ভালোবাসার কাব্য গাঁথবো পর্ব-৩৯+৪০+৪১

0
1377

#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো

(৩৯)
নরম বিছানা হটাৎ করে শক্তপোক্ত অনুভব হলো। অবচেতন লাবিবা ঘোরের মাঝেই হাত বাড়ালো। আঙুলের ডগায় লোমের ছোঁয়া লাগলো।‌‌ নড়লো না। ওভাবেই পড়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর‌ মনে হলো তার পুরো দেহটাকে কেউ তুলে নিচ্ছে শক্ত কিছুর উপরে। লাবিবা জোরপূর্বক চোখ খুললো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো লোমশ ফর্সা বুক। লাবিবা নাক ঢুবিয়ে শ্বাস নিলো। অল্পপরিচিত একটা স্মেল যেটা সে দু তিনেকবার খুব কাজ থেকে পেয়েছে। টনক নড়তেই হুরমুড় করে উঠে বসলো। হাতে বাধাপ্রাপ্ত হলো। হাত ধরে টান দিতেই একটু ঝুঁকে গেলো। খোলাচুল গুলো এসে পড়লো কপালের দু পাশে। ক্লান্ত চোখে লাবিবা তাকিয়ে রইলো। বিরবির করলো ‘ খান সাহেব!’ মাথাটা উপরের দিকে ধরে রাখতে না পেরে বালিশে হেলে পড়লো। তানভীর এক হাতে লাবিবার কোমড় চেপে সৃষ্ট হওয়া দূরত্বটুকু ঘুচিয়ে নিলো। বাকিটুকু লাবিবাই ঘুচালো। আলতো ভাবে গলাটা একটু একটু করে জড়িয়ে ধরলো। মুখ গুজলো তানভীরের গলায়। তানভীর দুহাতে লাবিবাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। লাবিবার ঘাড়ের উপর ফুস ফুস করে উষ্ণ শ্বাস ছাড়লো। মৃদু আওয়াজ তুলল,’ উমমমমহ ‘। লাবিবা নিচু স্বরে জানতে চাইলো, ‘ আপনি রাগ? ‘ তানভীর উত্তর করলো না। আরো নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। ঘরময় শুধু উষ্ণ শ্বাস। তানভীর ছটফট করলো। কাতর গলায় বললো, ‘ বউ! জ্বর কমবে কখন? ভালো লাগছে না। ‘ লাবিবা ফুঁপিয়ে উঠলো, ‘ য়্যু হার্ট মি। ‘ এই কথাটাই যথেষ্ট তানভীরকে এলোমেলো করে দেবার জন্য। হাতের বাঁধন শিথিল হলো। কানের নিচে ঠোঁট ছোয়ালো। ছোট ছোট চুমু তে ভরিয়ে তুললো।‌ এতো আদরে লাবিবা বিড়ালছানার মতো গলা জড়িয়ে ঝুঁলে রইলো। তানভীরের বুকের মাঝে নিজেকে সঁপে দিলো। খানিক বাদেই তানভীর জিজ্ঞেস করলো,
‘ মেডিসিন নিয়েছো?’
‘ হুম। ‘
‘ জ্বর কমছে না কেনো? ‘
‘ সারা রাত ই তো থাকে। ‘
তানভীরের ভাবনা অস্থির হলো। একটা মাত্র বউ তার ওকে জানানোর কেউ প্রয়োজন বোধ করলো না। বউটা নাহয় বুদ্ধি কম। শ্বশুর শ্বাশুড়ি কি করলো? তার কারণেই জ্বর এসেছে জন্য তাকেই এলাও করলো না। কবিরটাও তো জানালো না। ফ্লোরা না জানালে তো জানতেই পারতো না। গিয়েছিলো টাঙ্গাইল। এক জানাজায় অংশগ্রহণ করতে। থাকতেও হয়েছিলো। টাঙ্গাইল টা এক ঝলক ট্যুর দেবার প্ল্যান করেই থেকে গিয়েছিলো। সারাদিন টই টই করতে করতে ফোনের দিকে নজর ছিলোনা। যখন ফোন হাতে নিলো ফ্লোরার মেসেজ দেখে এতো রাগ হয়েছিলো যে আসবেনাই ভেবেছিলো। কিন্তু মন মানলে তো? ঠিকি চলে এসেছে। আসতে আসতে রাত হয়ে গেছে। লাবিবা ওয়েট করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে। শ্বশুর শ্বাশুড়ির সাথে কথা বলে এসে দেখে কাঁপছে। মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে অন্তুর মা ছোটকাকী। তানভীরের সাথে কথা বলে চলে গেলে তানভীর একদম অসুস্থ বউটাকে বুকে নিয়ে নিজেকে শান্ত করে। লাবিবার শরীর আরো গরম হয়ে উঠে। লাবিবার শরীরের উষ্ণতায় তানভীর ও প্রায় ঘেমে গেছে। লাবিবা বুঝতে পেরে হাত দিয়ে ঠেলে দু বার সরিয়ে দিতে চেয়েছে। তানভীর ছাড়েনি। আগুনের মতো গরম শরীরটাকে বুকে চেপে রেখেছে। কষ্ট শুধু বউটা কেনো করবে? সেও করুক। লাবিবা আবার ঠেলে দেয়। বুঝানোর স্বার্থে বলে,
‘ ছাড়ুন। গরম! ‘
‘ পোড়তে দাও।’

তানভীর কল করে তামিমকে।
‘ ভাইয়া কোথায়?’
‘ হসপিটালে। ‘
‘ ফিরবে কখন?’
‘ একটু পরেই। ‘
‘ আমার শ্বশুরবাড়ি থেকে ঘুরে যাও তো।’
‘ তুই ওখানে?’
‘ লাবিবার জ্বর। তিনদিন থেকে। কোনো মেডিসিনেই কাজ করছে না। একটু দেখে যাও। ‘
‘ আচ্ছা আমি আসছি। টেনশন নিস না। সিরিয়াস কিছু মনে হলে আমার কলিগকে ফোন করলেই চলে আসবে।’
‘ হুম। ‘

তামিম এলো ঘন্টা দেড়েক পর। তামিম একা আসেনি সাথে করে কলিগ কেও নিয়ে এসেছে। তানভীর এতোক্ষণ খেয়াল করেনি। তামিম আসার স্বার্থে শাড়ি ঠিক করতে গিয়ে লক্ষ্য করেছে লাবিবা স্লিভলেস ব্লাউজ পড়েছে। অনুসন্ধানী চোখে আবিষ্কার করলো ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক ও ছুইয়েছে যেনো বিশেষ খেয়াল না করলে বোঝা না যায়। গাল থেকে বেবী পাউডারের স্মেল আগেই পেয়েছে। কানে সুন্দর ঝুমকো। শাড়ির রংটা ফুটিয়েছেও গায়ে। বউটা তার দেখতে সাদাসিধে আদতে তা নয়। যাকে বলে সিম্পলের মধ্যে গর্জিয়াস। তানভীর শাড়ির আঁচলে দুই কাঁধ সুন্দর ভাবে পেঁচিয়ে দিলো। যাতে কাঁধ দেখা না যায়। ডক্টর কি কি ঔষধ খাওয়ানো হয়েছে তা দেখে জ্বর মেপে ইনজেকশন পুশ করে দিয়ে চলে গেলো। যাবার আগে তামিম জ্বর কমলে তাকে একবার জানিয়ে দিতে বলে গেলো ।

ঘন্টাখানেকের মধ্যে গা ঘেমে লাবিবার জ্বর ছাড়লো। উঠার শক্তি নেই। লাবিবার কাকী এসে গামছা ভিজিয়ে হাত পা মুখ পুছে দিলো। সাবিনা এসে মেয়েকে জোর করে স্যান্ডুইচ সহ মৃদু গরম দুধ খাইয়ে দিলো। ঘুমিয়ে পড়তে বলে লাইট আফ করে চলে গেলো। ডাইনিং এ তানভীর কে খাবার দেওয়া হয়েছে। সাথে বসেছে কবির। তানভীরের কথা শুনেই এসেছে। কবিরের মেয়েটাও বাবার সাথে টুক টুক করে খাচ্ছে। তা দেখে তানভীর হাসে।

ক্লান্ত তানভীর যখন ঘুমোনোর উদ্দেশ্য বিছানায় শুলো লাবিবা পাশ থেকে এক গড়ান দিয়ে তানভীরের উপর উঠে গেলো। দু হাতে গলা জড়িয়ে ধরলো। তানভীর দ্বিমত করলো না। লাবিবার শরীরের ভাড় নেওয়া তার কাছে ব্যাপার না। বরং সে চায় নিতে। তার হৃদয় কেনো শরীর ও জানুক একজন আছে। যার সংস্পর্শে সুখ মেলে। যাকে বহন করতে গেলে ক্লান্ত দেহ ও সায় দেয়। কখনো বিরক্তি আসেনা। তানভীর ঝুমকোর উপর আলতো করে চুমু দিলো। ডাকলো,
‘ লাবি পাখি?’
‘ হুম। ‘
‘ শাড়ি পরেছো?’
‘ হুম। ‘
‘ আমার জন্য?’
‘ হুম। ‘
‘ সুন্দর লাগছে। আমার বউটা ভীষণ সুন্দর। মাশাআল্লাহ। ‘
লাবিবা মুখ তুলে তাকায়। চোখে চোখ মেলায়।
‘ আপনার সাথে আমার অনেক গল্প আছে। ‘
‘ শুনবো। এখন ঘুমাও। ‘
‘ কয়টা বাজে? ‘ লাবিবা ফোনে টাইম দেখলো। বেশি রাত নয় ‌। এগারোটা দশ।
‘ ঘুমোলে আপনি চলে যাবেন। ‘
‘ আজ থাকছি। ভীষন টায়ার্ড। ‘
লাবিবা খুশি হলো। তানভীরকে শক্ত জড়িয়ে ধরলো। শান্তি পেলো না। শাড়িটাকে তাঁদের মাঝে বাঁধা মনে হলো। লাজ শরম ফেলে আঁচলটা কাঁধ থেকে ফেলে দিলো। তানভীরের উদোম বুকে নিরাভরণ বুক পেট ছুঁয়া লাগতেই শরীরটা শিরশির করে উঠলো। ঠান্ডাও লাগলো। উঠতে গেলো। কিন্তু পারলো না।‌ তানভীর কোমড় চেপে মিশিয়ে নিলো।‌ কানে মুখ নিয়ে ফিসফিস করলো, ‘ আমাকে অশান্ত করার চেষ্টা করোনা দুর্বল শরীরে পরে কিন্তু আমাকে শান্ত করতে পারবেনা। বউয়ের জন্য দ্বিতীয়বারের মতো শ্বশুড়ের কাঠগড়ায় উঠতে চাইছি না। ‘

ছোট্ট একখান পর্ব দিলাম। বাড়তি কিছু এড করলাম না।‌ আসলে বড় করে আজকের পর্ব লিখতেই ইচ্ছে করলো না। আশা করি এতেই আপনাদের দুলাভাই ছাড়া পর্বগুলো পুষিয়ে যাবে।‌গল্প নিয়ে আপডেট এবং আলোচনায় অংশ গ্ৰহন করতে এড হোন আমার ছোট্ট গ্ৰুপে Labiba’s Tale🧚‍♀

চলবে __

#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো

(৪০)
মনটা ভার। ফোনের লোকেশন এখানেই দেখাচ্ছে। আশেপাশেই আছে তানভীর।‌ জিম থেকে লাবিবা আর বাসার পথে যায়নি। ইসমাইল ফোন দিয়েছে জানিয়েছে লেট হবে। ইসমাইল ভেবেছে চলে আসবে। এদিকে লাবিবা জিম থেকে বেরিয়ে ব্যাগ কাঁধে তুলে বা দিকে জজ কোর্টের রাস্তার ধরেছে। রাস্তাটা ভালোই লাগে হাটতে। সারি সারি সরকারি সব ভবন। শিক্ষা অফিস থেকে শূরু করে মৃত্তিকা পর্যন্ত শহরের সব সরকারি ভবন এই রাস্তা ধরেই। এদিকটায় বছর দুয়েক আগেও লাবিবা আসতো বাবার সাথে ক্যারাটি শিখতে। ব্যাটমিন্টন ও খেলতো অবসর সময়ে এসে বাবা মেয়ে মিলে। স্টেডিয়াম এরিয়ার ভেতরেই ইনস্টিটিউট। তানভীর লাবিবাকে ফাঁকি দিয়েছে। যাবেনা বলেও ঠিক চলে গিয়েছে। ঘুম ভাঙার পর তাকে আর পাওয়া যায়নি। সাবিনা জানিয়েছে নাস্তা করেই বেরিয়েছে। আর যোগাযোগ হয়নি। ফোনে কল দিলেও মিনিট দুয়েক কথা ছাড়া আর কথা হয়নি। তানভীর এমন কেনো? লাবিবা বুঝতে পারেনা। একটা ফিলিংলেস নিরামিষ লোক যাকে নিজের করতে লাবিবা একপ্রকার উঠে পড়ে লেগেছিলো সে তার মর্জি মাফিক কাছে এলো আবার চলেও গেলো। যতক্ষন সামনে আছে ততোক্ষন বউয়ের কদর। একটু দূরে গেলেই লাপাত্তা।

লাবিবা স্টেডিয়ামের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সিট ছেড়ে ঘাসের উপরে বসে ব্যাগ থেকে বাদাম বের করে খেতে লাগলো। জেলা স্কুলের ছেলেরা ক্রিকেট প্র্যাকটিজ করছে। লাবিবা খেলাতে মগ্ন হলো। চার পড়ার সাথে সাথে ছেলেরা হৈ হৈ করে উঠলো। পরের বলটা একদম লাবিবার মাথার উপর দিয়ে বাউন্ডারি ক্রস করলো।‌ লাবিবা ঘাড় ঘুড়াতেই তানভীরকে চোখে পড়লো। বলটা ক্যাচ ধরে দাঁড়িয়ে। ছেলেরা ছক্কা বলে হিড়িক মারলো। তানভীর লাবিবার থেকে চোখ সরালো। বলে একটা ফু দিয়েই মাঠে ছুঁড়ে দিলো। প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে লাবিবার দিকে পা বাড়ালো। লাবিবা মুগ্ধ চোখে তাকিয়েই রইলো। তানভীর যত এগিয়ে এলো ততো লাবিবার হৃদস্পন্দন ক্রমশ বাড়তেই থাকলো। একদম দু ইঞ্চি সামনে এসে থামলো। লাবিবার মুখ ঠেকলো তানভীরের হাঁটুতে। লাবিবা চোখ বন্ধ করে ঢুক গিললো। গলা শুকিয়ে এলো। এটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু বারবার নতুনত্বের ফিল দেয়। তানভীর এ্যাশ কালার টুপি ওয়ালা স্লিভলেস গেঞ্জি পড়ে লাবিবার সামনে দাঁড়িয়ে। ফুলো ফুলো মাসল দুটো দৃশ্যমান। লাবিবা আগে খেয়াল করেনি। আজ ই প্রথম খেয়াল করলো। লাবিবা বুঝতে পারলো তার দুর্বলতার চার্ট লম্বা হচ্ছে। সব দুর্বলতা এই একটা মানুষের উপর ই এসে পড়েছে। আর কাউকে প্রয়োজন নেই।

তানভীর হাত বাড়ালো। লাবিবা বাড়ানো হাতের দিকে তাকিয়ে নিজের হাতে তাকালো। দশ টাকার বাদামের ঠোঙা কিনেছিলো। অর্ধেক খাওয়া শেষ। সেটাই তানভীরের হাতে দিলো। ঠোঙা দেখে তানভীর ভ্রু জোড়া কুচকালো। দুটো বাদাম বের করে ছিলে মুখ দিলো। চিবুতে চিবুতে ঠোঙাটা পকেটে ঢুকিয়ে আবার হাত বাড়ালো। লাবিবা আর কি দিবে? ব্যাগটা হাতে নিতেই তানভীর ছো মেরে নিয়ে কাঁধে তুললো। আরেকটা হাত লাবিবার দিকে বাড়ালো। লাবিবা ঘাড় উঁচু করে তাকাতেই তানভীর মুখ টিপে হাসলো।
‘ উঠো।’
লাবিবা এতোক্ষনে বুঝলো তাকেই উঠাতে চাইছে। এতোক্ষণ বোকার মতো ভেবেছিলো হাতে বাদাম তাই বাদাম নিতে হাত বাড়িয়েছিলো। খানিকটা লজ্জাও পেলো। ঝটপট হাত বাড়িয়ে দিলো।
‘ হাত দাও। বাদাম যত ইচ্ছা আমি তোমাকে খাওয়াবো। ইভেন যা চাইবে সব ই পাবে।‌ ‘
লাবিবা উঠে দাঁড়ালো। পেছনে কাপড় ঝাড়লো। তানভীরের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ হাত পেয়েই আপনি হ্যাপি? হাত তো কেটেও দেওয়া যায়। আমার হাতে কাজ নেই। আমি পুরো মানুষটার অভাব বোধ করি। এছাড়া আলহামদুলিল্লাহ আমার কোনো দিকে অভাব নেই। ‘
তানভীর চোখে হাসলো। হাতটা শক্ত করে ধরে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো।
‘ কোথায় যাচ্ছি? ‘
‘ আমি যেখানে নিয়ে যাচ্ছি। ‘
‘ আমি কেনো যাবো? আমি যে আপনাকে এতো বাসায় যেতে বলি আপনি সেখানে যান?’
‘ শ্বশুড়ের বাসায় গিয়ে পড়ে থাকবো নাকি? এতোটা নির্লজ্জ আমি নই। ‘
‘ কোন আদালতে রায় দিয়েছে যে শ্বশুড়ের বাসায় যাওয়া নিষেধ?’
‘ তুমি যাবে? যাবেনা?’
লাবিবা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তানভীর লাবিবার ভাব ভঙ্গি বুঝার ট্রাই করে। কোমড় থেকে হাত নামিয়ে বলে
‘ ওকে। গেলানা। ‘

লাবিবা দেখে তানভীর তাকে রেখেই চলে যাচ্ছে। মেজাজ তির তির করে বাড়ে লাবিবার। এই লোকটা ওকে একটু দাম ও দেয়না। দেয়ালের বাক নিতে দেখেই লাবিবা পিছু ছুটে। ফোনটা ব্যাগের ভেতরেই।এতো বড় এরিয়া! হারিয়ে গেলে খুঁজতেও কোমড় ভাঙবে।তানভীর জানে লাবিবা ঠিক পেছনে দৌড়োবে। ব্যাগ যে তার কাছে।

‘ মেয়েটা কে? ‘ গলফ খেলতে খেলতেই প্রশ্ন করে পার্টনার। তানভীর পেছনে ঘাড় ঘুরায়। ফোর্টের বাইরে সিঁড়ির উপর ফোন নিয়ে বসেছে লাবিবা। এদিকে তার দৃষ্টি নেই। মেরুন স্কার্টে টাটকা গোলাপের মতো লাগছে।
‘ গার্লফ্রেন্ড। ‘
চমকে তাকায় লাবিবা। গার্লফ্রেন্ড! বিয়ের এক বছর হতে চললো এতো দিন ছিলো আত্মীয়। বাসর করার পর গার্লফ্রেন্ড। তাহলে বাচ্চা হবার পর বউ! বাচ্চা বড় হবার পর বাচ্চার মা! নিজের ভাবনাতে নিজের ই মাথা ঘুরে গেলো।

তানভীর জোরে ডাকলো,
‘ খেলবে? এসো। ‘
লাবিবাও গলা বাড়িয়ে উত্তর দিলো,
‘ ভদ্র ঘরের ছেলে বউ নিয়ে এসে খেলেন। ‘
তানভীরের পার্টনার ফিক করে হেসে দিলো।
‘ ঝগড়া চলছে নাকি দুজনের মধ্যে? ‘
‘ গার্লফ্রেন্ড বলায় মেডামের একটু রাগ হয়েছে। ‘
দুজনেই হাসলো। ডাকলো,
‘ ভাবী আসেন। যে যাই বলুক আপনি আমার ভাবীই হন।’
‘ ওসব খেলায় আমার কোনো ইন্টারেস্ট নাই। ‘
‘ ভাবী কোন খেলা পছন্দ আপনার। ঐটাই খেলবো চলেন। ‘
‘ আমি ব্যাটমিন্টন লাভার। ‘
‘ সিউর সিউর। ‘

দুজনেই কোর্ট ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। গল্প করতে লাগলো, ‘ ভাবী আমাকে চিনে রাখুন। আমার নাম আকাশ। আপনি দেখতে মাশাআল্লাহ। আপনার ছোট বোন টোন নেই?’
‘ আছে। তিন বছর। হে হে। ‘
‘ ও আচ্ছা। নো প্রবলেম। বিয়েতে কিন্তু তানভীর ভাই যাই করুক আপনি আমাকে ইনভাইট করবেন। আগের কাতারে থাকবো। সুন্দরীদের মন চুরি করা আমার দায়িত্ব। ‘
‘ সেটা থাক। দেখি কে জেতে।‌’
‘ টর্চ। ‘
‘ বাজি হয়ে যাক। ‘
লাবিবা তানভীরের দিকে তাকালো।
‘ যদি আমি জিতি তাহলে আপনি আমাদের ডিনার করাবেন। আর যদি আপনি জিতেন স্যার আপনাকে ওয়ান কে দিবে। ‘
‘ ওকে ডান। ‘
তানভীর বসলো না। আকাশের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। লাবিবা চেঁচিয়ে উঠলো। তানভীর হাত তুলে বললো,
‘ প্রক্সি দিচ্ছি। দুজনকেই ইকুয়েল ইকুয়েল। ‘
খেলা শেষ হবার নাম নিলোনা। সন্ধ্যা লাইট জ্বলে উঠলো। হাঁপিয়ে গেছে তিনজনেই। আকাশ জানতে চাইলো, ‘ ভাবি কি রেগুলার খেলেন?’
‘ আগে খেলতাম। এখন আর সময় পাই না। ‘
‘ পড়াশোনায় এত্তো সিরিয়াস? গুড। ‘
‘ উহু। প্রেম নিয়ে সিরিয়াস। আপনার ভাইয়ের প্রেমে পড়েছি। তাকে নিয়ে টেনশনেই সময় কেটে যায়। ‘
আকাশ হো হো করে হেসে দিলো। তানভীর লাবিবার পিছু এসে খেলতে লাগলো। মৃদু আওয়াজে ধমকালো।
‘ চুপ যাও। ওর সামনে মান ইজ্জত খেও না। ‘
‘ আর আপনি যে আমাকে আনঅফিশিয়াল বানিয়ে দিলেন? আপনি জানেন আমার জন্য কত ছেলে পাগল? হাত বাড়ালে?’
‘ আমার ওমেনের দিকে হাত বাড়ানোর সাহস কারো নেই। ‘
‘ আমার হয়ে আপনি খেলুন। আমি আর পারছি না। ‘
লাবিবা গিয়ে সিঁড়িতে বসলো। আকাশ তানভীরের কাছে হেরে গেলো। শর্ত অনুযায়ী ডিনার একসাথে করতে অনুরোধ করলো। তানভীর অযুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে গেলো। লাবিবার পাশে এসে বসে পড়লো। তাকিয়ে দেখলো সত্যিই খুব হাঁপিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলো,
‘ আব্বুকে বলে এসেছো? ‘
‘ বলেছি লেট হবে। ‘
‘ সন্ধ্যা হয়ে গেছে ‌। চলো বাসায় চলো। ‘
‘ আপনিও আসেন। ‘
‘ সেদিন ই তো গেলাম। তোমার জ্বর ছিলো।’
‘ আমি কি আবার জ্বর নিয়ে আসবো? দিন গালে দুটো থাপ্পড় দিন। না দিলে বলুন। রাস্তায় যাকে পাবো তাকেই বলবো থাপ্পড় লাগাতে। ‘
‘ ফালতু কথা বলোনা। ‘
‘ ওকে বলবো না। আমার ই দোষ। আমিই যেচে পড়ে আপনার পিছু পিছু ঘুড়ি। ‘
‘ পেছন ফিরে দেখো তোমার পেছনে আমিই আছি। ‘
লাবিবা থেমে দাঁড়ায়। তানভীর পাশে এসে দাড়ালে বলে, ‘ পাশে চাই। পিছু নয়। লোককে বলে বেড়াচ্ছেন আমি আপনার গার্লফ্রেন্ড। ‘
‘ তো কি বউ ? বউ হলে আমার বাড়ি থাকতে। বাবার বাড়ি নয়। ‘
‘ আপনি তো দু রাত থেকে আপনার বাড়িতেও যান না। মামনি ভেবেছে আমার বাসায় এসেছেন। ‘
‘ বউ নেই বাড়ি ফিরে কি করবো ? ‘
‘ তো আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন না কেনো?’
‘ গিয়ে কি করবে? সংসার? নিজেকে সামলাতে পারো?’
‘ আপনি তো আছেন।’
‘ সেটা তোমার আব্বুকে গিয়ে বলো। ‘
‘ আব্বু কেনো দ্বিমত করে? আপনার সাথে আব্বুর কিসের এতো মনমালিন্য?’
‘ মনমালিন্য নয়। সবটাই আমার ভাগ্য। ‘
‘ মানে কি?’
‘ কিছু না। এদিকে আসো। একটু আদর করে দিই। ‘
‘ না। ‘
লাবিবা জেদ করেই গেলো না। কিন্তু তানভীর কেও ছাড়লো না। তানভীর গাড়ি নিয়ে আসেনি। একটা রিকশা ডেকে নিলো। রাতের ঠান্ডা মন মাতানো হাওয়া হৃদয় প্রশান্ত করে দিলো। তানভীর লাবিবার রাগ বুঝে হাতটা মুঠোয় নিলো। লাবিবা তাকাচ্ছে না দেখে অন্যহাতে মুঠোয় ধরা হাতটা ট্রান্সফার করে সেই হাতে কাঁধ চেপে কাছে কাছে টানলো। লাবিবা তাকালো না। নিচ দিকেই তাকিয়ে রইলো। শহর ছেড়ে যখন গ্ৰামের পথ ধরলো। দুপাশে খোলা ধানের মাঠ। ঠান্ডা হাওয়া। লাবিবার একটু শীত লাগলো। কুঁজো হয়ে বসলো। নিজে থেকেই তানভীরের গা ঘেসলো। তানভীর এতোক্ষন যাবৎ লাবিবাকেই দেখছিলো। লাবিবার প্রত্যেকটা মুভমেন্ট একেকটা নেশা দ্রব্য যেনো। মুচকি হেঁসে একপাশে বুকে টেনে নিলো। মাথাটা বুকে চেপে কপালে আলতো ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো। লাবিবার রাগ পড়ে গেলো। ভীষণ আদুরে হয়ে উঠলো। তানভীর যেনো এতোক্ষণ এটাই চেয়েছিলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলো এমন একটা মেয়েকে তার ভাগ্যে জুড়ে দেবার জন্য। কোনো চাহিদা নেই। একটু আদরেই সব মাটি হয়ে যায়। ভালোবাসার কাঙাল। বোকা মেয়েটাকি জানে তানভীর খান তার চেয়েও বড় কাঙাল।

মোড়ের মাথায় ইসমাইলের দেখা মেললো। টেনশনে কপাল কুঁচকে রেগেছে। তানভীরের সাথে দেখে চিন্তামুক্ত হলো। তানভীর বললো,
‘ আব্বুর সাথে চলে যাও। আমি আসছি। ‘
লাবিবা করুন চোখে তাকালো। তানভীর গেলো না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। ইসমাইল লাবিবাকে বকা দিলো।
‘ এটাকে একটু লেট বলে? জামাই সাথে আছে জানালে কি হতো? এই বয়সেও মেয়েটা টেনশনে মারবে আমাকে। বিয়ে দিয়েও শান্তি নেই। ‘
এমন ধমকে লাবিবা মুখ বাকালো। তাকে নিয়ে অযথা টেনশনের কি প্রয়োজন? ও বলেছে টেনশন করতে? বড় হয়েছে না!

ইসমাইল বাইক স্টার্ট দিলো। তানভীরের প্রতিও অভিযোগ করলো, ‘ তুমিতো জানাতে পারতে আমাকে। রাত নয়টা বাজে। টেনশন হয়না? তোমার আম্মু অনেক টেনশন করছে। উঠো গাড়িতে উঠো। ‘
লাবিবা উঠতে বসেছিলো। নেমে এসে তানভীরের জন্য জায়গা দিলো। তানভীর উঠে বসতেই লাবিবা মুখ টিপে হাসলো। তানভীরের চোখ এড়ালো না। লাবিবাও লাফ দিয়ে উঠে বসলো। কাঁধে হাত রেখে ছুটে চললো।

চলবে __

#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো

(৪১)
অনবরত ফোন বেজে চলছে। ফোনের শব্দে লাবিবার ঘুম ছুটে গেছে। কিন্তু ঠাহর করে উঠতে পারছেনা কার ফোন? তার ফোনের রিংটোন তো এটা নয়। কিন্তু শিয়রেই যে বাজছে এটা বুঝতে পারছে। হাত বাড়াতে গেলেই বাঁধে বিপত্তি। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে বুকের মাঝে সেঁধিয়ে জায়গা করে নিয়েছে তানভীর। লাবিবা চেষ্টা করে হাতটা বাড়াতে। সক্ষম হয় না। আর না পেরে তানভীর কেই ডাকে।
‘ এই! ‘
কাঁধে ধাক্কা দিয়ে সরাতে চায়। তানভীর একটু নড়ে আবার জড়িয়ে ধরে। লাবিবা আবার ডাকে,
‘ এই শুনুন না?’
‘ হুম। ‘
‘ আপনার ফোন বাজছে। ‘
‘ ধরো। ‘
‘ হাত ছাড়ুন।’
তানভীর একটু ঢিল দিতেই লাবিবা হাত বাড়ায়।
‘ মম ফোন করেছে। ‘
‘ ধরো। ‘
লাবিবা রিসিভ করে সালাম জানায়। সোহানা সালামের উত্তর নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘ তানভীর কোথায়? ‘
‘ মামুনি উনি ওয়াশরুমে। ‘
‘ ওকে তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে বলো তো।বলবে আর্জেন। ‘
‘ আচ্ছা মামুনী। ‘
‘ আর শোনো। তুমিও এসো । ‘
‘ আমি? ঠিক আছে। ‘
সোহানা কল কেটে দেয়। লাবিবা ভাবুক হয়ে পড়ে। এতো আর্জেন্ট কেনো ডাকবে? কিছু কি হয়েছে?

তানভীর আসতেই লাবিবা তানভীরকে জানিয়ে দেয়। নিজেও উঠে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। রেডি ওয়ে দুজনে একসাথে টেবিলে আসে। সাবিনা ওয়েট করছিলো ব্রেকফাস্ট রেডি করে। তানভীর জিজ্ঞেস করে , ‘ আম্মু আব্বু কোথায়?’
‘ তোমার আব্বু সকাল সকাল ই বেরিয়েছে। ‘
তানভীর লাবিবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেয় ‌। ইতস্তত করে বলে, ‘ আম্মু লাবিবাকে নিয়ে একবার মম আমাদের বাসায় যেতে বলেছে। ‘
‘ আবার? বার বার ঐ বাড়িতে যাওয়া ভালো দেখায় না বাবা। ‘
‘ ইমার্জেন্সি হয়তো। নয়তো আম্মু এভাবে বলতো না। প্লিজ। আব্বু না জানলেই তো হলো। ‘
‘ আচ্ছা আমি দেখবো। নিয়ে যাও। ‘
দু’জনে কিছুটা খেয়েই উঠে যায়। ইসমাইল বাইক নিয়ে যায়নি। সাবিনা তানভীরকে বাইক নিয়ে যেতে বলে। এদিকে রিকশাটা পাওয়া ট্রাফ। লাবিবা গিয়ে বাইকের চাবি নিয়ে আসে। দুজনে মিলে বেরিয়ে পড়ে।

খান বাড়িতে তুলকালাম কাণ্ড সৃষ্টি হয়েছে। ফ্লোরা ফ্লোরে বসে অঝোরে কাঁদছে। ফ্লোরার কান্নাতে বিরক্ত উপস্থিত সকলেই। ফ্লোরা বার বার কাকুতি মিনতি করছে তাকে ক্ষমা করার জন্য। সে আর ভূল করবেনা। কোনদিন করবেনা। তাকে যেনো মাফ করে দেয়। ফিরোজ খান বাড়িতে অলক্ষী কেনো ঢুকেছে বলে চিৎকার করে উঠে ফ্লোরাকে দেখে। ফ্লোরার কান্না থেমে যায়। ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে পড়ে। এতো বছর পরেও তার আত্মা কেঁপে উঠে এই মানুষটার হুংকারে। সোহানা এসে আল্লাহ দোহায় করে, ‘ তুমি আস্তে কথা বলো। বাড়িতে ছেলে ঘুমোচ্ছে। ডিউটি করে ফিরেছে সেই দুটোয়। এখন আল্লার ওয়াস্তে আস্তে কথা বলে বিদায় করো। ‘
‘ এই মেয়েটার সাহস কি করে হয় আমার বাড়িতে ঢুকার? ওর মুখ দেখতে চাইনা আমি। ‘
‘ তুমি আস্তে কথা বলো প্লিজ। ‘
‘ কিসের আস্তে কথা বলবো? ডাকো তোমার ছেলেকে। খাল কেটে আমার সংসারে কুমির কে ঢুকিয়েছে? এক্ষুনি নিচে আসতে বলো। তামিম। তামিম। তামিম। এক্ষুনি নিচে আসো। তামিম। ‘
জবেদা মিন মিন করে বলে, ‘ বড় ভাইজান তো ঘুমায়া আছে আব্বা। ‘
ফিরোজ খান তাকাতেই জবেদা ছুটে তামিমের রুমে।

তামিম ঘুমিয়ে নেই। বাবার ডাকে ঘুম ছুটে গেছে। হুট করে বাবা এতো কেনো ডাকছে তামিম জানে। ফ্লোরা এসেছে। তাকে দেখেই বাড়ির সবাই এতো রেগে। তামিম ই বলেছে ফ্লোরাকে আসতে। কাল রাতে যখন তাদের কথা হয় তামিম বলে,
‘ তুমি যদি সত্যিই আমার লাইফে ব্যাক করতে চাও তাহলে খান বাড়িতে পা রাখো। আমার কাছে ক্ষমা চাও। আমার ফ্যামিলির কাছে ক্ষমা চাও। তারা যদি তোমাকে ক্ষমা করে তাহলে তুমি ক্ষমা পাবে। যদি একজন মানুষ ও মন ভার করে তুমি ক্ষমা পাবে না। আর রইলো আমার লাইফে ব্যাক করা? আমার পাপা যদি বলে আমাকে তোমাকে গ্ৰহন করতে আমি ব্যবস্থা করবো। পাপার অবাধ্য হয়ে একবার জীবনের সবচেয়ে বড় মূল্য চুকিয়েছি। আর পারবো না। আমার পাপা যা বলবে আমি তাই করবো। লাস্টবার ট্রাই করে দেখতে পারো। ‘
‘ একটা কথার উত্তর দিবে?’
‘ দিবো। ‘
‘ আমার প্রতি কি এক বিন্দু ভালোবাসাও আর তোমার মনে নেই?’
‘ না। ‘
‘ ঘৃণা করো। ‘
‘ না। তুমি আমার জন্য একজন হারাম ব্যক্তি ছাড়া কিছুই না। ‘
‘ এতোবড় কথাটা বলতে বুক কাপলো না তোমার? মনে লাগলো না? ‘
‘ অকৃতজ্ঞের জন্য আমার বুক কাঁপে না। আমি সম্পূর্ণ ভাবে একজন প্রাপ্তবয়স্ক ডিভোর্সী সিঙ্গেল পার্সন। আমি নিজেকে নিজে কন্ট্রোল করার বয়সে উপনীত হয়েছি। আমার ব্রেইন যেটা চাইবে আমার মন ঠিক সেই দিবে ড্রাইভার্ট হবে। ‘
‘ আমার কি কোনো জায়গা নেই?’
‘ আছে কি?’
ফ্লোরা আর উত্তর কাটে না। এতো দিন এটা বিশ্বাস ছিলো কিছুটা হলেও তামিমের মনে তার জন্য মায়াটা কাজ করে। নয়তো অন্তত কথাটা বলতো না। তবে ফ্লোরা তার ডাকে সাড়া দিবে। রত্ন যদি একবার ছুঁতে পারে আর কোনদিন হাতছাড়া করবেনা।

জবেদা দরজায় বার বার নক করছে।
‘ বড় ভাইজান তাড়াতাড়ি উঠেন। কাল নাগিন আসছে। আব্বা রেগে বোম হয়ে আছে। ব্রাস্ট করলে আপনি আমি কেউ বাঁচবো না। ‘
‘ ভাইজান। ও ভাইজান। ‘

তামিম দরজা খুলে দেয়। জবেদাকে আর একটা ওয়ার্ড উচ্চারণ না করতে দিয়ে বলে, ‘ যাও আসছি আমি। ‘
জবেদা চলে যায়। তামিমের তাড়া নেই। সে ধীরে সুস্থে ফ্রেশ হয়ে নিচে নামে। ফ্লোরাকে একবার দেখেই মুখ ঘুরিয়ে নেয়। বাবার পাশে গিয়ে বসে।
‘ বাবা ডেকেছিলে?’
‘ এই অলক্ষী আমার বাড়িতে কেনো?’
তামিম ফ্লোরার দিকে তাকালো। ফ্লোরার অসহায়ত্বকে নিজ চোখ ভরে দেখলো। খারাপ লাগলো। কিন্তু তার করার কিছু নেই। বাবাকেই জিজ্ঞেস করলো,
‘ কি বলে?’
ফিরোজ খান এবার রাগ ধরে রাখতে পারলেন না।
‘ কি বলে তুমি শোনো। বেদ্দপ ছেলে। তোমার জন্য আমার মান সম্মান একবার হারিয়েছি। আবার কোন অঘটন ঘাটাতে চাও? আমি বলে দিচ্ছি তামিম তুমি যদি ভেবে থাকো এই মেয়েকে আমি আবার তোমার জীবনে জায়গা নিতে দিবো তাহলে সম্পূর্ণ ভূল। আমি বেঁচে থাকতে আর সম্ভব না। একে ঘরে তুলতে হলে আমার মৃত্যুর পরে তুলো। যদি চাও এখনি শেষ করে দিতে পারো। আমি প্রস্তুত। ‘
তামিম নিচে বসে পড়লো। ফিরোজের পা ধরে হুড়মুড় করে কান্নায় ভেঙে পড়লো। ফিরোজ একদমি টললো না। বরং আরো গর্জে বলে উঠলো, ‘ একভুল আমি বার বার করবো না। আমি জিন্দাদশায় আমার সন্তানের কষ্ট সহ্য করবো না। আমার সন্তানের কষ্ট দূর করতে আরো বেশী কষ্টের কূপ তৈরী করবো এটাও হতে দিবো না। তোমাদের চেয়ে অধিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আমি । সেদিন যা করার তুমি আমার অজান্তে করে ফেলেছিলে। মেনে নেওয়া ছাড়া আমার উপায় ছিলো না। আজ আমি ঠেকে যায়নি। মানুষ বুঝে ঘরে উঠাবো। যাকে তাকে স্থান দিবো না। এক্ষুনি বের করো একে। ‘

ফ্লোরা উঠে সোহানার কাছে যায়। সোহানার নরম মন। মেয়েটার কান্না দেখে নরম হয়ে গেছে। ফ্লোরা পা জড়িয়ে ধরলেও সরে গেলো না। ফ্লোরা কাকুতি মিনতি করলো। সব ছেড়ে ছুড়ে এ বাড়িতে ঝি বাদীর কাজ করবে সেটাও বললো। এতোসব ড্রামা নিতু ইসলামের সহ্য হলোনা। সদর দরজা দিয়ে দৌড়ে এসে বোনের থেকে ফ্লোরাকে সরিয়ে দিলো। কিন্তু খারাপ ব্যবহার করলো না। রক্ত গরম করার মানুষ তিনি নন। ফ্লোরা তাকেও বললো,’ খালামনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি যা করেছি না বুঝে ভুল করেছি। আমি তার শাস্তিও পাচ্ছি। আমার পাশে কেউ নেই। আমি ভীষণ একা হয়ে গিয়েছি। আমি সর্বশান্ত হয়ে গিয়েছি। আমাকে একটু আপনাদের পায়ের নিচে ঠায় দিন। একটু দয়া করুন। আপনাদের ছেড়ে আর কখনো কোনদিকে যাবোনা প্রমিজ করছি। কোনোদিন না। ‘
নিতু ইসলাম জিজ্ঞেস করলো, ‘ তোমার বাবা মা কোথায়? ‘
‘ আমাকে ত্যাগ করেছে উনারা। আপনারা ছাড়া আমার আর কেউ নেই। ‘
নিতু ইসলাম মুচকি হাসলো। বুঝিয়ে বললো,
‘ দেখো মা বাবা মা কি জানোতো? তোমাকে জম্ম দিয়েছে লালন পালন করেছে। বড় করেছে। বাবা থাক।‌মা এমন একটা মানুষ যে সন্তানের জন্য পৃথিবীর সকল কিছুর সাথে যুদ্ধ করতে পারে। প্রয়োজনে নিজের জীবন দিতেও দুবার ভাবে না। সেখানে সেই মানুষ গুলোই যদি তোমাকে ত্যাগ করতে পারে তাদের সাথে কোনো অন্যায় না করাতেই সেখানে তুমি আমাদের সাথে যে অন্যায়টা করেছো আমরা কিভাবে তোমাকে ত্যাগ না করে থাকতে পারি? আমাদের তো তোমার ছায়াও মাড়ানোর কথা না। সেখানে এই যে এতোক্ষন যাবৎ তুমি এই আলিশান বাড়িতে আছো এটাতো আমাদের অতি দয়ার কারনেই। তোমার তো কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত তাইনা? একা আছো সেজন্য ই তোমার মনে হচ্ছে তুমি আগের লাইফে ফিরে আসতে চাও। পাশে কেউ থাকলে অতীতের কথা তোমার মনেই পড়তো না। আমি বলি কি মা? জীবন অনেক দূর এগিয়ে গেছে। একটা বিয়ে করো। সংসারী হও।‌ আমাদের ছেলের মতো অনেক ছেলেই আছে যাদের রুপ দেখিয়ে চোখে চশমা লাগাতে পারবে। তোমার ছেলের অভাব হবেনা। ‘
সূক্ষ্ম খোঁচাটা তামিমকে খুব সুন্দর ভাবেই দিয়ে দিলো নিতু ইসলাম। তামিম নিজের প্রতি আরো বিরক্ত হলো। ছিহ এতো বোকা সে? এতো !

ফ্লোরা টললো না। তামিমকে বললো, ‘ তামিম তুমি কিছু বলো। আই ব্যাক করতে চাই তামিম। তামিম আই লাভ য়্যু তো। ‘

তামিম বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে ছল ছল করছে জল। ফিরোজ খান ফ্লোরাকে বললো,
আমার ছেলেদের জন্য অনেক মেয়েই পাগল। আমি দেখি কোন মেয়েটার জন্য আমার ছেলে পাগল? ছোট বউমা এদিকে আসো।

লাবিবা তানভীর এসে দাঁড়িয়েছে অনেক আগেই। চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলো। যেখানে ফিরোজ খান সিদ্ধান্ত নিবে সেখানে তারা কি বলবে? লাবিবা গিয়ে ফিরোজ খানের সামনে দাঁড়ালো। লাবিবাকে দেখিয়ে ফিরোজ বললো, ‘ দেখো এ হচ্ছে এই বাড়ির ছোট বউমা। তাকে দেখো কত ভদ্র, মার্জিত, ইনোসেন্ট। আর নিজেকে দেখো। চোখে পড়ে পার্থক্য? ‘
এতোটা অপমানে লজ্জায় চোখ থেকে শুধু জল গড়িয়ে পড়লো ফ্লোরার। করুন চোখে তানভীরের দিকে তাকালো। লাবিবাও মাথা নিচু করে আছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। যে মেয়েটা তাকে এতো হেল্প করলো তার হয়ে কিছুই করতে পারছেনা দেখে। আসলে পরিস্থিতিই উল্টোপথে। ফিরোজ খান বললো,
‘ আমার ছোট ছেলে ছোট বউমার জন্য পাগল। বড় ছেলে কি তোমার জন্য পাগল? তামিম? ‘
তামিম চোখ মুছে জবাব দিলো, ‘ তোমার সিদ্ধান্ত ই আমি গ্ৰহণ করবো পাপা। তুমি যা বলবে সেটাই হবে। আমি প্রাপ্তবয়স্ক। আমার নিজের উপর বিশ্বাস আছে।’
ফিরোজ খান চোখে হাসলো। ফ্লোরাকে বললো,
‘ শোনো মেয়ে। তুমি তো ক্ষমা চাও। আমরা তোমাকে ক্ষমা করবো একটা শর্তে। যদি তুমি আমার ছেলের জীবন থেকে সরে যাও। যদি শর্তে রাজি হও তাহলে তুমি ক্ষমা পাবে। নয়তো ঝুলে থাকো যেমন আছো। তোমার বাড়াবাড়ি বাড়লে আমার হাত কতটা লম্বা সেটা তো জানো। ‘

ফ্লোরাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হলো। নিতু ইসলাম তেড়ে এসে তামিমকে টেনে ফ্লোর থেকে সোফায় বসালো। লাবিবাও হেল্প করলো। তানভীর এসে তামিমের পাশে বসলো। নিতু ইসলাম রাগান্বিত হয়ে ফিরোজ কে বললো, ‘ দুলাভাই। আমি আর এসব দেখতে পারবো না। এর একটা বিহিত চাই। ‘
সোহানা কিছু বলতে চেয়েছিলো নিতু ওকে থামিয়ে দিয়ে আরো বললো, ‘ আপা ভাইজান কে কল দাও। জানাও তামিমের জন্য মেয়ে দেখতে। ছোট বউকে ঘরে তুলার আগেই বড় বউকে ঘরে তুলো। এসব বিশৃঙ্খলা আর ভালো লাগছে না। ‘
ফিরোজ খান ছেলের ভগ্ন হৃদয়ের কষ্ট অনুভব করলো। পিঠে হাত রাখলো। দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। তামিমকে বোঝালো,
‘ দেখো পাপা আজ তুমি আমাকে বড় করতে গিয়েও ছোট করে ফেললে। আমি তোমার পাপা সব সময় এটা মনে রাখবে। মনে এক মুখে এক এরকম দুমুখো মানুষ আমার পছন্দ না। তোমার মনে কোথাও না কোথাও একটা আশা ছিলো। আম সরি পাপা। তোমার আশা পূরণ করতে পারছি না। আজ আমি যদি ফ্লোরাকে ক্ষমা করে তোমার জন্য মেনে নিই তাহলে হয়তো তুমি খুশি হবে কিন্তু সুখী হবেনা। পুরোনো ব্যথা তোমাকে সুখী হতে দিবে না। প্রতিদিন কোন না কোন কাজে বা সময়ে তোমার মনে হবে এই মেয়েটার জন্য আমার এতোটা কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে। এই মেয়েটা এখনো স্বার্থপরতা করছে। সামান্য তম ব্যাপার নিয়ে তোমার মনে সন্দেহের বীজ বপন হবে। তুমি এককথায় সুখী হবেনা। এর চেয়ে কি ভালো না অন্য একটা মেয়েকে নিয়ে সুন্দর ভাবে শুরু করা? যে মেয়েটা তোমাকে সম্মান করবে, তোমাকে বুঝবে, তোমার যোগ্য বউ চাইবে তাকে সাপোর্ট করা? তোমার জন্য ফুল কন্যা আমি পাবোনা জানো। পেলেও এলাও করবো না এটাও জানো। বঞ্চিতদের একজন ই এখন তোমার জীবন সঙ্গী হবে। তাকে সাপোর্ট করার মাধ্যমেই দেখবে জুটি বাঁধবে। গাঢ় শক্ত হবে। শুধু ছেলের কথায় না নেচে আমি ছোট বউমাকে যেমন পরিক্ষা করেই এ বাড়ির লক্ষী বানিয়েছি তেমনি তোমার জন্য ও আমি লক্ষী খুঁজে আনবো। আশা করি তুমি আমার লক্ষীর মর্যাদা দিবে। ‘
তামিম মাথা নাড়ালো।
‘ জি পাপা। তুমি যাকে বলবে আমি তাকেই বিয়ে করবো। ‘

লাবিবা তানভীরের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলো, ‘ খান সাহেব? এক দুই ঘন্টার মধ্যে পাপা কিভাবে আমাকে পরিক্ষা করলো? আমি তো সেদিনের আগে পাপার মুখোমুখি ই হয়নি। ‘
‘ তোমার শ্বশুড়ের জন্য এক দুই ঘন্টা বিস্তর সময়। চাপ নিও না। ‘ বলে মুচকি হাসলো। লাবিবা ঠিকই চাপ নিলো। হিসাব মেলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

চলবে ___