বেসামাল প্রেম পর্ব-১১+১২

0
105

#বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_১১
রুদ্রর সঙ্গে কথোপকথন শেষে বিদায় নিল মাহের৷ রুমের বাইরে এসেই মুখোমুখি হলো সূচনার৷ সূচনার থমকে যাওয়া দৃষ্টি দেখে কিঞ্চিৎ বিচলিত হলো সে। কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই বাঁধ সেধে অবিশ্বাস্য, অভিমানী কণ্ঠে সূচনা বলল,
-” আপনি আমার ভাইয়াকে বখাটে বললেন!”

হকচকিয়ে গেল মাহের। দৃঢ় দৃষ্টিতে সূচনার মুখশ্রীতে কয়েক পল তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। দু’হাত বাড়িয়ে সূচনার কাঁধের দুপাশে স্পর্শ করে মৃদু থাপ্পড় দিয়ে বলল,
-” সত্যি যত তিক্ত এবং কঠিনই হোক আমি তা মেনে নিতে পারি, স্বীকার করতেও জানি, আবার চোখে আঙুল দিয়ে মানুষকে দেখিয়ে দিতেও কুণ্ঠা বোধ করি না।”

অপমানে মাথা নিচু হয়ে গেল সূচনার। কাঁধ থেকে ডানহাত সরিয়ে আলতো করে সূচনার চিবুক স্পর্শ করল মাহের। বলল,
-” চোখ তুলুন সূচনা। ”

নত মস্তক নতই রইল সূচনার। মাহের দৃঢ় স্বরে বলল,
-” আপনি যথেষ্ট ম্যাচিওর সূচনা, এসব ছেলেমানুষী আপনাকে মানায় না। অযথা ভুল বুঝে কষ্ট পাবেন না। খাবার রেডি করবেন বললেন? চলুন নয়তো দেরি হয়ে যাবে আমার। ”
__
টানা সাতদিন বাইরে বেরুতে দেয়া হলো না রুদ্রকে। বোনের অভিমানী কড়া নিষেধ তাকে মানতেই হলো। সাত পেরিয়ে আটদিনের মাথায় রুদ্র বাড়ি থেকে বের হলো৷ এর মধ্যে মাহের দুদিন এসেছিল সূচনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সূচনা রাজি হয়নি। কখনো রাত বিরেতে হুটহাট মাহের যখন তাকে ম্যাসেজ করতো,
-” আপনাকে মিস করছি সূচনা। বিছানার বা’পাশটা ফাঁকা রয়েছে। দেখতে ভালো লাগছে না। ”

উত্তরে সূচনা দিতো,
-” তাও ভালো বিছানার বা’পাশে ফাঁকা, বুকের বা’পাশে নয়! ”

উত্তর দেয়ার মতো কিছু খুঁজে না পেয়ে কিছুই বলতো না মাহের। কখনো যদি ম্যাসেজ দিতো,
-” কবে আসবেন? মা আপনার কথা বলে। ”

সূচনা উত্তর দিতো,
-” আমার বখাটে ভাইয়ের জন্য আপনার মায়া না থাকলেও আমার আছে। তাই তার পরিপূর্ণ সুস্থতা দেখে তবেই যাব। ”
____
হৈমীর পা ঠিকঠাক হতে সাতদিন লেগে গেল। এরপর বাড়ি ফিরল সে। ফেরার পর মায়ের মুখে রুদ্রর অবস্থা জানতে পেরে ভীষণ মায়া হলো। আবার তার করা আচরণবিধি স্মরণ হতেই বুকের ভিতরের মায়াগুলো উড়ে গিয়ে ভয় জেঁকে বসল। ভাবতে চাইল না আর রুদ্র নামক তুমুল ঝড়টির কথা৷ তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোও অন্তঃকোণে চেপে রইল। কারণ হিসেবে দাঁড় করাল কিছু কথা। যেমন,
-” গুন্ডাটা তো আর ডিস্টার্ব করেনি, হতে পারে সে এক্সিডেন্ট করে স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছে। ভুলে টুলে গেছে আমাকে। আবার হতে পারে এক্সিডেন্ট করে হেব্বি একটা শিক্ষা হয়েছে। তাই নিজে নিজেই শুধরে গেছে। আগ বাড়িয়ে আর ঝামেলা টামেলার প্রয়োজন নেই। আমার দয়ার শরীর দয়া করেই ঝামেলা থেকে বাঁচিয়ে দিলাম হুহ! ”

জীবন চলতে শুরু করল জীবনের গতিতেই। এরই মধ্যে রুদ্র একদিন সূচনাকে জানালো, সে অনির্দিষ্টকালের জন্য ঢাকা যাবে। নিজের শহর, টাঙ্গাইল শহরের পরিচিত হাওয়াতে শ্বাসরোধ হয়ে আসছে। এবার তার হাওয়া বদল প্রয়োজন। সূচনা চিন্তিত হয়ে পড়ল। সেদিন মাহেরের বলা কথাগুলোতে বেশ পরিবর্তন ঘটেছে রুদ্রর। কিন্তু এই পরিবর্তন স্বাভাবিক না অস্বাভাবিক বুঝতে পারছে না সূচনা৷ তাই তার চিন্তাটা গভীর হলো। বিচলিত হয়ে বলল,
-” রাদিফ ভাইয়াদের ওখানে যাবে? ”

রাশভারী কণ্ঠে রুদ্র বলল,
-” সিয়র না বাট ইচ্ছে হলে যেতেও পারি। চল বিকেলে ও বাড়িতে দিয়ে আসি তোকে। আর সময় পাবো না। ”

সূচনা সম্মতি দেয়। বিকেলবেলা ভাইয়ের সঙ্গে চলে আসে শশুর বাড়িতে। তার শাশুড়ি হামিদা ভীষণ খুশি হয়। রুদ্রকে আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ড্রয়িংরুমে সোফায় স্বভাবসুলভ গম্ভীর হয়ে বসে রুদ্র। সূচনা রুমে গিয়ে পোশাক পরিবর্তন করে ভাইয়ের জন্য সরবত নিয়ে এলো৷ রুদ্র সরবতের গ্লাস হাতে নিয়ে হামিদা বেগমের বলা কথাগুলো শুনে হু হা করছিল। এমন সময় ঝড়ের গতিতে বাইরে থেকে ড্রয়িংরুমে এসে আকস্মাৎ থমকে গেল হৈমী। কয়েক পল গোল গোল চোখ করে রুদ্রকে দেখে নিয়ে মৃদু চিৎকার করে বলল,
-” ওমা এটা কে? বেয়াইয়ের মতো লাগছে না? ”

হ্যাঁ রুদ্রর মতোই তো লাগছে কিন্তু রুদ্র নয়৷ তার তো এমন ফ্রেশ মুখ, ফ্রেশ মাথা নয়! কপালে ভাঁজ ফেলে
বিস্মিত চোখে সূচনার দিকে তাকাল সে। উত্তেজিত হয়ে বলল,
-” আরেহ ভাবি তুমি এসে গেছ! এটাও তোমার ভাই? আরেহ তোমার আরেকটা ভাই আছে? কিন্তু এত্তো মিল কেন? জমজ টমজ নাকি! ”

হামিদা ওঠে এসে মেয়েকে কড়া চোখে শাসন করলেন। সূচনা কিঞ্চিৎ ভীতু হয়ে রুদ্রর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। রুদ্র স্থির বসে শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে চঞ্চলিত হৈমীর পানে। হৈমী শান্ত, স্থির রুদ্রকে ড্যাবড্যাব করে দেখে নিয়ে হঠাৎ চিন্তিত হয়ে বলল,
-” তুমি তো বলেছিলে তোমরা দুভাই বোন। জেরিন আন্টিও তাই বলেছিল তাহলে উনি কোথা থেকে আসলো! এই যাহ মুভির মতো কাহিনী টাহিনী আছে নাকি? ঐ যে দু’টো জমজ বাচ্চা হলে একটাকে চুরি করা হয়৷ বহুবছর পর আবার চুরি হয়ে যাওয়া ছেলের খোঁজ পাওয়া যায়। ইস সিনেম্যাটিক কাণ্ড ঘটে গেল নাকি! ”

হামিদা এবার ধমক দিলেন। সূচনা বিরক্ত হয়ে বলল,
-” তোমার মাথা মনে হয় পুরোটাই খারাপ হয়ে গেছে হৈমী। কী আবল তাবল বলছো? ”

মাকে পাশ কাটিয়ে রুদ্রর সামনে এসে দু-হাত কোমরে রেখে পিটপিট করে তাকিয়ে হৈমী বলল,
-” দেখতে একদম সেম পার্থক্য এটাই উনার দয়াল বাবাদের মতো চুল, দাঁড়িতে তো ছোটোখাটো বেনি হয়েই যাবে মনে হয়! ”

রুদ্র শান্ত চোখে তাকিয়েই রইল৷ তার অমন গভীর চোখদুটোতে কিছু একটা ছিল যা হৈমীর মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য করল। চুপসে গেল সে। ধীরেধীরে পিছিয়ে গিয়ে মা, ভাবির দিকে তাকিয়ে বলল,
-” আচ্ছা উনাকে কে মেরেছে থুতনিতে আর মাথায় কীসের ব্যান্ডেজ? উনি কি কথা বলতে পারে না। ”

-” কী সব বলছো রুদ্র ভাইয়াকে তুমি চেনো না। অদ্ভুত! ”

সূচনার কথা শুনে হামিদা কঠোর স্বরে বলল,
-” হৈমী রুমে যা, রুমে যা বলছি। ”

রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ওঠে দাঁড়াল। হৈমী ঘাড় ফিরিয়ে তাকে ওঠতে দেখেই বারকয়েক ঢোক গিলে তড়াক করে চলে গেল নিজের রুমে। বিরবির করে বলল,
-” খাইছেড়ে সর্বনাশ ! ”

হৈমীর সঙ্গে সর্বনাশের মতো একটি ঘটনাও ঘটল না। মাহেরের সঙ্গে দেখা করে চলে গেল রুদ্র। হৈমীর চোখে ভাসিয়ে দিয়ে গেল পরিচিত মানুষ অপরিচিত রূপ। দ্বিতীয় রূপ। কিন্তু সে কী জানে? মানুষ বড়ো বিচিত্র। তার থেকেও বেশি বিচিত্র রুদ্র নামক এই শক্তিশালী পুরুষটি। একই মানুষের দু’টো রূপ তাকে যতটুকু দিয়েছে তার থেকে অধিক কিছু দেবে দুই রূপের এই এক মানুষের তৃতীয় রূপটি। সামলাতে পারবে তো ছোট্ট মেয়েটা? সহ্য করতে পারবে তো অপ্রত্যাশিত কিছু অনুভূতিদের? একজন পুরুষের জীবনে আসা নতুন অধ্যায় পাল্টে দেবে না তো তার ভবিতব্য?
___
ক্লান্ত বিকেলে বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎ অপরিচিত এক ব্যক্তি পেছন থেকে জিজ্ঞেস করল,
-” আপনি মাহের, সূচনার হাজব্যান্ড?”

বাইক স্টার্ট দিতে গিয়েও থেমে গেল মাহের। পেছন ঘুরে শ্যাম বর্ণীয় হ্যাংলা, পাতলা লম্বাটে ছেলেটিকে দেখে সাবলীল ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল,
-” ইয়েস, কে বলছেন? ”

ছেলেটা হাত বাড়িয়ে দিল। বাইক থেকে নেমে মাহেরও হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করল। ছেলেটা বলল,
-” আমি লিমন। সূচনার এক্স! ”

সহসা চমকে ওঠল মাহের৷ নিজেকে ধাতস্থ করে নিল মুহূর্তেই। এক্স শব্দটা শুনতেই কান গরম হয়ে চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠল৷ বলল,
-” সো? ”

-” আপনার সঙ্গে আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। একটা ছেলে হিসেবে আমি মনে করি এসব আপনাকে জানানো উচিৎ। কীভাবে আপনাকে ঠকানো হয়েছে, বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে এর পুরোটাই আপনার জানা উচিৎ। ”

তীব্র অস্বস্তিতে পড়ে গেল মাহের৷ আশপাশে তাকিয়ে লোকজনকে দেখে নিল। বলল,
-” সরি? ”

-” এখানেই বলব নাকি আড়ালে কোথাও বসবেন? আপনি সম্মানিত মানুষ রাস্তাঘাটে এসব আলোচনা করা ঠিক না। বলা তো যায় না কী থেকে, কার মাধ্যমে কী রটে কী ঘটে যাবে। ”

গম্ভীর স্বরে মাহের বলল,
-” আপনি আমার সঙ্গে আসুন। ”

চলবে…

#বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_১২
সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরল মাহের। দরজা খুলে তার ক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে সূচনা বলল,
-” আজ এত দেরি যে? ফোনও ধরছিলেন না। ”

মাহের গম্ভীর হয়ে গেল। ধীরগতিতে পা বাড়িয়ে চলে গেল রুমে। সূচনা কপালে দু ভাঁজ ফেলে দরজা লাগিয়ে দিল। এরপর মাহেরের জন্য এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি নিয়ে গেল রুমে। মাহের রুমে পায়চারি করছিল। তাকে ভীষণ বিধ্বস্ত দেখল সূচনা৷ মাথার চুলগুলো উষ্কখুষ্ক হয়ে কপাল জুড়ে ছড়িয়ে আছে। বুক-পিঠের কয়েকটা বোতাম খোলা। সূচনাকে দেখে তার হাঁটা থেমে নিঃশ্বাসে অস্থিরতা বেড়ে গেল৷ কিছু বলার জন্য উদ্যত হয়েও বলল না৷ দমে গেল। সূচনা পানির গ্লাস সামনে ধরে বলল,
-” এটা খেয়ে নিন ভালো লাগবে। যা গরম পড়েছে, আজকের গরমে সবার অবস্থাই কাহিল। আপনাকেও ভীষণ বিধ্বস্ত লাগছে। ”

মাহেরের গম্ভীরতা দৃঢ় হলো। স্বভাবসুলভ সেই হাসিটা আজ তার মুখে নেই৷ যে হাসিতে চোখ জুড়িয়ে যায় সূচনার। তাই মনে মনে কিছুটা বিচলিত হলো সে৷ জিজ্ঞেস করল,
-” আপনার কি মাথা ব্যথা করছে? ”

ছোট্ট করে উত্তর দিল মাহের,
-” হুম। ”

-” আদা চা করে দিব? আপনি পানিটা খেয়ে ফ্রেশ হন আমি চা করে আনছি।”

সূচনা দরজার বাইরে দু’কদম এগিয়েছে অমনি রুম থেকে বিকট এক শব্দ পেয়ে চমকে ওঠল সে। কিঞ্চিৎ ত্বরান্বিত হয়ে পুনরায় রুমে ঢুকতেই দেখল ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে মাহের৷ তার দৃষ্টি কয়েক হাত দূরের মেঝেতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাওয়া গ্লাসের টুকরো গুলোতে স্থির! এ দৃশ্য দেখে বারকয়েক ঢোক গিলল সূচনা। শান্তশিষ্ট, মিষ্টভাষী মানুষটার এ কী রূপ! নিজেকে ধাতস্থ করতে এক মিনিট লেগে গেল তার।
কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করল,
-” কী হয়েছে আপনার! ”

-” কিছু না। ”

ছোট্ট করে উত্তর দিয়ে শাওয়ারের উদ্দেশ্যে বাথরুমে ঢুকে পড়ল মাহের৷ সূচনা বড়ো বড়ো চোখ করে কাঁচের টুকরো গুলোর দিকে তাকিয়ে রইল৷ এরপর ধীরস্থির ভাবে সেগুলো ওঠিয়ে ফেলে দেয়ার জন্য বাইরে গেল।

রাতে খাবার সময়ও মাহের চুপচাপ গম্ভীর রইল। মনের ভিতর তীব্র অশান্তি চললেও মুখে কিছু বলল না সূচনা৷ হামিদা ছেলেকে দু’বার জিজ্ঞেস করল,
-” কী হয়েছে তোর? মুখ এমন লাগছে কেন? ”

মাহের তেমন কোনো উত্তর দিতে পারল না। শুধু বলল,
-” চারঘন্টা ডিউটি করে কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি৷ ঠিক হয়ে যাবে, চিন্তা করো না। ”

রাতে ঘুমানোর সময় সূচনা যখন জিজ্ঞেস করল,
-” আপনার কী হয়েছে? ”

মাহের শান্ত কণ্ঠে বলল,
-” কী হবে? ”

-” তাহলে তখন… ”

বাকিটুকু বলার সুযোগ না দিয়ে মাহের দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
-” যে প্রশ্নটি আপনার মনে ঘুরছে এর উত্তর আমার কাছে নেই। আপাতত আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছি না। গুড নাইট সূচনা ঘুমিয়ে পড়ুন। ”

মাহেরের সঙ্গে সূচনার সম্পর্কটা বেশ জটিলতায় কাটল কিছুদিন। চেনা মাহের যেন হঠাৎ করেই ভীষণ অচেনা হয়ে ওঠল। সব সময় কাজের মধ্যে ব্যস্ত থাকে। কাজ না থাকলে ছুটির দিনগুলোতে বইয়ে মুখ গুঁজে বসে থাকে। প্রয়োজনে দু’একটা কথা বললেও ভীষণ গম্ভীর হয়ে বলে। বুকের ভিতরটায় বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগে সূচনার। অদ্ভুত এক হাহাকারের পূর্ণ হৃদয়।

বরাবরের শান্তশিষ্ট, মিষ্টভাষী পুরুষ গুলোর ক্রোধ বড়ো ভয়ানক হয়। এরা কাউকে আঘাত করে না। কাউকে কটুকথা শোনায় না৷ এরপরও অদ্ভুত কৌশলে দোষী মানুষটিকে শাস্তি দিতে পারে৷ যেমন মাহের শাস্তি দিচ্ছে সূচনাকে। কিন্তু কীসের শাস্তি তার অপরাধ কী?

শুক্রবার ছুটির দিন। আজকের পরিকল্পনা হচ্ছে টিশার জন্য ভালোমন্দ রান্না করে সকলে মিলে তার বাসায় যাওয়া। মাহের যেতে নারাজ তার নাকি স্টুডেন্টসদের অনেকগুলো খাতা দেখা বাকি। তাই শাশুড়ি আর ননদের সঙ্গে সূচনা যাবে খালাতো ননদের বাসায়। গোসল করে রেডি হচ্ছিল সে৷ এমন সময় মাহেরের হোয়াটসঅ্যাপে কল এলো। মাহের তখন বাথরুমে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে। ফোন একাধারে বাজতে থাকায় বাঁধ্য হয়ে সূচনা ফোন রিসিভ করল। ওপাশ থেকে মেয়েলি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
-” স্যার আমি হিমি বলছি ঐ যে গতকাল আপনার নাম্বার নিলাম যে। পিক পাঠিয়েছি দেখুন ব্যতিক্রমে এতটুকুই উত্তর আপনি বিশ্বাস করলেন না। ভাবলেন আমি বাদ রেখে লিখেছি। আর হ্যাঁ স্যার পিকের সঙ্গে আমার একটা শাড়ি পরা পিকও চলে গেছে সরি স্যার। ”

-” এরপর থেকে খেয়াল রাখবে নিজের পিক যেন স্যারের হোয়াটসঅ্যাপে না আসে। ”

-” আপনি কে বলছেন? ”

-” স্যারের ওয়াইফ। ”

-” কিহ স্যার ম্যারেড! ”

মুচকি হেসে কল কেটে দিল সূচনা। নিশ্চয়ই মেয়েটা জানে না মাহের ম্যারেড। তাই ইমপ্রেস করার জন্য পিক পাঠিয়েছে। সূচনা পিকটা দেখে ডিলেট করে দিল। এরপর হোয়াটসঅ্যাপ থেকে বেরোনোর সময় হঠাৎ একটি নাম্বারে দৃষ্টি আঁটকে গেল। ভীষণ পরিচিত নাম্বার তার। কয়েক পল অতিবাহিত হতেই যখন পুরোপুরি নাম্বারটা চিনতে পারল সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠল৷ লিমনের নাম্বার! লিমনের সঙ্গে মাহেরের পরিচয় আছে? প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে ইনবক্সে ঢুকল সে৷ একের পর এক ম্যাসেজ, পিক দেখে মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার যোগার হলো। তার আর লিমনের বেশ কিছু ঘনিষ্ঠ ছবি দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে কয়েকটা ছবি সত্যি তার আর লিমনের। আর কয়েকটা ছবিতেও সে আর লিমন রয়েছে। যে ছবিগুলোতে অশ্লীলতার ছাপ স্পষ্ট। সূচনার মনে পড়ে না লিমনের সঙ্গে এতটা ঘনিষ্ঠ সে কখনো হয়েছে কিনা। তাহলে এগুলো কি এডিট করা! ছিঃ ছিঃ। লিমন লাস্ট যে ছবিটা দিয়েছে সে ছবিতে সূচনা শাড়ি পরা। কিন্তু বুকে আঁচল নেই। আঁচলটা লিমনের হাতে। লিমনের মুখ ডুবানো সূচনার বুকের বিভাজনে। সূচনা এক হাত তার পিঠ খামচে ধরা আরেক হাত চুল খামচে ধরা। মুখের এক্সপ্রেশন এমন যেন কিছু দেখে ভয় পেয়েছে। গা ঘিনঘিন করে ওঠল সূচনা। গতবছর তার জন্মদিন বন্ধুরা মিলে তাকে সারপ্রাইজ দিয়েছিল। পুরো রুম অন্ধকার করে হঠাৎ আলো জ্বালিয়ে একসঙ্গে সবাই রুমে ঢুকেছিল ভয় পেয়ে চোখ খিঁচে পরিহিত জামার ওড়না খামচে ধরেছিল সে। ছবিটা এখনো তার কাছে আছে৷ তিরতির করে ঘামতে শুরু করল সূচনা। লিমনের করা ম্যাসেজগুলো পড়তে লাগল একের পর এক,
-” এবার বিশ্বাস হলো তো? তখন আমার কাছে প্রুফ ছিল না। মুখের কথা বিশ্বাস করলেন না। এবার নিশ্চয়ই বিশ্বাস হচ্ছে। কেমন বা’রো* বউ পেয়েছেন আপনি? ”

মাহেরের কোনো রিপলাই নেই৷ লিমন পর পর ম্যাসেজ দিয়েই গেছে,
-” যে মেয়ে বিয়ের আগেই বয়ফ্রেন্ডকে শরীর বিলিয়ে দিয়ে সতীত্ব হারায় ঐ মেয়ে আপনাকে ঠকিয়েছে এটা বিশ্বাস হচ্ছে না। সূচনা যদি চরিত্রহীন না হতো আমি কি ওকে বিয়ে করতাম না নাকি?

হাত থেকে ফোনটা বিছানায় পড়ে গেল সূচনার। হামিদা, হৈমী এলো তাকে ডাকতে। সূচনা নিজের ভিতর বয়ে চলা ঝড়গুলো গোপন করে বলল তার শরীর খারাপ লাগছে। শরীর খারাপের মাত্রা এমনভাবে উপস্থাপন করল যে বাধ্য হয়ে মা মেয়ে তাকে রেখেই চলে গেল। মাহের শাওয়ার নিয়ে এসে সূচনাকে দেখে বলল,
-” কী ব্যাপার আপনি যাননি। ”

সূচনা টলমল চোখে তাকিয়ে রইল মাহেরের পানে। সহসা সূচনার চোখে চোখ পড়তেই চমকাল মাহের। কিছু প্রশ্ন করতে গিয়েও থেমে গেল। বাইরে বেরোবে বলেই বেরিয়ে গেল৷ ফিরল রাত প্রায় দশটা ছুঁই ছুঁই করে। রাতের খাবার খাওয়ার সময় মাহের জিজ্ঞেস করল,
-” আপনার খাবার বাড়ছেন না কেন? ”

শ্বাসরোধ করে সূচনা উত্তর দিল,
-” আমি খেয়েছি। ”

মাহের অবাক হলো। কারণ সূচনা রাতের খাবার সব সময় তার সঙ্গেই খায়। খাওয়া শেষ করে রুমে কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করে রুমে যেতেই দেখল সূচনা বিছানা গুছিয়ে বসে আছে নিশ্চুপ। তাকে দেখে কিছুটা নড়ে ওঠল। সে ঈষৎ হেসে মোবাইল চার্জ দিয়ে শুয়ে পড়ল। সূচনা ঠাঁই বসে। মাহের বলল,
-” শুবেন না? ”

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সূচনা। বিছানা ছেড়ে কাভার্ড খুলে ঢিলেঢালা একটি নাইটড্রেস বের করল। বিয়ের পূর্বে রাতে এসব পরে ঘুমানো হলেও বিয়ের পর লজ্জায় এসব আর পরা হয়নি৷ কিন্তু আজ আর লজ্জা পেলে চলবে না। তাকে পরীক্ষা দিতে হবে আজ কঠিন পরীক্ষা। সতীত্বের পরীক্ষা।

চলবে…