ভালোবাসা একটা বাজি পর্ব-১২+১৩

0
317

#ভালোবাসা_একটা_বাজি(১২)

সূর্যটা একেবারে মাথার ওপরে। দুপুরের কাঠফাঁটা রোদে ঘুম ভেঙ্গে গেল আরাফার। আরমোড়া ভেঙে বোঝার চেষ্টা করলো সে কোথায় আছে। গাড়ি থেকে নেমে এলো আরাফা। জায়গাটা বোধহয় গ্রামের কোথাও। এই কাঠফাঁটা দুপুরেও সূর্যের আলো কে বড্ড আদুরে লাগছে। চারদিকে সবুজ আর সবুজের সমারোহ। আরাফা এদিক ওদিক তাকিয়ে আরিয়ান কে খুঁজছে। তাকে একা রেখে কই গেল? আরাফার চোখ পড়ল একটা রঙ্গন গাছের দিকে। শতশত থোকা থোকা রঙ্গন ফুল ফুটে আছে। সূর্যের আলোয় ফুলগুলো কে ভীষণ সুন্দর লাগছে। আরাফা এগিয়ে গেলো গাছটার দিকে। এখানে অনেক নাম না জানা ফুল গাছও আছে। আরাফার এই জায়গাটায় এসে মনটা ভালো হয়ে গেল। সে ফুল নিয়ে খেলায় ব্যস্ত হলো।

-” কি গো ফুলগুলো ভালো লেগেছে?

আচমকা করো কথায় আরাফা পিছনে ফিরে তাকালো। আরিয়ান কে দেখে বুকে থুথু দিয়ে বলল–

-” আল্লাহ গো! আমি ভয় পেয়ে গেছি আরিয়ান। এভাবে কেউ হুট করে এসে কথা বলে? তুমি কি আমাকে ভয় পায়িয়ে মা”রার প্ল্যান করেছো?

আরাফার ইনোসেন্ট ফেস দেখে আরিয়ান জোড়ে জোড়ে হেঁসে দেয়। আরাফা চোখ ছোট ছোট করে আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে-

-” কি হলো ষাঁড়ের মত হাসছো কেন?

আরিয়ান হাসতে হাসতে বলে-

-” ষাঁড় কি হাসতে পারে?

আরাফা ভাব নিয়ে বলল—

-” অবশ্যই পারে! কেন তার কি হাসা নিষেধ?

আরিয়ান হাসা থামিয়ে বলে-

-” জায়গাটা কেমন?

আরাফা মুগ্ধ হয়ে চারপাশে চোখ বুলিয়ে বলে-

-” জায়গাটা আমার খুব ভালো লেগেছে। এতো সুন্দর জায়গা দেখে মনটাই ভালো হয়ে গেলো।

আরিয়ান‌ নিচে ঘাসের উপর বসলো। আরাফা কিছুটা দুরত্ব রেখে বসে। আরিয়ান খুশি মনে বলে-

-” এটা আমার সবচেয়ে পছন্দের। যখন মন খারাপ হয় আমি এখানে এসে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেই। জায়গাটায় আসলেই মনটা ভালো হয়ে যায়। এখানে আসতে শহর থেকে অনেক সময় লাগে। আর বেশ নিরিবিলি পরিবেশ এখানে। ফুল গাছ গুলো দেখলে মনটা প্রশান্তিতে ভরে যায়।

আরাফা একটা ফুল গাছ দেখিয়ে বলল –

-” ঐ যে কিছুটা মাইকের মতো হলুদ রঙের ফুল। ওগুলোর না কি?

আরিয়ান আরাফার হাতের ইশারায় সেদিকে তাকিয়ে বলল-

-” ঐ হলুদ ফুলগুলো হলো অলকানন্দা ফুল। দেখতে বেশ লাগে।

আরাফা বলল-

-” আমার সব ফুল গুলোই ভালো লাগে। এই রঙ্গন ফুলগুলো এত ভালো লাগে কি বলবো। আমার তো খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।

-” ছিঃ তুমি কি গরু নাকি ফুল খাবে।

আরাফা নাক ফুলিয়ে বলল-

-” কথার কথা আপনার কি আমাকে দেখে গরু লাগে? আচ্ছা বাদ দিন টপিক চেঞ্জ করেন। এই জায়গাটা কার মাধ্যমে চিনেছেন?

আরিয়ান ভালো মতো শুনেনি‌। তাই জিজ্ঞেস করলো-

-” কি বললে আবার বলো।

-” বলছি যে আমি তো এই জায়গাটা আপনার মাধ্যমে চিনেছি। মানে আপনি এই জায়গায় আমাকে নিয়ে এসেছেন‌। আপনাকে এই জায়গায় কে নিয়ে এসেছে সর্বপ্রথম?

কাথাটা শোনা মাত্রই আরিয়ানের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। কিছু স্মৃতি ভেসে উঠলেও রাগ নিয়ে বলল-

-” এক ছলনাময়ী নারী আর এক স্নেহময় পুরুষের হাত ধরেই এই জায়গাটা চেনা আমার। চলো বাড়ি যাবে। তোমার বাবাই চিন্তা করছেন হয়তো‌।

আরিয়ান উঠে হনহন করে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। আরাফা কিছুক্ষন থ হয়ে আরিয়ানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নিজেও উঠে দাঁড়ায়। কানে শুধু একটা কথাই বাজছে “ছলনাময়ী নারী”। আরাফা দ্রুত পা ফেলে গাড়িতে গিয়ে বসে। আরিয়ান আরাফা কে তার বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে যায়। আরাফা বাড়িতে ঢুকেই তাঁর বাবার রুমে যায়। রুমে গিয়ে বাবাকে দেখে না। আরাফা গুটি গুটি পায়ে বেলকনিতে যায়। তার বাবা বেলকির দোলনায় বসে আছে। মা থাকতে এখানে বাবা আর মা একসাথে বসে থাকতো। এখান থেকে বাড়ির সামনের সব কিছুই দেখা যায়। আরাফা ধীর পায়ে গিয়ে সৈকত সাহেবের পাশে গিয়ে বসে। সৈকত সাহেব মৃদু হেসে বলে-

-” কি রে মা এতো দেরি হলো কেন?

আরাফা আমতা আমতা করে বলে-

-” আসলে বাবাই হয়েছে টা কি.

-” কি আর হবে আরিয়ানের সাথে ঘুরতে গেছিলি?

আরাফা ধরা পড়ে গেছে। চোখ ছোট ছোট করে বলে-

-” আসলে বাবাই আমি যেতে চাইনি প্রথমে। না না মানে মন খারাপ ছিল বলে আরিয়ান একটা সুন্দর জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল। জানো বাবাই জায়গাটা অনেক সুন্দর। এতো এতো ফুল গাছ। আমার জায়গাটা খুব ভালো লেগেছে।

সৈকত সাহেব মৃদু হেসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে-

-” বেশ তাহলে তোমার জন্য নার্সারি থেকে ফুল গাছ এনে দেবো।

আরাফা খুশি হয়ে সৈকত সাহেব কে জড়িয়ে ধরে বলল-

-” সত্যি বাবাই। আমি তোমাকে ফুল গাছের লিষ্ট দেবো তুমি এনে দিও।

আরাফা করো কিছুক্ষন বাবার সাথে গল্প করে। দরজার পেছন থেকে এ দৃশ্য দেখে দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে সোহানার চোখ থেকে। বাবাই তার সাথে গল্প তো দূরে থাক, ভালো ভাবে একটু কথাও বলেনা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে নিজের রুমে চলে যায়।

কলিংবেল বাজছে অনেকক্ষন ধরে। মিহি বিরক্ত হয়ে উঠে বসে। এই বিকেলে কে এলো? জেঠিমা হয়তো ঘুমোচ্ছে। মিহি উঠে চুলগুলো হাত খোঁপা করে নেয়। এলোমেলো পা ফেলে বিছানা থেকে নামে। বিরক্ত মুখে দরজা খুলতেই সব বিরক্তি উবে যায়। একরাশ অভিমান এসে জমে চোখে মুখে। আরিয়ান চকলেট, আইসক্রিম আর কয়েকটা প্যাকেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিহি কথা না বলে দরজা ছেড়ে দাড়ায়। আরিয়ান বাড়িতে ঢুকলে মিহি দরজা লাগিয়ে দিয়ে আসে। আরিয়ান সবকিছু টেবিলে রাখে। আইসক্রিম গুলো ফ্রিজে রাখতে রাখতে বলে-

-” মেহু পাখি একগ্লাস পানি দে প্লিজ।

মিহি একগ্লাস পানি এগিয়ে দেয়। আরিয়ান পানি খেয়ে জিজ্ঞেস করে-

-” কি হয়েছে? রেগে আছিস?

মিহি মুখ ঘুরিয়ে উপরে যেতে যেতে বলে-

-” কেন রাগ করবো? আমি তো আর আপনার আপন বোন নই রাগ করবো কোন অধিকারে?

আরিয়ান ধমক দিয়ে বলে-

-” বেশি পেকে গেছো তাইনা? দেবো এক কানের নিচে। তুই আমারই বোন, এটা মাথায় রাখবি। মাহি কোথায়।

মিহি মাথা নিচু করে উওর দেয়-

-” রাহেলার কাছে। ছাদে নিয়ে গেছে রাহেলা‌।

শায়লা রহমান বেরিয়ে এসে বলে-

-” আরিয়ান বাবা তুমি এসেছো? আসলে আমি নামায পড়ছিলাম তাই দরজা খুলতে পারিনি। রাহেলা তো ছাদে গেছে মাহিকে নিয়ে। মিহি মা তুই রাগ করিস না, তোর কষ্ট করে দরজা খুলতে হলো‌।

মিহি মৃদু হেসে বলে-

-” আরে না আমি রাগ করিনি। তুমি তোমার ছেলেকে খেতে দাও। মনে হচ্ছে সে দশ দিনের অনাহারী।

মিহি হনহন করে উপরে উঠে যায়। আরিয়ান হেসে সেদিকে তাকিয়ে আছে। একটু দেখা করতে না আসলেই অভিমান করে। আরিয়ান মুখ ঘুরিয়ে শায়লা রহমানের দিকে তাকিয়ে বলে-

-” আপনি কি ওর ঔষধ গুলো ঠিকমতো খাইয়েছেন?

শায়লা রহমান চিন্তিত মুখে বলে-

-” হ্যা খাওয়াই অনেক জোড়াজুড়ি করে। খেতে চায়না। খালি জিজ্ঞেস করে কিসের ঔষধ কিসের ঔষধ। তুমি বসো আমি খাবার দিচ্ছি।

আরিয়ান বাধা দিয়ে বলল–

-“‌ পাঁচ প্যাকেট বিরিয়ানি এনেছি। দুটো আপনাদের, একটা রাহেলার আর দুটো আমি আর মেহুপাখি খাবো। এখন অন্য খাবার খাবো না।

শায়লা রহমান বলে-

-” কি বলছো? আমি তো রান্না করেছি অনেক কিছুই। ওগুলো খাবে না?

আরিয়ান ভেবে বলল—

-” কি কি রান্না করেছেন?

-” অনেক কিছুই কিন্তু স্পেশাল পায়েস ও আছে।

মিহির মুখে শুনেছে আরিয়ানের খুব পছন্দের পায়েস। তাই রান্না করেছে। আরিয়ান কিছুক্ষন ভেবে তারপর বলল—

-” আচ্ছা এখন তাহলে পায়েস নিয়ে আসুন।

শায়লা রহমান এক প্রকার দৌড়ে কিচেনে গেলেন। বড় একটা বাটিতে করে এক বাটি পায়েস নিয়ে আসলেন। আরিয়ান পায়েসের দিকে লোভাতুর দৃষ্টি দেয়। দেখতেই অনেক সুস্বাদু লাগছে। আরিয়ান একটা চেয়ার টেনে বসে বলে-

-” এতো পায়েস এনেছেন কেন?

শায়লা রহমান হেসে বলে –

-” তুমি খেতে পারলে আরো এনে দেব। এখন খাও।

আরিয়ান খাওয়া শুরু করে। মুখে দিতেই অন্যরকম লাগে স্বাদ। একদম মায়ের হাতের মতো লাগে। আরিয়ানের খাওয়ার মধ্যে শায়লা রহমান প্রশ্ন করেন-

-” সাদিয়া আর শফিক কোথায়। মিহির হাসবেন্ড কোথায়। আজ সব কিছুর উত্তর দিবে। এতো পালিয়ে কেন বেড়াচ্ছ?

আরিয়ানের খাওয়ার থেমে যায়। স্থির দৃষ্টিতে শায়লা রহমানের দিকে তাকিয়ে বলে-

-” নেই নেই নেই কেউ নেই!

#চলবে
#মেঘলা_আহমেদ(লেখিকা)

#ভালোবাসা_একটা_বাজি(১৩)

পিনপতন নীরবতা ভেঙে আরিয়ান বলল—

-” ঐদিন ছিল শনিবার, আকাশ টাও হালকা মেঘলা ছিল। তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। মা কে অনেক ভালোবাসতাম আমরা দুই ভাই বোন। কখনো বুঝতেই পারিনি তিনি আমার আসল মা নন। সবসময় মিহির চেয়ে আমাকে বেশি ভালোবাসতেন উনি। মিহির এই নিয়ে কতশত অভিযোগ ছিলো। তখন শফিক তাজওয়ার, যাকে এতদিন বাবা বলে জেনে এসেছি, সে মিহিকে নিয়ে আদর করতো আবার। অনেক সুখী পরিবার ছিলো আমাদের। তো স্কুল থেকে প্রাইভেট পড়ে সন্ধ্যায় বাসায় আসতাম। ঐদিন সন্ধ্যায় বাড়ির মধ্যে ঢুকে দেখি সারা বাড়ি অন্ধকার। অনেক বার চিৎকার করলাম মা মা বলে, কোন সাড়াশব্দ পাইনি। মেহু পাখিকে ডাকলাম, বাবাকে ডাকলাম কেউই আমার ডাকে সাড়া দিলো না। মনের মধ্যে ভয় দানা বাঁধতে শুরু করলো। হাতরে হাতরে লাইট জ্বালালাম। দেখলাম কেউ নেই বাড়িতে। বাবা-মায়ের রুমের সামনে তাকাতেই চমকে গেলাম। মেহু পাখি অ’জ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। স্কুলব্যাগ ফেলে দৌড়ে গিয়ে মেহুর মাথাটা কোলের উপর নিলাম। অনেকবার ডাকলাম চোখ খুললো না। ওকে কোলে করে বাবার বিছানায় শুইয়ে দিতেই দেখলাম মেঝেতে ছিট ছিট র’ক্ত। আমার আত্মা কেঁপে উঠলো। র’ক্তটা বেডের নিচে থেকে আসছিলো। কিন্তু আমার বেডের নিচে তাকানোর একটুও সাহস হচ্ছিল না। অনেকক্ষন মনের সাথে যুদ্ধ করে বেডের নিচে উঁকি দিলাম। কিন্তু যা ছিলো তা দেখার জন্য আমি মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। বাবার নিথর দেহটা পড়ে আছে। পা ধরে টেনে বের করলাম। মাথায় গুলি করা হয়েছে। আমার পুরো পৃথিবী দুলছিলো। চিৎকার করার ভাষাটাও যেনো হারিয়ে গেল। তারপর অনেক শক্তি জুগিয়ে ফুপি দের নাম্বারে কন দিলাম। নানুবাড়ি কল দিলাম। তারপর আর কি পুলিশ ও এলো। লা’শ পোস্টমর্টেম করা হলো। এরপর গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা‌ হয়েছে বাবাকে। মেহুর জ্ঞান ফিরেছিল দুইদিন পর। ও কারো সাথে কথা বলছিলো না। অনেক ভয় পেয়েছিলো। আমাকে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলো- ভাইয়া মা আর একটা আংকেল মিলে বাবার সাথে ঝগড়া করছিলো, তারপর আংকেল টা বাবাকে গুলি করে দেয়। আমি শব্দ শুনে এসে বাবাকে ওভাবে দেখে অজ্ঞান হয়ে যাই। কেসটা ধামাচাপা দিয়ে দিলাম কাঠখড় পুড়িয়ে। কাকে ধরিয়ে দেবো, যাকে নিজের মা বলে জেনে এসেছি? উনি পিশাচিনি। আমি নারী জাতিকে ঘৃনা করি, বিশ্বাস করিনা কাউকে সবাই প্রতারক‌। এত বড় বেইমানি করলো সাদিয়া!

আরিয়ান সামনে রাখা পানি ঢকঢক করে খায়। গলাটা শুকিয়ে গেছে। পুরোনো ঘা গুলো দগদগে হয়ে উঠেছে। একটা শুকনো ঢোক গিলে আবার বলল-

-” জানেন আমার মেহু পাখিটা না নির্জীব হয়ে গিয়েছিল। সুখ হারিয়ে গিয়েছিল জীবন থেকে। অনেকগুলো বছর দুই ভাই বোন মিলে কাটিয়ে দিলাম। তিনবছর আগে মেহু পাখির জীবনে রাজ আসে। আমার মেহু পাখিটা আবারো চঞ্চল হয়ে ওঠে। ও রাজকে অনেক ভালোবাসতো। ছেলেটাও ওকে ভালোবাসতো অনেক। এরপর একবছর পর বিয়ে দিলাম দুজনের। অনেক খুশি ছিলো আমার বোনটা। এর দেড়বছর পর মেহু কনসিভ করে। কি যে খুশি হয়েছিলাম বলে বোঝাতে পারবো না। চৌধুরী বাড়ির সবাই অনেক খুশি ছিলো। মেহুর শ্বশুরবাড়ির লোকজন অনেক ভালো ছিলো। কিন্তু কপালে যে সুখ নাই, সে কি সুখের পিছনে দৌড়েও সুখ পায়? একটা ঝড় এসে মেহুর জীবনটা এলোমেলো করে দিলো। রাজ কার এক্সি:ডেন্ট এ মা’রা গেলো। সেদিন মেহু পাগলের মতো কেঁদেছিলো। অনাগত সন্তানকে দেখে যেতে পারেনি রাজ। তারপর ওকে এই বাড়িতে নিয়ে এলাম। কারন চৌধুরী বাড়িতে থাকলে রাজের স্মৃতি ওকে তাড়া করে বেড়াতো। ও দুইবার সুইসাইড এটেম্প করার চেষ্টা করেছিলো। এরপর অনেক বোঝালাম। যে সন্তানটার‌ কথা ভেবে দেখ ও তো রাজের স্মৃতি। মেহু আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হলো। কোলজুড়ে এলো ছোট মাহি। কিন্তু এখন আমার বোনটা নাকি আর বাঁ’চবে না। ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে ওর শরীরে। আমার ছোট বোনটার জীবনে এত কষ্ট‌। ওর কষ্টগুলো আমাকে দিলে কি হয়?

শায়লা রহমান অঝোরে কাঁদছে। ছেলে মেয়ে দুটো কত কষ্টে বড় হয়েছে। এত ঝড় গিয়েছে। আর সে কি না বিদেশের মাটিতে ছিলো। কথাগুলো শুনে শহিদ পাথর হয়ে গেছে। প্রেম করে তার ভাই আর সাদিয়া বিয়ে করেছিল। কই গিয়েছিল এত ভালোবাসা? এই বাচ্চা দুটোর কথাও কি তার চিন্তায় ছিলো না। শহিদ সাহেব নিজেকে ধাতস্থ করে বলল-

-” আরিয়ান তুই কি আমাদের উপরেও রেগে আছিস বাবা। একটাবার ও কি আমাদের মা বাবা বলে ডাকবিনা? এই কান দুটো এতগুলো বছর ধরে তোর মুখ থেকে বাবা ডাক শোনার অপেক্ষায় আছে। বাবা আয়না একটু জড়িয়ে ধর।

আরিয়ান আর অভিমান ধরে রাখতে পারলোনা। ছুটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল-

-” বাবা বাবা তোমারা আমাকে আর‌ ছেড়ে যাবে না তো? আমি না আর কষ্ট সইতে পারবোনা। আমার না খুব কষ্ট হয়। জানো এই বাড়িতে আমি আসিনা কষ্ট হয় খুব। কিন্তু মেহুর জন্য আসা লাগে। কিন্তু আমার মেহু পাখিটা নাকি আমার কাছ থেকে চলে যাবে। ডাক্তার কেন এসব বলল? আমি কি নিয়ে থাকবো?

শায়লা রহমান ছেলেকে স্বান্তনা দিয়ে বলল-

-” বাবা ওর কিছু হবেনা ইনশাআল্লাহ। কিন্তু আমাকে কি মা ডাকবিনা। তোকে বুকে নেয়ার জন্য কতবছর অপেক্ষা করবো আর। বুকটা যে শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে আছে। একবার মা বলে ডাক না।

আরিয়ান একসাথে মা বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। উপর থেকে মেহু ডেকে বলে-

-” বাহ সব মিটে গেছে হ্যাপি ফ্যামিলি। আমাকে কি নেবে তোমাদের মাঝে।

আরিয়ান হেসে দুই তার মেলে দেয়। মেহু তাড়াতাড়ি করে নেমে জড়িয়ে ধরে সবাইকে‌। পরিবার যেন আবার পূর্ণতা পেলো। কিন্তু বুকের পুরোনো ক্ষত কি আর যাবে?

___________

সকালবেলা মিষ্টি রোদে ঘুম ভেঙ্গে যায় আরাফার। মনটা আর ভীষণ ফুরফুরে। অনেক সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখেছে সে। আচ্ছা আরিয়ানের কথা ভাবলেই আমার এতো লজ্জা লাগে কেন? আমি কি ওর প্রেমে পড়ে যাচ্ছি? প্রেমে পড়লে পড়লাম, নিজেকে আটকানোর ইচ্ছে নেই। আর ওকে আমি ঠিক করে দেবো। আরাফা ফ্রেশ হয়ে নিচে গিয়ে দেখে অনিক সোফায় বসে আছে। আরাফা ভ্রু কুঁচকে তাকায় অনিকের দিকে। অনিক মিষ্টি হেসে বলে-

-” গুড মর্নিং আরু কেমন আছো?

আরাফা জোড়পূর্বক হেসে বলে-

-” আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু এতো সকালে তুমি এখানে কেন? কোন দরকারে এসেছো?

-” কেন দরকার ছাড়া কি আসতে পারিনা‌?

আরাফা ইতস্তত করে বলে-

-” আরে তা বলতে চাইনি‌।

-” আমি কিছু বলতেই এসেছিলাম।

-” কি বলবে?

-” এখানে না তোমার রুমে চলো।

-” এসো তাহলে।

আরাফা নিজের রুমে যায়। অনিক ও পিছু পিছু আরাফার রুমে ঢোকে। আরাফার রুমে সোফায় গিয়ে আয়েশ করে বসে। আরাফা জিজ্ঞেস করে-

-” চা নাকি কফি?

অনিক মৃদু হেসে বলে-

-” কিছুই খাবো না। একটা কথা বলি?

-” হ্যা বলো।

অনিক কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলে-

-” আমি দেখেছি তুমি আরিয়ানের সাথে টাইম স্পেন্ড করো ইদানিং। সেটাও ব্যাপার না‌। আমার মনে হয় তুমি ওকে পছন্দ করো। তোমারও ধারনা ও তোমাকে পছন্দ করে। কিন্তু আরিয়ান কখনোই কাউকে ভালোবাসবে না। ও তোমার সাথে অভিনয় করছে। আরিয়ান ওর ফ্রেন্ডদের সাথে বাজি ধরেছে তোমাকে পটাবে। তাই এতো অভিনয় করছে। বিশ্বাস না হলে এই দেখো।

অনিক একটা ভিডিও ক্লিপ দেখায়। যেখানে আরিয়ান ওর ফ্রেন্ডদের বলছে-

-” ঐ আরাফাকে আমি ভালোবাসবো? মাথা গেছে তোদের? আমি কখনো জীবনের কোন বাজি হারিনি। আর না হারবো। ওকে আমি ভালোবাসি না। যাষ্ট বাজি ধরেছি ওকে পটানোর তাই এমন করছি। Love is a bet বূঝলি।

অনিক ভিডিও ক্লিপটা অফ করে বলে-

-” দেখো আরাফা তুমি অনেক ভালো মেয়ে। আমি চাইনা তুমি ওর ছলনায় নিজের জীবন টা নষ্ট করো। তাই ওর জন্য অনুভূতি থাকলেও তা মুছে ফেলো আজ আসি। আল্লাহ হাফেজ।

অনিক চলে যায়। পেছন ফিরে দেখে আরাফা থম মে’রে বসে আছে। অনিক বাঁকা হেসে চলে যায়। আরাফার কাছে সবকিছু কেমন মিথ্যা লাগছে। এমনটা করতে পারলো আরিয়ান? নাকি আমারই ভুল ও সুধরাবে এটা ভাবনায় আনা। আসলে ওর মতো ছেলেরা এমনই। কিন্তু মন তো মানে না। আরাফা দুই হাতে মাথার চুল টেনে ধরে। বিষাক্ত লাগছে সবকিছু।

#চলবে
#মেঘলা_আহমেদ(লেখিকা)