বৃষ্টির রাতে পর্ব-২৮+২৯

0
229

#বৃষ্টির_রাতে
#রূবাইবা_মেহউইশ
(২৮)

প্রচণ্ড বজ্রপাতের পর পরিবেশ হঠাৎ করেই যেমন শীতল, নিস্তব্ধ হয়ে ওঠে ঠিক তেমনটাই হয়ে গেছে তাসিনের বুকের ভেতরটা। দূর আকাশের মেঘগুলো আচমকাই বর্ষার স্নিগ্ধতা জড়িয়ে শীতল বাতাসে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নিয়ে ঝরে পড়ছে তাসিনের মনের আঙিনায়। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এলোমেলো চুল আর লেপ্টে থাকা কাজল চোখের চঞ্চল মেয়েটি এক সমুদ্র ঢেউ নিয়ে তারই হৃদয়ে আছড়ে পড়লো যেন এই মুহুর্তে। কানের ভেতর রুমঝুম ছন্দ তুলে বেজে উঠেছে কথাটা, আমাকে দেখতে এসেছিলেন তাই না!

কয়েক পল নিস্তব্ধতা আর বেখেয়ালিতেই কেটে গেল। তাসিন যখন বুঝলো তার আচরণ নেহায়েতই হ্যাংলামি হচ্ছে তখনি সে সামলে নিলো নিজেকে। ছোট্ট করে বলল, “নাতো!”

সুপ্রভার হাস্যজ্বল আর প্রাণোচ্ছোল মুখটাতে নিমেষেই মেদুর ছায়া নামলো। প্রকৃত হাসির ছটা মুহূর্তেই বদলে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে সেও বলল, “ওহ!”

“কি অবস্থা এখন তোমার হাতে কি হয়েছিলো?”

সুপ্রভার দু হাতের দিকেই দৃষ্টি ফেলে প্রশ্ন করলো তাসিন। সুপ্রভাও ডান হাতটা দেখিয়ে বলল, বৃষ্টিতে ভিজে পিচঢালা পথে পড়ে গিয়ে ভাঙার মতোই অবস্থা হয়েছিলো।”

“ভাঙার মত অবস্থা! ” বিষ্মিত হলো তাসিন।

“ভাঙেনি তবে হাড়ে আচর পড়েছে মানে ফাটার পর্যায়েই প্রায়। ভাগ্য ভালো পনেরো দিনের প্লাস্টারেই মোটামুটি ভালো অবস্থা তবে এখনো আরও সপ্তাহ খানেক বোধহয় সাবধান থাকতে হবে।”

কথাগুলো বলার সময় সুপ্রভা নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল। তাসিনের মনে হলো সুপ্রভা কথা বলতে বলতে হঠাৎ করেই কেমন সংকোচ বোধ করছে। আর আশ্চর্য হলো এই প্রথমবার সুপ্রভা এমন আচরণ করলো। নয়তো পরিচয়ের শুরু থেকেই মেয়েটা তার সাথে বজ্রপাতের মতই আচরণ করেছে এমনকি একটু আগেও। আবহাওয়া মোটেই মেঘলা ছিলো না অথচ এই সন্ধ্যায় দূর আকাশে পূর্ব দিকে চিকন চুলের মত শুরু একটু আলোর ঝলকানি দেখা গেল। বিজলি চমকালো মাত্রই অন্ধকারাচ্ছন্ন সন্ধ্যাটাও আরো অন্ধকার হয়ে এলো।

” হোস্টেলে ফিরে যাও বৃষ্টি হবে বোধহয়।”
সাবধানী গলায় বলল তাসিন। সুপ্রভাও মাথা নেড়ে সম্মত হলো। তাসিন গলার টাইটা টেনে একটু লুস করতে করতেই গম্ভীর স্বরে বলল, “আমি আসি। সাথে ছাতা নেই বৃষ্টি নামলে ভিজে ফিরতে হবে।” কেমন যেন কৈফিয়ত দেওয়া গলায় বলল কথাটা। সুপ্রভা এবার একটু মাথা তুলে তাকালো সামনের মানুষটির দিকে। আশপাশের দোকানের এবং রাস্তার বাতির আলো তাদের ওপর পড়ছে একটু একটু। তাতেই সে খেয়াল করলো তাসিনের গায়ে থাকা সাদার মধ্যে লম্বা কালো স্ট্রাইপড ইন করা শার্টের পেটের দিকটা কুঁচকে আছে। সারাদিন বসে বসে কাজ করার দরুণ শার্টের এমন দশা। হাতা দুটো ফোল্ড করা কনুই পর্যন্ত তার সাথেডান হাতে বড় ডায়ালের বেশ দামী একটা ঘড়ি। শক্ত পুরুষালি পশমভর্তি হাতটাতে দারুণ মানিয়ে গেছে ঘড়িটা। সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট আর কালো রঙের সু’তে সম্পূর্ণ ফরমাল বেশ আর টাইটা একদম কালো হওয়াতেই বুঝি তাকে আরো একটু বেশিই ভালো দেখাচ্ছে। কিন্তু মাথার চুলগুলো হঠাৎ আসা দমকা বাতাসে এলোমেলো হতেই সুপ্রভার খেয়াল হলো সে বেহায়া নজরে তাসিনকে দেখছে। আর তখনি টুপটাপ করে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি ছুঁয়ে দিলো তাদের দুজনের মাথা, চোখ-মুখ। তাসিন তাড়া দিয়ে বলল, “মাত্রই বললাম বৃষ্টি হবে চলে যাও…”

কথা শেষ হবার আগেই সুপ্রভা তার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল এক দোকানের সামনে। প্লাস্টিক জিনিসপত্রের দোকানটার সামনের অংশে লম্বাটে খোলা জায়গা। খদ্দের বোধহয় একজনও নেই শুধু ভেতরে দুজন লোক। হয়তো একজন মালিক অন্যজন কর্মচারী। মালিক মতন মনে হচ্ছে যাকে লোকটা দেখতে অনেকটা মুরুব্বি গোছের। দোকানের সামনে হঠাৎই দুজন ছেলেমেয়ে দেখে লোকটা কপাল কুঁচকে তাকালেন তবে কিছু বললেন না। মিবিট খানেকের মাঝেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি ঝরতে লাগলো। তাসিনের এবার রাগই হলো কিছুটা। নিজেই অমন ধীরস্থিরে গল্প করতে দাঁড়িয়ে গেল বলেই তো এমন আটকা পড়লো বৃষ্টিতে৷ অথচ এই বৃষ্টিতে এদিকটায় রিকশা পাবে না তা সে ভালো করেই জানে৷ তারও ইচ্ছে ছিলো খোলা হাওয়ায় হেঁটে ফেরার কিন্তু এখন আর তা সম্ভব নয়। বৃষ্টিতে ভিজলে মাথাব্যথাটা নির্ঘাত বেড়ে যাবে। “তুমি কিন্তু হোস্টেলে চলে যেতে পারতে।”

“আমি এখনো যেতে পারবো কিন্তু আপনি!”

“আমার চিন্তা করতে হবে না। সন্ধ্যে পেরুচ্ছো তুমি হোস্টেলে ফিরে যাও।”

তাসিনের বলা শেষ হয়েছে কি হয়নি সুপ্রভা সত্যিই দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল দোকানের সামনে থেকে। বেচারা ‘থ’ হয়ে তাকিয়ে রইলো সুপ্রভার যাওয়ার পথে আর ভাবতে লাগলো বৃষ্টিটা কি বাড়বে আরো না একটু ধরে আসবে। রিকশাও এপাশে চোখে পড়ছে না। এই রিকশার শহরেও বৃষ্টিদিনে রিকশা সংকট প্রায়ই দেখা যায়। ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও ভাবে অন্য কথা। বিকেল থেকে মন উচাটন ছিলো এদিকটায় আসার জন্য সেকারণেই কিছুটা সময় বাড়ির ঝামেলাগুলো কিছুটা ক্ষণ মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়েছিল। এখন আবার সেসব ভাবনাই ঘুরেফিরে মস্তিষ্কে তোলপাড় করছে।

“এটা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যান।” সুপ্রভার কথায় ভাবনার জাল ছিলো। মুখ জুড়ে তার অখন্ড হাসির ছটা। ঝকঝকে সাদা আঁকাবাঁকা দাঁতগুলো যেন প্রত্যেকটাই উন্মুক্ত হতে পেরে আনন্দিত। সুপ্রভা একটা ছাতা নিজের মাথায় ধরে অন্য একটা এগিয়ে দিলো তাসিনের দিকে।

আজও এহসানকে দেখে বিরক্ত হয়েছে আয়না। অন্যসব মেয়েদের মত তারও এখন বোঝার ক্ষমতা হয়েছে কোন ছেলের চোখে তার জন্য কিছু আছে, কে কখন তার দিকে কোন দৃষ্টিতে তাকায়। তার বুঝতে বাকি নেই ওই আধবুড়ো পুলিশটা যে তাকে পছন্দ করে। কিন্তু এই পছন্দ করা ব্যপারটাই তাকে রাগিয়ে দেয়। সে মনে মনে আঞ্চলিক ভাষায় কিছু গালিও দেয় এহসানকে। যতোই পুলিশ নামক উলুশটা লুকিয়ে তাকে দেখুক না কেন সে ঠিকই দেখে ফেলে লোকটাকে। রায়হানকে দমিয়ে এখন নিজেই কেমন রায়হানের মত বখাটেপনা করছে লোকটা। তবে এই ভালো যে লোকটা ভদ্র বখাটে। লুকিয়ে দেখলেও সামনে এসে উত্যক্ত করে না। হয়তো এলাকায় নিজের আলাদা একটা নাম আছে বলেই প্রকাশ্যে সাধু সেজে থাকে! আয়নার দেখার বিষয় না লোকটা সাধু কি অসাধু তার শুধু ভাবনা এ মাসে তাসিন ভাই বাড়ি এলেই নিশ্চয়ই মামী একটা ব্যবস্থা করবেন! তখন ওই ব্যাটা উলুশকে গুড নিউজ দিয়ে তাক লাগিয়ে দেবে। এখন শুধুই দিন গুণছে কবে যে একটা শুভদিন আসবে! মাস কয়েক পরেই তার বোর্ড এক্সাম সে চিন্তাও তাকে কাবু করছে না অথচ তাসিন ভাই এলেই বিয়ে নিয়ে কিছু একটা হবে ভাবলেই গা কাঁপিয়ে জ্বর আসতে চায়। সন্ধ্যায় নাশতা পানির পরই সে পড়তে বসেছিলো আর এখন রাত বাজে নয়টা। প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টার মত সে ইংলিশ একটা শিট নিয়ে বসেছে অথচ এতক্ষণেও একটা অক্ষরে সে চোখ বুলায়নি। শুধুই টেবিলে রেখে একবার ফোন ঘাটছে, একবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে, একবার ফেসবুকে ঢুকে তাসিন ভাইয়ের আইডি ঘাটছে, ছবি দেখছে আবার কখনো টুপ করে তাঁর ছবিতে উষ্ণ চুমুর বর্ষণ করছে। সেদিন তাসিন তার ফোন ধরে তাকে আচ্ছামত ধোলাই দিয়েছে বলে এখন আর ভুল করেও কল দেয় না আয়না। তবে নাম্বারে ফোনের ডায়ালপ্যাডে বারংবার তুলেই আবার মুছে ফেলে। কিশোরী মন প্রজাপতির পাখায় ভর করে ঘুরে বেড়াতেই বেশি ভালোবাসে। সামনে অনিশ্চিত বিপদ জেনেও সে রঙিন পাখায় নিজেকে চড়িয়ে রাখে। দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টাই তার উড়ু মন এলোমেলো হয়ে তাসিনের স্বপ্নে বিভোর থাকে। আজকাল তার প্রেমপাগলি এতোটাই প্রগাঢ় হয়েছে যে সে তার ঘুম, খাওয়া সবই ভুলে গেছে। এখনো তার সাথে তেমনই হলো। মা ডাকলো খাবার খেতে সে চট করে ঘরের বাতি বন্ধ করে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে ঘুমের ভং ধরলো। আয়নার কোন সাড়া না পেয়েই তার মা এলেন ঘরে। বাতি জ্বেলে মেয়েকে কাঁথায় মোড়ানো দেখে ভাবলেন গা গরম হলো কিনা! কাঁথা টেনে সরিয়ে কপাল ছুঁয়ে দেখলেন নাহ, জ্বর নেই। বাইরে বৃষ্টি কিংবা ঝড়ো বাতাসও নেই তবুও কাঁথায় কেন মেয়ে! অবাক হলেও কিছু বললেন না তিনি। আয়নার মা ঘর ছেড়ে বের হতেই আয়না আবার উঠে বসলো বিছানায়। আবারো ফোন নিয়ে তাসিনকে দেখতে লাগলো মুগ্ধ নয়নে।

মুরাদ আজ অফিস থেকে ফেরার পথে ছোটমাছ কিনলো অনেকগুলো। বাজার করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে তার সন্ধ্যা হলো। পথে আবার রিমনের সাথে দেখা হতেই দু বন্ধু দোকানে বসে চা আড্ডায় আরো কিছুটা সময় কাটিয়ে দিলো। আড্ডার মাঝে কথা হলো তাসিন আর সুমনকে নিয়ে। তাসিনের মত সুমনেরও সুযোগ হয়েছে ভালো একটা চাকরি আর তা এলাকার বাইরে। তাসিন আছে ঢাকায় আর সুমনের চাকরি হলো রংপুরে। মোটামুটি তিন বন্ধু চাকরিজীবন চমৎকারভাবেই শুরু করেছে শুধু রিমনটারই কিছু হয়েও হয় না। বন্ধুদের মধ্যে সর্বপ্রথম ভালো একটা চাকরি রিমনই পেয়েছিলো৷ কিন্তু তার খামখেয়ালি আর দুষ্ট আচরণে টিকলো না। এরপর আরো দু তিনটা চাকরি হলো আর হাতছাড়াও হলো। অথচ মুরাদ আর তাসিন প্রথম দফায় যে চাকরি পেয়েছে তাতেই এখনো লেগে আছে৷ গল্প করতে করতেই মুরাদ বলল, “অনেক তো হলো এবার একটা চাকরিতে থিতু হ ভাই।”

“আমি তো হতেই চাই কিন্তু মানুষগুলো আমার পেছনেই লেগে থাকে।”

“লাগে তো তোর দোষেই। যেখানেই যাস একটা না একটা ঝামেলা পাকাস। কি দরকার বল তো এত দিকে মাথা ঘামানোর? গত বারের চাকরিটা ভালো ছিলো। সরকারি চাকরি না হয়েও আলাদা ইনকাম হওয়ার সুযোগ ছিলো কিন্তু।”

মুরাদ কথাটা বলতেই ক্ষেপে গেল রিমন।সে এমনিতে যতোই বেগাভন্ড আচরণ করুক বন্ধুদের সাথে স্বভাবে একদমই সৎ। মুরাদের কথাটা পছন্দ না হওয়ায় রেগে জবাব দিলো, “কি বা’ল ভালো চাকরি ওটা? যখন তখন অসৎ লোক ঘুষ দিয়ে নিজের কাজ আদায় করতে চায় নিয়মের বাইরে গিয়ে। এমন ইনকামে আমি থুতু মারি।”

“হ্যাঁ তোর থুতুই মারতে হবে শা’লা। সব চাকরিতেই কোন না কোন দোষ খুঁজিস। এমন করলে আজীবন হয় বসে থাকতে হবে আর নয় নিজের ব্যবসা শুরু করতে হবে।” মুরাদের গলার স্বরও একটু উঁচু হলো। তারা বসেছিলো চায়ের দোকানে একটা বেঞ্চিতে৷ দুজনের হাতেই চায়ের কাপ আর তাদের পাশেই গ্রামেরই আরো দু চারজন লোক বসেছে। সবাই কৌতুহলী নজরে তাদের দেখছে। মুরাদের রাগ হলো কিছুটা সে বসা থেকে উঠে চায়ের দাম দিয়ে বলল, বাড়ি যাচ্ছি আমি।

রিমন বুঝলো বন্ধু তার রেগে গেছে। পেটুক এই বন্ধুটা রেগে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না জানে তাই আপাতত আর কোন জবাব দিলো না। মুরাদ বাড়ি গিয়ে বাজারের ব্যাগ টিয়ার হাতে দিয়ে তার মাকে বলল এক কাপ চা দিতে। টিয়া ব্যাগ থেকে বাজার বের করতে করতে অবাক হলো। সে ফ্রী আছে অথচ তাকে চায়ের কথা না বলে মাকে বলছে! আর তখনি তার চোখ দুটো বৃহৎ হয়ে গেল আর মুখ থেকে অস্ফুটে বের হলো, “হায় আল্লাহ!”

মুরাদের মা রান্নাঘরে ঢুকছিলেন চায়ের জন্য তখনি শুনলেন বউমার অস্পষ্ট উচ্চারণ।

“কি হইছে?”

“কি আর হবে হওয়ার তো সময় হয় নাই।”
রাগের মাথায়ই এমন ধারা কথা বলে ফেলেছে টিয়া। মুরাদের মা আরেকটু এগিয়ে ব্যাগের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলে কি হয়েছে বা হতে পারে। মনে মনে খুশিই হলেন তিনি। টিয়া আর তার শ্বাশুড়ি মায়ের মধ্যে আজকাল শীতল যুদ্ধ চলে৷ মুরাদের মা প্রচুর খুশি এই রাত্রিবেলা বউমাকে জব্দ হতে দেখে। তিনি অবশ্য জানেন এই জব্দ হওয়া ক্ষণিকের আর এর ঝালও তার ছেলের ওপরেই ঢালবে এই নাক উঁচু তর্কবাজ মেয়েটা। তবুও তো একটু তো শাস্তি পাবে এই মেয়েটা! তিনি আলোগোছে চা বানিয়ে ছেলের জন্য নিয়ে চলে গেলেন ঘরে। আর টিয়া রান্নাঘরের টিমটিমে আলোতে বসে ছোটছোট পাঁচমিশালি মাছগুলো কাটছে আর বিড়বিড় করে অসংখ্য কথা বলে যাচ্ছে মুরাদকে। তার সকল কথার মূল কথা, “কোন দোষে যে এই ব্যাটারে যে বিয়া করছিলাম আল্লাহ! আমারে তুইলা নাও।” বিয়ের প্রায় কিছুদিন পর থেকেই টিয়া এই বাক্যটা বলে তবে যতক্ষণ রাগ থাকে ঠিক ততক্ষণই৷ এরপরই আবার মুরাদের প্রেমে দিওয়ানী হয়ে কল্পনার রাজ্যে সুখে ভাসে। টিয়ার হাত চলছে আর মুখও চলছিলো সমান তালে। রিমন এসে রান্নাঘরে আলো দেখে এগিয়ে এলো।

” মিসেস মুরাদ বিড়বিড় করে ক্যান!”
রিমন কপাল কুঁচকে টিয়ার উদ্দেশ্যে বলল কথাটা। হঠাৎ পরিচিত তবে বাইরের পুরুষের কণ্ঠ শুনতেই ভড়কে গেল টিয়া। চোখ তুলে রিমনকে দেখতেই হালকা হেসে সালাম দিলো সে। রিমন বলল, “কি হয়েছে আমার বন্ধুরে ক্যান ঝাড়তাছো?”

রিমনের গলার স্বর শুনে ঘর থেকে মুরাদ বের হয়ে এলো। তবে কোন কথাই সে বলল না। টিয়া অভিযোগের সুরে বলল, “দেখেন ভাইয়া আপনার বন্ধুর আক্কেল। কত্তোগুলা ছোট মাছ নিয়ে আসছে এই রাতের বেলা।”

কাঁদো কাঁদো মুখ প্রায় টিয়ার। রিমন হেসে ফেলল তার আচরণে। মুরাদ বলল, ভালো না লাগলে ফেলে দাও কাটতে হবে না।

“বললেই হলো, টাকা দিয়ে আনোনি?” টিয়া পাল্টা জবাব দেয়। কাটতে কষ্ট হচ্ছে ঠিক তাই বলে কি মাছ ফেলে দিবে! অসম্ভব!

তাদের ছোট খাটো ঝগড়া চলতেই থাকবে তা জানে রিমন। সে আপাতত বন্ধুকে স্যরি বলতে এসেছে তাই তাদের তর্কের মাঝে বলল, “স্যরি মুরাদ। আমার আসলে…”

“তোর আসলে মাথা গরম হয়ে গিয়েছিলো তাই ওভাবে বলেছিস। ভুল আমারই হয়েছে হুদ্দাই বন্ধুগিরি দেখায়। যার যার ভালো সে নিজেই তো বোঝে।”

ছোট বাচ্চাদের মত অভিমান করা কথা মুরাদের৷ রিমন আবারও স্যরি বলে নিজের দোষ স্বীকার করলো। তারপর দুই বন্ধুতে আরো কিছুক্ষণ গল্প গুজব হলো সাথে সুমন আর তাসিনকেও কল করে কথা হলো চারজনে।

রাতের চমৎকার ঘুমের পর সকালটা একটু বেশিই সুন্ধর লাগছিলো সুপ্রভার। শরীর যত ঝরঝরে মন ততোই ফুরফুরে হয় এমনটাই ধারণা সুপ্রভার। কাল রাতে হাতে একটু একটু ব্যথা ছিলো কিন্তু ঘুমটা ভালো হওয়ায় এখন একদমই ব্যথাহীন শরীর। রাতে জানালা খোলা রেখেই ঘুমিয়েছিলো বলে সকালের সূর্যের আলো দারুণভাবে ঘরে ঢুকে গেছে পূব দিকের জানালা দিয়ে৷ সূর্যের আলোয় ঘরটা থৈ থৈ করছে। তাসিন রাতে তাকে একটা বার্তা পাঠিয়েছিলো, “শুকরিয়া। ঝড় তুফানের এত বড় উপকার আমি জীবনেও ভুলবো না।”

সুপ্রভা বুঝতে পেরেছিল তাসিন তাকে ঝড় তুফান বলে সম্মোধন করেছে আর উপকার বলতে তার ছাতাটাকে উল্লেখ করেছে। কিন্তু সে মুহূর্তে হাতে কিছুটা ব্যথা থাকায় আর রিপ্লাই করেনি। কিন্তু এখন সকাল হতেই মন ছটফট করছে রিপ্লাই দিতে। কি দিবে কি লিখবে ভেবে ভেবে কূল কিনারা পাচ্ছে না। এদিকে আজ তার ডিপার্টমেন্টের দুটো ক্লাসই আছে তাও কিনা সকাল নয়টায় একটা আর বারোটায় আরেকটা৷ সময়ের অভাবে আপাতত তাসিনের জন্য ভাবা মেসেজখানা তুলে রাখলো মনের মাঝেই। তৈরি হয়ে নাশতা সেরে বেরিয়ে পড়লো কলেজের উদ্দেশ্যে।

চলবে

#বৃষ্টির_রাতে
#রূবাইবা_মেহউইশ
(২৯)

ক্যাম্পাস জুড়ে রঙ বাহারি শাড়িতে সুন্দরী ললনাদের মেলা বসেছে। ছেলেরাও তাতে পিছিয়ে নেই বেশিরভাগের গায়েই পাঞ্জাবী আজ। সুপ্রভা শাড়ি পরবে না পরবে না করেও পরে নিলো। হোস্টেলে তার কোন শাড়ি আনা হয়নি তাই কাল সন্ধ্যের দিকে মার্কেটে গিয়েছিলো। সেদিন তাসিনের সাথে দেখা হওয়ার পর আবারও দুদিন কেটে গিয়েছিলো যোগাযোগবিহীন। মনের ব্যকুলতা থাকলেও বিভিন্ন কারণেই সুযোগ হয়নি কথা বলার। সুপ্রভা রাতের বেলায় সুযোগ পেত কিন্তু কোথা হতে ঝুপ করে এক পশলা সংকোচ এসে বসতো তার মনে। মন বলতো, একটা ছেলেকে যেচে পড়ে কল দেওয়াটা বিশ্রী লাগে। আবার মনটাই বড্ড জ্বালিয়ে বলল, সে তো তোকে কখনোই যেচে কল দেবে না। তার প্রেমে পাগল তুই হয়েছিস বেহায়া তো একটু হতেই হবে!

মনের যুক্তি মস্তিষ্কে খাটে না। তবুও তিনদিন পার করে মনের সংকোচ দূর করে সন্ধ্যা বেলায় সুপ্রভা কলটা দিয়েই ফেলল। তাসিন সবে অফিস থেকে বেরিয়েছিল। সুপ্রভার কল দেখে সারাদিনের ক্লান্তিমাখা মুখটাতে এক ঝলক শান্তি দেখা দিলো। মনে মনে দুটোদিন সেও বড় দ্বিধায় পড়ে ভেবেছিলো সুপ্রভাকে একটা কল করবে। আজ তো চমৎকার একটা প্ল্যানও সাজিয়েছিলো কল করার এবং সুযোগমতো দেখা করার। কিন্তু তার মনে হলো ওপরওয়ালা তাকে এতোটাও পরিশ্রম করাতে চান না তাইতো মিথ্যে বাহানা ছাড়াই কথা বলার সুযোগ দিলো।

কল রিসিভ করে সাধারণ কথাই হলো প্রথমে তারপরই তাসিন জিজ্ঞেস করলো, “কি করছো তোমার আশপাশে গাড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে।”

তাসিনের এই প্রশ্নটাতে কি একটু অধিকারসূচক সাউন্ড ছিলো! সুপ্রভার মনে হলো কেমন যেন একটু অধিকার মিশ্রিত ছিলো কথাটা। সেও জবাবে কেমন কৈফিয়ত দেওয়ার মত করে বলল, “আসলে কাল ইউনিভার্সিটিতে সিনিয়রদের একটা অনুষ্ঠান আছে। কিছুটা মেলার মতও হবে আয়োজনটা। ক্যাম্পাসের অনেকেই ছোট খাটো স্টল খুলবে আবার অনেকে মিলে দুয়েকটা নাটক আর গানেরও আয়োজন করেছে। তো আমার ডিপার্টমেন্টের মেয়েরা সবাই শাড়ি পরবে কিন্তু আমার তো শাড়ি নেই তাই বেরিয়েছিলাম।”

ওপাশ থেকে তাসিন শুধু বলল, “ওহ আচ্ছা।”

রাত নামছে ভুবন জুড়ে সেই সাথে নামছে শহুরে কোলাহলের এক ভিন্ন নিস্তব্ধতা। তাসিন কি অজান্তেই পা বাড়িয়েছে সুপ্রভার হোস্টেলের গলিতে! হবে হয়তো তার এপার্টমেন্ট অফিস পথের সোজাসুজি অথচ সে হাটছে দক্ষিণ দিকের পথে। সুপ্রভা রিকশা ডেকে তাতে উঠে পড়লো। তাসিনকেও অকপটে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কি করছেন?”

এটা কি প্রশ্ন ছিলো নাকি দেখা হওয়ার একটা সুযোগ! তাসিন চমকে ওঠে বলে বসলো, ভাবছিলাম মার্কেটে যাব দুয়েকটা টিশার্ট কেনা দরকার। কিন্তু এদিকটায় তো ঠিকঠাক চিনি না সব।

তাসিনের এই কথাটা কি খুব হাস্যকর ছিলো! এমনই তো মনে হচ্ছে তাইতো সুপ্রভা শোনামাত্র খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো।

“হাসছো কেন?”

“হাসার মত কথা বললে হাসবো না! আপনি কি নিজেকে হারিয়ে ফেলার ভয় পাচ্ছেন নাকি? বেশিই ভয় পেলে বলুন আমি নিয়ে যাচ্ছি মার্কেটে। ছোট বাচ্চা বলে কথা হারিয়ে গেলে আবার আন্টি কান্না করবেন তাঁর বাবুটা হারিয়ে গেল বলে।”

হাসি একটুও কমেনি সুপ্রভার তেমনি হেসে চলছে৷ রিকশাওয়ালা অবশ্য বার দুয়েক পেছন ফিরে দেখেছে তাকে। হয়ত ভাবছে এ কোন পাগল উঠেছে রিকশায়!

তাসিন কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ হাসিটা শুনে বলে বসলো, “রাক্ষসী হাসিটা শেষ হলে লোকেশনটা বোলো আমিও আসছি মার্কেটে।”

“সেও আসবে!” এই একটা কথাতেই আবার ঝিরিঝিরি হাওয়ায় পাতার কেঁপে উঠার মত মনটাও কেঁপে উঠলো। এ কি অবস্থা তার! তাসিনকে তো এই প্রথম দেখছে না সে। আগেও দেখেছে বরং কাকতালীয় ভাবেই প্রথম দিককার দেখাগুলো হয়েছিলো তখন তো সব স্বাভাবিক ছিলো। এখন কেন এমন লাগে তার! তাসিনের সাথে কথা বলার সুযোগ খোঁজা আবার দেখা হলেই মন নেচে ওঠে, লজ্জায় রাঙা হয় এ কেমন অস্বস্তি! মনের লজ্জা আড়াল করে লোকেশনটা বলে দিলো সুপ্রভা। মিনিট পনেরো না গড়াতেই তাসিন এসে হাজির সুপ্রভার বলা জায়গায়। সুপ্রভা অবশ্য আরো মিনিট সাতেক আগেই এসে মার্কেটের সামনে এসে অপেক্ষা করেছিলো। তারপরই দুজনে প্রথমেই শাড়ির দোকান গুলোতে ঢুকেছে। সুপ্রভা বলেছিলো আগে আপনার কেনাকাটা হোক। তাসিন বাঁধ সাধলো, আমারটা খুব বেশি জরুরি না সো লেডিস ফার্স্ট।

চার, পাঁচটা দোকান ঘুরেও সুপ্রভা একটা শাড়িও চুজ করতে পারেনি দেখে তাসিন জানতে চাইলো অনুষ্ঠানের জন্য স্পেসিফিক কোন রঙটা দেওয়া হয়েছে। সুপ্রভা জানালো তাদের তেমন কোন ডিসকাসন হয়নি যার যা পছন্দ তাই পরবে। এতেই সহজ হয়ে গেল যেন ব্যপারটা। তাসিন বলে উঠলো, “তবে তো নীল, সাদা, আকাশী অথবা লেবুরঙা একটা নিলেই হয়। না মানে মেয়েরা সাধারণত এসব রঙই বেশি পরে আমার ধারণা।”

“মেয়েদের ব্যপারে আপনিএকটু বেশিই অভিজ্ঞ মনে হচ্ছে।”
কথাটায় সুক্ষ্ম একটা টিপ্পনী ছিলো তাসিন তা বুঝতে পেরে বাঁকা হাসলো। সেও দুয়েকটা জবাব দিতে ছাড়লো না। আর এরই মাঝে একটা দোকানে ঢুকে একটা শাড়ি তাসিনেরই খুব পছন্দ হয়ে গেল। একদম সুতি গাঢ় নীল শাড়িতে লেবুরঙা ছোট ছোট ফুল। আর দুপাশের পাড় জুড়ে সম্পূর্ণ লেবুরঙা। তাসিন শাড়িটা দেখেই বলল, “এটা নিতে পারো দারুণ লাগছে দেখতে।”
সুপ্রভা আঁড়চোখে তাসিনকে একবার দেখে শাড়িটা হাতে নিলো। সত্যি বলতে তারও খুব পছন্দ হলো শাড়িটা তাই আর কথা না বাড়িয়ে দাম জিজ্ঞেস করলো। কি মনে করে তাসিন দাম মিটাতে চাইলো। কিন্তু এভাবে সরাসরি শাড়ি কিনে দেওয়ার মত সম্পর্ক তো তাদের মাঝে নেই তা ভেবেই আবার বলল, “তোমার তো একটা ট্রিট পাওনা ছিলো। তা দেওয়া হচ্ছে না তাই এভাবেই ট্রিট উসুল করে দিচ্ছি।”

সুপ্রভা রাজী হলো না। সে বলল তার ট্রিট ডিনারেই চাই। তাসিন আর জোর করলো না বাড়াবাড়ি হবে বলে। সুপ্রভা শাড়ির সাথে মিলিয়ে কিছু নীল আর লেবুরঙা চুড়িও কিনলো। গলা আর কানের জন্য অনেক খুঁজেও কিছু পছন্দ করতে পারলো না বলে বাদ দিলো কেনা। তাসিনকে যখন বলল তার টি শার্ট দেখতে সে মাথা চুলকে বলল, “আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে কাল বরং আসি।”

সুপ্রভারও বুঝি মাথায় কোন দুষ্ট কিংবা লাজুক এক বুদ্ধি খেলেছিলো তাই তৎক্ষনাৎ সম্মত হয়ে বলল ঠিক আছে চলুন ফিরি। সাড়ে আটটার মধ্যে ফিরে এসেছিলো তারা আপন গন্তব্যে। আর রাতভর চমৎকার কিছু আইডিয়া সাজিয়ে সকালে তৈরি হয়ে চলে এসেছে ক্যাম্পাসে। আর এখন অপেক্ষা সন্ধ্যে নামার। মেহরিনের সাথে দেখা হয়েছে ক্যাম্পাসে আসতেই কিন্তু মেয়েটা তাকে এড়িয়ে চলছে। সৌহার্দ্যও এসেছে কিন্তু সুপ্রভা তাকে পাত্তা না দিয়ে নিজের ডিপার্টমেন্টের কয়েকজনের সাথে আড্ডা আর ঘুরাঘুরি করছে। মনের ভেতর রঙিন প্রজাপতিরা ওড়ে ওড়ে সন্ধ্যে নামার অপেক্ষায় তাকে অস্থির করে তুলছে।

আজও এহসান চোরের মতন কলেজের গেইটের আশপাশে দুয়েক রাউন্ড চক্কর লাগিয়েছিলো। কিন্তু তার একজন মধ্যবয়স্ক কনস্টেবল আজ কিছুটা সরাসরিই বলে ফেলেছে, “এভাবে মেয়ের পেছনে ঘুরাঘুরি করাটা বোধহয় ঠিক যায় না স্যার আপনার চরিত্রে। রাগ করবেন না স্যার প্লিজ এলাকায় একটু আধটু এই নিয়ে কানাঘুষা হতে শুনেছি।”

এহসান কথাটা শুনে সত্যিই রাগ করেনি বরং একটু আহত হলো। নিজের কাছেই নিজেকে কেমন অসহ্য ঠেকলো। সত্যিই তো পদমর্যাদার কথা ভেবে অন্তত তার এমন করা উচিত নয়। এমনিতেই আমাদের দেশে পুলিশ আর আর্মিদের নিয়ে জনসাধারণের ধারণা বেশ তরল। পু’লিশ মানেই ঘু”ষখোর, জো’চ্চোর আর আ’র্মি মানেই বউ পে”টায়। নিজের প্রতি একটু রাগও হলো এহসানের। সে তো এখন আর সেই বিশ, বাইশ বছরের তরুণ নয়। এখন তো তার নিজের আবেগ, অনুভূতির ওপর প্রবল নিয়ন্ত্রণ আনতে পারে সে তবে কেন ওই পুঁচকে আর কপাল কুঁচকে রাখা মেয়েটার প্রতি এত দূর্বল হচ্ছে! সে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলো মেয়েটি মোটামুটি ভালো অবস্থাপন্ন পরিবারের একমাত্র মেয়ে। এবং মেয়েটির বাবা যথেষ্ট শিক্ষিত সে হিসেবে মেয়েকে নিশ্চয়ই একটা বয়স পর্যন্ত পড়াশোনা করিয়ে তবেই পাত্রস্থ করবেন। ততদিনে তো এহসানের দু একটা ছেলেমেয়েও হয়ে যাবে। এমনিতেই মা সেই কবে থেকে পাত্রী দেখার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এ সপ্তাহেও দুজন পাত্রীর ফটোসহ বায়ো পাঠিয়েছেন। কি যে হবে তার এই মন নিয়ে! মাকে বলে দিতে ইচ্ছে করে মেয়েটির কথা কিন্তু মা তাহলে সরাসরি প্রস্তাব নিয়ে হাজির হবেন। আর মেয়ের পরিবার হয় ‘হ্যাঁ’ বলবে অথবা ‘না’। যদি উত্তর ‘না’ হয়! নাহ, আর ভাবা যায় না এসব। কষ্ট লাগে এহসানের তার মনে হয় একটু চান্স কি নিয়ে দেখা ভুল হবে! কয়েকটা দিন যাক চোখে চোখে মেয়েটা যদি তাকে নিয়ে একটু ভাবে তাহলে ক্ষতি কি? বরং এটাই ঠিক নিজ থেকেই চেষ্টা করে দেখুক কোন পজিটিভ সাইন পাওয়া যায় কিনা। ভাগ্য ভালো হলে হতেও তো পারে৷

সারাটাদিন ক্যাম্পাসের ভেতরই এটা সেটা কেনা, গান শোনা, সিনিয়রদের করা মঞ্চ নাটক দেখা আবার লান্চের জন্য ফ্রেন্ডরা মিলে ক্যাম্পাসের সামনের ডিলাইট ফুড কর্ণারে গিয়ে মজার মজার খাবার খাওয়া এসবেই কেটে গেছে। সারাদিনের হুল্লোড়ে সুপ্রভার সাথে আরো একটা ভালো ঘটনা ঘটলো মেহরিনের ‘স্যরি’ বলা। সৌহার্দ্য আর সুপ্রভা দুজনকেই স্যরি বলেছে সে। এবং সেই খুশিতে সুপ্রভা আইসক্রিম ট্রিট দিয়েছিলো সৌহার্দ্য আর মেহরিনকে। এদিকে সৌহার্দ্যও পুরনো বন্ধুত্ব ফিরে পাওয়ার আনন্দে দুই বান্ধবীকে একটি করে দারুণ দুটো চিরুণি গিফট করেছে৷ কাঠের চিরুনি দুটোতে মেহরিন আর সুপ্রভার নাম খোদাই করার সুযোগ থাকায় তাই করে দিয়েছে। আজকের দিনের আনন্দ অনুষ্ঠান চরম আনন্দে কেটে গিয়ে সন্ধ্যে মুহূর্তে সুপ্রভার চেহারার অবস্থা লাগছিল ভীষণ বিধ্বস্ত। মেহরিন তার এক আত্মীয়ের বাড়ি থাকে বলে আগেই চলে গেছে। সৌহার্দ্য গাড়ি এনেছে বলে সুপ্রভাকে বলল, “চলো তোমায় হোস্টেলে পৌঁছে দেই।”

সুপ্রভা আঁতকে উঠে বলল, না না তুমি চলে যাও আমার একটু কাজ আছে।

সৌহার্দ্য জানতে চাইলো কি কাজ৷ সুপ্রভা তা এড়িয়ে গিয়ে বলল সৌহার্দ্য যেন চলে যায়। ব্যাপারটা সৌহার্দ্যের ভালো লাগলো না কিন্তু জোর জবরদস্তিও করলো না। আজই তো সব স্বাভাবিক হলো আজই তাকে চটিয়ে দিতে চায় না। সুপ্রভা ফোন স্ক্রীণে সময় দেখলো পাঁচটা বাজে সবে। তাসিন বলেছিলো তার অফিস টাইম পাঁচটা পর্যন্ত। কিন্তু একদম এ সময়টাতেই কি ফোন দেওয়া ঠিক হবে! লোকটা আবার কিছু ভেবে বসবে না তো! দ্বিধার পাহাড় বুকে নিয়েই কলটা করে বসলো সুপ্রভা। মাত্রই কম্পিউটার শাট ডাউন করে এলোমেলো ফাইলগুলো গোছাতে হাত দিলো ফাইলে। আর সেই মুহূর্তেই ফোনটা ভাইব্রেট করলো পকেটে৷ বা হাতে ফাইলগুলো সামনে টেনে ডান হাতে ফোনটা বের করলো। কলারের নাম দেখেই ঠোঁটে চওড়া হাসি টানলো। এমন কিছুই তো চাচ্ছিলো মনে মনে। অগোছালো ফাইল অগোছালোই রয়ে গেল ডেস্ক জুড়ে৷ জরুরি কিছু কাগজপত্রও আছে সেগুলোতে৷ কি ভেবে ফোনটা কানে ধরে সবগুলো ফাইলো এলোমেলো অবস্থাতেই তার লকওয়ালা ড্রয়ারে রেখে লক করে দিলো। ওপাশ থেকে ভেসে এলো রিনরিনে কণ্ঠ, “টি শার্ট কিনবেন বলেছিলেন না রিকশা নিয়ে সেই লোকেশনেই চলে আসুন।”

ঠোঁটের হাসি বোধহয় এবার চোখেও ভাসলো তাসিনের। সুপ্রভার এমন কথাগুলো শুনলে কেমন যেন আপন আপন অনুভূতি গাঢ় হয়। মেয়েটা কি বোঝে তার এমন আদেশ, আজ্ঞা শুনলে মনে হয় ঘরের ঘরণী কিংবা বহুদিনের প্রেম করা প্রেমিকা বলছে কথাগুলো! গুনে গুনে পঁচিশ মিনিট সময় লাগলো তাসিনের পৌঁছুতে। মনের ভেতর যে উত্তেজনা তাকে অস্থির করে তুলছিলো তা দ্বিগুণ হলো সুপ্রভাকে প্রথম পলক দেখতেই। কালকের কেনা নীল শাড়িটা পরনে দু হাত ভর্তি গাছি গাছি চুড়ি, চোখের কোলে লেপ্টে আছে কাজল , নাকের ওপর আর আশপাশটা চিটচিটে তেল, কপালেও ঘাম আর তৈলাক্ততায় লেগে আছে এলোমেলো কিছু চুল। ঠোঁটের মাঝে আবছা আবছা লিপস্টিকের ছাপ। গভীর দৃষ্টিতে লক্ষ্য করতেই তাসিনের মনে হলো কপালের মাঝে একটা টিপের কমতি রয়ে গেছে। অথচ সুপ্রভা কিন্তু কানে, গলায় কিছুই পরেনি। তার সকল সজ্জা হাত আর চোখেই ছিলো। চুলগুলো অবশ্য খোলাই রেখেছিলো। কখন যে গরমে অতিষ্ঠ হয়ে হাত খোঁপা করেছিলো মনে নেই।

তাসিন অবাক চোখে চেয়ে থেকে স্বগোতক্তির মত বলে উঠলো, “তুমি খুব সুন্দর মেয়ে!”

“কিহ!”

“Tu eres belissima chica” (spanish)

“এটা আবার কি?”

চলবে