন ভেঙে ফেলে সুপ্রভা। রাগটা তার সৌহার্দ্যের ওপর থাকলেও তা মিটিয়েছে ফোনের ওপর। এরপরই মনে পড়েছে তার কাছে তাসিনের নাম্বারটা আর কোথাও নেই। কয়েকটা ডিজিট মনে থাকলেও সবটা নেই। তাসিন নিশ্চয়ই রেস্টুরেন্টে তার জন্য অপেক্ষা করবে! এরপর তো বড়দা এসে নিয়ে গেলো বাড়িতে৷ কয়েকবার ভাবীর ফোন থেকে তাসিনকে কল করতে চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু নাম্বারটা আর ঠিকঠাক মনেই করতে পারেনি এদিকে তার এফবি একাউন্টের পাসওয়ার্ডটাও মনে নেই৷ নয়তো এফবি থেকে টিয়ার কাছ থেকে জোগাড় করা যেত মুরাদ ভাইয়ার মাধ্যমে। নিজেকে নিজেই শ’খানেক গালি দিয়ে বসলো আফসোসে।
মহিলা কলেজের সামনে একদল বখাটে নিয়মিতই ঘুরঘুর করতো। রায়হান আর তুহিনের ঝামেলাটা পুলিশ পর্যন্ত যাওয়ার কারণেই এহসানকে একটু ঘাটাঘাটি করতে হয়েছে ব্যপারটা। রায়হান শুধরেছে কিনা খুব একটা বোঝা না গেলেও আয়নার পেছনে তার আনাগোনা বন্ধ হয়েছে। একটু আধটু খোঁজ নেওয়ার কারণেই এহসান দুদিন কলেজেও গিয়েছিলো যদিও সরাসরি এসব কাজ সে করে না। কলেজের প্রিন্সিপালের সাথে ইচ্ছাকৃত ভাবেই একটু সাক্ষাতের জন্যই প্রথমদিন যাওয়া। সেখানে গিয়েই প্রথমেই সে ভুলবাশতই ধাক্কা খেয়েছিলো আয়নার সাথে। আয়নাকে দেখতেই মনে পড়লো প্রথমবার বাজারে রায়হানের সঙ্গে দেখেছিলো মেয়েটিকে৷ মেয়েটিও যে তাকে দেখেই চিনতে পেরেছে তা বোঝা গেল মেয়েটির আঁড়চোখে তাকানো দেখে। এহসানের কি হলো কে জানে সে এরপরও আরো একদিন কোন কারণ ছাড়াই এসেছিলো কলেজে৷ ঘুরেফিরে তার দৃষ্টি অজান্তেই আবার আয়নাকে খুঁজে ফিরলো। দেখা মেলেনি সেদিন আর। এরপর পরপর আবারো এলো এহসান একদিন, দুদিন আরো কয়েকদিন। হঠাৎ করেই তার মনে হতে লাগলো সে বখাটেদের তাড়াতে গিয়ে এখন নিজেই বখাটেদের ভূমিকায় চলে এসেছে। মেয়েটিকে সে এখন রোজই একবার করে দেখে তবে তা অবশ্যই লুকিয়ে। কেমন যেন নিজেকে আজকাল পুলিশ কম চোর চোর বেশি মনে হয়।
চলবে
#বৃষ্টির_রাতে
#রূবাইবা_মেহউইশ
(২৭)
প্রেমের বর্ষণ হতে হাজারো বাঁধা বিপত্তি থাকতে পারে কিন্তু প্রেমে পড়তে! তাতে নিশ্চয়ই কোন বাঁধা নেই? বরং কে কখন এই প্রেম পথে হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়বে তার ঠিক ঠিকানা নেই। সত্যিই নেই নয়তো একই সময়ে তিন দিকে তিন তিনজন মানুষ হঠাৎই প্রেমের ভরাডুবিতে ডুবলো কি করে! পুলিশ অফিসার এহসান হঠাৎ করেই হাঁটুর বয়সী এক মেয়ের প্রেমে নাক মুখ ডুবিয়ে পড়ে গেল। সে সময়েই তারই ফুপাতো বোন সুপ্রভাও পড়লো ঝড় বাদলের রাতে তাকে জ্বালিয়ে মারা ছেলেটির প্রেমে আছড়ে পড়লো। যা তা পড়া নয় সেই প্রেমে সে আজকাল পাগলের মত একা একাই নানান প্রলাপ বকে। আবার এই পাগল ঝড় তুফানের মত মেয়েটির প্রেমে পড়লো সেই হুটহাট ধমকে ওঠা কিছুটা মুডি ছেলেটা। ঋতুটা জৈষ্ঠ্যমাস অথচ এই তিনজন মানুষের মনে একটানা শ্রাবণ চলছে যেন বাতাসে বসন্তকে জড়িয়ে। এ কেমন মাতাল অনুভূতিতে ছেয়ে গেল তাদের মন! বহুকষ্টেই সুপ্রভা তাসিনের নাম্বারটা জোগাড় করেছিলো পনেরো দিনের মাথায়। বড়দাকে অনেক বলে কয়ে মায়ের মতের বিরুদ্ধে গিয়েই একটা নতুন স্মার্ট ফোন কেনা হলো সুপ্রভার। ডান হাতের প্লাস্টারটাও উতরে গেল পনেরো দিনে আর ডান হাতের আঙ্গুল গুলোও মোটামুটি সচল ছিলো বলেই প্রথমে ফেসবুক আইডির পাসওয়ার্ড রিকভার এবং পরে টিয়াকে নক করে টিয়ার ফোন নাম্বার নিলো। কল দিয়ে এক ঘন্টা বারো মিনিট নিজেদের আলাপ আলোচনার মাঝেই ইনিয়েবিনিয়ে বাহানা দাঁড় করিয়ে তাসিনের নাম্বার চাইলো। দিনের বেলায় মুরাদ অফিসে থাকায় রাত অব্ধি অপেক্ষার পরই টিয়া তাকে পাঠালো তাসিনের ফোন নম্বরটা। দ্বিধায় ভরা বুক নিয়েও সসংকোচে ছোট্ট একটা বার্তা লিখে পাঠিয়ে দিলো তাসিনের নম্বরে। পরীক্ষার বেশি দিন নেই তারওপর পড়ালেখায় লম্বা গ্যাপ পড়ে গেছে। দু দিনের ভেতরই তো ঢাকায় যেতে হবে তখন তার প্রথম কাজই তাসিনের পক্ষ থেকে ডিনার ট্রিট অথবা অন্যকিছু তবুও একটাবার দেখা হওয়া চাই।
ছটফটে মন নিয়ে আয়না দিনভর এখন ঘরে বন্দী পাখির মতো পড়ে থাকে। গত চারদিন ধরে সে তুহিনের সাথে কলেজেও যায় না লজ্জায়। তার করা বেহায়াপনাটা এখন তাদের দু পরিবারের সবাই জেনে গেছে। মাইশা তো কাল এসে মজাও করে গেছে সে তাকে ভাবী বলবে না কখনোই। সে তো ছোট থেকেই আনা আপু বলতো পরেও তাই বলবে। তার ভাষ্যমতে আয়না আপু বেশ বড় হয়ে যায় তাই সে একটা বর্ণ সরিয়ে আনা আপু বানিয়েছিলো আর সারাজীবন তাই ডাকবে। আয়না খুব লজ্জা লাগছিল মাইশার কথা শুনে। বাড়িতে আজকাল আয়নার মা খুব রুদ্রমূর্তি ধারণ করে থাকেন মেয়ের সামনে। খুব বড় নির্লজ্জতা করে ফেলেছে আয়না এটা ভেবেই সে এত রেগে থাকে তার ওপর লজ্জায় দেড় সপ্তাহের মত হলো বাপের বাড়ির দিকে পা বাড়ায়নি। মাঝে অবশ্য মাছুমা নিজেই এসেছিলো বৃষ্টির দিনে ভুনাখিচুড়ি আর গরুর মাংস নিয়ে। তবুও কোথাও একটা লজ্জার কাঁটা বিঁধে আছে গলায়। তাসিনকেও এজন্য এবার এতদিন পেরিয়ে গেলেও ফোন করেনি।
আজ সকাল থেকে কড়া রোদ আর হালকা ঝিরঝিরে বাতাস বইছে। এহসানের ডিউটি থাকায় সে তার ইউনিফর্ম গায়ে দিয়ে নাশতা করতে বসলো। এক হাতে ফোন আর অন্য হাতে পানির গ্লাস। রায়হানের ব্যাপারটা তার বাবার কাছে জানানোর পর আইনি কোন ইস্যু যেন না বানানো হয় সে অর্ডারই পেয়েছিলো এহসান। একজন পুলিশ অন্য একজন সিনিয়র পুলিশের মতের বিরুদ্ধে এমনিতেই যাওয়ার কথা না। রায়হানের বাবা নিজে কথা দিয়েছেন তার ছেলেকে নিয়ে আর কোন অভিযোগ আসবে না। এহসান কথাটা মেনে নিয়েই আফছার মীর আর আয়নার বাবার সাথে কথা বলে ব্যাপারটা মিটিয়েছিলো। কিন্তু সেই মিটিয়ে নেওয়া ঘটনা যে এখন এহসান নিজেই নতুন করে শুরু করতে চাচ্ছে তা ভাবতেই কেমন নিজের প্রতি অসহ্যকর একটা রাগ হচ্ছে। আজ কতগুলো দিন হয়ে গেল সে বখাটেদের মত আয়নার পেছনে পড়ে আছে যদিও সে রায়হানের মত উত্যক্ত করে না। বরং লুকিয়ে চুরিয়ে দৃষ্টিসীমানায় বন্দী করে রাখে আয়নাকে। অদৃশ্য সে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আয়না অগোচর হলেই আবার এহসান ছটফটিয়ে পুনরায় সীমানার ভেতর নিয়ে আসে৷ আয়না অবগত নয় তার এই মনের টানাপোড়েন নিয়ে শুধু দু চারদিন দেখেছে সে এই পুলিশটাকে৷ পুলিশটার আচরণ রুক্ষ লাগলেও চোখের দৃষ্টি তার কাছে বড্ড ন্যাকা লেগেছিলো। নাশতা করতে করতেই এহসান আজও ঠিক করলো কলেজের দিকে যাবে৷ নিয়ম শৃঙ্খলায় কঠোর থাকা এহসান আজকাল ঘুষখোর, নিয়ম না মানা পুলিশের মতোই আচরণ করছে। চাকরিজীবনে এই তার প্রথম নিয়ম ভাঙা। নয়াগঞ্জ থানায় বদলি হয়ে আসার খুব বেশিদিন হয়নি তবুও এলাকায় তার পরিচিত বেশ। কিন্তু বর্তমান করা ঔদ্ধত্য ভাব না জানি তার সম্মানের ওপর ঘা দেয়! তারই’বা কি করার আছে? মন বড্ড বেপরোয়া হয়ে উঠেছে তার পুঁচকে একটা মেয়ের জন্য । কে জানে কি করে এমন হলো চোখের তারায় জ্বলজ্বল করে সেই পুচকে মেয়েটার মুখ। খেতে, বসতে, ঘুমোতে সব অবস্থাতেই কেমন টিকটিক করে কানে বাজে মেয়েটার বলা, “অন্ধউলুশ” শব্দটা। গত সপ্তাহের ঘটনা , এহসান প্রতিদিনকার সেদিনঔ গিয়েছিলো কলেজের সামনে। সেদিনও সে আয়নাকে লুকিয়ে দেখবে বলে কলেজের সামনের লাইব্রেরি শপে ঢুকেছিলো। কিছু কেনার নেই তবুও সে এদিক ওদিক তাকিয়ে শপটাকে দেখার ঢং করেই আবার বাইরে নজর রাখছিলো। সে কি জানতো আয়না সেদিন কলেজে ঢোকার আগেই লাইব্রেরিতে ঢুকবে! তুহিন তাকে গেইটের কাছে রেখে নিজের কলেজের দিকে চলে যেতেই আয়না তার এক বান্ধবীকে দেখতে পেল। একটা খাতা কেনার ছিলো বলেই বান্ধবীটিকে বলল, “চল তো তৃষা একটা খাতা কিনবো।”
লাইব্রেরি শপটা খুব লম্বাটে আর বেশ বড়। ভেতরে ঢুকে দাঁড়ানোর মত জায়গা আছে বেশ খানিকটা তাই আয়নারাও একটু ভেতরে ঢুকলো। কথা বলতে বলতে ঢুকতে গিয়েই খেয়াল করেনি সামনে থেকে কেউ একজন আসছে৷ এহসানেরও দৃষ্টি ছিলো কলেজ গেইটের দিকটাতে আর তাতেই ঘটলো দূর্ঘটনা। দুজনের বেখেয়ালিপনায় জোর এক ধাক্কা লাগলো দুজনে। আয়নার কপাল গিয়ে ঠেকলো এহসানের বুকের ওপর পকেট বরাবর তার ছোট্ট নেম কার্ডটাতে৷ পাতলা ধাতবের মত নামের ওপর কপাল লেগেই একটুখানি চোট পেয়ে আর্তনাদ করে উঠে আয়না । এহসানও আকস্মিক ধাক্কায় হতচকিত হয়। দুজনেই তাকায় দুজনার দিকে৷ কপাল কুঁচকে নাক ফুলিয়ে আয়নাই প্রথমে ধমকে উঠে, “চোখে দেখেন না!”
এহসান বোধহয় বুকের কাছে আয়নাকে দেখতেই তব্দা খেয়েছে। সে কোন জবাব না দিয়ে বোকার মত তাকিয়ে আছে আয়নার দিকে৷ একটু একটু টের পাচ্ছে তার হৃদযন্ত্রের ধকধকানি প্রবল হচ্ছে৷ তার উনত্রিশ বছর বয়সী জীবনে প্রেমে পড়তে গিয়েও ঠিকঠাক পড়া হয়নি তার। এখন কোথায় প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ে দেখে বিয়েশাদি করে সংসারী হবে তখন কিনা এমন এক বাচ্চা মেয়ের প্রেমে দিওয়ানা হয়ে লাফাঙ্গাগিরি করছে!
আয়না তার ধমকানির কোন জবাব না পেলেও এহসানের তাকানো দেখে বেশ বিরক্ত হয়েছিলো। তাকে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতেই উচ্চারণ করেছিলো, “অন্ধউলুশ।”
এহসান শুনলেও কিছু বলেনি তবে ফিরে এসে মনে পড়েছিলো অন্ধউলুশ মানে কি! ভাবছে একদিন সময় সুযোগ করে সে জিজ্ঞেস করবে এর অর্থ কি?
মুড তো আজ অনেকদিনই হলো ঠিক থাকে না তাসিনের। কিন্তু আজ সকাল থেকে থাকা খারাপ মুডটাই হুট করে ভালো হয়ে গিয়ে আবার খারাপ হলো। সকালে ফোনটা চেক করেনি। অফিসে এসেও ইচ্ছে ছিলো না চেক করার। মূলত মা আর সুপ্রভা দুজনের জন্যই তো মনের আবহাওয়া এতোটা খারাপ তার তাই আর ফোনটাতে নজর বুলায়নি। কিন্তু এখন লাঞ্চ ব্রেকে একটুখানি ফেসবুকে ঢু মারতেই ফোনটা হাতে নিয়েছিলো আর তখনি চোখে পড়লো সুপ্রভার নাম্বার থেকে একটা মেসেজ। মেসেজ এসেছে দেখেই মুড ভালো হয়েছে এবং তা পড়তেই মনটা খারাপ হয়েছে। সুপ্রভা লিখেছে, হাতের প্লাস্টার আর দু দিন পরই উঠে যাবে তখন কি আমার পূর্ব পাওনা ট্রিট অফারটা পুনরায় পেতে পারি?”
‘হাতের প্লাস্টার’ এই দুটো শব্দই যেন পাহাড় পরিমাণ ওজন নিয়ে বুকে ভর করলো। মুহূর্তেই দমবন্ধ অনুভূতির আভাস। এ কেমন যন্ত্রণা! তাসিনের পুরো দিন কাটলো অস্থিরতায়। সুপ্রভাকে তখনি সে ফোন করলো না। মন বলছিলো দু এক মিনিটের কথা বলায় বুকের ভার নামলো না। তাই রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করে রাতেই রুমে বসে কল দিলো। কিন্তু ফোনকলটি পৌঁছুলো না সুপ্রভার কাছে৷ রাতভর ছটফট করে প্রথম দেখার বৃষ্টিময় রাতটা কল্পনা করেই কাটিয়ে দিলো। পরেরদিনও শ্রান্ত চোখমুখে অফিস করে আবারও একরাশ মন ভার করা পাথর বুকে নিয়ে রুমে ফিরলো। সুপ্রভার মেসেজের পর দুদিন কেটে গেলো আবারও তাসিনের প্রচণ্ড অসুস্থ মন নিয়ে। রাতে মায়ের আবারও ফোন এলো সে চুপচাপ এড়িয়ে গেল কলটা। ঘুমানোর আগ মুহূর্তে মামীর ফোন এলো। সে সালাম দিয়ে মামীর হাল জিজ্ঞেস করতেই মামী বলল, “তাসিন একটা প্রশ্ন করবো সত্যি জবাব দিবি?”
“প্রশ্ন!”
“হ্যাঁ বাবা। তুই তো আমায় কিছু লুকাস না আজ একটা কথা জানতে চাইবো না লুকিয়ে জবাব দিবি?”
“ওরে বাবাহ্! এভাবে বললে তো ভয় লাগছে মামী!”
“ভয় পাওয়ার কিছু নেই শুধু সঠিক জবাবটা দিবি আমি কাউকে কিছু বলবো না।”
ব্যস, মামীর এ কথাতেই তাসিন বুঝতে পারলো মামী কি জিজ্ঞেস করবে। এই সহজ সরল মানুষটাকে সে এমনি এমনি বলে নাকি! ঠিক বাবার মত করে সবটা বুঝে যায় এই মানুষটার মনের কথা, ইচ্ছে আর কখনো কখনো করা আবদারগুলো তাইতো সাধ করে মেয়ে বলে সম্মোধন করে আর মামীও আহ্লাদে তাকে আব্বা বলে। মামীর প্রশ্নের আগেই সে সরাসরি জবাব দিলো, “আমার কারো সাথে প্রেমের চক্কর নেই সত্যিই। আয়নাকে আমি তার জন্মের পর থেকেই আপন বোনের মত ভেবে এসেছি। মা বললেই তো আর আমার পক্ষে তাকে বউ বলে ভাবা সম্ভব নয় মামী। বিয়েটা কি ছেলে খেলা নাকি সবাই মিলে বলল আর আমিও বিয়ে করলেই তাকে বোন থেকে বউ ভেবে নেব!”
তাসিন কিছুটা রুদ্ধশ্বাসেই সবটা বলে দিলো। মামী ওপাশ থেকে শুনলো চুপচাপ তারপরই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
“মাছুমা খুব করে ধরেছে আমায় তোমাকে রাজী করানোর জন্য। কিন্তু আমি জোর করতে নয় তোমার মুখে শুধু সত্যটা জানতে চাইছিলাম। আচ্ছা দেখি কি বলা যায় তোমার মাকে তবে একটা কথা রইলো…”
“আমি জানি কি কথা। আমি যদি কখনো নিজেই কাউকে পছন্দ করি তবে অবশ্যই আমার মেয়েকেই আগে জানাব।”
মামী হাসলেন এবং বিশ্বাসও করলেন তাসিনের কথা। আরো কিছু সময় কথা বলে ফোন রাখলে তাসিন ঘুমিয়ে পড়লো। পরেরদিন আবার যথারীতি অফিস শেষ করে এপার্টমেন্টে ফিরছিলো। কি মনে করে হঠাৎই মোড়ে এসে তিন গলির মাথায় অন্য গলিতে ঢুকে গেল। সে গলি দিয়ে বের হলেই সেই ফার্নিচার শপ সামনে পড়ে এবং তার পেছন দিকেই সুপ্রভার হোস্টেল। অবচেতন মন ক্লান্ত দেহটা টেনে চলেই গেল সে গলি পেরিয়ে হোস্টেলের সামনে কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে। কি মনে করে চোখ তুলে হোস্টেলের দেয়ালের ওপারে দোতলা আর তিন তলার করিডোরে তাকালো। কি খুঁজলো সে আদৌ বুঝতে পারলো কিনা কে জানে! লম্বাটে পুরো করিডোরটাতে চোখ বুলিয়ে আবারও দৃষ্টি নিচু করলো। আকাঙ্ক্ষিত মুখটির দেখা মিলল না বলেই হয়তো আবারও মন খারাপের মেঘগুলো জমাট বাঁধলো তাসিনের সৌম্য মুখটাতে। এলোমেলো পা ফেলে সে ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো আর তখনি কানে এলো রিনরিনে সেই কণ্ঠস্বর যা শুনতে তার কান প্রায় আজ কতগুলো দিন ধরে উদ্বেগে নির্ঘুম অর্ধরাত কাটায়।
“আমাকে দেখতেই এসেছিলেন তাই না?”
চলবে