#ভালোবাসার কাব্য গাঁথবো
(৮৪)
ভোর বেলা ছাদে কাপড় নাড়তে এসে রোজীর চোখে পড়লো লাবিবাকে। বেচারি একটু পর পর হাঁচি দিচ্ছে আর কাপড় মেলছে। বালতি হাতে দাঁড়িয়ে লাবিবার দিকে তাকিয়ে আছে রোজী। এই প্রথম তার এতো সকালে ছাদে আসা। তাও সদ্য স্নান অবস্থায়। লাবিবার রোজীকে দেখে বিনয়ের হাসি হাসলো। হাত বাড়ালো।
‘ দাও আমি নেড়ে দিচ্ছি কাপড়। ‘
‘ আমি পারবো। ‘
‘ শরীর ভালো তোমার?’
রোজী মাথা নাড়ালো। শরীর ভালো। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে কাপড় নাড়লো। উপরে হাত বাড়াতেই শাড়ির আঁচল হাত থেকে খসে পড়লো। অর্ধ খোলা পিঠে স্পষ্টত দৃশ্যমান হলো ভালোবাসার গুটি কয়েক চিহ্ন। লাবিবা দেখে মুখ টিপে হাসলো। রোজী জানতে চাইলো, ‘ হাসছো কেনো? ‘
‘ আমার কাছে স্টিচের ফুল নেক ব্লাউজ আছে। তুমি কয়েকটা নিও। ‘
‘ কেনো?’
লাবিবা এবার হো হো করে হেসে দিলো। রোজী পিঠে হাত রাখলো। ছোঁয়া পেতেই জায়গায় জ্বলে উঠলো। সাথে সাথে কাঁধে আঁচল টেনে নিলো। রোজীর ইচ্ছে করছে এই ছাদ মাটি হয়ে যাক আর সেই মাটি ভেদ করে সে পাতালপুরীতে ঢুকে যাক। লজ্জায় চোখ বন্ধ করে রইলো। মিছেমিছি ধমকালো, ‘ হেসোনা। চুপ থাকো।’
‘ আপু লজ্জা পাচ্ছ?’
‘ তুমি লজ্জা করো। বড় ঝা হই তোমার।’
লাবিবা আরো জোরে হাসতে লাগলো। রোজী কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলো। এভাবে কেউ লজ্জা দেয়? দমলো না। কান মলে দিলো।
‘ এই দেবরের বউ চুপ থাকো। ‘
‘ এই ভাসুরের বউ ভাসুর আমাদের না বলেই কেনো তোমাকে এতো আদর দিলো?’
‘ আশ্চার্য! বলে কয়ে কেউ আদর দেয়? ‘
‘ দেয়। ‘
রোজী ঝটপট কাপড় মেলে দিয়ে বালতি হাতে পালানোর চেষ্টা করলো। লাবিবার সামনে আর পরা যাবে না। মেয়েটা মজা নিচ্ছে রিতীমতো।
‘ পালাচ্ছো? ‘
‘ লজ্জা নেই একটুও না? নিজের বেলা কি? একটা দিন সকালে গোছল না দিয়ে থাকতে পেরেছো?’
‘ আজ থেকে তুমিও পারবেনা। মিলিয়ে নিও। ‘
রোজী ছুটতে গিয়ে শ্বশুড়ের সামনে পড়লো। ভারী বেজ্জতি হতে হচ্ছে তাকে। ফিরোজ খান রোজীকে দেখে স্নেহের সাথে মাথায় হাত রাখলো। রোজী কোন মতে বললো, ‘ গুড মর্নিং পাপা। ‘
‘ গুড মর্নিং মা। ধীরে হাটবে। শরীর দুর্বল আছে তোমার। মাথা ঘুরায়?’
‘ সময়ে। সব সময় না। ‘
‘ নিজের প্রতি খেয়াল রাখো। ‘
‘ জি আচ্ছা। ‘
তামিম দুপুরে বাসায় ফিরলো। সবার সাথে লাঞ্চ সারলো। বাবা ছেলেদের আলাপনে বোঝা গেলো রাজনৈতিক বিষয়ে কথা হচ্ছে। নির্বাচনের কিছু মাস আছে আর। লাবিবা রুমে এসে পড়তে বসলো। তানভীর থাকলে সে মোটেই পড়তে পারে না। বই সামনে রেখে ফ্যালফ্যাল করে তানভীরের দিকে তাকিয়ে থাকে। যেনো না তাকালে তার চোখ জ্বলে যাবে। গরম ধোঁয়া বেরোবে। তানভীর বকা দিলেও শুনে না। তার তানভীরকে দেখতে ভালো লাগে। মনোযোগ দিয়ে পড়ার সময় তানভীর রুমে এলো। দরজা চাপিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। শেষ। লাবিবার পড়া এখানেই শেষ হলো। চুপ থাকতে দেখে তানভীর বললো,
‘ পড়ো। ‘
‘ আরো শক্ত করে ধরুন। ‘
তানভীর বাঁধন টাইট করলো। মুখ গুঁজে রইলো কাঁধের উপর।
‘ পেছনেই আছি। সামনে যাচ্ছিনা। এবার পড়ো। ‘
লাবিবা খুশি মনে পড়তে লাগলো। পরিক্ষার ডেট এগিয়ে আসছে। ফাইনাল ইয়ার টা শেষ হলে সে বাঁচে। মাস্টার্সের কথা পরে ভাববে। বিয়ের পর পড়াশোনা তার আকাশে উড়ে। আগেই জানা ছিলো তাই হবে। বড় ঘরে বিয়ে হয়েছে। এখানে কুটোটা ছিড়ে দু ভাগ না করলে কেউ বলেনা। সপ্তাহে সপ্তাহে জমা ময়লা কাপড় পর্যন্ত ধুতে হয়না। শুধু খাও আর বসে থাকো। বাপের বাড়ির মতোই । পড়াশোনা করার প্রচুর সময়। রেজাল্ট খারাপ হলে সবাই বলবে এতো সুযোগ পাওয়ার পরেও পারলেনা? কিন্তু সবার জানা এক নয়। লাবিবার যে বড় দায়িত্ব পালন করতে হয় তা কাউকে বলতে পারবে না। পুরো আগাগোড়া একজন স্বামীকে সামলাতে হয়। তার প্রত্যেকটা কাজ খাওয়া থেকে শুরু করে জুতো পর্যন্ত তাকে পরিয়ে থাকতে হয়। যতক্ষন বাইরে থাকে তাকে নিয়ে টেনশন কাজ করে। বাড়ি ফিরলেই তার দফা রফা হয়।
তানভীরের ফোনে কল এলো। লাবিবা দেখে বললো,
‘ আব্বু। ‘
‘ কথা বলো। ‘
লাবিবা আব্বু বলতেই ইসমাইল বললো, ‘ তানভীর কোথায়?’
‘ এখানেই। ‘
‘ ওকে বলে দিও সময় করে যেনো আমার সাথে দেখা করে। কথা আছে। ‘
‘ কি ব্যাপারে?’
‘ আগে আলোচনা টা সারি তারপর বলছি। ‘
‘ আচ্ছা আব্বু। ‘
লাবিবা জানতে চাইলো তানভীরের কাছে, ‘ কোনো প্রব্লেম হয়েছে? ‘ তানভীর মাথা নাড়ালো। না কোনো প্রব্লেম হয়নি।
বাড়ির কাজ মোটামুটি শেষের পর্যায়। ছাদ সহ দেয়াল তুলা শেষ। দুতলার উপর বড় ছাদঘর। ছাদের উপর হরেক রকম গাছ। তানভীর আগেই এনে রেখেছে। গাছ বড় হয়ে ফুল দিতেও সময় লাগে। লাবিবার ছাদ বাগানের কথা মাথায় রেখেই এই কাজ। ইন্টেরিয়র সাজানো লাবিবার হাতে। তার যেভাবে পছন্দ সে সেভাবে করে নিবে। গেইট করাও শেষ। আজ বাড়ির নাম খোদাই করা হবে। এতোদিন ইসমাইল তানভীরকে ডাকলেও তানভীর আসলো আজ। বাড়ির নাম খোদাই করার সময়। ইসমাইল এজন্য বেশ বিরক্ত। জামাই কেনো কথা শুনবেনা? জামাই বড্ড অবাধ্যতা করছে। এরকম অবাধ্য জামাই ইসমাইল মোটেই পছন্দ করছেনা। তানভীর ইসমাইলের সামনে দাঁড়িয়ে বিনয়ের হাসি হাসলো।
‘ আব্বু ভালো আছেন?’
‘ না। ‘ ইসমাইলের সোজাসুজি উত্তর। তানভীর সামনে থেকে পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। একেবারে সমানে সমান। তাকালো রুচিসম্পন্ন ডিজাইনের বাড়িটির দিকে। ইসমাইল জিজ্ঞেস করলো, ‘ কথা কেনো শুনছো না? একাউন্টে টাকা ট্রান্সফার করে দিয়েছো কেনো?’
‘ আমিই দিলাম আব্বু। ‘
‘ কেনো আমি দিলে কি প্রব্লেম? ‘
‘ আমার আবদার রাখবেন না আপনি? ‘
ইসমাইল হাঁসফাঁস করলো। জামাইয়ের টাকায় করা বাড়িতে থাকবে লোকে শুনলে কি বলবে? তানভীরের কাঁধে হাত রাখলো, ‘ দেখো আব্বা বাড়িটা করা আমার সপ্ন ছিলো। আমি আমার মেয়ে, জামাই নাতি নাতনীকে নিয়ে নিজের করা বাড়িতে শেষ বয়সে থেকে যাওয়ার সপ্ন দেখেছি। তুমি না বললে হয়তো আরো পরে কাজ ধরতাম। কিন্তু ধরতাম। ‘
‘ যেদিন আপনার মেয়েকে বিয়ে করবো ঠিক করেছি আপনার যাবতীয় সব পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে খোঁজ নিয়েই এগিয়েছি। আমি চেয়েছিলাম আমি একটা বাড়ি বানাবো। বাড়িটা হবে আপনার মেয়ের নামে। বাড়ির জমিটা থাকবে আপনার আর বাড়িটা আমার। যাতে আপনি না বলতে পারেন যে আপনি থাকবেন না আমাদের সাথে। আত্মসম্মান দেখিয়ে যেনো গ্ৰামেই না থেকে যাওয়ার জেদ করে বসেন। এতে আমাদেরো টেনশন কমবেনা আপনারাও একা পড়ে যাবেন। আমিও শ্বশুড়শাশুড়ির রেগুলার আদর থেকে বঞ্ছিত থাকবো। আম্মুর রান্নাটা কিন্তু বেশ করে আব্বু। চিংড়ি আর গরুর মাংসের স্বাদটা আমার মুখে লেগে থাকে। ভুলতেই পারিনা। ‘
ইসমাইল কথা বললো না। তানভীরের হাত নাড়িয়ে কথা বলার দিকে তাকিয়ে রইলো। প্রথমে যে রাগের সাথে কথা বলছিলো এখন আর সেই রাগ নেই। কারণ পেছন থেকে তার পেট জড়িয়ে আছে কোমল দুটো হাত। তার সত্ত্বা। তার অস্তিত্ত্ব। তানভীর আড় চোখে একবার দেখে নিলো। পিঠে নাক ঢুবিয়ে লেপ্টে দাঁড়িয়ে আছে। তানভীরের মনে হলো টিংটিং এ নাকটা না আবার বেঁকে যায়। মেয়েটা ভীষন আদুরে। বড়ই করেছে তাকে এইভাবে। শ্বশুড়ের ঘরের রাজকুমারী আজ তার ঘরের রাণী। মিস্ত্রী হাঁকলো, ‘ স্যার নাম কি ঠিক করলেন? বলেন খোদাই করবো। ‘
লাবিবা বাবার মুখের দিকে তাকালো। ইসমাইল তাকালো তানভীরের দিকে। তানভীর লাবিবার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ রাণী মহল। ‘
রোজী অনেকটাই সুস্থ এখন। তামিমের যত্নে মানসিকভাবেও সে পুরোপুরি সুস্থ। স্বামীর প্রতি আহ্লাদে আটখানা। তামিম রোজীকে আবার স্কুলে যাওয়ার পারমিশন দিয়েছে। সে প্রতিদিন স্কুলে যাতায়াত করে। তামিম ব্যস্ত থাকলে কখনো লাবিবা কখনো তানভীর কখনো সোহানা দিয়ে আসে আবার নিয়েও আসে। একা ছাড়ে না কখনো রোজীকে। সোহানা এখনো রোজীর প্রতি তেমন ভালোবাসা প্রকাশ করেনা। হয়তো আর করা হবেও না। তবে স্নেহ করে। রোজীও শ্বাশুড়ি ভক্ত। মায়ের অভাব তার শ্বাশুড়িই পূরণ করে। হয়তো কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে নেয়না। কিন্তু এতে রোজীর মনে আর কষ্ট নেই। তামিম ব্যবসা হাসপাতাল নিয়ে ভীষন ব্যস্ত। কখনো কখনো ফিরে রাতে গভীর রাতে। রোজীকে সময় দিতে পারেনা। কিন্তু কাজের ফাঁকে সময় বের করে ঠিকই একান্তে সময় কাটায়। তামিমের মতে সম্পর্ক সুন্দর করে দেয় একমাত্র সময়। যত সময় দিবে দুজন দুজনকে ততো গভীর হবে। রোজী নিজের অবস্থান চিন্তা করলে মাঝে মাঝে ভীষণ আবেগী হয়ে উঠে। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে এতো সুখ তার কপালে সইবেতো?
রেসপন্স এতো কমে যাচ্ছে কেনো? পাঠকগন তোমরা কেনো রেসপন্স করতে আলসেমি করো ?🥹
চলবে___
@লাবিবা তানহা এলিজা
#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো
(৮৫)
সিড়ির উপর থেকে লাবিবা ডাকে।
‘ আপু কি করো?’
রোজী তখন হাতে আটা মাখছে। রান্নাটা সে সোহানার সাথেই করে। সোহানা বারণ করলেও ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। এভাবে দেখতে দেখতে যখন সোহানা বিরক্ত হয়ে একদিন জুস বানাতে বলে। তারপর থেকে রোজী সোহানার সাথে রান্নায় হেল্প করে। কখনৈ কখনো একাই রান্না করে। রোজীর হাত রান্নায় বেশ পাকা। স্বাদেও সুস্বাদু। সোহানা সেজন্য আত্বীয়দের থেকে বেশ প্রসংসা কুড়োয়। এমন রান্না জানা বউ ভাগ্য করে পেয়েছে সে। রোজী মাথা তুলে তাকায়।
‘ ওখানে কি নিচে এসো? ‘
লাবিবা আসার সময়টুকু রোজী তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। আটপৌরে করে গাঢ় কালারের শাড়ি পরে লাবিবা। ঠিক যেনো বাঙাল বাড়ির বউ। দুহাত ভর্তি চুড়ি পরে সেজেগুজে সামনে দিয়ে ঘুর ঘুর করে। তানভীরের আবদার। এই সাজে নাকি লাবিবাকে ভীষন সুন্দর লাগে। বাড়ি থাকা কালীন এভাবেই সেজে গুঁজে থাকতে হবে আর তানভীর দেখে দেখে এক সমুদ্র তৃষ্ণা মেটাবে। লাবিবা যত এগিয়ে আসে ছম ছম মৃদু ঝংকার তুলে। চুড়ির শব্দ নয়। অন্যকিছুর। রোজী জিজ্ঞেস করে,
‘ পায়েল পড়েছো? দেখি?’
রোজীর কথায় তানভীর ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। উল্টোপাশের সোফায় বসে পাপার কিছু ফাইল ঘাঁটাঘাঁটি করছিলো। লাবিবা পেছন ঘুরতেই চোখা চোখি হয়ে গেলো। লাবিবা স্মিত হাসলো। রোজীর পাশে বসে পা দুটো সেন্টার ঠেবিলের উপর তুলে দিলো। হাটুর উপর তাতের সুতি শাড়ি খামচে ধরতেই পা জোড়া বেরিয়ে এলো। হলুদাভ পা জোড়ায় পার্ল আর এন্টিকের তৈরী চওড়া এঙ্কলেট। পা জোড়ার সৌন্দর্য বাড়িয়েছে তিনগুণ। তানভীর দৃষ্টি রেখেই ঢুক গিললো। বউয়ের চকচকে পা জোড়া তাকে ভীষন ভাবে টানছে। ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করলো একবার। লাবিবার প্রত্যেকটা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ তানভীরের দুর্বলতা। এই মেয়ে পুরোটাই একটা নেশা। যতবার তানভীর মুগ্ধ হয় ততবার আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করতে ভুলে না। আল্লাহ ই তো দিলো তাকে ‘ সোনার বরন কইন্যা। ‘
লাবিবা খিলখিল করে হেসে উঠলো। রোজী মুখ চেপে ধরলো। লজ্জাও পেলো। যেখানে যেখানে এদের প্রেম চলে। কোনো মতে বললো, ‘ ভাইয়া দিয়েছে?অনেক সুন্দর হয়েছে। যাও ভাইয়ার কাছে। ‘ তানভীর বেকুব বনে গেলো। এতো জেরে সে কথা বলেছে? তানভীর ডেকে বললো,
‘ ভাবী তোমার হাতে এককাপ কফি চাই। ‘
‘ রুমে যান পাঠিয়ে দিবো। ‘
তানভীর উঠে দাঁড়ালো। রোজীর দিকে এগিয়ে এলো।
‘ তুমি আমাকে কি ভাবো?’
রোজীর চোখ উপরে।
‘ কি ভাববো?’
তানভীর রোজীর সামনেই লাবিবাকে পাজাঁকোলে তুলে নিলো। লাবিবা গলা আকড়ে ধরলো। চিৎকার করলো,
‘ কি করছেন? ড্রয়িংরুমে আমরা।কেউ দেখে ফেলবে। ‘
‘ বাড়িতে কেউ নেই। ‘
লাবিবা রোজীর দিকে তাকালো। ততোক্ষনে তানভীর লাবিবাকে কোলে বসিয়েছে সোফাতে। রোজী মাথা নিচু করে আটার বোল তুলে নিলো।
‘ রোজ আপুকে আপনি দেখতে পাচ্ছেন না?’
‘ ভাবীর অপর নাম অদৃশ্য ব্যাক্তি। ‘
এই ভাবী সুপার ভাবী নয়। ভীষন লাজুক আর চুপচাপ। সে তাড়াতাড়ি সরে পড়লো। ফিরলো কফির কাপ হাতে। মুখটাকে একদম নিচু রেখেছে। একদমি তাকাবেনা সে দুষ্টু দুটোর দিকে। তানভীর রোজীর দিকে হাত বাড়িয়ে মিটি মিটি হাসছে। গলা খাঁকারি দিয়ে বললো, ‘ ভাবী। আমি জানি আমার ভাই তেল মসলা দিয়ে ফ্রাই ভালোই করতে পারে। এতো লজ্জা পাবার কিছু নেই। তাকাও। ‘
রোজী তানভীরের কথায় আরো লজ্জা পেয়ে গেলো। ঠোঁট কাটা দেবর তার। লাবিবা জিজ্ঞেস করল,
‘ ভাইয়া রান্না পারে?’
চট করে লাবিবার দিকে রোজী তাকালো। তানভীরও তাকালো। দুজনে এমন দৃষ্টি ফেললো যে লাবিবা দুজনের মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলো । রোজী এবং তানভীর একসাথে হেসে ফেললো। লাবিবা মাথা খাটালো। বুঝতে পেরেই লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো। রোজী হাসি থামিয়ে নিজের রুমের দিকে ছুট দিলো। চোখের আড়াল হতেই তানভীর লাবিবাকে সোফায় ফেলে সরে বসলো। লাবিবার উম্মুক্ত কোমড়ে হালকা লাগলো। ব্যথা পেয়ে তানভীরের উপর কিঞ্চিত মিথ্যা রাগ দেখালো।
‘ আপনি আপুকেও ছাড় লেন না? ‘
তানভীর এঙ্কলেটের উপর ততক্ষনে গাঢ় চুমু বসিয়েছে। কোমল পা জোড়ায় ছোট ছোট চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছে। এঙ্কলেট জোড়া খুলতে খুলতে লাবিবার মুখের দিকে তাকায়। শরীরে যা হয় তা কি ঐ গোলগাল মুখখানায় ভেসে উঠে? এইযে লাজুকতায় ছেয়ে গেছে পুরোটা।
‘ ছাড়লাম তো। কিন্তু সুন্দরী তোমাকে ছাড়ছিনা। ‘
লাবিবা চোখ বন্ধ করে নিলো। কিভাবে প্রশংসা করে লোকটা লজ্জায় ফেলে। তানভীর সেই লজ্জার আভা দেখতে দেখতেই পায়ের আঙুলে চুমু দিলো। লাবিবা মাথা তুলে তাকাতেই বুড়ো আঙুলটা মুখে পুড়ো নিলো। লাবিবাকে ঘায়েল করার এর থেকে কার্যকরী অস্ত্র আর নেই বললেই চলে। একের পর এক আঙুল শুষে নিতে লাগলো।থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে লাবিবা বাঁধা দেবার চেষ্টা করলো।
‘ না। খান সাহেব এখন সকাল বেলা। ‘
তানভীর মোটেই শুনলো না।
‘ বউয়ের ব্যাপারে আমি কোনো সময় জ্ঞান মানতে রাজি না। ‘
লাবিবার সারাদিন কাটে ঘোরের মাঝে। মাথা ব্যাথার ট্যাবলেট তার নিত্যদিনের সঙ্গী। সারারাত না ঘুমিয়ে শরীরটা মাতলাম মাতলাম লাগে। মনে হয় হাই ড্রোজের নেশা দ্রব্য নিয়েছে। তানভীর মোটেই ঘুমোতে দেয়না ঠিকমতো। তার উপর আবার ক্লাস,প্রাইভেট রেগুলার করে করে লাবিবার কোন কিছুই ঠিক নেই। শরীর ঠিক নেই মনটাও ঠিক নেই। তানভীর ভীষন ব্যস্ত। আজকাল তাকে পাওয়াই যায়না। দিনে যতটুকু সময় বাড়ি থাকে ঘুমের মাঝেই সময় চলে যায়। রাতে খুলে তার আদরের ঝুড়ি। এমন এমন কান্ড করে মাঝে মাঝে লাবিবার মনে হয় লোকটা পাগল। আর সে তার এসিস্ট্যান্ট। যতগুলো ডাউনলোড হবে ততোগুলো জুনিয়র পাগল। এতো ভালোবাসার মাঝে লাবিবার সব কথা তাকে বলার সময় ই হয়না। অথচ লাবিবার প্রত্যেকদিনের এ টু জেট গল্প তানভীরের কানের কাছে গিয়ে না বললে তার পেটের ভেতর গুড়গুড়ি শুরু হয়ে যায়। কানের কাছে মুখ নিয়ে সারাদিন এটা করেছে ওটা করেছে টুক টাক বিষয়গুলোও বলতে থাকে। এতো এতো গল্প শুনলে যে কেউ বিরক্ত হয়ে যাবে। তানভীর একটুও বিরক্ত হয়না। লাবিবার গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যায়। বরং তার এই বকবকানি যেদিন না শুনে সেদিনই সে টেনশনে পড়ে যায়। বুঝে যায় তার রাণীর মুড অফ। কি করে মুড ভালো হবে সেই চেষ্টায় লেগে যায়। সিকনেস, টায়ার্ডনেস সব কিছুর সাথে ফাইট করে ফিল্ডে নামতে সে দুবার ভাবে না। তার রাণীর হ্যাপিনেস ই তার হ্যাপিনেস। তার রাণী ভালো থাকলেই সে ভালো থাকবে। এই ব্যপারে কোনো কার্পন্য চলবেনা।
তানভীরের ফোনে কল এলো বিকেল চারটা নাগাদ। লাবিবার কান্নার ধকলে কথা বলতে পারছে না। তানভীরের বুকের ভেতর মৃদু ব্যাথার সঞ্চার ঘটলো। ব্যতিব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘ কি হয়েছে? জান? ব্যাথা পেয়েছো? ঠিক আছো?’
‘ হসপিটালে আসুন। আপু ভালো নেই। ‘
‘ কি হয়েছে ভাবীর?’
‘ পড়ে গিয়ে ব্লিডিং হচ্ছে। ‘
‘ পায়ে চোট লেগেছে ?’
তানভীরের প্রশ্নের উত্তর না করেই লাবিবা ফোনটা কেটে দিয়েছে। চোট তো হাতে পায়ে লেগেছে। ব্লিডিং ও হচ্ছে। সিড়ি থেকে পড়ে গিয়ে চিৎকার দিতেই লাবিবা তাড়াহুড়ো করে এটো হাতেই দৌড়ে গেছে। আয়েশ করে মালাই চপ খাচ্ছিলো সে। ব্লাড দেখে চিৎকার করে সোহানাকে ডাকছিলো। ব্লাডে তার ফোবিয়া আছে। এতো ঘাবড়ে গেছে যে রোজীকে ধরে যে তুলতে হবে সেই হুস টুকুও নেই। সোহানা এসে দেখে রোজী ফ্লোরে আধশোয়া হয়ে আছে। উঠতে চাইছে সে। সোহানা হেল্প করে। উপরে টেনে তুলতে যায়। তখনি তার খেয়ালে আসে রোজী পেট চেপে আছে। সোহানা সাথে সাথেই তার ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলে। তামিম খবর পেয়েই ছুটে এসেছে। লাবিবা তো সোহানার আঁচল ধরে ফুপিয়েই যাচ্ছে। বেচারা ভালোই ঘাবড়ে গেছে।রোজী বেডে আধশোয়া হয়ে আছে। দুটো হাত তামিমের মুঠোতে। একটু আগেই ডাক্তার তামিমকে কি বলেছে বেচারা সেটা হজম করার চেষ্টায় আছে।
‘ ডক্টর তামিম। আমার অভিজ্ঞতা মতে আপনার স্ত্রী কনসিভ করেছে। বাকিটা টেস্ট গুলোর রিপোর্ট এলেই সিউর হবো। পড়ে যাওয়াতে কোনো ক্ষতি না হলেই হয়। আপনার স্ত্রীর পায়েও বেশ চোট লেগেছে। কিছুদিন বেড রেস্টে থাকতে হবে। এবার থেকে দেখেশুনে রাখবেন। আর একা ছাড়বেন না। ঘন ঘন মাথা ঘুরালে এরকম ছোট খাটো এক্সিডেন্ট হবার সম্ভাবনা আছে। ‘
তামিম রোজীর উপর ঝুকলো। কনুই এবং পায়ের ব্যথায় রোজীর মুখটা বিষময় হয়ে আছে। তামিমের চোখ চোখ রেখে নরমাল হবার চেষ্টা করলো। বললো,
‘ একটা পেইন কিলার দিতে বলেন না। ‘
‘ দিয়েছে। ব্যাথা কমে যাবে। আমার রোজ ?’
‘ হু?’
‘ তুমি কি কিছু জানো? ‘
রোজী চুপ থাকলো। ‘ আমি বুঝতে পারিনি। সার্কেল মিস গিয়েছে তো। ‘ বলতে বলতেই রোজীর লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। সাদা গাল দুটোতে লাল লাল আভা ছড়ালো। সেই মুহূর্তে তামিমের বুকের মধ্যে কি ঝড় উঠেছে তা শুধু তামিম ই জানে। রোজীর কপালে ঠোঁট চেপে রইলো। জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় চলে যাবার পর তার জীবনে পা রাখলো তার প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি বয়সের এক নারী। জীবনে কখনো ভেবেছিলো যে তার জীবনে দ্বিতীয় কোনো নারীর আগমন ঘটবে? সেই নারী তাকে ভালোবেসে উপহার দিবে তার অস্তিত্ত্ব? যৌবনে সন্তান লাভের আশা থাকলেও সেতো ভুলেই গিয়েছিলো সেই কথা। মধ্য বয়সে সেই আশা পূরণ হচ্ছে একেবারে তাকে না জানিয়ে। তামিম ফিসফিসিয়ে বললো,
‘ রোজ। তুমি বুঝতে পারছো আমার ভেতরে কি হচ্ছে? আমি ভাবিনি কখনো আমি বুড়ো বয়সে বাবা হবার সুযোগ পাবো। ‘
রোজী কপট রাগ দেখালো,
‘ একদম নিজেকে বুড়ো বলবেন না। আমার বর মোটেই বুড়ো না। বয়সটা একটু আমার থেকে বেশি এই যা। ‘
‘ সত্যিটাতো আর মিথ্যে হয়ে যাবে না। জুলফির চুলে পাক ধরেছে। আমি তো আর লুকিয়ে রাখতে পারবোনা।’
‘ ঐটা ন্যাচারাল কালার। আমার হ্যান্ডসাম , স্টাইলিশ হ্যাজবেন্ডের নিউ লুক। ‘
‘ রোজ আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছি না। এখন যদি একটা চিৎকার করি ভীষন লজ্জাজনক ব্যাপার হবে। আমাকে এসবে মানায় না। ‘
রোজী আবদার জানালো। ‘ আমাকে শক্ত করিয়ে জড়িয়ে ধরুন ডাক্তার সাহেব। একদমি ছাড়বেন না। ‘
রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর সোহানা খান আবেগে কেঁদে উঠলো। চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিলো রোজীর মুখ। বুকে ধরে রাখলো। যেনো ছাড়বেই না। কত কত বছরের চাওয়া যে তার পূরণ হলো এই খুশি সে ধরে রাখবে কিভাবে ভেবেই পাচ্ছেনা। তার বয়সের মানুষের নাতি নাতনি বিবাহ যোগ্যা হয়ে উঠছে অনেকের। সে ছেলেদের বউ, নাতী নাতনী দেখার জন্য কতো যে আল্লাহর কাছে কেঁদে কেটে ভাসিয়েছে সেই জানে। আল্লাহ কবুল করেছে। ভাই বোন ভাগনীকে ফোন করে এই সুখবর দিচ্ছে আর ফুপিয়ে উঠছে। মামা শ্বশুড়ের পরিবার এসেছে। হসপিটালেই তাদের উৎসব শুরু হয়েছে। ফিরোজ খান বেরিয়ে গিয়েছিলেন শোনামাত্রই ড্রাইভারকে মিষ্টি আনতে বলতে। ডায়বেটিক এর রোগী হলে কি হবে আজ বিনা বাঁধায় প্রত্যেকেই চার পাঁচ টা করে মিষ্টি খেয়ে নিয়েছে। একদিন একটু পয়েন্ট বাড়ুক। সমস্যা না মনে করলে সমস্যা নাই তাতে। লাবিবা চোখে চোখে রোজীকে একবার কনগ্ৰাচুলেশন জানিয়ে চুপচাপ প্রত্যেকের খুশির সাক্ষী হচ্ছে। তার মনের ভেতর চলছে চিন্তার রেলগাড়ি। তানভীরকে ফোন দিয়েছিলো বিকেলে। এখন রাত এগারোটা বাজতে চললো। এখনো আসার নাম নেই। কোনো কিছু হলোনাতো? ফোনটাও তো নেই সাথে। তামিমের হাতে দিয়েছিলো। বাবা সাহেব এতো মানুষের ভিড় থেকে লজ্জায় ঠিকই পালিয়েছে চেম্বারের নাম করে। লাবিবা দেখেছে তামিমের চোখে জল। রোজীকে এসে বলেছে,
‘ ভাই মনে হয় কাঁদবে। ‘
রোজী ঠোঁটে আঙুল চেপে লাবিবাকে চুপ করিয়ে দিয়েছে। কাদুক। এটা খুশির কান্না। আড়ালে কাঁদতে চাইলে তাকে কাঁদতে দেওয়া উচিত।
চলবে___
@লাবিবা তানহা এলিজা