ভালোবাসার কাব্য গাঁথবো পর্ব-৬৫

0
965

#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো

(৬৫)
‘ শইলের থাইকা বিয়ার গন্ধ যাইতে না যাইতেই সোয়ামী হাত ছাড়া হয়ে গেলো । এতো রুপ দিয়া কি হইবো যদি সোয়ামীরে বাগেই না আনতে পারস। আফতাবের মোবাইলে তো দেখলাম বিদেশী হাফ প্যান্ট পড়া মাইয়াগো সাথে ঢলাঢলি করতাছে তোর জামাই।’
কথাটা শোনামাত্র লাবিবার গা জ্বলে উঠলো। রোষানল ভরা চোখে তাকালো বয়স্ক মহিলার দিকে। পরক্ষনেই চোখ ঘুরালো সাবিনার দিকে। সাবিনার মুখে সামনে এক আঙুল চেপে ইশারা করলো চুপ থাকতে। লাবিবা মাটির দিকে দৃষ্টি মেললো। মাঝারে উপচে পড়ছে গ্ৰামের মানুষ। ছোট কাকার শ্বশুড়বাড়ির লোক এসেছেন। কিসের জন্য জানি মানত রেখেছিলো সেজন্য খিচুড়ির আয়োজন করা হয়েছে। নান্দিনা এলাকার মানুষ আবার এসব মানত টানত বেশ মানে। সাবিনা বুঝলো মেয়ের মনের অবস্থা। কিন্তু উত্তর কাটলো না। মুরুব্বি মহিলাগণ, শ্বাশুড়ীর সাথে তাঁদের ছিলো গলায় গলায় ভাব। এখনো যে কোনো প্রয়োজনে ডাকলে তাদের পরিবারকে পাশে পাওয়া যায় । গ্ৰামের মানুষজন একে অপরের সাথে মিশেমিশেই বসবাস করেন। আরেকজন মহিলা সাবিনাকে বলেন,
‘ বড়লোকের পোলা দেইখা বিয়ে দিছো জানতানা ঐসব নেতা-ঠেতা মাইনষের চরিত্রের দোষ থাকে। নিষ্পাপ মাইয়াডারে কার হাতে তুলে দিলা?’
লাবিবা সাথে সাথে গর্জে উঠে, ‘ এই বুড়ি। ‘
সাবিনা ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়। মুখে মিথ্যা হাসি টেনে বলে, ‘ সেসব কিছু না চাচী। আসলে বিদেশে মেয়েরা তো ছোট খাটো জামা কাপড় ই পড়ে। ওদের দেশের পোশাক-আশাক ই ঐরকম। আর ওরা জামাই বাবার বিজনেস পার্টনার। আর কিছু না। ‘
এদিকটায় খেয়াল করে লাবিবার ছোট চাচা এগিয়ে আসে। লাবিবাকে রাগে বোম হয়ে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করে, ‘ কি হয়েছে ভাবী?’
‘ তেমন কিছু না। লাবিবাকে অন্তুদের দিকে দিয়ে আসো তো আনোয়ার। ‘
‘ রেগে আছে কেনো?কিরে? কি হয়েছে?’
লাবিবা, সাবিনা উত্তর দিলো না। পাশ থেকে আরেকজন বললো, ‘ শোন বইন আমরা রাগের কথা কই নাই। বিয়া হইতে না হইতেই জামাই চইলা গেলো। ওসব ব্যবসা-ট্যাবসা কিচ্ছু না। নয়া বউ রাইখা ছেমড়া বাইরে বাইরে ঘুরে বিদেশী মাইয়াগোর সাথে একলগে আবার ছবি দেয় মোবাইলে মোবাইলে । কিচ্ছু কি শিখায়া দেই নাই তোরে? কি করে কবিরের বউডা? পরে কিছু হইলে ঘর ভাঙবি নাকি!’
আনোয়ার এবার বুঝলো বিষয়টা। লাবিবার হাত টেনে তুলে দাড় করালো। মহিলাদের উদ্দেশ্যে বললো,
‘ আমরা দেখে শুনেই জামাই নিয়ে আসছি চাচী। জামাই আমাদের সচ্চরিত্রবান। আপনাদের মাথায় চিন্তা নিবেন না। আমাদের মেয়ে আমরা আছি চিন্তা করার জন্য। ‘
সাবিনা সাহিদারি একজনকে ডাকলো, ‘ এই এদিকে আসো। চাচীদের পাত খালি পড়ে আছে। ‘
মহিলাদের পাত ভর্তি খিচুড়ি দেওয়া হলো। সাবিনা উঠলো ওখান থেকে। এদিকটা খাওয়ানো শেষের পথে। খালি পায়ে মাঝারে পা রাখলো। লাবিবাকে নিয়ে আর থাকা যাবেনা এখানে। আসছে যখন যাওয়ার আগে মাজার শরীফ জিয়ারত করেই যাবে।

লাবিবাকে দেখা মাত্র অন্তু দৌড়ানো বাদ দিয়ে কোলে উঠে বুকের উপর মাথা ছেড়ে দিয়েছে। একটু আগেই রতনের চুল টেনে ছিঁড়ে দিয়েছে। আর এখন লাবিবার বুকের সাথে মিশে আছে। শান্তশিষ্ট এই ছেলেকে দেখে কে বিশ্বাস করবে একটু আগে বড় ভাইয়ের চোখের জল বের করিয়ে ছেড়েছে? অন্তুর নানী এরমধ্যেই চিল্লাপাল্লা করে উঠে। মহিলা মাজার সংলগ্ন খালে গিয়েছে হাত মুখ ধুতে। তার পা নাকি কে টেনে ধরেছে। একে একে লোক জড়ো হয় ঘাটে। মহিলা ভীষন ভয় পেয়েছে। আনোয়ারের নির্দেশে খালপাড়ের মাঝিরা কিছুদূর পর্যন্ত জাল ফেলে খালে। নানান মানুষ নানান আজগুবি গল্প বলা শুরু করে। লাবিবার ফ্যামিলি অবশ্য এসব বিশ্বাস করে না। আশ্চার্য কিছু না পেলেও মাঝিরা বিশাল বড় একটা গজার মাছ পায়। তাদের ধারণা এই গজার মাছ ই বয়স্ক মহিলার পা টেনে ধরেছে। আনোয়ার মাছটা মাঝিদের নিকট কিনে নেয়। বাড়ি ফিরে তিন জা লেগে পড়ে মাছটা কাটতে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় রাতে এই মাছ ভাত খাওয়া হবে। আত্মীয়দের ফিরে যেতে দেওয়া হয়না। লাবিবাও ভাই বোনদের সাথে থেকে যায়। রাতে সবাই ছাদে গোল হয়ে বসে গজার মাছ দিয়ে ভাত খেতে। লাবিবার ফোন ছোট্ট ভাতিজির হাতে। টকিং টমের সাথে কথা বলছে আর খিল খিল করে হাসছে। এর ই মধ্যে কল আসে। দৌড়ে এসে লাবিবার কোলে ফোন রাখে।
‘ পিপি পোন দিচে। পোন। ঐত। ‘
লাবিবার একহাতে প্লেট আরেক হাত দিয়ে খাচ্ছে। স্কিনে দেখলো ‘ খান সাহেব ‘ নামটা ভাসছে। লাবিবা খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। ফোন তুললো না। আজ পাঁচদিন থেকেই তানভীরের কল রিসিভ করছে না। টেক্সেটের ও রিপ্লাই দিচ্ছে না। সাতদিনের জায়গায় আজ বারোদিন হতে চললো। সাহেবের কাজ শেষ হচ্ছে না। ফিরোজ খানের থেকে অবশ্য লাবিবা শুনেছে সেখানে একটা বিজনেসের পারপাসে গিয়ে আরেকটা বিজনেসে হাত বাড়িয়েছে তানভীর। খানদের কিসের বিজনেস জানতে চাইলে সম্পূর্ণ এড়িয়ে যান ফিরোজ খান। অন্য বিষয় নিয়ে কথা বলে ফোন রাখেন। লাবিবা বুঝ পায়না সে কি ছোট এখনো যে কিসের বিজনেস নাম বললে চিনবেনা? শুধু এইটা জানে খানদের তিনটা জাহাজ আছে চলমান।
ফোন বেজে লাইট অফ হয়ে গেলেও যখন লাবিবা খাওয়া বন্ধ করে তুলছে না তখন পিচ্চি প্রসস্ত হেসে ফোন হাতে নিয়ে দৌড় দেয়। একদৌড়ে তাদের আড্ডাখানায় এসে যোগ দেয়।

রাতে লাবিবা বাসায় ফিরে আসে। আনোয়ারদের বাসায় এতো মেহমান তাই জায়গা হয়না। উল্টো অন্তুর দুই মামা মামী লাবিবাদের বাসায় থাকতে চলে আসে।

তানভীর এগারোটা নাগাদ ইসমাইলকে কল করে। বিদেশী নাম্বার দেখে ইসমাইল চওড়া হাসে। রিসিভ করে কানে ধরতেই তানভীর আগে সালাম দেয়। পর পর কুশলাদি জিজ্ঞেস করে। তানভীর জিজ্ঞেস করে লাবিবা কোথায়? কি করছে? পড়াশোনা করছে তো ঠিকঠাক? ব্যাস এর বাইরে আর কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারলো না। শ্বশুড়ের ফোনে কল দিয়ে তো আর বউকে চাওয়া যায়না। ব্যাপারটা শ্বশুড়ের কানে যাওয়া মানে বিপত্তি। পরে না আবার বলে বসে তোমার সাথে আমার মেয়ে ভালো নেই। ব্যপারটা উল্টো পথে হাঁটবে তখন। এমনিতেই বড্ড সাধনার বউ তার। শ্বশুড়ের সাথে প্রতিনিয়ত লডাই করে বিয়েটা করতে পেরেছে। তানভীর না বললেও ইসমাইল ঠিক জেনে নিয়েছে মেয়ে তার জামাইয়ের সাথে অভিমান করে বসে আছে। ইসমাইল অবশ্য কিছু বলেনি। একটু মুচকি হেসেছে। একজন পুরুষ মানুষ ই জানে আরেকজন পুরুষ কাজের চাপে পড়েও বাড়ি ফেরার কতো তাড়া নিয়ে‌ থাকে।

ইসমাইল লাবিবাকে নিজের রুমে ডাকে। লাবিবা আলমন্ড চিবুতে চিবুতে গিয়ে ধপ করে ইসমাইলের পাশে বসে পড়ে। ইসমাইল জিজ্ঞেস করে, ‘ মুখে কি?’
লাবিবা হাত মেলে দেয়। হাত ভর্তি আলমন্ড আর কার্গো । ইসমাইল কিছু নিয়ে মুখে পুড়ে।
‘ তানভীরের সাথে কথা হয়?’
লাবিবা চিবুনো অফ করে ইসমাইলের দিকে তাকায়। দৃষ্টি নামিয়ে ঢোক গিলে মুখের আলমন্ড যতটুকু যায় গিলে নেয়।
‘ কথা হবে না কেনো? হয় তো। ‘
দাহা মিথ্যা কথা। ইসমাইল মনে মনে হাসেন। মেয়ে তার মিথ্যা বলতে পারেনা জানে তাও মিথ্যা বলতে আসে। এইযে বলার সময় গলাটা কেমন কেঁপে উঠলো। লাবিবা আড় চোখে ইসমাইলের দিকে তাকায়। ইসমাইলের চোখে মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। এই হাসিটা শুধু এই মুহূর্তে নয়। যখনি লাবিবা তাকায় তখনই দেখে আলাদা একটা উজ্জলতা তার বাবার মুখে আজকাল দেখা মিলে। লাবিবার বিয়ের পর থেকেই এরকম। ইসমাইল বরাবরই মেয়ের সাথে বিশেষ কোন কারণ ছাড়া নরম। কিন্তু। তবুও মনে হতো গম্ভীর প্রকৃতির লোক। কিসের যেনো ভাবনা,কিসের যেনো দুশ্চিন্তা অস্থিরতা থেকেই যেতো। কিন্তু এখন সেসবের রেশ নেই। যে কেউ দেখে বলবে এই মানুষটার মতো সুখী মানুষ দুটো নেই। লাবিবাকে বিয়ে দিয়েই কি এসবের গোড়াপত্তন হয়েছে। খান সাহেব কে নিয়ে সবাই কত হেপি। শুধু হেপি হতে পারছেনা লাবিবা নিজে। এই লোকটার শুরু থেকেই ছাড় ছাড় ভাব। কিন্তু যখন কাছে আসে একাকী সময়গুলো ভুলিয়ে দেয়। আবার শুরু হয় অপেক্ষা। বিয়ে করে লাবিবা যাও ভেবেছিলো এবার আর খানসাহেবের থেকে আলাদা হবে না, সেইতো খান সাহেব হাজার হাজার মাইল দূরে। লাবিবা হাতের নাটস গুলো শেষ করলো। পানি খেয়ে ইসমাইলের উদ্দেশ্যে বললো, ‘ আব্বু। আমি খান বাড়িতে যেতে চাই। ‘
ইসমাইল মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
‘ আচ্ছা। আমি সময় করে নিয়ে ঘুরিয়ে আনবো। ‘
‘ আব্বু আমি থাকার জন্য যেতে চাই। ‘
ইসমাইলের মুখটা সাথে সাথে শুকিয়ে যায়। আপত্তি সুর টানে।
‘ তানভীর আসুক। এখনি গিয়ে কি করবে?না না আমি ছাড়ছিনা। যাওয়ার দরকার নেই। ‘
‘ আমি এখানে থাকবো না। ‘
‘ জেদ করে না মা। তানভীর আসুক নিয়ে যাবে তোমাকে। ‘
‘ চলেই তো আসবে। আমি আগেই যাই। আগে গেলে ভালো হয় একটু ‌। কিছু কাজ ও আছে গুছিয়ে রাখতে পারবো। ‘
ইসমাইল দ্বিধায় পড়ে যায়। মেয়ের জেদের কাছে পরাজিত হয়ে পারমিশন দেয়। নিজে গিয়ে রেখে আসবে জানায়। সোহানা ইসলাম শোনা মাত্রই লাবিবার গাড়ি পাঠিয়ে দেয়। আউটগোয়িং লাবিবার জন্য আলাদা গাড়ি লঞ্চ করা হয়েছে। ইসমাইল ও সাথে আসে মেয়ের। সাবিনা আসার সময় একটু কান্নাকাটি করে ঠিক কিন্তু লাবিবার মনটা বড় উচাটন। মাকে শান্ত করেই এসে পা রাখে খান বাড়িতে। সোহানা ছেলের বউকে দেখা মাত্রই জড়িয়ে ধরে। ঠোঁটের কোণ থেকে হাসি সরে না। রোজীর কথা জিজ্ঞেস করতেই বলে বাপের বাড়িতে গিয়েছে পরশু। লাবিবা আসার নাম শুনেই জানায় আগামীকাল চলে আসবে। সোহানা লাবিবার প্রতি ভীষণ সন্তুষ্ট হলেও রোজীকে নিয়ে টেনশন অনুভব করে ‌ । ছোট ছেলেটাকে তো লাবিবা আয়ত্ত করে নিয়েছে। দুজনে এখন চুটিয়ে সংসার করবে। রোজী কি পারবে তার বড় ছেলেটাকে ভালো রাখতে? এই মেয়ের তো নিজের ই ঠিক ঠিকানা নেই। কতো বার সাবধান করলো কতো বোঝালো যে তামিমকে ছাড়া যেনো না থাকে। আর সে বাপের বাড়ির মোহ ই ছাড়তে পারছে না। কবে ছেলেটাকে নিয়ে চিন্তা মুক্ত হবে কে জানে?
লাবিবার লাগেজ টানছে জবেদা। লাবিবা খেয়াল করে জবেদা তার দিকে একটু পর পর তাকাচ্ছে আর মিটি মিটি হাসছে। লাবিবা জিজ্ঞেস করে, ‘ তুমি কিছু বলবে? বলে ফেলো। এভাবে হেসে আমাকে অসস্তিতে ফেলো না প্লিজ। ‘
‘ আপনে হইলেন এই বাড়ির ছোট বউ। এই বাড়ি ঘর এখন আপনের। ভাইজান থাক বা না থাক আপনের বাড়ি আপনে থাকবেন নাতো কি ভুত প্রেত্নী থাকবো? আমি ভাবছিলাম বড়বউ মতো আপনে উদাসীন। কিন্তু না। এইটা আমি বুঝে গেছি। আপনে হইলেন এই বাড়ির আসল লক্ষী। নয়তো কি ভাইজানের না থাকনেও আপনি থাকতে চলে আসতেন? ‘
‘ তোমাদের বড়বউ ও কাল চলে আসবে দেখো। আমি ছিলামনা লোনলি ফিল করছিলো তাই চলে গেছে। আমি চলে এসেছি এখন আপুও চলে আসবে। ‘
‘ কেন? আমিতো আছি বাড়িতে। ‘
লাবিবা এখন কি বলবে? কথায় কথা বাড়বে তাই রুমে ঢুকে সোজা ফ্রেশ হতে চলে যায়। বেরিয়ে দেখে জবেদা চলে গেছে। লাবিবা পা বাড়িয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। রুমের চারিদিকে চোখ বুলায়। যাবার সময় যেভাবে গুছিয়ে রেখে গেছে ঠিক ঐরকমি আছে। দৌড়ে গিয়ে নরম বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। চাদর খামচে ধরে ঘ্রাণ নেয়। এইতো সেই ঘ্রাণ। লাবিবার একমাত্র ব্যক্তিগত পুরুষের। কতোটা দিন এই ঘ্রাণ না পেয়ে ছটফট করে গেছে। লাবিবার অশান্ত মন অনেকটাই শান্ত হয়ে আসে। নিজের মস্তিষ্ককে বোঝায় এইতো খান সাহেব তার পাশেই আছে।

চলবে _____
®লাবিবা তানহা এলিজা