ভালোবাসা একটা বাজি পর্ব-০৮

0
328

#ভালোবাসা_একটা_বাজি(৮)

আরাফা সেই কখন থেকে বিরক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটু দুরেই আরিয়ান দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরপর গা জ্বালানো হাসির দিচ্ছে আর তেরছাভাবে কথা বলছে। আরিয়ান হেসে হেসে সুহাস কে বলে-

-” বন্ধু যে গরম পড়ছে। আমার মেকআপ গলে গলে পড়ছে রে। টিস্যু দে টিস্যু দে।

আরাফা আরিয়ানের দিকে তাকাতেই সে চোখ টিপে দেয়। আরাফা কটমট দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। আরাফা তার ড্রাইভার কে দেখছেনা। তার বাবা কে কল করলো। ওপাশ থেকে রিসিভ করতেই আরাফা বলে –

-” বাবাই আমি কখন থেকে ভার্সিটির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। গাড়িও নাই, ফাহিমও নাই।

ওপাশ থেকে গম্ভীর কন্ঠে তার বাবা বলে-

-” ফাহিম কে একটা জরুরী কাজে শহরের বাহিরে পাঠিয়েছি। তুমি রিকশা নিয়ে চলে এসো। বাসে উঠতে যেওনা আবার।

আরাফার মেজাজ বিগড়ে যায়। কোন কথা না বলেই খট করে ফোনটা কেটে দেয়। আরাফার বাবা চমকালেন না, মেয়ে রেগে গেছে তাই এমন করেছে। সে হতাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আরিয়ানের ফোনের ও রিং বেজে ওঠে। আরিয়ান বিরক্তি নিয়ে ফোন বের করে। মেহু পাখি নামটা স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে। আরিয়ানের বুকটা মোচড় দেয় অজানা কারনেই। কলটা কেটে যায়। ফোনটা আবারো নতুন উদ্যমে বাজতে থাকে। আরিয়ান ঝট করে রিসিভ করে।

-“‌ হ্যালো মেহুপাখি।

আরাফা তীর্যক চোখে তাকায়। মেহু পাখি ডাকছে। কি যে প্রেম এদের আল্লাই জানে। যত ঢং। ফোনের ওপাশ থেকে কি বলে তা আরাফা শোনে না। আরিয়ান অস্থির হয়ে কাঁপা কন্ঠে বলে-

-” মেহু পাখির কিছু হবেনা, আমি আসছি। আমি আসছি।

আরিয়ান কাউকে কিছু না বলে বাইক ছুটিয়ে চলে যায়। তার বন্ধুরা ও আরাফা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আরাফা মনে মনে বলে গার্লফ্রেন্ড এর একটা কলে কু’ত্তার মতো দৌড়েছে। বড়ই আজব। কিন্তু বাকি তিনজন তো ঝড়ের আভাস পাচ্ছে। আরিয়ান যত দ্রুত সম্ভব বাইক চালাচ্ছে। বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটাচ্ছে। এই বুঝি সব পেয়েও হারালো। বাড়ির সামনে এসে আরিয়ান বাইক থামায়। তাড়াতাড়ি বাড়িতে ঢোকে। আরিয়ান একছুটে মিহির রুমে যায়। ততক্ষনে এম্বুলেন্স এসে পড়েছে। মিহি অচেতন হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। আরিয়ানের বুকে ঝড় শুরু হয়। আরিয়ান মিহিকে পাঁজাকোলা করে এম্বুলেন্স এ নিয়ে যায়। আরিয়ানের সাথে তার বাবা-মা আসে মাহিকে নিয়ে। নিজের ছোট বোনটার এমন বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে আরিয়ানের কষ্ট হচ্ছে। এই মেয়েটা তাকে সবসময় মেন্টালি সাপোর্ট করেছে। এম্বুলেন্স থামতেই আরিয়ান মিহিকে নিয়ে নামে। তাকে নিয়ে হাসপাতালের বেডে শুইয়ে দেয়। ডাক্তার বলেছে কিছু টেস্ট করা লাগবে। শায়লা রহমানের কোলে মাহি। সে কান্না করছে খুব। শায়লা রহমান আর শহিদ মিলে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। আরিয়ান গিয়ে মাহি কে কোলে নেয়। তারপর হেসে বলে-

-” কি হয়েছে আমার মামনি টার? এভাবে কাঁদছো কেন আম্মু? তুমি তো স্ট্রং গার্ল। কাঁদেনা মা।

আরিয়ানের কথায় মাহির কান্না থেমে যায়। শায়লা রহমান ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। আরিয়ান তাদের দিকে তাকায়। চোখাচোখি হয়ে যায়, আরিয়ান চোখ নামিয়ে নেয়। অনেক কষ্টে বলে-

-” আপনারা বাড়ি চলে যান। আমি মেহু পাখির কাছে আছি।

শায়লা রহমান নাচোক করে বলেন-

-” নাহ আমরা যাবোনা। তুমি মাহিকে আমার কাছে দাও।

-” নাহ প্রিন্সেস আমার কাছে থাকুক। আপনি ওকে সামলাতে পারবেন না। বাচ্চা সামলানো সবার কর্ম নয়। আমি ওর মা কে বড় করেছি। ওকেও সামলাতে পারবো।

আরিয়ানের কথায় তার মা কষ্ট পায়। ছেলে তার উপরে অভিমান করে আছে। তিনি ইতস্তত করে বলে-

-” আচ্ছা মাহির বাবা কোথায়?

আরিয়ান এই প্রশ্নে থমকে যায়। কি উত্তর দিবে? তখন ভরাট কন্ঠে শহিদ তাজওয়ার জিজ্ঞেস করেন-

-” শফিক আর সাদিয়া কোথায়?

আরিয়ানের চোখ লাল হয়ে যায়। নিজের রাগ কন্ট্রোল করে বলে-

-“এতো জানার ইচ্ছে থাকলে। নিজের চেষ্টায় জেনে নিন। ঐসব কালো দিনের কথা আমি বারবার আওরাতে পারবোনা।

শহিদ কিছু বলতে জাবে তার আগেই ডাক্তার আসে। আরিয়ান ডাক্তারের কাছে যায়। তাড়াতাড়ি করে জিজ্ঞেস করে-

-” স্যার মেহুর জ্ঞান ফিরেছে? ওর সাথে দেখা করতে পারবো? আর রিপোর্ট এ কি এসেছে?

ডাক্তার আরিয়ান কে থামিয়ে বলে-

-” জ্ঞান ফিরেছে। দেখা করে আসুন। আর আরিয়ান আপনি আমার সাথে চেম্বারে আসুন।

শায়লা আর শহিদ মিহির কাছে চলে যায়। আরিয়ানের অনেক ভয় করছে। কি বলবে ডাক্তার। আরিয়ান ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে বসে।
এরপর ডাক্তার যা বললো তার শুনে আরিয়ানের মাথায় বাজ পড়ে। বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটাচ্ছে। সে এই কথা কাউকে বলতে না করে। আরিয়ান ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেড়িয়ে মিহির কেবিনের দিকে এগোতে থাকে। পা দুটো চলছে না। মাহিকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে আরো শক্ত করে। মাহির ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকাতেই ভেতরটা হু হু করে ওঠে। আরিয়ানের এখান থেকে মিহির কেবিনের দুরত্ব ও আজ যোজন যোজন মনে হচ্ছে। মিহি জ্ঞান ফিরেছে পর থেকেই আরিয়ানের কথা জিজ্ঞেস করে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলেছে। আরিয়ান মিহির রুমের ভিতরে আসে। মিহি কে আলতো কন্ঠে জিজ্ঞেস করে-

-” কেমন লাগছে মেহুপাখি।

মিহি কিছুক্ষন ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ধীর কন্ঠে বলে-

-” ভাইয়া আমি ম’রে গেলে তুই মাহিকে দেখে রাখিস। ওকে কখনো কষ্ট পেতে দিবি না। আর নাহলে ওকে চৌধুরী বাড়িতে দিয়ে আসিস।

আরিয়ানের বুকটা ছ্যাত করে ওঠে। এসব কি বলছে মিহি। বোনের মৃত্যুর কথা সে দুঃস্বপ্নে ও ভাবতে পারেনা। মৃত্যু হলো চরম‌ বাস্তব খুব তেতো একটা সত্য। এই দুই অক্ষরের শব্দটা এতো ভারি কেন? আরিয়ান নিজেকে ধাতস্থ করে বলে-

-” ধুরর পাগলি। এইসব আজেবাজে কথা কেউ বলে। তুই বাড়ি ফের থাপ’রিয়ে গাল লাল করে দেবো। সবসময় আজগুবি চিন্তা।

শায়লা রহমান চিন্তিত হয়ে বলেন-

-” মিহির কি হয়েছে?

শহিদ, মিহি আর শায়লা উত্তরের আশায় আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। আরিয়ান আর চোখে মিহিকে পরোখ করে বলে-

-” আরে বিপি লো হয়ে গেছিলো তাই। না খেয়ে খেয়ে শরীর দুর্বল করে ফেলেছে। বাড়ি নিয়ে তোকে চারবেলা করে খাওয়াবো।

শহিদ গলা খাঁকারি দিয়ে বলে-

-” ওকে বাড়ি নিয়ে যাবো কবে?

আরিয়ান বলে-

-“আজকেই নিয়ে যাওয়া যাবে। ঔষধ গুলো যাওয়ার পথে কিনে দিব।

শায়লা হাফ ছেড়ে বাঁচলো যেন। মিহির প্রতি মায়া লেগে গেছে খুব। মিহির মনে ভরলোনা আরিয়ানের উত্তরে। তার মনে হচ্ছে মৃত্যু খুব নিকটে। দুচোখের কার্নিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। আরিয়ান মিহিসহ সবাইকে নিয়ে বাড়িতে আসে। কড়া নির্দেশ দেয় ঔষধ ঠিকমতো খাওয়ার। আর ফুল রেস্টে থাকতে বলে। শায়লা রহমান কে সব বুঝিয়ে বেড়িয়ে যায়। শায়লা রহমান পিছন থেকে ঠেকছে বলে-

-” এতো অভিমান তোর! একটাবার মা বলে ডাকলিও না। খুব রেগে আছিস তাই না!

আরিয়ান থমকে একবার পেছনে তাকিয়ে আবার চলে যায়। শায়লা রহমানের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

_____________________

আরাফা সকালবেলা হন্তদন্ত হয়ে বেরোয়। ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে। ক্লাস মিস যাবে নির্ধাত। আজও ড্রাইভার ফিরেনি। মেজাজটা আরো তুঙ্গে উঠে যায়। এখন একটা রিকশাও আসছেনা। হঠাৎই দেখা মিলে অনিকের। আরাফাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে সে বাইক থামায়। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে-

-” আরে দাড়িয়ে আছো যে? ভার্সিটি যাবেনা?

আরাফা ও সৌজন্য হেসে বলে-

-” আসলে ড্রাইভারকে বাবাই কাজে পাঠিয়েছে। তাই রিকশা খুঁজছি।

অনিক কিছু ভেবে বলে-

-” আমার সাথে এসো। চলো আমি তোমাকে লিফট দেই।

আরাফা ইতস্তত করছে। কোন রিকশাও আসছেনা। বাধ্য হয়ে অনিকের পিছে উঠে পড়ে। আরাফা দুরত্ব রেখে বসে। পিছনে থেকে এসব আরিয়ান দেখে রাগে ফেটে পড়ে। তার সামনে আসলেই সাধু সাজে। নিজেই একটা প্লে গার্ল আবার আসে অন্যকে জ্ঞান দিতে। ওকে যদি ভেঙে গুঁড়িয়ে না দিয়েছি। আমার নাম ও আরিয়ান তাজওয়ার নয়। আরাফার অহংকার আমি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবো।

#চলবে
#মেঘলা_আহমেদ(লেখিকা)