#ভালবাসা_বাকি_আছে -২৪
হাসিন রেহেনা
(কোন অবস্থাতেই গল্প কপি করবেন না।)
শিউলি বেগম রুকুর খোজে গিয়ে দেখলেন মেয়েটা কাঁদছে। আরমানের সাথে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা সখ্যতার কথা অজানা নয় তাঁর। এ ভয়টাই পাচ্ছিলেন তিনি। মেয়েটার মন এত নরম।
বিছানার উপর রুকুর ফোন ভাইব্রেট করছে একনাগাড়ে। আরমান কলিং। দেখলেন শিউলি বেগম।
ছেলেটার এতদিন প্রশংসাই শুনেছেন অন্যদের কাছে, এমনকি রুকুর কাছেও। অথচ আজ!! মেয়ের চোখে পানি দেখে মায়ের বুকটা ফেটে যাচ্ছে। সত্যিই কি আরেকটু ভাবা উচিত ছিল।
“আমি কি তোর ভাইয়ার সাথে কথা বলব?” , আলতো করে বললেন তিনি।
ঝট করে মুখ তুলে রুকু বলল, “কি কথা বলবে?”
“তুই চাইলে তোর ভাইয়া ওদের কাছে ক্ষমা চাইবে। তবু কাঁদিস না এত।“
“আম্মা… কি বল এগুলা? ভাইয়া কেন ছোট হবে ওদের কাছে?”
অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে রুকু। সবসময় অন্যায়ের সাথে আপোষ না করা মা যে মেয়ের সুখের জন্য এমন কথা বলতে পারে ভাবতেই পারছে না ও। আর আসলেই কি এভাবে সুখের সওদা করা যায়?
ততক্ষণে রায়হানও হাজির।
মাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আচ্ছা আম্মা তোমার কি মনে হয় আমি রুকুর সাথে কথা না বলে নিজের সিদ্ধান্ত চাপায়ে দিছি? তাহলে তো যখন উনারা উল্টাপাল্টা বলা শুরু করছে তখনই যা বলার বলতাম। আমাকে তুমি এই চিনলে মা?”
শিউলি বেগম ছেলের আক্ষেপ দেখে লজ্জা পেলেন। মায়ের মন যে উচাটন হয়েই ক্ষমা চাওয়ার কথা বলেছে সেটা ঠিকই বুঝেছে রায়হান।
আলতো করে মায়ের হাত ধরে বলল, “ওকে একটু সময় দাও আম্মা। কাঁদুক। মনটা হালকা হবে। দিনের পর দিন প্রিয় মানুষের থেকে আশাভঙ্গের কান্নার চেয়ে একদিন, দুইদিন, দশদিনের কান্না ভালো।“
তারপর বোনের দিকে হাতের র্যাপিং পেপারে মোড়ানো বক্সটা এগিয়ে দিল।
বোনের চেহারায় প্রশ্নবোধক দৃষ্টি দেখে রায়হান বলল, “খুলে দেখ।“
র্যাপিং পেপার খুলতেই বেরিয়ে এল একটা জুয়েলারি বক্স। বক্সের ভেতর একটা মাঝারি সাইজের একটা সীতাহার। সচরাচর স্বর্নের যেমন সীতাহার দেখা যায় তার চেয়ে বেশ আলাদা। মুক্তা আর স্বর্নের এর চেয়ে ভাল কম্বিনেশন বোধহয় সম্ভব না। পাশাপাশে চার লাইন মুক্তার চেইন নিচে এসে তিন স্টেপের স্বর্নের লকেট। প্রতিটা লকেটের দুইপাশে কয়েকটা করে মুক্তাগুচ্ছ। আর সবার শেষের ছোট্ট লকেটার নিচে লম্বাটে বড় একটা মুক্তার দুপাশে দুইটা ছোট ছোট মুক্তাগুচ্ছ। আর ছোট লকেটটার সাথে মিলিয়ে মাঝারি সাইজের একজোড়া কানের দুল।
শিউলি বেগম হেসে বলল, “তুই না একটু আগে ভরা মজলিশে বললি বোনকে এক আনা স্বর্ণও দিবি না?”
“দেখো না? সেজন্যই তোমার মেয়ে কান্নাকাটি শুরু করছে?“, রুকুকে রাগাতে বললো রায়হান।
রুকু মুহুর্তের জন্য কান্না ভুলে রেগেমেগে উঠে ভাইকে কিলঘুষি মারতে ভুলল না। আর রায়হানও নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে বোনের মার খাচ্ছে।
ভাই বোনের মধুর বিবাদ দেখে চোখের পানি আড়াল করলেন শিউলি বেগম।
“ভাইবোন যা খুশি কর।“, বলে কপট রাগ দেখিয়ে বেরিয়ে গেলের শিউলি বেগম।
মারামারিপর্ব শেষ হলে রুকুকে বিছানায় বসিয়ে হাতদুটো মুঠোর মধ্যে নিয়ে বলল, “আজকে কান্নাকাটি করতেছিস কর, মানা করব না। কিন্তু, জীবনে কখনো কেউ কষ্ট দিলে মনে রাখবি, ভাইয়া ইজ অলওয়েজ দেয়ার ফর ইউ। যাস্ট একটা ফোনকলের দূরত্ব। ঠিক আছে?”
রুকু আবার কাঁদল। সুখের কান্না। স্বস্তির কান্না। সৌভাগ্যবতী বোন হওয়ার কান্না।
“আম্মা এত্তগুলো গহনা বানাইছে কয়দিন আগেই। আবার এটা কিনতে গেলে কেন?”
রায়হান ভেংচি কেটে বলল, “আমি কি শখে পকেটের টাকা নষ্ট করছি? আম্মা তোর গহনাগুলো আনতে পাঠাইছিল আমাকে। সেগুলো নিয়ে ফেরার সময় এটাতে চোখ আটকে গেল। এত সুন্দর জিনিসটা দেখে মনে হল, বাড়িতে একটা পাগলি আছে, তার গলায় এটা ভাল মানবে। গেল আমার এতগুলো টাকা গচ্ছা।“
“এহহ। বুশরার জন্য তো কিনতে দেখি না বিয়ের এতদিনেও।“
“আমার বউ এসব গয়নাগাটিফাটি পছন্দ করেনা।“
“বাব্বাহ… বউয়ের পছন্দ অপছন্দের উপর পিএইচডি করে ফেলছো দেখি!”
“একটু করা লাগে। বয়স তো আর কম…”
রুকুর ফোনটা তখনো ভাইব্রেট করছে। রায়হান সেটা দেখে বেরিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিল।
যাওয়ার আগে বলল, “চাইলে কথা বলতে পারিস। বা ব্লকলিস্টেও ফেলে দিতে পারিস। যদি একান্তই ভুলতে না পারিস, আমি বিয়ের ব্যবস্থা করব তোর সুখের জন্য। চিন্তা করিস না, ক্ষমা চাইবো না। এমন ছেলে আর তার পরিবারকে কন্ট্রোলে রাখার মত ক্ষমতা ভাইয়ার আছে। যেটাই কর, ভেবেচিন্তে। ওকে?“
রুকু মাথা নেড়ে সায় জানালো আর বলল,”ভাইয়া, বুশরাকে এসব বলোনা এখন, বেচারি ডেডলাইনের প্রচুর চাপে আছে। সপ্তাহখানেক পর আমি নিজেই বলব।“
আচ্ছা বলে বিদায় নিল রায়হান। আর এই কারনেই বাড়িতে ঘটে যাওয়া সুনামির খবর দেশান্তরে পৌঁছায়নি বেশ কয়েকদিন। এই এক সপ্তাহে হাজারবার ফোন করেছে আরমান। প্রথমে হম্বিতম্বি করেছে রায়হানের অপমানের কারনে। তারপর একসময় ক্ষমা চেয়েছে। শেষ পর্যন্ত রুকু অনড় দেখে অনুনয় বিনুনয়ও করেছে।
আদতে আরমান ছেলেটা খারাপ না। রুকুর মত আরমানও একটা সুখের নীড়ের স্বপ্ন দেখেছিল। দুজনে একসাথে অনেকটা ভাল সময়ও কাটিয়েছিল। নিত্যদিনের জীবনে যথেষ্ট ব্যাক্তিত্ববানও। কিন্তু পরিবারের অন্যায় আবদারের সামনে কিভাবে কিভাবে মাথা উচু করে ভুলটা ধরিয়ে দিতে হয় সেটা জানা নেই ওর। আর এখানেই চেনা আরমান অচেনা হয়ে দৃশ্যমান হয়েছে রুকুর কাছে। কঠিন হলেও আরমান চ্যাপ্টার ক্লোজ করার সিদ্ধান্তে অনড় থেকেছে রুকু।
প্রাণপ্রিয় বান্ধবীর এই মেন্টাল ব্রেকডাউনের সময়টাতে কিছুই করতে পারেনি জানার পর থেকেই ভীষণ খারাপ লাগে বুশরার। সারা রাত ঘুমাতে পারেনি। বুশরার শরীরটা কয়দিন যাবত ভাল যাচ্ছেনা। ডেডলাইনের প্রেসারে শরীর খারাপকে পাত্তা দেয়নি এতদিন। আর তারসাথে নির্ঘুম রাত।
এত ধকল শরীর সইবে কেন? ফলাফলস্বরূপ মাথা ঘুরে পড়ে থাকলো একলা ঘরে। জ্ঞান ফিরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো সিলিংয়ের দিকে। ওঠার চেষ্টা করতেই আবার মাথা ঘুরে আসলো।
শরীরকে ধাতস্থ হওয়ার জন্য কিছুটা সময় দিল বুশরা। তারপর ধীরেসুস্থে উঠে ফ্রেশ হল নাস্তা করল। সারাদিন বাসা থেকে বের হলো না। অভিমানে রায়হানের সাথেও কথা বলল না। রুকু না বলুক। রায়হান তো বলতে পারত। ও তো জানে রুকুর এত ভালো বন্ধু আর নেই যার সাথে সব শেয়ার করে হালকা হতে পারে।
ওদিকে আরমান কয়েকদিন চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল। অবশ্য হাল না ছেড়ে উপায় নাই। সোশ্যাল মিডিয়া, ফোন থেকে শুরু করে সবখানে ওকে ব্লক করে দিয়েছে রুকু। ও খুব চেষ্টা করছে স্বাভাবিক থাকার। আর সবাই মিলে সাপোর্টটাও দিচ্ছে ওকে। বিয়ে বিষয়ক কোন কথা রুকুর কানে যাতে না পাড়া হয় আপাতত, রুস্তম শেখের কড়া নিষেধাজ্ঞা।
এর মাঝে ঘটনা যা ঘটল সেটা হল বেশ কিছুদিন পেরিয়ে গেলেও বুশরার শরীর ভাল হলো না। প্রচন্ড শারিরীক দুর্বলতা, ঘুম থেকে উঠে মাথা ঘোরা, হালকা গা গরম, এসিডিটি আরো নানান সমস্যা বাসা বাঁধতে লাগল শরীরজুড়ে।
তানিয়াপু সামনাসামনি দেখে একদিন আঁতকে উঠলেন, “এ কি হাল হয়েছে তোর বুশরা? শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছিস তো একদম।“
“ও কিছু না আপু, শরীর ভালো যাচ্ছে না কদিন ধরে।“
কথাবার্তার এক পর্যায়ে বুশরাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আর ইউ প্রেগন্যান্ট?”
“ধুর, খালাম্মাদের মত কি বলো আপু। আমি মোটেও বমি টমি করি না।“
“ডাক্তার হয়ে তুই খালাম্মাদের মত কথা বলছিস কেন? সবার মর্নিং সিকনেস কি এক টাইমে শুরু হয়? সাইকেল মিস করেছিস আসার পর?”, এক নাগাড়ে প্রশ্ন করে গেল তানিয়াপু।
শেষ প্রশ্নটা শুনে বুশরা থমকে গেল। চেহারার অভিব্যক্তি পাল্টালো দ্রুত। তা দেখে অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে তানিয়াপু বলল, ”আর ইউ ম্যাড বুশরা? মাত্র কয়দিন সংসার করছিস। তারচেয়ে বড় কথা তোর ডিগ্রী হাফ ডান। এইটা কি প্রেগন্যান্ট হওয়ার সময়?”
তানিয়াপুর এমন প্রশ্নের কারন বা উত্তর চিন্তা করতে পারলো না বুশরা।
খুব বাজেভাবে প্রশ্নটা করা হয়েছে বুঝল তানিয়া। গলার স্বর নমনীয় করে বলল, “আমাকে খারাপ ভাবিস না। মাঝপথে এত কষ্টের ডিগ্রী ছেড়ে দিবি? নাকি বাচ্চা এবোর্ট করবি? কোনটাই তো বেঁছে নেওয়া সহজ না। আবার একলা এই বিদেশ বিভূঁইয়ে একসাথে তো দুইটা যুদ্ধ কিছুতেই করতে পারবি না।”
চলবে…
#ভালবাসা_বাকি_আছে -২৫
Hasin Rehana ( কপি করা নিষেধ)
অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে তানিয়াপু বলল, ”আর ইউ ম্যাড বুশরা? এইটা কি প্রেগন্যান্ট হওয়ার সময়?”
তানিয়াপুর এমন প্রশ্নের কারন বা উত্তর চিন্তা করতে পারলো না বুশরা।
খুব বাজেভাবে প্রশ্নটা করা হয়েছে বুঝল তানিয়া। গলার স্বর নমনীয় করে বলল, “আমাকে খারাপ ভাবিস না। মাঝপথে এত কষ্টের ডিগ্রী ছেড়ে দিবি? নাকি বাচ্চা এবোর্ট করবি? কোনটাই তো বেঁছে নেওয়া সহজ না। আবার একলা এই বিদেশ বিভূঁইয়ে একসাথে তো দুইটা যুদ্ধ কিছুতেই করতে পারবি না।”
প্রিয় তানিয়া আপুর কথাগুলো আজ ভীষণ অপ্রিয় ঠেকছে।
“আপু আমাকে একবার ল্যাবে যেতে হবে। পরে কথা হবে।“, বলে স্থানত্যাগ করল বুশরা।
ল্যাবে যাওয়ার বিষয়টা মিথ্যে নয়। তবে আরেকটু পরে গেলেও হতো। প্রাণপণ কাজের মধ্যে ডুবে শরীর আর মনের কাছ থেকে কিছুক্ষণের ছুটি খুঁজছে বুশরা। তবে তাতে কাজ হলো না। রায়হানের সাথে কথা বলতে হবে, এক্ষুনি। এই কথাটাই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। শরীর খারাপের অযুহাত দিয়ে প্রফেসরকে বলে বাসায় চলে গেল বুশরা।
বাসায় ফিরে বার দশেক রায়হানকে ফোন করে বুশরা। প্রতিবারই কল বেজে কেটে যাচ্ছে। কোন সাড়া নেই।
“মানুষটা সব সময় ব্যস্ত। কিসের এত ব্যস্ততা? ঘন্টায় ঘন্টায় তো তাকে ফোন করে বিরক্ত করি না। নাইবা দৈনন্দিন সংসারের ঝুটঝামেলা আছে। অথচ একটু ফোন করলেও দু’মিনিটের জন্য পাওয়া যায়না। নিষ্ঠুর লোক।”, নিজের মনেই এসব বলে চলে বুশরা। অভিমানেরা জল হয়ে গড়িয়ে পড়ে, বাষ্প হয়ে উবে যায়।
মন হালকা হলে ঠান্ডা মাথায় ভাবতে বসে বুশরা, “তানিয়া আপুর কথাই কি ঠিক? বাড়ি থেকে ফিরে দুইমাস প্রায় হয়ে গেছে। তার আগে আরো পনেরো বিশ দিন। আসলেই তো, তানিয়া আপুর মাথায় এলো, অথচ আমার মাথায় এলো না।“
নিজেকে বার তিনেক “গবেট” বলল বুশরা। প্রথমবার বলল, প্রেগন্যান্সির ব্যপারটা নিজের মাথায় না আসার জন্য। দ্বিতীয়বার বলল, এখনই রায়হানকে জানানোর পাগলামি করার জন্য। তৃতীয়বার বলল…
তা যাই হোক। এসব কথা থাক আপাতত। ঠান্ডা মাথায় চিন্তাভাবনা করে বুশরা একা একাই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল এই মুহুর্তে করণীয় কি। তারপর এক মুহুর্ত দেরি না করে মেডিক্যালে গেল। ডাক্তারের সাথে কন্সাল্ট করে টেস্ট স্যাম্পল দিয়ে আসলো। রিপোর্ট আসলো সন্ধ্যায়।
রিপোর্ট দেখে ডঃ হাসিমুখে বলললেন, “কনগ্র্যাচলেশনস, ইউ আর গোইং টু বি অ্যা মম। বাই দ্য ওয়ে হোয়্যার ইজ দ্য লাকি ম্যান?“
বুশরা চুপ করে আছে দেখে উনি নিজেই বললেন, “আই অ্যাম এক্সটেমলি সরি, আই শুডন্ট হ্যাভ আস্কড দ্যাট। একচুয়্যালি ইউ আর লুকিং সিক। ইউ নিড নিড এক্সট্রা কেয়ার নাউ। দ্যাটস হোয়াই আই আস্কড এবাউট হিম। ডোন্ট মাইন্ড।”
“ইটস ওকে ডঃ। একচুয়্যালি আই অ্যাম আ ইমিগ্রান্ট স্টুডেন্ট হিয়ার। মাই হাজব্যান্ড ইজ স্টেইং এট আওয়ার হোম কান্ট্রি।“
“ওহ, আই সি। ইটস গোয়িং টু বি আ টাফ জার্নি দেন। আর ইউ রেডি ফর ফাইটিং এলোন?”
বুশরাকে বিস্তারিত নির্দেশনা দিয়ে প্রেশক্রিপশন ধরিয়ে দিল দায়িত্বরত ডাক্তার।
রিপোর্ট আর প্রেসক্রিপশনের ফাইল হাতে নিয়ে মেডিক্যালের সামনের রাস্তার উপর দাড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল বুশরা।
এপার্টমেন্টে ফিরে বিছানার উপর আলগোছে ব্যাগটা ফেলে হাতমুখ ধুতে গেল বুশরা। রাত তখন বাজে নয়টা। বিছানার ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিয়ে ফোনটা হাতে নিল বুশরা। দশটা মিসড কল, রায়হানের। অনেক রাত হয়েছে এখন ওখানে। কলব্যাক করে লাভ নেই, শুধু শুধু হতাশা গ্রাস করবে আবার। তাই কল না দিয়েই ফোনটা রেখে দিল।
অথচ ওদিকের মানুষটা ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে। যে মেয়েটা কখনো একটানা তিনবার ফোন দেয়না তার এতগুলো মিসড কল দেখার পর থেকেই টেনশনে মাথা খারাপ মানুষটার। ফোনও ধরছে না। কোন বিপদ হলো না তো?
বুশরার কিছুই খেতে ইচ্ছা করে না আজকাল। তবু জোর করে খাওয়াদাওয়া করলো। খাওয়ার মাঝেই টুং করে মেসেজটোন বেজে উঠলো।
“সরি বউ”
“একটা সমাবেশ ছিলাম দেখে ফোনটা সাইল্যান্ট ছিল।“
“কোন সমস্যা হয়নি তো?”
“ঠিক আছো তুমি?”
“ফোন ধরছো না কেন?”
পরপর অনেকগুলো ম্যাসেজ আসলো। উত্তরে বুশরা ছোট্ট করে লিখলো, “হুম। আই ওয়াজ যাস্ট মিসিং ইউ। গুড নাইট।“
বুশরা ঠিক আছে শুনে মাথা ঠান্ডা হলো রায়হানের।
“আই মিস ইউ টু।”, ম্যাসেজটা দেখেও উত্তর দিল না বুশরা।
মনে মনে বলল, “বউয়ের জন্য সময় আছে আপনার?“
চেয়ারটেবিলে বসে রায়হানকে চিঠি লিখতে বসলো বুশরা। ডিজিটাল চিঠি (ইমেইল) না, হাতে লেখা চিঠি।
বারকয়েক অনেককিছু লিখেও প্রতিবারই দুমড়ে মুচড়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিল বুশরা। কিছুতেই গুছিয়ে লিখতে পারছে না। রাত বাড়ছে। একসময় লেখায় সমাপ্তি টানলো মেয়েটা।
আসার সময় খাম কিনে এনেছিল। যখন হাতের কাগজটা ভাঁজ করে খামে পুরে মুখ আটকে দিল, তখন দেয়াল ঘড়িটা ঢং ঢং করে জানান দিচ্ছে রাত্রি দ্বিপ্রহর। অসুস্থ শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে বিছনায় নিয়ে গেল বুশরা।
রায়হান যেদিন সকালে বিদেশি খামটা হাতে পেল ভীষণ অবাক হল। গত এক বছরে কতশত ভার্চুয়াল চিঠি আদানপ্রদান হলেও এই প্রথম এমন চিঠি পেল যা হাতে ধরে ছোঁয়া যাবে, অনুভব করা যাবে, চাইলে নাকে চেপে প্রিয় মানুষটার অদৃশ্য ঘ্রাণ অনুভব করা যাবে। সারাদিন বুকপকেটে বয়ে বেড়ালো সে চিঠি।
রাতে বাড়ি ফিরে দরজা আটকে চিঠিটা নিয়ে বসলো নিভৃতে। সন্তর্পণে খামটা খুলতেই বেরিয়ে এলো একটা হলুদ চিরকুট আর ভাঁজ করা চিঠি। স্বভাবতই ছোট হওয়ায় চিরকুটটা আগে মেলে ঘরল রায়হান। তাতে একটাই লাইন। নেই কোন সম্বোধন, নেই কোন পুনশ্চঃ, ইতি, সমাপ্তি।
সেটা পড়ে ফুলস্পিডে ঘুরতে থাকা ফ্যানের নিচে বসেও কুলকুল করে ঘামছে রায়হান। নিজেই নিজেকে বারবার বলছে, এমন রসিকতা করার মেয়ে বুশরা না।
কি লেখা ছিল চিঠিতে জানতে চান নিশ্চয়।
“আমাদের দুজনের মাঝে আরেকজন এসেছে”, এইটুকুই লেখা ছিল।
আসলে বিগত কয়দিন কাজের ব্যস্ততায় বউকে ভীষণ অবহেলা করেছেন এমপি সাহেব। তাই তাকে শায়েস্তা করার জন্য দ্ব্যার্থক এই চিঠি লিখেছে বুশরা। তবে তার সাথে পাঠিয়েছে মেডিক্যাল রিপোর্ট। যা প্রমাণ করে সত্যিই তাদের মাঝে আরেকটা ছোট্ট প্রাণ আসছে।
রায়হানকে ফোনে জানানো যেত। বা ইমেইল। বা হোয়াটসআপ, ম্যাসেঞ্জার। কিন্তু বুশরা ভেবেছিল এমনভাবে জানাতে যাতে ছুঁয়ে দেখার জন্য, অনুভব করার জন্য সামান্য হলেও কিছু একটা পায় মানুষটা। আর রিপোর্টটাই এজন্য উপযুক্ত মনে হয়েছে।
লেখাটা বারকয়েক পড়ে চিরকুটের সাথে থাকা কাগজটার ভাঁজ খুলল রায়হান। মেডিক্যাল রিপোর্ট দেখে যেন হার্টবিট মিস হলো রায়হানের। কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম যেন বেড়েই চললো। চিরকুটটার কথা মাথা থেকে বেরিয়ে গেল প্রচন্ড দুঃশ্চিন্তায়। বেশ কয়েকবার পুরো রিপোর্টে চোখ বুলিয়ে মূল ঘটনা বুঝতে পারলো রায়হান। চিরকুটের মর্মার্থ বুঝে দুঃশ্চিন্তারা ছুটি নিল। তার বদলে চোখের কোণে জমলো একফোটা জল। কে বলে পুরুষ মানুষ কাঁদতে জানে না?
*******