#বৃষ্টির_রাতে
#রূবাইবা_মেহউইশ
(৩৭)
বেশ আপ্যায়ন চলছে এহসানের হবু শ্বশুর বাড়ির লোকদের। আয়নাদের বাড়িতে তো হুট করে রাতের খাওয়া হয়েছে তাই আয়োজন খুব একটা হয়নি। কিন্তু এহসানের আম্মা পূর্বপ্রস্তুতি নিয়েই বিশাল আয়োজন করেছেন। তার আয়োজনের বহর দেখে আয়নার বাবা ইতস্তত করছেন খুব। আজ ভেবেছিলো শুধু দু তিনজন এসে দেখে যাবে পাত্রের বাড়িঘর। কিন্তু এহসানের মায়ের ফোন করে জোরাজোরি করায় বাধ্য হয়েই তাদের মোটামুটি মুরুব্বি বলতে যে ক’জন আছে সবাইকেই নিয়ে আসা। এহসানও আজ ছুটি নিয়ে বাড়িতে আছে। আয়নাদের বংশে খুব একটা আত্মীয় স্বজন নেই তাই লোকজনের সংখ্যাও খুব কম। আয়নার বাবা তার দাদার একমাত্র সন্তান কিন্তু তার দাদার বড় একটা ভাই ছিলো সেই ভাইয়ের দুজন ছেলে। বংশে এখন মুরুব্বি বলতে আয়নার বাবার সেই চাচাতো ভাই দুটোই। এদিকে আয়নার মায়ের দিককার আত্মীয়ও তার মামা। তাই আয়নার বাবা তার সেই চাচাদের আসতে বলেছিলেন। ছোট চাচা ব্যস্ত থাকায় শুধু বড় চাচাই এসেছেন। আয়নার বাবা, মা, তার মামা-মামী আর তাসিনের মামী বাড়িতে ছিলেন বলে তাকেও জোর করেই নিয়ে এসেছেন। তারা ছেলের বাড়ি এসে সবাই খুব অবাক হলো। এ বাড়িতে তো এলাহী কান্ড যেন আজই বিয়ের কোন অনুষ্ঠান হচ্ছে। তাসিন বার কয়েক ফোন করেছে একবার মায়ের কাছে একবার মামীকে আর ভোর সকালেই করেছিলো ফুপুকে। কারণ সে সুপ্রভার মাধ্যমেই জেনেছে তাদের বাড়িতে সবাই এই বিয়ের জন্য খুব প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাই তাসিন এবার ফুপিকে ফোন করে খুব নরম আর বিনতির সুরে কিছু কথা বলেছে সেই সাথে আয়নার মতামতের কথাও বলেছে। ফুপি আজ কথা বলতে গিয়ে খুব কেঁদেছে সেই সাথে এও বলেছে তিনি তাসিনের ওপর একদমই রাগ করেননি, অভিমানও না। বরং কষ্ট পেতেন তাসিন যদি তার মায়ের কথা মেনে আয়নাকে ভালো না বাসা সত্ত্বেও বিয়ে করতো। তাসিন নিজের দিক থেকে একদম পরিষ্কার আছে সে কিছুতেই সমঝোতার কোন সম্পর্কে জড়াতে চায়নি কখনো। এতে নাতো সে মানসিক ভাবে সুখী থাকতো আর না আয়নাকে রাখতে পারতো। ফুপির সাথে কথা শেষ করেই সে আয়নাকেও কল দিয়েছিলো। আয়না ফোন তুলে লাউডে দিয়ে চুপচাপ বসেছিলো। তাসিন কল না কাটতে দেখে বুঝলো আয়না কথা বলবে না তবে শুনবে। তাই সে তাকে ডাকলো, “আয়না।”
……
কোন জবাব এলো না আয়নার পক্ষ থেকে। তাসিন আবার বলল, ” এ্যাই আয়না তুই কষ্ট পাস না বোন। বিশ্বাস কর আমি অনেক ভেবেছি তোকে নিয়ে। তোকে আমার অর্ধাঙ্গিনী করতে পারলে তোর চেয়েও বেশি খুশি আমার মা হতো, আমার ফুপিটাও হতো। আমি জেনে বুঝে আমার এত আপন মানুষগুলোর খুশি কি নষ্ট করতে পারি বল! নষ্ট করার কথা কেন বলছি এবার তা শোন, আমরা চাইলেই বিয়ে করতে পারি, কিন্তু সেই বিয়েটা সারাজীবন গলার কাঁটার মত বিঁধে থাকতো সারাজীবন। আমার এখনও মনে পরে তোর জন্মের পর আমি তুহিনের চেয়েও বেশি তোকে কোলে নিয়েছি। তুহিন তো তোর সমবয়সী তোর থেকেও পাঁচ মাসের বড়। আমি তোদের দুজনের মধ্যে বরাবর তোকেই বেশি আদর করেছি কারণ আমার ছোট্ট একটা বোন চাওয়া ছিলো। সেই চাওয়া তোকে পেয়ে পূরণ হয়েছিলো। মাকে জিজ্ঞেস করিস আমি তুহিনকে একদমই সহ্য করতে পারতাম না কারণ আমার ভাই না বোন চাওয়া ছিলো। তোর জন্মের পর থেকেই আমি তোকে মাইশার মত আদর স্নেহে রেখেছি এখন হুট করে সবাই যদি বলে তোকে বিয়ে করতে তখন আমার এত বছরের ভাবনার ওপর কেমন প্রভাব পড়বে! কি করে আমি তোকে বউ..”
এ পর্যন্তই তাসিনের কথা হয়। তারপর আয়না কল কেটে দেয় কিছু না বলেই। বাড়ির লোকজন যখন এহসানদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় তখন থেকে এখন পর্যন্ত আয়না বিছানাশ পড়ে কাঁদছে। বাড়িতে আয়না একা বলেই আজ নুড়ি আর মাইশাকেও রেখে গেছে এ বাড়িতে। দুপুরে পটল আর তুহিনও চলে আসবে তারপর তারা এখানেই খাবে একসাথে। কিন্তু আয়নার কান্নায় অস্থির হয়ে তার আশপাশে পায়চারী করছে মাইশা আর নুড়িও একবার ঘরে একবার রান্নাঘরে ছুটছে। বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষেরই জানা আয়নার মনের খবর আর তাই অনেকেই মনে মনে তাসিনকে বকছে। নুড়ি বিড়বিড় করে বকছে কোন এক অজানা মেয়েকে। তার ধারণা তাসিন কোন মেয়ের পাল্লায় পড়েছে। মাইশাও ভাইকে মনে মনে কটুকথা শোনাচ্ছে আয়না আপাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য। বকছে মনে মনে মাছুমা নিজেও তার ছেলেকে কেন ঘরের মেয়েটাকে পরের ঘরে পাঠাতে হবে! এহসানদের বাড়ি এসে অব্দি সে কারো সাথে কথা বলেনি। এ বাড়িতে এসে সবার উজ্জ্বল মুখশ্রী দেখতেই মাছুমার মনে হলো আয়না খারাপ থাকবে না এখানে বিশেষ করে এহসানের ঘরে ঢুকে তার মনে হলো এই ছেলেটা বেশ গোছালো। তাসিনও পরিপাটি কিন্তু এই ছেলেটার ঘর বলছে ছেলেটা আরো অনেক গোছালো এখানে একটা ধূলোকণাও খুঁজে পাওয়া মুশকিল মনে হচ্ছে। আর ঘরের আসবাব দেখে মনে হচ্ছে হবু বউয়ের প্রয়োজনটাই আগে ভেবেছে সে। তাসিন আর তুহিনের মুখে শুনেছিলো ছেলেটা আয়নাকে পছন্দ করে। কিন্তু এ ঘরে পা দিয়ে মনে হচ্ছে ছেলেটা খুব ভালোও বাসবে আয়নাকে আর তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য সব করতে পারবে। ঘরটা নতুন করে সাজানো তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। খাটটা পুরনো হলেও পড়ার টেবিল, ড্রেসিংটেবিল, তিন পাল্লার আলমারি আর খালি ফটোফ্রেমগুলো একদমই নতুন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পুরো বাড়িটাই দেখলো মাছুমা এবং ভুল করেই অথবা ইচ্ছাকৃত কিনা কে জানে মাছুমা এহসানের ঘরের বারান্দায় উঁকি মেরেছিলো। সেখানে টবে করে চারটে গোলাপ গাছ এবং চারটাই হলুদ গোলাপের। মাছুমার মনে পড়ে যায় আয়নার বছর কয়েক আগের কথা। তাসিন বাড়িতেই ছিলো তখন আর আয়না খুব সম্ভব তখন ক্লাস এইটে পড়ে৷ তাদের আম বাগানে তাসিন একটা লিচু গাছ লাগাচ্ছিলো তা দেখে আয়না বাঁধা দেয়। মাছুমা আরো একটা আম গাছের চারা নিয়ে সেখানেই আসছিলেন লাগাবেন বলে। আয়না বারণ করে, “তাসিন ভাই এদিকটায় আর গাছ লাগিয়ো না।”
কেন? কৌতুহলী হয়ে তাসিন প্রশ্ন করতেই আয়না বলে এখানে চারটা গোলাপ গাছ লাগাবো।
তাসিন বিরক্ত হয়ে বলে না এখানে সে এটাই লাগাবে। তার ঘরের জানালা এদিকটায়। আয়না জেদ ধরে তাসিন ঝাড়ি মারে। তারপর বিরক্ত হয়ে বলে ঠিক আছে একটা গোলাপ গাছ এনে এদিকেই লাগিয়ে দিবে। আয়না মানতে চাইলো না। তার নাকি চারটা গাছই লাগবে তা শুনে তাসিন জিজ্ঞেস করে চারটা কেন! আয়না তো লাজুক লাজুক মুখ করে বলে একটা তার একটা গাছ তার বরের বাকি দুইটা থাকবে বাচ্চা গাছ তাদের ছানাপোনা। মাছুমা তখন পেছন থেকে শুনে খুব হেসেছিলেন৷ কিন্তু অবাক করা ব্যপার হলো এত বছর পুরনো কথা আয়নার পছন্দ এই ছেলের জানার কথা নয়। তবে কি এই গাছগুলোর এখানে থাকাটা কাকতালীয়!
দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষ হতেই এহসানের বড় চাচা, ফুপু আর তার মা তিনজনেরই আবদার ছিলো সময় নিয়ে তারা এখানেই একটা সিদ্ধান্ত জানিয়ে যাক। এহসান অবশ্য কথাটা পাত্তা না দিয়ে বলেছিলো আরো সময় নেক তারা। আয়নার বাবা বললেন, পরবর্তীতে আপনারা গিয়ে সামনে আগান।
এ কথাতেই পরিষ্কার তারাও আগাতে চায় সামনে। ব্যস সে মুহূর্তেই বড়রা নিজেরা আলোচনা করে ঠিক করলেন এক সপ্তাহ পরে আকদ হবে। যেহেতু আয়না এখনো বিয়ের বয়সী হয়নি মানে সাংবিধানিক বয়সটা হয়নি বিয়ের তাই অনুষ্ঠানাদি করে পরেই আনা হবে। এহসান মানলো না। সে বলল সে অপেক্ষা করবে আয়নার বয়স আঠারো হোক আর তার সামনে পরীক্ষা সে কারণেও আপাতত এসব থাক। বড়রা এমন কিছু মানেন না তারা ভাবেন শুভ কাজ ফেলে রাখতে নেই এতে বাঁধা আসে। হতে পারে এগুলো কুসংস্কার কিংবা প্রথার নামে ভুল ধারণা তবুও তারা সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন বিয়েটাই হবে একটু না হয় বয়সটা বাড়িয়ে নেবে বিয়ের কাগজে! এহসান অবাক হয়ে যায় সকলের কথায়। সে আইনের লোক আর তাকেই কিনা বলছে বেআইনি কাজ করতে!
চলবে
#বৃষ্টির_রাতে
#রূবাইবা_মেহউইশ
(৩৮)
সম্পূর্ণ সাদা শাড়িতে হালকা ল্যাভেন্ডার রঙের আভা আর দোপাট্টার রঙটা সম্পূর্ণ ল্যাভেন্ডার। দু হাতের একটাতে স্বর্ণের চূড় অন্যটাতে এক গাছি হালকা বেগুনি রঙা চুড়ি। গলায়, কানে আর কপালে স্বর্ণের গহনা। আকদ উপলক্ষেই কিছু গহনা এহসানের মা আলাদা করে দিয়েছেন বিয়ের উদ্দেশ্যে কিছু আলাদা করে রেখেছেন। এসবের ভেতর এহসান আবার কখন যেন লুকিয়ে একজোড়া পায়েলও রেখে দিয়েছিলো টের পায়নি কেউ। সেগুলোও পরানো হয়েছে আয়নাকে আর সাজ বলতে এহসানের মায়ের কথা রাখতে পার্লারে না নিয়ে ঘরেই সাজিয়েছে। মাইশা সাজের বেলায় অপটু তাই আয়নার দুই বান্ধবী সাজাবে ভাবছিলো কিন্তু সুযোগ বুঝে সুপ্রভা সকালেই এসে হাজির হয়েছিলো আয়নাদের বাড়ি। বাহানা হিসেবে অবশ্য সে এহসানকে ফাঁসিয়েছে। এহসানের নাম করে কিছু তাজা ফুলের গাজরা মালা আর কলি গোলাপ ঢালি সাজিয়ে নিয়ে এসেছে। এহসানদের বাড়িতে শুধু রেজিস্ট্রি হওয়ার কথা হলেও আজই সকালে আবার এহসানের মা আয়নার বাবাকে ফোন করে ধর্মীয় রীতিতেও বিয়ে পড়ানোর আরজি রাখলেন। সত্যি বলতে তাসিনের বাবা যেদিন রেজিস্ট্রির কথা ঠিক হলো সেদিনই বলেছিলেন, “আমার এমন আদ্দেক( অর্ধেক) বিয়াশাদী পছন্দ না কিন্তু পোলার বাড়ি থাইকা না চাইলে যাইচ্চা ( যেচে) নিজেরা কওয়া ভাল্লাগে না।”
সময়টা মাসের মাঝামাঝি হওয়ায় তাসিনের পক্ষে বাড়িতে আসা সম্ভব নয়। সে সকালেই একবার ফোন করে কথা বলেছিলো ফুপুর সাথে। তার ফুপু এখন আর একটুও কষ্ট পাচ্ছে না তাসিনের সাথে আয়নার বিয়ে দিতে না পারায়। শুনে ভালো লাগলো তাসিনের। মনের ভেতর একটা ভার, একটা অপরাধবোধ কাজ করতো তার আয়নাকে গ্রহণ করতে না পারায়। এটাতো সত্যি সে চেষ্টা করেছিলো কারণ এতে তাদের দু পরিবার তার আপন মানুষগুলোই খুশি হতো। দিনের অর্ধেকটা পেরিয়ে গেছে সুপ্রভার আয়নাদের বাড়িতে আর এত সময়ের মাঝে তাসিন দু’বার ফোন করলেও সুপ্রভা একবারও কথা বলতে পারেনি। প্রথমবার কল রিসিভ করে কানে তুলেছিলো ঠিক সে সময়েই আয়নার মা এসে কথা বলছিলেন তার সাথে৷ আর পরেরবার আয়নার পাশে বসা ছিলো সে তখন মাইশা আর আয়নার দুই বান্ধবীও ছিলো পাশে। বিয়ে পড়ানো হবে সন্ধ্যায় আর তাই বরপক্ষ আসবে সন্ধ্যায়ই। সুপ্রভা ভেবেছিলো সকালে এসে শুধু কনে দেখেই সে চলে যাবে টিয়ার বাড়িতে৷ কিন্তু কিছুতেই ছাড়লো না কেউ তাকে৷ শত হোক বরের পক্ষের আত্মীয় বলে কথা। বরের আপন ফুপাতো বোন সে জোর করে হলেও বিশেষ আপ্যায়ন করতে হয় বলেই দুপুরে আয়নাদের বাড়িতে খেতে হলো। কিন্তু সন্ধ্যার প্রোগ্রামের জন্য সে ব্যাগে করে পোশাকও এনেছে কিন্তু এখানে সে তৈরি হতে চায় না। টিয়ার কাছেই গিয়ে তৈরি হয়ে বসে রইলো সুপ্রভা। দু বান্ধবীতে গল্প হলো অনেক আর সে ফাঁকেই টিয়াকে বলে দিলো তার তাসিনের প্রতি ভালোলাগা আর ভালোবাসার কথাটা। দিনটা শুক্রবার হওয়ায় মুরাদের ছুটি ছিলো। সে বিকেলে একটু বেরিয়েছিলো বন্ধুদের সাথে দেখা করতে আর যখন সে বাড়ি ফিরলো তখন শুনতে পেলো তার শোবার ঘরে তার স্ত্রী আর তার বান্ধবীর কথোপকথন।
“তোর কি মনে হয় তাসিন ভাই এখনও সিঙ্গেল?”
“মনে হবে কেন আমি শতভাগ শিওর সিঙ্গেল আর সিঙ্গেল বলছি কেন লোকটা বদ আমাকে পছন্দ করে কিন্তু মুখে বলে না।”
রিমন গলা খাকাড়ি দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েও দিলো না।লুকিয়ে কারো কথা শোনা মন্দ কথা কিন্তু সেই কথা যদি হয় জানে জিগার দোস্ত সম্পর্কে তখন সব জায়েজ। মুরাদের মনে হলো এত সুন্দর মুহূর্তটা বন্ধুর অগোচরে কেন থাকবে!
মুরাদ দ্রুত ভিডিওকল করে ফোনের কল ভলিউম জিরো করে নিলো। তাসিন ভিডিও কল বলেই একটু অবাক হয় তবে যথা সময়েই রিসিভ করে। হ্যান্ড ফ্রী লাগানো তাই আরো একটু সুবিধা হয় তাসিনের। সে অফিসের বাইরে এসেছে তখন সবে। কল রিসিভ করে স্ক্রীণে তাকাতেই ভড়কালো তাসিন। ক্যামেরায় অর্ধেকটা অন্ধকারাচ্ছন্ন তার ফাঁকে প্রিয় একটি মুখের একপাশ দৃশ্যমান। সে আবারও একাউন্ট চেক করলো না এটা মুরাদেরই নম্বর তাহলে সুপ্রভাকে কেন দেখছে! বার কয়েক হ্যালো হ্যালো করলো তসসিন কিন্তু কোন জবাব এলো না তবে একটু মনঢ়োগ দিতেই শুনতে পেল সুপ্রভার কথা, “এহহহ নিজে থেকে সে প্রপোজ না করলে আমি আমার অনুভূতির খোলাসা কখনোই করবো না।”
কথাটা কর্ণগোচর হতেই শিউরে ওঠে তাসিন। সুপ্রভা কি তার কথা বলছে! সে পথ চলতে চলতে ধ্যান হারিয়ে ফেলল মুহূর্তেই। মন চলে গেল দূর গ্রাম নয়াগঞ্জে মুরাদের ঘরটিতে। সুপ্রভার কথা শুনেই টিয়া আবারও বলেছিলো, “তাসিন ভাই যদি কখনোই না জানায় তোকে মনের কথা! তুই নিজেই বললি আয়না নাকি উনাকে ভালোবাসে আর উনি তাকে ভালোবাসে না বলেই যত্রতত্র করে এহসান ভাইয়ের সন্ধান পেয়ে আয়নাকে গছিয়ে দিচ্ছে সেদিকে। তোকেও যদি না ভালোবাসে!”
“কেন অগোছালো কথা বলছিস টিয়া? এখন কি তোর আমাকে ভয় না দেখালেই চলছে না! আমি সত্যিই রে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি তাকে। কবে, কখন আর কেমন করে জানি না শুধু বলতে পারি তার চোখের তারায় লুকানো এক হাসি থাকে। সেই হাসি চোখে পড়তেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। তার কথার পিঠে কথা বলতে গেলেই আমার ভেতর থেকে এক ভিন্ন উচ্ছাস আনন্দের লহরি বইয়ে দেয়। আর তার দুষ্টুমির ছলে আমাকে ‘তু*ফান’ বলে সম্মোধন করাটাও আমায় বিমোহিত করে। কি এক ভালোলাগায় আমি ম*রে যাই প্রতিটাক্ষণ৷ প্রায়ই যখন মিথ্যে কোন বাহানায় এসে আমার হলের সামনে এসে দাঁড়ায় আমি করিডোরে দাঁড়িয়ে দেখি অফিস ফেরতা ক্লান্ত মানুষটা কি যেন খুঁজতে থাকে আমাদের হলের দোতলার বারান্দায়। তখন বুকের ভেতর বসন্তের হাওয়া দাপিয়ে বেড়ায় ছোট্ট টুনটুনির চন্চলতার মতন। আমি আনন্দে ভেসে যাই।”
তাসিন চুপচাপ শুনতে শুনতে বিভোর হয়ে কখন যে রাস্তার কিনারা থেকে মাঝখানে চলে এসেছে তার খেয়াল নেই। কোম্পানির নিজস্ব পথেই ছিলো সে তখনও। এ পথে ফ্যাক্টরির বিশাল বিশাল ট্রাক আর কর্গো ছাড়া দুয়েকটা রিকশারও যাতায়াত আছে। তাসিনের অন্যমনস্কতায় হঠাৎই সে এক রিকশার সামনে এসে পড়লো। রিকশার চাকা ডাব পায়ের ওপর উঠে গেছে , হাত থেকে ফোন ছিটকে পড়েছে তৎক্ষনাৎ। রিকশাওয়ালা চেঁচিয়ে তাকে সরতে বলার পরও বিপদ ঘটেই গেল। এতে রিকশাওয়ালার কোন দোষ নেই রিকশায় বসা যাত্রী তাই খিস্তি দিয়ে উঠলো তাকে। পায়ে কালো সু পরা তবুও আঘাতটা মোটামুটি লেগে গেছে। অফিস ছুটির পরের সময় হওয়ায় পরিচিত আরো কয়েকজন ছিলেন আশপাশে সবাই হৈ হৈ করতে করতে এগিয়ে এলেন। দুজন মিলে তাসিনকে কোম্পানির ক্লিনিকেই নিয়ে গেলেন আরেকটা রিকশা ডেকে। তাসিনের গাড়ি সে বাড়ি থেকে আসার সময় নিয়ে আসলেও অফিসে কখনো গাড়ি নিয়ে আসেনি। তাদের এপার্টমেন্ট গ্যারেজেই পড়ে থাকে গাড়িটা শুধু মাঝেমধ্যে সন্ধ্যার পর ককনো সখনো নিয়ে বেরিয়েছিলো সুপ্রভার সাথে ঘোরার জন্য৷ কিন্তু এই মুহুর্তে তার মনে হলো এই যে সে গাড়ি নিয়ে বের হয়না এটাই মঙ্গলজনক।
সন্ধ্যার পরপরই বিয়ে পড়ানো হলো আয়নার। ঘরোয়া অনুষ্ঠানে মানুষ বলতে তাসিন বাদ দিয়ে পুরো পরিবার, এহসানের চাচাতো বড় দুই ভাই, ভাবী আর সুপ্রভার মা, বাবা, মীরা সুপ্রভা৷ এহসানের বাবা নেই বলে সুপ্রভার বাবাই মুরুব্বি হিসেবে আছেন। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতেই এহসানকে আয়নার ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। মাইশা আর সুপ্রভার উৎসাহে আয়না দেখা আর মিষ্টিমুখ পর্ব করা হলো খুব হৈ চৈ এর মধ্যেই। পুরোটা সময় আয়না থম মেরে বসে ছিল একরকম মূর্তির মত। রাত নয়টার পরপরই বাড়ি ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলে তাসিনের মা আর সুপ্রভার মা দুজনেই বললেন, বিয়ের প্রথম রাত ছেলে মেয়ে দুটোকে আলাদা রাখার দরকার নেই। এমনিতেও আয়নাকে তারা ছয় কি সাত মাস পর বাড়ি নিবে তার আগে আর এহসান আসবে বলে মনে হয় না। কিন্তু প্রথম রাতটা তারা একসাথেই কাটাক।” ছেলের ফুপু আর মেয়ের মামী দুজনেই বড় আর সম্মানীয় মানুষ তাই মিনতিও আর অমত করেননি। বরং তিনি নিজেও চাচ্ছিলেন জামাই আজ এখানেই থাকুক। এহসান যেন এমন কিছুই চাইছিলো সেও ফুপু একবার বলতেই থেকে গেল। বাকিরা চলে গেল রাত দশটার মধ্যেই। সুপ্রভা যাওয়ার আগে একবার আয়নার সাথে দেখা করতে তার রুমে প্রবেশ করেছিল। এহসান তখন আয়নার রুমেই একটা চেয়ারে বসা। সুপ্রভা মুচকি হেসে এহসানকে বলল, “এটা কি করলে ভাইয়া এইটুকুনি একটা পুতুলকে বিয়ে করলে এখন আমি তাকে ভাবী ডাকবো কি করে বলোতো!”
“ভাবী ডাকতে না পারলে নাম পুতুল বলে ডাকিস।”
“ইশ, সত্যিই নিজের বউকে পুতুল ভেবে বসেছো নাকি আমি তো ভাবছি নাম ধরেই ডাকবো।”
সুপ্রভার কথাটা শেষ হতেই আয়না মুখের ওপর বলে বসলো, “সম্পর্কে তো আপনিই বড় হবেন নাম ধরে বললেইবা কি!”
আয়নার কথাটায় কিছুটা ব্যঙ্গাত্বক সুর ছিলো যা উপস্থিত দুজনের কারোই বুঝতে সমস্যা হয়নি। তবে কথার ইঙ্গিতটা তাদের ঠিক বোধগম্য হয়নি। সুপ্রভার মনে হলো মেয়েটা তাকে কোন কারণে অপছন্দ করছে আর এহসান বিচক্ষণ সে যেন আয়নার কথায় কোন রহস্য খুঁজে পেল। সুপ্রভা আর কোন কথা না বলে, “শুভ বাসররাত ভাইয়া, ভাবী” বলে বেরিয়ে গেল।
হাবীব চাচা হুইল চেয়ারে করে দোতলা থেকে লিফটে গ্রাউন্ড ফ্লোরে নিয়ে এলেন তাসিনকে। হাসপাতালের সামনে রিকশা ডেকে রিকশাওয়ালার সাহায্যে তাকে রিকশায় বসিয়ে নিজেও বসলেন। ইট পাথরে ঢাকা এই শহরে আপন বলতে রক্তের কেউ নেই তবে সবসময়কার মতোই এই মানুষটা আপন হয়ে পাশে রইলেন। তাসিনের রুমে ফিরতে দেরি দেখেই তিনি কল করেছিলেন আর তখন তাসিনকে নিয়ে আসা ব্যক্তিদের একজন ফোন তুলে দূর্ঘটনার কথা জানাতেই তিনি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসেন হাসপাতালে৷ তারপর থেকে টানা দেড় ঘন্টা পাশে থেকে তাসিনের অবস্থা জেনে তাকে নিয়ে ফিরছেন। এর মাঝে অবশ্য হাবীব চাচা বার কয়েক তাসিনকে জোর করলো তার বাড়িতে খবর দিতে কিন্তু সে রাজী হলো না। সামান্য ফ্র্যাকচার আর কিছুটা ছিলে গেছে পায়ের ওপর অংশে। আপাতত প্লাস্টার করে দিতে চেয়েও ডক্টর করেননি৷ এক্সরেতে দেখেছেন হাড়ে চির নেই কোথাও তাই সাবধান থেকে নিয়মিত ঔষধ খেলে সেরে ওঠতে সময় লাগবে না। রুমে এনে তাসিনকে বিছানায় দিয়ে হাবীব চাচা বেরিয়ে গেলেন৷ আধঘন্টার মধ্যেই আবার কিছু শুকনো খাবার এনে রাখলেন তার সামনে। জোর করেই কয়েকটা বিস্কিট আর এক কাপ কফি খাইয়ে ঔষধ দিলেন৷ তাসিনও ঔষধ খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলো একসময় ঘুমিয়েও পড়লো।
উজ্জ্বল অর্ধচাঁদ আকাশে আর তাতেই শুভ্র আলো ঠিকরে পড়ছে ধরণীর বুকে৷ দক্ষিণের জানালাটা খোলা থাকায় ঘরময় শুভ্র নরম আলোর খেলা বসেছে। কাঠের চেয়ারে চেরী রংয়ের পাঞ্জাবী পরে বসে আছে লম্বা চওড়া স্বাস্থ্যের মানুষটা৷ ঘরের বাতি বন্ধ থাকায় তার মুখটা ঠিকঠাক দেখতে পাচ্ছে না আয়না তবে সে চেষ্টা করছে এহসানের মুখভঙ্গি দেখার। ভয় হচ্ছে খুব ভেতরে ভেতরে তার কাঁপন ধরছে। লোকটার চোখ চতুর শেয়ালের মত তীক্ষ্ণ তাকালেই মনে হয় তার ভেতরের গোপন কথাগুলো সব পড়ে নেবে। এহসান বসা থেকে হুট করেই দাঁড়িয়ে গেল। আয়না বসে ছিলো খাটে একটু আগেই মাইশাকে দিয়ে রাতের খাবার ঘরে পাঠিয়েছিলো মা আর মামী। আয়না খাবে না বলেছে কিন্তু লেকটা সে কথায় পাত্তা না দিয়ে তার সামনে নিজেই প্লেট দিয়ে পোলাও, মাংস, সালাদ সব তুলে দিয়েছিলো। মাইশাকেও জোর করে বসিয়েছিলো খেতে। কেমন যেন স্কুলের গণিত স্যারের মত তীক্ষ্ণ নজরে চেয়ে থেকে তাদের দুজনকে খাওয়ার আদেশ দিলো। বিয়ের দশ মিনিট আগ পর্যন্তও আয়নার মনে ছিলো বিশাল প্ল্যান। বিয়েটাকে তার মনে হয়েছিলো একটা ড্রামা পার্ট যেখানে সে ড্রামার খল নায়িকার মত সুপ্রভাকে সারাজীবনের মত আলাদা করে দিবে তাসিনের জীবন থেকে। তারপরই এই লম্বুসম্বু লোকটাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ছেড়ে দিবে বিয়ের বাঁধন থেকে তারপর….. ভোজভাজির মত পাল্টে দিবে নিজের জীবনের চিত্র। হায়! কিশোরী, অল্পবয়স্ক মস্তিষ্ক জীবনটাকে যতোটা সহজ ভেবে বসেছিলো জীবনটা আদৌও তা নয় টের পেয়ে গেল আয়না দশ মিনিটের মাঝেই। তার আবেগ এখন ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে চার দেয়ালের কোণায় কোণায়।
সুপ্রভা বাড়ি ফিরে ভেবেছিলো রুমে ঢুকেই একবার তাসিনকে ফোন করবে। কিন্তু ফিরতেই দেখা গেল বসার ঘরে বড়সড় আলোচনা সভা বসেছে। মেজদার বিয়ের ডেট ফিক্সড করতে যাবে কাল। এবং নিজেরাি আগে থেকে একটা সময় ঠিক করে নিবে বলে আলোচনা চলছে। সুপ্রভার মন বলছিলো আলোচনায় তার থাকা না থাকা সমান তাই সে পা বাড়ায় ওপরতলার দিকে। তখনি কানে এলো মায়ের কণ্ঠ, “কোথায় যাচ্ছো বসো এখানে। তোমার সাথে জরুরি কথা আছে।”
সুপ্রভা একবার আমতা আমতা করে বলল, “আমার খুব ঘুম পাচ্ছে মা।”
” নিজের বিয়ের চেয়ে ঘুম জরুরি নয়৷ চুপচাপ বোসো কথা শেষ হলে ঘুমাতে যাবে।”
চলবে