#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো
(৬০)
অফ হোয়াইট শেরওয়ানি পড়ে মাত্রই এসে দাঁড়ালো তামিম। পাশেই তার বাবা ফিরোজ খান এসে দাঁড়িয়েছে। ছেলের পিঠে হাত রেখে ইশারা করে কাজীর পাশে গিয়ে বসতে। পাশাপাশি দুটো বসার গদি পাতা হয়েছে। মাঝখানে রজনীগন্ধার দেয়াল। কাজী এসে বসেছেন তার মাঝ বরাবর। দুই ছেলের বিয়ে একসাথে দিচ্ছেন ফিরোজ খান। আয়োজনে কোন কমতি নেই। দুই পুত্রবধূ কে ঘরে তোলার জন্য সোহানা ইসলাম অপেক্ষা করছেন বাসায়। তিনি আসেননি আজ। ফিরোজ খান তামিমকে অবজার্ব করলেন। ছেলে মেয়েকে বাবা মাই আগে বুঝতে পারে। এইযে এই মুহূর্তে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে যন্ত্রের মতো ছেলেটা যে দাঁড়িয়ে আছে অথচ তার বুকে একবুক কষ্ট। সেই কষ্ট লাঘব করতেই নতুন কারো আগমন। ফিরোজ খান তাগিদ দিলেন তাড়াতাড়ি কনেদের নিয়ে আসতে। তামিম অনুমতি চায়, ‘ পাপা চলো বসি?’
‘ মাই সান। আই উইশ তুমি এই মমেন্ট থেকে সকল দুঃখ কষ্ট ভুলে সুখী হও নতুনকে বরণ করে। আমার বউমা তোমার সকল কষ্ট ভুলিয়ে দিবে। তুমি ও আমার বউমার কষ্ট গুলো দূর করে দিবে। তুমি ভুলে যেও না আমি তোমার জন্য পূর্ণ কাউকে নয় ভাঙা কাউকেই নিয়ে আসছি যাতে তোমরা দুজনে একত্রে হয়ে পূর্ণ হতে পারো। ‘
‘ জি পাপা। ‘
তামিমকে বসিয়ে তানভীরকে ডাকে ফিরোজ খান। ব্লাক শেরওয়ানি মাথায় মেরুন পাগড়ীতে রাজার বেশে বিয়ে করতে যাচ্ছে সে। দুই ছেলেকে দেখে আজ ফিরোজ খানের প্রাণ জুড়িয়ে গেছে। এখন ঘরের লক্ষীদের মুখখানা দেখার বাকি। অপেক্ষা করছেন ছেলে, ছেলের বউ দেখে দোয়া করবেন বলে।
‘ বসে পড়ো। ‘
‘ হুম পাপা। ‘
ইসমাইলের কথা শুনতে শুনতে বেখেয়ালি ভাবে পা ফেলে লাবিবা। হাই হিল কাত হয়ে পড়ে। ইসমাইল সাথে সাথে ধরে ফেলে। ‘ পায়ে লেগেছে?’
‘ ঠিক আছি আব্বু। ‘
তানভীর আসন ছেড়ে উঠে যায়। লম্বা কদম ফেলে মহুর্তেই লাবিবার সামনে এসে দাঁড়ায়। হাই হিল দেখে পার্লারের মেয়েটাকে ডাক দেয়,
‘ মমী ক্যাটস কোথায়?’
‘ স্যার ম্যাম হাই হিল ই চুজ করেছে। ‘
‘ আমি তোমাকে বলিনি ক্যাটস পড়াতে? যাও নিয়ে আসো। ‘
মেয়েটা দৌড় দেয়। তানভীর হাটু গেড়ে বসে সোজা পা থেকে হিল ছাড়িয়ে নেয়। লাবিবা বাঁধা দেয়,
‘ আমি খুলবোনা। ‘
‘ তুমি তো হাঁটতেই পারছো না। ‘
‘ ইটস এক্সিডেন্ট। আমি পারবো। ‘
‘ ক্যাটস পড়ো। ‘
‘ আমি তো আপনার লেভেলেই পৌছাবো না। ‘
তানভীর আর কোন উত্তর দিলো না। মৌমির হাত থেকে ক্যাটস নিয়ে নিজে পায়ে পড়িয়ে দেয় হাটু গেড়ে বসে। লাবিবা তানভীরের কাঁধে হাত ঠেকে ব্যালেন্স রাখে। এক হাত ধরে আছে বাবা আরেকহাত স্বামীর কাঁধের উপর। চমৎকার এই বধুর পা জুতো পরিয়ে দিচ্ছে তার স্বামী। সুন্দর। ভরসা এবং ভালোবাসা দুটোই সুন্দর। একসাথে রাজজোটক কে মুগ্ধ চোখে দেখছে উপস্থিত থাকা মেহমান। আর লাবিবা দেখছে তানভীর কে। আজকে কি জেন্টস পার্লার থেকে সেজে বর সেজে এসেছে? হয়তো বা তাই। এই পুরুষটা এতো সুন্দর কেনো? কেনো এতো সুন্দর হতে হবে? কেনো লাবিবার কায়া নাড়িয়ে দেয়? কেনো এতো কেয়ারিং হতে হবে তাকে? সে কি জানে তার জন্য বয়ে চলা বুকে শত শত ঝড়ের কথা? সে কি বুঝে তার ছোঁয়ায় লাবিবার ছোট্ট কায়ায় কম্পন সৃষ্টি হবার কথা? সে কি জানে তার হঠাৎ এই পরিবর্তন কতটা এলোমেলো করে দিয়েছে লাবিবাকে? যার উপর স্বৈরাচারী মনোভাব পোষন করে সেই ব্যক্তি যখন প্রতিটা শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে মিশে যায় তখন কিভাবে সহ্য হবে এতো যন্ত্রনা ? লাবিবার বলতে ইচ্ছে করে, ‘ খান সাহেব শুনছেন? আমি শান্তি পাইনা। কিছুতেই শান্তি পাইনা। আপনি কাছে থাকলেও শান্তি পাইনা দূরে গেলেও পাইনা। আমাকে একটু শান্তি দিননা। ভালোবাসায় এতো যন্ত্রনা জানলে আমি ভুল করেও ভালোবাসতে যেতাম না। কখখোনো না। ‘
উঁচু সল্টের ক্যাটস পড়ে লাবিবা তানভীরের কাঁধ অব্দি নাগাল পেলো। অজান্তেই ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো। আর উঁচু হতে হবেনা। তাকে ছোঁয়ার জন্য হাত তো আছেই। সামনা সামনি বসিয়ে দেওয়া হলো দুই বধুকে। এখনো দুই বধুর মুখ কেউ দেখেনি। লম্বা ঘোমটা টেনে আড়াল করে দেওয়া হয়েছে। সর্বপ্রথম বর কনের মুখ দেখবে তারপর অন্যরা। তামিম আড় চোখে একটু একটু রোজীর দিকে তাকাচ্ছে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা মোটেই তার শোভা পাবে না। এই বয়সে বিয়ে! অস্বস্তি তো কাজ করবেই। লোকলজ্জা বলে তো কিছু আছে। তানভীর আবার ওসবের ধার ধারে না। বিয়ে তার বউ তার। এখানে লোকজনের সমুদ্র বয়ে গেলে তার কি করার? তার চোখ তো ঘোমটার আড়ালে বউয়ের উপরি আবদ্ধ। লাল বেনারসীতে বউটাকে কত সুন্দর লাগছে! উজ্জল শ্যামবরণ কন্যার রুপ যেনো আর ধরে না। কোমল হাত জোড়ায় সোনার অলংকার যেনো প্রতিফলন সৃষ্টি করেছে। ঐ হাত জোড়ার সৌন্দর্য দ্বিগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। তানভীরের এখনি ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। এখনি না ছুলে যেনো তার জান যাবে। তৃষ্ণার্ত কাকের মতো অসহায় দৃষ্টিতে লাল ঘোমটার আড়ালে বউটার দিকে তাকিয়ে ঢুক গিলে। কবুল পড়ে বিয়ে সম্পন্ন করে দেয় বউয়ের দিকে তাকিয়েই। কাজী আলহামদুলিল্লাহ বলে মোনাজাত ধরে। লাবিবাকে অনুসরণ করেই তানভীর হাত তুলে মোনাজাত ধরে। দুটো মানুষের মোনজাতে একটাই চাওয়া বীপরীতে থাকা মানুষটা। উকিল সহ কাজী এবং মুরুব্বিরা উঠে যাবার পর তানভীর হাটুর উপর ভর করে লাবিবার দিকে হাত বাড়ায়। ঘোমটা তুলে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে অশান্ত মনটাকে শান্ত করে নেয়। বউ সাজে লাবিবাকে মুগ্ধ হয়ে দেখে । শালীরা জিজ্ঞেস করে, ‘ দুলাভাই মাথা কি ঘুরে গেলো?ধরবো নাকি?’
তানভীর হাসতে হাসতে মাথা নাড়ায়। দ্বিতীয়বার কপালে চুমু দিয়ে বলে, ‘ মাশাআল্লাহ। ‘ তানভীরের অবস্থা দেখে তরুনদের মাঝে হাসির রোল পড়ে। তানভীরকে বলে,
‘ দুলাভাই পাশে এসে বসেন। ‘
তানভীর লাবিবাকে পাশাপাশি বসিয়ে আয়না ধরা হয় সামনে। দুই মাথা একসাথে পেছন থেকে চেপে ধরে বলে ,’ দুলাভাই মিররে কি দেখেন? ‘
‘ আমার সুখ। ‘
‘ ওওওওওওওওওও_____’
‘ লাব্বু মিররে আড় চোখে কি দেখে?’
‘ আমার আবছা অন্ধকার জীবনের চন্দ্র।’
‘ আরে বাহ! সাধু! সাধু! ‘
এনার হাজবেন্ড জিজ্ঞেস করে, ‘ কত বছর ধরে একসাথে?’
‘ এরেঞ্জ। ‘
‘ হুয়াট?’
মাথা ঘুরার উপক্রম। তামিম দুঃখী দুঃখী মুখ করে বলে,
‘ এক্সিডেন্ট। ‘
‘ কোনটা ধরবো?
আকাশ বলে, ‘ লাভ ম্যারেজ। ‘
নাকিব বলে, ‘ ফোর্স ম্যারেজ। ‘
উর্মিলা বলে, ‘ আমি সাক্ষী আছি। ‘
রোজী মিনমিনিয়ে বলে, ‘ ভাইয়ার না শুনেছি ওয়ান সাইড লাভ?’
‘ হচ্ছেটাকি?’
লাবিবা ঠোঁট টিপে বলে, ‘ দুলাভাই ডলার ছাড়েন নয়তো আসল কথা বের হবে না। ‘
‘ শালা শালার বউ দুটোর ই আমার ডলারের দিকে নজর। এখানে আর থাকাই যাবে না। ‘
‘ দুলাভাই একটা নোট ছাড়েন। গল গল করে কথা বের হবে। ‘
‘ যা তোদের হানিমুন ট্রিপ আমার পক্ষ থেকে। ‘
‘ হুররেএএএএ ___’
‘ দুলাভাই লাভ টা আকদের পরে হয়েছে।এন্ড এখন আমরা সারাজীবন থাকবো একসাথে। দোয়া রাখবেন। ‘
‘ আবশ্যই। ‘
বিদায় বেলায় লাবিবার হাত ছাড়তে হয় তানভীরের। প্রিয়জন দের থেকে বিদায় নেওয়া কতটা কষ্টের তা প্রত্যেকটা মেয়েই ভোগ করে। মায়ের গলা ধরে সমস্ত কষ্ট উগড়ে দিচ্ছে লাবিবা। ছোট ছোট ভাই বোনেরা লাবিবাকে ঝাপটে ধরে হাওমাউ করে কাঁদছে। গমগমে উল্লাসে মাতোয়ারা বিয়ে বাড়িতে কিছুক্ষন পরেই শোকের ছায়া পড়ে গেছে । কান্নার আওয়াজে ধ্বনিত হচ্ছে চারপাশ থেকে। তানভীর গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে বিদায় শেষ হবার। ছেলে বাড়ি মেয়ে বাড়ির সবাই কেঁদে দিয়েছে। কেউ নিজেকে আঁটকে রাখতে পারেনি। তানভীর দূর থেকে লাবিবাকে দেখছে। এতো কাঁদছে কেনো মেয়েটা? এতো কেনো কাঁদতে হবে? আজকাল যুগে কেউ এভাবে বিয়েতে কাঁদে? নাচতে নাচতে শ্বশুড়বাড়ি চলে যায়। শ্বশুড়ের এক মেয়েকে বিয়ে করলে বোধহয় এমনি হয়। তানভীর পা উঁচু করে ভিড়ের ভেতরটা দেখলো। কোথাও ইসমাইল নেই। এই কান্নাকাটি পর্ব শেষ হবেনা যতক্ষন না ইসমাইল এসে বিদায় দিচ্ছে। বাপ পাগল মেয়ে এক্ষুনি বাপের খোঁজ করবে। ড্রাইভারকে ইশারা করে তানভীর ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়লো। প্যান্ডেলের এক কোনে বসে আছে ইসমাইল। দুহাতে মুখ চেপে আছে। তারপাশেই বসে অনরগল চোখ মুছে যাচ্ছে রোজীর বাবা। দুইপাশে চাচা জেঠরা দাঁড়িয়ে। ফিরোজ খান সামনে চেয়ারে বসে একের পর এক সান্তনা দিচ্ছে।
তানভীরের একটু খারাপ লাগলো। অদূরে নিজের ভবিষ্যৎ থেকে একবার ঘুরে এলো। না সে কোনো সাধারণ বাবা হবেনা। অসাধারণ চিন্তার বাবা হবে নিজের শ্বশুরের মতো। তাও যদি নিজের মেয়ের জন্য একটা দ্বিতীয় তানভীর খান খুঁজে পায়। তানভীর গিয়ে ইসমাইলের পাশে বসলো। ডাকলো, ‘ আব্বু। ‘ ইসমাইল মুখের উপর থেকে হাত সরিয়ে তানভীরের দিকে তাকালো। লাল চোখ জোড়া মিনিটেও ঘোলা হয়ে এলো। কাঁপা হাতে তানভীর কে বুকে টেনে নিলো। কপালে চুমু দিয়ে ডাকলো, ‘ আমার আব্বু। ‘
‘ আমাদের গাড়িতে দিয়ে আসেন আব্বু। ‘
‘ যাও আব্বু। আসছি আমি। ‘
বাবার গলা ধরে লাবিবা নুইয়ে পড়লো। গলা ভেঙে গেছে একদম। ইসমাইল মারে…. আমার মা… বলে চোখ ধরে হামলে কাঁদতে লাগলো। ছেলেপক্ষরা তাড়া দিলো গাড়িতে তুলে দিতে। লাবিবাকে ধরতে এলেই চিৎকার করতে লাগলো, আব্বু আমি যাবো না। আম্মু আমি যাবোনা। কাকা আমি যাবোনা। ও ভাইয়া রে__।আমি কোথায় যাবোনা। আব্বু।
তানভীর পাগড়ি গাড়িতে রেখে পকেট থেকে ফোনটাও গাড়ির ভেতরে ছুড়লো। ভিড় ঠেলে গিয়ে ইসমাইল কে বললো, ‘ আব্বু আমরা এবার আসি। কাল সকালেই দেখা হচ্ছে। নিজেদের খেয়াল রাখবেন। আমি প্রমিজ করছি আপনার মেয়েকে আমি আপনার থেকেও ভালো রাখবো। ‘ বলতে বলতেই লাবিবাকে ছাড়িয়ে নিয়ে কোলে তুলে নিলো।লাবিবা কোলে উঠে আরো চিৎকার করে ছটফট করছে। তানভীর কোনভাবে এতো ভারী গহনা শাড়িতে ব্যালেন্স রেখে গাড়িতে বসিয়ে দিলো। হল থেকে একে একে বরের আত্বীয় স্বজনের এগারোটা গাড়ি বেরিয়ে গেলো।
খান বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে একে একে গাড়ি। সোহানা তার বোন বান্ধবী আত্বীয় মহিলাদের নিয়ে গেইটে অপেক্ষা করছে। সব সময়কার হাসি হাসি মুখটা আরো উজ্জল দেখাচ্ছে। ফিরোজ খান প্রথম গাড়ি থেকে নেমে এসে সোহানার সামনে এসে দাড়িয়ে হাসলো। সোহানা ইসলাম যেনো আনন্দে গলে গেলো। ফিরোজ খান মাথায় হাত রেখে বললো, ‘ নাও তোমার দুই মেয়ের শখ পূরণ হলো। সব ব্যবস্থা করেছো তো?’
‘ তোমার দুই মেয়ের কোনো অসুবিধা ই আমি হতে দিবো না দেখো। ‘
ফিরোজ খান হাসতে হাসতে বাড়ির ভেতর চলে গেলো।
প্রথমেই বাড়ির বড় বউকে দুধ মিষ্টি খাইয়ে গাড়ি থেকে নামালো হলো। তামিমের খালামনি আর মামা নতুন বউয়ের মুখ দেখলো সোনার হার দিয়ে। ননাশ মুখ দেখলো মানতাশা দিয়ে। অনান্য আত্বীয় রা নতুন বউ নামিয়ে আনলো গলার চেইন আংটি দিয়ে মুখ দেখে। রোজী বাড়ির গেইট পেরোতেই নিতু ইসলাম বললো,
‘ বাবা! বউমাকে কোলে তুলে সরাসরি তোমার রুমে নিয়ে যাও। ড্রয়িংরুমে বসার প্রয়োজন নেই। এমনিতেই অনেক রাত হতে চললো। ‘
তামিম মাথা ঝাকালো। রোজীকে পাঁজাকোলে তুলে নিলো। রোজী তামিমের বাহুতে শেরওয়ানি খামচে ধরে নিজের ব্যালেন্স রাখলো। দু পা ফেলতেই বললো,
‘ গলা ধরো। ‘
রোজী গলা ধরলো। তামিম নাকোচ জানালো।
‘ এভাবে না। দু হাতে গলা জড়িয়ে ধরো। ‘
রোজী দু হাতে গলা জড়িয়েই ধরলো। মাথা নিচু করে রইলো যতক্ষন সে ফুলের বর্ষনের মাঝে রইলো। অতঃপর চোখ তুলে তাকালো। তামিম সে চোখ ভরা লজ্জা দেখে মৃদু হাসলো।
সামনের গাড়ি গুলো ক্রস করে তানভীরের গাড়ি গেইটে থামলো। লাবিবা এখনো হিক তুলে যাচ্ছে। অথচ বাড়ি পৌঁছতে তাদের প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট লেগে গেলো। তানভীর এতোক্ষন তার এই কাঁদুনে বউটাকেই দেখে গেছে। এইযে একবালতি চোখের পানি ঝড়ালো। এখন আবার একটু পর পর হিক তুলছে সিটে গা এলিয়ে দিয়ে। তানভীরের এটা দেখতেও ভীষন ভালো লাগছে। যখন হিক তুলে পুরোটা শরীর সিট থেকে একটুখানি উপরে উঠে আবার নেমে পড়ে। ঠোঁটজোড়া একটুখানি ফাঁক হয়ে আবার বন্ধ হয়ে যায়। নাকটা সংকুচিত হয়ে আবার ফুলে ফেঁপে উঠে। বড় বড় চোখ দুটোও নিস্তেজ থেকে প্রাণ ফিরে পায়। এরকম সৌন্দর্য এর আগেও উপভোগ করেছে তানভীর। তবে স্থান সময় সিচুয়েশন ছিলো পুরোটাই আলাদা। একান্ত ব্যক্তিগত সময়ের দৃশ্য চোখের সামনে ভাসতেই তানভীরের মাথা আওলা হয়ে গেলো। মনে মনে দোয়া করলো,’ ওহ গড! এরকম বিধংসী বউ যেনো কারো না হয়। সুস্থ চিন্তাধারার ধৈর্য্যশীল পুরুষটাকে কিভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করে মায়ার জালে উম্মাদ বানিয়ে ছাড়লো। ‘
চলবে ____
#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো
(৬১)
লাবিবার হিক তুলা দেখে সবাই আহা উহু করতে লাগলো। কেউ কেউ হাসতে হাসতে এগিয়েই এলো।
‘ আহারে বউ ! এবার তো চুপ যাও। তোমার বাপের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে এসেছি নাকি আমরা? হু? বাপের মেয়ে বাপের ই থাকবে। এতো কাছাকাছি ইচ্ছে করলেই তোমার বাপ দিনে দশবার আপডাউন করতে পারবে। চোখ ফুলিয়ে কি করছে দেখো বোকা মেয়ে। ‘
‘ আমরা নয় তোমার বাপমা কে বলে দিবো যখন তখন ডাকলেই চলে আসতে হবে। মেয়ের তাঁদের জন্য মন পুড়ে। ‘
‘ আহ! ভাবী সরেন তো। ওসব কিছু না। এখন কাদবেই। স্বামীর সোহাগ পেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ‘
‘ সরোতো তোমরা। বউয়ের মুখ দেখতে দাও। ‘
তানভীর আগেই নেমে দাঁড়িয়েছে। লাবিবাকে বরণ করা শেষ হলে তানভীর এসে কোলে করে গাড়ি থেকে নামিয়ে নেয়। লাবিবার পায়ের জুতো জোড়া এই ফাঁকে এনা খুলে নেয়। তানভীরকে বলে , ‘ আগেই রুমে নিশ না। লাবিবার মাথায় একটু পানি ঢালতে হবে। মুখ চোখের কি অবস্থা করেছে।’
‘ আমি দেখছি আপু। টেনশন নিও না। ‘
‘ গোছল করে চুল শুকিয়ে দিস নয়তো ঠান্ডা লেগে যাবে রাতে। ‘
‘ ঠিক আছে। ‘
লাবিবা তানভীরের ঘাড়ে মুখ গুজে দিয়েছে গলা জড়িয়ে ধরে। তানভীর মুচকি হেসে কানের লতিতে ঝুমকোর উপর চুমু দিলো।
‘ ওয়েলকাম টু আউয়ার বেডরুম। ‘
লাবিবা চোখ তুলে পিটপিট করে তাকালো। চোখ ঘুরিয়ে এদিক ওদিক চোখ বুলালো। এই মুহূর্তে সে বেডরুমের ঠিক মাঝখানে উপস্থিত আছে তার স্বামীর কোলে। পুরো রুম বাহারী তাজা ফুলে সুন্দর করে ডেকোরেট করা হয়েছে। বিছানায় সাদা চাদরের উপর গোলাপের পাপড়ি দিয়ে লেখা {তানভীর+লাবিবা} এটা দেখেই লাবিবা কুঁকড়ে গেলো। খামচে ধরলো তানভীর কে যতটুকু নিজেকে আড়াল করা যায় তানভীরের বুকে মুখ গুঁজে দিলো। তানভীর ছাড়ার পাত্র না। লাবিবার কানে ফিসফিসিয়ে বললো, ‘ লাব্বু জানো তোমার সাথে পরিচয় হবার পর আমার সব থেকে মেমোরাবল মমেন্ট কখন পাস করেছি আমি? হাজার ভালো মমেন্ট এলেও যা ঐ মমেন্টকে ছুঁতে পারবে না। ‘
‘ কখন?’
‘ আমাদের ফাস্ট নাইট। ‘
‘ খান সাহেব! ‘
‘ সরি ডারলিং বাট ইটস ট্রু। এ যুগে এসে বড্ড কপাল করে জম্মালে এটা অর্জন করা যায়। ‘
‘ আমার সবথেকে বিভীষিকাময় রাত। ‘
‘ ভাগ্যিস কড়া একটা শ্বশুর পেয়েছিলাম। আমার শ্বশুড় আমাকে যা ইচ্ছা তা করলেও একমাত্র তার মেয়ের কারণে আমি তার পা ধরে থাকবো সারাজীবন। উনার থেকে আমার অনেক শিক্ষা নেবার বাকি আমার ভবিষ্যৎ এর জন্য। জয় আমার কড়া শ্বশুরের জয়। ‘
‘ কি শুরু করলেন? ‘
তানভীর হাসে। লাবিবাও অন্যদিকে মুখ করে হেসে ফেলে। তানভীর গালে আলতো চুমু দেয়। নিচুস্বরে জানায়,’ তোমাকে প্রচুর কষ্ট দিবো আমি তার থেকেও একশগুণ দিবো সুখ। তোমাকে কষ্ট দিয়ে আদর করতে আমার বেশ লাগে জান। এরজন্য আমি একটুও সরি না।’
‘ নামান। ‘
‘ একটা চুমু দাও। ‘
‘ পারবোনা। ‘
‘ এতোটা পথ কোলে নিয়ে এলাম একটা চুমু দিবে না?’
‘ আপনার কষ্ট হলে ড্রাইভারকে বলতেন। উনি যদি আমাকে কোলে নিয়ে আসতেন একদমি খুটা দিতেন না।’
‘ ড্রাইভারের কোলে উঠতে মন চায় না? একদম গলা টিপে মেরে ফেলবো। ‘
লাবিবা খিল খিল করে হেসে উঠে। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ আপনি খুব খারাপ স্বামী। ‘
‘ কেনো?’
‘ আমার শরীর টা খারাপ আপনি জানেন। কিন্তু এখনো এমন ভাব দেখাচ্ছেন যেনো আপনি কিছুই জানেন না।’
‘ রাতে ঘুমাও না কেনো?’
‘ আপনার চিন্তায় বিভোর থাকি। ‘
‘ কেনো এতো চিন্তা?’
‘ কারণ আমি আপনাকে ছাড়া থাকি। ‘
‘ বড্ড বোকামোটা করে ফেলেছো। এতো মাথামোটা বউ হলেতো সমস্যা। বুদ্ধিমান বউ হলে চব্বিশ ঘন্টার মাঝে বাইশ ঘন্টাই ঘুমিয়ে নিতো। এরপর আর টানা সাত আটঘন্টা কবে ঘুমাবে তার কোন সিউরিটি থাকতো না। ‘
‘ এমনভাবে বলছেন! হ্যা! আপনাকে তো আমি খুজেই পাই না। ‘
তানভীর নাকে নাক ঘষে বলে, ‘ পিছে পিছে দেখো হতাহে ক্যা!’
‘ আমাকে বিয়ে করে কেমন ফিল করছো রোজ?’
‘ কেমন?’
‘ বলতে চাইছি তোমার ফিলিংস কেমন? কি এক্সেপ্ট করছো আমার থেকে?’
রোজী মাথা নাড়ায়। ‘ কিছু না। যা পেয়েছি তা আমার কাছে সপ্ন ছাড়া কিছুই না। ‘
‘ তোমার থেকে আমার অনেক এক্সপেক্টেশন। ‘
‘ কি?’
‘ কিছু চাওয়ার আছে তোমার থেকে। ‘ বলে তামিম এসে সরাসরি চোখ রাখে রোজীর চোখে। রোজী ঘাবড়ে যায়। আমতা আমতা করে বলে, ‘ আমার কাছে কিছু নেই আপনাকে দেবার। আপনার তো অনেক আছে। আমি মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। ‘
‘ তোমার কাছে কি মনে হয় আমি টাকা চাইবো? সিরিয়াসলি?’
রোজী ঝটপট মাথা নাড়ায়। কিছুক্ষন চিন্তা করে বলে,
‘ এটা আমার সেকেন্ড ম্যারেজ। আপনাকে দেবার মতো নতুন কিছু নেই আমার। ‘
‘ তোমার মস্তিষ্ক এটাই জানান দিলো? রোজ এমন কিছু ভাবো যেটা একজন স্বামী তার স্ত্রীর থেকে চাইতে পারে। থিংক বি পজেটিভ। ‘
রোজ ভীষন চিন্তায় পড়ে গেলো। তামিম ওকে আরেকটু নাড়িয়ে দেবার জন্য বললো,
‘ রোজ আজ আমাদের বাসর রাত। তুমি আমার নতুন বিয়ে করা বউ। কিন্তু সত্যি বলতে আমি একদমি তোমার প্রতি এই মুহূর্তে মন থেকে এট্যাকটিভ না । এমন কিছু করো যাতে আমাদের ফাস্ট নাইট সুন্দর হয়ে হয়ে। প্লিজ গো। ‘
রোজী এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো । কান্নাস্বরে বলে উঠলো, ‘ ডাক্তারসাহেব। আম ইন পিরিয়ড। সরি। ‘
এবার তামিম ধৈয্যের কুল ভেঙে রোজীর সামনে থেকে সরে গেলো। মেয়েটার সাথে মন খুলে কথা বলার সময় না এটা বুঝতে পারলো। সে তো নিজেই ডিস্টার্ব। মনকে শান্ত করার জন্য গিয়েছিলো রোজীর সাথে টাইম স্পেন্ড করতে। নতুন বউ একটু সময় দিলে তার ও ভালো লাগবে তামিম ও নিজেকে সামলে উঠবে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে তামিম হা নিশ্বাস ফেলে। সময় অনেক দূরে চলে গেলেও তামিমের চোখে সে স্মৃতি একদমি তাজা। দিনের স্বচ্ছ আলোর মতো পরিষ্কার। বাসর রাত! সে রাতে কতই না এক্সাইটেড ছিলো দুজন। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কত সময় কাটিয়েছে জানা নেই। আর আজ বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট নেই এই রাত নিয়ে। তবে এটা সত্য রোজীর প্রতি তামিমের একটা মায়া পড়ে গেছে। আবার মনে হয় এই মেয়েটাকে অনেক কিছু সে দিবে। সচ্ছ মনের মেয়েকে দিতে ভয় নেই। তারা জানে কিভাবে কৃতজ্ঞ থাকতে হয় । তবুও ভয় হয়। এই ভয়কেই তামিমকে জয় করতে হবে। ছাড় নেই। নেই অন্ধ বিশ্বাস। দ্বিতীয় বার আর এক ভুল করবে না। নিজের সাথে বোঝাপড়া করে নেয়। রোজীর জীবন হবে তামিমময়। ক্ষমতা থাকবে তামিমের হাতে। বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে সে প্রস্তুত নয়। তামিম ডাকলো রোজীকে। সাড়া পেলো না। তাই সে নিজেই রুমে এলো। রোজী উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। কাঁধে হাত দিতেই বুঝলো মেয়েটা কাঁপছে। তামিম রোজীকে টেনে তার মুখোমুখি করলো। ঠিকই ধরেছে। রোজী কাঁদছে।
‘ কাঁদছো কেনো?’
কথা বলে না।
‘ কি হলো কাঁদছো কেনো? আমি বকেছি তোমাকে? ‘
‘ না। ‘
‘ তাহলে?’
রোজী বলতে পারেনা তামিমকে সে কি জন্য কাঁদছে। বড্ড লজ্জার ব্যপার এটা তার জন্য। বাসর রাতে স্বামী তাকে চাইলো আর সে সাড়া দিতে পারলোনা। আরো জানলো তাকে নিয়ে একটুও ইন্টারেস্ট নেই স্বামীর। রোজীর কষ্ট হচ্ছে তার আগের জীবনের জন্য। সবার মুখে মুখে গোলাপের মতো ফুটে থাকা সুন্দরী মেয়েটার এতো অধঃপতন যে তার দ্বিতীয় স্বামী বলছে সে একটুও এট্যাকটিভ না। কথাটা একটা মেয়ের জন্য কতটা অপমানজনক হতে পারে তা একটা মেয়েই জানে অন্যকেউ না। রোজীর এই মুহূর্তে তার আগের স্বামীকে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে। ধ্বংস করে দিলো তার জীবনটা। একদম ধ্বংস করে দিয়েছে। সে স্বাভাবিক জীবনটাই খুঁজে পাচ্ছে না। পেলেও ভাগ্য তার হাতে ধরা দিচ্ছেনা। আর পাঁচটা মেয়ের মতো রোজী স্বাভাবিক জীবন চায়। স্বামী সন্তান নিয়ে বাকিটা জীবন ডাল ভাত খেয়ে হলেও পার করতে চায়। তার কোনো চাহিদা নেই এছাড়া। রোজীর এখন মনে হচ্ছে তামিম তাকে বিয়ে করে ঠকে গেছে। রোজী তার একটুও যোগ্য না। একটুও না।
তামিম রোজীর বাহু টেনে ধরলো, ‘ উঠো। কান্না থামাও। আমার সাথে এসো। ‘
রোজী চোখ মুছে বারান্দায় এসে বসলো। এখানে দুটো বসার টুল পাতা রয়েছে। বুঝা যায় প্রতি সকালে এখানে সেন্টার টেবিলে তামিমের চা/কফি চলে। তামিম পকেট থেকে একটা লাইটার আরেকটা সিগারেটের প্যাকেট বের করে রাখলো। একটা সিগারেট ধরিয়ে বললো,
‘ রোজ! তুমি কি আজ আমার সাথে একটা সিগারেট শেয়ার করবে?’
‘ আপনি কি আমার পরিক্ষা নিচ্ছেন?’
‘ আমি ভেতর থেকে বিক্ষিপ্ত রোজ। তাই ভেবেছি আজ সিগারেটের ধোঁয়ায় কষ্ট উড়াবো। ‘
‘ আর আমি?’
‘ তুমি আমার কষ্ট বুঝবে না। সময় নাও। একদিন ঠিকই বুঝবে। ‘
‘ সিগারেট খাবেন না। আমার সিগারেট পছন্দ না। ‘
‘ কি পছন্দ তোমার?’
‘ আপনাকে পছন্দ। ‘
‘ তুমি তো আমার কথা বুঝো না। মনের কথা বুঝো। মন যা বলে সেটাই মাথায় ঘুরপাক খাওয়াও আর ভাবো আমি তোমাকে সময় দিবোনা। এক্ষুনি আমার ডিমান্ড পূরণ করতে পারছোনা তাই কান্নাকাটি করা শুরু করেছো। ‘
রোজী মাথা নিচু করে ফেলে। তামিম রোজীর টুল টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে। থুতনিতে হাত রেখে বলে,
‘ রোজ আমার দিকে তাকাও। আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও।
‘ তুমি আমাকে নিয়ে বাকি জীবন টা কাটাতে চাও?’
‘ হ্যা। ‘
‘ তুমি কি তোমার আগের স্বামীর জন্য কিছু অনুভব করছো?’
রোজীর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠে। গো ধরে বলে,
‘ একদমি না। ‘
‘ এই ব্যাপারে আমি হেরে বসে আছি রোজ। আমি আমার এক্স ওয়াইফের জন্য অনেক কিছুই অনুভব করছি। যার মাঝে ত্রীব্র হলো কষ্ট। রোজ তুমি সমাজের দিক থেকে হেরে যাওয়া মানুষ হলেও মনের দিক থেকে একটুও বেঁকে যাওনি। কিন্তু আমি সমাজ এবং নিজ মনের দিক থেকে বিদ্ধস্ত । তুমি যদি আমাকেই চাও নিজের করে তাহলে আমাকে হেল্প করো। আমার ভাঙাচোরা মনটাকে সারিয়ে তুলো। আমি নিজের দিক থেকে আমার বেষ্টটা দিবো। মানুষের জীবনে কিছু কিছু ভুল থাকে। ফ্লোরা আমার জীবনের সেই ভুল। তাকে আমি আমার পাজরে তৈরী মনে করিনা। সে আমার জীবনের একটা ভুল ছাড়া কিছুই না। এই মুহূর্তে তোমাকেই সত্য মনে করছি। আমার ধারণা কখনো যেনো পাল্টে না যায়। তুমি কখনো নিজেকে হেয় ভাববে না। রোজ আমি অভিজ্ঞ মনের ডাক্তার। তোমার মনে কি চলে তা ধরতে আমার সময় লাগবেনা। ফ্লোরা ফুলের মতো সুন্দর। কিন্তু কাটা যুক্ত। তুমি সাধারণ ফুল হয়েই থাকো। সব দিক সর্বোচ্চ থাকলেই যে সুন্দর হবে তেমন কিন্তু না। যদি তাই হতো আমার ভাই শ্যামসুন্দরীর জন্য পাগলামী করতো না। তুমি একটা ফর্সা সুন্দরী কে দাড় করাবে আরেকপাশে ছোট বউকে। চোখ ছোট বউয়ের দিকেই পড়বে। সে এক আলাদা মায়া। আমি তোমাকে কেনো পছন্দ করেছি জানো? তোমার মুখের আদলে একটা আলাদা মায়া আছে। আমি সেই মায়ায় পড়েছি। তুমি সুন্দর। মায়াবী সুন্দর। তোমার কোন দিক থেকে কোনো কমতি নেই। শুধু নিজের যত্নটার ই অভাব। সেই দায়িত্ব স্বামী হিসেবে আমার। তোমার এখানে খাপ খাওয়াতে অনেক সমস্যা হতে পারে। কিন্তু শিখে নিবে। লাবিবা প্রচুর বুদ্ধিমতি। দুই জায়ের ভেতর কোনো রেষারেষি, অহংবোধ , হিংসাত্মক মনোভাব আমি সহ্য করবোনা। তাকে ছোট বোনের চোখে দেখবে। স্নেহ করবে। সে তোমাকে সর্বোচ্চ সম্মান দিবে। ভালো থাকার পথ খুঁজবে বড় হবার নয়। যেটাতে সামান্যতম সুখ আসবে সেই কাজটাই করবে। বৃহৎ সুখ তোমার ছোট্ট চাওয়াতেই ধরা দিবে। পারিপার্শ্বিক বিষয়ে অধিক লোভ করোনা সেই সামান্যতম সুখটাও হারাবে। তোমার যত লোভ আমার উপর হোক। আমি বিরক্ত হলেও বাঁধা দেবো না। ফ্লোরার জায়গা তোমাকে দিতে পারবোনা কিন্তু তোমার জায়গাটা তোমাকে ঠিকই দিবো। নিজেরটা ভালোভাবে বুঝে নাও আমি খুশিই হবো। আমাকে সময় দিবে। আমার দিন রাত্রির সঙ্গী হবে। আমি সঙ্গী বিহীন তৃষ্ণার্ত। প্রচুর তৃষ্ণার্ত। আমাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক রাখবে। কখনোই আমার কথার অবাধ্য হবেনা। আমি যা বলবো তাই করবে। পারবেনা? পারবেতো। ‘
‘ পারবো। ‘
‘ আমার ঘুম হবেনা। তুমি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। ‘
‘ এখানেই ঘুমাবো। ‘
‘ বসে বসে!’
‘ আমাকে আপনার বুকে নিবেন? সকাল অব্দি আপনাকে জডিয়ে ঘুমাবো। ‘
‘ আমি পুরুষ মানুষ রোজ । ‘
‘ আমারি তো। ‘
লাবিবার লাগেজ আনতে গিয়ে তানভীরের মোটামুটি দেড়িই হয়। কাজিনরা চেপে ধরে। ঘরে তো বউ নিয়ে গটগট করে চলে গেলে কিন্তু আমাদের টাকা তো দিয়ে গেলে না। এখন তাদের টাকা চাই। না দিয়ে পার পাবে না। ট্রিট দেবে বলে তানভীর রাজি করিয়ে যখন লাগেজ নিয়ে ফিরলো তখন দেখে লাবিবা উল্টোদিক হয়ে বসে কুটকুট করে কিজানি খাচ্ছে। তানভীর কে দেখে সোজা মুখ হয়ে বসলো। হাতে প্লেটে কিছু ফ্রুটস। তানভীর কে সাধলো, ‘ খাবেন?’
‘ না। আমি খেয়েই আসছি হল থেকে। ‘
‘ আচ্ছা। আমি খাই। ক্ষুধা লেগেছে। ‘
‘ কে দিও গেলো?’
‘ এনাপু। ‘
‘ গোছল দিবে?’
‘ না। ‘
‘ এদিকে এসে বসো। আমি অনার্মেন্টস খুলে দিচ্ছি। ‘
তানভীর লাবিবার এক হাত ধরে যত্নের সাথে চুর আংটি খুলে দিচ্ছে। পাছে না আবার ব্যাথা লেগে যায়। ডান হাতের সময় লাবিবার খাওয়া অফ হয়ে যায়। বুঝতে পেরে তানভীর একটু একটু করে ফ্রুটরের স্লাইস মুখে তুলে দেয়। লাবিবাকে আর হাত দিতে হয়না। মাঝে মাঝে দুষ্টুমি চেপে যায়। লাবিবার ঠোঁট থেকে নিজের ঠোঁট দ্বারা আঙুর তুলে নেয়। লাবিবাকে জ্বালাতেও বাদ রাখে না। স্পর্শকাতর সব জায়গায় হুট হাট ছুঁয়ে দেয়। প্রতিটা স্পর্শে লাবিবা থর থর করে কেঁপে উঠে। এ এক অদ্ভুত সুখ জাগায় মনে। গলার হার গুলো খুলে নেবার পরে লাবিবা গা ছেড়ে দেয় তানভীরের উপরে। তানভীর কোলে নিয়ে বসিয়ে দেয় ফ্লোরে। জুলফির নিচে খেলা করছে তার ঠোঁট।
‘ জান! বেশী খারাপ লাগছে। ‘
‘ খাওয়ার পর একটু ভালো লাগছে। চুলগুলো ছাড়িয়ে নিলে ভালো লাগবে। ‘
‘ কিভাবে ছাড়াবো?’
‘ তেল দিয়ে। ‘
তেলের বোতল থেকে তেল ঢেলে তানভীর দুহাতে ঘষে নেয়। তারপর হাত লাগায় লাবিবার চুলে। সুবিধা করতে গিয়ে দুপায়ের বেষ্টনী তৈরি করে। একটার পর একটা স্তর ছাড়িয়ে নিচ্ছে চুলে। এতো এতো ভাজ কেনো ফেলতে হবে? তানভীরের বিরক্ত ধরে গেছে।
‘ আগে জানলে কখনোই এভাবে চুল বাঁধতে দিতাম না। কি একটা ঝামেলা! ‘
এদিকে লাবিবা আরামে চোখ বুজে ঝিমুচ্ছে। চুলে হাত বুলালে এমনিতেই ঘুম চলে আসে চোখে। তার উপর তানভীর আনাড়ি হাতে এতো যত্ন নিয়ে তেল দিয়ে দিচ্ছে ক্লান্ত দেহে আর বাধ মানলো না। ঘুমে ঢলে পড়লো তানভীরের কোলে।
সকালে যখন ঘুম ভাঙলো নিজেকে বিছানায় দেখলো। তানভীর কে কোথাও খুঁজে পেলো না। ঝটপট নেমে ফ্রেস হয়ে এলো। ফোন খুঁজে পেলো বালিশের নিচে। স্কিনে টাইম ওঠা ১১.১৪ । লাবিবা দৌড় দিলো জানালার দিকে। পর্দা টেনে দেখে বাঈরে ফকফকা রোদ। মাথায় এবার হাত পড়লো। এতো ঘুমালো! রাতেই বা কখন ঘুমালো? আর তানভীর? মানুষ টা এতো তাকে চাইছিলো আর সে? সারাদিনে দুইবার তানভীর কে চোখে পড়লো। কিন্তু তানভীর তাকে টোটালি ইগনোর করে গেলো। তবে কি তানভীর সত্যি সত্যি রাগ করে বসলো? লাবিবা যেচে কথা বলতে গেলো কিন্তু তানভীর আছে দৌড়ের উপর। কথা বলার সময় টাও পায়নি। একবার শুধু জিজ্ঞেস করতে পেরেছে ,
‘ আপনি কি আমার উপর রাগ করেছেন?’
তানভীর উল্টো প্রশ্ন করলো, ‘ এখন ঠিকাছো?’
লাবিবা মাথা নাড়ালো সে ঠিক আছে। কিন্তু কতক্ষন ঠিক থাকবে জানেনা। তানভীর যদি এভাবে ইগনোর করে চলে তাহলে মুহুর্তে ই সে গতি হারিয়ে ফেলবে। মস্তিষ্কে চাপ পড়বে। বুকের উপর পাথ্য জমা পড়বে। রিসিপশনের জন্য সুন্দর পেঁয়াজ কালার লেহেংগা টা পড়ে নিলো। পার্টি মেকাপ করে সোহানার সাথে বেরিয়ে এলো হলে যাবার উদ্দেশ্যে। তানভীরের গাড়িতে তানভীরের পাশেই বসলো। কিন্তু সে মানুষটার কোনো রিয়েকশন নাই। লাবিবা ফ্রন্ট মিররে বার বার উকি দিয়ে নিজেকে দেখলো তাকে কেমন লাগছে। নিজের কাছে তো নিজেকে ভীষন সুন্দর লাগছে কিন্তু তানভীর কেনো কোনো রিয়েক্ট করছে না? লাবিবা হাঁসফাঁস করতে লাগলো। নিজে থেকেই হাত বাড়িয়ে তানভীরের উরুর উপর রাখলো। তার সপ্নের পুরুষটার উপর বেহায়া দৃষ্টি ফেললো। অফ হোয়াইট সুট কোটে একদম পার্টি গোয়িং মেকাপ। বুকপকেটে রোজের ব্রোজ এর উপর লাবিবার চোখ আটকালো। ভীষন সুন্দর একটা ব্রোজ দারুন মানিয়েছে তাকে। উরু থেকে হাতটা বুকের উপর উঠে আসতেই তানভীর নিজের হাত উপরে রেখে আটকে দিলো। চমকে উঠলো লাবিবা। ড্রাইভারকে বললো, ‘ গাড়ি থামাও। ‘
রাস্তার পাশে পার্ক করতেই তানভীর নেমে পড়লো। ড্রাইভারকে ওয়ালেট থেকে কিছু টাকা বের করে দিয়ে বললো , ‘ রিসিপসনে চলে যেও। ‘
লাবিবাও নেমে পড়লো তাড়াহুড়ো করে গাড়ি থেকে। তানভীর কি করছে বুঝতে পারছে না। রাগের মাথায় উল্টোপাল্টা কিছু না করলেই হলো। লাবিবাকে অবাক করে দিয়ে তানভীর নিজেই ড্রাইভিং সিটে উঠে বসলো। লাবিবাও পাশের ডোর খুলে ফ্রন্ট সিটে তাড়াহুড়ো করে বসলো। তানভীর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে উল্টো রাস্তা ধরলেই লাবিবার দম বন্ধ হয়ে এলো। কাঁপা স্বরে বললো ,
‘ হলের রাস্তা ঐদিকে। ‘
তানভীর কিছু বললোনা। লাবিবা ঢুক গিললো। করুন গলায় বললো, ‘ খান সাহেব! আমাদের রিসিপশনে যেতে হবে। ‘
এবার লাবিবা আশে পাশে তাকিয়ে ঢাকা ময়মনসিংহের রাস্তা দেখে উত্তেজিত হয়ে উঠলো। জানতে চাইলো,
‘ খান সাহেব! আমরা যাচ্ছি কোথায় ?’
তানভীরের ছোট্ট উত্তর , ‘ হানিমুনে। ‘
চলবে ____
#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো
(৬২)
তানভীরকে বার বার কল দেওয়া হচ্ছে। সুইচস্টপ বলছে। লাবিবাকেও কল দেওয়া হয়েছে। প্রথমে রিং হলে পরে সুইচস্টপ বলছে। এটা যে ইচ্ছে করে সুইচস্টপ করেছে সেটা বোঝা যাচ্ছে। ইসমাইল রাগে ফেটে পড়ছে। কি হচ্ছেটাকি? তামিম রোজী এসে বসে আছে অথচ তার মেয়ে জামাইয়ের খবর নেই। লোকজন কতক্ষন থেকে উৎসুক হয়ে আছে। কি জবাব দিবে? ড্রাইভার মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভারকে দেখেই শরীর জ্বলে যাচ্ছে। ফিরোজ খান দিলো এক ধমক। ‘ ইডিয়ট! তোমাকে নামিয়ে দিলো আর তুমি চলে এলে? এট লিষ্ট জিজ্ঞেস তো করতে পারতে তারা কোথায় যাচ্ছে। রাস্তায় কোন বিপদ আপদ না হলে হয়। ‘
ড্রাইভার মাথা নিচু থেকে নিচুতর করে নিলো। ভয়ে পা দুটো থরথর করে কাঁপছে । ফিরোজ খান রেগেমেগে প্রস্থান করলেন। বড় ছেলে ছেলে বউকে নিয়েই অনুষ্টান শেষ করতে বললেন।
গাল ফুলিয়ে তানভীরের দিকে মুখ করে বসে আছে লাবিবা। রাগের চোটে নাক ফুসফুস করছে। ফোন কেড়ে নেওয়ার কি মানে? কথাটাতো বলতে দিবে। বাবা না জানি কত টেনশন করছে। তানভীর একটু পর পর লাবিবার দিকে তাকাচ্ছে। ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি একটু স্লো করেই হাত বাড়িয়ে ফুলো গালে একগাল টেনে দিলো। আদুরে গলায় বললো, ‘ সুন্দর লাগছে। ‘ অপমান! লাবিবা মুখ স্বাভাবিক করে নিলো। বললো,
‘ আব্বু টেনশন করবে। ‘
‘ করুক। ‘
‘ এটা কেমন ধরনের পাগলামি? রিসিপশনে আমার কত প্লান ছিলো! রোজীপু আমি একসাথে নেচে এন্ট্রি নিবো পেছনেই থাকবেন আপনারা। ফ্রেন্ডসদের সাথে বন্ধু পোজে ছবি নিবো। পেট ভরে রোষ্ট খাবো। আমার সব জ্বলে গেলো। ‘
‘ সব প্লান মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো এখন থেকে শুধু আমাকেই ভাবো। আগামী তিনদিন আমাকে পাচ্ছো তার পরের পাঁচদিন কনভারসেশনটাও থাকবে না। ‘
‘ কোথায় যাবেন আপনি?’ অবাক হয়ে লাবিবা প্রশ্ন করলো।
‘ সিঙ্গাপুর। বিয়ের জন্য ইমপর্টেন্স কিছু কাজ আনকমপ্লিট রেখেছি। সেটাই কমপ্লিট করতে যেতে হবে। ‘
‘ বিজনেসের? কিসের বিজনেস আপনার?’
‘ আমার না। পাপার। আমাকেই দেখতে হয়। ভাইয়ার এসবে ইন্টারেস্ট নেই।’
‘ বুঝেছি।বাসায় ফিরে মমের সাথে আমাকেও জয়েন করতে হবে ।’
তানভীর ফিক করে হেসে দিলো। কিছু না বলে ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিলো। লাবিবা বাইরের দিকে চোখ রাখলো। নিশুথি রাত গ্ৰামের মাঝদিয়ে শো শো করে চলে যাচ্ছে তাদের গাড়িটি। খারাপ লাগা সব ধুলিসাৎ হয়ে গেলো। মৃদুমন্দ হাওয়ায় চোখ বুজে নিলো। তানভীর চোখ খুলে আবছা অন্ধকার সুন্দর রাস্তাটা উপভোগ করতে বললো। লাবিবা খুললো না। চোখ বন্ধ রেখেই বললো,
‘ চোখ খুলা থাক আর বন্ধ! আমার পৃথিবী আজ থেকে আপনার মাঝেই আবদ্ধ। ‘
তানভীর মৃদু হাসলো। ‘ ধন্যবাদ বউ। অল্পতেই আমাকে বুঝে যাওয়ার জন্য। ‘
অল্পসময়েই গাজীপুরের চৌরাস্তা পার হয়ে ঢাকার জ্যাম ছাড়িয়ে গাড়িটা যখন চলতে লাগলো তখন লাবিবা ভেতরে ভেতরে ভীষন উত্তেজিত। বার বার জিজ্ঞেস করলো, ‘ খান সাহেব! কোথায় যাচ্ছি আমরা? একবার বলুন। আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারছিনা। ‘
তানভীর ফিসফিসিয়ে বললো, ‘ সারপ্রাইজ। ‘
‘ দুলাভাইয়ের পক্ষ থেকে?’
‘ আরে না! এতো বোকা নাকি? তার থেকে তার দেশের ট্রিট নিবো। মাসে মাসে এতো ডলার কামায় সুযোগ মতো কিছু ছাড়াতে হবে তো। ‘
‘ আমরা আমেরিকাতেও যাবো!’
‘ তো ননাশের বাসায় যাবে না?’
লাবিবার আনন্দ যেনো আর ধরে না। বকবক করতে করতে পুরো রাস্তা শেষ করলো। ঘড়িতে তখন প্রায় এগারোটা। বিকালেই বুকিং দেওয়া হয়েছে। তারা তাদের জন্য বরাদ্দকৃত কটেজে উঠলো। রাস্তায় নেমে ডিনার করে নিয়েছে সেজন্য খাওয়া-দাওয়ার আর ঝামেলাটা নেই। তানভীর রিসোর্টের বয়দের সাথে লাবিবাকে যেতে বললো। লাবিবা ছেলে দুটোর মুখপান করে ভয় পেয়ে গেলো। তানভীর অভয় দিলো,
‘ ভয়ের কিছু নেই। যাও তুমি।ফ্রেস হয়ে নাও। আমি আসছি। ‘
‘ হুম। ‘
তানভীর হাতের ব্লেজারটা লাবিবার হাতে ধরিয়ে দিলো।
যেতে যেতে চোখে ইশারা করলো, ‘ ওয়েট ফর মি। আর বাসায় কথা বলে নিও। দু চারটে বকা নাহয় আমার হয়ে তোমারই পাওয়া হোক। ‘
লাবিবা চোখে হাসলো। তানভীরকে যতদূর দেখা গেলো ততক্ষন দাঁড়িয়ে রইলো। ঘোর কাটলো ছেলে দুটোর কথায়। ‘ চাবিটা ম্যামের হাতে দিয়ে দে। ‘
লাবিবা এগিয়ে গিয়ে চাবি নিলো। ওরা আগেই লাগেজ ভেতরে দিয়ে গেছে। কটেজে ঢুকে আলো জ্বালাতেই লাবিবার চোখ ধাঁধিয়ে গেলো। আর্টিফিশিয়াল ফুলে অনেক সুন্দর করে ডেকোরেট করা পুরো রুমটা। কেউ একপলক দেখেই বলবে ফুলগুলো রিয়েল। লাবিবা ঘ্রাণ নিলো। কেমন যেনো মিষ্টি একটা ঘ্রাণ। ফুলে হাত ছোয়ালো। না। ফুলগুলো আর্টিফিশিয়াল। উপর দিয়ে সুগন্ধী স্পে করে দিয়েছে। লাবিবার মন চনবন করে উঠলো। দৌড়ে দিয়ে জানালার পর্দা খুলে দিলো। ভেবেছিলো জানালা হবে। কিন্তু না বেলকনির দেখা যাচ্ছে। লাবিবা লেহেংগা তুলে বেলকনিতে পা রাখলো। বিশাল বেলকনি তার নিচেই পুরো ফাঁকা। চাঁদের আলোয় দেখা মিলেছে সামনের পাহাড় গুলি। কোন জায়গা এটা? লাবিবা জানে না। তবে পাহাড়ের উপরে আছে সেটা জানে। কিছুক্ষন খোলা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রুমে চলে এলো। লেহেংগার নিচের পার্ট খুলে আরাম করে বিছানায় বসলো। ফোন অন করে কল করলো বাবার কাছে। ইসমাইলের স্বর গম্ভীর। লাবিবা ঝটপট সরি বললো। এখন না কতোগুলো বকা শুনতে হবে। কিন্তু ইসমাইল বিন্দুমাত্র বকলোনা। বকার কথাও না। কাজটা যে তার মেয়ে জামাইয়ের সেটা জানা কথা। তার মেয়ের এতোটা স্পর্ধা নেই। উল্টে লাবিবাকে বললো, যে কয়দিন থাকবে সাবধানে থেকো। আমি আমার মেয়েকে সুস্থ অবস্থায় বাড়ি দেখতে পেলেই হলো। ‘
লাবিবা আরো কিছুক্ষণ কথা বললো। তারপর ফোনটা রেখে ফ্রেস হতে উঠতে যাবে তখনি একটা টেক্সট আসে।
‘ থ্যাংক য়্যু সেই স্পেশাল মানুষটাকে যে আমার প্রতিটা সময়কে সুখময় করে তুলে। ‘
স্পেশাল মানুষ! স্পেশাল মানুষের জন্য কিছু স্পেশাল হোক। লাবিবা প্রত্যেকটা সময় তৈরী থাকবে এই কৃতজ্ঞ মানুষটাকে আরো স্পেশাল ফিলিংস এনে দেবার জন্য।
বাথরুমে ঢুকে খুব সময় নিয়ে ফ্রেশ হলো। মুখে সাজসজ্জার রেশ নেই। র ফেইসে গাঢ় লাল লিপস্টিকে ভরালো। এই লিপস্টিক দিতেই যত বাধা। আজ তো কোন বাধা নেই। তাহলে কেনো দিবেনা? লাগেজ থেকে বিয়ের লাল বেনারসীটা বের করে নিলো। বাবার বাড়ি যাবার উদ্দেশ্যে লাগেজ গুছানোর সময় ভাগ্যিস বিয়ের শাড়িটা তুলেছিলো। লাবিবা প্যাচ দিয়ে শুধু শাড়িটা গাড়ে জড়িয়ে নিলো। শুধুই শাড়ি। বুকের উপর আঁচল টেনে দিলো সুন্দর ভাবে। জুয়েলারি বক্স থেকে সোনার গহনা গুলো একে একে গায়ে জড়িয়ে নিলো। চুল গুলো ছেড়ে দিয়ে এসে দাঁড়ালো বেলকনিতে। অপেক্ষার প্রহর গুনলো তানভীরের নামে। মুহুর্তের পর মুহুর্তে পার হয়ে যাচ্ছে তানভীর আসার নাম নেই। অতপর মাঝরাতে তানভীরের আগমন। লাবিবা তখনও বেলকনিতে দাঁড়িয়ে। গা শিউরে উঠা বাতাসে খোলা পিঠ একদম ঠান্ডা হয়ে গেছে। তবুও শরীরের ভেতরে যে উষ্ণতা বইছে সে উষ্ণতায় বাইরের শীতলতা কিছুই নয়। দরজা খুলা পেয়ে তানভীর রুমে ঢুকে দেখলো রুম একদম ফাঁকা। লাবিবা নেই। কিন্তু বেলকনির দরজা খুলা। বাতাসে পর্দা উড়তেই দৃশ্যমান হলো অপরদিকে মুখ করে তাকানো লাল টকটকে এক বধু। বাতাসে উড়ছে যার শাড়ীর আঁচল। চুল গুলো সব সামনে নেওয়া। তানভীরের হাতে একঝুড়ি সদ্য তুলা কয়েকশত লালগোলাপ। প্রেয়সীর জন্য এই রাতে অদূরে বাগান থেকে নিজ হাতে তুলে এনেছে। আসার সময় ই চোখে পড়েছিলো বাগানটা। প্রেয়সীকে চমকে দেবার জন্য ই এতোগুলো গোলাপ ডাল বিহিন হাতে গুটিয়ে তুলে এনেছে। আর প্রেয়সী যে তার প্রেমে মরণ ফাঁদ তৈরী করে রেখেছে জানতো কে? কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তাকাতেই তানভীরের চোখ যেনো জ্বলসে গেলো। বিছানার উপর ঝুড়ি রেখে ধীরে ধীরে লাবিবার দিকে এগিয়ে গেলো। একদম দাঁড়ালো পেছন বরাবর। এতো কাছে। অনেক কাছে। লাবিবার গায়ের সুবাস পাচ্ছে। দৃষ্টি আটকে গেছে খোলা পিঠে। লম্বা চুলের কয়েকটা চুল এলোমেলো হয়ে পিঠের উপর পড়ে আছে। তানভীরের গরম শ্বাস পড়ছে লাবিবার ঘাড়ের উপরে। হটাৎ ই লাবিবা ঘুরে দাঁড়ালো। চোখ পড়লো ডাগর ডাগর দুই চোখে। সেই চোখে স্পষ্ট লজ্জার ছাপ। চোখ নামিয়ে নিলো লাবিবা। প্রচন্ড উত্তেজনায় তার শরীর কাঁপছে। এমন মোহনীয় রুপে তানভীর ব্যালেন্স হারিয়ে ফেললো। ধপ করে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়লো ফ্লোরে। বাহুবন্ধনে আঁকড়ে নিলো প্রেয়সীর জানু। আবেগে কাঁপছে তার কন্ঠ। কোনভাবে আওড়ালো,
‘ আমার রাণী!’
( চলবে)