বৃষ্টিস্নাত তুমি পর্ব-৩১

0
397

#বৃষ্টিস্নাত_তুমি – (৩১)
হুযাইফা মাইশা

ঘুম থেকে উঠে ইয়াভকিনকে পাশে পেলনা পূর্ণতা। উঠে বসে নিজেকে ধাতস্থ করে যখন বুঝলো, পুরো রুমে ইয়াভকিনের অস্তিত্ব নেই তখন তার সুন্দর, শান্ত, সুশ্রী মুখে চিন্তার রেখা উদয় হলো। এলোমেলো চুল বেঁধে গায়ের কুঁচকানো শাড়ি ঠিক করে সে বিছানা ছেড়ে উঠে। তার পূর্বে আড়চোখে দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে নেয়, সাড়ে পাঁচটার বেশি বাজে। লেট করে ঘুমালেও জলদি ঘুম ভেঙে যাওয়ায় মাথাটা ধরেছে।
সে রুম থেকে বের হওয়ার পূর্বে একবার বারান্দায় ঢু মে’রে আসে। সেখানটাও শূণ্য।
বিয়ে বাড়ি বলে মানুষ জনের অভাব নেই। ইতিমধ্যে কয়েকজন উঠে পড়েছেন। কাজল আর শায়লাও উঠে পড়েছেন। সায়মাকে দেখা যাচ্ছেনা। পূর্ণতা আবার রুমে ফিরে আসে। ফোন হাতে নিয়ে কল দেয় ইয়াভকিনকে। আশ্চর্য! ফোনটাও ফেলে গেছে বিছানায়। পূর্ণতা মুখ ধুঁয়ে এল এবার। নিজের ফোনটাও বিছানার পাশে ছুঁড়ে দরজা লক করে বেরিয়ে গেল। কাজলের পাশ ঘে’ষে দাঁড়িয়ে বলল,
–” প্রতিভা কি ঘুমাচ্ছে, মা?”
–” হ্যাঁ।”
–” আপনার ছেলে কোথায়, মা?” ইতস্তত কণ্ঠ পূর্ণতার। ইতস্তত ভাব এড়াতে চা চুলোয় বসায় কথার মাঝখানে।
কাজলের অবাক কণ্ঠ,
–” কেন? রুমে নেই? এত সকালে কই যাবে!”

পূর্ণতা চুপ থাকে। কাউকে কিছু না বলে কোথায় গেল লোকটা! চিন্তার মাঝেই চা নামায়। সবার জন্য কাপে ঢেলে একে একে দিয়ে প্রতিভার কাছে আসে। বাইরেও তো যেতে পারবেনা। কাকে খোঁজার কথা বলবে?

প্রতিভা গায়ে হাত বুলাতেই মেয়েটা নড়েচড়ে উঠে। মিনিট কয়েকের ব্যবধানে পিটপিট নয়নে তাকায়। রাতে কাজলের সঙ্গে গল্প করেছে বেশ। তবে মায়ের শূণ্যতায় ঘুমাতেও কষ্ট হয়েছে। সে সময় নিয়ে উঠে বসে। পূর্ণতার গলা জড়িয়ে বলে,
–” বাবা।”
দৃঢ় কণ্ঠ পূর্ণতার,
–” চলো, ব্রাশ করে নাও।”
–” বাবা..”
–” বাবা আসবে। এখন চলো।”

প্রতিভাকে ব্রাশ করানোর সময় বাইরের হইচইয়ের শব্দ কানে আসে ওর। প্রতিভাকে নিয়ে বের হয়ে আসে। প্রতিভা গা ঘে’ষে হাঁটছে। আলুথালু অবস্থা তার। ফর্সা মুখশ্রীতে পানির বিন্দু বিন্দু ফোটা স্পষ্ট। মেয়েটা মুখ মুছতে দেয়না কিছুতেই। পূর্ণতা তাও আঁচল দিয়ে মুছে দিল। নজর গেল এবার সদর দরজার দিকে। বাড়ির পুরুষরা প্রথমে ঢুকেন। এরপর ইয়াভকিন, ইয়াজিদ, ইয়াদ, ইরিনের হাজবেন্ড আবরার আর আরো কয়েকজন। ইয়াভকিনের গায়ে শুভ্র রঙের পাঞ্জাবি। মাথায় টুপি। নামাজে গেছিল নিশ্চিত। পূর্ণতা গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে মেয়েকে কোলে তুলে নিল। প্রতিভা কোল থেকে নেমে গেল নিমিষেই। চঞ্চল পায়ে বাবার নিকট গেল। হাত ধরে টানতেই ইয়াভকিন আস্তে করে আর্ত’নাদ করে উঠল। কেউ লক্ষ্য না করলেও পূর্ণতা ঠিকই লক্ষ্য করলো। কিন্তু জনসম্মুখে কাছে যেতে পারলোনা।

–” আস্তে আম্মু। এভাবে ছুটেনা।”

মেয়েকে কোলে তুলে পূর্ণতার দিকে দৃষ্টি নেয় ইয়াভকিন। পূর্ণতার রক্তিম চোখে ইশারায় মেয়েকে নিয়ে রুমে যায়।

পূর্ণতা বিছানার পাশে দাঁড়ায়। ইয়াভকিন ঢুকে ভিড়িয়ে রাখে দরজা। পূর্ণতা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলে,
–” হাতে কি হয়েছে?”
–” কি হবে আবার!”
–” পাঞ্জাবির হাতায় লাল কি?”

অপ্রস্তুত ইয়াভকিন বলে,
–” তুমি মানুষের মাঝ থেকে এটা জিজ্ঞেস করবে বলে ডেকে এনেছ? আমি আরো কি না কি ভাবলাম!”
–” কি ভাবলেন?”
–” রোম্যান্স করবে তাই।”
–” মেয়ে কোলে, লজ্জা শরম অবশিষ্ট থাকলে দয়া করে এই প্রসঙ্গ টানবেন না। কথা ঘুরানোর চেষ্টাও করবেন না। হাত কে’টেছে? দেখি!”
–” টিনে লেগে গেছিল!”
–” টিন কই!”
–” মসজিদের বাইরে আছে।”
–” মসজিদে যাচ্ছেন বলে যাবেন না? বাপ মেয়ে সবসময় টেনশনে রাখেন আমাকে।”
–” আল্লাহ! টেনশন করবে কেন! যাওয়ার আগে ডেকে গেছি। কিন্তু তুমি তো গভীর ঘুমে। মাথায় চুমু খেয়ে গেছি সেটাও বুঝোনি!”
দাঁতে দাঁত চাপে পূর্ণতা। কিছু বলার প্রতিভা পূর্ণতার মতো অনুকরণ করে প্রশ্ন রাখে,
–” হাতে কি?”
ইয়াভকিন হেসে টুপ করে মেয়ের গালে চুমু খায়। বলে,
–” কিছুনা আম্মু।”
পূর্ণতা আস্তে করে বলে,
–” আপনাকে পরে দেখছি আমি। এখন নাশতা করবেন চলুন।”
–” আমাকে তো সারাদিনই দেখো, একমাত্র বরই তো। প্রাণভরে দেখো, সমস্যা নেই!”

পূর্ণতা রক্তিম চোখে তাকায়! এই লোকের কমছে নাকি বাড়ছে! দিনকে দিন লাগামহীন কথাবার্তা বাড়ছে, লজ্জায় জর্জ’রিত করছে পূর্ণতাকে!

–” বড় বউ! তুমি কেন বিয়েতে যাবানা?”
সায়মার অবাক কণ্ঠ। পূর্ণতা কিঞ্চিৎ লজ্জা পেয়ে বলে,
–” আমি যাচ্ছিনা ছোটমা।”
–” সেটা তো বুঝলাম, কারণ কি?”
–” আমার শরীরটা খারাপ যাচ্ছে।”
–” সেকি! আচ্ছা তাহলে যেও না। তোমার মেজো আপাকে বলো, ওষুধ দেবে।”

নিজেই কাজলকে ডাকতে উদ্যত হোন সায়মা। পূর্ণতা মিথ্যে বলেছে কিঞ্চিৎ। এতটাও শরীর খারাপ না তার। কাজল রুমে ঢুকলেন সঙ্গে সঙ্গে। সেই সাথে শায়লাও। সায়মা কথাখানা বলতেই কাজল শান্ত নয়নে তাকিয়ে বললেন,
–” বেশি শরীর খারাপ হলে যাওয়ার দরকার নাই। এখানে থাকো, বিশ্রাম নিবা।”
–” কিন্তু প্রতিভা যাবেনা? ওর ছোট চাচ্চুর বিয়ে!”
সায়মার প্রশ্ন।
–” ইয়াভকিনের সঙ্গে যাবে। আর যদি না যায় তো না যাক! মায়ের জন্য যদি ওখানে কাঁদে!”

.

ইয়াভকিন রেডি হয়ে বসে আছে। এক মিনিটের জন্য পূর্ণতার নাগাল পাচ্ছেনা। এতকি ব্যস্ত সে? মেয়েকে রেখে এসেছে কাজলের কাছে। উনি বলেছেন রেডি করিয়ে দেবেন। মেয়েটা জেদ ধরেছে যাবে।
পূর্ণতা আঁচলে ঘাম মুছতে মুছতে রুমে ঢুকে। ইয়াভকিন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
–” মতলব কি তোমার! যাবেনা বিয়েতে?”
–” না।” সোজাসাপ্টা জবাব পেয়ে ইয়াভকিন অবাক হয়। বলে,
–” কি না? মেয়ে যাবে, তুমি যাবেনা? ইয়াদ মানবে?”
–” ভাইয়াকে মাত্র বলে এসেছি। মেয়েকে নিয়ে যান। সমস্যা কই!”
–” পা’গ’ল হয়েছ? এক ঘন্টা থাকার পর কান্না ধরবে!”
–” তাহলে যাবেনা।”
–” কি বলছো! ওর চাচ্চুর বিয়ে!”
পূর্ণতা কেমন করে যেন তাকায়। ইয়াভকিন এগিয়ে আসে। হালকা জড়িয়ে ধরে বলে,
–” শরীর খারাপ? ডাক্তার ডাকি?”
–” ইশ! বাড়ি ভর্তি মেহমানের মধ্যে ডাক্তার? গায়ে জ্বর এসেছে বোধহয়। ওষুধ দিয়েছেন মা। আমি যাবোনা তাও। এখানে এসব সামলাতে সাহায্য করবোনা?”
–” আচ্ছা, কিন্তু প্রতিভা?”
–” রেখে যান। প্রথমে কান্নাকাটি করবে পরে ঠিক হয়ে যাবে।”
–” অযথাই মেয়েকে কাঁদাবো? সাথেই নেব নাহয়। বাবারাও তো মেয়ে সামলাতে পারে!”

পূর্ণতা মাথা কিঞ্চিৎ নত করে ফিচেল হাসে। ইয়াভকিনের কাঁধে কপাল ঠে’কিয়ে বলে,
–” সাবধানে যাবেন! এমনিতেই সকাল সকাল হাত কে’টেছেন।”
–” ব্যথা পাইনি তাতে। তবে তোমার এমন মলিন মুখ দেখে হৃদয় ক্ষ’ত’বি’ক্ষ’ত হচ্ছে। এখন শক্ত করে জড়িয়ে ধরো।”

পূর্ণতা নিশ্চুপে মেনে নেয় সেই আবদার। সর্বশক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরে ইয়াভকিনকে।
ইয়াভকিন হেসে পূর্ণতার মাথায় ঠোঁট ছুঁয়ায়। আবেশে বন্ধ করে নেত্রযুগল।

.

রোকেয়া আসলেন বরযাত্রী যাওয়ার পর। রাস্তার অবস্থার কারণে আসতে দেরি হলো। কাজল মুখ ভার করে বললেন,
–” সবাই যাওয়ার পর আসলেন আপা? আপনার ভাইরা কতো রাগ করেছে।”
–” ওর বুঝাইয়া বলবোনে। আমি ওসব বরযাত্রীর সঙ্গে যাইনা। আগে আসলে তো টাইনা নিত!”

সোফায় বসেন উনি। সাবা বেশ বড় হয়েছে। আর কখনো এ বাড়িতে এসে থাকেনি। পূর্ণতাকেও পায়নি। পূর্ণতা তাকে দেখে এগিয়ে আসে। সর্বপ্রথম রোকেয়ার সঙ্গে কথা সেড়ে সাবাকে বলে,
–” কেমন আছো সাবা?”
–” ভালো আছি।”

রোকেয়া মাঝ থেকে বলেন,
–” তোমার মেয়ে কই!”
–” ও বিয়েতে গেছে ফুফু।”
–” আল্লাহ! এইটুকুন মেয়েরে কাছছাড়া করলা কেন!”

পূর্ণতা আবার চিন্তায় পড়ে। প্রতিভাকে এভাবে ছাড়া সত্যিই উচিত হয়নি। মেয়েটা ভীষণ জে’দি। যখন বলল না যাওয়ার কথা, কেঁদেকুটে একাকার করেছে। ইয়াভকিনকে ছাড়েনি। তবে এখন তাকে পাঠিয়ে তার নিজের মনই আনচান করছে!

চলবে।