#বৌপ্রিয়া
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – |৪|
‘ তোর উচ্ছাস ভাই কল করেছে রে কুসুম। নে, কল ধরে কথা বল। ‘
কুসুম পড়ছিল। কদিন পরেই দশম শ্রেণীর প্রথম সাময়িক পরীক্ষা। কুসুমের ক্লাসে ফলাফল বরাবরই দুর্দান্ত। প্রথম না হলেও, সবসময় রোল ১-৩ এর মধ্যে থাকে। উষার কথা শুনে কুসুমের কান লাল হয়ে গেল। যেন গরম ধোঁয়া উঠছে কান থেকে। কুসুম মাথা তুলে তাকাতে পারল না। নত মুখে বইয়ে ডুবে বলল,
‘ আমি পারব না আপা। আমার অস্বস্থি হয় তার সঙ্গে কথা বলতে। ‘
উচ্ছাসের কল এসে এতক্ষণে কে”টেও গেছে। উষা মোবাইল টেবিলের উপর রাখল। কুসুমের পাশে বসে কুসুমের মাথায় হাত বুলাল। কুসুম তখন অস্বস্থিতে জমে। ফোনটা আবার বেজে উঠেছে। ধমধম-ধমধম করে ফোনের ভাইব্রেন্টে টেবিলে কেঁপে উঠছে। কুসুম সেদিকে আড়চোখে চেয়ে পুনরায় বইয়ে মুখ গুজে দিল। উষা বলল,
‘ ধুর বোকা। বিয়ে হয়েছে সবে। এখন কথা বলে বলে ফ্রি না হলে, সংসার করবি কিভাবে? মোবাইল রেখে গেলাম। ইচ্ছে হলে কল রিসিভ করিস, নাহলে রেখে দিস। উচ্ছাস কল করে ম”রে যাক, তোর তাতে কি? তাইনা? ‘
কুসুম দ্রুত বলল,
‘ ফোন রেখে যেও না, আপা। ‘
কুসুমের কথা কানে তুলল না উষা। এতক্ষণে সে বাহারি রেশমী চুল আঙ্গুলের ডগায় পেঁচাতে পেঁচাতে ঘর ছেড়েছে। কুসুম পরল মহা ফ্যাসাদে। গা অস্বস্তিতে জ্ব”লে যাচ্ছে যেন। এই নতুন বিয়ে নামক শব্দ তার ঠিক সহ্য হচ্ছে না। উচ্ছাসের কথা মনে করলেই তার পেটের ভেতরে কেমন যেন গুড়ুম গুড়ুম করে উঠে। মো”চড় দিয়ে উঠে বুক। এই অদ্ভুত অনুভূতি ঠিক সহ্য হচ্ছে না কুসুমের। কুসুম মোবাইল উল্টো করে টেবিলের উপর রেখে আবার পড়তে লাগল। না, কল বেজেই যাচ্ছে। ফোনের ভাইব্রেন্টে টিকে থাকা যাচ্ছে না। টেবিল কাঁপছে, সেই সঙ্গে কাঁপছে কুসুমের বুক। ইশ! ব”জ্জাত বুক এত ধরফর করছে কেন? কুসুম কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। ফোন না ধরে একসময় পারল না। কল রিসিভ করে কানে লাগাল।
‘ হ্যালো। ‘
কুসুমের কথা শুনে উচ্ছাস বলল,
‘ এতবার কল দিলাম। এখন ধরার সময় হল। পড়ছিলে? ‘
কুসুম মিনমিন করে বলল,
‘ হুঁ। আপনি কিভাবে জানেন? ‘
‘ তোমার বোন বলল, তুমি খুব পড়াকু মেয়ে। সারাক্ষণ চোখ দিয়ে বই খেতে থাকো। তাই গেইস করলাম। ‘
উচ্ছাসের ফোনের কণ্ঠ ভীষন সুন্দর। ছাড়াছাড়া, স্পষ্ট সব কথা। কোথাও কোনো ছন্দপতন নেই। কাজের সাথে, তার কথা বলার স্টাইলও পারফেক্ট। এত পারফেক্ট একজন ছেলে আল্লাহ কি না কুসুমের মত অগোছালো মেয়ের কপালে জুটিয়ে দিলেন? ইশ! কুসুম বলল,
‘ কি দরকারে কল করেছেন? ‘
উচ্ছাস কোনোরূপ কথা বাড়ানোতে গেল না। সোজাসাপ্টা বলল,
‘ আমি দুইদিন পর লন্ডন চলে যাচ্ছি। জানো তো? ‘
কুসুম কেপে উঠল। মৃদু স্বরে মাথা দুলাল,
‘ হুঁ। ‘
‘ ওহ, ভালো। আসলে আম্মা বলল, তোমাকে একবার আমাদের বাড়িতে আনতে। সারাদিন থেকে তারপর রাতে আমি গিয়ে দিয়ে আসব। বাড়িতে সবাই তোমার সঙ্গে একদিন কাটাতে চাচ্ছে? আসবে? আপত্তি থাকলে বলতে পারো। আমি আম্মাকে বুঝিয়ে বলব। ‘
কুসুম কি বলবে খুঁজে পেল না। এভাবে উচ্ছাসের বাড়িতে যেতে তার খুব অস্বস্তি হচ্ছে। এই যে, গাল অস্বস্তিতে গরম হয়ে যাচ্ছে। বিয়ের আগে কুসুম রোজ যেত উচ্ছাসদের বাড়ি। কিন্তু অষ্টম শ্রেণীতে উঠার পর মা বলল, উচ্ছাসের বাড়িতে আর না যেতে। কুসুম তখনো জানে না, উচ্ছাস ভাইয়ের সঙ্গে কুসুমের বিয়ে ঠিক হয়েছে। বিয়ের আগে যে তাদের দেখাসাক্ষাৎ মা বন্ধ করে দিতে চেয়েছেন, তা কুসুম জানলোই না।
‘ কি হল? কথা বলছ না। আপত্তি আছে? লজ্জা পেও না। বলো। ‘
কুসুম মৃদু স্বরে বলল,
‘ মাকে জিজ্ঞেস করেন। মা যা বলবেন। ‘
দেখা গেল, উচ্ছাস হাসছে। প্রাণখুলে হেসে তারপর বলল,
‘ মায়ের মেয়ে, মাকে আমি জিজ্ঞেস করে নিয়েছি। তোমার মা”ই বললেন তোমাকে জিজ্ঞেস করতে। ‘
ইশ! কি সুন্দর করে বলল, ‘ মায়ের মেয়ে ” এত সুন্দর করে কথা বলে সে। কুসুমের বুক কাঁপে। কুসুম বলল,
‘ আমি রাজী। ‘
‘ কবে আসতে চাও? ‘
‘ আগামীকাল। ‘
‘ ঠিকাছে। দুপুরের দিকে তৈরি থেকো। আমি এসে নিয়ে যাব। রাখছি এখন। ‘
‘ ঠিকাছে। আসালামুয়াইকুম। ‘
উচ্ছাস হেসে বলল,
‘ ওয়ালাইকুম আসসালাম। রাখছি। ‘
কুসুম চট করে কল কেটে দিল। মোবাইল টেবিলের উপর ধড়াস করে রেখে বুক চেপে ধরল। দম বন্ধ হয়ে আসছে যেন। জীবনে প্রেম কি জানে নি কুসুম। প্রেম করতেও বুকের পাটা লাগে। কুসুমের বোধহয় সে বুকের পাটা’টাই ছিল না। তাই তো কক্ষণো প্রেমে জড়ায় নি। তারপর প্রেম নয়। সোজা বিয়ে করে বসল কাউকে। এখন এই সদ্য বিয়ের অনুভূতি কুসুম সামলাতে পারছে না। একদম না। কেমন যেন লাগছে তার। উচ্ছাস ভাইয়ের সঙ্গে এতক্ষণ কথা বলে এখন অস্থির লাগছে। উচ্ছাস ভাইয়ের কথা বলার ধরন সুন্দর, ভয়াবহ সুন্দর। এই সুন্দর বিষয়টাই কুসুমের হৃদয় নাড়িয়ে দিয়েছে। ইশ! কুসুম পড়ায় মন দেবার চেষ্টা করল। পারছে না, হচ্ছে না। এখনো বুক কাঁপছে। কুসুম কি করবে তাহলে? ভেবে পাচ্ছে না।
_________________________
কুসুম তৈরি হচ্ছে না। বিছানার উপর এখনো ঘাপটি মেরে বসে রয়েছে। উষা এসে কতবার বলল, তৈরি হয়ে নে কুসুম। উচ্ছাস এই এলো বলে। তবুও কুসুমের কোনো নড়চড় হচ্ছে না। মূলত কুসুম যেতে চাইছে না। নার্ভাস লাগছে। খালার বাড়ি হলেও, কুসুম গত দুই বছর ধরে সে বাড়ি যায়নি। আজ যাচ্ছে। তবে খালার বাড়ির বৌ হয়ে। তাতেই কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে কুসুমের। উষা কুসুমের জামা কাপড় বের করে বিছানার উপর রাখল। কুসুমের পাশে বসলেই কুসুম উষার হাত খামচে ধরে বলে,
‘ আমি ওই বাড়ি যাব না, আপা। আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। ‘
উষা বলে,
‘ পাগল মেয়ে। তুই তোর খালার বাড়ি যাচ্ছিস। বৌ ভাবছিস কেন নিজেকে, পাগল। এখন তৈরি হ। উচ্ছাস এলে তোকে তৈরি না দেখলে হুলস্থুল কান্ড বাঁধিয়ে দেবে। ‘
কুসুম এখনো বসেই রইল। নিচের ঠোঁট কা”মড়ে বিছানার উপর রাখা জামা কাপড়ের দিকে চেয়ে রইল। খয়েরী রঙের শাড়ী পরে যাবে কুসুম। সেটাই বিছানার উপর রাখা। হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজে কুসুম চমকে উঠল। উষা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,
‘ তৈরি হস নি। উচ্ছাস এসে গেছে। ব”কা দেয় কি না, দেখ। ‘
কুসুম ভয় পেল কী? বোধহয় হ্যাঁ। এই যে কুসুম কেপে উঠছে সময়ের সাথে সাথে। কেন? লজ্জায়, অস্বস্থিতে নাকি ভয়ে?
#চলবে