#বৌপ্রিয়া
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব-২৪
কেটে গেছে কটাদিন। কুসুম এবং উচ্ছ্বাস কদিনের মধ্যে হানিমুনে কক্সবাজার যাবে। তবে তার আগে উচ্ছ্বাসের ফুপুর মেয়ে মানহার জম্মদিন পালন করা হবে। মানহা এবার বায়না ধরেছে ধুমধাম করে জম্মদিন করার। তাই উচ্ছ্বাসের ফুপা মেয়ের বায়না রেখেছেন। বাড়িতে ধুমধাম করে জম্মদিন করার পাশাপাশি মাদ্রাসা এবং এতিমখানায় খাওয়ানো হবে। তাই উচ্ছ্বাস হানিমুনের তারিখ আরো দুইদিন পেছালো।
কুসুম সবে গোছল করে বেরিয়েছে। ভেজা চুল হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে নিল ঝটপট। বাথরুব গায়ে দিয়ে আলমারির সামনে এসে দাঁড়ালো। আজ সে সাদা রঙের জর্জেটের শাড়ি পরবে। আজকের জন্মদিনের পার্টির থিম সাদা। সেই উপলক্ষে শিউলি কদিন আগে কুসুমের জন্যে একটা সাদা শাড়ি কিনে এনেছে। কুসুম সেটাই এখন পরবে। তবে আলমারি তন্নতন্ন করে খুঁজেও সাদা শাড়ি পাওয়া গেল না।
আধা ঘন্টা ধরে সম্পূর্ণ আলমারি ঘেঁটে সিল্কের সেই শাড়ি খুঁজে পাওয়া গেল না। কুসুম অস্থির বোধ করল। আলমারির আনাচে কানাচে খোঁজ চালালো। পেল না কোথাও!
কুসুম যখন শাড়ির খুঁজে কাবার্ড এলোমেলো করতে ব্যস্ত, ঠিক তখন উচ্ছ্বাস ব্যস্ত পায়ে ফোনে কথা বলতে বলতে রুমে ঢুকছে। কুসুমকে অস্থির দেখে সে ফোন কেটে এগিয়ে আসে।
‘ কি খুজছ? ‘
‘ আমার সিল্কের শাড়ি! শিউলি আজকে পরার জন্যে দিয়েছিল। সেটা এখন কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। ‘
কুসুমের অসহায় গলা শুনে উচ্ছ্বাস মোটেও চিন্তিত হল না। বরং তাকে নিশ্চিন্ত দেখা গেল। সেদিন শাড়ির পাতলা আঁচল দেখেই উচ্ছ্বাসের মেজাজ পুরোপুরি বিগড়ে গিয়েছিল। কৌশনে কুসুমকে বোঝাতে চেয়েছিল শাড়িটা উচ্ছ্বাসে ভালো লাগে নি। কিন্তু অবুঝ কুসুম সেটা বুঝে নি। তাই উচ্ছ্বাস রাতের দিকে কুসুম ঘুমে থাকাকালীন শাড়ি নিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে। কুসুম সেটাই এখন খুজছে?
উচ্ছ্বাস এতকিছু বললো না কুসুমকে। সে ধীর পায়ে বিছানার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,
‘ আমি ফেলে দিয়েছি ওটা। ‘
কুসুম তাজ্জব বনে গেল। এগিয়ে এসে বলল, ‘ কেন? কেন ফেললেন? শাড়িটা কি সুন্দর ছিল। আমাকে ভালো লেগেছিল শাড়িতে। আপনার সামনেই না সেদিন ট্রায়াল দিলাম। তখন কেন বললেন না কিছু। এখন আমি আজকে পরব। আজকেই ফেলে দিলেন। কেন? ‘
উচ্ছাস পায়ের থেকে স্যান্ডেল খুলল। চশমা খুলে টেবিলে রেখে সাদা শার্ট আর প্যান্ট দিয়ে বাথরুমে গোসল করতে চলে গেল। যাবার আগে বলে গেল, ‘ এখন থেকে শরীর বোঝা যায়, এমন শাড়ি পরার দরকার নেই। লাইট অফ করে দাও। আমি ঘুমাব। ‘
কুসুম হতভম্ব হয়ে গেল উচ্ছাসের কথা শুনে। শাড়িতে শরীর একটু হলেও সেদিন বোঝা যাচ্ছিল। তাই কুসুম বারবার উচ্ছ্বাসকে বলেছে শাড়িতে তাকে ভালো লাগছে কি না। উচ্ছ্বাস তখন কিছুই বলে নি। এই মানুষটা এমন অন্যরকম কেন?
কুসুমও আর ঘাটাল না নিজেকে। যে শাড়ি, যে পোশাক উচ্ছ্বাসের পছন্দ নয়, সেই পোশাক কুসুম আজ থেকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিবে। উচ্ছ্বাসের সকল অপছন্দ আজ থেকে কুসুমের নিজেরও অপছন্দ। কুসুম খুঁজে খুঁজে পুরোনো এক সাদা রঙের শাড়ি বের করে পরে নিল। আজকে কুসুম নিজে নিজে বেশ সুন্দর করে শাড়ি পরল। সেদিন ঊষা আপার শাড়ি পরানো খুব সূক্ষ চোখে কুসুম লক্ষ্য করেছে।
কুসুম রেডি হয়ে নিচে নেমেছে। জন্মদিনের আয়োজনে সবাইকে সাহায্য করে উচ্ছ্বাসকে ডাকতে উপরে এল। উচ্ছ্বাস তখন তৈরি হয়ে হাতে হাতঘড়ি পরছে। সাদা ব্লেজারে বেশ ভালো লাগছে উচ্ছ্বাসকে। কুসুম শুধু চেয়েই থাকলো উচ্ছ্বাসের দিকে। চোখে যে। ধাঁধা লেগেছে তার। কুসুমকে দেখে উচ্ছ্বাস চুলে জেল লাগাতে লাগাতে বলল,
‘ শাড়ি ফেলে দিয়েছি বলে কি রাগ করেছ? শাড়ি আমার ভালো লাগেনি আসলে। তোমাকে আমি দেখে দেখে আরো সুন্দর শাড়ি কিনে দেব। তবে আজ থেকে ওসব শাড়ি পরে আমার অন্তর পুড়িও না, হুঁ? ‘
কুসুম হেসে ফেললো উচ্ছ্বাসের কথা শুনে। এগিয়ে এসে উচ্ছ্বাসের ব্লেজারের কলার ঠিক করে বলল,
‘ মোটেও রাগ করিনি আমি। আর না আপাতত আমার কোনো শাড়ি লাগবে না। শাড়ি আছে আলমারিতে। বিয়েতেও অনেক শাড়ি পেয়েছি। সেগুলো শেষ করি আগে। ‘
উচ্ছ্বাস মৃদু হাসলো। একটু সূক্ষভাবে কুসুমকে দেখে নিয়ে মোহগ্রস্ত গলায় বলল,
‘ শাড়িতে মোটেও তোমাকে ছোট লাগে না। সমবয়সী মনে হচ্ছে এখন।’
কুসুম মুচকি হাসলো। উচ্ছ্বাসকে দ্রুত তৈরি হতে বলে চলে যেতে নিলে উচ্ছ্বাস পেছন থেকে কুসুমের হাত আটকে নেয়। হাতে ধরে হেচকা টান দিতেই কুসুম ছিটকে এসে উচ্ছ্বাসের বুকে এসে পরে। কুসুমের নাক এসে লাগে ম্যানলি পারফিউমের গন্ধ। কুসুম মোহিত হয়ে যায়। উচ্ছ্বাস নিজের বুক থেকে কুসুমের মুখ দুহাতের আজলায় পুড়ে নিয়ে উচু করে তুলে। কুসুম চোখ বন্ধ করে। তারপর ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকায়। দুজনের চোখে চোখ পরে। চোখে চোখে কথা হয়। পবিত্র কিছু অনুভূতি দোলা দিয়ে যায় দুজনের মনে। উচ্ছ্বাস মৃদু স্বরে বলে,
‘ আজকে তোমায় অন্যরকম লাগছে। একদম ডিফরেন্ট।”
কুসুম প্রশ্ন করল, ‘ অন্যরকম কেমন? ‘
উচ্ছ্বাস মৃদু স্বরে বলল, ‘ জানিনা। বাট তোমাকে দেখে কেমন অস্থির লাগছে আমার। ‘
কুসুম মাথা নত করে হালকা হাসে। কুসুম কি করে বলবে, উচ্ছ্বাসকে দেখেও আজ কুসুমের অস্থির অস্থির লাগছে। বুকের ভেতরে ঝড় বইছে। দাউদাউ করে জ্বলছে সবকিছু। এই সুদর্শন স্বামী স্বয়ং তার, ভাবতেই শরীরের রক্ত ছলকে উঠছে।
উচ্ছ্বাস খানিক পর ঢোক গিলে ফিসফিস করে কুসুমের কানের কাছে মুখ এনে বলে,
‘ কুসুম, ক্যান আই কিস ইউ নাও? আই কান্ট কন্ট্রোল মাইসেল্ফ টুডে ইন দ্যাট ক্রিটিক্যাল মোমেন্ট।’
কুসুমের বুক ধড়ফড় করে উঠে। বুকের উঠানামার গতি বেড়ে যায়। অস্বাভাবিক হয়ে যায় শরীরের রক্তপ্রবাহের সঞ্চালন। কুসুম মাথা নত করে। পরপর আবার মাথা তুলে তাকায়। ঢোক গিলে মাথা নেড়ে সায় দেয়। উচ্ছ্বাস হাসে। ঝলমল করে উঠে উচ্ছ্বাসের চেহারা। মুখ নামিয়ে আনে কুসুমের পাতলা ঠোঁটে। কুসুম ভেসে যায় আনন্দে। প্রথমবারের মত দুজনের মধ্যে হওয়া গভীরতম স্পর্শ। পাঁচ সেকেন্ডের মাথায় উচ্ছ্বাস সরে আসে। কুসুম লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া মুখ নত করে রাখে। থুতনি যেন মিশে যায় বুকের সঙ্গে। উচ্ছ্বাস আলতো কণ্ঠে বললো,
‘ ট্রাস্ট মি কুসুম, দিস ইজ দ্য বেস্ট ফিলিং এবার। এমন অনুভূতি আমি আমার সাতাশ বছরের জীবনে পাইনি। তুমি সত্যি আমার জন্যে বিশেষ কেউ। ‘
কুসুম কথা বলে না। লজ্জায় আপাতত সে জমে। উচ্ছ্বাস কুসুমের কপালে চুমু দেয়। কুসুম এবার সত্যি সত্যি বরফ হয়ে যায়। ছিটকে সরে আসে উচ্ছ্বাসের থেকে। একপল উচ্ছ্বাসের দিকে চেয়ে দৌঁড়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। উচ্ছ্বাস মাথা চুলকে হেসে উঠে শব্দ করে। আজ প্রথমবার কেমন অদ্ভুদ অনুভব হচ্ছে উচ্ছ্বাসের। একটু অন্যরকম, একটুখানি আলাদা, একটুখানি মিষ্টি অনুভূতি। উচ্ছ্বাস শান্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। বুদ্ধিমান উচ্ছ্বাস বুঝতে পারে, ধীরে ধীরে তার কাছে ভালো লাগতে শুরু করেছে এই কুসুমকে। ধীরে ধীরে খুব করে জড়িয়ে যাচ্ছে কুসুমের সঙ্গে
#চলবে
#বৌপ্রিয়া
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – ২৫
সেদিনের পর থেকে কুসুম উচ্ছ্বাসের সামনে এলে লজ্জায় আলুথালু হয়ে থাকে। উচ্ছ্বাসের নিজেরও এখন কুসুমকে লজ্জা লাগে। দুজন যতবার মুখোমুখি হয়েছে ততবার কুসুম মৃদু হেসে সরে যায়, উচ্ছ্বাসও মাথা চুলকে হেসে উঠে। ব্যপারটা নতুন নতুন প্রেমে পরার মতই সুন্দর। আগামীকাল তারা দুজন কক্সবাজার যাবে। রাত থেকেই দুজনের প্যাকিং শেষ করে সবকিছু তৈরি করা হয়েছে।
চলে যাবে দেখে উচ্ছ্বাস আগের দিন রাতে সব কাজ শেষ করে বেশ দেরি করেই বাড়ি ফিরেছে। উত্তেজনায় কুসুম নিজেও ঘুমায় নি। দুজন সারারাত গল্প করছিল। দুজনের আগ্রহ, খুশী তাদেরকে ঘুমাতে দেয়নি। উচ্ছ্বাস অবশ্য কয়েকবার বলেছে ঘুমানোর কথা। তবে কুসুম ঘুমিয়ে গেলে তো? কথার ফুলঝুরি যেন উপচে পরেছিল তার। কুসুমকে এত খুশী দেখে উচ্ছ্বাসও বাঁধা দেয় নি আর। কুসুমের হাসিহাসি অন্যরকম উচ্ছল চেহারা দেখতে বেশ লাগছিল তার।
বিকেলের ফ্লাইট ধরে সন্ধ্যার দিকে তারা কক্সবাজার এসে পৌঁছে। হোটেলের সমস্ত ফর্মালিটিজ পূরণ করে সবে তারা রুমে ঢুকেছে।
হোটেল রুমে ঢোকার পরপরই দুজনের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। সম্পূর্ণ বাসর ঘরের মত বিছানা সাজানো। রুমটাও মোমবাতি, বেলুন, লাল গোলাপ দিয়ে সজ্জিত করা। লাভ শেপের বিছানা, সম্পূর্ণ রুম সাদা এবং লাল রঙের আবরণে সাজানো। কুসুম পলক ঝাপটে ঝাপটে সম্পূর্ন রুম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। উচ্ছ্বাস প্রথমে কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছিল। পরপরই তার মনে হল, টাফ হানিমুন প্যাকেজ নিয়েছে। তাই তাদের হানিমুন স্টাইলে ঘর সাজানো হয়েছে। উচ্ছ্বাস মাথা হালকা নিচু করে মৃদু হাসল। চোখ তুলে তাকাল কুসুমের দিকে। কুসুম এখনো এসব হজম করতে পারে নি। উচ্ছ্বাস বলল,
‘ আমরা হানিমুন প্যাকেজ নিয়েছি না? তাই হানিমুন প্যাকেজে এই রুম সাজানো হয়েছে। তুমি কি ডিসকমফোর্ট ফিল করছ কুসুম?রুম কি পরিষ্কার করিয়ে দেব? ”
কুসুম নিজেকে সামলে নিল। পরপরই লজ্জিত আভা কণ্ঠে ঢেলে বলল, ‘ না,থাক। ভালো লাগছে দেখতে। ‘
উচ্ছ্বাস ঘরটা আরো একবার দেখে নিয়ে বলল, ‘ গোসল করে নাও। গোসল করে সমুদ্রে যাব। ‘
‘ এই রাতে? আর রাতের খাওয়া? ‘
‘ খাবার খেয়েই যাব। আর রাগের সমুদ্র দেখেছ কখনো? অসম্ভব সুন্দর হয়। গেলেই বুঝবে। সমুদ্র থেকে মধ্যরাতে হেঁটে হেঁটে ফিরব। তখন আরো বেশি ভালো লাগবে। ভেজা মাটি যখন পায়ে লাগে, উফ! জাস্ট মারাত্মক লাগে। কাদা ডিঙিয়ে চলা আমার কাছে খুব ভালো লাগে। অনেকের কাছে ঘেন্না লাগে। তবে আমার কাছে ভালোই লাগে। মাটির খুব কাছের মনে হয় লাইক মাটির মানুষ। ‘
কুসুম এতক্ষণ মুগ্ধ হয়ে উচ্ছ্বাসের কথা শুনছিল। কুসুম প্রশ্ন করল,
‘ কবার এসেছেন এখানে? ‘
উচ্ছ্বাস আঙ্গুলে গুনে নিয়ে বলল, ‘ আব…পাঁচবার। দুবার কলেজ ট্যুরে। আরো দু বার ফ্রেন্ডের সঙ্গে। আর একবার একা একা। ‘
‘ একা একা? একা একা এরকম জায়গায় এসে ভালো লেগেছিল? ‘
‘ লাগবে না কেন? আর তাছাড়া আমি তখন রেগে ছিলাম। তাই একা থাকতেই এখানে এসেছি। ‘
‘ কিসের জন্যে রাগ? ‘
‘ ডাক্তারি পড়ব না তাই। ‘
‘ কিহ? ‘
উচ্ছ্বাসের বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। চোখ বুজে ক্লান্ত কণ্ঠে বলল,
‘ ছোটবেলা থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ব ইচ্ছে ছিল। সে অনুযায়ী প্রিপারেশন নিচ্ছিলাম উচ্চ মাধ্যমিক শেষ। মেডিকেল এক্সাম এলো। বন্ধুরা অনেকেই এক্সপেরিয়েন্সের জন্যে এক্সাম দিয়েছে। তাই আমিও দিয়েছিলাম। দুর্ভাগ্যবশত ঢাকা মেডিকেলে চান্স হয়ে যায়। তারপর পুরো ব্যাপারটি বদলে যায়। আমি মেডিকেল পড়ব না, আম্মু রীতিমত যুদ্ধ করা শুরু করল আমার সঙ্গে। বাসার কেউই আমাকে বুঝে নি। তাই রাগে কক্সবাজার চলে এসেছিলাম। ‘
‘ পরে? মেডিকেলে ভর্তি হলেন কিভাবে? ‘
উচ্ছ্বাস আঙুল দিয়ে নিজের কপাল দেখিয়ে বলল,
‘ অল অ্যাবাউট লাক। এখানে এসে সবার কথা ভাবার চেষ্টা করেছিলাম। পরে মনে হল, ফ্যামিলির বিরুদ্ধে যাওয়াটা ঠিক হবে না। আর ডাক্তারি পড়া ইজ নট দ্যাট ব্যাড। তাই আর ভাবিনি। দুদিন পর বাসায় গিয়ে মেডিক্যালে পড়ব জানিয়ে দিলাম সবাইকে। তুমি ভাবতেও পারবে না, সবাই কি খুশি হয়েছিল সেদিন। এখন মনে হয়, ওই খুশি দেখার জন্যে হলেও আমি শ’বার মেডিকেলে পড়তে রাজি। কি অদ্ভুত ব্যাপার। ‘
কুসুম হেসে ফেলল। উচ্ছ্বাসও হালকা হাসল। পরপরই উচ্ছ্বাস তাড়া দেখিয়ে বলল,
‘ দ্রুত গোসলে যাও তো। তুমি এলে আমি যাব। তুমি গোসল করার সময়টায় আমি চা অর্ডার করে রাখি? চা তো? নাকি কফি? ‘
‘ চা, দু চামচ চিনি দিয়ে। ‘
‘ ওকে। যাও এখন। দেরি হচ্ছে আমাদের।’
কুসুম তাড়াহুড়ো করে শাড়ি নিয়ে বাথরুমে যাবে, তবে পেছন থেকে উচ্ছ্বাস মোবাইলে ওয়াইফাই কানেক্ট করতে করতে বলল,
‘ শাড়ি আর সেলোয়ারের কামিজ পড়ার দরকার নেই। ওয়ান পিস, বা কুর্তি এনেছ না? সেসব পরো। সমুদ্রে কেউ শাড়ি পরে যায় না। ‘
কুসুম নিজের বোকামিতে দাত দিয়ে জিহ্বা কামড়ে ধরল। লং কুর্তি নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল।
দুজন গোসল করে পরিপাটি হয়ে চা খেয়ে খানিক গল্প করল। ডিনারের সময় একবারে সমুদ্রে যাবার জন্যে তৈরি হয়ে নিচে নেমে এলো।
হোটেলে সি ফুড পাওয়া যাচ্ছে। উচ্ছ্বাস দেখে দেখে খাবার টেবিলে সব সি ফুড অর্ডার করল। কুসুম প্রথম প্রথম ইতস্তত করল সি ফুড খেতে। পরে উচ্ছ্বাস অনেক বুঝিয়ে দু একটা আইটেম ট্রাই করাল। তাতেই কাজ হল। কুসুম পরের খাবারগুলো স্বতঃস্ফূর্ত খেতে লাগল। উচ্ছ্বাস বুঝতে পারল, কুসুমের খাবার মজা লেগেছে।
_______________________
রাতের সমুদ্রের তীর নীরব, নিস্তব্ধ। হাতে গোনা কয়েকজন দেখা যাচ্ছে। উচ্ছ্বাস দেখে দেখে বেশ দূরের এক জায়গায় এলো। এখানে মানুষের শোরগোল একদম নেই। শুনশান জায়গা। তুমুল বাতাস, সেই সঙ্গে সমুদ্রের উত্তাল পাত্তাল গর্জন। কুসুম মুগ্ধ দৃষ্টিত চেয়ে আছে সমুদ্রের দিকে। একটু এগিয়ে গিয়ে কুসুম সমুদ্রের পানিতে পা ভেজাল। উচ্ছ্বাসও কুসুমের পেছনে পেছন আসছে। কুসুম ভয়ে বিয়ে আরো একটু এগিয়ে এল। আরো একটু গভীর পানিতে পা নামাল। উচ্ছ্বাস এসব দেখে হাসল। হুট করে এগিয়ে এসে কুসুমকে কোলে তুলে যতটা গভীরে যাওয়া যায় গেল। কুসুম ভয়ে দুবার চিৎকার দিল। উচ্ছ্বাস আঙুল দিয়ে কুসুমের ঠোঁট বন্ধ করে ফিসফিস করে বলল,
‘ সাইলেন্ট অ্যান্ড ইনজয় দিস ম্যাজিকাল মোমেন্ট। ‘
কুসুম চুপ হয়ে গেল। উচ্ছ্বাসের বুক বরাবর পানি। উচ্ছ্বাস সেখানে কুসুমকে কোল থেকে নামিয়ে দিল। কুসুম পানিতে নেমে পায়ে কোনো ঠায় পেল না। এতেই ভয়ে চিৎকার দিয়ে বলল,
‘ আমি নামব না, ডুবে যাব,ডুবে যাব। ধরেন আমাকে। ‘
‘ শান্ত হও। আমি থাকতে তুমি ডুববে না। আমার কাঁধে ধরে রাখো। আমি তোমার ঠায় হচ্ছি। ‘
উচ্ছ্বাস কুসুমের কোমর দুহাতে জড়িয়ে ধরে ওকে উচু করে ধরল। সমুদ্রের পানি কুসুমের বুক বরাবর এসে ঠেকল। কুসুম শান্ত হল এবার কিছুটা। চারপাশ দেখল। যেদিকে চোখ যায় পানি আর পানি। এত এত পানি দেখে খুশিতে কুসুমের দম বন্ধ হয়ে আসছে। কুসুম হারিয়ে যাচ্ছে অতল মুগ্ধতায়। উচ্ছ্বাস মৃদু স্বরে বলল,
‘ ক্লোজ ইউর আইজ। ‘
কুসুম চোখ বন্ধ করল। উচ্ছ্বাস নিজেও চোখ বন্ধ করল। কুসুমের কানে এখন শুধু সমুদ্রের তীব্র গর্জন ভেসে আসছে। পানির শব্দ, সামনে গা ঘেঁষে থাকা উচ্ছ্বাসের নিঃশ্বাসের শব্দ, আকাশের নিচে রাতের নিস্তব্ধতার শব্দ, সব মিলিয়ে কুসুম সম্মোহিত হয়ে যাচ্ছে। উচ্ছ্বাস বলল,
‘ এবার আমার কাঁধ থেকে হাত সরাও। দুহাত দুদিকে স্বাধীনভাবে ছড়িয়ে দাও। এমনভাবে নিজেকে ছেড়ে দাও সমুদ্রে, যেন তুমি উড়ছ। পানিতে পাখির ন্যায় উড়ার চেষ্টা করো। ‘
কুসুম তাই করল। আস্তে আস্তে উচ্ছ্বাসের কাধের উপর থেকে নিজের হাত সরাল। এবার যেন কুসুম একটুও ভয় পেল না। সমুদ্রের গভীরতা আপাতত কুসুম ডুবে। নির্দ্বিধায় দুহাত দুদিকে ছড়িয়ে দিল। পানির ঝাপটা এসে দোল খেল কুসুমের দুহাতে। ভিজিয়ে দিয়ে গেল শরীরের সঙ্গে কুসুমের মন। উচ্ছ্বাস বলল,
‘ এবার মাথা আকাশের দিকে তুলো। ‘
কুসুম মাথা আকাশের দিকে তুলে ধরল।
উচ্ছ্বাস নিজেও আকাশের দিকে তাকাল। সম্মোহনের ন্যায় বলল,
‘ এবার চোখ ধীরে ধীরে খুলে তাকাও। ‘
কুসুম ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকাল। এ কেমন অনুভূতি? উপরে আকাশ, নিচে সমুদ্রে, সমুদ্রে পাখির ন্যায় উড়ে বেড়ানো ওরা দুজন। আশপাশে কিচ্ছু নেই, কিচ্ছু না। পুরো পৃথিবী এই মুহূর্তে কুসুমের কাছে অদৃশ্য হয়ে গেছে। চোখের সামনে ভাসছে রাতের তারাময় বিশাল কালো আকাশ, কানে আসছে সমুদ্রের গান। কুসুমের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল,
‘ ই-ইটস ম-ম্যাজিকাল। ‘ ‘
#চলবে