#বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_১৯
দাদিন সহ তার তিন নাতি এলো সন্ধ্যার পর। রাদিফের আসার কথা থাকলেও অফিসে জরুরি কাজ পড়ে যাওয়ায় আসতে পারেনি। সে আসেনি বলে তার মা, বউ, বাচ্চা কেউই এলো না। ছোটো চাচা, চাচি তারাও আসেনি। শুধু ছেলেদের পাঠিয়ে দিয়েছে। সাদমান, সোহান, রোশান বাড়িতে পা রাখতেই পুরো বাড়ির আমেজ বদলে গেল। দাদিন এসেই নিজের ঘরে গিয়ে হায় হুতাশ করতে শুরু করলেন। এই বয়সে এসে এমন জার্নি তার শরীরে কুলোয় না। মনে মনে প্রতিজ্ঞাও করে ফেললেন। আর ঢাকার মুখ সে দেখবে না। পায়ে ব্যথায় আহাজারি শুরু করাতে কাজের মেয়েটা ছুটে গেল তার পা টিপতে। মাহের শাওয়ার নিচ্ছিল বলে সেই ফাঁকে দাদিনের সঙ্গে দেখা করল সূচনা। কথার ছলে দাদিনকে বলল,
-” তুমি তাহলে রেস্ট করো। তোমার নাত জামাইকে কফি দিয়ে আসি। ”
দাদিন বলল,
-” যা যা খাবার সময় দেখা করবনি ওর সাথে। ”
সূচনা বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পূর্বে হঠাৎ কাজের মেয়েটার দিকে তাকাল। ভ্রু কুঁচকে বলল,
-” কুসুম তুই অমন মুখ চেপে রেখে হাসছিস কেন? কী হয়েছে? ”
দাদিনের পা টেপা থামিয়ে কুসুম লজ্জায় মুখ লুকাল। বলল,
-” আপা আমি কমু না। আয়নার সামনে যেয়ে আপনি নিজেই দেখে নিয়েন। ”
কপালে দু’ভাঁজ ফেলে রুম ছেড়ে বের হলো সূচনা। ছোট্ট একটি বিষয় নিয়ে তেমন মাথা ঘামাল না। ড্রয়িংরুমে সাদমান, সোহান, রোশান হুড়োহুড়ি করছে। তাদের চ্যাঁচামেচি বড্ড কানে লাগছে। একটু ধমক দেয়া প্রয়োজন। তাই হাঁটার গতি বাড়িয়ে ড্রয়িংরুমে এলো। তিনজনকে কঠিন করে ধমক দিল। সঙ্গে সঙ্গে তিনজন ভীষণ ভদ্র হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। সাদমান সূচনার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সহসা বত্রিশ পাটি দাঁত দেখিয়ে হাসল। তার হাসির দিকে তাকিয়ে বাকি দু’জনও হাসতে লাগল। কিছুটা বিব্রত হলো সূচনা। বলল,
-” বলদের মতো হাসছিস কেন? জার্নি করে তোদের মাথা কি গেল নাকি? ফ্রিজে সরবত বানানো আছে দেখ গিয়ে। ”
বলতে বলতে রান্নাঘরের দিকে গেল সে। সাদমান সোহানের মাথায় গাট্টা মেরে জিজ্ঞেস করল,
-” হাসছিস কেন? ”
সোহান, রোশান দু’জনই একসাথে বলল,
-” তোমার হাসিতে সঙ্গ দিলাম ব্রো। ”
সাদমান মনে মনে স্বস্তি পেল। যাক বাঁদর দু’টো তাহলে হাসির আসল কারণ বুঝতে পারেনি। কিন্তু সোহান বুঝে যেতেও পারে। তার তো আবার গার্লফ্রেন্ড আছে। যতদূর জানে বেশ লুতুপুতু ধরনের সম্পর্ক। গার্লফ্রেন্ড অবশ্য তার নিজেরও আছে। তাই সূচনার ব্যাপারটা বুঝতে দেরি হয়নি। শত হোক বড়ো বোন এভাবে লজ্জায় ফেলাও দৃষ্টিকটু তাই বাকি দু’জনের চোখে যেন সূচনা এ মূহুর্তে না পড়ে। তাই বলল,
-” তোরা দু’জন এখানে বসে থাক আমি সরবত এনে দিচ্ছি। ”
সূচনা কফি বানিয়ে যেই ঘুরল অমনি সাদমান দাঁত ক্যালিয়ে হাসি দিল। সূচনা চোখ রাঙিয়ে বলল,
-” ভালো হচ্ছে সাদু এমন করে হাসছিস কেন? ”
সাদমান মাথা চুলকে প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকালে। হ্যাংলা, পাতলা বডির দিকে তাকিয়ে সূচনা বলল,
-” সামনে থেকে সরে দাঁড়া ভাই। এখন ইয়ার্কি মারার সময় নেই। ”
সাদমান ভীষণ সিরিয়াস হয়ে সরে দাঁড়াল। সতর্কী কণ্ঠে বলল,
-” বিচ্ছু দু’টোর সামনে আপাতত যেও না আপা। ওরা কিন্তু অনেক বেশি পেকে গেছে। ”
চোখমুখ শক্ত করে সূচনা তাকাল সাদমানের দিকে। বলল,
-” তুইও অনেক বেশি পেকেছিস। মাসে কয়টা গার্লফ্রেন্ড বদলাস সে খবর ঠিক কানে আসে। আর মুখ খুলতে বাধ্য করিস না। ফ্রিজে সরবত আছে, আইসক্রিম আছে, ফ্রুটস আছে, যা পারিস খেয়ে রেস্ট কর। ”
গটগট পায়ে সাদমানের সামনে থেকে চলে এলো সূচনা। ড্রয়িংরুমে বিচ্ছু দু’টো গেমস খেলায় ব্যস্ত। সূচনার বুকের ভিতরটায় অদ্ভুতরকম কাঁপছে। তখন ওভাবে মাহেরের বুকে নিজের জায়গা করে নেয়া তার দ্বারা সত্যি অসম্ভব ছিল৷ সেই অসম্ভটা সম্ভব করেছে মাহের নিজেই। এর পাশাপাশি আরো একটি ভয়াবহ ঘটনা ঘটিয়েছে মানুষটা। তার কান্নার গতি যখন বেড়ে চলছিল তাকে থামানোর জন্য এ প্রথমবার আদর করেছে। সেই আদরের মাঝেই কখন যেন গালে গাঢ় করে চুম্বনও এঁটেছে। সেই শক্ত চুম্বনের রেশটা এখনো রয়ে গেছে। মাহেরের পুরুষালি পাতলা ওষ্ঠজোড়া যেন এখনো লেগে আছে তার নরম তুলতুলে গালটায়। অদ্ভুত শিরশিরানি অনুভব হচ্ছে। তার এই অনুভূতিটা কি কাজের মেয়ে কুসুম, ভাই সাদমান কোনোভাবে টের পেয়েছে? নাকি লুকিয়ে লুকিয়ে মাহেরের দেয়া আদর তারা দেখে নিয়েছে। তীব্র অস্বস্তি নিয়ে রুমে প্রবেশ করল সূচনা। মাহের বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে ফোনে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা ছিল। সূচনা রুমে প্রবেশ করতেই ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বলল,
-” দাদিনরা এসে গেছে? ”
মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝিয়ে কফির মগ এগিয়ে দিল সূচনা। মৃদু হেসে কফির মগ হাতে নিয়ে মাহের বলল,
-” আপনার জন্য বানাননি? ”
-” আমি এখন খাব না। ”
নরম সুরে কথাটা বলেই আয়না দেখার উদ্দেশ্যে পিছন ঘুরল সে। পা আগাতে নিতেই বিচলিত হয়ে মাহের বলল,
-” দেখি এদিকে ঘুরুন কী হয়েছে? ”
আঁতকে ওঠে মাহেরের দিকে ফিরে তাকাল। বেড সাইট টেবিলে মগ রেখে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল মাহের। সূচনার বাম গালে কয়েক পল স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল,
-” এটা আমি করেছি? ”
কণ্ঠে অবিশ্বাস স্পষ্ট। সূচনা কাঁদো কাঁদো দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
-” কী করেছেন? আমাকে দেখে ওরা হাসল, কী হয়েছে আমার ? ”
-” কারা হাসল! ”
-” কুসুম, সাদু মানে সাদমান! ”
অস্পষ্ট স্বরে মাহের বলল,
-” শীট! আমার খেয়াল রাখা উচিৎ ছিল। ”
সূচনা আর অপেক্ষা করতে পারল না। ত্বরিৎ পায়ে আয়নার সামনে গিয়ে নিজের মুখশ্রীতে সচেতন দৃষ্টি বুলালো। বাম গালে স্পষ্ট লালচে দাগ সুক্ষ্ম নজরে তাকালে স্পষ্টই বোঝা যাবে কেউ দৃঢ় চুম্বন এঁটেছে এই গালে। আর সেই কেউ যে তার স্বামী মাহের এ কথা কারোরি অজানা নয়। তীব্র লজ্জায় পুরো মুখশ্রীই রক্তিম হয়ে ওঠল এবার। নিশ্বাস হয়ে গেল বড়োই বেসামাল। একটুখানি পিছু তাকাতেই মাহেরের অদ্ভুত চাহনি দেখে মুখ লুকাতে ইচ্ছে করল। তার অমন কঠিনতম লজ্জা দেখে অধর কামড়ে হাসল মাহের। কফির মগ হাতে নিয়ে সন্তর্পণে চুমক দিল। এরপর হালকা কাশি দিয়ে সূচনার অ্যাটেনশন পাওয়ার চেষ্টা করল। বলল,
-” একটু সময় নিন ঠিক হয়ে যাবে। আপাতত কিছু সময় বের হবেন না। ”
সূচনা মাথা দোলালো। মাহের তৃপ্তি নিয়ে আরেকটু হাসল। পরিস্থিতি স্বাভাবিকতায় আনতে প্রশ্ন করল,
-” হৈমী কোথায়? ওদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে? ”
চমকে ওঠল সূচনা সত্যিই তো হৈমী কোথায়?
________
রুদ্রর রুম থেকে বেরিয়ে হৈমী সূচনাদের গেস্ট রুমে গিয়ে বসে ছিল দীর্ঘক্ষণ। তীব্র বিষণ্ণতায় আচ্ছাদিত মন। তাই এই বিষণ্নভরা মনে একমাত্র সম্বল হিসেবে টিশাকেই মনে পড়ল তার। সঙ্গে সঙ্গে কলও করে ফেলল। রুদ্রর বলা কথাগুলো কাঁদতে কাঁদতে জানালো টিশাকে। সব শুনে টিশা ভীষণ রেগে গিয়ে ধমক দিল, বিরক্তি ভরা কণ্ঠে বলল,
-” তুই কাঁদছিস! তোর সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। একজন গর্ভবতী মেয়েকে ফোন করে কাঁদিস। আর কান্নার কারণ কী বললি? ঐ রুদ্র না ছিদ্র, হ্যাঁ ছিদ্রই তার নাম। তোর হৃদয় ছিদ্র করেই তো দিয়েছে। ব্যাটা খাটাশ, এই শোন খাটাশের দিল ওয়ালি। আরে বেটি থাম আগে আমার কথা শোন। আরে আশ্চর্য তোর সঙ্গে চিল্লাতে চিল্লাতে আমার ডেলিভারি হওয়ার উপক্রম, আর তুই থামছিস না। দেখ হৈমী আমার জামাই বাসায় নেই। খালামুনি রান্নাঘরে বিপদ ঘটলে কিন্তু সর্বনাশ! ”
ধমক খেয়ে কিছুটা দমে এলো হৈমী। ভাঙা কণ্ঠে নাক টেনে বলল,
-” বল শুনছি । ”
-” আমি যা বলব একদম মাথায় সেট করে ফেলবি। আর সে অনুযায়ীই কাজ করবি কেমন? তাহলে দেখবি ব্যাটা বেয়াই কেমন জব্দ হয়। ”
-” আচ্ছা বল। ”
-” ওকে মস্তিষ্কে নোট করে ফেল। ”
______
ডিনারের সময় সবাই একত্রিত হলো। টিশার সঙ্গে কথা বলার পর মনের আকাশে মেঘের ঘনঘটা কেটে গিয়েছিল। তাই সবার সঙ্গে অর্থাৎ সাদমান, সোহান, রোশানের সঙ্গে দেখাটা স্বাচ্ছন্দ মতোই হলো। খেতে বসার পর রুদ্রর মুখোমুখি হলেও একবার তাকিয়ে দেখল না। বোনের মাঝে কিঞ্চিৎ নিরবতা দেখে মাহের আড়ালে জিজ্ঞেস করল,
-” তোমার শরীর খারাপ লাগছে? চোখ, মুখ লাল কেন? ঠান্ডা লাগিয়েছ? ”
হৈমী মাথা নাড়িয়ে না বোঝাল। মৃদু হেসে বলল,
-” দুপুরে একটু আইসক্রিম খেয়েছিলাম তাই বোধহয় একটু ঠান্ডা লেগেছে। ”
সকলকে খাবার বেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সূচনা। মাহের মৃদু কণ্ঠে তাকে আদেশ করল,
-” দাঁড়িয়ে থাকবেন না, আমাদের সাথেই খেয়ে নিন। কারো কিছু প্রয়োজন হলে কুসুম এনে দেবে বসুন। ”
মাহেরের এটুকু আদেশকে রুদ্র ভীষণ পজেটিভ নিল। আপনমনে খুশিও হলো ভীষণ। তাই গম্ভীর কণ্ঠে বোনকে বলল,
-” দাঁড়িয়ে কেন খেতে বোস। ”
খাবারের পাট চুকিয়ে হৈমী রাতে কোথায়, কার সঙ্গে ঘুমাবে এই আলোচনা করে উপরে চলে গেল মাহের। একা যেহেতু এক রুমে থাকতে পারবে না তাই আজ রাত সে দাদিনের সঙ্গে ঘুমাবে বলে ঠিক হলো। হৈমীর ঘুমের স্টাইল তেমন সুবিধার নয়। তাই সে ভীষণ চিন্তিত। বুড়ো মানুষ না জানি আজ রাতে কী অঘটন ঘটে যায়! ঘুমাতে যাওয়ার পূর্বে ভাইদের সঙ্গে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে হৈমীকে দ্রুত ঘুমাতে যাওয়ার কথা বলে সূচন চলে গেল। কিন্তু হৈমীকে যেতে দিল না রোশান। তার বায়না তিন ভাইয়ের সঙ্গে এবার লুডু খেলতে হবে। খেলায় একটি নিয়মও দেয়া হলো। যে জিতবে সে দু’টো শর্ত দেবে। সেই শর্তগুলো পূরণ করতে হবে যে হারবে তাকে। দূর্ভাগ্যবশত আজ হেরে গেল হৈমী। আর জিতে গেল সোহান। মনটাই খারাপ হয়ে গেল হৈমীর। বিরস মুখে বলল,
-” আমার শরীরটা ভালো নেই আজ৷ না জানি কী শর্ত দেবে আজকে সেসবের জন্য আমি প্রস্তুত নই। তাছাড়া রাতও হয়েছে অনেক এবার ঘুমাতে যাই। যত শর্ত সব কাল পূরণ করব। ”
প্রতিবাদ করল সোহান কিন্তু সাদমান মেনে নিল। মাত্রই তার ফোনে রুদ্রর ম্যাসেজ এসেছে। অ্যাংরি ইমোজি দিয়ে সে লিখেছে,
-” বারোটা চব্বিশ বাজে। এবার তোদের খেলা বন্ধ না হলে খুব খারাপ হবে! ”
এমন ম্যাসেজ পেয়ে সাদমান বাকি দু’জনকে ম্যানেজ করে উপরে চলে গেল। বিরস মুখে হৈমীও দাদিনের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। সারারাত না ঘুমিয়ে ছটফট ছটফট করেই কাটল তার। একদিকে অবশ্য ভালই হলো, ঘুমের ঘোরে মহাবিপদ ডেকে আনা হলো না।
পরের দিন সকাল থেকে রুদ্র ভীষণ ছটফট করতে লাগল। গতকাল হৈমী তাকে উত্তর না দিয়েই বেরিয়ে গিয়েছিল। এরপর সকলের ভীরে আর উত্তর শোনা হয়নি। কিন্তু আজ শুনতেই হবে তার উত্তরটি। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে হৈমী কোথায় সেটাই দেখার চেষ্টা করছিল সে। এমন সময় সূচনার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো হৈমী। রুদ্রও তার সামনে দেয়াল সরূপ দাঁড়াল। রাশভারী স্বরে জিজ্ঞেস করল,
-” আমার উত্তরটা? ”
সূচনার ঘর থেকে মাহের বেরিয়ে এলো। রুদ্র কৌশলে হৈমীকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। মাহের জিজ্ঞেস করল,
-” এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন? রুদ্র কিছু বলেছে? ”
-” কইই না তো আমি যাচ্ছিলাম উনি তো ছাদে গেলেন। সামনাসামনি পড়ে গিয়েছিলাম। ”
-” আচ্ছা, বাইরে যাচ্ছি কিছু খাবে? কী আনব? ”
-” যা খুশি এনো। ”
ভ্রু কুঁচকে তাকাল মাহের। থতমত খেয়ে হৈমী বলল,
-” চকলেট, আর চাটনি এনো। ভাবি তো চিকেন ফ্রাই বানাচ্ছে কোকাকলাও নিয়ে এসো। ”
______
দুপুর বেলা হঠাৎ হৈমীর মনে পড়ল সে গতকাল লুডু খেলায় হেরেছে। সে জন্য তাকে আজ দু’টো শর্ত পূরণ করতে হবে। কিন্তু শর্তগুলো কী কী জানা হয়নি। তাই রোশান, সোহানকে খুঁজতে বের হলো। খোঁজাখোঁজি করতে করতে রুদ্রর রুমের সামনে এসে দ্বিধায় পড়ল। দুবার ডাকল,
-” সোহান… রোশান… তোমরা আছো? ”
কোনো সাড়া পেল না। ব্যর্থ হয়ে সরে যেতে উদ্যত হলো। পেছন ঘুরেছে অমনি দরজা শব্দ করে খুলে রুদ্র
তার ওড়না টেনে ধরল আচমকা। আঁতকে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল হৈমী। বড়ো বড়ো চোখ করে শুঁকনো ঢোক গিলল বারকয়েক। পুরো ওড়না যখন রুদ্রর দখলে তখন নিজের শেষ চেষ্টাটুকু দিয়ে ওড়নার শেষ কোণাটা টেনে ধরল হৈমী। শঙ্কিত হয়ে বলল,
-” প্লিজ এমন করবেন না। ভাইয়া এসে যাবে। ”
প্রতুত্তরে রুদ্র কিছু না বলে ওড়নায় হেঁচকা টান দিল। ফলশ্রুতিতে ওড়না সহ পুরো হৈমীটাই রুদ্রর ঘরে চলে গেল। ত্বরিত গতিতে দরজা লক করে দিল রুদ্র৷ জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে হৈমী। সুক্ষ্ম নজরে বোঝা যাবে তার শরীর মৃদু কাঁপছে। চোখের পাতা চঞ্চলিত। ঢোক গিলছে ঘনঘন। রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল রুদ্র। হাতে থাকা ওড়নাটা ছুঁড়ে দিল হৈমীর দিকে। হৈমী তৎক্ষনাৎ ওড়না গলায় জড়িয়ে নিল। রুদ্র কঠিন চোখে তাকিয়ে। তীব্র রোষানলে কপালের রগ ফুলে ওঠেছে তার। চোয়ালজোড়াও দৃঢ়। হৈমী ভীতু চোখে তার পানে তাকাতেই সে দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্ন করল,
-” উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে চলছো কেন? আমার উত্তর চাই। ”
হৈমী এক সেকেণ্ড সময় না নিয়ে বলল,
-” আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমার উত্তর কর হতে পারে? ”
চিল্লিয়ে ওঠল রুদ্র। দু’কদম তেড়ে এলো হৈমীর দিকে। হাত বাড়িয়ে শক্ত করে চেপে ধরল হৈমীর কাঁধজোড়া। ব্যথায় চোখ বন্ধ করে ফেলল হৈমী। রুদ্র ধমকে বলল,
-” না জানি না৷ আমি তোমার মুখে উত্তরটা শুনতে চাই। ”
কয়েক পল পর অসহায় চোখে তাকাল হৈমী। রুদ্রর কঠিন দৃষ্টিজোড়া তার চোখেতেই স্থির। সে চোখে নিজের চাহনি দৃঢ় করল হৈমী। কিঞ্চিৎ দৃঢ় স্বরে উত্তর দিল,
-” কোনো মেয়ে তার ভালোবাসার জন্য মাতৃসত্তা ত্যাগ করেছে কিনা জানি না। কিন্তু আমি করতে রাজি যদি আপনি আপনার পৌরুষ চাহিদা ত্যাগ করতে পারেন। আপনার বউ হতে রাজি তখন হবো যখন আপনি আমাকে সম্পূর্ণ নিশ্চয়তা দিতে পারবেন। মা তো আর একা একা হওয়া যায় না তাই না? এবার আপনি নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করে আমাকে উত্তরটা জানান ? মনে রাখবেন আপনার আমার মনের সম্পর্ক তৈরি হবে, দেহের না৷ আপনি, আপনার পৌরুষচিত মন, দেহ যদি এই ত্যাগটুকু করতে পারে আমারো নারী মন, মাতৃসত্তা ত্যাগ করতে পারবে। ”
চলবে…
#বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২০
স্তম্ভিত রুদ্রের দু-হাত আচম্বিত নম্রতায় পরিণত হলো। হৈমীর দৃষ্টি ক্রমশ দৃঢ় হচ্ছে। কয়েক পল অতিবাহিত হওয়ার পর হৈমীর কাঁধজোড়া পুরোপুরি আলগা করে দিল রুদ্র। একই সঙ্গে বিস্ময়, অবিশ্বাস্য চাহনি তার। এমন একটি উত্তরের জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। হৈমীর এই শীতল ক্রোধ হজম করতে ভীষণ বেগ পেতে হলো৷ থমথমে স্বরে কেবল উচ্চারণ করল,
-” বেরিয়ে যাও। ”
তার বলতে দেরি কিন্তু হৈমীর বেরিয়ে যেতে দেরি হলো না৷ এ ঘটনা যেন কাটা ঘায়ে নুনের ছিঁটে পড়ার মতোন ঘটনা। তাই অসহনীয় হয়ে দু-হাত শক্ত মুষ্টিবদ্ধ করে চোখমুখ খিঁচে দাঁড়িয়ে রইল রুদ্র। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ যেন ক্ষণে ক্ষণে তার বক্ষ তীরে আছড়ে পড়তে লাগল।
_____
সন্ধ্যার পর মাহেরের অনুরোধে জর্জেটের মধ্যে একটি হলুদ শাড়ি পরল সূচনা। বাসন্তী হলুদ শাড়ি। সূচনাকে বেশ মানিয়েছে। সেই যে বিয়ের ক’দিন শাড়ি পরেছিল এরপর আর পরা হয়নি। শাড়িতে সূচনাকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছিল মাহেরের। পাশাপাশি বউ নিয়ে রাতের শহর ঘুরারও ইচ্ছে হচ্ছিল। সারপ্রাইজের কথাটাও সে ভুলেনি। কিন্তু সময়, সুযোগই পাচ্ছিল না। তাই প্ল্যান করল কোথাও একটা ঘুরে আসা যাক। সূচনারও মন ভালো হবে, তারও একান্তে পাওয়া হবে মানুষটাকে। কাঙ্ক্ষিত উপহারটুকুও দেওয়া হবে। বাইকের চাবি হাতে ঠাঁই দাঁড়িয়ে মাহের৷ সূচনার সাজ কমপ্লিট হতেই বের হবে সে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে সূচনা। সাজ সম্পন্ন হলেও লজ্জায় আয়নার সামনে থেকে সরতে পারছে না। কারণ সরলেই মাহেরের মুখোমুখি হতে হবে। পেতে হবে বুক কাঁপা, ঠোঁট কাঁপা, দু গাল রঙিন হয়ে ওঠা লজ্জাদের। সময় অপচয় করতে চুলের আগায় চিরুনি বুলাতে শুরু করল৷ মাহের মৃদু কেশে বলল,
-” সব ঠিক আছে তো, আরো সাজবেন? ”
মুহুর্তেই বুকের ভিতর ধড়াস করে ওঠল তার। ইস কী লজ্জা, কী লজ্জা! আরো কেন সাজবে? সব তো ঠিকই আছে। মাথা নাড়িয়ে না সূচক ইশারা করল সে। নরম সুরে বলল,
-” আপনি এগোন আমি আসছি। ”
শাড়ি পরে বাইকে বসতে কিঞ্চিৎ অসুবিধা হলো। মাহের বুঝতে পেরে বলল,
-” আঁচল কোলে তুলুন। একহাত কাঁধে রাখুন। ”
ধীরেসুস্থে তাই করল সূচনা। মাহেরও বাইক স্টার্ট দিল। ধীরেসুস্থে চলতে শুরু করল শহরের পরিচিত রাস্তায় । এরপর চলে গেল লেকের পাড়ে। সেখানে মাহেরের গুটিকয়েক বন্ধু, বান্ধবী ছিল। সূচনার সঙ্গে আগেই পরিচিত থাকার দরুন কুশল বিনিময় করল তারা। লেকের একপাশে সারি সারি কফিশপ। রাতের পরিবেশটাকে রঙবেরঙের আলোকচ্ছটা মুখরিত করে রেখেছে। ভালোই লাগছিল সূচনার৷ চারপাশে তাকিয়ে তাকিয়ে পরিবেশটা উপভোগ করছিল সে। এমন সময় সকলের মাঝেই তার গা ঘেঁষে দাঁড়াল মাহের। হাতে হাত আলতো ছুঁইয়ে দিয়ে বলল,
-” হাত ধরুন। ”
সকলের দিকে তাকিয়ে লজ্জা পেল সে। বিব্রত চোখে তাকাল মাহেরের পানে। মাহের পুনরায় শান্ত কণ্ঠে বলল,
-” হাত ধরুন একটা জায়গায় যাব আমরা। ভয় পেতে পারেন, হাত ধরলে সাহস পাবেন। ”
সিরিয়াস হয়ে মাহেরের শক্তপোক্ত হাতটা আলতো করে স্পর্শ করল সে। অধর কামড়ে হাসল মাহের। বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে আমুদে সুরে বলল,
-” বউ আমার ব্যাপক লজ্জাবতী! ”
বাক্যটির ইতি টেনেই সূচনার নরম হাতের আঙুলের ফাঁকে আঙুল গুঁজে শক্ত করে ধরল সে। সূচনা কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটানে সকল আলোকচ্ছটা এবং বন্ধুদের মাঝখান থেকে হারিয়ে গেল দু’জনায়। তলিয়ে গেল নিবিড় অন্ধকারে। মাহেরের সঙ্গে কয়েক পা মিলিয়ে হাঁটার পর ভীত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
-” এত অন্ধকার কেন? কোথায় যাচ্ছি আমরা? ”
-” ভয় পাচ্ছেন? ”
একটু বেশি কাছাকাছি হয়ে সূচনা বলল,
-” ফোন বের করুন, ফ্লাশ অন করুন। ”
মৃদু হেসে সূচনার কাঁধ জড়িয়ে ধরল মাহের। ঘন অন্ধকারে আচমকাই এমন উষ্ণ আলিঙ্গন পেয়ে বুক ধড়ফড় করে ওঠল। কাঁপা স্বরে বলল,
-” মাহের আমি সত্যি ভয় পাচ্ছি। ”
একহাতে সূচনাকে জড়িয়ে অপর হাতে পকেট থেকে ফোন বের করল মাহের। ফ্লাশ অন করে নিজের দিকে ধরেই বলল,
-” এই তো আমিই ভয় কীসের? ”
-” আমরা কথায় যাচ্ছি? ”
-” কোথায় না এখানেই বসব। ”
ফোনের আলোটুকু সম্মুখে ধরতেই সূচনা দেখল কয়েক টুকরো কাঠ জড়ো করে রাখা হয়েছে। মাহের তার কাঁধ ছেড়ে হাত ধরে বসতে ইশারা করল। বসার পর কাঠগুলোতে আগুন ধরাল সে।
পৌষের প্রথম সপ্তাহ চলছে। আহামরি শীত পড়েনি তাই অবাক হলো সূচনা। আমতা আমতা করে বলল,
-” এসব কী চলুন ওদিকে যাই। ”
আড়চোখে তাকিয়ে ঘাসের ওপর লাইটার রাখল মাহের। সূচনা খেয়াল করল চারপাশে বেশ ঘন গাছ। ছোট্ট খাটো জঙ্গল বলা চলে। সে জঙ্গলের ভীতর ফাঁকা অংশের ঘাসের ওপর বসে আছে তারা। আশ্চর্য হয়ে মাহেরের পানে তাকাল সে। জিজ্ঞেস করল,
-” এখানে আমি কখনো আসিনি। ”
-” আমিও। এটা কফিশপের পিছনের অংশ। জায়গাটা বেশ নিরিবিলি। দিনের বেলায় অনেক ছোটো-ছোটো ছেলেরা এখানে এসে সিগারেট খায়। কেউ কেউ নেশাও করে। ”
মন খারাপ হলো সূচনার। বলল,
-” তাহলে আমরা এখানে কেন? ”
-” নেশা করব তাই। ”
-” ছিঃ আপনি এসব কী বলছেন? ”
-” সত্যি বলছি তার আগে সারপ্রাইজটা দিই? ”
বিস্মিত হলো সূচনা। এমন জায়গায় তাকে সারপ্রাইজ দিতে এনেছে মাহের? কী এমন সারপ্রাইজ যা এখানে দিতে হবে? চিন্তায় মগ্ন সে হঠাৎ চমকে ওঠল পরিচিত একটি কণ্ঠস্বর পেয়ে। ভীতিগ্রস্ত হয়ে সামনে তাকাল সে। হ্যাঁ লিমন তার প্রাক্তন। আঁতকে ওঠে পাশে তাকাল। মাহের তার দিকেই তাকিয়ে। সূচনা ঢোক গিলল কাঁপা স্বরে বলল,
-” মাহের! ”
মাহের তার দিকে চেপে বসল। একহাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিল তাকে। মৃদু স্বরে বলল,
-” পুরো ভিডিয়োটা দেখুন সূচনা। ”
সূচনার শরীরটা থরথর করে কাঁপছে। মাহের ফোনের স্ক্রিনে ভিডিয়ো প্লে করে তার সামনে ধরে আছে। স্ক্রিনে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, র”ক্তা”ক্ত অবস্থায় বসে আছে লিমন। তার সামনে চার-পাঁচ জন ছেলে দাঁড়িয়ে। সবাই এক ডাকে প্রশ্ন করছে লিমনকে,
-” বল তোর সঙ্গে মাহেরের বউয়ের ঠিক কতটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। আমরাও শুনি? ”
উত্তরে আহত সুরে লিমন বলল,
-” আমাকে ক্ষমা করুন। আমি যা বলেছি সব রাগের বশে। সব মিথ্যা সব মিথ্যা। সূচনা পবিত্র আমি ওকে কোনোদিন সেভাবে স্পর্শই করিনি। হাত ধরা ছাড়া ওর সঙ্গে আমার আর কোনো সম্পর্ক হয়নি। ও খুব ভালো মেয়ে, ভদ্র মেয়ে। শুধুমাত্র ওর সংসারে আগুন ধারনোর জন্য, ওর হাজব্যন্ডের ওর সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করার জন্য আমি এসব করেছি। কারণ আমি ওকে এভাবে মেনে নিতে পারছিলাম না। মায়ের কথায় ওকে রিফিউজড করলেও এবার হারে হারে টের পাচ্ছি কী রত্ন হারিয়েছি আমি। ভাইয়েরা আমার আপনারাও তো কাউকে না কাউকে ভালোবাসেন। আপনাদের ভালোবাসার মানুষটা যদি অন্যকারো সঙ্গে ঘরবাঁধে আপনার বুকে কি আগুন জ্বলবে না? সেই আগুন আমি সহ্য করতে পারছিলাম না বলেই ওদের ঘরে আগুন ধরাতে চেয়েছিলাম। আমাকে মাফ করে দিন। আমি মাহেরের পা ধরে মাফ চাইব। প্রয়োজনে সূচনার পা ধরেও মাফ চাইব। আমাকে ছেড়ে দিন। ”
আকস্মাৎ ফুঁপিয়ে ওঠল সূচনা। তরিৎবেগে ভিডিয়োটা বন্ধ করে দিল মাহের। চমকে তাকাল সূচনার দিকে। প্রচণ্ড খারাপ লাগায় বুকটা বিষিয়ে ওঠল তার। এত কিছুর মাঝে সে ভুলেই গিয়েছিল সূচনা লিমনকে ভালোবাসতো! সূচনাকে ছেড়ে দিয়ে থমথমে স্বরে বলল,
-” আ’ম সরি সূচনা। ওরা এভাবে ওকে মারবে আমি জানতাম না। সে সময় আমি কক্সবাজার ছিলাম। আমি বলেছিলাম শান্ত ভাবে বুঝিয়ে জাস্ট ওর মুখ থেকেই সত্যিটা বের করা৷ সত্যিটা আমি জানতাম, হ্যাঁ বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু ওর মুখ থেকে সত্যিটা জানতে চেয়েছি শুধুমাত্র আপনার মনের স্বস্তির জন্য। কারণ আমি মুখে যতই বলি আমি আপনাকে বিশ্বাস করি আপনি গিল্টি ফিল করতেন। ইভেন করছিলেনও। তাই সত্যি টা বের করার জন্য বন্ধুদের দায়িত্ব দিয়েছিলাম। ওরা সহজ ভাবে লিমনকে বুঝিয়েছিল। যেহেতু আপনাদের একটি সম্পর্ক ছিল, সে সম্পর্কে সম্মান রেখেই যেন সত্যি বলে। শুরুতে কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে এভাবে সবটা উন্মোচন করেছে। ওদের হয়ে আমি আবারো সরি। ”
সূচনার কান্নার বেগ বাড়ল। পাশাপাশি রাগে, অভিমানে দাঁড়িয়ে পড়ল। ভাঙা আওয়াজে বলল,
-” আপনি আমাকে সরি বলছেন কেন? ”
ওঠে দাঁড়াল মাহেরও। সূচনার মুখোমুখি হয়ে বলল,
-” আমি আপনাকে কষ্ট দিতে চাইনি। ”
-” আমি কেন কষ্ট পাবো? ”
-” কাঁদছেন তো! ”
অসহায় কণ্ঠে বলল মাহের। সূচনা নাক টেনে, হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছল। বলল,
-” আপনি আমায় এতটুকু বিশ্বাস করেন এটা জেনেই কাঁদছি মাহের! যার কাছে যা আশা করি তার কাছে তা পাই না৷ অথচ যার কাছে আশা সীমিত সেই সবটা উজার করে দেয়। এই দুঃখ আমি কোথায় রাখব বলুন তো? ”
ঈষৎ হেসে হাত বাড়িয়ে আঙুল ছুঁয়ে চোখের পানি মুছে দিল মাহের। সূচনা নত মাথায় দাঁড়িয়ে। মাহের তার চিবুক ছুঁয়ে স্নেহময় কণ্ঠে বলল,
-” কষ্ট কমাতে চেয়ে কি বাড়িয়ে দিলাম। ”
মাথা নাড়িয়ে সূচনা না বোঝাল। মাহের আবারো বলল,
-” যেই রাতে আপনি নিজেকে প্রমাণ করতে এসেছিলেন সেই রাতে ভীষণ রাগ হয়েছিল আমার। ইচ্ছে করছিল কয়েকটা মার দিয়ে বুঝিয়ে দিই মাহের লিমন নয়। আর সে সময় আপনার থেকে দূরে থেকেছি, অভিমান করে থেকেছি এর পিছনে কারণ একটাই, তা হলো আপনি কোন সাহসে অমন একটা বেইমানকে ভালোবেসেছিলেন? যে কিনা সুযোগ পেয়ে এভাবে অসম্মান করে? ”
-” ভুল হয়ে গেছে আমার৷ ”
চট করে ভুল স্বীকার করে দায় ছাড়া হলো সূচনা। মাহেরকে আর কিছু বলতে না দিয়ে বলল,
-” ভুল আপনারো আছে। ”
অবাক হয়ে মাহের বলল,
-” আমার ভুল! ”
-” হ্যাঁ আপনি কেন আরো আগে আমার জীবনে এলেন না? যে পৃথিবীতে নেই তার কত ভাগ্য ইস সেই ভাগ্যটা যদি আমার হতো৷ পৃথিবীতে না থেকেও আপনার গভীর ভালোবাসা পেতাম। ”
-” সূচনা! ”
মৃদু ধমক দিয়ে সহসা সূচনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল মাহের। অদ্ভুত স্বরে বার বার করে বলল,
-” এমন কথা আর কখনো বলবেন না আপনি। দ্বিতীয়বার এমন কথা শুনলে ভয়ানক কিছু ঘটিয়ে ফেলব বলে দিলাম। আপনি ভাগ্যবতী, বরং ওই অভাগী। তাই তো আমার ভালোবাসা না-পেয়েই হারিয়ে গেল। একজনকে হারিয়েছি নিজের করে না পেয়েই। আপনাকে নিজের করে পেয়েছি। অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে পেয়েছি, আপনি হারালে আমিটাই হারিয়ে যাব। এমন কথা আর কখনো বলবেন না কক্ষোনো না। ”
দু’হাতে শক্ত করে সূচনার পৃষ্ঠদেশ চেপে ধরে কথাগুলো বলছিল মাহের। তার শ্বাস-প্রশ্বাস প্রচণ্ড বিক্ষিপ্ত। বিক্ষিপ্ত নিঃশ্বাস গুলো একের পর এক সূচনার ঘাড় ছুঁয়ে দিচ্ছে। ফলশ্রুতিতে শরীরের লোমকূপ গুলোও কেঁপে ওঠছে সূচনার। দীর্ঘক্ষণ পর মাহের শান্ত হলো। সূচনা তার পিঠে আলতো ছুঁয়ে নরম সুরে বলল,
-” সরি এমন কথা আর কখনো বলব না, প্রমিজ। ”
লম্বা করে নিঃশ্বাস ফেলল মাহের। কিন্তু সূচনাকে ছাড়ল না। সূচনা ওভাবেই পড়ে রইল তার বুকে। কিছুসময় পর হঠাৎ কানের কাছে উত্তপ্ত নিঃশ্বাসের পাশাপাশি ফিসফিসে আওয়াজ শুনল,
-” আই ক্যান হ্যাভ টু কিসেস প্লিজ.
ছোট্ট নিশ্বাস ছেড়ে ছোটো করেই সম্মতি দিল সূচনা। মাহের ধীরে ধীরে মাথা তুলে তার কপালে গাঢ় চুম্বন এঁটে দিল। সন্তর্পণে চোখজোড়া বদ্ধ করে ফেলল সে। বুকের ভিতর একনাগাড়ে শব্দ হতে লাগল ধিকধিক ধিকধিক। কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে স্বল্প আলোয় সূচনার ভীতু, লাজুক মুখটায় দৃষ্টিপাত করল মাহের। ধীরেধীরে ঠোঁটজোড়া নামিয়ে নিল সূচনার অধর সুধা পান করার জন্য। দু’জোড়া ঠোঁট খুব কাছাকাছি আসার পর সহসা চোখ বন্ধ করে ফেলল মাহেরও। অতি সন্তর্পণে নিজ ওষ্ঠাধর ফাঁক করে সূচনার নরম অধর নিজ অধিকৃত করে নিল। একহাত সূচনার কোমরে রেখে অপরহাতে কান এবং ঘাড় বেষ্টন করে নিল। কয়েক পল পেরোতেই একজোড়া নর, নারীর উত্তপ্ত নিশ্বাসে রাতের আঁধার, থমথমে পরিবেশ মুখরিত হয়ে ওঠল। সূচনার চোখের কোণ বেয়ে ঝরতে লাগল সুখাশ্রু। মাহেরের সুললিত ওষ্ঠ চুম্বনে হৃদয়ের স্পন্দন হয়ে ওঠল বড্ড বেসামাল। এমন আদর মেখে যত্ন নিয়ে পাওয়া চুমুটায় যেন সুখে মরণ যন্ত্রণা পেল সে। শেষে প্রকৃতির কোন নিয়ম মেনে আপনাআপনিই দু-হাত চলে গেল মাহেরের পৃষ্ঠদেশে জানেনা। প্রচন্ড জোরে খামচে ধরল পিঠে। মাহেরের দখলে থাকা ওষ্ঠজোড়া যেন একটু সুযোগ পেলেই লাজুক স্বরে বলে বসবে,
-” এই সারপ্রাইজ আমি কীভাবে সহ্য করি, কোথায় লুকিয়ে রাখি? এই মুহূর্তটা আমি কীভাবে ভুলি? ”
______
সোহান, রোশানের দু’টো শর্ত পূরণ করার জন্য রাত আটটার দিকে হৈমীকে ছাদে যেতে হলো। বিচ্ছু দু’টো বলেছিল বারোটার পর ছাদে গিয়ে একা একা আধাঘন্টা কাটাতে হবে। সে রাজি হয়নি। তাই বাধ্য হয়ে তারা সময় নির্ধারণ করেছে রাত আটটা। রোশান, সোহানের জন্য সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, আজ হৈমীকে তারা দারুণভাবে জব্দ করবে। কেউ বাঁধা দেবে না। কারণ বাড়িতে এ সময় কেউ নেই। দাদিন আর কুসুম নিচেই থাকে তারা এ সময় উপরে আসবে না। সূচনা গেছে স্বামীর সঙ্গে একটু বাইরে সময় কাটাতে। রুদ্র কোথায় গেছে জানে না৷ সাদমান গেছে এলাকার বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে, ফিরতে রাত দশ, এগারোটা বাজবে। তাই পুরো দমে জমে যাবে তাদের দুর্ধর্ষ পরিকল্পনা।
চলবে…