#ভালোবাসার কাব্য গাঁথবো
(৮৬)
তানভীর ফিরলো পৌঁনে বারোটা নাগাদ। সকালেই তানভীর বেরিয়েছিলো রংপুরের উদ্দ্যেশ্যে। লাবিবার ফোন পেয়ে কাজটা মোটামুটি গুছিয়েই রওনা দিয়েছে। পৌঁছলো এতো রাতে। এদিকে টেনশনে টেনশনে লাবিবা শেষ হয়ে যাচ্ছিলো। মামাতো ননদকে সাথে নিয়ে ক্যান্টিন থেকে আইসক্রিম নিয়ে এসেছে। টেনশন হলেই তার ক্ষিধে পায়। না খেলে আরো টেনশন বাড়ে সাথে মাথা চক্কর ফ্রি। হসপিটালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দুজনে আইসক্রিম খাচ্ছে। তিনতলায় উঠেই তানভীর লাবিবাকে পেলো। খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আইসক্রিম খাচ্ছে। মাঝে মাঝে ফাহার কথায় দু একটা হু হা উত্তর দিচ্ছে। মুখটা শুকিয়ে গেছে। চোখ দুটো ফোলা। খুশির খবরটা তানভীর রাস্তাতেই পেয়েছে। আইসক্রিম গলে হাত বেয়ে যে জামাতেও লাগছে তাতে রাণী সাহেবার হুস নেই। আইক্রিম খেতে গেলে বাচ্চাদের মতো হাত নোংরা করবেই। যখন চিটচিট করবে তখন ঠিকই নাক ছিটকাবে। তানভীর পকেট থেকে রুমাল বের করলো। দু আঙুল চেপে হাত টেনে রুমাল দিয়ে হাত মুছতে লাগলো। তানভীরকে পেয়ে লাবিবার চিন্তারা দূরে পালালো। শুকনো মুখটায় নিমেষেই প্রাণবন্ত হাসি ফুটে উঠলো। হাত মুছে তানভীর রুমালটা পকেটে পুরলো। লাবিবা একহাত জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো,
‘ আপনি আজ লেট লাবিবা হয়ে গেছেন। জানেন আমাদের বাড়িতে একটা পুচকু আসবে। এই খবরটা দেবার জন্য কখন থেকে অপেক্ষা করছি। ‘
‘ আইসক্রিম টা শেষ করো। ‘
‘ খান সাহেব একটা পুচকু আমাকে দিলে কি হয়? ‘
‘ দ্বিতীয় বার যেনো এই কথা না শুনি। বিয়ে করেই আকাশে উড়ছো। বেবী তো ইমপসিবল। পড়াশোনায় ফোকাস করো। আমার যখন বেবী নেবার সঠিক সময় মনে হবে আমরা ঠিকই বেশী নিবো। ‘
লাবিবা গাল ফুলালো। তানভীরের একহাত বুকের সাথে জড়িয়ে ধরেই হাঁটতে লাগলো। তার রাজ্যের খবর গুলো তানভীরের কানে পই পই করে দিতে লাগলো। তানভীর শুধু মাথা ঝুমিয়ে গেলো।
‘ আপু কনসিভ করলো কিন্তু আপু নিজেই বুজতে পারেনি। এতে আপুর কি দোষ? ভাইয়া তো অবিশ্বাস করে বসলো। যখন আপু সিউর করলো বাচ্চা ছেলেদের মতো কাঁদতে লাগলো। আপুকে অনেক আদর করলো। কিন্তু যখন বাড়ির সবার সামনে হলো কান্না লুকাতে বাইরে চলে গেলো। গেলো তো গেলো আমার ফোনটাও সাথে নিয়ে গেলো। মামুনি আপুকে ভীষন আদর দিলো। মামা এসে হাতে টাকা ধরিয়ে দিলো। পাপা মিষ্টি খাওয়ালো। সবাই কিছু না কিছু দিলো। আমরা কি দিবো? ‘
‘ দিবো কিছু একটা। ‘
‘ আচ্ছা পরে ভাবা যাবে। আমার ভীষণ খুশি লাগছে। আমাকে কেউ মামুনী বলে ডাকবে। ছোট ছোট দুটো হাত দুটো পা দিয়ে সারাবাড়ি ঘুরে বেড়াবে। আমি ভীষণ এক্সাইটেড। ‘
লাবিবার চোখে মুখে হাসি উপচে পড়ছে। যখন ভীষন এক্সাইটেড হয়ে যায় তার মুখ থেকে হাসি সরে না। কথা গুলো জড়িয়ে আসে। ভেতর থেকে বাচ্চা এক লাবিবা বেরিয়ে আসে। করিডোরে দাঁড়িয়ে ফিরোজ খান এবং খইরুল ইসলাম দেখে হাসলো। এতোক্ষন চুপসে ছিলো। যেই তানভীর এলো সেই তার উচ্ছাস ফেটে পড়লো। কথার ঝুড়ি খুলে গেলো। তানভীর হলে লাবিবার কাউকে চাইনা। এই একটা মানুষের মাঝেই সে নিজেকে সপেছে।
রোজীর আর পড়াশোনা হবেনা। একটার পর একটা বাঁধা তার জীবনে লেগেই আছে। তার ক্লাসে যাওয়া আবার বন্ধ। মন খারাপ করে তামিমকে বললো, ‘ আমি একবছর ড্রপ দিয়ে দিচ্ছি। তিনবছরে এইচ এস সি পাস করবো। ‘
‘ সেটা আর হচ্ছেনা। ‘
‘ কেনো? মানুষ কি ড্রপ দেয়না? ‘
‘ তোমার কি মনে হয় সারাজীবন আমি এসব টেনে বেড়াবো? যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই লেখাপড়ার পাঠ চুকাবে। আমি ব্যবস্থা করছি বাসাতেই পড়বে তবুও ইয়ার লস দেওয়া যাবে না। নিজের টাই যদি শেষ না করতে পারো মেয়েকে পড়াবে কখন? মা মেয়ে দুজনকে একসাথে পড়ানোর সময় নেই আমার। আমি মাকেই রেডি করবো তারপর মা তার মেয়েকে। ‘
‘ আপনি কিন্তু দায়িত্ব এড়াবেন না। ‘
‘ চুল পাক ধরেছে। ‘
‘ ঐটা আমি কালার করিয়ে আনবো।’
‘দুদিনে কালার উঠে আবার বুড়োর পতাকা দেখে দিবে।’
‘ খবরদার বুড়ো শব্দটাই উচ্চারণ করবেনা।
‘ এতো তেজ আসে কোথা থেকে? চুপচাপ শুয়ে থাকো।’
রোজী তামিমের হাতটা টেনে আঁচল গলিয়ে খোলা পেটের উপর রাখলো। চোঁখে চোখ রেখে বললো,
‘ এখান থেকে। আমি হতে পারি অতি সাধারণ ,অযোগ্য কিন্তু ফিরোজ খানের বংশধর আমার এই গর্ভে। ‘
তামিম স্তব্দ হয়ে তাকিয়ে রইলো রোজীর চোখে। সেই চোখে জলন্ত আগুন শিখা দাউ দাউ করে জ্বলছে। রোজী বিছানা ছাড়লো। তামিমকে রেখেই ঘর ছাড়ার জন্য পা বাড়ালো। তামিম রোজীকে ডাকলো,
‘ রোজ শোনো। তুমি কি নিজেকে নিয়ে এখনো হীনমন্যতায় ভূগো ? ‘
‘ না। আমি প্রতিনিয়ত আমাকেই আবিষ্কার করি। আপনাকে একটা কথা বলা হয়নি। বাচ্চাটা আমি সেচ্ছায় নিয়েছি। এতো তাড়াহুড়োতে আমার অসুস্ততার মাঝে বলে ভাববেন না আমার বাড়ির কেউ আমাকে এই কাজটা করতে বুদ্ধি দিয়েছে। নিজের বুদ্ধিতেই নিয়েছি। মামুনী শুধু আমার বুদ্ধির জং ছাড়িয়ে দিয়েছে। শ্বাশুড়ি হয়েও আমার মা হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে। আমি আপনার যোগ্য নই ডাক্তার সাহেব। আমার পড়াশোনা নেই, সামর্থ্য নেই যে জন্য আপনি আমার দিকে সমান মনোভাব পোষণ করবেন। আপনার চোখে যে রুপ ধরা দিয়েছিলো তার অর্ধেক ও নেই। শুধু তিন কবুলের জন্য আপনি দায়বদ্ধ হয়ে আছেন। আপনি প্রথম দিকে কাছে আসতেন ঠিক। কিন্তু মাঝরাতে ঠিকই বারান্দায় ধোঁয়াতে আফসোস উড়িয়ে দিতেন। আমি দেখেছি। আমি আপনাকে জানি। আপনাকে বুঝি। ধীরে ধীরে হয়তো আমার প্রতি মানষিক দিক থেকে এটাচ হয়েছেন। তবুও আমার গোড়া নড়বড়ে। আমার ভয় হয়। এই বাচ্চা আপনার আর আমার সেতুবন্ধন। আমাদের সম্পর্কের ভীত মজবুত করতেই আমি তাড়াতাড়ি কনসিভ করেছি। যাতে বাচ্চার জন্য হলেও আপনি আমাকে কোনো দিন ভুলে না যান। ‘
রোজীর কথা শুনে তামিম অবাক হয়ে তাকিয়েই রইলো। রোজী দরজার বাইরে পা বাড়াতেই তামিম তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে এসে রোজীকে ভেতরে এনে দরজা বন্ধ করে ধরলো। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে মাথা নিচু করে চোখে চোখ রাখলো।
‘ তোমার মনে এতো দিন এই চলছিলো ?’
রোজী ঢুক গিললো। চোখ নামিয়ে নিলো।
‘ আমি কোনো অভিনেতা নই রোজ। আমাদের মাঝে তো এসব কথা ছিলো না। আমরা দুজনেই দুজনের কাছাকাছি আসার চেষ্টায় ছিলাম। দুজনেই দুজনকে ভালোবাসার চেষ্টা করেছি। আমি তোমাকে ভালোবাসি রোজ। তুমি বলেছো তুমিও আমাকে ভালোবেসেছো। তাহলে তোমার এতো কেনো ভয়? এতো কেনো মনে কষ্ট পোষে রেখেছো? তুমি আমার থেকে কথা লুকাও রোজ। ‘
রোজী নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলো। চোখের পানিতে গাল ভিজে গেলো। তামিম দুহাতে রোজীর মুখটা উপরে তুললো। বুড়ো আঙুলে রোজীর গাল মুছে দিলো।
‘ বোকা মেয়ে বাচ্চাই যদি সম্পর্কের ভীত গড়তো তাহলে শত শত বাচ্চা ডাস্টবিনে,ম্যানহোলে পড়ে থাকতো না। দু, তিনটে বাচ্চা থাকার পরেও ডিভোর্স হতো না। আবার বাচ্চা জন্ম দিতে অক্ষম দম্পতি বুড়ো বয়সে একসাথে বসে বসে উলের মাফলার বুনতো না।
সম্পর্কের ভীত কয়েকটা শক্তির উপর নির্ভর করে। সারাজীবন একসাথে থাকার প্রচেষ্টা, বিশ্বাস, দুজনের বোঝাপড়া, আর কমফোর্ট জোন। এদের মধ্যে যদি ঊক চিমটি ভালোবাসা ঢেলে দেওয়া হয় তাহলেই সুখের সৃষ্টি হয়। রোজ আমি কি তোমাকে সুখ দিতে পারিনি? তোমার চোখে পানি কেনো? আমি কি তবে ব্যর্থ?’
রোজীর দৃষ্টি শান্ত। একটু পর পর ঠোঁট ভেঙে কান্না আসছে। আবার নিজের মধ্যেই টেনে নিচ্ছে। ফুঁপিয়ে উঠছে সময় নিয়ে একটু পর পর। তামিম রোজীর বুকের ভেতর উম্মাদনা বোঝার চেষ্টা করলো। রোজীকে তামিম আজ শক্ত জবাব দিতে পারতো। তামিমের বুকে যে একটু আগে হোল ফুটিয়ে দিলো মেয়েটা সেই কষ্টের ফিডব্যাক রোজী পেতো যদি আজ সে এই অবস্থায় না থাকতো। তামিম চায়না নিজের রাগ রোজীর উপর ফেলতে। এই অবস্থাতে তো নয়ই। তাতে তার বাচ্চার ই ক্ষতি। রোজীর মনের মধ্যে অনেক ভুল ধারণা আছে। তামিম একটু একটু করে সেই ভুল ধারণা গুলো শুধরে দিয়ে রোজীকে পারফেক্ট করে তুলবে।
‘ আমাকে বলো আমার কোথায় ভুল? না বললে বুঝবো কিভাবে? আমি একবারো তোমাকে ছাড়ার জন্য প্রেশার দেয়নি। একবারো তোমার সামনে নিজের প্রাক্তনের কথা বলিনি। তুমি আমাকে ইনডাইরেক্টলি কাঠগড়ায় তুলে দিয়েছো রোজ। ‘
‘ না। আপনি কিছুই করেন নি। সম্পূর্ণ আমার ভাবনা। আমি নিজেই নিজের প্রতি বিরক্ত। সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকি। যা পেয়েছি তাই আকড়ে ধরার চেষ্টা করি কিন্তু হারিয়ে ফেলি। আমার অতীত ভাগ্যটাই খারাপ। কিন্তু আমার বর্তমান অকল্পনীয় সুখের। আমার সকল সুখের কারণ আপনি। আমি ভয়ে থাকতাম যখন তখন আপনি আমাকে ছুঁড়ে ফেলবেন। সেজন্য নিজেকে লুকিয়ে রাখতাম। কিন্তু না আপনি আমাকে কখনোই আলাদা করবেন না কখন বুঝতে পারলাম জানেন?যখন আপনি আমাকে ফোনে বলেছিলেন , আমার রোজ। দাগহীন ভাবে ফুটে যেদিন সৌন্দর্য ছড়াবে সেদিনই আমি তোমাকে আমার কাছে নিয়ে আসতে যাবো।
আপনি যদি আমাকে এতো ত্রুটি সমেত গ্ৰহন করতে পারেন আমি কেনো দু পা এগোতে পারবোনা? আমি নিজেই এসেছি আপনার কাছে। ভালোবেসেছি আপনাকে। আপনার ভালোবাসায় রাঙিয়েছি নিজেকে। সুখে আছি আপনার সাথে। কিন্তু আমার বড্ড ভয় হয় ডাক্তার সাহেব। আমার সব সুখ ক্ষনস্থায়ী। আমি আপনাকে হারাতে চাইনা। আমি বড্ড অভাগী। ‘
রোজী দুহাতে মুখ চেপে কাঁদতে লাগলো। তামিম বললো, ‘ তাহলে তো তোমার এতো উল্টাপাল্টা চিন্তা ডাস্টবিনে ফেলে আমার প্রতি থ্যাংকফুল থাকা উচিত। আমাকে বেশি বেশি ভালোবাসা উচিত। ‘
রোজী তামিমের বুকে মাথা রেখে গলা জড়িয়ে ধরলো।
‘ আপনাকে অনেক ভালোবাসি ডাক্তার সাহেব। আমার ভীষণ কষ্ট হয়। আপনি একমাত্র প্রথম যে আমার হৃদয় ছুঁয়েছেন। শরীর কেনো ছুলেন না ডাক্তার সাহেব? আমাদের যদি এক হবারই ছিলো আপনার একমাত্রই কেনো হতে পারলাম না?’
‘ আমার জীবনে যখন প্রেম এলো তখন তুমি শুধু হাফপ্যান্ট পড়ে খেলে বেড়াতে রোজ। ইটস টাইমিং মিসটেক। আমাদের নয়। আমি ভীষন সুখী হবো যদি তুমি এসব আলতু ফালতু বিষয় না ভেবে আমাকে আর আমার মেয়েকে নিয়ে ভাবো আর পড়াশোনাটা কন্টিনিউ করো। ‘
‘ আপনি সিউর মেয়েই হবে?’
‘ কেনো? ছেলে চাইছো? এখন কি তুমি এটা নিয়ে আমার সাথে তর্ক করবে?’
‘ না। দোয়া করবো। আপনি যা চাইবেন তাই হবে। ‘
চলবে___
@লাবিবা তানহা এলিজা
#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো
(৮৭)
তানভীরের কাজের চাপে মাথা ধরেছে। সেজন্য মেডিসিন বক্স থেকে মাথা ব্যাথার একটা পিল নিয়ে খেলো। কি মনে করে আবার বক্সটা খুললো। মারভেলনের পাতা পুরোটাই পরে আছে। একটাও নেওয়া হয়নি। বক্স এর গুলোও অক্ষত। তানভীরের যতদূর মনে পড়ে এইটা সপ্তাহ খানেক আগে নিয়ে এসেছে। একটাও খাওয়া হয়নি। তানভীর ডাকলো লাবিবাকে।
‘ লাব্বু একবার উপরে এসোতো। ‘
লাবিবা আসতেই বক্সটা সামনে এগিয়ে দিলো। তানভীর কে কিছু বলতে হলোনা। তার আগেই ছো মেরে নিয়ে নিলো।
‘ মারভেলনের পাতা খালি কেনো?’
লাবিবা ফাঁকা ঢুক গিললো। স্পষ্ট বুঝলো গলা শুকিয়ে আসছে। এখনি তার পানির দরকার।
‘ উত্তর দিচ্ছো না কেনো? ‘
‘ আগের ছিলো। ‘
‘ আগের থাকবে কেনো? হিসাবটা আমি নাকি তুমি রাখো? ‘
লাবিবা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো। লাবিবার নিশ্চুপতা তানভীরের মাথা গরম করে দিলো। লাবিবাকে শাষিয়ে দিলো।
‘ লিসেন, আমার উপরে যাওয়ার চেষ্টা করোনা। আমার এখন বেবী চাইনা। সব কিছুর একটা সময় আছে। আমি তোমার আব্বুর কাছে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ঠিক আছে? কতদিন পিল নিচ্ছোনা?’
লাবিবা মুখ খুললো না।
‘ আমার সাথে যাবে। রেগুলার চেকআপ করিয়ে আনবো। ‘
‘ কিছু দিন পরে গেলে হয়না?’
তানভীর চোঙ রাঙিয়ে তাকালো। হাত তুলে বললো,
‘ মেরে একেবারে তক্তা বানিয়ে ফেলবো। মনে যেনো থাকে। ‘
লাবিবা মাথা নিচু করেই রইলো।
রোজীর পেট বেশ ফুলেছে। সাথে উন্নতি হয়েছে তার স্বাস্থ্যের। আদরে আদরে তার দিন চলছে। যা খেতে ইচ্ছে করছে তাই হাজির করছে সোহানা। রোজী খায় একটু বমি করে বারবার। সোহানার টেনশনের শেষ নেই। ঠিকমতো না খেতে পারলে বাচ্চা পুষ্টি পাবেনা। ঘন্টায় ঘন্টায় খাওয়ানোর চেষ্টা করে। রোজী এতে বিরক্ত। শ্বাশুড়ির উপর মেজাজ খারাপ হয়। মুখ থেকে একটা রা কাটতে পারেনা তাই যখন তখন কেঁদে ফেলে। সোহানাই আবার আদর করে চুপ করায়। বোঝায় যে না খেলে বাচ্চা হৃদপুষ্ট হবেনা। নাম রোজীর কাজ লাবিবার। অর্ধেকের বেশি খাবার পেটুক লাবিবার পেটেই যায়। সোহানা যখন বকবে বুঝতে পারে তখনি রোজী লাবিবাকে ছোট্ট করে একটা মিসড কল দেয়। পাশাপাশি রুম হওয়াতে বেলকনিও পাশাপাশি। লাবিবা রেলিং পার এসে খেয়ে দেয়ে আবার গিয়ে পড়তে বসে।
ফ্রম ফিলাপ হয়ে গেছে। লাবিবাকে এখন প্রচুর পড়তে হবে। সামনের দরজা দিয়ে এলে নিশ্চিত ধরা পড়বে সোহানার হাতে। রোজী এখনো সোহানাকে ভীষন ভয় করে। খাবারের জন্য হলেও রোজী লাবিবার অতি প্রিয় হয়ে উঠেছে। এইযে তানভীর জোর করে তাকে ভাত খাওয়ায়। ঝোল তরকারি খাওয়ায়। পানি ডাল খাওয়ায়। লাবিবাতো এসব মোটেও পছন্দ করেনা। তার চলবে শুধু ভাজা পোড়া। পেটের সমস্যা হলে ওর স্যালাইন ভরসা। রোজীকে তেমন ভাজাপোড়া দেওয়া হয়না। ফলমূলের উপর চলে। ডেজার্ট আইটেম বেশি। বেশি মিষ্টি খেলে বাচ্চার মাথা ঠান্ডা থাকবে। বুদ্ধি হবে। সব থেকে ফেভারিট ডাবের পানি। যা রোজী একদমি খেতে পারে না। সবগুলো লাবিবার পেটে যায়। আচারের বয়াম রোজীর হাতে একবারো শেষ হয়না। শেষ হয় লাবিবার হাতে। বড়ই আর কাঁচা আমের বেশ কয়েক বড় বড় কাঁচের জার ভর্তি করে সাবিনা আচার বানিয়ে পাঠিয়েছে। জলপাইয়ের সিজন এলে জলপাইয়ের আচার বানানো হবে। লাবিবা খায় আর দুঃখী দুঃখী মুখ করে বলে, ‘ আমাদের একসাথে বাবু হলে ভালো হতো। এইযে তুমি খেতে পারছো না আমি খেয়ে নিচ্ছি। অপচয় ও হতো না বেশি টাকা পয়সাও খরচ হতো না। আমার সাহেবটা বুঝলোনা। ‘
‘ বাবু পেটে হলে তুমিও দেখো খেতে পারবেনা। যদি অপচয় কমাতে চাও তাহলে এক কাজ করবে বমিটা স্কিপ করে যাবে।’
‘ ধ্যাত। তা হয় নাকি? আমার কোনো হাত নেই। ‘ রোজীকে দেখে লাবিবার বেশ ভালো লাগে। দিনকে দিন রোজীর গাল ফুলছে। ভেতরকার লাবণ্য বেরিয়ে আসছে। সবার চোখের মনি হয়ে উঠছে। এসব দেখে লাবিবার চোখে লাড্ডু ফুটছে। বুকে হতাশার সৃষ্টি হচ্ছে। রোজীর ফোলা পেটে হাত রেখে নিজেও সপ্ন দেখে তার ও বেবী হবে। লাবিবা জিজ্ঞেস করে, ‘ আপু ফিলিং কেমন?’
রোজী মুচকি হাসে। ‘ বেস্ট পিরিয়ড অফ মাই লাইফ। ‘
‘ আমারো চাই। ‘
‘ নিয়ে নাও। ‘
‘ উনি রাজি হন না। ‘
‘ ইনশাআল্লাহ একদিন হবে। ‘
‘ হুম। ‘
রোজী বমি করার পর যখন দুর্বল হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে পড়ে লাবিবা দুঃখ পায়।
‘ আপু তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে?’
রোজী মুক্ত হাসি হাসে। মাথা নাড়ায়।
‘ সুখ হচ্ছে গাধী। যখন বাবুর কথা ভাবী তখন এসব কষ্ট কিছুই না। সব দুধ ভাত। ‘
‘ তোমার ছেলেটা আমাকে দিও। ‘
‘ কি করবি? ‘
‘ জামাই বানাবো। ‘
‘ কি বলিস? তোর ভাইতো বলেই দিয়েছে মেয়ে হবে।তখন কি করবি? ‘
‘ ছেলের বউ বানাবো। ‘
‘ শখ থাকা ভালো। ‘
‘ এ্যা! পাত্তা দিলেনা? আমি সিরিয়াস তো। ‘
লাবিবা চলে গেলে রোজী একা একাই হাসলো। রোজী লাবিবার সম্পর্ক এখন তুই এ নেমে এসেছে। এমন ভাবে মিশে থাকে কেউ দেখলে বলবে দুই বোন। এদের ছুটাছুটিই সর্বদা সারা বাড়িতে চলে। খান বাড়িতে কান পাতলে এই দুই রাণীর গলা পাওয়া যায়। সুখের এক সমুদ্রে পরিনত করেছে এই বাড়িকে।
তানভীর লাবিবাকে ছাড়লো না। ঠিক ই চেকাপ করিয়ে আনলো। ডক্টর তানভীরকে প্রটেকশন নেবার পরামর্শ দিলো। তানভীর তাতে রাজি নয়। নজর রাখলো লাবিবার উপর। পিল সে এখন নিজের হাতে খাওয়ায়। এদিকে রোজীকে দেখে লাবিবার ইচ্ছা দমিয়ে রাখা গেলোনা। সে সুযোগ খুঁজতে লাগলো। কিন্তু কিছুতেই কিছু করে উঠতে পারলো না। মন খারাপ করে রোজীর কাছে মাঝে মধ্যে বলে, ‘ আমি দোয়া করি তোমার একটা ছেলে হোক। চার পাঁচ বছর পর যখন আমার বেবী হবে একটা মেয়ে বেবী নিবো। ‘
রোজী অসহায় মুখ করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
‘ আচ্ছা। ‘
‘ নেক্সট জেনারেশন যে কি হবে আপু বলা যায়না। নিজের হাতে গড়ে যদি বাচ্চাদের লাইফ সেটেল করতে পারি তাহলেই শান্তি। ‘
সোহানা শুনতে পায়। হাসতে হাসতে বলে, ‘ কোথায় আকাশ আর কোথায় মাটি। তোমার না পরিক্ষা? বই রেখে এখানে এসে গল্প করছো? যাও গিয়ে পড়তে বসো।’
‘ বসে থাকতে থাকতে আমার কোমড়টা ভেঙেই গেলো।’
‘ তানভীরকে কল করবো?’
লাবিবা ঝটপট উঠে গেলো। আর একদন্ড বসলো না। শুনলেই শুরু করবে ধমকানো। আব্বু কখনো ধমকাই নি। বলেও নি পড়তে বসো। লাবিবা সেচ্ছায় পড়তে বসেছে। কিন্তু এখন যে কি হয়েছে! পড়তেই মন চায় না। লাবিবা বই নিয়ে উবু হয়ে শুয়ে পড়লো। বইয়ের পাতায় নিচের দিকে খালি রয়েছে। লাবিবা সেখানে কলম চালালো। গোঁজামিল দিয়ে একটা মানুষের আকৃতি আকঁলো। পুরুষ মানুষ। চওড়া তার দেহ। মাথায় একঝাঁক চুল। গালে চাপ দাড়ি। কালো প্যান্ট সাদা শার্ট। পেটের মাঝখানে লেখা #খান_সাহেব। পায়ের ঠিক নিচে লেখা, আর্ট বাই #রাণী_সাহেবা। ঘন্টা লাগিয়ে এই ছবিটার দিকেই তাকিয়ে রইলো। সময়ের খেয়াল হতেই উঠে বসলো। ডেস্কে বসলো ম্যাথ করতে। আজ একটা অধ্যায় শেষ করবে। দৈনিক একটা করে অধ্যায় শেষ করলে ঠিক এগিয়ে যাবে। লাবিবা রুটিন দেখলো। এক্সামের আর একমাস এগারো দিন আছে। মনে হচ্ছে অনেক দিন। কবে এই এক্সাম নামক প্যারা শেষ হবে কবে সে তানভীরকে বলবে হানিমুন ট্রিপের ব্যবস্থা করতে। তানভীরকে নিয়ে দূর দেশে ভেসে তার ভীষন মন টানছে। লাবিবা প্যাট থেকে পাতা ছিড়ে নিলো। তানভীরকে পত্র লিখতে বসলো। সেটা সম্পূর্ণ মনগড়া রুলস ফলো করে।
তপ্ত দুপুর
বেলা দুইটা পাঁচ মিনিট
আমার ভালোবাসা। আমার প্রেম,
আমি ভালো নেই। যতক্ষন আপনি কাছে থাকেন ততোক্ষন আমি ভালো থাকি। আমার মনের হৃদাকাশে লাভ বার্ডের ঝাঁক উড়ে যায়। আমি মুগ্ধ হই। কলিজা ঠান্ডা করা শরাবের বিকল্প হয়ে আসেন আপনি। আমি তেষ্টা ভুলে যাই। মাঝ নদীতে পালতোলা নৌকা আপনি। আমি দিক বেদিক ভেসে যাই।
এতোটুকু লিখে লাবিবা থামলো। আর কি লিখবে খোঁজে পেলো না। আবেগ দিয়ে লেখার মতো লেখিকার স্থানে সে নিজেকে বসাতে পারলো না । পা নাচাতে নাচাতে একটা কাজ করে বসলো। পুরো প্যাটে জুড়ে লিখলো,
‘ লাভ য়্যু খান সাহেব ‘
‘ মিস য়্যু খান সাহেব। ‘
একটা প্যাট ছেড়ে আরেকটা ধরলো। একটু কালি ছিলো কলমে। শেষ হয়ে গেলো। আরেকটা কলম নিতে যাবে দেখলো সব সাইন প্যান। এখন লিখবে কিভাবে? খুঁজতে লাগলো। কলমদানিতে নেই। বসে পড়তেই প্যাটের উপর কলম পেলো। কিন্তু এই কলম তো একটু আগে ছিলো না। পেছনে কেউ আছে খেয়াল হতেই চট করে পিছু তাকালো। বিশাল দেহী ব্যক্তিগত পুরুষটির গলা পাওয়া গেলো।
‘ পড়তে বসে তাহলে এসবই করা হয়। ‘
লাবিবা ধরা পড়ে অমাইকভাবে ভুবন ভুলানো একটা হাসি দিলো। হাসির পৃষ্টে তানভীর আর কিছু বললোনা। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়েই ওয়াশরুমে চলে গেলো। লাবিবা বুকে হাত রেখে বড়শ্বাস ফেললো। ঝটপট চিঠি আর প্যাট বিনে ফেলে এলো। তানভীর ফ্রেস হয়ে এসে বললো, ‘ ডাইনিং এ যাচ্ছি না। খাবার নিয়ে এসো। ‘
লাবিবা প্লেটে খাবার তুলে নিয়ে এলো। ভাত মাখিয়ে তানভীরের মুখের সামনে ধরল। তানভীর লাবিবার বই খুলতে খুলতেই মুখে পুড়ে নিলো।
‘ সন্ধ্যা নাগাদ আছি। কোথায় কোথায় প্রব্লেম আছে বলো সব বুঝিয়ে দিচ্ছি। ‘
‘ আপনি কি পারবেন?’
‘ বউয়ের জন্য সবই পারতে হয়। ‘
‘ আপনি কিভাবে পারবেন?’
‘ সাইন্সের ম্যাথের সাথে সিমিলারিটিস আছে।’
বইয়ের কোনা ভাঁজ করে রাখা। লাবিবা এভাবেই চিহ্ন করে রাখে। তানভীর অধ্যায়টা দেখতে লাগলো। খেতে খেতেই পুরোটা অধ্যায় এর টপিক গুলো দেখে নিলো। লাস্টের পেইজে লাবিবার আকানো খান সাহেব কে দেখে বিষম খেলো। নাকে ভাত চলে এলো। লাবিবা পানি এগিয়ে দিলো। মাথা চাপড়াতে লাগলো।
‘ বাট্টি বাট্টি বাট্টি। ‘
কাশি থামিয়ে তানভীর চোখ গরম করে তাকালো। লাবিবা জোর পূর্বক হাসলো। বইটা ঝটপট হাত থেকে নিয়ে রেখে দিলো।
‘ বি সিরিয়াস। ফাস্ট ক্লাস না আসলে ধরে বেঁধে গ্ৰামে রেখে আসবো। কান্নাকাটি করে সেন্স হারালেও সেখানে আমার পা পড়বে না। ‘
‘ এমন করেন কেনো? আপনি আমাকে একটুও ভালোবাসেন না। ‘
‘ লাস্ট ইয়ার রেজাল্ট খারাপ করেছো কিচ্ছু বলিনি। এবার আমি মানবোনা। ‘
‘ আপনার জন্য ই তো। ‘
‘ আমার আসলে তোমাকে বিয়েটা করাই উচিত হয়নি। যার যার সাথে তোমার আব্বু বিয়ে দিতে চাইতো তাদের কে লাঠি পেটা করে তাড়ালেই ভালো হতো। আরো তিন চার বছর ব্যাচেলর থাকতাম। তারপর একদিন রাস্তা থেকে তুলে এনে তোমাকে বিয়ে করে ফেলতাম। ‘
লাবিবা এটো হাতেই তানভীরের উপর ঝাপিয়ে পড়ল। পিঠের উপর আঙুল গুলো সোজা রেখে চাপ দিলো।
‘ তবুও আমাকে ছাড়া অন্যকাউকে বিয়েই করতেন না।হায় আল্লাহ! এতো ভালোবাসা আমি কোথায় রাখবো নিজেও জানি না। ‘
তানভীর হাত দুটো ধরে সামনে আনলো। মেজাজ তার এখন তুঙ্গে চলে গেছে। আকাশী শার্টের উপর যে পাঁচ আঙুলের হাতের ট্যাটু হয়ে গেছে এটা ভালো ভাবেই বুঝতে পারছে। লাবিবার হাতে এখনো মাংসের ঝোল চ্যাটচ্যাট করছে। এক্ষুনি শার্ট খুলতে হবে। তানভীর উঠতে গেলে লাবিবা পেছন থেকে কলার টেনে ধরলো। কানের কাছে মুখ নিয়ে এলো।
‘ খান সাহেব দেশের মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীকে ধরে এই এক্সামের প্যারা উঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করুন তো। পড়াশোনাটা না থাকলেই ভালো হতো। চারবছরে বছরে দুটো দুটো করে আটটা বাবু নিতাম। দুটো আব্বু আম্মুকে দিতাম। দুটো পাপা মামুনি কে দিতাম। দুটো ভাইয়া আপুকে দিতাম। আর দুটো আমাদের কাছে রাখতাম।কেউই অসন্তুষ্ট থাকতো না। বাবু নিয়ে টানাটানি ও হতো না। ব্যপারটা জোস হতো না?’
‘ চারবছরে আটজন?’
‘ হে প্রত্যেকবার টুইন হবে। ‘
‘ কিভাবে সিউর হলে?’
‘ সবই বাবা প্রোডাকশন হাউজের দয়া। বড় বড় সিডর আইলা গুলো যখন আসে লোড গুলো তো আমাকেই সামলাতে হয় তাইনা?’
তানভীরের মাথার রগ ছিড়ে যাচ্ছে যাচ্ছে। এক্ষুনি মনে হয় ব্রাস্ট হবে। এই মেয়ে আবারো নিশ্চিত কলেজে তার মান সম্মান ঢুবাবে। হিটলার শ্বশুর তারপর মাথার উপর উঠে ডাংগুডি খেলবে।
চলবে___
@লাবিবা তানহা এলিজা